বাইরে রাত নামছে। আলমারির ভেতরে কি আর আরাম করে বসা যায়? বেকায়দা অবস্থায়ই রয়েছে মুসা। এভাবে বেশিক্ষণ থাকলে হাত-পায়ে খিল ধরে যাবে, নিদেনপক্ষে ঝিঁঝি যে ধরবে, তাতে তার কোনো সন্দেহ নেই।
এক ঘন্টা পেরোলো।
কিছুই ঘটলো না। আলমারিতে বসে থাকতে খুব খারাপ লাগছে মুসার। বদ্ধ ঘর, গরম হয়ে উঠছে। আলমারির ভেতরে গুমোট আরও বেশি। বাইরের খোলা বাতাসে কিশোর আর গালিভার বেশ আরামে রয়েছে ভেবে কষ্ট যেন বেড়ে গেল। তার। অবশ হয়ে আসছে পা।
খিদে পেলো তার। সঙ্গে করে স্যাণ্ডউইচ নিয়ে এসেছে। বের করে খেতে শুরু করলো।
পেরোলো আরও এক ঘন্টা।
.
ঝোপের ভেতর আলোআঁধারি সৃষ্টি করেছে উজ্জ্বল জ্যোৎস্না। ঘাপটি বসে দরজার দিকে তাকিয়ে রয়েছে কিশোর আর গালিভার।
দশটা বাজলো। ইতিমধ্যে কাউকে দেখা গেল না। নীরব স্টুডিও।
অস্বাভাবিক কিছু ঘটছে না। খাঁচার ভেতরে চিতাবাঘটার পদচারণা, মাঝে মাঝে চাপা গোঙানি। পোকামাকড়ের ডাক আর নিশাচর ছোট ঘোট জীবের আনাগোনা ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই।
একভাবে বসে থেকে পা ব্যথা হয়ে গেছে। এক পা থেকে আরেক পায়ে শরীরের ভার বদল করলো কিশোর।
কিছুই ঘটছে না।
ঘুম তাড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে মুসা। এই বেকায়দা অবস্থা আর অসহ্য গরমেও চোখের পাতা ভারি হয়ে আসছে তার। কেমন যেন শূন্য লাগছে মাথার ভেতরটা। এমন তো হয় না। এতে খারাপ লাগছে কেন?
কিছুতেই খুলে রাখতে পারছে না চোখের পাতা। দুবার ঢলে পড়লো তন্দ্রায়। তৃতীয়বার দীর্ঘ তন্দ্রা থেকে চমকে জেগে উঠে মাথা ঝাড়া দিলো। হঠাৎ বুঝতে পারলো, এরকম লাগার কারণটা।
বাম্প!
আলমারি ভরা রঙ, রঙ গোলানোর তেল আর অন্যান্য রাসায়নিক দ্রব্য। ভ্যাপসা গরমে ওগুলো থেকে বাষ্প বেরোচ্ছে, বিষাক্ত করে তুলছে আলমারির বাতাস। আর সেই বাতাস ফুসফুঁসে ঢোকাতেই এই অস্বাভাবিক তন্দ্রা।
ভাবতে ভাবতেই আবার ঘুমিয়ে পড়লো মুসা। কতোক্ষণ পরে জানে না, চোখ মেললো। ঘোলাটে হয়ে আছে মাথার ভেতর, ফলে দৃষ্টি অস্বচ্ছ।
ঘরের ভেতরে ঢুকেছে কিছু একটা! স্কাইলাইট দিয়ে চাঁদের আলো আসছে, সেই আলোয় দেখা যাচ্ছে বটে ওটাকে, কিন্তু স্পষ্ট নয়।
মাথা ঝাড়া দিলো মুসা। সে-কি জেগে আছে? নাকি এখনও ঘুমিয়ে? আশ্চর্য এক ধরনের অনুভূতি! ঘন তরলের মাঝে সাঁতার কাটছে যেন তার মন। কিছুতেই পরিষ্কার হচ্ছে না। এই
স্টুডিওর ভেতরে নড়ছে কিছু। চাঁদের আলোয় হালকা একটা কি যেন, ভেসে বেড়াচ্ছে! কাঁপা কাঁপা একটা মূর্তি নিচু হয়ে যেন তুলে নিলো একটা ছবি, ভাসতে ভাসতে এগিয়ে গেল জানালার কাছে, পলকে বাতাসে মিলিয়ে গেল যেন ছবিটা!
ভূতুড়ে মুর্তিটা দাঁড়িয়েই রয়েছে জানালার কাছে। নড়ে না আর। যুগ যুগ বুঝি পেরিয়ে যাচ্ছে। কিছু একটা করা দরকার। কিন্তু পুরোপুরি সজাগই হতে পারছে না মুসা, ভয়াবহ এক দুঃস্বপ্ন, একটা ঘোরের মধ্যে রয়েছে যেন।
আবার ছবিগুলোর কাছে ফিরে এলো মূর্তিটা। নিচু হয়ে তুলে নিলো আরেকটা ছবি। আবার গেল জানালার কাছে। গায়ের হয়ে গেল ছবিটা।
দাঁড়ানোর চেষ্টা করলো মুসা। পা নড়তে চাইছে না।
তার দিকে ভেসে আসছে মূর্তিটা।
গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে উঠতে চাইলো মুসা।
.
চাপা চিৎকার শুনতে পেলো কিশোর আর গালিভার। স্টুডিওর ভেতর থেকে এসেছে।
লাফ দিয়ে উঠে দরজার দিকে দৌড় দিলো দুজনে।
তাড়াতাড়ি তালা খুললেন গালিভার।
বাইরের আলোর তুলনায় ঘরের ভেতরে অন্ধকার। দরজার পাশেই সুইচ, বোর্ড। আলো জ্বেলে দিলো কিশোর।
শুন্য ঘর।
আলমারির কাছে ছুটে গেল দুজনে। মেঝেতে বসে রয়েছে মুসা। মাথা ঝুলে পড়েছে বুকের ওপর। সাড়া পেয়ে অনেক কষ্টে সোজা করলো। চোখে উদভ্রান্ত দৃষ্টি।
সর্বনাশ! সলভেন্ট আর থিনারের বাম্প! চেঁচিয়ে উঠলেন আর্টিস্ট। ধরো। ধরো, বের করো ওকে।
টেনে আলমারি থেকে বের করা হলো মুসাকে। দাঁড়াতে পারছে না। অসাড় হয়ে গেছে পা।
বগলের নিচে ধরে জোর করে তাকে দাঁড় করালো দুজনে মিলে। হাঁটানোর চেষ্টা করলো। ধীরে ধীরে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক হয়ে এলো, দাঁড়াতে পারলো মুসা। জোরে নিঃশ্বাস ফেললো।
কি হয়েছিলো? জিজ্ঞেস করলো কিশোর।
ভালোই ছিলাম, ক্লান্ত কণ্ঠে বললো মুসা, কখন জানি ঘুম এসে গেল! চোখ খুলে রাখতে পারলাম না কিছুতেই। তার ঘোরেই দেখলাম ভূতটাকে…
আরি! চেঁচিয়ে উঠলো কিশোর। জানালার দিকে চেয়ে আছে।
একদিকের জানালার নিচে পড়ে রয়েছে ডেনবারের একটা ছবি। জানালার পাল্লা খোলা!
বললাম না, ভূত! কেঁপে উঠলো মুসা। দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। ধপ করে, বসে পড়লো কম্বলে ঢাকা বেঞ্চটার ওপর। ধীরে ধীরে জানালো, কি করে ছবি সরিয়েছে ভূতটা।
নিশ্চয় কেউ ঢুকেছিলো, বললো কিশোর।
আমিও তো তা-ই বলছি ভূত!
আরে দূর! হাত নাড়লো কিশোর। তুমি তো ছিলে আধাবেহুশ হয়ে। মানুষটাকেই ভূত ভেবেছে।
তাহলে মানুষটা কোথায়? দাড়ি নাচালেন গালিভার। ঢুকলো কিভাবে? ওই জানালা দিয়ে কেউ ঢুকতে পারবে না।
অন্য কোনো পথ দিয়ে ঢুকেছে। হঠাৎ চকচক করে উঠলো চোখ। ওই যে, ওই দেখুন!
তাকালো মুসা আর গালিভার। একজস্ট ফ্যানটা যেখানে ছিলো, সেখানেই এখন একটা চৌকোণা ফোকর। ফ্যানটা নেই। টানটান হয়ে রয়েছে তার, প্লগটা : সকেটেই ঢোকানো।
এগিয়ে গিয়ে তার ধরে আস্তে টানলো কিশোর। বাইরের দেয়ালে ঘষা লেগে মৃদু শব্দ হলো। ফ্যানের স্কু ঢিল করে রাখা হয়েছিলো, মিস্টার গালিভার। বাইরে থেকে সহজেই খুলে ফেলেছে ভূতটা। ফোকরের ভেতর দিয়ে টেনে নিয়ে গিয়ে ঝুলিয়ে রেখেছে কর্ডে।
কিন্তু কিশোর, প্রতিবাদ করলো মুসা, গর্তটা দেখছো না কতো ছোট? বড়; জোর একফুট বাই, একফুট। ওখান দিয়ে মানুষ ঢুকতে পারবে না।
পারবে, যদি তোমার মতো শরীর বড় না হয়। এমন কেউ ঢুকেছে, যার শরীর খুব সরু।
হাঁ করে ফোকরটার দিকে চেয়ে আছেন আর্টিস্ট। মাথা নাড়ছেন আস্তে আস্তে, বিহ্বল হয়ে গেছেন যেন।
এখন আরেকটা কথা, তর্জনী নাড়লো কিশোর। মুসা চেঁচিয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে আমরা এসে ঢুকেছি। এতো তাড়াতাড়ি পালাতে পারেনি চোর।
ঘরের চারপাশে চোখ বোলালেন গালিভার। তাহলে গেল কোথায়? এখানে, তো নেই।
কই? জিজ্ঞেস করলো মুসা।
মুসার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো কিশোর।
কি হলো?
জানি, কোথায় আছে, শান্তকণ্ঠে বললো কিশোর।
কোথায়?
ওর ওপরই বসে আছে।
ছিটকে সরে এলো মুসা, যেন বোলতায় হুল ফুটিয়েছে। বড় বড় চোখ করে তাকালো কম্বলে ঢাকা বেঞ্চটার দিকে।
ভারি গলায় ডাকলো কিশোর, এই, বেরিয়ে এসো। আমি জানি, তুমি আছো ওখানে।
এক মুহূর্ত নীরবতা। তারপর নড়ে উঠলো কম্বল। উঁকি দিলো একটা মুখ
চোখ মিটমিট করলেন গালিভার।
শুঁটকি! চেঁচিয়ে উঠলো মুসা।
.
১৭.
ঘরের কোণে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে রয়েছে টেরিয়ার। চেহারা ফ্যাকাশে। মোটা একটা ডাণ্ডা নিয়ে তার কাছে দাঁড়িয়ে আছে মুসা। উঠলেই মারবে বাড়ি।
ওখানে ঢুকেছে, কি করে বুঝলে? জিজ্ঞেস করলেন গালিভার।
কম্বলটা সরানো দেখলাম, জবাব দিলো কিশোর। বিকেলে অন্যরকমভাবে রাখা ছিলো।
টেরিয়ারের দিকে ঘুরলেন গালিভার। শেষ পর্যন্ত চুরি করতে ঢুকেছো?
আমাকে বরখাস্ত করলেন কেন? তেজ দেখিয়ে বললো টেরিয়ার।
তাই বলে চুরি করবে? আর বরখাস্ত কি অন্যায়ভাবে করেছি? আমাকে না। জানিয়ে ছবি নিয়ে গেলে…
ফেরত দিয়েছি আবার। মেরে তো দিইনি।
ওই ছবি তোমার কি দরকার? এতো আগ্রহ কেন?
সেকথা আপনাকে বলতে যাবো কেন?
জানালা দিয়ে পাচার করতে চেয়েছো, বললো কিশোর। কার কাছে? ছবিগুলো নিয়ে সে কি করবে?
আমি কিচ্ছু বলবো না।
লোকটা কি জন ফেরেনটি? ডাণ্ডা নাচালো মুসা।
আড়চোখে ডাণ্ডার দিকে তাকালো টেরিয়ার। নামই শুনিনি।
দেখো ছোকরা, ধৈর্য হারালেন গালিভার।.বেশি বাড়াবাড়ি কোরো না। চুরি করতে ঢুকেছো, হাতেনাতে ধরা পড়েছে। পুলিশকে ফোন…
পু-পুলিশ! আঁতকে উঠলো টেরিয়ার। দোহাই আপনার, ফোন করবেন না। বাবা তাহলে মেরে ফেলবে…
খবরদার! জানালার বাইরে থেকে বলে উঠলো একটা চাপা কণ্ঠ, কেউ নড়বে না। আমার হাতে পিস্তল আছে। টেরিয়ার, জলদি বেরোও।
কণ্ঠস্বরটা চেনা গেল, না, বিকৃত।
নড়লো না কেউ, শুধু টেরিয়ার উঠে দাঁড়ালো। ছুটে বেরিয়ে গেল। ঝনঝন। করে বন্ধ হয়ে গেল লোহার দরজা।
গেল! চেঁচিয়ে উঠলো মুসা। এতো কষ্ট সব বিফল।
যাবে কোথায়? সান্ত্বনা দিলেন গালিভার। দরকার হলে পুলিশকে জানাবো। বাড়ি থেকে গিয়ে ধরে আনবে।
চোর কে, সেটা জানা গেল, বললো কিশোর। আরও বোঝা গেল, কারও সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাজ করছে টেরিয়ার। কিন্তু কার সঙ্গে, কেন, করছে জানি না। ডেনবারের ছবি দিয়ে ওই লোকটা কি করবে?
চুরির উদ্দেশ্য ছিলো না, জানালার নিচের ছবিটা দেখিয়ে বললো মুসা। শুঁটকি দিয়েছে, লোকটা নিয়ে আবার ফিরিয়ে দিয়েছে। সেটা আরেক রহস্য!
ছবিটা তুলে আনলো কিশোর। মাথা নেড়ে বললো, কোনো মেসেজ আছে। কিনা বোঝা যাচ্ছে নাঃ স্যার, দেখুন তো! এই কোণটা ভিজে লাগছে!
ভেজা? ছুঁয়ে দেখলেন গালিভার। তাই তো। রিটাচ করেছে।
কেন করলো? মুসাও ছুঁয়ে দেখলো।
ভিজে কোণটা ডলে দেখলেন গালিভার। নিচে অন্য কোনো ছবি আঁকা রয়েছে কিনা দেখেছে হয়তো। তারপর আবার রঙ দিয়ে রিটাচ করে আগের মতো করে রেখেছে।
ছবিটার দিক থেকে চোখ সরালো না কিশোর। বিড়বিড় করলো, অন্য কোনো ছবি…! ঝট করে মুখ তুললো। স্যার, টেলিফোন কোথায়? এখুনি। দরকার। জরুরী!
.
আধ ঘন্টা পর। বাড়ির সদর দরজায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন গালিভার, কিশোর আর। মুসা। রিকিকে সঙ্গে নিয়ে গাড়িতে করে এলেন প্রফেসর হোফার।
আর্টিস্টের সঙ্গে প্রফেসরের পরিচয় করিয়ে দিলো কিশোর।
কি হয়েছে, কিশোর? জানতে চাইলো রিকি।
চলো, স্টুডিওতে। বলছি।
ডেনবারের ছবিগুলো দেখেই চিনতে পারলেন প্রফেসর আর তাঁর ছেলে।
পেয়ে গেছো? চেঁচিয়ে উঠলো রিকি।
কাউন্টেসকে জানিয়েছো? জিজ্ঞেস করলেন- প্রফেসর। শুনে খুশি হবেন।
এখনও জানাইনি, জবাব দিলো কিশোর। আপনাদের ফোন করেছি, তার কারণ, আমার ধারণা ছবিগুলো খুবই মূল্যবান। অনেকেই চাইবে।
চাইবে? মুসার কণ্ঠে সন্দেহ।
হ্যাঁ। রিকি, অ্যাডোবের। সেই সোনালি ফ্রেমটা…বলেছিলে, একসময় ওটাতে একটা ছবি লাগানো ছিলো।
সোনালি ফ্রেম! প্রফেসর বললেন। কই, ওরকম ফ্রেম লাগানো কোনো ছবি দেখেছি বলে তো মনে পড়ে না? ছেলের দিকে তাকালেন প্রফেসর।
বাবা, রিকি বললো, রিগ ডেনবার যখন প্রথম আমাদের বাড়িতে এলো, একদিন হঠাৎ করেই দেখে ফেললাম। চমকে গেল, বুড়ো। জানালো, ওটা নাকি একটা ইমিটেশন, প্রিন্ট, ফেলে দেবে। তারপর আর একবারও দেখিনি। ফ্রেমটাই। শুধু পড়ে ছিলো অ্যাডোবে।
ছবিটা কেমন ছিলো? জিজ্ঞেস করলো কিশোর।
মাথা চুলকালো রিকি। এই, পাহাড়-পর্বত, ঘোড়া, পাম গাছ, ঘাসের কুঁড়ের সামনে কয়েকজন প্রায় উলঙ্গ মানুষ…পাহাড়ের রঙ বেগুনী, ঘোড়াগুলো নীল, পাম গাছ হলুদ, আর মানুষগুলো লাল
কী! চেঁচিয়ে উঠলেন–গালিভার। চকচক করছে চোখ। সত্যি ওরকম ছিলো?
হ্যাঁ। উল্টোপাল্টা রঙ।
ছবিটা চিনতে পেরেছেন, স্যার? কিশোর বললো।
এক মিনিট! তাড়াতাড়ি গিয়ে তাক থেকে বিরাট একটা বই নামালেন আর্টিস্ট। দ্রুত পাতা উল্টে এক জায়গায় এসে থামলেন। এই যে। রিকি, এরকম ছিলো ছবিটা?
একনজর দেখেই বলে উঠলো রিকি, হ্যাঁ, অবিকল এরকম।
কি জিনিস দেখেছো তুমি জানো না, রিকি! ওটা বিখ্যাত এক ফেঞ্চ আর্টিস্ট ফ্র্যাঙ্কোই ফরচুনার্দ-এর আঁকা। একটা মাস্টার পীস। জার্মানরা দেখতে পারতো না তাঁকে। ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তাঁর আঁকা যতো ছবি পেয়েছে নষ্ট করে দিয়েছে নাৎসী সৈন্যরা। কি বলবো তোমাদেরকে, ছবির জগতে এ-এক অসামান্য। ক্ষতি…, মুখের ভাব দেখে মনে হলো কেঁদে ফেলবেন বুঝি শিল্পী। যা-ই হোক, একটা ছবিও যদি অন্তত পাওয়া যায়..রিকি, কি বলেছিলো ডেনবার? প্রিন্ট? কিন্তু ওই ছবিটার তো কোনো প্রিন্ট হয়েছিলো বলে জানি না!
তাহলে ওটা আসল, বললো কিশোর। কোনোভাবে বুড়ো ডেনবারের হাতে এসে পড়েছিলো?
খাইছে! গালিভারের দিকে তাকালো মুসা। দাম আন্দাজ কতো হতে পারে?
অনেক, অনেক টাকা। এসব জিনিসের দাম কতো উঠবে, আন্দাজ করা মুশকিল। কিশোর, তুমি সত্যি ভাবছো…
ভাবছি না, স্যার। আমি শিওর। প্রলাপ বকার সময় মাস্টার শব্দটা বলেছে। ডেনবার। তারমানে বলতে চেয়েছে মাস্টার পীস। অর্থাৎ ছবিটা আসল। আমার মনে হয়, ওই বিশটা ছবির কোনোটার নিচে লুকানো
কিশোরের কথা শেষ হওয়ার আগেই ঘুরে দাঁড়ালেন গালিভার। সলভেন্ট নরম কাপড় আর আরও কিছু সরঞ্জাম নিয়ে কাজে বসে গেলেন। একটা একটা করে ছবি নিয়ে খুব সাবধানে ঘষে দেখলেন, কোণের দিকটায়। তারপর আবার আগের মত রিটাচ করে রাখলেন।
আধ ঘন্টা পর নিরাশ হয়ে উঠে দাঁড়ালেন। না, নেই। কিশোর, তোমার ভুল হয়েছে। আসল ছবিটা নেই।
ঠোঁট কামড়ালো কিশোর। ভুল আমি করিনি, স্যার। এগুলোর নিচে যখন নেই, নিশ্চয় অন্য কোথাও আছে। আর এই ছবিগুলো তার চাবিকাঠি, আমার তা-ই বিশ্বাস।
এগিয়ে এলেন প্রফেসর। অনেক রাত হয়েছে। ছবিগুলো আমি নিয়ে যাই। কাল কাউন্টেসকে দিয়ে দেবো। আপনার যা খরচ হয়েছে, সেটা আমি দিয়ে দেবো, মিস্টার গালিভার। :
প্রফেসরের গাড়িতে ছবিগুলো তুলে দিতে সাহায্য করলো ছেলেরা।
প্রফেসর আর রিকি চলে গেলে গোয়েন্দাদের বললেন :গালিভার, তোমরা এখানেই থেকে যাও। এতো রাতে আর গিয়ে কাজ নেই। বাড়িতে ফোন করে দাও। এক মুহূর্ত চুপ থেকে বললেন, কাল সকালে দেখবো, শুঁটকির ব্যাপারে কি। করা যায়।
.
১৮.
পরদিন সকালে। হেডকোয়ার্টারে বসে আছে কিশোর আর রবিন।
আমারও মনে হয়, রবিন বললো। আসল ছবিটা পায়নি ডেনবার। আমিও যতোদূর জানি, ফরচুনার্দের সব ছবি নষ্ট করে ফেলেছিলো নাৎসীরা।
কিন্তু আমার দৃঢ় বিশ্বাস, ওই একটা ছবি নষ্ট করতে পারেনি। ডেনবারের হাতে পড়েছিলো। রিকি দেখে ফেলেছিলো। তাকে মিথ্যে বলেছে বুড়ো, বলেছে ওটা প্রিন্ট। তারপর, যখন অসুখে পড়লো, ঘোরের মধ্যেই একটা মেসেজ রেখে যাওয়ার চেষ্টা করলো। জানাতে. চাইলো, ছবিটা কোথায় লুকিয়েছে। কাগজের পাতাটা আবার বের করলো কিশোর। আঁকাবাঁকা বলে দিক নির্দেশ করতে চেয়েছে বুড়ো, বুঝলাম। কিন্তু ভুল মনে হবে বলে কি বোঝাতে চেয়েছে? ভুল : কিছু খুঁজতে বলেছে হয়তো। এমন কিছু দেখে যা মনে হয়, হয়তো আসলে তা নয় ওটা।
ভুলভাবে কিছু করা হয়েছে বলছো?
তা-ই। মাস্টার মানে মাস্টার পীস। আমার ছবি, আমার ক্যানভাস, আর ক্যানভাস থেকে আঁকাবাঁকা, এই কথাগুলো বলে নিশ্চয় বোঝাতে চেয়েছে তাঁর কুড়িটা ছবির মধ্যেই রয়েছে ধাঁধার সূত্র। ওই ছবিগুলোই বলে দেবে কোথায় রয়েছে আসল ছবিটা।
তাহলে সূত্রটা কি?
হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়লো কিশোর। সেটাই তো বুঝতে পারছি না। সব চেয়ে বেশি যেটা চোখে লেগেছে, ছবিগুলোতে কটেজটার আকার। ধীরে ধীরে ছোট করে ফেলা হয়েছে। অথচ আশপাশে আর যা যা রয়েছে, সব কিছুর আকার একই রেখেছে। কেন?
ভাবছে রবিন। কিছু বুঝতে পারছে না।
মুসা আসুক, বললো কিশোর। দেখি, শুঁটকি ওদেরকে কি বলে?
ও-ব্যাটা বলবে?
মিস্টার গালিভার সঙ্গে গেছেন তো। পুলিশের ভয় দেখালে হয়তো বলবে।
আমার মনে হয় না।
সেটা মুসা এলেই জানা যাবে।…আচ্ছা, রবিন, আরেকটা কথা মনে আছে। তোমার? রিকিকে নাকি বলেছিলো ডেনবারঃ আমি দুনিয়ার সব চেয়ে দামী আর্টিস্ট! কিন্তু কেউ সেটা জানে না। তারপর হেসে উঠেছিলো বুড়ো। কেন হাসলো? কি বোঝাতে চেয়েছিলো?
হয়তো মাস্টার পীসটা তার কাছে ছিলো বলে…
ভেবেছি সেকথা। কিন্তু তার কথার ধরনে তো মনে হয়, নিজের ছবিগুলোর কথাই বলেছে সে। ওগুলো অনেক দামী, এবং কেউ সেটা জানে না।
কিশোর, মেসেজটা কার জন্যে রেখে গিয়েছিলো…
ট্রেলারের নিচে শব্দ হলো। দুই সুড়ঙ্গের ঢাকনা উঠে গেল। ভেতরে ঢুকলো। মুসা। দুই বন্ধুর দিকে চেয়ে মাথা নাড়লো। পাওয়া যায়নি। পুঁটকি গায়েব। কাল রাতে বাড়ি ফেরেনি। তার মায়ের ধারণা, শুঁটকিকে কিডন্যাপ করা হয়েছে।
কিডন্যাপ! ভুরু কোঁচকালো রবিন।
কে করেছে? জিজ্ঞেস করলো কিশোর।
শুঁটকির মা জানে না। বললো, তাদের বাড়ির আশপাশে নাকি একটা নীল সেডানকে ঘুরঘুর করতে দেখেছে। আর ওই গাড়ির লোকটার সঙ্গে কথা বলেছে শুঁটকি।
জন ফেরেনটি! বললো কিশোর।
শুঁটকির মা আরও বললো, ওদের টেলিফোন লাইনও নাকি ট্যাপ করা হয়েছে। সেটা তো আমরাই করতে দেখেছি।
হ্যাঁ, মাথা ঝোঁকালো কিশোর। নিচের ঠোঁটে জোরে জোরে চিমটি কাটলো কয়েকবার। ওর কিডন্যাপ হওয়াটা একটা কথাই প্রমাণ করে, শুঁটকি অনেক কিছু জানে। তাই তাকে ধরে নিয়ে গেছে। কাউকে যাতে কিছু বলতে না পারে।
মেরে না ফেলে! বললো রবিন।
ফেলতেও পারে! ওর জন্যে আমাদের কিছু করার নেই। সেটা পুলিশ দেখবে। চলো এখন, রেমুডা ক্যানিয়নে যাবো।
.
১৯.
সাইকেল চালাতে চালাতে জানালো মুসা, শুঁটকিকে বাড়িতে না পেয়ে থানায় গেছেন মিস্টার গালিভার। রাতে তার স্টুডিওতে যেসব ঘটনা ঘটেছে, জানানোর জন্যে। শুঁটকির বাবাও নাকি গেছে পুলিশের কাছে, ছেলে নিখোঁজ হয়েছে সেকথা জানাতে।
ক্যানিয়নে পৌঁছলো তিন গোয়েন্দা।
কটেজের চতুরে দাঁড়িয়ে ছিলো রিকি, ওদেরকে দেখে দৌড়ে এলো। উত্তেজিত। বললো, জানো, আজ সকালেও কে জানি এসে কটেজে ঢুকেছিলো! তছনছ করে দিয়ে গেছে।
ছবিগুলো কটেজে রেখেছিলে? জিজ্ঞেস করলো কিশোর।
না, আমাদের ঘরে। সকালে কাউন্টেসকে ফোন করার চেষ্টা করেছে বাবা, পায়নি। তারা নাকি বাইরে গেছে। শেষে, বাবা গাড়ি নিয়ে নিজেই গেছে। মোটেলে বসে থাকবে। কাউন্টেস ফিরলেই তাকে ধরবে, জানাবে ছবিগুলোর কথা।
সকালে কাউকে দেখেছো এখানে?
হ্যাঁ। গ্যারেজের কাছে। পলকের জন্যে দেখেছি, চিনতে পারিনি। ছুটে চলে গেল নালার দিকে। তারপরই গিয়ে দেখলাম কটেজের ওই অবস্থা।
গ্যারেজের আশপাশে দেখেছো? মুসা জিজ্ঞেস করলো।
না।
চলো, দেখি গিয়ে, বললো রবিন।
অনেক খুঁজলো ওরা, কিছু পেলো না। কিছুটা নিরাশ হয়েই এসে দাঁড়ালো। গ্যারেজের সামনে।
কোনো চিহ্ন রেখে যায়নি ব্যাটা, হাত নাড়লো রবিন।
না, বললো কিশোর। এমনকি পায়ের ছাপও না। চলো, কটেজে। দেখি…
মৃদু একটা শব্দ শোনা গেল। একে অন্যের দিকে তাকালো ওরা। সকালের রোদ এসে পড়েছে চোখেমুখে। অদ্ভুত শব্দ! গোঙানির মতো। যেন গলা টিপে ধরা হয়েছে।
কী?… বললো রিকি।
শ শ শ! তাকে থামিয়ে দিলো কিশোর।
আবার হলো শব্দটা। কাছেই কোথাও।
কান খাড়া করলো মুসা। অন্য তিনজনের চেয়ে তার শ্রবণশক্তি জোরালো। গ্যারেজের ভেতরে! বলেই দৌড় দিলো, দরজার দিকে। কিন্তু দরজা বন্ধ। তালা। লাগানো।
চেঁচিয়ে বললো রিকি, এসো, আরেকটা দরজা আছে পাশে।
এই দরজাটাতেও ভারি তালা আটকানো।
এটাও তো বন্ধ! জিজ্ঞেস করলো রবিন, চাবি আছে?
আছে… বলতে বলতেই দরজার পাশের একটা খোপ থেকে চাবি বের করলো রিকি। তালাটা খুললো।
হুড়মুড় করে ভেতরে ঢুকলো চারজনে। প্রথমে কিছু চোখে পড়লো না, দরজার কাছে ফেলে রাখা কয়েকটা যন্ত্রপাতি আর কাঠ ছাড়া।
কোণের কাছে নড়ে উঠলো কি যেন। গোঁ গোঁ করলো।
ছুটে গেল ওরা।
শুঁটকি! চমকে উঠলো রবিন।
হাত-পা বেঁধে ফেলে রাখা হয়েছে। মুখে রুমাল গোঁজা। গোঙানো ছাড়া আর কোনো শব্দ করতে পারছে না। বাঁধন খুলে দিতে উঠে বসলো টেরিয়ার।
কি হয়েছিলো, শুঁটকি? পাশে বসে জিজ্ঞেস করলো মুসা।
কেঁপে উঠলো টেরিয়ার। বাঁধনের জায়গাগুলো ডলছে। তো-তোমরা আমাকে বাঁচালে…! গলা ভীষণ কাঁপছে ওর। সরি! তোমাদেরকে সব সময় শত্রু ভাবি…
তা তো ভাবোই, মুসা বললো। এখান থেকে বেরিয়েই আবারও ভাবতে শুরু করবে। সরি-ফরি বাদ দাও। কি হয়েছিলো, তা-ই বলো।
সারা রাত ছিলে কোথায়? এখানেই? প্রশ্ন করলো কিশোর।
না, বললো টেরিয়ার। আমাকে নিয়ে এলো। হাত-পা বাঁধলো। ওদিকে একটা নালার কাছে। না দেখে নালার পাড়ে গিয়েছিলাম। নেমে এসে আমাকে বাঁধলো সে। খুব একচোট হেসে বললো, সবাই নাকি একবার করে পড়েছে ওই নালায়। আমার দুঃখ পাওয়ার কিছু নেই।
তা পড়েছে! মাথা দোলালো কিশোর। অকস্মাৎ গম্ভীর হয়ে গেছে।
সারা রাত নালার মধ্যে ফেলে রাখলো, আবার বলে চললো টেরিয়ার। সকালে এনে ঢোকালো এখানে। বাইরে থেকে তালা দিয়ে চলে গেল। কিছুক্ষণ আগে অনেক শব্দ শুনলাম। ভয়ে রা করিনি। ভেবেছি, ও-ই আবার এসেছে। তারপর শুনলাম তোমাদের গলা..তখন চিৎকার করার চেষ্টা করলাম…
খুব ভালো করেছো, টিটকারির ভঙ্গিতে বললো মুসা। কেন, দোস্তের সঙ্গে তো খুব ভাব হয়ে গিয়েছিলো। ধরে বাধলো কেন…
আহ্, মুসা, এখন ওসব কথা রাখো তো, বাধা দিয়ে বললো কিশোর। তা শুঁটকি, লোকটা…
দড়াম করে বন্ধ হয়ে গেল খোলা দরজাটা। তালা লাগানোর শব্দ হলো। জানালাশূন্য অন্ধকার গ্যারেজে বন্দি হলো এখন পাঁচজন।
চেঁচিয়ে ডাকলো রিকি।
কেউ সাড়া দিলো না।
ছুটে গিয়ে সামনের দরজার ফোকরে চোখ রাখলো কিশোর। কে দরজা বন্ধ করলো, দেখতে চায়। রিকি, রবিন, আর মুসাও ছুটোছুটি করে গিয়ে যে যেখানে পারলো, চোখ রাখলো।
আমি দেখছি! বলে উঠলো রিকি। পাশের দরজাটার ফ্রেমের ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে আছে সে।
দরজাটার পাশে ফাঁকফোকর আরও আছে। ওগুলোতে চোখ রাখলো তিন গোয়েন্দা। সকালের রোদে স্পষ্ট দেখা গেল লোকটাকে। বেঁটে, ভারি শরীর। এদিকেই ভুরু কুঁচকে চেয়ে রয়েছে ওলন্দাজ আর্ট ডিলার, জন ফেরেনটি।
মিস্টার ফেরেটি, চেঁচিয়ে বললো রিকি। আমাদের ছেড়ে দিন!
আমরা জানি, আপনি কি খুঁজছেন! বললো রবিন।
গ্যারেজের দিকে চেয়ে থেকে ভুরু আরও বেশি কুঁচকে গেল লোকটার। থাকো, ওখানেই! আমি… ঝট করে ঘুরলো ফেরেনটি। খোঁড়াতে খোঁড়াতে চলে গেল গ্যারেজের পেছনে একটা ঝোপের আড়ালে।
পুরো এক মিনিট আর কিছু ঘটলো না।
তারপর শোনা গেল পায়ের আওয়াজ। এগিয়ে আসতে দেখা গেল আরেকজনকে। ফ্রেড ব্রাউন।
মিস্টার ব্রাউন! গলা ফাটিয়ে চিৎকার করলো মুসা। জন ফেরেনটি, আছে ওখানে! সাবধান!
গ্যারেজের দিকে চেয়ে রইলো এস্টেট ম্যানেজার।
পেছনে! ঝোপের ভেতরে! চেঁচিয়ে বললো রবিন।
ঝোপের দিকে ফিরলো ব্রাউন।
আমাদের আটকে রেখে গেছে, রিকি বললো। তালাটা খুলুন।
দরজার কাছে এগিয়ে এলো ম্যানেজার। জিজ্ঞেস করলো, ফেরেনটি কি একা?
হ্যাঁ, জবাব দিলো মুসা। মিস্টার ব্রাউন, আমাদের সঙ্গে শুঁটকিও আছে।
টেরিয়ার? আই সী। ছেলেটাকে বিশ্বাস কোরো না, বুঝেছো? নানারকম কথা বলবে। পাজি ছেলে।
ঠিক বলেছেন, একমত হলো মুসা।
দরজার তালা পরীক্ষা করলো ব্রাউন। এটা তো বন্ধ।
চাবি আমার কাছে, রিকি বললো। দরজার নিচ দিয়ে ঠেলে দিচ্ছি। খুলে দিন।
কিশোর…! বলতে গেল টেরিয়ার।
চুপ! ধমক দিয়ে তাকে থামিয়ে দিলো কিশোর।
চাবিটা দেয়ার জন্যে নিচু হতে গিয়ে জোরে ধাক্কা খেলো রিকি, কিশোরের। গায়ে। তাল সামলাতে না পেরে পড়ে গেল সে। ঠনন করে ধাতব শব্দ হলো। চেঁচিয়ে উঠলো, হায়, হায়!
কি হলো? জিজ্ঞেস করলো ব্রাউন।
চাবিটা পড়ে গেছে। যা অন্ধকার, কিছু দেখতে পাচ্ছি না।
খোজো! খুঁজে বের করা। তাড়াতাড়ি!
খুঁজতে শুরু করলো রিকি, রবিন আর মুসা। ঘরের কোণে আগের জায়গাতেই বসে রয়েছে টেরিয়ার। রিকির গায়ে ধাক্কা লাগানোর পর থেকে চুপ হয়ে আছে। কিশোর, বিন্দুমাত্র নড়েনি।
চাৰিটা খুঁজছে তিনজনে। পাচ্ছে না, আফসোস করছে।
একটা গাড়ি আসছে, হঠাৎ বললো কিশোর।
দরজার ফোকরে চোখ রাখলো সবাই, টেরিয়ার বাদে। সে বসেই রয়েছে। ঘুরে। গ্যারেজের সামনের দিকে চেয়ে রয়েছে ব্রাউন।
না দেখলেও বুঝতে পারলো ছেলেরা, গাড়িটা গিয়ে থামলো মূল বাড়ির ড্রাইভওয়েতে।
দৌড় দিলো ম্যানেজার। হারিয়ে গেল নালার দিকে।
নিশ্চয় ফেরেনটিকে দেখেছে! বললো রিকি।
হ্যাঁ, হ্যাঁ! চেঁচিয়ে উঠলো মুসা।
ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসছে ফেরেনটি। হাতে পিস্তল। দৌড় দিলো। নালার দিকে, ব্রাউন যেদিকে গেছে।
.
২০.
ফেরেনটিও অদৃশ্য হয়ে গেল। কয়েক সেকেণ্ড পর প্রফেসর হোফার আর কাউন্টেসকে আসতে দেখা গেল কটেজের দিকে।
বাবা! চেঁচিয়ে ডাকলো রিকি।
পাঁই করে ঘুরলেন প্রফেসর। রিকি? কোথায়?
গ্যারেজে, বাবা! আটকে রাখা হয়েছে!
দ্রুত গ্যারেজের দিকে এগিয়ে এলেন দুজনে। সামনের দরজার চাবি প্রফেসরের কাছে, তালা খুলে বের করলেন ছেলেদের। কে তালা দিলো?
জন ফেরেনটি, জানালো মুসা। মিস্টার ব্রাউন বের করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু রিকি চাবিটা হারিয়ে ফেললো। তারপর ম্যানেজারকে তাড়া করলো ফেরেনটি। পিস্তল নিয়ে।।
ব্রাউন এখানে এসেছিলো? অবাক মনে হলো কাউন্টেসকে। ফেরেনটিও?
কেন, আপনি জানেন না? জিজ্ঞেস করলো কিশোর। বলে আসেনি?
ইয়ে…কাল বিকেল থেকেই ম্যানেজারকে পাচ্ছি না। রাতে মোটেলে ছিলো! সেকথাই বললাম তখন প্রফেসর হোফারকে। আমাকে কিছুই বলে যায়নি।
প্রফেসর বললেন, কাল নাকি ফেরেনটির নীল সেডানটা মোটেলের কাছে দেখা গেছে, কাউন্টেস বললেন।
পিস্তল নিয়ে তাড়া করেছে ফেরেনটি, উদ্বিগ্ন গলায় রিকি বললো, আমাদের যাওয়া দরকার। ম্যানেজারকে বাঁচানো দরকার।
কোনো দরকার নেই, সবাইকে অবাক করে দিলো কিশোর। ইচ্ছে করেই তখন ধাক্কা দিয়েছিলাম তোমাকে। চাবিটা হাত থেকে ফেলে দেয়ার জন্যে। টেরিয়ারের দিকে ঘুরলো সে। এখন তুমি নিরাপদ। সব কথা খুলে বলতে পারো। কে কিডন্যাপ করেছিলো? কার হয়ে কাজ করছিলে?
অবশ্যই জন ফেরেনটি, বললো মুসা।
না, ফেরেনটি নয়, মাথা নাড়লো গোয়েন্দাপ্রধান।
তুমি ঠিকই আন্দাজ করেছে, কিশোর। শুকনো ঠোঁট চাটলো টেরিয়ার। ফেরেনটি নয়। ফ্রেড ব্রাউন। সেদিন তোমাদেরকে ছবিটা দেখিয়ে বাড়ি ফিরতেই আমার সঙ্গে দেখা করলো। রাতে গালিভারের স্টুডিও থেকে ছবি বের করে দেয়ার জন্যে আমাকে রাজি করালো।
আমিও তা-ই সন্দেহ করেছি, বললো কিশোর। তখন ব্রাউনকে চাবি দিলে গ্যারেজে ঢুকে আমাদেরকে কি করতো কে জানে! গ্যারেজেই বরং নিরাপদ থেকেছি আমরা।
তুমি শিওর, কিশোর? বললেন কাউন্টেস।
হ্যাঁ। টেরিয়ার তো নিজেই স্বীকার করছে। এরপর আর সন্দেহ কিসের? নিজেই ভেবে দেখুন না আপনি। বিপজ্জনক বলে আমাদেরকে কাজ করতে। মানা করে দিলো। বললো, পুলিশকে জানাবে সব কথা। জানিয়েছে?
না, জানায়নি।
কেন জানালো না? কারণ, কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ বের করে ফেলবে। পুলিশ। আমরাও বের করে ফেলতে পারি, এটা বুঝেই আমাদেরকেও থামিয়ে রাখতে চেয়েছে। বলে চললো কিশোর, সেদিন শুঁটকি গিয়েছিলো-মোটেলে। কটেজে উঁকিঝুঁকি মারছিলো। আমরা ভাবলাম, ভেতরে ঢোকার জন্যে অমন করছে। আসলে তা নয়। গিয়েছিলো ব্রাউনের সঙ্গে দেখা করতে। তাকেই খুঁজছিলো। এখন বুঝতে পারছি।
অনেক দেরিতে বুঝেছে, নিরাপত্তা পেয়ে আবার আগের খোলসে ঢুকেছে টেরিয়ার। খিকখিক করে গা-জ্বালানো হাসি হাসলো। তারমানে যতোটা ভাবো, ততোটা চালাক তোমরা নও।
তার কথায় কান দিলো না কিশোর। আমার বিশ্বাস, ম্যাডাম, সেই মহিলার কাছে যায়ইনি ব্রাউন। ভেনাসের মূর্তি তার দরকারই ছিলো না। প্রয়োজন ছিলো। ছবিগুলোর।
কি জানি, বলতে পারবো না। হয়তো যায়নি। জিজ্ঞেস করিনি আর।
না, যায়নি। আপনার ভাইয়ের শেষ স্মৃতির চেয়ে ছবিগুলোর প্রয়োজন ছিলো তার অনেক বেশি। মিস্টার ডেনবারের প্রলাপের কথা রিকির মুখে শুনেছে ব্রাউন, বুঝে গেছে, ছবিগুলোতেই রয়েছে চাবিকাঠি।
কিসের চাবিকাঠি?
ফ্র্যাঙ্কোই ফরচুনার্দের মাস্টার পীস কোথায় লুকিয়ে রেখেছেন আপনার ভাই।
কিন্তু, কিশোর, প্রফেসর বললেন, ব্রাউন কি করে জানলো, ডেনবারের কাছে একটা মাস্টার পীস আছে? কাউন্টেস তো জানেন না। তিনি জানেন না, অথচ তার। ম্যানেজার জানবে…
অদ্ভুত, তাই না, স্যার? ঠিকই ধরেছেন। মনে হয় কাউন্টেসকে ধোকা দিয়েছে ম্যানেজার। আমি এখন শিওর, ফেরেনটি আমাদেরকে অ্যাডোবে আটকায়নি। কালো পোশাক পরে সেদিন যে লোকটা আপনার বাড়িতে ঢুকেছিলো, সে-ও ফেরেনটি নয়।
কিন্তু ব্রাউন কি করে জানলো, একটা মাস্টার পীস আছে আমার ভাইয়ের কাছে?
শুরু থেকেই জানতো, ম্যাডাম, রহস্যময় কণ্ঠে বললো কিশোর। মিস্টার ডেনবার বলেছিলেনঃ বি-ধ্বলো। শুনলে মনে হবে, জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকার সময় কথা জড়িয়ে গেছে, তোতলামি, আসলে তা নয়। বি-ব্বলো মানে হলো, বি কে বলো, অর্থাৎ ব্রাউনকে বলো। কারণ, ব্রাউন ছিলো তার পার্টনার।
পার্টনার! আঁতকে উঠলেন যেন কাউন্টেস। কিসের পার্টনার? কোনো। অপরাধের?
হ্যাঁ। ছবির ব্যাপারেই কোনো কিছু। কী, এখনও শিওর নই, তবে খারাপ। কিছু। জানতে পারলে পুলিশে ধরবে…
তাহলে এখুনি পুলিশে ফোন করা উচিত, বলে উঠলেন কাউন্টেস। ফ্রেডকে পালাতে দেয়া যাবে না।
আমি যাচ্ছি, বললেন প্রফেসর, পুলিশকে ফোন করতে।
চলুন, আমরাও যাই, কিশোর বললো। দেখি আরেকবার ছবিগুলো, ধাঁধার সমাধান করা যায় কিনা।
<