শেষ বিকেল। আগে আগে চলেছেন প্রফেসর, পেছনে ছেলেরা। উপত্যকার প্রতিটি ফুট পরীক্ষা করে দেখে এসেছে ওরা, ছোট পাহাড়টারও অর্ধেকটা। সম্ভাব্য সমস্ত দিক থেকে খুঁটিয়ে দেখা হয়েছে পুকুরটাকে, ফ্যান্টম লেক। উত্তেজিত প্রফেসরের সঙ্গে প্রায় দৌড়ে দৌড়ে তিনবার চক্কর দিয়েছে ওরা পুরো বাড়িটা। পরিশ্রম অনেক করেছে, কিন্তু পায়নি কিছুই।
বিশাল বাড়িটার চত্বরে এখন পড়ন্ত রোদ। সেখানে এসে জমায়েত হল সবাই। হেসে ওদের সান্ত্বনা দিলেন মিসেস ডাই। বাঁকা হাসল ডিনো, দাঁতের ফাঁকে পাইপ, ফকফক ধোঁয়া ছাড়ছে।
কিছুই পেলাম না, ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেললেন প্রফেসর। বাড়িটা ছাড়া বড় কিছু বানায়নি বাওরাড ডাই। আর এখানে খোঁজা হয়েছে প্রায় একশো বছর ধরে। মাথা নাড়লেন তিনি। স্কুস টিম্বারের চিহ্নও দেখলাম না।
হেসে উঠল ডিনো, খুব মজা পাচ্ছে যেন। বলেছিলাম না, বেকুব। তখন তো রেগে গেলেন। টিম্বার দিয়ে বুড়ো কিছু বানিয়ে থাকলেও নেই এতদিন, নষ্ট হয়ে গেছে কবেই। আর গুপ্তধন? ঘোড়ার ডিম আছে।
আছে। এবং বেরও করব আমরা! রেগে গেল শান্ত রবিন। সে-ও লোকটাকে সত্ম করতে পারছে না।
নিশ্চয়ই করবে, প্রেরণা জোগালেন মিসেস ডাই। তিরস্কারের ভঙ্গিতে তাকালেন ডিনোর দিকে। সোনার মোহর কিংবা হীরের গহনা না পেলেই বা কি? এমন কিছু পাওয়া যেতে পারে, যার ঐতিহাসিক মূল্য অপরিসীম।
মা, এড বলল। মনে হচ্ছে গুপ্তধন আছে তুমিও বিশ্বাস কর না?
এসব কথায় কান নেই কিশোরের। বাওরাড ডাইয়ের চিঠিটা আবার পড়ছে। ইস, আর একটু যদি বুঝতে পারতাম। আমি শিওর, চাবি কোথাও আছেই। আসলে, সময় পেরিয়ে গেছে অনেক। হয়ত নষ্ট হয়ে গেছে সূত্র। তারপর যেন নিজেকেই প্রশ্ন করল, আচ্ছা, বাড়িতে কি ভালবাসতেন বাওরাড?
মাথা নাড়লেন মিসেস ডাই। তোমরা যখন পাউডার গালচে, আমিও বসে থাকিনি। নোরিয়ার অনেক চিঠি বের করে পড়েছি। আগেও পড়েছি, আবার পড়লাম। লেখা আছে অনেক কথাই। কিন্তু স্কটল্যান্ডে কি ভালবাসতেন বাওরাড, সে-সম্পর্কে তেমন কিছু নেই। হ্রদের দৃশ্য দারুণ ভালবাসতেন, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে শুধুই একথা।
ওটা এমন কোন ব্যাপার না, হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন প্রফেসর।
জটিল সমস্যা, আনমনে বলল কিশোর।
শঙ্কিত হল এড। খোঁজা বাদ দেবে না তো, কিশোর?
বাদ? মুচকি হাসল মুসা। কিশোর পাশাকে তুমি চেন না, এডবার ডাই। তদন্ত তো সবে শুরু করেছে ও।
বাদ দিলেও তোমাদের দোষ দেব না আমি, বললেন মিসেস ডাই।
বাদ দেয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না, মুখ খুলল কিশোর। প্রথম ধাপে রয়েছি আমরা, বাওরাড এখনও বলেননি কোথায় খুঁজতে হবে। জার্নালটা খুলল সে। ঊনত্রিশ অক্টোবরের পরে, যেটাতে কিছু আছে বলে মনে হচ্ছে, সেটা নভেম্বর এগার। লিখেছেনঃ সাইপ্রেসের দ্বীপে গিয়েছিলাম আজ। নৌকা বোঝাই ছিল। আরেকটু হলেই গিয়েছিল ডুবে, দক্ষিণ-পশ্চিম থেকে আসা ঝড়ে, এমনই ফুসে উঠেছিল সাগর। আমার প্রস্তাবে রাজি হয়েছে দ্বীপের মালিক। দুপুরের দিকে সন্তুষ্ট হয়ে বাড়ি ফিরে এসেছি আমি। নোরিয়ার উপহারের কাজ ভালই এগোচ্ছে। মুখ তুলল গোয়েন্দাপ্রধান। পরের হপ্তায় আর বিশেষ কিছু নেই।
কিশোর, মুসা বলল। লিখেছে, নৌকা বোঝাই ছিল।
হ্যাঁ, মাথা ঝাঁকাল কিশোর। দ্বীপেই হয়ত রয়েছে জবাব। কিন্তু, বলল এড। কোথায় ওটা? এখানে সাইপ্রেসের দ্বীপ আছে বলে তো শুনিনি?
আমিও না, কিশোর বলল। মুসা, তুমি জান?
রকি বীচের আশপাশের সাগর সম্পর্কে ভাল জ্ঞান মুসার। সাগর, সাঁতার, নৌকা বাওয়া খুব পছন্দ করে। হাত বাড়িয়ে জার্নালটা নিল সে। আমার মনে হয় না ওটা আসল নাম। হয়ত কোন নামই নেই, সে-জনেই ওই নাম রেখেছে। চ্যানেল আইল্যাণ্ডস-এর বড় বড় সমস্ত দ্বীপের নাম আছে, এটার নেই যখন, নিশ্চয় খুব ছোট। উপকূলের কাছেই কোথাও হবে। নইলে সকালে গিয়ে দুপুরের আগে ফিরে আসতে পারত না বাওরাড ডাই। ব্যক্তিগত সম্পত্তি তো বললই, আর দ্বীপটায় সাইপ্রেস গাছ আছে। খুঁজে দেখা দরকার।
আমিও যাব, বলে উঠলেন প্রফেসর। ছোট একটা সেইলিং বোট আছে আমার। রকি বীচ থেকে বেশি দূরে না হলে ওটা নিয়েই যাওয়া যায়।
উঠে দাঁড়াল ডিনো। গুজব, ভূত, নাম ছাড়া দ্বীপ, একশো বছর আগে মরে যাওয়া একজন মানুষ…পাগল..সব উন্মাদ হয়ে গেছে। গটমট করে বেরিয়ে গেল স্কটসম্যান।
সেদিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লেন মিসেস ডাই, হাসলেন। প্রফেসরের দিকে চেয়ে বললেন, ওর ব্যবহারে কিছু মনে করবেন না। ও একটু বদমেজাজী। অবাস্তব কথা সইতে পারে না। তবে লোক খারাপ না, ভাল। এডের বাবা মারা যাওয়ার পর কি কষ্টে যে দিন কাটছিল আমাদের, ডিনো আসাতে খানিকটা সহজ হয়েছে। ভীষণ খাটতে পারে। আগে অবশ্য মেজাজ এত খারাপ ছিল না তার। বাইরে থেকে আসার পর এমন হয়েছে।
বাইরে? কথাটা ধরল কিশোর। দৃষ্টি তীক্ষ্ণ। কোথায় গিয়েছিল?
সান্তা বারবারায়। অ্যাভোকাডো বেচতে গিয়েছিল। তিনদিন পর কাল রাতে ফিরেছে।
মেঘ জমল কিশোরের চেহারায়। ও আপনার কেমন আত্মীয়, মিসেস ডাই? মাত্র এক বছর হল এসেছে বললেন না?
স্কটল্যাণ্ড থেকে এসেছে। আমার স্বামীর দূর সম্পর্কের খালাতো ভাই, সেই সম্পর্কে আমারও। বছরখানেক আগে আমাদের এখানে বেড়াতে এসেছিল। এসে দেখে এডের বাবা নেই। সাহায্য করতে চাইল। আমার তখন অবস্থা খারাপ। রাজি হয়ে গেলাম। আমাদের জন্যে ওর খুব মায়া। এত যে খাটে, কাজের জন্যে একটা পয়সা নেয় না। থাকা আর খাওয়া, ব্যস।
উঠে দাঁড়াল কিশোর। রবিন আর মুসাকেও ওঠার ইঙ্গিত করে বলল, দেরি হয়ে গেছে। চলি, ম্যাডাম। বাড়ি যাব।
চল, পৌঁছে দেব, বললেন প্রফেসর। শাখাপথ থেকে বেরিয়ে হাইওয়েতে উঠল স্টেশন ওয়াগন।
প্রফেসর, হঠাৎ কথা বলল কিশোর। একটা ব্যাপার অবাক লাগছে। আচ্ছা বলুন তো, চিঠি আর ডাইদের সম্পর্কে এত কথা জানল কি করে টিক বানাউ?
বলতে পারব না। গুপ্তধনের জোর গুজব রয়েছে, অনেকেই জানে। কিন্তু টিক বানাউয়ের কথা যা শুনলাম, তাকে স্থানীয় লোক মনে হচ্ছে না। কে জানে, লিটল মারমেইডের বেঁচে যাওয়া অন্য কোন নাবিকের বংশধর হতে পারে। ক্যাপ্টেনের কেউ হলেও অবাক হব না।
ঠিক, রবিন বলল। এটাই ব্যাখ্যা।
হতে পারে, ধীরে ধীরে বলল কিশোর।
ডিনারের আধ ঘন্টা আগে স্যালভিজ ইয়ার্ডে ছেলেদের নামিয়ে দিয়ে গেলেন প্রফেসর।
দুই সুড়ঙ্গ দিয়ে হেডকোয়ার্টারে ঢুকল ওরা।
কিশোর, ভাবছি,মুসা বলল। ফ্যান্টম লেকেই কোন খনি রেখে যায়নি তো বাওরাড ডাই? গোপন খনি?
থাকতেও পারে। হাতে কোন প্রমাণ নেই, শিওর হই কি করে? আর স্কটল্যাণ্ডের ভূতের গুজবের সঙ্গে খনির যোগাযোেগ কোথায়? কিংবা আয়নার?
রবিন মনে করিয়ে দিল, মিসেস ডাই বললেন, ভাইকিংরা আসে কিনা সেদিকে নাকি চোখ রাখে ভূত। ওই কথাটাই বোঝাতে চেয়েছে হয়ত বাওরাড। হ্রদের দিকে চেয়ে থাকা ভূত। মানে কি? পুকুরের নিচে লুকিয়ে রাখেনি তো গুপ্তধন?
রাখতে পারে, কিশোর বলল। তবে তার জন্যেও প্রমাণ চাই। নির্ভরযোগ্য সূত্র। কোথায় রেখেছে, জানতে হলে। সারা পুকুরের তলায় তো আর খোঁজা যাবে না। থামল এক মুহূর্ত। ডিনোর কথা মিসেস ডাই কি বললেন মনে আছে?
আছে, বলল মুসা। খুব খাটতে পারে, আর খুব মায়া। কাজের বিনিময়ে একটা পয়সা নেয় না।
তবে কিছুটা বদমেজাজী, যোগ করল রবিন। চমক্কার সব লক্ষণ।
এবং, কিশোর বলল। ফ্যান্টম লেক থেকে তিনদিনের জন্যে বাইরে চলে গিয়েছিল, ফিরেছে কাল রাতে। তারমানে, গতকাল তার রকি বীচে থাকা সম্ভব, যখন টিক আমাদের ওপর হামলা চালিয়েছিল।
টিকের সঙ্গে হাত মিলিয়ে গুপ্তধন খুঁজছে ভাবছ? রবিন বলল। বাওরাডের চিঠির কথা, ফ্যান্টম লেক, মিসেস ডাই কি কি জিনিস বিক্রি করেছেন, সব জানা আছে ডিনোর।
হ্যাঁ, আছে। মুসা, আজ রাতের মধ্যে সাইপ্রেস আইল্যাণ্ডটা কোন দ্বীপ, জানার চেষ্টা করবে। কাল সকালে প্রফেসর কেইনের বোটে মিলিত হব আমরা।
ডিনারের পর চাচা-চাচীকে ঘরের কাজে সাহায্য করল কিশোর। দশটায় বাজল টেলিফোন।
মুসা করেছে। বলল, কিশোর, ওটা আসলে ক্যাবরিলো আইল্যাণ্ড। আঠারশো ছিয়ানব্বই সালে দ্বীপটা ক্যাবরিলো পরিবারের দখলে ছিল। সাইপ্রেস গাছের ছড়াছড়ি। তীর থেকে মাত্র মাইলখানেক দূরে। বন্দর থেকে মাইল দুই উত্তরে।
চমৎকার কাজ দেখিয়েছ, সেকেণ্ড! দুর্লভ প্রশংসা পেল মুসা, কিশোর পাশা সহজে কারও প্রশংসা করে না।
রিসিভার রেখে দোতলায় নিজের ঘরে চলে এল কিশোর। আলো জ্বালার আগে একবার সামনের জানালার কাছে এসে দাঁড়াল। রকি বীচে ক্রিস্টমাস লাইট দেখার জন্যে। অনেক বাড়িতেই জ্বলছে রঙিন আলো।
সরে আসতে যাবে, এই সময় আলোর একটা ঝিলিক চোখে পড়ল তার। তাকাল সেদিকে। আবার দেখা গেল আলো। অবাক হল সে। ওখানে তো কোন বাড়িঘর নেই? হঠাৎ বুঝল, তাদের স্যালভিজ ইয়ার্ডের ভেতরেই। যেখানটায় ওদের হেডকোয়ার্টার লুকানো রয়েছে জঞ্জালের তলায়।
আলোটা আসছে ট্রেলারের স্কাইলাইটের ফোকর দিয়ে!
তাড়াতাড়ি নিচে নামল কিশোর। বাইরে বেরিয়ে নিঃশব্দে এগোল। মেইন গেট বন্ধ। তালা দেয়া। মোড় নিয়ে ওয়ার্কশপের দিকে চলল সে। এখানে আরেকটা গোপন প্রবেশ পথ রয়েছে তিন গোয়েন্দার, সবুজ রঙ করা বেড়ার গায়ে দুটো আলগা বোর্ড।
সাবধানে সবুজ ফটক একের ভেতর দিয়ে ওয়ার্কশপে ঢুকল কিশোর। আলো আর চোখে পড়ছে না এখন। দুই সুড়ঙ্গের কাছেও কেউ নেই। সহজ তিন-এর সামনে থেকে খুব সতর্ক ভাবে কিছু জঞ্জাল সরাল।
পুরানো কাঠের দরজার পাল্লা ভেঙে খোলা হয়েছে। তার ওপাশে হাঁ হয়ে খুলে আছে ট্রেলারের দরজা।
হেডকোয়ার্টারে ঢুকল কিশোর। বাওরাড ডাইয়ের জার্নালটা ডেস্কের ওপরই আছে, তবে বন্ধ নয়, খোলা। তীব্র আলোর ঝিলিকের মানে বুঝে ফেলল। দরজা ভেঙে ঢুকে জার্নালটার ছবি তুলে নিয়ে গেছে কেউ। ফ্লাশগানের আলো দেখেছে সে।
সহজ তিন-এর দরজা আবার ঠিকঠাক করে লাগিয়ে ঘরে ফিরে এল কিশোর। চিন্তিত। এখন আরও একজনের জানা হয়ে গেল, কি লেখা রয়েছে বাওরাডের দ্বিতীয় জার্নালে।
<