শ্যাকের সামনের দিকের এক কোণে চলে গেল সলটার। তার পাশে শেরিফ। কোণ ঘুরে চলে এল ঘোট একটা জানালার কাছে। পর্দা নেই। উঁকি দিল সে। ঝুলে পড়ল চোয়াল যখন দেখল জোহান বসে রয়েছে ফায়ারপ্লেসের পাশে। হাতে সিক্সগান নিয়ে তার পেছনে দাঁড়ানো হাওয়ার্থ। আরেকজন আছে ঘরে। হ্যারিসন। দম আটকে এল সলটারের। আজ সন্ধ্যায় মার্টিনকে খুন করেছে এরা। এখন তৈরি হচ্ছে জোহানকে খুন করার জন্যে। দরজার দিকে এগোল সে। কিন্তু তার হাত আঁকড়ে ধরল শেরিফ।
জোহান, ডাকল হ্যারিসন। আমরা হুকুমের দাস। ম্যাকগ্রর কথা শুনতে হবে। তোমাকে না মেরে উপায় নেই।
মাটিনকে যেমন মারতে হল, হাওয়ার্থ বলল। হাসল নিষ্ঠুরভাবে। বক্স ডব্লিউর বিরুদ্ধে আজ রাতে যুদ্ধ ঘোষণা করছি আমরা। সকালের আগেই মারা পড়বে সলটার শালা। কার্টলিকে মেরেছে।
মারুক। কোন আপত্তি নেই আমার, বলল জোহান। মদে চুর হয়ে রয়েছে সে, বুঝল সলটার। আমি ম্যাকার বন্ধু। আমাকে মারবে কেন তোমরা?
তোমার বাবাকে পঙ্গু করার জন্যে। ম্যাকগ্র একদিন না একদিন বক্স ডব্লিউ হাতাবেই। তোমাকে আর সলটারকে মেরে আপাতত পথের কাঁটা দূর করছে সে। পরে জর্জের ব্যাপারে ব্যবস্থা নেবে।
চুক্তি তো সেরকম ছিল না, বলল জোহান। মনের দুঃখে মাথা নাড়াল সে। ম্যাকগ্রকে সাহায্য করেছি নিজেদের র্যাঞ্চের স্টক চুরি করে। আমার সঙ্গে এমন করাটা ঠিক নয়। না না ম্যাকগ্র অমন করতেই পারে না।
দশ মিনিট হয়ে এল প্রায়, বলল হ্যারিসন। শ্রাগ করল সে। ঝামেলা চুকাবে কে? তুমি না আমি?
আমি, বলল হাওয়ার্থ। মার্টিন খুব সম্ভব তোমার গুলিতে মরেছে। কাজেই তোমার দায়িত্ব শেষ।
অর্ধেকটা শরীর ঘোরাল সলটার। পিস্তলের মাজল দিয়ে খোঁচা দিল শেরিফের কাঁধে। ইশারায় দরজা দেখাল। মাথা ঝাঁকাল শেরিফ। ঘুরল দ্রুত। আবার ঘরের ভেতর দৃষ্টি দিল সলটার। পিস্তল তুলছে হাওয়ার্থ। বদলে যাচ্ছে তার চেহারার ভজ। গুলি করতে প্রস্তুত সে।
না, জোহান বলল। মের না, তোমাদের দুজনকেই একশো ডলার করে দেব আমি।
হিংস্রভাবে হেসে উঠল ওরা। তখুনি পিস্তল তুলল সলটার। মাজলের আঘাতে ভেঙে ফেলল কাঁচ। চাপ দিল ট্রিগারে। প্রচণ্ড বিস্ফোরণ কাঁপিয়ে দিল পুরো বাড়িটাকে। গুলি খেয়ে কয়েক পা পিছিয়ে গেল হাওয়ার্থ। টালমাটাল অবস্থায় ট্রিগার চাপল। গুলি বিধল জোহানের ডান পায়ের কাছে। মেঝেতে।
হ্যারিসন লাফিয়ে চলে এল দরজা বরাবর। পিস্তল এসে গেছে তার হাতে। ওদিকে শেরিফ ঢুকে পড়েছে দরজা দিয়ে। একসঙ্গে গুলি করল ওরা। দড়াম করে পড়ে গেল হ্যারিসন। দুটো গুলি বুক ফুটো করে দিয়েছে তার। নিথর পড়ে রইল সে। শেষ।
বুক ভরে নিশ্বাস নিল সলটার। জানালা থেকে সরে এসে কেবিনে ঢুকল। শেরিফ তখন পরীক্ষা করছে তোক দুটোকে। ফায়ারপ্লেসের পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে জোহান। মুখে লাজুক হাসি। মাতলামি ছুটে গেছে তার।
সলটার, তোমাকে দেখে যে কী খুশি লাগছে।
জোহানের কাছে গিয়ে কষে এক চড় কষাল সলটার। উফ বলে মাথা ঘুরে পড়ে গেল জোহান। সতর্ক চোখে সলটারকে পর্যবেক্ষণ করল শেরিফ। কুঁকল সলটার। টেনে দাড় করাল জোহানকে। ঠেলে নিয়ে চলল দরজার দিকে।
সোজা র্যাঞ্চে ফিরে যাও, কঠিন গলায় বলল সলটার। একটু এদিক ওদিক করলে হাড় গুড়ো করে দেব।
টলতে টলতে বেরিয়ে এল জোহান। অন্ধকারে মিশে গেল সে। দীর্ঘশ্বাস ফেলল শেরিফ। এসে দাঁড়াল সলটারের পাশে।
ও দুটো মরেছে, মন্তব্য করল সে। মার্টিনের আত্মা শান্তি পাবে। জোহান রাসলিং-এর সঙ্গে জড়িত, একথা ভাবতেও অবাক লাগছে। ওর বাবাকে জানাবে না?
আমি জানাব না। যা বলার জোহানই বলবে, বলল সলটার। চল রওনা দিই। স্যাডল ব্ল্যাঙ্কেট ক্রীকে দ্রুত পৌঁছতে হবে। লোকজন নিয়ে র্যাঞ্চ ও অপারেশনে যাব।
অসকার অবাক হয়ে যাবে, যখন শুনবে ওর লোর্কেরা গরু চুরিতে জড়িত।
আজ রাতে অবাক হওয়ার মত আরও ঘটনা ঘটবে, দাঁতের ফাঁকে বলল সেলটার। বেরিয়ে এল বাইরে। প্রচণ্ড দুর্বল লাগছে কিন্তু সেটাকে প্রশ্রয় দিল না সে। অনেক কাজ বাকি রয়েছে এখনও।
ঢিবির ওপর উঠে এল ওরা। কাহিল হয়ে পড়ল সলটার। ঘেমে উঠল। অতি কষ্টে নিজেকে স্যাডলে টেনে তুলল সে। ওর অবস্থা দেখে ওকে সাইড দিল শেরিফ। ঢাল বেয়ে সমতল জমিতে নেমে এল ওরা। ঘোড়া দাবড়াল দ্রুত গতিতে। লক্ষ্য তাদের স্যাডল ব্ল্যাঙ্কেট ক্রীক। ওখানে অপেক্ষা করছে বক্স ডব্লিউ এর কাউবয়রা। জোর মুখে মাটিনের মৃত্যু সংবাদ শুনে নিশ্চয় রক্ত গরম হয়ে গেছে ওদের। র্যাঞ্চ ও-এর দিকে রওনা দেয়ার আগে সব কিছু ভাল করে বুঝিয়ে দিতে হবে সবাইকে। ব্রিফ করতে হবে। ঘণ্টাখানেক পেরিয়ে গেছে। চাঁদ উঁকি দিচ্ছে আকাশে। আরও এক ঘণ্টা একটানা চলার পর থামল ওরা। ঘোড়া দুটোকে বিশ্রাম দেয়ার জন্যে। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল জীব দুটো। ওদের নিশ্বাস ভারি করে তুলল রাতের বাতাস। স্যাডলে প্রায় শুয়ে পড়ল সলটার। কাছে এসে ওর কাঁধে হাত রাখল শেরিফ।
পারবে তো, সলটার? প্রশ্ন করল সে। না পারলে কোন অসুবিধে নেই। বক্স ডব্লিউতে ফিরে যাও। আউটফিটদের নিয়ে আমি একাই যেতে পারব। তুমি অনেক করেছ। এবার ফিরে গিয়ে বিশ্রাম নাও। ভোরের আগে র্যাঞ্চ ও-তে যাব না আমরা। তার এখনও ছঘন্টা বাকি। এতক্ষণ কষ্ট করতে পারবে না তুমি। চলে যাও, এখন আমরাই সব সামলাতে পারব।
ঠিকই বলেছ, মাথা তুলে বলল সলটার। ফিরেই যাব।
তবে চলি আমি, স্যাডলে চাপল গিয়ে শেরিফ। ঘোড়া ছোটাল। শেরিফকে যতক্ষণ দেখা গেল ততক্ষণ চেয়ে রইল সলটার।
তারপর সিধে হয়ে বসল সে। ঘোড়াটাকে মন্থর গতিতে এগিয়ে নিল। এভাবে চললে বক্স ডব্লিউতে পৌঁছতে ঘণ্টা দুয়েক মত লাগবে তার। লাগুক, কোন তাড়া নেই। পরিস্থিতিটা ভাবতে চেষ্টা করল সে। মনের গভীর থেকে ফোরম্যানের কাজটা ছেড়ে দেয়ার তাড়না অনুভব করছে সে। এই রেঞ্জ ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাবে সে। নতুন করে আবার সব শুরু করবে। এখানে অনেকগুলো ভূত জ্বালাতন করছে তাকে। বাপের ভূত তো রয়েছেই, তার ওপর আবার প্রেমের ভূত। অসহ্য কষ্ট!
হঠাৎ গুলির শব্দে বাস্তবে ফিরে এল সে। ওর ডান পাশ দিয়ে গিয়েছে গুলিটা। তবে বহুদূর দিয়ে। এর অর্থ কী? ঘোড়া থামিয়ে কান পাতল সলটার। অল্প খানিকক্ষণ বাদে আবার গুলি হল, তারপর আবার। চিবুক ঘষল সে। র্যাঞ্চ ও-তে ফিরে থাকলে ওপথেই গিয়েছে ম্যাকগ্র। কিন্তু গুলি করছে কাকে?
জোহান! হঠাৎ মনে পড়ল ওর। গুলির শব্দ লক্ষ্য করে ঘোড়া ছোটাল সে। জোহান জেনেছে ম্যাকগ্র তাকে খুন করার নির্দেশ দিয়েছে। ওকে ব্যাঙ্কে ফিরে যেতে বলেছে সলটার। কিন্তু সত্যি ফিরে গেছে কি সে? নাকি ম্যাকগ্রর ওপর প্রতিশোধ নেয়ার পরিকল্পনা করেছে? গোলাগুলি হচ্ছে এখনও। দীর্ঘ বারো ঘণ্টা ধরে প্রচণ্ড টেনশনে রয়েছে সলটার। তার সঙ্গে পরিশ্রম। ফলে শরীর আর চলতে চাইছে না। এ মুহূর্তে নিরবচ্ছিন্ন বিশ্রাম বড় প্রয়োজন তার। কেবল মাত্র মনের জোরে এগিয়ে চলল সে।
শ্যুটিং স্পটের ধারে কাছে আসতেই নিস্তব্ধ হয়ে গেল জায়গাটা। এতক্ষণ যাই ঘটুক না কেন শেষ হয়ে গেছে ঘটনা। এদিক ওদিক চাইল সে। গুলির কারণ বুঝতে চাইল। আচমকা গুলি হল আবার। লালচে শিখা দেখে লাফিয়ে নামল সে স্যাডল থেকে। মাটিতে শুয়ে সামান্য মাথা জাগিয়ে দেখতে লাগল যুদ্ধ। দুটো পিস্তল থেকে গুলিবর্ষণ হচ্ছে। যোদ্ধাদের দূরত্ব কয়েক গজ মাত্র। শুয়ে থেকেই লোক দুটোর পরিচয় বোঝার চেষ্টা করল সে। বোঝা গেল না। ঠিক করল চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করবে। তবে তার আর প্রয়োজন হল না। কর্কশভাবে চেঁচিয়ে উঠল একজনঃ কে ওখানে?
জমে গেল যেন সলটার। কণ্ঠস্বরটা অতি পরিচিত। র্যাঞ্চ ও-র ফোরম্যান ম্যাকগ্র! পিস্তল ড্র করল বক্স ডব্লিউ-এর ফোরম্যান।
কিন্তু প্রশ্নটার জবাব না দিয়ে চুপ করে অপেক্ষা করতে লাগল। আশা করল উত্তর দেবে ম্যাকগ্রর প্রতিপক্ষ। জবাব আসতে আপন মনেই মাথা নাড়ল সে। শালা বদমাশ, আমি জোহান। ভোরের আগেই তোরা সব শালা মরবি নয় ধরা খাবি।
ও তুই? বেঁচে আছিস এখনও? আবার গুলি করতে শুরু করল ম্যাকগ্র। পাল্টা গুলি ছুঁড়ল জোহান। পরবর্তী কমুহূর্ত কেবল গুলির শব্দই শোনা গেল। খানিক বাদে
পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হলে ডাক ছাড়ল সলটার, থাম তোমরা, আমি রয় সলটার। জোহান, শিগগির দূর হও এখান থেকে। আর ম্যাক পিস্তল ড্র কর। আমি তোমাকেই খুঁজছি।
পিনপতন নিস্তব্ধতা। প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়েছে ম্যাকগ্র। মৃদু হাসল সলটার। ম্যাকগ্রর মাথায় খেলা করছে পরিকল্পনা, স্পষ্ট বুঝতে পারল সে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে গুলি ছুঁড়ে পাল্টা জবাব দিল র্যাঞ্চ ও-র ফোরম্যান। তার সঙ্গে তাল মেলাল সলটার। গুলির শব্দে কেঁপে উঠল জায়গাটা। সলটারের শরীরের আশপাশ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে সীসা। তবে গা করল না সে। রোখ চেপে গেছে তার। পিতৃহত্যার। প্রতিশোধ নেয়ার বাসনা উন্মত্ত করে তুলেছে তাকে। ওদিকে ম্যাকগ্র এলোমেলো গুলি চালাচ্ছে। ওকে এক ঝলক দেখার জন্যে অপেক্ষা করতে লাগল সলটার। সুযোগটা পেতেই দুটো সীসে ঢুকিয়ে দিল শত্রুর শরীরে। মুহূর্তে থেমে গেল প্রতিপক্ষের আক্রমণ। ম্যাকগ্রর তীক্ষ্ণ আর্তনাদে ভেঙে পড়ল রাতের নীরবতা।
মরেছে, চেঁচিয়ে উঠল জোহান। খোড়াতে খোঁড়াতে বেরিয়ে এল সে। ছুটে গেল ম্যাকগ্রর কাছে। মাটিতে পড়ে রয়েছে ও। চিৎকার করে ওকে সাবধান করল সলটার। কিন্তু গায়ে মাখল না জোহান।
পরমুহূর্তে কোল্টের শব্দ শুনল সলটার। দেখতে পেল ঝাঁকি খেল জোহানের শরীর। যেন ধাক্কা খেয়েছে শক্ত পাথরের সঙ্গে। পড়ে গেল সে। ম্যাককে উঠতে দেখা গেল এ সময়। চাঁদের আলোয় চকচক করছে হাতের অস্ত্রটা। সলটারের দিকে ফিরল ও। তাক করল কোল্ট।
তোমাকে আর বাঁচতে হচ্ছে না, সলটার, হিংস্র শোনাল ম্যাকগ্রর গলা। আজই শেষ দিন তোমার।
পিস্তল ঝলসে উঠল সলটারের হাতে। প্রথম গুলিতে পেট ফুটো হয়ে গেল ম্যাকগ্রর। মাটিতে বসে পড়ল সে। পরবর্তী গুলিতে ওর কপাল থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোল। প্রাণ হারাল ম্যাকগ্র। দ্রুত জোহানের দিকে এগোল সলটার। মাটিতে পড়ে রয়েছে সে। সলটারের আশঙ্কা মারা গেছে জোহান। কিন্তু ওকে দেখে কথা বলে উঠল ছেলেটি।
সলটার, আমাকে ক্ষমা করে দিয়ো, বন্ধু।
হোলস্টারে পিস্তল ঢুকিয়ে হাঁটুতে ভর দিয়ে ওর পাশে বসে পড়ল সলটার।
কোথায় লেগেছে?
হার্টে। আমি গেছি, কাশতে লাগল জোহান। কাশির দমকে নিশ্বাস আটকে আসছে তার। ওর মাথাটা সামান্য তুলে ধরল সলটার। বড় দেরি হয়ে গেল, ধীরে বলল জোহান। একটা অনুরোধ রাখবে, সলটার? বাবাকে রাসলিং-এর কথা কিছু জানিয়ো না, প্লীজ। বাবা কষ্ট পাবে।
কথা বল না, জোহান। চুপ করে শোও আমি দেখছি।
লাভ নেই, বিড়বিড় করে বলল জোহান। আমি তোমাদের কাছে ক্ষমা চাই, সলটার। করবে?
নিশ্চয়ই। তোমার বাবাকে জানাব ম্যাকগ্রকে খুঁজে বার করতে আমাকে সাহায্য করেছ তুমি।
ধন্যবাদ, অতিকষ্টে বলল জোহান। সলটার, তানিয়া তোমাকে ভালবাসে, ওকে আর কষ্ট দিয়ো না।
বল কি তুমি! তবে অসকার?
অসকারের সঙ্গে মিশে তোমার মধ্যে ঈর্ষা জাগাতে চায় ও, কথা কটা বলতে যেন প্রাণ বায়ু বেরিয়ে গেল জোহানের।
বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে গেল সলটার। বিস্ময় কাটলে দেখল জোহানের মুখে কথা নেই। মারা গেছে সে। ওর শরীরটা ধরে বারকয়েক ঝাঁকি দিল সলটার। ফাঁকা লাগছে বুকের ভেতরটা। জোহান নেই! আর ভাবতে পারল না ও। ডুকরে কেঁদে উঠল। খানিক পরে নিজেকে অনেকটা সামলে নিল সলটার। চোখ মুছে জোহানের ঘোড়াটা খুঁজতে লেগে গেল। খানিক খুঁজতেই পাওয়া গেল ওটাকে। কোনমতে জোহানের মৃতদেহটা স্যাডলে চাপাল সলটার। হাঁপাতে লাগল সে। এবার নিজের ঘোড়ায় চাপল ও। ম্যাকগ্রর নিপ্রাণ দেহ পিছনে ফেলে বক্স ডব্লিউ-এর দিকে এগোল। জর্জের ওপর রাগ হচ্ছে ওর। জোহানের মৃত্যুর জন্যে সে-ই দায়ী। ছেলেকে কেন বশে রাখতে পারল না? তানিয়ার কথা ভাবল ও। একমাত্র। ভাইটাকে হারাল মেয়েটি। একথা ওকে কি করে জানাবে সলটার?
নিশুতি রাতে একা চলেছে সে। পাশের ঘোড়ায় মৃত জোহান। সলটারের ওপর দিয়ে প্রচণ্ড ধকল গেছে। তার মনে হচ্ছে যে কোন মুহূর্তে জ্ঞান হারাতে পারে সে। অর্ধ সচেতন অবস্থায় পেরিয়ে এল কয়েক মাইল। শেষ পর্যন্ত উঁচু একটা টিলায় উঠে এল সে। এখান থেকে স্পষ্ট চোখে পড়ে বক্স ডব্লিউ। জানালা দিয়ে হলদে আলো এসে উঠনে পড়ছে। নিপ বসে থেকে সেদিকে চেয়ে রইল সে। মাঝরাত পেরিয়ে গেছে; নিশ্চিত ও মার্টিনের মৃত্যু সংবাদ র্যাঞ্চে নিয়ে আসার পর কি ঘটেছে কে জানে। সবাই নিশ্চয় ছুটে গেছে স্যাডল ব্ল্যাঙ্কেট ক্রীক এ। অপেক্ষা করেছে সলটারের জন্যে। কিন্তু দেরি দেখে রওনা দিয়েছে নিজেরাই। র্যাঞ্চ ও-র দিকে।
ঢাল বেয়ে ঘোড়া দুটো নিয়ে নেমে এল সলটার। শথ গতিতে এগোল র্যাঞ্চের দিকে। উঠনে ঢুকে স্যাডল থেকে নেমে পড়ল ও। হেলান দিল করাল ফেন্সে। ঝাঁপসা চোখে চাইল। মনে হল বারান্দায় বসে আছে দু’জন মানুষ। বারান্দার দিকে এগোল সে। জোহানের মরদেহবাহী ঘোড়াটা নিয়ে। প্রথম ধাপের কাছে এসে থামল। বারান্দার বেঞ্চিতে বসে রয়েছে তানিয়া আর উইলবার অসকার। এখানে বসে করছেটা কি লোকটা? ওর র্যাঞ্চে তো এখন গোলমাল চলার কথা। ওকে দেখে চিৎকার করে উঠল তানিয়া।
সলটার, কোথায় ছিলে? ব্যাকুল প্রশ্ন করল মেয়েটি। এক ঝলক চাইল অসকারের দিকে। সলটারের দিকে একদৃষ্টি চেয়ে বসে রয়েছে সে। নিশ্চুপ।
আর সবাই কোথায়? প্রশ্ন করল সলটার। জোহানের কথা কিভাবে বলবে ভেবে পাচ্ছে না সে।
ওরা ঘণ্টা কয়েক হল বেরিয়ে গেছে। অসকারের দিকে চাইল তানিয়া, এবার সত্যি কথাটা বলা যায় তোমাকে। বাবা কাউবয়দের নিয়ে শহরে যাননি। গেছেন স্যাড়ল ব্ল্যাঙ্কেট ক্রীক-এ। শেরিফ আর সলটারের সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্যে। সেখান থেকে তোমার র্যাঞ্চে যাবে সবাই। ম্যাকগ্র আর র্যাঞ্চ ও-র লোকেরা রাসলিং-এর সঙ্গে জড়িত এটা এখন আর কারও অজানা নয়।
অসকারের চেহারা দেখে হাসবে না কাদবে বুঝে উঠতে পারল না সলটার। প্রচণ্ড চমকে গেছে অসকার।
তোমার জন্যে আরও দুঃসংবাদ আছে, অসকার, শান্ত কণ্ঠে বলল সলটার। তোমার লোকের হাতে মারা গেছে আমার ভাই। আমি তোমাকে ছাড়ছি না।
কি বললে তুমি? চেঁচিয়ে উঠল তানিয়া। কে মারা গেছে বললে?
জোহান, মৃদু স্বরে বলল সলটার। ঘোড়ায় রয়েছে ওর লাশ। ম্যাকগ্রর হাতে মারা গেছে।
জোহান মারা গেছে! চিৎকার করে বারান্দা থেকে নেমে এল তানিয়া। দৌড়ে গেল জোহানের ঘোড়র কাছে। জাপটে ধরল ভাইয়ের মৃতদেহ। হাউমাউ করে কাঁদছে সে। ওর দিকে একবার চাইল লটার। কথা সরল না তার মুখে। চোখ ফেরাল অসকারের দিকে।
ওদিকে পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে রইল অসকার। তার চোখ জোড়া সলটারের চোখে।
জানতাম তানিয়াকে কিছুতেই বিয়েতে রাজি করাতে পারব না, এই প্রথম মুখ খুলল সে। ও তোমাকে ভালবাসে। হাজার চেষ্টা করেও ওর মন পাইনি আমি। আজ রাতে শেষ সুযোগ দিয়েছিলাম মনস্থির করার জন্যে। কথা শুনল না। যাই হোক, ওকে পাচ্ছ না তুমি। শেষের দিকে গলার স্বর কঠিন হল তার। কভারডেল, কোথায় তুমি?
ঠিক ওর পেছনে, বস, জবাব এল দ্রুত। কভার করে রেখেছি।
জমে গেল সলটার। পরিচিত কণ্ঠ। এ গলা জীবনে কোনদিন ভুলতে পারবে সে। খুনী। এর হাতেই প্রাণ দিয়েছে শেরিফ রজার হার্পার। আর গুলি খেয়ে আহত হয়েছে ও নিজে।
গুড, বলল অসকার। কভারডেল এর আগেরবার ভুল করেছিল। তোমাকে খতম না করেই চলে গিয়েছিল। এবার ভুলটা শুধরে নেবে সে।
কিন্তু তুমি এসবে জড়ালে কেন? অসকারকে প্রশ্ন করল সলটার।
আমি চাই ক্ষমতা। সেজন্যে রাসলিং-এ নেমেছি। জর্জ ওয়াগনারকে ফতুর করার এছাড়া আর কোন উপায় ছিল না, বলল অসকার। অবশ্য তানিয়া আমার কথায় রাজি হলে ক্ষতিটা গায়ে লাগত না ওর বাপের। হাজার হোক জামাই বলে কথা। কিন্তু তোমার জন্যে সে আর হল না। কাজেই মরার জন্যে প্রস্তুত হও। তুমি।
তানিয়ার কি হবে?
মরবে, প্রেমিকের জন্যে। ওর বাপটাও ছাড়া পাবে না। রাসলিং করে কম পয়সা তো আর কামাইনি। দুনিয়াতে মেয়েমানুষেরও অভাব নেই। কি বল?
সলটারের ইচ্ছে হল অসকারের টুটি চেপে ধরে। কিন্তু একেবারেই অবাস্তব কল্পনা সেটা। ওর পিঠে খোঁচা দিচ্ছে পিস্তলের নল।
ওকে নিয়ে যাও, কভারডেল, অসকার বলল। তুমি ফিরে আসা পর্যন্ত তানিয়াকে দেখে রাখব আমি। চোখের সামনে তার প্রেমিককে মারা ঠিক হবে না। এমনিতেই ভাইটা গেছে।
ওর পিঠে ধাক্কা দিল গানম্যান। আগে বাড়াল। এভাবে মরতে কিছুতেই রাজি নয় সলটার। শেষ চেষ্টা করতে হবে। গভীর শ্বাস নিল সে দৃঢ় করল মাংসপেশী। মরিয়া হয়ে ঘুরে দাঁড়াবে ও। হয় গুলি খেয়ে মরবে নয় খুনীকে পেড়ে ফেলবে। ঠিকমত মুখে একটা ঘুসি বসাতে পারলেই হল। উল্টে যাবে দাবার ছক। হঠাৎ তানিয়ার চিৎকারে থেমে দাঁড়াল ওরা। তানিয়ার দিকে চাইল সলটার।
ভাইয়ের মৃতদেহের পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে মেয়েটি। স্যাডলের পেছন দিকে। ব্ল্যাঙ্কেট রোল থেকে একটা হাত উঠতে দেখল সলটার। ঝকঝক করে উঠল সিক্সগানের নল। দাঁতে দাঁতে বাড়ি খেল সলটারের। ওর পেছনের লোকটা আর্তচিৎকার করে উঠল। ঝাঁকি খেয়ে সরে গেল খানিকদূর। আরও দুটো গুলি হল। এবার ভূমিশয্যা নিল সে, চিরদিনের মত। রাতের বাতাসে এখন বারুদের গন্ধ। জোহান গুলি করেছে। তারমানে মরেনি ও। এজন্যেই হঠাৎ চিৎকার করে উঠেছিল তানিয়া। সলটারের নিজেরও চিষ্কার করতে ইচ্ছে করছে। খুশিতে।
খিস্তি করল অসকার। তার হাত চলে গেছে হোলস্টারে। চোখের কোণে ব্যাপারটা লক্ষ করল সলটার। অসকারের হাত ওঠার আগেই হোলস্টারমুক্ত হল সলটারের কোল্ট। অসকারের বুক লক্ষ্য করে ট্রিগার টিপল সে। র্যাঞ্চ মালিকের সাদা শাটার বুক পকেট লাল হয়ে উঠল। গুলি খেয়ে পিছিয়ে গেল অসকার। পিস্তলটা শেষবারের মত ব্যবহার করল সে। ব্যর্থ চেষ্টা। তারপর হাত পা ছড়িয়ে দড়াম করে পড়ে গেল বারান্দার কাঠের মেঝেতে। হাত থেকে ছিটকে পড়ল অস্ত্র। ছুটে এল তানিয়া। নিজেকে ছুঁড়ে দিল সলটারের বুকে। প্রেয়সীকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে গিয়ে কাঁধে ব্যথা পেল সলটার। তবে পরোয়া করল না। তানিয়ার মাথার ওপর দিয়ে অসকারের প্রাণহীন দেহটার দিকে চাইল সে। লোকটা অসম্ভব ভুগিয়েছে। ওর বুকে তখন ফুঁপিয়ে চলেছে তানিয়া। প্রেমিকার পিঠে হাত বুলিয়ে দিল সলটার।
আমি কিন্তু সব দেখে ফেলেছি, জোহানের কথায় সংবিৎ ফিরে পেল ওরা। ছিটকে সরে গেল দুদিকে। তারপর দুজনেই দৌড়ে এল জোহানের কাছে। এখনও স্যাডলে শুয়ে রয়েছে সে। ওই অবস্থাতেই ওকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে লাগল সলটার, গালে-কপালে।
তুই না বললি হার্টে গুলি লেগেছে? প্রশ্ন করল সলটার। বিস্ময়ের ঘোর পুরোপুরি কাটেনি তার। স্যাডল থেকে জোহানকে নামাল সে আর তানিয়া।
ঠিকই তো বলেছি, বলল জোহান। হার্ট কোথায় থাকে যেন? বাঁ দিকে না? আমার তো ওদিকেই লেগেছে।
দেখি কোথায় তোর হার্ট, শার্ট খুলে দেখল সলটার।
ওরে গর্দভ, হার্ট এখানে থাকে? কাঁধে লেগে বেরিয়ে গেছে গুলি। তেমন কিছুই হয়নি। আর গাধাটা আমাকে পর্যন্ত বোকা বানিয়ে ছেড়েছে।
তানিয়া আর সলটার দুজনেই হাসতে লাগল। বড় লজ্জা পেয়েছে জোহান। বেশি হেস না, বলল সে। ভুল সবারই হয়।
জোহানের কথায় হাসির দমক বাড়ল ওদের। জোহানকে নিয়ে ঘরে ঢুকল ওরা। ওকে শুইয়ে দিল বিছানায়।
ডাক্তার নিয়ে আসব? প্রশ্ন করল সলটার।
দরকার নেই। কাল সকালে আনলেও চলবে। তাছাড়া গুলি খাওয়া রোগীর চিকিৎসায় আমার অভিজ্ঞতাও কিন্তু কম নয়, চোখ গোল গোল করে বলল তানিয়া।
ওর বলার ধরনে এবার লজ্জা পাওয়ার পালা সলটারের। আমি চলি, দ্রুত বলল সে। স্যাডল ব্ল্যাঙ্কেট ক্রীক-এ যাব।
যাও, বলল তানিয়া। সাবধান থাকবে কিন্তু।
মাথা ঝাঁকিয়ে সায় জানাল সলটার। ঘর থেকে বেরিয়ে এসে রজার হার্পারের খুনীর মৃতদেহ দেখে নিল এক ঝলক। আপন মনেই হাসল সে। তারপর ঘোড়ায় চাপল। লক্ষ্য স্যাডল ব্ল্যাঙ্কেট ক্রীক। ওর হৃদয়টা এ মুহূর্তে দু’টুকরো হয়ে গেছে। একটা টুকরো রয়েছে ওর সঙ্গে, আর অন্যটা তানিয়ার কাছে।
<