ব্রাউন লেডি
গত দেড়শো বছরে ইংল্যাণ্ডের নরফোকের রেইনহ্যাম পার্কে ব্রাউন লেডি বা বাদামি বসনাকে দেখা গিয়েছে অনেকবার।
সিঁড়ি বেয়ে নিঃশব্দে ওঠা-নামা করে সে, কখনও করিডর ধরে হেঁটে বেড়ায়। তার পরনে থাকে বাদামি-হলুদ একটা পোশাক আর গলায় পশমের গলাবন্ধ। তার চোখের জায়গায় থাকে অন্ধকার গর্ত, মুখটা মোমের মত সাদা। এমনিতে কোনো কথা বলে না, কারও ক্ষতি করে না, এমনকী কিছু চায়ও না। তবে কখনও কখনও তার ঘুরে বেড়াবার মধ্যে অশুভ, ভয়ঙ্কর কী যেন একটা থাকে, এমনকী তাকে দেখে সবচেয়ে দুঃসাহসী মানুষটিরও গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে।
রেইনহ্যাম ছিল মারকুইজ অব টাউনশেদের বাড়ি। খুব প্রাচীন একটা বাড়ি এটি। ১৮৩৫ সালের দিকে এটা কিনে সংস্কার করান টাউনশেন্ডরা। এ উপলক্ষে বেশ কিছু বন্ধু-বান্ধবকে দাওয়াত দেন লর্ড এবং লেডি চার্লস টাউনশেণ্ড। এদের একজন ক্যাপ্টেন ফ্রেডেরিক মারিয়াট। ছোটদের জন্য গল্প লিখে তখন খুব নাম কামিয়েছেন ভদ্রলোক। ফ্রেডেরিক পৌঁছার পরপরই লর্ড চার্লস তাঁকে এক পাশে টেনে এনে নিজের স্টাডির দিকে নিয়ে চললেন।
দুজনের জন্য গ্লাসে মদ ঢেলে কথা বলা শুরু করলেন. লর্ড চার্লস। মুখে চিন্তার ছাপ। ফ্রেডেরিক, এখানে কিছু একটা সমস্যা তৈরি করছে। তোমার সাহায্য দরকার আমার। বাড়িতে একটা ভূত আছে এই গুজব ছড়িয়ে পড়েছে। আমি এটাকে পাত্তা দিতে চাইনি। কিন্তু কোনো চাকর-বাকর কিংবা অতিথিই দু-চার রাতের বেশি থাকতে পারে না এখানে। তারা ব্রাউন লেডি নামে পরিচিত একজন মহিলাকে দেখেছে। এই তথাকথিত ভূত নাকি বারান্দা এমনকি শোবার ঘরগুলোর ভিতরে আর আশপাশে ঘুরে বেড়ায়।
চার্লস, তিরস্কার করলেন ক্যাপ্টেন, এ ধরনের আজগুবি গল্পে তুমি কেন বিচলিত হচ্ছ এটা মাথায় আসছে না আমার। আমি ওসব ভূত, প্রেতাত্মায় বিশ্বাস করি না। যদি আসলেই কাউকে দেখা যায়, তবে ধরে নিতে পার কেউ তোমার সঙ্গে চালাকি করছে। তুমি কিনে নেওয়ার আগে কিছুদিন বাড়িটা খালি পড়ে ছিল। ঠিক না?
হ্যাঁ।
এই এলাকার একজন ম্যাজিস্ট্রেট হিসাবে আমি জানি, আবার কথা বলা শুরু করলেন ক্যাপ্টেন ম্যারিয়াট, এদিকটায় বেশ ভাল পরিমাণ চোরাচালানি আর চোরাশিকার হয়। এসব চোরাচালানির লুকানোর জায়গা হিসাবে যে বাড়ি আর আস্তাবলগুলো ব্যবহার করা হত এটি সম্ভবত তার একটা। এখন তোমাদের উপস্থিতির কারণে একটা নিরাপদ আত্মগোপনের জায়গা হাতছাড়া হওয়ার অবস্থা হয়েছে তাদের। তারাই গ্রামে ভূতের গল্প ছড়িয়ে তোমাকে তাড়াতে চাইছে।
লর্ড চার্লস উঠে দাঁড়ালেন চেয়ার ছেড়ে। উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে তার চোখ। আমার ধারণা তুমি আসল জায়গায় হাত দিয়েছ। তুমি জান আমার কুকুর আছে। আর এদের চেঁচামেচিতে রাতে এই বাড়ি কিংবা আস্তাবলের ধারে-কাছে ঘেঁষা কঠিন কারও কারও জন্য। তারাই আমাকে তাড়াতে চাচ্ছে। সন্দেহ নেই চোরাচালানি কিংবা চোরাশিকারীদের বানানো চরিত্র এই বাদামি বসনা নারী।
কোন্ কামরাটায় এই মহিলাকে দেখেছে লোকেরা? হালকা চালে জিজ্ঞেস করলেন ক্যাপ্টেন। তার বুদ্ধির প্রতি বন্ধুর আস্থা দেখে মনে-মনে খুশি হয়ে উঠেছেন।
আস্তাবলের দিকে মুখ করা দ্বিতীয় তলার একটা কামরা ওটা, জবাব দিলেন লর্ড চার্লস। বেশ বড়সড়, চমৎকার একটা কামরা এটা। চারপাশে সিডার কাঠের প্যানেল দেওয়া। দেয়ালে একজন মহিলার প্রতিকৃতি আছে। তার পরনে একটা বাদামিহলুদ পোশাক, গলায় একটা গলা বন্ধনী। সম্ভবত এটাই সেই ব্রাউন লেডি, যার কথা লোকে বলে।
তাহলে তোমার অনুমতি পেলে আমি সেখানে রাতে ঘুমাতে চাই, ঘোষণা করলেন ক্যাপ্টেন। এখান থেকে আস্তাবলের দিকে চোখ রাখতে পারব। আর তোমার ওই ব্রাউন লেডি যদি চেহারা দেখায় তার কুশলও জিজ্ঞেস করতে পারব, যদিও সে আসবে কিনা এ বিষয়ে সন্দেহ আছে আমার।
কোনো সমস্যা নেই। তোমার জন্য কামরাটা ঠিক করে দিতে বলছি। মনে হয় না রাতে কোনো অনাহূত অতিথি ব্যাঘাত ঘটাবে তোমার ঘুমে।
বালিশের নীচে গুলি ভরা একটা রিভলভার রেখে. পর পর দুরাত ভুতুড়ে কামরাটায় কাটালেন ক্যাপ্টেন ম্যারিয়াট। কিন্তু অস্বাভাবিক কিছুই নজরে এল না। তৃতীয় রাতটাই এখানে তাঁর শেষ রাত। ক্যাপ্টেনের ধারণা এ রাতটাও কাটবে ঘটনাবিহীনভাবে।
মাঝরাতের ঠিক আগে। হাতে মোমবাতি নিয়ে, বাদামী সিল্কের পোশাক পরা তরুণী মহিলার প্রতিকৃতিটা পর্যবেক্ষণ করছেন ক্যাপ্টেন। মহিলার চেহারায় কোনো অস্বাভাবিকতা নেই। মাথাটা একবার ঝাকিয়ে ভূতের চিন্তা-ভাবনা মন থেকে বিদায় করে এক পা পিছিয়ে এলেন। মোমবাতির শিখাটা কেঁপে উঠল। এখান থেকে মোমবাতির আলো যে ছায়া তৈরি করছে তাতে বদলে গেল চেহারাটা। ওটাকে এখন সাধারণ আর নিস্পাপ মনে হচ্ছে না। বরং ভীতিপ্রদ আর পৈশাচিক লাগছে। চোখ দুটো কোটরের ভিতরে ঢুকে গেছে, চামড়ার ভেতর থেকে হাড় ফুটে বেরোচ্ছে। ক্যাপ্টেনের কেন যেন মনে হলো তিনি একটা খুলির দিকে তাকিয়ে আছেন।
আবার সামনে এগুলেন, আগের সেই শান্ত, সুন্দর চেহারাটা ফিরে এল। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে, পাশের টেবিলে রাখলেন ম্যারিয়ট মোমবাতিটা। এবার ঘুমাতে যাবেন। ঠিক এমন সময় দরজায় ধাক্কা দিল কেউ। ভিতরে আসুন, বলার সময় মহিলার ছবিটার দিকে দৃষ্টি দেওয়া এড়াতে পারলেন না।
তবে কোনো ভূত কিংবা প্রেতাত্মা ঢুকল না ঘরে। লর্ড চার্লসের দুই ভাতিজা দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে, করিডোরের শেষ মাথার একটা কামরা ভাগাভাগি করছে তারা। সন্ধ্যায় তাদের সঙ্গে দেখা হয়েছে ক্যাপ্টেনের, তখন শিকারী কুকুর আর বন্দুক নিয়ে আলাপ করছিল তারা।
যাক বাবা! আপনি ঘুমিয়ে পড়েননি। বলল কিশোরদের একজন। আপনি কি আমাদের রুমে একবার আসবেন? লণ্ডন থেকে কেনা একটা বন্দুক এই মাত্র খুলেছি। ওটা সম্পর্কে আপনার মতামত জানতে চাচ্ছিলাম।
মোমবাতিটা তুলে নিয়ে দরজার দিকে এগুলেন ক্যাপ্টেন। মনে হলো যেন ছবির মহিলাটি তাঁর দিকে তাকিয়ে ভেংচি কাটছে। তারপর জোর করে মুখে একটু হাসি ফুটিয়ে রিভলভারটা তুলে নিয়ে বললেন, এটা নেব আমি। ব্রাউন লেডির সঙ্গে যদি দেখা হয়ে যায়!
তিনজন করিডোর ধরে হেঁটে ছেলেদের কামরায় চলে এলেন। ক্যাপ্টেন অস্ত্রটার প্রশংসা করে বললেন, আগামীবার লণ্ডনে গেলে নিজেও এমন একটা কিনবেন। আরও কয়েক মিনিট আলাপের পর ক্যাপ্টেন হাই তুলতে তুলতে বললেন, এখন বিছানায় যেতে হবে আমাকে। আগামীকাল আবার লম্বা পথ পাড়ি দিতে হবে।
আপনাকে বরং আমরা পৌঁছে দিয়ে আসি, হাসতে-হাসতে বলল চার্লসের এক ভাতিজা, ব্রাউন লেডি যদি আবার আপনাকে অপহরণ করে ফেলে।
একসঙ্গে কামরা থেকে বের হয়ে লম্বা, অন্ধকার করিডোরটা ধরে হাঁটা ধরলেন তাঁরা। গোটা বাড়িটাই অন্ধকারে ঢেকে আছে, তাদের পায়ের আওয়াজ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই কোথাও। মাত্র কয়েক গজ এগিয়েছেন এমন সময় হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেলেন ক্যাপ্টেন।
দেখো! ফিসফিস করে বললেন তিনি।
করিডোরের অপর পাশ থেকে একটা কাঠামো এগিয়ে আসছে, হাতে লণ্ঠন। একজন মহিলা, হাঁটার সময় তার পোশাকটা খসখস শব্দ করছে। তবে ছায়ায় ঢাকা পড়ায় চেহারাটা দেখা যাচ্ছে না।
তিনি নিশ্চয় মহিলা অতিথিদের একজন, সম্ভবত পথ হারিয়েছেন। ম্যারিয়াট বিড়বিড় করলেন, কিংবা কেউ বাগানের দিকে যাচ্ছেন।
কিন্তু মহিলাটি কে? ছেলেদের একজন বলল, তাকে অতিথিদের কারও মত লাগছে না আমার।
কাঠামোটা তাঁদের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। তাপমাত্রাটা হঠাৎ করেই বেশ কয়েক ডিগ্রী নেমে গেল, মনে হচ্ছে যেন হঠাৎ করেই শীতকাল চলে এসেছে। তিনজন শীতে ঠকঠক করে কাঁপতে শুরু করলেন। হঠাই সামনের একটা খালি কামরার খোলা দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকে ছেলেদেরও টেনে নিলেন ম্যারিয়াট। তারপর একটু ফাঁক রেখে দোর টেনে দিলেন। এবার এই ফাঁকে চোখ রাখলেন সবাই, হৃৎপিণ্ডে দ্রিম দ্রিম বাড়ি খাচ্ছে।
মহিলাটি এখন দরজার কাছাকাছি চলে এসেছেন। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন ক্যাপ্টেন। লণ্ঠনের আলোয় চেহারাটা ধরা দিল তাঁর সামনে, পরনে সেই সিল্কের বাদামি পোশাক। সন্দেহ নেই ছবির সেই মহিলা আর ইনি একই ব্যক্তি। করিডোর ধরে আস্তেআস্তে হেঁটে চলেছেন। পোশাক খস খস শব্দ তুললেও পা ফেলার কোনো আওয়াজ হচ্ছে না। লণ্ঠনের আলোয় তার চোখে, মুখে অশুভ কিছু নজর পড়ল না।
দরজার ঠিক উল্টো পাশে যখন চলে এলেন তখন দাঁড়িয়ে পড়লেন। বাতিটা মুখের সামনে ধরলেন। আর তখনই চেহারাটা পাল্টে গেল। চামড়া-মাংস ভেদ করে স্পষ্ট হয়ে উঠল হাড়গুলো। মনে হলো যেন একটা কংকাল হেঁটে যাচ্ছে সামনে দিয়ে। গর্তের মধ্যে অদৃশ্য হয়েছে চোখ জোড়া, ঠোটহীন মুখটাকে লাগছে যেন একটা গোরস্থানের প্রবেশদ্বারের মত।
ধীরে-ধীরে দরজাটা মেললেন ক্যাপ্টেন। ব্রাউন লেডির ভয়ঙ্কর মুখটা আরও পরিষ্কার হয়ে উঠল তাঁদের চোখের সামনে। জোর খাটিয়ে নিজের মনটাকে স্থির করলেন কাপ্টেন। তারপর একেবারে কাছ থেকে গুলি করলেন প্রেতাত্মাটার দিকে।
বদ্ধ জায়গায় শব্দটা কানে তালা লাগিয়ে দিল। যখন ধোঁয়া অদৃশ্য হলো মেঝের দিকে তাকালেন ক্যাপ্টেন। আশা করছেন মাটিতে একটা দেহ পড়ে থাকতে দেখবেন। কিন্তু এখানে কিছুই নেই। এমনকী কিছু ছিল তা প্রমাণ করার মত কোনো চিহ্নও না। তিনজন পুরুষ আর বাতাসে ভেসে চলা হালকা ধোঁয়ার রেখা ছাড়া করিডোরে আর কিছুর অস্তিত্ব নেই।
পাগলের মত একজন আরেকজনের দিকে তাকাতে লাগলেন তারা। এখানে কিছু একটা ছিল, তাই না? আমার চোখ নিশ্চয় বেঈমানি করেনি? বললেন ক্যাপ্টেন। ছেলেদের একজন কাঁপতে-কাপতে বলল, আমি যা দেখেছি আপনিও যদি তা দেখে থাকেন তবে তা ভয়ঙ্কর। তারপর উল্টো পাশের দরজার দিকে ইশারা করে বলল, দেখুন, বুলেটের গর্ত। এখানে যা ছিল বুলেটটা তাকে ভেদ করে গেছে।
এবার ক্যাপ্টেন গম্ভীরকণ্ঠে বললেন, আমরা যাকে দেখেছি সে কোনো চোরাচালানী বা পোচার নয়, রেইনহ্যামের ব্রাউন লেডি, ছবির থেকে যে জীবন পেয়ে গেছে। তারপরই হঠাৎ একটা চিন্তা মাথা চাড়া দিয়ে উঠল তার। আমার সঙ্গে চলো। বলে দ্রুত নিজের কামরার দিকে হাঁটতে শুরু করলেন।
দেয়ালের যেখানে বাদামি বর্সনার ছবি ঝুলছে সেখানে চলে এলেন ক্যাপ্টেন। মোমটা উঁচু করে ধরলেন। ব্রাউন লেডি যেন এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তার মুখটাতে কোনো অস্বাভাবিকতা নেই। আলো পড়ে ঝিকিয়ে উঠছে বাদামি পোশাকটা। হঠাৎই ক্যাপ্টেনের শ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলো। মহিলার হৃৎপিণ্ডের কাছটায় কি একটু রক্তের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে? আলো পড়ে চিক চিক করছে? নাকি তার উর্বর মস্তিষ্কের কল্পনা এটা?
ব্রাউন লেডিকে নিয়ে ক্যাপ্টেনের এই অভিজ্ঞতার বর্ণনা পাওয়া যায় তাঁর মেয়ে ফ্লোরেন্সের লেখা একটি বইয়ে। ১৮৯৯ সালে মারা যান ভদ্রমহিলা। তবে ক্যাপ্টেন ছাড়াও আরও অনেকেই বাদামি বসনাকে দেখেছেন। ধারণা করা হয় তিনি ছিলেন ডরোথি ওয়ালপল, ১৭২২ সালে ইংল্যাণ্ডের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করা রবার্ট ওয়ালপলের বোন। লোকে বলে ব্রাউন লেডি তার বাচ্চাদের খুঁজে ফিরছেন। ভদ্রমহিলা জীবিত থাকার সময় স্বামী দ্বিতীয় ভিসকন্ট টাউনশেণ্ডের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর বাচ্চাদের তাদের দাদির হেফাজতে রাখা হয়েছিল।
১৯৩৬ সালে বাদামি বসনার একটা ছবি তোলার চেষ্টা করেন একজন আলোকচিত্রী। তবে যে ছবিটি একটা ম্যাগাজিনে ছাপা হয় সেটা খুব স্পষ্ট।
<