০৬.

ভটভট-ভটভট করে পাইরেটস কোবের দিকে চলেছে ব্ল্যাক ভালচার। বাতাস, ঢেউয়ের গর্জন, আর জলদস্যুদের কোলাহল ছাপিয়ে লাউডস্পীকারে গম গম করে উঠলো ক্যাপ্টেন ফিলিপের কণ্ঠ, বেগুনী জলদস্যুর আড্ডায় স্বাগতম। উত্তর লস। অ্যাঞ্জেলেসের সব চেয়ে রোমাঞ্চকর এক অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে এসেছেন। আপনারা। কুখ্যাত বেগুনী জলদস্যু আর তার ভয়ংকর সহকারীদের নিষ্ঠুর। কাণ্ডকারখানা দেখবেন আপনারা পাইরেটস কোভে। তবে তার আগে ওই দসর্দারের কথা কিছু জানা থাকা দরকার আপনাদের, আমি মনে করি। কাহিনীর শুরু আঠারোশো আঠারো সালে, যেদিন আলটা ক্যালিফোর্নিয়ার উপকূলে এসে নোঙর ফেলেছিলো দুটো কালো জাহাজ। একটা থারটি এইট-গান ফ্রিগেট, নাম আরজেনটিনা। কমাণ্ডার ছিলেন একজন ফ্রেঞ্চ প্রাইভেটিয়ার, ক্যাপ্টেন হিপোলাইট ডা বুচার্ড। দ্বিতীয় জাহাজটা টোয়েন্টি সিক্স-গান, ওটার কমাণ্ডার একজন জলদস্যু, পেড্রো কনডে। তার প্রধান সহকারী ছিলো লেফটেন্যান্ট উইলিয়াম ইভানস। জাহাজের সেকেন্ড ইন কমাণ্ড।

জাহাজটায় দুশো পঁচাশি জন লোক ছিলো। আরজেনটিনার পতাকা। আঠারোশো আঠারো সালে স্পেনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমেছিলো আরজেনটিনা। কুখ্যাত সব ডাকাতদের ভাড়া করেছিলো স্প্যানিশ জাহাজ আর শহর আক্রমণ করার জন্যে। কালিফোর্নিয়া তখন স্পেনের দখলে। আঠারোশো আঠারো সালের। একুশে নভেম্বর মনটিরে শহরের ওপর কামানের গোলা ফেলতে আরম্ভ করেছিলো জাহাজ দুটো। ওখানকার গভর্নর ছিলেন তখন সোলা।

বুম্মম্! করে কামান গর্জে উঠলো।

খাইছে! বলে লাফিয়ে একহাত শূন্যে উঠলো মুসা। তার পাশেই রয়েছে। কামানটা। একঝলক কালো ধোঁয়া বেরোলো ওটার মুখ দিয়ে। ছড়িয়ে পড়লো ডেকের ওপর। হাঁচি দিলো কয়েকজন, কাশতে লাগলো অনেকে।

কামানের গোলার জবাব এলো তীর থেকে, গল্পের খেই ধরলেন আবার ক্যাপ্টেন।

সত্যিই এলো জবাব।

কামানের গোলা ফাটলে আর পানিতে পড়লে যেরকম আওয়াজ হয়, তেমন। শব্দ হতে লাগলো লাউডস্পীকারে।

চারটে দ্বীপের প্রথমটার দিকে এগিয়ে চলেছে ব্র্যাক ভালচার। সরু পথ দিয়ে। দ্বীপগুলো একটার সঙ্গে আরেকটা এবং মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত। প্রথম দ্বীপটার পাশ দিয়ে জাহাজ যাওয়ার সময় ঝোঁপের ভেতর থেকে চারটে কার্ডবোর্ডের মূর্তি লাফিয়ে উঠলো। যান্ত্রিক কোনো ব্যবস্থা রয়েছে ওগুলোকে ভোলা এবং নামানোর জন্যে। পুরনো কালের স্প্যানিশ সৈনিকের মূর্তি। ছোট একটা পুরনো কামান, চাকায় গড়িয়ে বেরিয়ে এলো পাথরের আড়াল থেকে। জাহাজ লক্ষ্য করে গোলা ফেললো।

চললো ভয়াবহ লড়াই! বললেন ক্যাপ্টেন ফিলিপ।

বুম করে ধোয়া উদগীরণ করলো আবার জাহাজের কামান। জবাব দিলো। তীরের কামানটা।

শীঘ্রি ডা বুচার্ডের সৈন্যরা তীরে নামলো, বলছেন ক্যাপ্টেন। হটিয়ে দিলো। গভর্নর সোলার সৈন্যদের।

ধীরে এগোচ্ছে ব্ল্যাক ভালচার। গলুইয়ের কাছ থেকে দড়িতে ঝুলে দ্বীপে। নামলো দুজন জলদস্যু, দাঁতে কামড়ে রেখেছে কাঠের ছুরি। ডাঙায় পা দিয়েই কোমর থেকে একটানে ভোজালি বের করে, গালি দিয়ে উঠে কার্ডবোর্ডের সৈন্যগুলোকে আক্রমণ করলো ওরা। ঝোঁপের মধ্যে পড়ে গেল ওগুলো। দুজন। দস্যুই চেনা কিশোর আর মুসার। একজন সেই টিকেট বিক্রেতা, যার বয়েস। আন্দাজ করা যায় না, আরেকজন পিটার ফিলিপ।

কেন ব্যবসা করতে পারছেন না ক্যাপ্টেন, মুসা বললো, বুঝতে পারছি।

আমিও পারছি, শুকনো গলায় বললো, কিশোর।

লাউডস্পীকারে গমগম করছে কণ্ঠ, মনটিরের সমস্ত বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে দস্যুরা, শুধু মিশনারি আর কাস্টোম হাউসটা বাদে। তারপর জাহাজ নিয়ে দক্ষিণে রওনা হলো ওরা। পৌঁছলো গিয়ে রিফোজিও কোভ আর ওরটেগা সিয়েনড়ায়। সমস্ত ধনরত্ন একটা ট্রাংকে ভরে রিফোজিও পাস দিয়ে পালালো ওরটেগারা, সান্তা। ইনেস মিশনে আশ্রয় নেয়ার জন্যে।

দ্বিতীয় দ্বীপটায় পৌঁছলো ব্ল্যাক ভালচার। ঝোঁপ থেকে বেরিয়ে এলো দুজন। মানুষ, মাথায় কাউবয় হ্যাট, পরনে পুরনো ছাঁটের স্যুট। পিটার আর সেই টিকেট বিক্রেতা। প্রথম দ্বীপটা থেকে পায়ে হেঁটে চলে এসেছে এখানে, পোশাক বদলে। নিয়েছে। স্প্যানিশ জমিদার সেজেছে ওরা এখন। ছোট একটা টিলার ওপর দিয়ে একটা ট্রাংক বয়ে নিয়ে চলেছে। লাউডস্পীকারে শোনা যাচ্ছে ছুটন্ত অশ্বারোহী বাহিনী আর জলদস্যুদের চেঁচামেচি।

ঝাঁকে ঝাঁকে জলদস্যু গিয়ে নামলো তীরে, বললেন ক্যাপ্টেন। আগুন। লাগিয়ে দিলো পুরো ওটেগা হাসিয়েনড়ায়।

ঝোঁপের ভেতর হারিয়ে গিয়েছিলো, আবার জলদস্যুর পোশাক পরে বেরিয়ে এলো পিটার আর টিকেট বিক্রেতা। হাতে মশাল। আসল মশাল নয়, তৈরি করা। হয়েছে ঝাড়ুর ডাণ্ডায় লাল প্ল্যাস্টিকের গোলক বসিয়ে। গোলকের ভেতরে ব্যাটারির সাহায্যে ছোট বাল্ব জ্বলছে। একটা স্মোক বম্ব ফাটলো, ছড়িয়ে দিলো ঘন ধোয়া। কার্ডবোর্ড দিয়ে র‍্যাঞ্চ হাউস বানানো হয়েছে। দেয়ালে লাল রঙ করে বোঝাতে চাইছে, আগুন জ্বলছে। চিৎকার করে সেই আগুনের চারপাশে নাচানাচি শুরু করলো দুই জলদস্যু।

উপকূল ধরে এগিয়ে চললো দুটো জাহাজ, বললেন ক্যাপ্টেন। পথে বাড়িঘর যা চোখে পড়লো, সব পুড়িয়ে ছারখার করে দিতে লাগলো। পৌঁছলো। তৎকালীন বুয়েনাভিস্তা কোভে। এখানকার বড় বড় স্প্যানিশ জমিদারেরা শেষ। চেষ্টা করলো লস অ্যাঞ্জেলেস আর স্যান ডিয়েগোর শহরগুলোকে বাঁচানোর।

খাঁড়ির সব চেয়ে বড় দ্বীপটার দিকে এগোচ্ছে জাহাজ। কার্ডবোর্ডের অসংখ্য মূর্তি উঠে দাঁড়াচ্ছে ঝোঁপের ভেতর থেকে। রঙ দিয়ে পোশাক একে বোঝানো হয়েছে কোনটা কোন ধরনের মানুষ। কাঁচা হাতে রঙ করা হয়েছে। বেশির ভাগই রঙ নষ্ট হয়ে গেছে। কিছু মূর্তি ভেঙে গেছে কয়েক জায়গায়। প্রথমে পাহাড়ের। গোড়ায় দেখা দিলো একসারি মূর্তি, আরেক সারি মূর্তি লাফিয়ে উঠলো পানির কিনারে। লাউডস্পীকারে বাজতে লাগলো প্রচণ্ড লড়াইয়ের শব্দ-কামানের গর্জন, জলদস্যু আর স্প্যানিশ সৈন্যদের চিৎকার, তলোয়ারের ঝনঝন। এতো কিছু ঘটছে, কিন্তু দর্শকদের তাতে কোনো প্রতিক্রিয়া হলো না। এমন ভঙ্গিতে তাকিয়ে রয়েছে, যেন পুরো ব্যাপারটাই হাস্যকর আর একঘেয়ে লাগছে তাদের কাছে।

উত্তেজিত করার যথেষ্ট চেষ্টা করছেন ক্যাপ্টেন ফিলিপ। প্রাণপণে যুদ্ধ করলো স্প্যানিশরা, কিন্তু জলদস্যুরাই জিতলো। এখন আমরা যে খাড়িটায় রয়েছি, এটারই নাম ছিলো তখন বুয়েনাভিস্তা কোভ। জলদস্যুরা জেতার পর থেকেই এর নাম হয়ে গেল পাইরেটস কোভ। ডা বুচার্ড আর তার সহযোগীরা ধ্বংস করে দিলো সমস্ত হাসিয়েনড়া, লুটপাট করলো ইচ্ছেমতো। রওনা হলো আরও দক্ষিণে। একের পর এক শহর ধ্বংস করে দিয়ে কেবল এগিয়েই গেল ওরা, ফিরলো না আর কোনোদিনই। তবে পাইরেটস কোভের নাম আর ধ্বংসস্তূপই শুধু ফেলে যায়নি, মূর্তিমান একটা মারণাস্ত্রও ফেলে গিয়েছিলো। তার নাম বেগুনী জলদস্য!

নাটকীয় ভঙ্গিতে শেষ দ্বীপটার দিকে হাত তুললেন ক্যাপ্টেন। সিমেন্টের একটা বেদির ওপর সেখানে দাঁড়িয়ে আছে একটা মূর্তি, হাতের ভোজালিটা কোপ মারার ভঙ্গিতে তুলে রেখেছে। মোটা, খাটো এক লোকের মূর্তি। হ্যাট থেকে শুরু করে পায়ের জুতো পর্যন্ত, সব কিছুর রঙ বেগুনী। ঢোলা বেগুনী আলখেল্লার কিনারে সোনালি কাজ করা। ঢোলা প্যান্টের রঙ বেগুনী। মুখের নাক-ঢাকা বেগুনী মুখোশের নিচে ইয়াবড় পাকানো গোঁফ। বিকট করে তুলেছে চেহারাটাকে। কোমরের বেগুনী বেল্টে ঝুলছে পুরনো ধাচের পিস্তলের খাপ। গোড়ালি ঢাকা উঁচু বুটের ভেতরে ঢোকানো বড় ছুরি।

 লেফেটেন্যান্ট উইলিয়াম ইভানস, বলে চলেছেন ক্যাপ্টেন, সান্তা রোসার। সেকেণ্ড ইন কমাণ্ড। ডা বুচার্ডের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বিদ্রোহ করেছিলো, খুন করেছিলো পেড্রো কোনডেকে। জাহাজে করে চলে এসেছিলো পাইরেটস কোভে। এখানে জলদস্যুদের একটা ঘাঁটি গড়ে তুলেছিলো সে, নিজের জাহাজ করেছিলো, নাম দিয়েছিলো ব্ল্যাক ভালচার। উপকূলে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে রেখেছিলো। বহু বছর ধরে। সব সময় বেগুনী রঙের পোশাক পরে থাকতো সে, যাতে নাম হয়ে যায়। বিখ্যাত হতে পারেনি, সত্যি, তবে ভীষণ কুখ্যাত যে হয়েছিলো তাতে কোনো সন্দেহ নেই। জলে, স্থলে, সবখানে ছিলো তার জয় জয়কার। তার বিরুদ্ধে পাঠানো কোনো সেনাবাহিনীই জিততে পারেনি বহু বছর ধরে। তবে মাঝে মাঝে কোণঠাসা যে হতো না, তা নয়। কোণঠাসা হলেই এসে ঢুকতো তার পাথরের দুর্গে। শক্তি সঞ্চয় করে আবার বেরোতো। পরাজিত করে ছাড়তো হামলাকারীদের। তবে একদিন তার দুর্গ বেগুনী জলদস্যুর আড়ায় ঢুকে আর বেরোলো না সে। সেটা আঠারোশো চল্লিশ সালে। বাইরের সৈন্যরা ভাবলো, আটকে ফেলেছে, এবার ধরতে পারবে। কিন্তু পারলো না। দুর্গের ভেতর থেকেই। গায়েব হয়ে গেল সে। তারপর আর কেউ কোনোদিন দেখেনি তাকে। তার বংশধররাই এখনও এই উপদ্বীপ আর টাওয়ারের মালিক।

ক্যাপ্টেনের কাহিনী শেষ হলো। মুখ ঘোরালো ব্ল্যাক ভালচার, দ্বীপগুলোর। পাশ দিয়ে ফিরে চললো। চার তলা পাথরের দুর্গটা দেখালেন ক্যাপ্টেন। নির্জন, শূন্য লাগছে বাড়িটা।

ফিরে এলো টিকেট বিক্রেতা আর পিটার। শশা শেষ হয়েছে। দর্শকদের মনে কোনোই দাগ কাটতে পারলো না জলদস্যুদের নাটক। শুধু বেগুনী জলদস্যুর কাহিনী যা-ও বা একটু কেটেছে, তা-ও নষ্ট করে দিলো এয়ার ট্যাক্সি সার্ভিসের। একটা বিমানের গর্জন।

লেডিজ অ্যাণ্ড জেন্টলমেন, ক্যাপ্টেন বললেন, আমাদের অভিযান শেষ। হয়েছে। ক্যালিফোর্নিয়ার কুখ্যাত বেগুনী জলদস্যুর ইতিহাস জানলেন আপনারা। ডকে ফিরে যাচ্ছি আমরা। খিদে পেলে খেতে পারেন ওখানে, ব্যবস্থা আছে। সুভনির কিনতে পারে। যতো সময় ইচ্ছে কাটাতে পারবেন ওখানে, কেউ মানা। করবে না। আবার যদি আসতে চান, তা-ও পারেন। পনেরো মিনিটের মধ্যেই আবার শো শুরু হবে।

হেসে উঠলো কয়েকজন, কয়েকজন বিড়বিড় করলো। একটা ব্যাপার। পরিষ্কার হয়ে গেল, দ্বিতীয়বার আর এই ছেলেমানুষী দেখার ইচ্ছে কারো নেই। জাহাজ তীরে ভিড়তেই সিঁড়ি বেয়ে নেমে পড়লো সবাই। সুভনিরের দোকানের সামনে থামলো কয়েকজন। হংকং থেকে আমদানী করা প্ল্যাস্টিকের জাহাজের মডেল, ছুরি, খুদে ভোজালি আর আরও নানারকম জিনিস রয়েছে, জলদস্যুরা যেসব জিনিস ব্যবহার করতো, তার নকল। কেউই তেমন আগ্রহ দেখালো না ওগুলোর প্রতি। মারিয়া, সেই মেকসিকান মেয়েটা টিকেট বিক্রি বন্ধ রেখে এসে এখন খাবারের দোকান চালাচ্ছে। কয়েকটা ছেলে মা-বাবার কাছে বায়না ধরলো। কোক আর হটডগ কিনে দেয়ার জন্যে। কিশোর আর মুসা এসে দাঁড়ালো। ওখানটায়। ক্যাপ্টেন ফিলিপের আসার অপেক্ষায়। কিন্তু তিনি এলেন না। এমনকি তার ছেলে পিটারও না।

আসবে না, মুসা বললো।

তাই মনে হচ্ছে, একমত হলো কিশোর। কিন্তু অন্য সময় থাকে কোথায়? বাড়িটাড়ি নিশ্চয় আছে।

মিউজিয়মের পেছনে উঁকি দিয়ে দেখলো ওরা। কোনো বাড়িঘর চোখে পড়লো না, শুধু ওক গাছের জটলার মাঝে দাঁড়িয়ে রয়েছে পাথরের টাওয়ারটা। তবে খাবারের দোকান আর স্যুভনির স্ট্যাণ্ডের পেছনে বড় একটা হাউস ট্রেলার দেখতে পেলো ওরা। দ্রুত গিয়ে দাঁড়ালো ওটার কাছে। দরজায় লাগানো একটা মলাটের টুকরোর ওপর নাম লেখা রয়েছেঃ ক্যাপ্টেন রোজার ফিলিপ।

পাওয়ার আশা নেই, তবু এগিয়ে গিয়ে দরজায় টোকা দিলো কিশোর। সাড়া মিললো না।

জাহাজ থেকেই নামেননি হয়তো, আন্দাজে বললো মুসা।

আমার তা মনে হয় না। হয়তো ভেতরেই আছেন। টোকা শুনতে পাননি।

ট্রেলারের সামনের দিকে জানালাগুলোয় ভারি পর্দা টানা। পেছনটা ফেরানো রয়েছে খাড়ির দিকে, লম্বা পিয়ার আর কারখানাটা রয়েছে যেদিকে। ওদিকের একটা জানালা খোলা দেখা গেল। উঁকি দিয়ে ভেতরে কি আছে দেখতে গেল। কিশোর।

কি-কি-কিশোর! তোতলাতে লাগলো মুসা।

ঝট করে মাথা ঘোরালো কিশোর। জ্বলন্ত চোখে ওদের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে বেগুনী জলদস্যু। মুখে মুখোশ। হঠাৎ বিকট চিৎকার করে উঠে ভোজালি উঁচিয়ে ছুটে এলো সে।

.

০৭.

ভোজালিটার দিকে তাকিয়ে ঢোক গিললো মুসা। কিশোর চুপ।

দিনে দুপুরে চুরি করতে এসেছো, না! চিৎকার করে বললো বেগুনী জলদস্যুরূপী টিকেট বিক্রেতা।

আ-আ-আমরা ক্যাপ্টেন ফিলিপকে খুঁজছিলাম, মুসা বললো। চো-চো

চুপ! আবার মিছে কথা! জানালা দিয়ে উঁকি মেরে মানুষ খুঁজছিলে! দাঁতে দাঁত ঘষলো লোকটা। দিনেও আসে, রাতেও!

রাতে? কথাটা ধরলো কিশোর। প্রায়ই আসে নাকি?

আসে কিনা জানো না?

এই সময় ট্রেলারের কোণ ঘুরে বেরিয়ে এলো পিটার ফিলিপ। অবাক হয়ে তাকাতে লাগলো তিনজনের দিকে। কিশোর আর মুসাকে চিনতে পারলো। আরি, তোমরা?

তাড়াতাড়ি বললো মুসা, তোমার আব্বাকে খুঁজতে এসেছিলাম, পিটার।

ওদের চেনো? সন্দেহ যায়নি টিকেট বিক্রেতার।

চিনি, জেসন আংকেল। আমাদের ইস্কুলে পড়ে। ওটা নামান।

অনিচ্ছা সত্ত্বেও ভোজালিটা খাপে ভরে রাখলো জেসন। মুখোশ খুললো। গত দুরাত ধরে চোরের আনাগোনা বড্ড বেড়েছে!

জেসন আংকেলেরও দোষ নেই, কৈফিয়তের সুরে বললো পিটার। সন্দেহ হবেই। ইদানীং বড় বেশি চোর আসে। …আংকেল, ও কিশোর পাশা। আর ও মুসা আমান। ওদেরকে বললো, ইনি আব্বার হেলপার; জেসন গিলবার্ট। ডাক। নাম নোনতা জেসন।

নোনতা? বিড়বিড় করলো কিশোর। তারমানে জাহাজে কাজ করেছেন? নাবিক ছিলেন?

নেভিতে বিশ বছর চাকরি করেছি, জেসন বললো।

পাইরেটস কোভে এই প্রথম এসেছি আমরা। ক্যাপ্টেন ফিলিপের সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছে ছিলো। মেজর নিরেকের কথা কিছু জিজ্ঞেস করতাম।

কফি মেশিনটা হঠাৎ খারাপ হয়ে গেল, পিটার বললো। সেটা দেখছে আব্বা। এসো।

কফি স্ট্যাণ্ডেই পাওয়া গেল ক্যাপ্টেনকে। রেগে যাওয়া বেঁটে এক টুরিস্টকে বোঝানোর চেষ্টা করছেন।

ঠকানো হয়েছে আমাদের! ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো লোকটা। পাইরেট শো না ছাই! টাকা ফেরত দিন!

আপনার ভালো লাগেনি, সেজন্যে আমরা দুঃখিত, স্যার, শান্ত কণ্ঠে বললেন ক্যাপ্টেন। কিন্তু টাকা ফেরত দেয়া যাবে না। সব জিনিসই সবার কাছে ভালো লাগবে, এমন কোনো কথা নেই। অমন যে বিখ্যাত ডিজনিল্যাণ্ড, সেটাও তো ভালো লাগে না অনেকের কাছে। তারা কি টাকা ফেরত পায়?

জ্বলে উঠলো লোকটার চোখ। ওরা আপনাদের মতো মিথ্যে কথা বলে না! আপনারা স্রেফ ঠকিয়েছেন। বেশ, দেখে নেবো আমি। বেটার বিজনেস বুরোতে নালিশ করবো!

কাছেই দাঁড়িয়ে থাকা একজন মহিলা আর ছেলেকে ইশারায় সঙ্গে যেতে বলে পার্কিং লটের দিকে এগোলো সে। বেগুনী একটা রুমাল বের করে কপালের ঘাম। মুছলেন ফিলিপ। পিটারের দিকে চোখ পড়তে আফসোস করে বললেন, আর কদ্দিন এভাবে চলবে বুঝতে পারছি না! টাকাও পাচ্ছি না, ঠিকমতো চালাতেও পারছি না সব!

বন্ধই করে দিন, ক্যাপ্টেন, হাত নেড়ে হতাশ কণ্ঠে বললো নোনতা জেসন। হবে না যখন, হবেই না। খালি খালি কষ্ট করে, লোকের কথা শুনে লাভ আছে?

কথাটা পছন্দ হলো না পিটারের। কড়া চোখে একবার জেসনের দিকে তাকিয়ে বাবার দিকে ফিরলো। হবে। চেষ্টা করলেই হবে।

জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেললেন ক্যাপ্টেন। হয়তো হবে। ঘন্টায় পঁচিশ ডলারে যদি গল্প জোগাড় করতে পারে মেজর, আর দিতে থাকে আমাদের, দর্শক ধরে রাখা হয়তো যাবে।

আমি জানি, আব্বা, মেজর পারবে।

স্যার, গলা পরিষ্কার করলো কিশোর। এই ব্যাপারেই আলোচনা করতে এসেছিলাম আমরা।

আলোচনা? কিশোর আর মুসার দিকে তাকিয়ে ভুরু কোঁচকালেন ক্যাপ্টেন। কে তোমরা?

আমাদের ইস্কুলেই পড়ে। পরিচয় করিয়ে দিলো পিটার। মেজর নিরেকের ব্যাপারে কথা বলতে চায় তোমার সঙ্গে।

কি কথা? ক্যাপ্টেন জানতে চাইলেন।

মেজর কি করছেন? বলে উঠলো মুসা।

তাকে সন্দেহ হয় আমাদের, বললো কিশোর।

সন্দেহ! কিশোরের কথার প্রতিধ্বনি করলেন যেন বেগুনী জলদস্যুর আড্ডার মালিক। মেজর নিরেককে সন্দেহ! আশ্চর্য! দিন দিন মানুষগুলো যে সব কি হয়ে যাচ্ছে! নিজের চরকায় তেল দেয়া যেন বন্ধ করে দিয়েছে সবাই!

.

মেজর নিরেক আর রিগোর বেরোনোর অপেক্ষায় রইলো রবিন। বেরোলো ওরা। ভ্যান নিয়ে রওনা হলো। পেছনে চিহ্ন দেখে দেখে অনুসরণ করলো সে।

পাইরেটস, কোভে চলে গেছে চিহ্নগুলো। পার্কিং লট পেরিয়ে গিয়ে ঢুকেছে বেগুনী জলদস্যুর আড়ার ভেতরে। হাতে গোনা কয়েকটা গাড়ি দেখা গেল লটে। মাত্র দুজন দর্শক দাঁড়িয়ে রয়েছে আইস ক্রীম ভ্যানটার সামনে। ওটার পাশ দিয়ে চলে গেছে চিহ্ন। ঢুকে গেছে ছোট বনের ভেতরে। হ্যারিসনস ট্রী সার্ভিসের একজন শ্রমিক ট্রাকের ওপর দাঁড়িয়ে একটা গাছের যেন কি করছে। এদিক ওদিক তাকালো রবিন। ভ্যানটাও চোখে পড়লো না, মেজর কিংবা রিগোকেও দেখলো না। একটা রাস্তা ধরে উত্তরে চলে গেছে চিহ্ন।

ভাবছে রবিন। আইস ক্রীম ভ্যান! ট্রী-সার্ভিস ট্রাক! এসব গাড়ি নিয়ে মেজরের চত্বরে ঢুকেছিলো দুজন ড্রাইভার, তারপর বেরিয়ে গেছে। ওরাই এসেছে এখানে,পাইরেটস কোভে চিহ্ন যখন রয়েছে, মেজরও এসেছেন। কেন? লোকগুলোর সঙ্গে কথা বলে চলে গেছেন আবার?

সাইকেলটা ঝোঁপের ভেতর লুকিয়ে রেখে পা টিপে টিপে ট্রী-সার্ভিসট্রাকটার কাছে চলে এলো রবিন। লোকটাকে দেখলো ভালোমতো। চিনতে পারলো। টনি! কি মনে হতে ফিরে তাকালো আইস ক্রীম বিক্রেতার দিকে। চিনতে পারলো তাকেও। খাটো, মোটা, টাকমাথা লোকটা, যার নাকের নিচে বেমানান গোঁফ।

তার মানে ছদ্মবেশী ওরা সবাই! কেন এসেছে? নিশ্চয় বেগুনী জলদস্যুর হআড়ার ওপর চোখ রাখতে। চব্বিশ ঘন্টাই চোখ রাখার ব্যবস্থা করেছে ওরা।

ট্রাকের পেছনে বসানো লম্বা লিফটটা তুলে নিলো টনি। ওপরে উঠে গেল। তারপর বিনকিউলার বের করে দেখতে লাগলো। কি দেখছে, বুঝতে পারলো না। রবিন। বেড়া আর গাছপালার জন্যে দেখতে পাচ্ছে না সে। দ্রুত মনস্থির করে নিলো। নিরেক আর রিগো কোথায় গেছে, পরেও দেখা যাবে। আপাতত টনি কি দেখছে সেটা জানা দরকার।

গাছপালার ভেতর দিয়ে সরে চলে এলো রবিন, আড্ডার উল্টোদিকে। ফিরে তাকালো। ডানে নজর লোকটার। কারো দিকে না তাকিয়ে হেঁটে চললো রবিন। আইস ক্রীম ওয়ালার পাশ কাটালো। টিকেট বুঁদ বন্ধ হয়ে গেছে, তবে গেট খোলা। ঢুকে পড়লো সে। হঠাৎ মোড় নিয়ে ঢুকে গেল ওকের জঙ্গলের মধ্যে, যেগুলোর অন্যপাশে রয়েছে পাথরের টাওয়ারটা।

টাওয়ারের কাছে এসে থামলো সে। চারতলা পুরনো বাড়ি। উপদ্বীপের উত্তরে, পানির ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। কাঠের বেড়া দেয়া আছে, রাস্তা থেকে সরাসরি যাতে কেউ ঢুকতে না পারে এখানে। গাছপালার পরে, টাওয়ারের লাগোয়া আর কিছু নেই, শুধু লন, আর বালিতে ঢাকা চত্বর। পুরনো একটা বোটহাউস রয়েছে, ধসে পড়েছে এখন। কি দেখছে টনি? টাওয়ার? না ওই ভাঙা বোট-হাউস? বোট হাউসের ভেতরেই প্রথমে দেখার সিদ্ধান্ত নিলো রবিন।

কালচে হয়ে গেছে বোটহাউসের তক্তাগুলো। ক্ষয়া। সামনের দিকে একটামাত্র জানালা। বড় দরজাটা বন্ধ। বাঁয়ে কাত হয়ে রয়েছে ঘরটা, বেশ কিছু তক্তা খসে গেছে। বেগুনী জলদস্যুর আমল থেকেই বোধহয় আছে ওটা ওখানে।

জানালা দিয়ে ভেতরে উঁকি দিলো সে। চোখে পড়লো শুধু কালো পানি। দরজায় ঠেলা দিয়ে খোলার চেষ্টা করলো।

আচমকা শক্ত কি যেন লাগলো পিঠে। ঠেসে ধরা হয়েছে।

 ঘোরো, খোকা, আদেশ দিলো একটা ভারি কণ্ঠ। খুব ধীরে।

ঘুরে দাঁড়ালো রবিন। চওড়া কাঁধ, মাঝারি উচ্চতার একজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। পরনে শাদা ট্রাউজার, পায়ে দড়ির স্যাণ্ডাল, গায়ে নীল টি-শার্ট। হাতের। পিস্তলটা ধরে রেখেছে রবিনের পেট বরাবর।

.

০৮.

ক্যাপ্টেন ফিলিপ এভাবে নিরাশ করবেন, ভাবেনি কিশোর আর মুসা। যাওয়ার জন্যে ঘুরলো।

পিটার বলে উঠলো, আব্বা, ওদেরকে আমি চিনি। কি বলতে এসেছে, অন্তত শোনো তো?

আরে দূর! কি আবার বলবে? গোলমাল পাকাতে এসেছে, হাত নেড়ে উড়িয়ে দিলো যেন নোনতা জেসন। যাক, বেরিয়ে যাক।

অতোটা রুক্ষ ব্যবহার করলেন না ক্যাপ্টেন। আমার কাজ আছে। ঠিক আছে, পাঁচ মিনিট সময় দিলাম। জেসন, টিকেট বুদে যাও। এই, তোমরা এসো আমার সঙ্গে।

দুই গোয়েন্দাকে ট্রেলারে নিয়ে এলেন ক্যাপ্টেন। কাউচ দেখিয়ে ওদেরকে বসার ইঙ্গিত করলেন। পিটার বসলো একটা চেয়ারের হাতলে।

বলে ফেলো, ফিলিপ বললেন।

দুদিন আগের সাক্ষাৎকারের কথা সংক্ষেপে বললো কিশোর। কি করে ঠকিয়েছেন মেজর, সে কথাও জানালো।

ঠকালো কোথায়? প্রশ্ন তুললেন ক্যাপ্টেন। গল্প পছন্দ হয়নি, টাকা দেয়নি, ব্যস। মুছে ফেলেছে। পছন্দ না হলে টাকা কেন দেবে?

বিজ্ঞাপনে তো সেকথা বলেনি, মুসা বললো। বলেছে, যে-ই গল্প শোনাবে, তাকেই দেবে।

এটা হতে পারে না। যে যা খুশি শুনিয়ে আসবে, তার জন্যেই টাকা দিতে হবে নাকি? বিজ্ঞাপনটা লেখা হয়নি ঠিকমতো।

বেশ, ধরে নিলাম লেখা হয়নি। কিন্তু গল্প পুরোটা না শুনেই কি করে বুঝলেন। উনি, ভালো না মন্দ? শুরু করতে না করতেই তো থামিয়ে দিয়েছেন অনেককে। কিশোর বললো।

যে বোঝার সে অল্প শুনেই বুঝতে পারে। তাছাড়া পয়লা দিন অনেক বেশি লোক চলে এসেছিলো। কি করে শুনবে এতো লোকের গল্প? বরং বুদ্ধিটা ভালোই। বের করেছিলো, শহরের বাইরে থেকে যারা এসেছিলো তাদের গল্প শুনবে।

তাহলে ওকথাও বিজ্ঞাপনে লিখে দিতে পারতো, পিটার বললো। শহরের ভেতরের কারো গল্প যদি না-ই শুনবে তাহলে ঢালাও ঘোষণা দেয়া কেন? অবিচার করা হলো না? ডেকে এনে ফিরিয়ে দেয়া? আমি হলে সোজা গিয়ে পুলিশকে রিপোর্ট করে দিতাম। ..

ছেলের কথার জবাব দিতে পারলেন না ক্যাপ্টেন। দ্বিধা করলেন। ইয়ে…

চাপটা বাড়ালো কিশোর, লোকের বাড়ি বাড়ি সার্কুলার দিয়ে আসার কি প্রয়োজন ছিলো? সাক্ষাঙ্কারই যদি না নেবে, কেন এই অহেতুক হয়রানী?

তা ঠিক, গাল চুলকালেন ক্যাপ্টেন। তবে মনে হয় আমার আর পিটারের গল্পই শুধু শুনতে চেয়েছে।

তাহলে শুধু আপনাকে ডেকে নিয়ে গেলেই পারতেন। আর তা-ই বা কি করে বলবেন? আপনার বলে আসা গল্পও তো মুছে ফেলেছেন মেজর।

আমারটাও মুছেছেন!

 নিজের চোখে দেখেছি! জোর পেয়ে প্রায় চেঁচিয়ে উঠলো মুসা।

অসম্ভব! তোমরা কি জন্যে এসেছো…

আব্বা, বাধা দিয়ে বললো পিটার, ঘাপলা একটা আছে। মুসা আর কিশোর– খুব ভালো গোয়েন্দা। আমার মনে হয় না ওরা ভুল করছে।

ডিটেকটিভ? এই বয়েসে অনেক ছেলেই গোয়েন্দা সাজতে চায়। এক ধরনের খেলা।

মোটেও খেলা নয়, স্যার। গম্ভীর হয়ে গেছে কিশোর। পকেট থেকে প্রথমে তিন গোয়েন্দার কার্ড, তারপর পুলিস ক্যাপ্টেন ইয়ান ফ্লেচারের প্রশংসাপত্র বের করে দিলো।

পড়লেন ফিলিপ। মাথা দোলালেন। হু, পুলিসের একজন চীফ ফালতু কথা বলবেন না। তোমাদের সম্পর্কে খুব উঁচু ধারণা তার। কিন্তু কিশোর, মানুষ মাত্রেই ভুল করে। আমার বিশ্বাস, মেজরের ব্যাপারেও তোমরা ভুল করছে।

আগে বলো তাহলে, চেপে ধরলো পিটার, তোমার গল্প মুছলো কেন?

হতে পারে, টেকনিক্যাল কোনো কারণ ছিলো। কিংবা পরে বিশেষ টেপে। রেকর্ড করার কথা ভেবেছিলো। দুদিন ধরেই তো আমাদের সাক্ষাৎকার নিচ্ছে। ওগুলো নিশ্চয় মুছছে না।

জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন, স্যার, পরামর্শ দিলো কিশোর।

ভ্রূকুটি করলেন ক্যাপ্টেন। দীর্ঘ একটা মুহূর্ত কিশোরের দিকে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার বক্তব্যটা কি, বলে ফেলো তো?

আমার ধারণা, পুরো ঘটনাটাই ঘটিয়েছেন মেজর, আপনাকে আর পিটারকে হাতে পাওয়ার জন্যে।

কিন্তু আগে কখনও পরিচয় ছিলো না মেজরের সঙ্গে! কখনও তার নামও শুনিনি। আমাদের কাছে কি চায়? টাকা নেই, পয়সা নেই, কিচ্ছু নেই আমাদের। এই শো বিজনেস চালিয়ে কোনোমতে খেয়েপরে বেঁচে আছি। তা-ও যায় যায় অবস্থা।

কিন্তু বিরাট এলাকা আপনার, মুসা বললো। অনেক জমি। হয়তো ওগুলো চায়?

আমার জমি নয় এটা, মুসা। ইভান পরিবারের কাছ থেকে লীজ নিয়েছি।

ইভান পরিবার? চোখে জিজ্ঞাসা নিয়ে তাকালো কিশোর।

মাথা ঝাঁকালেন ক্যাপ্টেন। হ্যাঁ। পুরনো সেই জলদস্যুর বংশধর। এই কোভের মালিক এখনও ওরাই।

আপনি না বললেন ইভান গায়েব হয়ে গেছে? মুসার প্রশ্ন।

হাসলেন ক্যাপ্টেন। গিয়েছিলো। তারপর আবার ফিরে এসেছে। নতুন বেশে। তবে সেকথা বলি না শো-এর সময়। অযথা নাটকটা নষ্ট করে লাভ কি? স্রেফ গায়েব হয়ে যাওয়ার মধ্যে একটা অন্যরকম ব্যাপার থাকে।

কিশোর জিজ্ঞেস করলো, রাতে নাকি এখানে চোর আসে?

চোর কিনা বলতে পারবো না। রাতে ঘুরতেও বেরোয় অনেক মানুষ, নির্জন। জায়গা দেখলে বেড়াতে চলে আসে। তাছাড়া কাছে দিয়েই গেছে রেললাইন। কাজেই দুচারটে ভবঘুরে যে নেমে না পড়ে তা নয়। আমাদের বড়িঘরগুলোকে ঘুমানোর জায়গা হিসেবে বেছে নেয়। কিশোরের দিকে তাকালেন ক্যাপ্টেন। দেখো, মেজরের ব্যাপারে ভুল করছো তোমরা। এমন কিছু নেই আমাদের কাছে, যার জন্যে আমরা তার কাছে দামী হয়ে যাবো।

আব্বা, শেষ চেষ্টা করলো পিটার, কিছু না হোক, তিন গোয়েন্দাকে কাজ করতে দিতে অসুবিধে কি আমাদের? কিছু বেরিয়েও তো যেতে পারে?

না, দরকার নেই, দৃঢ়কণ্ঠে বললেন ক্যাপ্টেন। অযথা ভালো মানুষকে হয়রানী করা আমার পছন্দ নয়। তাছাড়া ভালো টাকা দিচ্ছে আমাদেরকে মেজর। এক ঘন্টা গল্প বলার জন্যে কে পঁচিশ ডলার করে দেবে? আমি সেটা হারাতে চাই না। তোমরা ওকে খোঁচাতে যাবে না, ঠিক আছে?

কিশোর কিংবা মুসা জবাব দেয়ার আগেই বাইরে থেকে ডাক শোনা গেল, ফিলিপ! দরজা খুলুন! বলেছিলাম না, চোর আসে!

.

০৯.

ভিকটর ইভানস! উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিলেন ক্যাপ্টেন।

নীল টি-শার্ট পরা মাঝারি উচ্চতার একজন মানুষ ট্রেলারে ঢুকলো। মুখ রাগে। লাল। এই ফিলিপ, বলেছিলাম না খেয়াল রাখতে? টাওয়ারে লোক যায় কেন? একটা ছেলে বোটহাউসে ঢোকার চেষ্টা করছিলো। জিজ্ঞেস করলাম, বললো গোয়েন্দা। ইহ! আপনার কাজ নাকি করছে।

রবিন! প্রায় একসঙ্গে বলে উঠলো কিশোর আর মুসা।

কী? দরজা দিয়ে বাইরে উঁকি দিলো ভিকটর। এই ছেলে, এসো, ঢোকো। রবিন ট্রেলারে ঢুকলে তাকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলো, এটাকে চেনো, ফিলিপ? চোর-টোর না তো?

না! গরম হয়ে বললো মুসা। চোর আমরা কেউই নই।

চোখ পাকিয়ে মুসার দিকে তাকালো আগন্তুক। তোমার সঙ্গে কথা বলে কে? ফিলিপ, এটাকে ওরা চেনে কি করে?

সরি, ভিকটর, ক্যাপ্টেন বললেন, আপনাকে বিরক্ত করেছে। ওদের হয়ে আমি মাপ চাইছি। ওরা পিটারের বন্ধু। আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে…।

 তাড়াতাড়ি বাধা দিয়ে বললো কিশোর, বেগুনী জলদস্যুর কাহিনী শুনতে, স্যার। ইস্কুলের ম্যাগাজিনে লিখবো। ওর নাম রবিন, গবেষণার কাজগুলো সে-ই করে। তিনজনে একসাথে কাজ করি আমরা। জায়গাটা ভালোমতো দেখতে গিয়েছিলো, বর্ণনা দেয়ার জন্যে। আপনাকে বিরক্ত করার, কিংবা আপনার জায়গার ক্ষতি করার কোনো ইচ্ছেই ওর নেই। টাওয়ারে তাহলে আপনিই থাকেন। ভিকটর ইভানস, তার মানে কি বেগুনী জলদস্যু উইলিয়াম ইভানসের বংশধর আপনি?

মোরগের মতো ঘাড় কাত করে কিশোরের দিকে তাকালো ভিকটর। খুব। চালাক মনে হচ্ছে? ম্যাগাজিনে লেখ বা জাহান্নামে লেখ, সেটা তোমাদের ব্যাপার। খবরদার, আমার এলাকার ধারেকাছে আসবে না! ওকের সারিটার দিকে আর যাবে না, মনে থাকে যেন। ক্যাপ্টেনের দিকে ফিরে বললো, এবার ছেড়ে দিলাম। আপনাকেও বলে দিচ্ছি, টুরিস্ট হোক আর যে-ই হোক, আমার সীমানায় যেন না ঢোকে।

ঢুকবে না, কথা দিলেন ফিলিপ।

না ঢুকলেই ভালো। বেরিয়ে গেল ভিকটর। দড়াম করে লাগিয়ে দিয়ে গেল ট্রেলারের দরজা।

লোকটা বেরিয়ে যেতেই কিশোরের দিকে ফিরলেন ক্যাপ্টেন। আসল কথা ভিকটরকে বললে না কেন?

কথা গোপন রাখতে হয় গোয়েন্দাদের। যাকেতাকে সব বলে দেয়া উচিত না। মিস্টার ইভানসকে চিনি না, কি কাজ করে তা-ও জানি না। অচেনা একজন মানুষকে পেটের কথা কেন বলবো?

তা বটে, আনমনে ঘাড় দোলালেন ক্যাপ্টেন।

 চোরের ওপর খুব রেগে আছে মনে হয়?

চোরকে কে পছন্দ করে? তাছাড়া বিনা অনুমতিতে কেউ ওর এলাকায় ঢুকলে রাগ তো করবেই।

 আচ্ছা, মুসা বললো, জলদস্যু আবার সম্পত্তির মালিক হয় কি করে? সেটা। আবার বংশধরদের জন্যে রেখেও যায়? মানে, নিজেই তো একটা অপরাধী। রাষ্ট্র। কি স্বীকৃতি দেয়?

ক্যাপ্টেন হাসলেন। উইলিয়াম ইভানস খুব চালাক মানুষ ছিলো, মুসা। শুনেছো, কখনও ধরা পড়েনি সে। ১৮৪০ সালের সেই দিনে টাওয়ার থেকে গায়েব হয়ে যায়। কিন্তু স্ত্রী আর ছেলেমেয়েদের রেখে যায়। আঠারোশো আটচল্লিশ সালে আবার এসে হাজির হয় একদিন, আমেরিকান সৈনিকের বেশে, মেকসিকানদের বিরুদ্ধে লড়াই চলছে তখন। আমেরিকা জিতলো, ক্যালিফোর্নিয়া হয়ে গেল। ইউনাইটেড স্টেটসের অংশ। যুদ্ধে জেতার পুরস্কার হিসেবে আমেরিকান সরকারের কাছ থেকে তার জায়গা ফেরত পায় ইভানস। কারণ, কেউ প্রমাণ। করতে পারেনি যে সে-ই বেগুনী জলদস্যু। তখন আঙুলের ছাপ দেখে অপরাধী। ধরার উপায় জানা ছিলো না কারো। বেগুনী জলদস্যু কখনও ধরাও পড়েনি কারো। হাতে। তার কোনো ছবি ছিলো না, যা দেখে বলবে বেগুনী জলদস্যু আর উইলিয়াম ইভানস একই লোক। কাজেই সৈনিক হিসেবে জায়গাটা সরকারের কাছ থেকে নিতে কোনো অসুবিধে হলো না তার। তার পর অনেক বছর গেল। তার বংশধরেরা জায়গা বিক্রি করে করে ছোট করে ফেললো। বাকি রইলো শুধু ওই টাওয়ার আর উপদ্বীপটা। ভিকটরও কোথায় চলে গিয়েছিলো। বহু বছর পরে আবার ফিরে এসেছে।

কতো দিন আগে? জিজ্ঞেস করলো কিশোর।

এই বছর খানেক।

এতো দিন! হতাশই মনে হলো কিশোরকে।

ঘড়ি দেখলেন ক্যাপ্টেন। এহূহে, পরের শো-এর সময় হয়ে গেছে।

তুমি যাও, আব্বা, আমি আসছি। তিন গোয়েন্দার সঙ্গে বেরোলো পিটার। বাইরে উজ্জ্বল রোদ, লুকোচুরি খেলছে যেন গাছপালার ফাঁকে। গেটের বাইরে সারি দিয়ে দাঁড়িয়েছে কয়েকজন দর্শক।

সত্যি কি মেজর আমাদের সঙ্গে ফাঁকিবাজি করছে? পিটারের প্রশ্ন।

করছে, জবাব দিলো কিশোর। তাতে কোনো সন্দেহ নেই আমার।

যা দেখলাম আজ, রবিন বললো কিশোরের সঙ্গে সুর মিলিয়ে, তাতে সন্দেহ আমারও নেই।

ছদ্মবেশে এসে টনি আর আইসক্রীমওয়ালাকে কি করতে দেখেছে, খুলে বললো সে। আলুর বস্তা, ব্যাটারি আর মাটি খোঁড়ার যন্ত্রপাতিগুলোর কথাও বললো।

শুনে পিটার বললো, চলো, আব্বাকে গিয়ে সব বলি!

মাথা নাড়লো কিশোর। লাভ হবে না এখন বলে। আমাদের কথা বিশ্বাস করতে চাইবেন না। আরও জোরালো প্রমাণ জোগাড় করতে হবে আমাদের। জানার চেষ্টা করবো, মেজর আর তার চেলারা কিসের পেছনে লেগেছে। রবিন, বেগুনী জলদস্যুর কথা লোকাল হিস্টরি কি বলে, জানার চেষ্টা করো। মুসা, তুমি পাইরেটস কোভের ইতিহাস জানবে। আর আমি জানবো, ক্যাপ্টেন ফিলিপের অতীত কি বলে। পিটার, তুমি কি চাও এই রহস্যের সমাধান হোক?

নিশ্চয়ই চাই, আগ্রহের সঙ্গে বললো পিটার। আমাকে কি করতে হবে?

মাথা খাটাবে। তোমার বাবার অতীত জানার চেষ্টা করবে। মেজর নিরেক তার ব্যাপারে ইন্টারেস্টেড কেন, বোঝা দরকার। তোমাদের শেষ শশা তো। চারটেয়। আমাদের স্যালভিজ ইয়ার্ডে কখন দেখা করতে পারবে?

সাড়ে পাঁচটায়?

 গুড। তোমরা?

আমি পারবো, জবাব দিলো রবিন।

আমিও, বললো মুসা।

বেশ, কাজে নেমে পড়া যাক তাহলে। সাড়ে পাঁচটায় হেডকোয়ার্টারে দেখা করবো আমরা। আলোচনা করবো, এর পর কি করা যায়।

.

১০.

কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে পাঁচটায় পাশা স্যালভিজ ইয়ার্ডে ঢুকলো পিটার। জঞ্জালের স্কুপের কাছে দাঁড়িয়ে তাকালো এদিক ওদিক। তিন গোয়েন্দার ছায়াও চোখে পড়লো না।

এই ছেলে, কি চাও? কোমল কণ্ঠে প্রশ্ন হলো।

চমকে ফিরে তাকালো পিটার। একজন সুন্দরী মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন তার পেছনে।

আমি…আমি কিশোর, রবিন আর মুসাকে…

ও। আমি কিশোরের মা, মারিয়া পাশা। বাইরের লোকের কাছে নিজেকে কিশোরের মা বলে পরিচয় দেন মেরিচাচী। ওদেরকে খুঁজছো? হেসে হাত নাড়লেন তিনি। গায়েব। সারাটা দিন দেখা নেই। খানিক আগে যা-ও বা ছায়াটা। দেখলাম, তারপরেই দেখি আবার গায়েব।

এখানে আছে?

ছিলো, পাঁচ মিনিট আগেও। জ্যান্ত রাডার একেকটা!.. আমি জানার আগেই কি করে জানি জেনে যায় কাজের জন্যে ডাকবো ওদের। নিজেদের ইচ্ছে হলে আমাকে কিছু বলতে হয় না, অসম্ভব খাটে। কিন্তু ইচ্ছে না। হলে.. বাক্যটা শেষ না করে হাত নেড়ে বুঝিয়ে দিলেন মেরিচাচী, ওরা কি করে। গত কদিন ধরে ভালোই ছিলো, কাজটাজ ঠিকমতো করছিলো। আজকেই বদলে গেছে। নিশ্চয় নতুন কেস পেয়েছে। তা কি নাম তোমার?

পিটার ফিলিপ।

ও। তো পিটার, তুমি বরং আজ চলেই যাও। আরেকদিন এসো। ওরা আজ আর বেরোবে বলে মনে হয় না। জমানো কাজ যতোক্ষণ না অন্যকে দিয়ে শেষ। করাচ্ছি, ওরা আর বেরোচ্ছে না…

কিন্তু আমাকে তো আসতে বলে দিয়েছে। আরেকটু থাকি?

থাকতে পারো। তোমার ইচ্ছে। ওই যে, ওটা কিশোরের ওয়ার্কশপ। ওখানে বেঞ্চ আছে, গিয়ে বসো। তবে ওদেরকে আজ আর পাবে বলে মনে হয় না। হেসে, ইয়ার্ডের অফিসের দিকে রওনা হয়ে গেলেন মেরিচাচী।

সব চেয়ে বড় জঞ্জালের স্তূপটার পাশে ওয়ার্কশপ, সহজেই খুঁজে পেলো। পিটার। সাইকেলটা বাইরে রেখে ঢুকলো ভেতরে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই কানে এলো ডাক। ফিসফিসিয়ে ডাকলো তার নাম ধরে কেউ, পিটার!

কেমন যেন ফাঁপা শোনালো ডাকটা। ভীষণ চমকে গেল পিটার। চারপাশে। তাকিয়ে কিছুই চোখে পড়লো না।

 আরে ওখানে না, এখানে!

পিটারের মনে হলো, বিশাল জঞ্জালের স্তূপের ভেতর থেকেই আসছে কথা।

মু-মু-মুসা! তোতলাতে শুরু করলো পিটার। কি-কি-কি-কিশোর!

শশশ! আবার শোনা গেল ফিসফিসানি। আস্তে বলো! মেরিচাচী শুনলেই ধরে নিয়ে গিয়ে কাজে লাগিয়ে দেবে! কেসফেস সব শেষ হয়ে যাবে। তাহলে।

চারদিকে তাকালে আবার পিটার, ওপরে তাকালো, নিচে তাকালো। কাউকেই চোখে পড়লো না। বেগুনী জলদস্যু

হেসে উঠলো অদৃশ্য কণ্ঠটা। বাইরে গিয়ে দেখে এসো, মেরিচাচী আছে। কিনা। তারপর ঢুকে পড়ো এই পাইপটায়! জলদি করো!

মোটা পাইপটার দিকে তাকালো পিটার। জঞ্জালের নিচে হারিয়ে গেছে ওটা, শুধু মুখ বেরিয়ে রয়েছে। চট করে গিয়ে দেখে এলো কেউ আছে কিনা। তারপর হাত-পায়ের ওপর ভর দিয়ে উবু হয়ে উঁকি দিলো পাইপের ভেতরে। আবছা আলোয় দেখলো মুসার মুখ। উপুড় হয়ে পাইপের ভেতরে শুয়ে আছে সে। চোখাচোখি হতেই হাসলো।

এটার নাম দুই সুড়ঙ্গ, বললো মুসা। হেড-কোয়ার্টারে ঢোকার আরও পথ আছে। তবে এটাই বেশি ব্যবহার করি আমরা।

হেডকোয়ার্টার! ওই মালপত্রের তলায় বসে কথা বলো তোমরা?

বলি, হাসলো আবার মুসা। এসো।

ঢুকে পড়লো পিটার। মুসার পিছে পিছে হামাগুড়ি দিয়ে এগোলো। মাথার ওপর দেখা গেল একটা চারকোণা ফোকর, আলো আসছে ওপথে। ওটা। ট্র্যাপোের, পরে বুঝলো সে। ওই পথে ঢুকলো একটা ঘরের মধ্যে। চেয়ার, টেবিল, ফাইলিং কেবিনেট আর আরও নানারকম জিনিস আর যন্ত্রপাতি রয়েছে ওই ঘরে। এমনকি একটা স্টাফ করা কাক পর্যন্ত সাজানো রয়েছে বুককেসের ওপর। তার দিকে তাকিয়ে হাসলো কিশোর আর রবিন।

আশ্চর্য! অবাক হয়ে দেখছে পিটার। এ-তো দেখি ঘর! আমি ভেবেছিলাম। জঞ্জালের তলায় খানিকটা জায়গা পরিষ্কার করে নিয়েছো বুঝি।

এটা একটা ট্রেলার। তোমাদেরটার মতোই, রবিন বললো। তবে ছোট।

আমরা এখানে থাকলে বাইরে কেউ দেখতে পায় না, মুসা বললো। কিন্তু আমরা দেখি, এই পেরিস্কোপটা দিয়ে। এটার নাম দিয়েছি আমরা সর্ব-দর্শন, বাংলা। নাম।

এখানে ঢুকে বসে থাকলে, কিশোর বললো, কারো পক্ষে খুঁজে বের করাও কঠিন।

এমনকি মেরিচাচীর কাছ থেকেও নিরাপদ, হেসে বললো মুসা। যেই দেখি। বেশি কাজ, পালিয়ে আসি এখানে। হাহ্ হাহ!

তার সঙ্গে যোগ দিয়ে সবাই হাসলো। একটা চেয়ার দেখিয়ে পিটারকে বসতে ইশারা করলো কিশোর। বললো, তারপর, পিটার, তোমার বাবার অতীত কিছু জানতে পারলে?

কিছু না। সারাটা বিকেল ভেবেছি। যতোদূর মনে পড়ে আমার, রকি বীচেই বাস করছি। কখনও কোনো গোলমালে জড়ায়নি আব্বা, অপরাধ করেনি। আগে। আমার আম্মাকে নিয়ে স্যান ফ্রানসিসকোয় থাকতো আব্বা, যখন নেভিতে চাকরি করতো। আম্মা মারা যাওয়ার পর আমাকে নিয়ে এখানে চলে এলো, তখনও আমি কিছু বুঝি না। একটা মাছধরা জাহাজ কিছুদিন ভাড়া নিয়েছে আব্বা। তারপর ইভানসদের জায়গাটা লীজ নিয়ে এই বেগুনী জলদস্যুর ব্যবসা খুলেছে।

মাথা ঝাঁকালো কিশোর। হ্যাঁ, ঠিক এসবই জেনেছি আমিও তোমার আব্বার সম্পর্কে। অস্বাভাবিক কিছুই নেই। রবিন, বেগুনী জলদস্যুর কথা তুমি কি জানলে?

বেশি কিছু না। প্রায় সবই তো তোমরা জেনেছো ক্যাপ্টেন ফিলিপের কাছে, শো-এর সময়। স্প্যানিশরা শিওর, উইলিয়াম ইভানসই বেগুনী জলদস্য, কিন্তু কোনোদিন প্রমাণ করতে পারেনি সেটা। কয়েকবার তার টাওয়ারে তাকে আটক করেছে, কিন্তু ধরতে পারেনি। চেহারাও দেখেনি। শেষ বার আটকানোর পর সবার চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়ে গেল, ফিরে এলো একজন সম্মানিত আমেরিকান নাগরিক হয়ে।

মুসা বললো, পাইরেটস কোভের ব্যাপারে খোঁজ নিয়েছি আমি। অনেক আর্টিক্যাল লেখা হয়েছে জায়গাটাকে নিয়ে, গোটা দুই আস্ত বইও আছে। বেগুনী। জলদস্যু ছাড়াও আরও অনেকে জায়গাটাকে তাদের আস্তানা বানিয়েছিলো বিভিন্ন সময়। সবাই ওরা অপরাধী। চোরাচালানী, চোর-ডাকাত, খুনী, এসব ধরনের লোক। যো রকমের অন্যায় কাজ হতে পারে, সব ঘটেছে ওখানে। তবে ফিলিপ কিংবা নিরেক নামের কেউ, এমনকি শুধু উইলিয়াম ইভানস ছাড়া ইভানস নামের আর কোনো অপরাধীও ছিলো না কখনো ওখানে।

ভ্রূকুটি করলো কিশোর। হু। বিশেষ কিছু জানা গেল না। সূত্র বলতে একটাই দেখতে পাচ্ছি, বেগুনী জলদস্যু। বুঝতে পারছি, মেজর নিরেক আর তাঁর চেলারা গিয়ে মাটি খোঁড়াখুঁড়ি করছে কোনো কারণে। কিন্তু আঁড়ার ওপর কেন চোখ। রেখেছে বোঝা যাচ্ছে না। পিটারের আব্বার সঙ্গেই বা কেন দীর্ঘ সাক্ষাত্তারের ব্যবস্থা করেছে, সেটাও দুর্বোধ্য।

গুপ্তধন লুকানো নেই তো? মুসার প্রশ্ন। জলদস্যুদের গুপ্তধন? ক্যাপ্টেন। ফিলিপকে ভুলিয়ে ভালিয়ে সরিয়ে রেখে হয়তো সেসব খুঁজছে ওরা।

যাতে নিরাপদে নিয়ে পালাতে পারে, মুসার কথার পিঠে বললো রবিন।

কথাটা ভেবে দেখলো কিশোর। অসম্ভব নয়। ক্যাপ্টেনের গল্প শোনার আরও কারণ থাকতে পারে। মেজর হয়তো ভেবেছেন, এমন কিছু জানেন ফিলিপ, যেটা জানা থাকলে ধনরত্ব খুঁজে বের করতে সুবিধে হবে।

তাহলে আব্বা খুঁজছে না কেন? পিটার প্রশ্ন তুললো।

হয়তো তিনি জানেনই না গুপ্তধনের কথা। কিন্তু মেজর জানেন। তোমার। আব্বার গল্প শুনে আন্দাজ করতে পারবেন হয়তো, কোথায় রয়েছে ওগুলো। হয়তো সূত্র পাবেন। কারণ বেগুনী জলদস্যুর সম্পর্কে অনেকের চেয়ে অনেক বেশি জানেন তোমার আব্বা।

তাহলে হয়তো ইতিমধ্যেই মেজর সব জেনে ফেলেছে।

মনে হয় না। তাহলে ওই সাক্ষাৎকার বন্ধ হয়ে যেতো, এখনও চলতো না। আড্ডার ওপর ওভাবে চব্বিশ ঘন্টা নজর রাখারও ব্যবস্থা করতো না। জাস্ট তুলে নিয়ে চলে যেতো। সাক্ষাৎকারে কি কি বলেছেন ক্যাপ্টেন, সব আমাদের জানা দরকার।

পিটার বললো, আমি সাহায্য করতে পারি। ছোট একটা টেপ রেকর্ডার নিয়ে যেতে পারি সঙ্গে করে, আব্বা যা যা বলে তুলে আনতে পারি।

হ্যাঁ, তা পারো, পিটারের দিকে তাকিয়ে রয়েছে কিশোর। কাল রাতেও তোমার আব্বার সঙ্গে গিয়েছিলে। সব সময়ই যাও।

হ্যাঁ, যাই, কিশোরের কথায় অবাক হয়েছে পিটার। মেজরই যেতে বলে আমাকে। প্রায় জোরই করে। বলে, বছরের পর বছর আমাকে জলদস্যুদের গল্প শুনিয়েছে আমার আব্বা, অনেক কিছুই মনে আছে। এমন কিছু হয়তো বলে ফেলতে পারবো, যা আব্বা ভুলে বলেনি। মনে করিয়ে দিতে পারবো।

উজ্জ্বল হলো কিশোরের চোখ। সন্ধ্যায় যখন সাক্ষাৎকার দিতে যাও, তখন। কি মেজর থাকেন?

মাথা নাড়লো পিটার। কখনও না। অন্য লোক থাকে। কথা রেকর্ড করে নেয়।

নোনতা জেসন কোথায় থাকে ওই সময়টায়?

 রকি বীচে ঘর ভাড়া নিয়েছে। রাতে ওখানেই থাকে।

তুমি আর তোমার আব্বা ছাড়া আর কেউ থাকে আড্ডায়?

 না। শুধু ভিকটর ইভানস।

আরেকটা কথা। কতোক্ষণ ধরে সাক্ষাঙ্কার চলে?

নটা থেকে এগারোটা।

ঠিক আছে। আজ রাতেও তো সাক্ষাৎকার দিতে যাবে। ঘরের এয়ারকুলারটা বন্ধ করে দেবে। যাতে লোকটা বুঝতে না পারে। আর একটা জানালা খুলে ফাঁক করে রাখবে। কি কি কথা হয়, শুনতে চাই।

চোখে বিস্ময় নিয়ে তিনজনেই তাকিয়ে রইলো গোয়েন্দাপ্রধানের দিকে।

রহস্যটা বোধহয় আন্দাজ করে ফেলেছি, আনমনে নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটলো একবার কিশোর। আশা করছি, আজ রাতেই সমাধান হয়ে যাবে।

Super User