কি বলতে চেয়েছিল ও? জানতে চাইল জেমস অ্যালেন।
তিনটে পোস্টার আছে, বলেছিল ও। আর তোমার পরিচয়।
রেমন্ডকে জানিয়েছ? রোজালিনা খুব বেশি সাহস দেখিয়ে ফেলেছে, ভাবল ও, লপার আর কুশারের বিপক্ষে শহরবাসীকে সংগঠিত করতে চেয়েছিল। ওর প্রতি যে অন্যায় করেছিল তারা, সেটা জানিয়ে জেমসের পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে চেয়েছে। অথচ কিছুই জানে না ও! মেয়েটার মাথায় এ চিন্তা এল কোত্থেকে?
না।
লপারকে কোথায় পাওয়া যাবে, বলতে পারো?
মাথা নাড়ল প্রাইস। হয়তো ওর অফিসে কিংবা বাসায়।
কেভিন লপারকে ভাল করে চেনা আছে ওর, লোকটার স্বভাব সম্পর্কে জানে। সুযোগসন্ধানী সে, রোজালিনাকে একা পেলে সর্বনাশ করে ছাড়বে। ক্রুশার হয়তো সাথে আছে, তাকে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করবে কিংবা দলে ভেড়াবে। ওর বাসা চেনো?
চলো। আমিও যাব।
তুমি শুধু বাসাটা দেখিয়ে চলে আসবে।
দেখা যাবে, ক্ষীণ হেসে এগোল নিকোলাস প্রাইস। পেছন দিক দিয়ে যাব আমরা।
ক্যাফের পোর্চে দেখা গেল রেমন্ড বার্থেজকে। মনে হচ্ছে আমাকে বাদ দিয়ে সবটার মজা একাই নিতে চাইছ? সহাস্যে অনুযোগ করল সে, হাতের রাইফেলে চাপড় মারল। বুড়ো হয়ে গেলেও নিশানাটা ভালই আছে। কি বলো, জেমস?
অসাধারণ! প্রত্যুত্তরে হাসল জেমস। এবং সঠিক সময়ে উপস্থিত হওয়ার গুণটাও আছে। তুমি সময়মত বাগড়া না দিলে ওরা ঠিকই আমাকে পেড়ে ফেলত।
বাগড়া? তুমি এটাকে বাগড়া বলছ! শুনে কষ্ট পেলাম, বাছা! কৃত্রিম নিরাশা তার মুখে, কিন্তু গলায় সন্তুষ্টির প্রচ্ছন্ন সুর। এই ঠেলায় সব জঞ্জাল সাফ করে ফেলব। তিনজনে মিলে আমরা দলটা একেবারে হেলাফেলা করার মত নই, কি বলো?
কাজটা সহজ হবে না, বলল প্রাইস। জীবনে কাউকে খুন করিনি আমি।
এটাকে খুন বলছ কেন, নিক? এটা আমাদের দায়িত্ব। এ শহরের নাগরিক হিসেবে এখানকার শান্তি বজায় রাখা আমাদের কর্তব্য। আমরা নিজেরা যদি তা করতে পারি…
মি. রেমন্ড, বাধা দিল জেমস, গম্ভীর দেখাচ্ছে ওকে। এখানেই থাকা উচিত তোমার। এদের কোন বিপদ হলে তোমাকেই দেখতে হবে।
নীরবে তাকিয়ে থাকল বার্থেজ। ভুরু কোঁচকাল যেন একমত হতে পারছে। অবশেষে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল সে, দুলে উঠল কাঁধজোড়া। আসলে আমাকে এড়িয়ে যেতে চাইছ। ঠিক আছে, যাও তোমরা।
নিক, তুমি বরং এখানেই থেকে যাও। মি. রেমন্ডের সাহায্য দরকার হতে পারে।
বিস্মিত দেখাল কাঠ ব্যবসায়ীকে। একা ওখানে যাওয়ার পাঁয়তারা করছ নাকি? ভুলে যাও। একগাদা লোক তোমাকে হেঁকে ধরবে। তারচেয়ে, আমি বলি কি…দুজনে মিলে গেলে সহজ হয়ে যাবে কাজ।
মাথা নাড়ল জেমস। ঠিক আছে, যাবে তুমি। কিন্তু বাড়িটা দেখিয়ে দিয়ে তোমার ছুটি। প্রাইস কিছু বলতে উদ্যত হতে হাত তুলে থামিয়ে দিল। কোন কথা শুনতে চাই না। লপারের বাড়ি দেখিয়ে দেয়ার জন্যে এ শহরে ঢের লোক পাওয়া যাবে।
তোমার ইচ্ছে, হতাশ দেখাল প্রাইসকে। কেউ যদি সেধে ঘাড়ে বিপদ নিতে চায় তো আমার কি! বলে ঘুরে উত্তরে এগোতে শুরু করল।
অনুসরণ করল জেমস।
পেছনে ওদের দিকে তাকিয়ে থাকল রেমন্ড বার্থেজ, অনেকক্ষণ। ব্যাপারটা বোধগম্য হচ্ছে না তার। ঘুরে ক্যাফের দিকে তাকাল। মারিয়া যথেষ্ট দৃঢ়চেতা, ঝামেলা সামাল দেয়ার ক্ষমতা ওর আছে, ভাবছে সে। তাছাড়া তেমন কিছু হওয়ার সম্ভাবনা আছে কি? রোজালিনা স্কুলে আছে, ওর কাছেই যাওয়া যাক, সিদ্ধান্ত নিল বার্থেজ। দেখা যাক কতদূর এগোতে পারল মেয়েটা।
ফুটপাথ ধরে এগোল সে। জেমস বা নিকোলাসকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না।
মিনিট পাঁচের মধ্যে স্কুল থেকে ঘুরে এল সে। মিসেস লয়ারীর কাছ থেকে দুঃসংবাদটা শোনার পর মাথায় রক্ত চড়ে গেছে। আফসোস আর অপরাধবোধ হচ্ছে তার, মেয়েকে সে নিজেই উৎসাহিত করেছে। জেমসের কাগজপত্র দেখে আর পরিচয় জানার পর রোজালিনাকে পরামর্শ দিয়েছিল শহরের শীর্ষস্থানীয় লোকজনের সাথে দেখা করে আসল সত্যটা জানাতে। বড্ড ঝুঁকি নেয়া হয়ে গেছে, ভাবল সে, আরেকজনের উপকার করতে গিয়ে নিজের সবচেয়ে প্রিয় জিনিসের ঝুঁকি নিয়ে ফেলেছে। কোনভাবেই ব্যাপারটা পছন্দ করতে পারছে না বার্থেজ, রোজালিনাকে এরমধ্যে না জড়ালেও চলত। এখন খারাপ কিছু হয়ে গেলে?
জেমস অ্যালেন আছে…নিজেকে সান্ত্বনা দিল সে…ও নিশ্চয়ই বসে থাকবে না।
দ্রুত পায়ে হেঁটে ব্যাংকের কাছে চলে এল বার্থেজ। ক্রুশার বা লপার কাউকেই পাওয়া গেল না। এক কর্মচারী ওদের বাসার পথ বাতলে দিল।
কেভিন লপারের বাসাটা দোতলা। বিশাল সুদৃশ্য বাড়ি। নিঃসন্দেহে লিয়ন সিটির সেরা বাড়ি। বাইরে সাদা চুনকাম করা, বাগানে হরেক ফুলগাছের সমারোহ। দালানের পেছনে পাইনের ঝাড়। সব মিলিয়ে অপূর্ব। খোলা গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ল রেমন্ড বার্থেজ। কোন বাধা না আসায় সন্দেহ হলো হয়তো ভুল জায়গায় চলে এসেছে, কিংবা লপার বোধহয় আদৌ বাড়িতে নেই।
মূল দরজায় কড়া নাড়ার পর ভুলটা ভাঙল। হাসিমুখে নিজেই দরজা খুলল কেভিন লপার। আরে মি. বার্থেজ যে! উষ্ণ অভ্যর্থনা জানাল স্টোর মালিক। এসো, ভেতরে এসে বসো।
অস্বস্তি অনুভব করছে রেমন্ড, এরকম আন্তরিক সম্ভাষণ আশা করেনি। ধীর পায়ে পারের পিছু নিয়ে ভেতরে ঢুকল ও। বড়সড় একটা হলরুমে এসে বসল ওরা।
রোজালিনার খোজে এসেছি আমি, মৃদু স্বরে নিজের উদ্দেশ্য জানাল রেমন্ড।
চেয়ার ছেড়ে দেয়ালের কাছে চলে গেল লপার। দেয়ালের বুকে বসানো কেবিনেট, কাচের দরজার ভেতর সুদৃশ্য বোতল সাজিয়ে রাখা। দরজা খুলে বোতল আর গ্লাস বের করল সে, পানীয় ঢালতে শুরু করল। ও যদি আমার কাছে আসত সত্যি খুশি হতাম, খানিকটা ম্লান সুরে বলল সে। আগে-পরে যাই হোক, আমি একজন অবিবাহিত পুরুষ এবং রোজালিনা এ শহরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় মহিলা। মি, বার্থেজ, বুঝতেই পারছ…।
আমি শুনেছি ওকে নিয়ে এসেছ তুমি! বাধা দিল ক্যাফে মালিক, মেয়ের অমঙ্গল আশঙ্কায় অধৈর্য হয়ে পড়েছে।
পানীয় ভরা গ্লাস পরিবেশন করল সে। চোখ তুলে তাকাল, চাহনিতে কোন রকম ছলনা বা চাতুরির চিহ্ন নেই। তুমি হয়তো ভুল বুঝেছ, মি. বার্থেজ, হেসে দরাজ গলায় বলল লপার। স্কুলে গিয়েছিলাম আমি ঠিক, এ জন্যে আমাকে দোষ দিতে পারবে না তুমি। রোজালিনা এখানকার সব পুরুষের আগ্রহের বিষয়, এমনকি বিবাহিতদের কাছেও। মেয়েকে সারাজীবন নিজের কাছে রাখার চিন্তা নিশ্চয়ই করছ না!
তোমার সাথে ওর দেখা হয়েছে? রুক্ষ স্বরে জানতে চাইল রেমন্ড।
হয়েছে, রেমন্ডের রূঢ় স্বরকে গ্রাহ্য করল না লপার। তার হাসি অম্লান, গ্লাস তুলে চুমুক দিল। তুমি নিশ্চই চাও না আমাদের মধ্যে কি কি কথা হয়েছে তা-ও বয়ান করি?
তারপর?
গ্লাস রেখে সিগার কেস তুলে নিল সে। অফার করল ওকে, মাথা নেড়ে প্রত্যাখ্যান করল রেমন্ড বার্থেজ। মূল রাস্তা পর্যন্ত ওকে এগিয়ে দিয়েছি আমি, সিগার ধরিয়ে ধোঁয়া গিলল লপার। অযথা তোমার হয়রানি হচ্ছে বলে আমার খারাপ লাগছে, মি. বার্থেজ। হতে পারে ও প্রাইসের বাসায় গেছে কিংবা অন্য কোথাও।
তোমার বাসা খুঁজে দেখব আমি।
এবার গম্ভীর দেখাল স্টোর মালিককে। তুমি কি আমাকে মিথ্যেবাদী ভাবছ নাকি …।
অত কিছু বুঝি না, লপার, অধৈর্য কণ্ঠে বাধা দিল রেমন্ড। তুমি আমাকে স্বেচ্ছায় বাড়িটা দেখতে দেবে কি-না তাই বলো।
আমি অপমান বোধ করছি, মি. বার্থেজ! হতাশা প্রকাশ পেল লপারের কণ্ঠে। ত্যাগ করে সিগারটা ছাইদানিতে গুঁজে রাখল। তুমি আমার সম্মানিত অতিথি আর… অসহায় ভঙ্গিতে কাঁধ উঁচাল সে। তোমার কাছে অস্ত্র আছে কিন্তু আমার কাছে নেই, এটাই বোধহয় বড় ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ওকে এখানে খুঁজে পেলে একটা অস্ত্র তোমার হাতে তুলে দেব! শীতল সুরে ঘোষণা করল ক্যাফে মালিক। সমান সুযোগ পাবে তুমি।
হাসল লপার। তার দরকার হবে না, মি. বার্থেজ। এসো।
সারা বাড়ি খুঁজে দেখল ওরা একটা কামরাও বাদ গেল না।
দুশ্চিন্তা পেয়ে বসেছে রেমন্ড বার্থেজকে। মুখ থমথমে। দরজার দিকে এগোতে গিয়েও ঘুরে দাঁড়াল, অস্বস্তিভরা দৃষ্টিতে তাকাল লপারের দিকে। আমি দুঃখিত, লপার। অযথাই তোমার হয়রানি হলো।
হেসে হাত বাড়িয়ে দিল স্টোর মালিক। তোমার মানসিক অবস্থা বুঝতে পারছি। আমি বলি কি, আগে ক্যাফেতে ফিরে যাও, মি. বার্থেজ। রোজালিনা হয়তো এরমধ্যে ফিরেছে।
গেট পর্যন্ত রেমন্ডকে এগিয়ে দিল সে। তারপর দরজা বন্ধ করে ফিরে এল হলঘরে। টমাস? গ্লাসে পানীয় ঢেলে চড়া গলায় ডাকল কাজের লোককে।
ভেতরের কামরা থেকে বেরিয়ে এল মাঝবয়সী এক লোক।
মেয়েটা কোথায়? নতুন সিগার ধরিয়ে জানতে চাইল লপার। আনন্দে পুলকিত, খুব সহজে সামাল দেয়া গেছে রেমন্ড বার্থেজকে।
ওপরে, তোমার বেডরুমে।
একটা রাইফেল নিয়ে দোতলায় চলে যাও। হ্যাঙ্কস আর মুরকে গেটের কাছে পাঠাও। কাউকে ঢুকতে দেবে না। তবে কারও সাথেই জোরাজোরি করার দরকার নেই। খুব ঝামেলা না হলে আমাকে ডেকো না।
মাথা ঝাঁকিয়ে চলে গেল লোকটা।
ফের গ্লাসে পানীয় ঢালল লপার। গলায় ঢেলে দিল সবটা। তরল আগুন নেমে গেল গলা দিয়ে। আজ তার জন্যে দারুণ একটা দিন। হেনরী ক্রুশারের বহু সাধনার জিনিস পেতে যাচ্ছে সে। সামান্য দুশ্চিন্তার একটা ব্যাপার রয়ে গেছে এখনও-জেমস অ্যালেনকে সামাল দেয়া গেছে কি-না এ খবর এখনও আসেনি। তাকে অবশ্য পরেও সামলানো যাবে।
সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে এল সে। দুটো কামরা পরে তার বিলাসবহুল শোবার ঘর। না চাইলেও বারবার দৃশ্যটা চোখে ভাসছে…নরম বিছানায় রোজালিনাকে পেতে যাচ্ছে। গলায় সিগারের ধোয়া আটকাতে বিষম খেল লপার। কাশল বার কয়েক, তারপর বারান্দা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল সিগার। বন্ধ দরজার সামনে এসে দাড়াতে ফের সুখানুভূতি গ্রাস করল তার সারা শরীর। ইশশ, মেয়ে বটে একখানা!
তালা খুলে ভেতরে ঢুকল কেভিন লপার। রোজালিনাকে একটা চেয়ারের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে। মুখে কাপড় গুঁজে দেয়া। দরজা খোলার শব্দে ফিরে তাকাল ও, লপারকে দেখে ম্লান হয়ে গেল সুন্দর মুখটা।
ঘুরে দরজা আটকে দিল লপার। রোজালিনার সামনে এসে দাঁড়াল। তাড়াহুড়োর কি আছে, অফুরন্ত সময় হাতে। সময় নিয়ে রসিয়ে রসিয়ে সারা যাবে কাজটা। বিছানার ওপর বসে রোজালিনার দিকে ঝুঁকে এল। আমাদের বোঝাঁপড়াটা বাকি রয়ে গেছে, হানি, মৃদু হাসি ফুটল তার মুখে, মেয়েটার অসহায় অবস্থা উপভোগ করছে। মিটিয়ে ফেলা যাক এবার। হাত বাড়াতে ভয়ে কুঁকড়ে গেল রোজালিনা, কিন্তু লপার কেবল ওর মুখ থেকে গুজে দেয়া কাপড় সরিয়ে নিল। রোজালিনার তটস্থ অবস্থা দেখে কৌতুক ফুটে উঠল তার চোখে।
কে এসেছিল? জানতে চাইল রোজালিনা, আতঙ্কে গলা বুজে আসতে চাইছে।
তোমার বাবা।
বোকা বোকা দেখাল মেয়েটাকে।
আমাকে চ্যালেঞ্জ করল সে, লপারের হাসি দুকান পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। সারা বাড়ি ঘুরিয়ে দেখালাম। দুর্ভাগ্য, মেয়েকে খুঁজে পায়নি বেচারা।
হতাশায় কিছু বলতে পারল না রোজালিনা। জেমস অ্যালেন এর সম্পর্কে সতর্ক করেছিল, মনে পড়ল ওর। দারুণ ধূর্ত লোক, সবাইকে বোকা বানিয়ে ছেড়েছে। একটু আগে ওকে নিচে নামিয়ে নিয়ে গিয়েছিল টমাস লোকটা, মিনিট পাঁচ পার্লারের কাছে অপেক্ষা করে ওপরে নিয়ে এসে ফের বেঁধে রেখে গেছে। তখন এর অর্থ বুঝতে পারেনি, এখন সবটাই পরিষ্কার হয়ে গেছে।
সে কি আসবে? উঁহু, মোনা ছাড়া অন্য কোন মেয়ে তার জগতে নেই। রোজালিনার আগ্রহ সে ধরতে পারেনি বা ইচ্ছে করেই এড়িয়ে গেছে। অথচ ওর ধারণা ছিল তাকে জয় করতে পারবে। কয়েকটা দিন তো নিবিড় করে পেয়েছিল, তবু একবারের জন্যেও ধরা দেয়নি কঠিন লোকটা।
তুমি একটা অন্যায় করতে যাচ্ছিলে, হানি। তোমাকে সাবধান করেছিলাম। কিন্তু আমার কথাকে পাত্তাই দাওনি। নিশ্চিন্তে অ্যালেনকে জায়গা দিয়েছ, সেবা করে সুস্থ করে তুলেছ। আবার আমার বারোটা বাজানোর জন্যে কয়েকটা পোস্টার নিয়ে মীটিং ডেকেছ। না, রোজালিনা, আমি তোমার সাহসের প্রশংসা করছি। দুঃখ হচ্ছে তোমার জন্যে শেষপর্যন্ত ব্যর্থ হলে তুমি।
চুপ করে থাকল ও। ভয়ে মুখ-গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। জিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁট ভেজাল, ঢোক গিলল, কিন্তু কাজ হলো না। দয়া করে একটু পানি দেবে? শুকনো গলায় অনুরোধ করল।
নিশ্চই, চাই কি হুইস্কিও দিতে পারি। উঠে বিছানার কিনারে টেবিলের কাছে গেল লপার, গ্লাসে পানি ঢেলে এগিয়ে ধরল ওর মুখের কাছে। সাগ্রহে পান করল রোজালিনা। ফিরে গিয়ে শূন্য গ্লাস টেবিলে রাখল সে। এবার আমাদের আলাপটা সারতে পারি, তাই না?
জেমস অ্যালেন কি মারা গেছে?
চোখ ছোট করে তাকাল লপার, বোঝার চেষ্টা করল কি যেন। হয়তো, তবে নিশ্চিত খবর পাইনি এখনও। ওর ব্যাপারটা হেনরী দেখছে। আমি বলেছি অ্যালেনকে শেষ করতে পারলে তোমার দাবি ছেড়ে দেব।
ও হয়তো মারা যায়নি এখনও, প্রবোধের সুরে বলল রোজালিনা।
হতে পারে। কিন্তু সেটা ভেবে আশায় থেকে লাভ নেই, হানি। এখানে ঢুকতে পারবে না সে। তাছাড়া এতক্ষণে না মরলেও দুএকটা গুলি নিশ্চয়ই হজম করতে হয়েছে ওকে। বিছানায় বসল লপার, নীরবে রোজালিনাকে দেখল কিছুক্ষণ। তারপর কেশে গলা পরিষ্কার করল। অনেকদিন আগে তোমাকে একটা প্রস্তাব দিয়েছিলাম। হয়তো ভুলে গেছ, তবু মনে করিয়ে দিচ্ছি। আমাকে বিয়ে করতে হবে তোমার।
তাকিয়ে থাকল রোজালিনা, মুখে কথা সরছে না।
তোমাকে স্বীকার করতেই হবে মানুষটা আমি মন্দ নই, খেই ধরল কেভিন লপার। তার কণ্ঠে আত্মপ্রসাদের সুর। টাকা, সম্পত্তি আর সম্মান-কোনটারই অভাব নেই। দেখতেও বদখৎ নই। তোমার আপত্তিটা কোথায় বুঝতে পারছি না।
নিজের সম্পর্কে আমাকে জ্ঞান দিতে এসো না, মি, লপার, বিরক্তি চেপে রাখতে পারল না ও। তোমার সম্পর্কে জানি আমি।
জেমস অ্যালেনের কল্যাণে, তাই না? হাসল লপার, পকেট থেকে পোস্টারগুলো বের করল। এগুলো ওর কাছ থেকে পেয়েছ নিশ্চয়ই? আমাকে ফসানোর জন্যে যথেষ্ট নয়। তুমি বা কেউই প্রমাণ করতে পারবে না। ক্যাল ইনগ্রসের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই।
তুমি স্বীকার করবে না, এটাই স্বাভাবিক।
মাথা ঝাঁকাল লপার। এবার জেমস অ্যালেনের প্রসঙ্গ। ওর সম্পর্কে। বোধহয় সবচেয়ে বেশি জানো।
তোমার চেয়ে বেশি কিছু নয়।
বিশ্বাস করলাম না।
সেজন্যে কি তোমার পায়ে ধরতে হবে?
রোষের সাথে তাকাল কেভিন লপার। সাহস ফিরে পাচ্ছে মেয়েটা, ভাবল সে, হয়তো ভেবেছে আপাতত ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই ওর। শোনো, রোজালিনা, আমাকে খোঁচা মারবে না। এ জিনিসটা আমি একেবারে সইতে পারি না। কঠোর দেখাল তার মুখ, শীতল ভাবটুকু স্পষ্ট। প্রস্তাবটা ভেবে দেখার জন্যে সময় দিতে পারছি না। সিদ্ধান্তটা তোমাকে এখুনি নিতে হবে।
যদি তোমার পছন্দ না হয়?
রোজালিনার সারা শরীরে নজর বুলাল লপার। হাসল এরপর। নিজের ভাল বোঝার ক্ষমতা, তোমার হয়েছে, তাই না?…আগামী রোববারই গির্জায় যাচ্ছি আমরা। সকালে ক্যাফের দরজায় বাগি নিয়ে অপেক্ষা করব আমি।
ধরো রাজি হলাম না।
ক্যাল ইনগ্রস সম্পর্কে কেবল শুনেছই তুমি, কিছু জানো না। সারা জীবন যাতে তোমাকে পস্তাতে হয় সেই ব্যবস্থা করব আমি। এখান থেকে ছাড়া পাবে ঠিকই, ততদিনে কাউকে যাতে মুখ দেখাতে না পারে সেটা নিশ্চিত করব। তোমার বাবা-মাকেও ছাড়ব না, ওদেরকে চেপে ধরলেই রাজি হয়ে যাবে তুমি। সবচেয়ে বড় ব্যাপার, এখানে দুটো দিন থাকলেই আমাকে বিয়ে করার জন্যে পাগল হয়ে উঠবে।
অজান্তে কেঁপে উঠল রোজালিনার শরীর। কোণঠাসা অবস্থাটা বুঝতে পারছে। ভয়ে-আতঙ্কে গলা শুকিয়ে আসছে, বুক ধড়ফড় করছে। বুকের খাচার ভেতর লাফাচ্ছে ওর হৃৎপিণ্ড। নিজের দ্রুত লয়ের নিঃশ্বাস স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে। ভাবার চেষ্টা করল কি করে এড়ানো যায় অবশ্যম্ভাবী ঘটনাটা, কিন্তু মাথা কাজ করছে না। আমাকে কয়েকটা দিন সময় দাও, কথা দিচ্ছি ভেবে দেখব।
আমাকে হাসালে, হানি। সময় পেলে তোমাকে কখনোই আর কজা করতে পারব না। উঁহু, দেরি সইবে না আমার। সরে গিয়ে টেবিলের কাছে চলে গেল সে, ড্রয়ার খুলে কাগজ-কলম বের করল। বিছানার ওপর সেগুলো রেখে সিগার ধরাল। জানালার কাছে সরে গেল এবার, বাইরে ফ্লো মাউন্টেনের ওপর চোখ রাখল। উঁহু, রোজালিনা, আমার সাথে তামাশা কোরো না। দুই মিনিট সময় পাবে তুমি। যদি রাজি থাকো, তোমার হাত খুলে দেব। কাগজে স্বাক্ষর করবে, তারপর সসম্মানে তোমাকে পৌঁছে দেব আমি। এবং তোমার বাবা-মার সামনে বিয়ের প্রস্তাব দেব। রোববারে, আগে যা বলেছি, ঠিক সেভাবে সেরে যাবে বিয়েটা।
চুপ করে থাকল রোজালিনা। মাথা নিচু করে আকাশ-পাতাল ভাবছে। হায় খোদা, কেউ কি আসতে পারে না! হেনরী ক্রুশার, সে-ও কি বুঝতে পারেনি কি ভয়ঙ্কর বিপদে আছে ও? দীর্ঘ একটা কাঠামো ভেসে উঠল ওর মানসপটে, দৃঢ় সঙ্কল্পবদ্ধ একটা মুখ…কিছুটা নিষ্ঠুর আদল কিন্তু চোখজোড়ায় অফুরন্ত নির্ভরতা-জেমস, অ্যালেন। কোথায়?
অভিমান আর আশাহতের যন্ত্রণা পাগল করে তুলেছে ওকে। অনুভব করল গলার কাছে কিছু একটা আটকে আছে যেন, চোখ ফেটে কান্না আসতে চাইছে। একটা মেয়ে হিসেবেও কি ও তার কাছে এতটুকু সহানুভূতি পেতে পারে না? এতগুলো লোককে একা সামাল দিতে পেরেছে, অনায়াসে এখানে আসতে পারে সে। এমনকি ক্যাল ইনগ্রসের সামনে দাড়ানোর মত সাহস তার আছে। অথচ…
রোজালিনা, আমি ধৈর্য হারাচ্ছি! ওকে রূঢ় বাস্তবে টেনে আনল কেভিন লপার।
দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ফেলল ও, তারপর দেখল লপারকে। ঘৃণা করে, তবু এ লোকটিকেই ওর বিয়ে করতে হবে। দুটো শর্ত আছে, মি. লপার, ক্ষীণ কণ্ঠে জানাল।
সাগ্রহে ওর দিকে ফিরল সে।
জেমসকে চলে যেতে দেবে তুমি।
অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে থাকল কেভিন লপার, গম্ভীর দেখাচ্ছে। ধূসর কালো চোখজোড়া বিদ্ধ করল রোজালিনাকে, ভয় ধরে গেল ওর মনে। তারপর সহসাই হেসে উঠল সে, দুহাতের তালু দিয়ে নিজের উরুতে চাপড় মারল। শব্দটা শুনে চমকে উঠল রোজালিনা, এত জোরাল শোনাল যেন সপাটে চড় কষানো হয়েছে। কারও গালে।
উঠে দাঁড়াল লপার, হাসিটা এখনও আছে কিন্তু তাচ্ছিল্য আর কৌতুকে ঠোঁটের কোণ বেঁকে গেছে। এই তাহলে ব্যাপার? তলে তলে ওর প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েছ তুমি। কোত্থেকে একটা ভবঘুরে এল লিয়ন সিটিতে আর তাকে দেখে মজে গেলে তুমি। নাহ্, রোজালিনা, তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে!
শর্তটা মানছ? দৃঢ় শোনাল রোজালিনার গলা, কিন্তু সেটা কষ্টকৃত। ভেতরে ভেতরে দারুণ ভয় পেয়েছে।
ধরো, মানলাম না। কি করতে পারবে? আমার কজায় আছ তুমি। তোমার বাবা-মাকেও ইচ্ছে করলে হাতের মুঠোয় পেতে পারি। আর অ্যালেন? সে আগেপরে আসবেই। ওর মত লোক বহুবার আমার সামনে দাঁড়িয়েছিল, কিন্তু তারা সবাই এখন বুটহিলে শুয়ে আছে।
এত সহজ ভাবছ কেন, তুমি কি অজেয়? হিককও তো গুলি খেয়ে মরেছে। বন্দুকবাজরা বন্দুকের গুলিতেই মরে।
ক্যাল ইনগ্রসকে চেনার লোক তুমি ছাড়া কেউ নেই, হানি। অ্যালেনকে এখান থেকে জীবিত বেরোতে দেব না আমি।
ইচ্ছে করলেই পালাতে পারে ও। তোমার লোকেরা যে আটকাতে পারবে না তা এ কদিনে বেশ বোঝা গেছে।
খুব সাফাই গাইছ ওর পক্ষে, ব্যাপার কি? আত্মবিশ্বাসীও মনে হচ্ছে তোমাকে। অন্ধ বিশ্বাস? না অন্য কিছু জানো ওর সম্পর্কে?
চুপ করে থাকল রোজালিনা, লপারের তীক্ষ্ণ অন্তর্ভেদী দৃষ্টিকে গ্রাহ্য করল। আচ্ছা, তুমি কি একজন মেয়েলোক চাও, নাকি একজন স্ত্রী?
স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল লপার, তারপর হেসে উঠল। নাহ, তুমি সত্যিই বুদ্ধিমতী, রোজালিনা। তোমার মত মেয়েকে কেভিন লপারের স্ত্রী হিসেবেই মানায়। সুন্দরী, বুদ্ধিমতী, শিক্ষিতা এবং গুণী। সারা শহরের লোক আমাদেরকে দেখে বলবে আদর্শ জোড়া।
তাহলে বিয়ের আগে আমাকে স্পর্শ করতে পারবে না, সাহসী, আশাবাদী হয়ে উঠেছে ও। আর…অ্যালেনকে তাড়া করতে পারবে না। ওকে চলে যেতে বলব আমি, জানাব যে তোমাকে বিয়ে করতে যাচ্ছি। …দুটো শর্তের একটা ভাঙলেও আমাদের আর বিয়ে হবে না।
নীরবে একটা সিগার ধরাল লপার। চিন্তিত দেখাচ্ছে তাকে। মাঝে-মধ্যে সিগার টানার ফাঁকে দেখছে ওকে। কিন্তু অ্যালেন যদি আমার কাছে আসে, চ্যালেঞ্জ করে?
সে প্রমাণ করতে পারবে না তুমিই ক্যাল ইনগ্রস, একটু আগে তাই বলেছ। তাছাড়া আমার অনুরোধ ফেলবে না ও।
গভীর সম্পর্কের আঁচ পাচ্ছি যেন! কৌতুক স্টোর মালিকের চোখে। দ্রুত কয়েকটা টান দিল সিগারে। ধরো, রাজি হলাম, ধীর কণ্ঠে বলল, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখছে ওকে।
তাহলে হাত খুলে দাও, স্বাক্ষর করছি আমি।
সাথে সাথেই নড়ল না সে, আরও কিছু সময় ব্যয় করল। জানালার কাছ থেকে ঘুরে এল একবার। সিগার শেষ করে ছাইদানিতে গুজে রাখল। তারপর ওর পেছনে এসে দাঁড়াল। আমার সাথে বেঈমানি করার চিন্তা ভুলেও মাথায় এনে, হানি, বাঁধন খোলার সময় শাসাল সে। তোমার জীবনটা তাহলে বিষিয়ে তুলব, খোদার কসম!
বাঁধনমুক্ত হতে হাতের কবজি ডলতে লাগল রোজালিনা। রক্ত চলাচল স্বাভাবিক হতে কাগজ টেনে নিয়ে লিখতে শুরু করল। দূরে দাঁড়িয়ে থেকে দেখছে কেভিন লপার। স্নান দেখাচ্ছে মেয়েটাকে, মেনে নিয়েছে নিয়তি। কাঁপা হাতে কঠিন কাজটা সারল রোজালিনা, তারপর পাশে দেখতে পেল লপারকে।
একটা হিংস্র কুগারের মত ঝাপিয়ে পড়ল লপার। রোজালিনার কোমর চেপে ধরে ওকে আছড়ে ফেলল বিছানার ওপর। প্রবল বিস্ময় আর আতঙ্কে কোন বাধাই দিতে পারল না ও। দেখল লপারের আগ্রাসী ঠোঁটজোড়া এগিয়ে আসছে। লপার, তুমি কথা রাখছ না! আহত স্বরে রাগে চেঁচিয়ে উঠল রোজালিনা, মুখ সরিয়ে নিয়েছে।
পৈশাচিক হাসি দেখা গেল তার মুখে। সবই ঠিক থাকবে, হানি। বিয়ে হবে, অ্যালেনকেও চলে যেতে দেব। কেবল এই একটা ব্যাপার ছাড়া। ক্লেইম ফাইল কি জিনিস জানো? নিজের মালিকানা প্রতিষ্ঠিত করতে যাচ্ছি আমি। বাধা দিয়ো না, সোনা! দুদিন পর এমনিতেই তুমি আমারই হবে। কিন্তু অতটুকু ধৈর্যও আমার নেই। বিশ্বাস করো, তুমি আমাকে পাগল করে তুলেছ!
সমানে হাত-পা চলছে রোজালিনার, কিন্তু সুবিধে করতে পারছে না। ঠেলে ফেলে দিতে চাইছে তাকে। কিন্তু এক বিন্দু শিথিল হলো না বাঁধন। তোমাকে আমি বিশ্বাস করেছিলাম! ঘৃণায় শিরশির করে উঠল ওর শরীর। থুথু ছিটাল ও, লপারের চোখে-মুখে গিয়ে পড়ল।
রাগে দিশেহারা হয়ে পড়ল কেভিন লপার। হাত চালাল, প্রচণ্ড চড় এসে পড়ল রোজালিনার গালে। পরপর আরও তিনবার হাত চালাল সে। রাগে কাপছে শরীর, রোজালিনার কোমরের ওপর উঠে বসেছে। তোমাকে এমন শিক্ষা দেব যে জীবনেও এমন করবে না আর! হিসিয়ে উঠল লপার। থাবা মারল, খামচে ধরল ওর ব্লাউজ। টান দিতে চড়চড় করে ছিঁড়ে এল।
চড়গুলো বেসামাল করে দিয়েছে রোজালিনাকে, চোখে অন্ধকার দেখছে। ব্লাউজ হেঁড়ার শব্দ ওর বুক কাঁপিয়ে দিল। প্লীজ, লপার! আর্তনাদ করে উঠল ও।
সহসা জানালার কাচ ভাঙার শব্দ হলো, চমকে সেদিকে তাকাল রোজালিনা। ভাঙা জানালার ফাঁকে পিস্তলের একটা নল দেখা গেল। পাশে একটা হাত প্রবেশ করল ঘরে, হাতড়ে ছিটকিনি খুলল। জানালার পাল্লা সরে যেতে দেখা গেল জেমস অ্যালেনের দৃঢ় কঠিন মুখ। চোখে শীতল দৃষ্টি।
ওকে ছেড়ে দাও, লপার! উঠে এসে দেয়ালে হাত ঠেকিয়ে দাঁড়াও। উঁহু, তুমি নিরস্ত্র এটা মোটেই আমল দেব না আমি। বেচাল দেখলেই গুলি করব। একটা হিংস্র কুগারকে গুলি করার সময় কেউ আশা করে না ওটার থাবায় পিস্তল থাকবে।
কেভিন লপার হতবাক। দ্রুত সামলে নিল নিজেকে। উঠে দেয়ালের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। কোটা সত্যিকার হুমকি তা ভাল করেই জানে। ধৈর্য ধরার পক্ষপাতি সে, জানে নিরস্ত্র অবস্থায় ওকে গুলি করবে না অ্যালেন। তারচেয়ে অপেক্ষায় থাকা যাক, টমাস বা অন্য কেউ চলে আসতে পারে। ছকটা তখন পাল্টে যেতে পারে।
রোজ?
ধড়মড় করে উঠে বসল রোজালিনা। তারপর লজ্জা পেল, শুধু অন্তর্বাস ওর বুকে। বিছানার চাদর টেনে তুলে গায়ে চাপাল।
দরজাটা খোলো, তারপর জানালার কাছে এসো। খবরদার, আমার আর লপারের মাঝখানে আসবে না! এই তো লক্ষ্মী মেয়ে! সাহস জোগাল জেমস, একবারের জন্যেও লপারের ওপর থেকে চোখ সরাল না।
জানালার কাছে এসে দাঁড়াল রোজালিনা।
এটা ধরো, পিস্তল এগিয়ে ধরল জেমস। লপার নড়লেই গুলি করবে। আসছি আমি, এক মিনিটের বেশি লাগবে না।
অসহায় দৃষ্টিতে রোজালিনাকে পিস্তল নিতে দেখল কেভিন লপার। পিস্তল হস্তান্তরের সময় অন্য একটা পিস্তলে ওকে নিশানা করে রেখেছে জেমস অ্যালেন। রোজালিনাকে দেখল সে, পিস্তল ধরা হাত মৃদু নড়ছে, ট্রিগারে চেপে থাকা আঙুলে রক্ত সরে গেছে। মুহূর্তের ব্যবধানে গুলি বেরিয়ে যেতে পারে। ঠায় দাঁড়িয়ে থাকল লপার। মেয়েটার আতঙ্ক এখনও কাটেনি, খুনের নেশা ওর চোখে। অনায়াসে গুলি করবে। লপার জানে পিস্তলে মোটেই আনাড়ি নয় রোজালিনা বার্থেজ। তাছাড়া এ অবস্থায় ঝুঁকি নেওয়াও ঠিক হবে না, সাফল্যের সম্ভাবনা একেবারেই নেই।
খোলা পিস্তল হাতে কামরায় প্রবেশ করল জেমস। পা দিয়ে ঠেলে দরজা ভিড়িয়ে দিল। জানালার কাছ থেকে সরে গেল রোজালিনা। উড়ে গিয়ে আছড়ে পড়ল জেমসের বুকে। মৃণাল দুটো বাহু জড়িয়ে ধরল ওর গলা। কাদছে মেয়েটা, বুকে মুখ ঘষছে। ও আমাকে অপমান করেছে, জেমস। তুমি শোধ নেবে না? কাপা গলায় অনুরোধ করল রোজালিনা।
একহাতে মেয়েটার সরু কোমর বেষ্টন করল জেমস, আরেক হাতে পিস্তল, শিথিলভাবে ঝুলছে দেহের পাশে। চোখ সরছে না লপারের ওপর থেকে। অন্তত এইবার সময়মত আসতে পেরেছি আমি, মৃদু স্বরে বলল, ও, অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল লপারের দিকে। সন্দেহ আর কৌতূহল ফুটে উঠল স্টোর মালিকের চোখে।
প্রশান্তি অনুভব করছে রোজালিনা। ছাড়ল না জেমসকে।
রোজ?
মুখ তুলে তাকাল ও, জেমসের মুখে হাসি। এবার ওর সাথে আমাকে লেনদেনটা চুকাতে দাও। তিনটে বছর ধরে জ্বলে মরছি আমি।
একপাশে সরে দাঁড়াল ও।
ওর ড্রয়ার খুলে একটা শার্ট পরে নাও, বিছানার ওপাশে ওয়ার্ডরোবৃটা দেখিয়ে বলল জেমস, এগোল লপারের দিকে। ঠায় দাঁড়িয়ে আছে সে, মুখ ভাবলেশহীন। সামনে গিয়ে দাঁড়াল ও, লপার কিছু বুঝে ওঠার আগেই প্রচণ্ড চড় মারল।
মাথা একপাশে হেলে গেল তার, কিন্তু সরাসরি তাকাল জেমসের চোখে। নীরবে হজম করল পরের চড়গুলো। তোমার হাতে পিস্তল আছে বলে বাহাদুরি করছ, অ্যালেন, শীতল সুরে বলল সে। ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি। প্রতিপক্ষ নিরস্ত্র থাকলে ওরকম বড়াই যে কেউ করতে পারে।
ক্ষীণ হাসল জেমস। ভেবো না তোমাকে কোন সুযোগ দেব না আমি। কিভাবে চাও, লপার? হাতাহাতি, না পিস্তলে?
পিস্তল, সংক্ষেপে জানাল স্টোর মালিক।
মাথা ঝাঁকাল ও। জানতে ইচ্ছে করছে না কেন তিনটে বছর ধরে খুঁজে মরছি তোমাকে? তুমি আমার শান্তি কেড়ে নিয়েছ, লপার। তিনটে বছরের অপরিসীম কষ্ট আর পরিশ্রমের শোধ তুলব আজ। কেন জানো? তিন বছর আগে অ্যাবিলিনের ছোট্ট একটা বাথানে নিজের কফিনে পেরেক ঠুকে এসেছ তোমরা, ইনগ্রস। তোমার দুই সঙ্গী শেষ, এবার তোমার পালা।
তুমি কে, অ্যালেন? ওই মেয়েটা…
ওর স্বামী। যাক, মনে করতে পেরেছ তাহলে। আমি ভেবেছি তোমাকে হয়তো মনে করিয়ে দিতে হবে।
নির্লজ্জের মত হাসল লপার। দারুণ কেটেছিল সকালটা।
সপাটে ঘুসি হাঁকাল জেমস। বুঝতে পারছে নোংরা ইঙ্গিত করে ওকে বেসামাল করতে চাইছে লোকটা। লড়াইয়ের আগে প্রতিপক্ষের আত্মবিশ্বাস বা মনঃসংযোগে চিড় ধরাতে পারলে কাজটা সহজ হয়ে যায়। পকেট থেকে সিগার কেসটা বের করল ও। একটা সিগার ছিল, ধরাল। চিনতে পারছ, ইনস? নাকি অস্বীকার করবে?
তাতে কি? ফাটা ঠোঁটে জিভ বুলিয়ে রক্তের নোনা স্বাদ পেল লপার। রাগে ফেটে পড়তে চাইছে, কিন্তু সামলে রেখেছে নিজেকে। পরিস্থিতি মোটেই অনুকূলে নয়। একটা সুযোগ পাবে, নিশ্চিত জানে। সুতরাং বেতাল কিছু করে সেটা হারানো ঠিক হবে না। জেমস অ্যালেন বেপরোয়া লোক, ইচ্ছে করলে ওকে পিটিয়ে ছাতু বানিয়ে ফেলতে পারবে। রিক স্যাভেজ হাত বাঁধা অবস্থায়ও কুলিয়ে উঠতে পারেনি তার সাথে। ঘটনাটা ভুলে যায়নি লপার, অ্যালেনের ধাত বুঝতে ওই একটা ঘটনাই যথেষ্ট-একাধারে প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী, সেইসাথে দারুণ একরোখা লোক।
কিছু আসে-যায় না অবশ্য, সরে গিয়ে চেয়ারে বসল জেমস, একটু আগে যেটায় বেঁধে রাখা হয়েছিল রোজালিনাকে। সিগার ফুকছে। পরোয়াও করি না। তুমি যেই হও তাতে কিছু আসে-যায় না। বিলি দ্য কিড বা সাডেনও যদি তোমার জায়গায় হত, পরোয়া করতাম না আমি। ক্যাল ইনগ্রস, তোমার সাথে ওদের তুলনা চলে না। ওরা কঠিন মানুষ, কিন্তু জীবনে কখনও কোন মহিলার অসম্মান করেনি অথচ তুমি হরহামেশা করেছ।
নীরবে ওকে দেখছে কেভিন লপার। বুকের সাথে দুহাত বাঁধা, ভাব দেখে মনে হচ্ছে মনোযোগী শ্রোতা। জেমস অ্যালেনকে ভয় পাওয়ার কোন কারণ ঘটেনি, ভাবছে ও। পিস্তলের ফয়সালায় অনায়াসে খুন করতে পারবে তাকে, এটুকু ক্ষমতা আর আত্মবিশ্বাস ওর আছে।
কোথায় লড়তে চাও, ইনগ্রস? রাস্তায় না তোমার বাড়ির লনে?
লিয়ন সিটির মানুষ ডুয়েলটা দেখুক, নাকি তোমার আপত্তি আছে?
লপারের প্রস্তাবে উদারভাবে হাসল জেমস। সবই তোমার মর্জিমাফিক ঘটছে, ইনগ্রস। এবার তোমার পিস্তল পাবে। খুব সাবধান, জানি নিজের মৃত্যুকে এগিয়ে আনবে এমন বোকা লোক তুমি নও। তবু, সাবধানের মার নেই। মনে রেখো, তোমাকে একবিন্দু বিশ্বাস করি না আমি। এবার বলো কোথায় রেখেছ তোমার অস্ত্র।
ড্রয়ারে।
রোজ?
সাড়া দিল মেয়েটা। বেঢপ সাইজের শার্ট আর স্কার্টে হাস্যকর দেখাচ্ছে ওকে।
কোথায় আছে বলে দাও, বলল জেমস। রোজ বের করে নেবে। রাস্তায় গিয়ে ওগুলো পাবে তুমি।
পাঁচ মিনিট পর রাস্তায় দেখা গেল তিনজনের দলটাকে। জেমস আর রোজালিনা পাশাপাশি, ওদের সামনে কেভিন লপার। হোলস্টারসমেত একজোড়া পিস্তল দেখা যাচ্ছে মেয়েটার হাতে। একটু পর টেম্পলার, প্রাইস আর বার্থেজকে দেখা গেল বাড়িটা থেকে বেরোতে। পেছনে তিনটে লাশ ফেলে এসেছে ওরা।
মি. বার্থেজ?।
জেমসের দিকে ফিরল রেমন্ড বার্থেজ। রেমন্ড নামটাই আমার পছন্দ, বাছা। বন্ধুরা আমাকে ওই নামেই ডাকে। টের পেল পাশে এসে দাঁড়িয়েছে রোজালিনা, একহাতে তার বাহু জড়িয়ে ধরেছে।
ওর পিস্তল আর হোলস্টারটা দিয়ে আসবে, নিক? অনুরোধ করল জেমস, টেম্পলার আর রেমন্ডের দিকে ফিরল এবার। তোমরা নজর রেখো ও কোন চালাকি করে কি-না। হয়তো হোলস্টারে পিস্তল ঢোকানোর সময় মাথায় দুষ্টবুদ্ধি চাপতে পারে। মনে রেখো লোকটার নাম ক্যাল ইনগ্রস, মুহূর্তের ব্যবধানে ও সবাইকে খুন করে ফেলতে পারবে। মি. টেম্পলার, গুলি ফুটিয়ে পিস্তলগুলো পরখ করে নাও। আমি চাই না পরে কেউ বলুক ওকে অচল অস্ত্র দেয়া হয়েছে।
ওর নির্দেশ পালন করল জোহান টেম্পলার। পালিশ করা চকচকে পিস্তলের বাটগুলো উঁকি দিচ্ছে লপারের হোলস্টার থেকে, চল্লিশ গজ দূরে থেকে দেখতে পেল জেমস অ্যালেন। এখন আর লিয়ন সিটির নিপাট ভদ্রলোক মনে হচ্ছে না তাকে, হিমশীতল আগুন-ঝরা দৃষ্টি চোখে। দাঁড়ানোর ভঙ্গিই বলে দিচ্ছে বহুবার এভাবে প্রতিপক্ষের সামনে দাঁড়িয়েছে, অটল পাহাড়ের মত দৃঢ়তা আর সাহস নিয়ে। চূড়ান্ত সময়ে এসেও তার মধ্যে কোন রকম চাঞ্চল্য দেখা যাচ্ছে না, মুখের পেশী পর্যন্ত কাঁপেনি। অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথার চতুর একজন খুনী। অনায়াস দক্ষতা আর প্রবল নিষ্ঠার সাথে কোমরে ঝোলানো অস্ত্রটাকে নিজের সাথে এতই আত্মস্থ করে নিয়েছে যেন ওটা ওর শরীরেরই একটা অংশ।
বড় করে শ্বাস টানল জেমস, মোনা আর ফ্রেডের চেহারা ভেসে উঠল ওর চোখের সামনে। তারপর সহসাই ইচ্ছে হলো রোজালিনাকে দেখে একবার। কে বলতে পারে একটু পর বেঁচে থাকবে সে? অ্যারিজোনার সবচেয়ে কুখ্যাত বন্দুকবাজের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, খানিকবাদে হয়তো দুএকটা বুলেট ঢুকবে বুকে…ওর আশা অপূর্ণ থেকে যাবে। মনে পড়ল মেয়েটিকে বলা হয়নি ওকে পছন্দ করে, একটা পরিকল্পনা করেছে ওকে নিয়ে।
মনে মনে নিজেকে অভিসম্পাত করল জেমস, সবচেয়ে সঙ্কটপূর্ণ মুহূর্তে যত সব ফালতু চিন্তা ওকে বেচাল করতে চাইছে। আর হয়তো কয়েকটা সেকেন্ড, তারপরই প্রশান্তি ঘিরে ধরবে ওকে, দুঃসহ জ্বালা মিটে যাবে চিরতরে। কিন্তু হারানোর ব্যথাটা সবসময়ই থেকে যাবে।
বাপের কাছে সরে এল রোজালিনা, দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখছে দুই প্রতিদ্বন্দীকে। দুঃসহ উৎকণ্ঠা হচ্ছে ওর, মনে হচ্ছে এই উদ্বেগ কখনও কাটবে না। দুহাতে বার্থেজের বাহু জড়িয়ে ধরল ও। বাবা, আমি সহ্য করতে পারছি না। যদি কিছু হয়ে যায়… কেঁপে গেল ওর গলা।
প্রার্থনা কর, মা, মেয়েকে প্রবোধ দেয়ার চেষ্টা করল বার্থেজ। নিজেও মনে মনে তাই করছে। আমরা এতগুলো লোক চাইছি যেন অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারে ছেলেটা, এত লোকের প্রার্থনা বিফলে যেতে পারে না। নিশ্চয়ই আমাদের কথা শুনবেন প্রভু। বুকে ক্রুশ আকল সে, তার নিজেরও অস্থির লাগছে। তাছাড়া…এত ধৈর্য ধরেছে ও, নিশ্চয়ই সফল হবে। পুরস্কারটা ওর পাওয়া উচিত।
দুপা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে আছে কেভিন লপার, আত্মবিশ্বাস ঠিকরে পড়ছে তার দাঁড়ানোর মধ্যে। ঝুঁকে এসেছে কিছুটা, হাতজোড়া পিস্তল ছুঁইছুঁই। পুরোপুরি প্রস্তুত সে, এবং ডুয়েলের পরিণতি সম্পর্কেও নিশ্চিত। জেমস অ্যালেন শক্তপাল্লা ঠিকই কিন্তু তাকে অনায়াসে হারানো যাবে। বোকা আর কাকে বলে, ভাবল লপার, হাজার মাইল দূর থেকে মরতে এসেছে এখানে!
সোজা হয়ে বুক উঁচিয়ে দাঁড়াল সে, তারপর দুপা এগোল। নীরব হয়ে থাকা দর্শকরা ওর আচরণে হঠাৎ করে খাবি খেল মনে মনে। ওদের বিস্মিত দৃষ্টির পলক পড়ার আগেই বিদ্যুৎ খেলে গেল লপারের হাতে। পরিচিত পিস্তলের বাটগুলোর স্পর্শ তার মধ্যে আগুন ধরিয়ে দিল। কোমর সমান তুলে ট্রিগার টিপল। সহসা বুকে কিছু একটা প্রচণ্ড আঘাত করতে হাত কেঁপে গেল। টলে উঠল তার শরীর, লপারের মনে হলো ভূমিকম্প হচ্ছে। দূরে দাঁড়ানো জেমস অ্যালেনের দেহেই কেবল তার দৃষ্টি, অন্য কিছু দেখছে না—অ্যালেনের শরীর কাঁপছে। আগুন ঝরল তার হাত থেকে। ফের টলে উঠল বন্দুকবাজের দেহ। চরম বিস্ময়ের সাথে টের পেল শূন্য অনুভূতি হচ্ছে মাথায়। জোর পাচ্ছে না হাতের মুঠিতে, পিস্তল ধরে রাখতে কষ্ট হচ্ছে। হাঁটু ভেঙে পড়ে গেল সে। শেষবারের মত চেষ্টা করল পিস্তল তোলার, কিন্তু দশমণী পাথরের মত ভারী মনে হচ্ছে ওগুলোকে। সীমাহীন ক্লান্তি গ্রাস করছে তাকে, ঝাঁপসা দৃষ্টিতে দেখল এগিয়ে আসছে অ্যালেন। দৃঢ় পদক্ষেপ, একটুও টলছে না।
তুমি কে, অ্যালেন? নিচু, কঁপা স্বরে জানতে চাইল লপার। আমি বিশ্বাস করি না সাধারণ একজন জেমস অ্যালেন আমাকে হারিয়ে দিতে পারে।
শুনে শান্তি পাবে?
অসহায় দৃষ্টিতে জেমসকে দেখল লপার। এটা হতেই পারে না, ভাবছে সে, এভাবে হেরে যাবে সাধারণ এক লোকের কাছে বিশ্বাসই করতে পারছে না।
মেয়েটাকে মনে পড়ে, ইনগ্রস?
দুর্বোধ্য একটা আওয়াজ করল সে, কিছু বলল না। মরার আগে তাকে শেষ মানসিক কষ্টটা দিতে চাইছে জেমস অ্যালেন, যেন জেনে যেতে পারে কেন, কোন কারণে মারা যাচ্ছে।
এলিসনের নাম শুনেছ, ইনগ্রস? ফ্লিন্ট এলিসন আমার নাম।
ইশশ, আগে যদি জানত! হাহাকার উঠল লপারের সারা শরীর জুড়ে। ঘুণাক্ষরেও মেয়েটার গায়ে হাত দিত না সে, কিংবা আজ ডুয়েল লড়ত না। চরম ক্লান্তিতে নুয়ে পড়ল তার শরীর। তুমিই জিতলে, এলিসন। আমার সান্ত্বনা সেরা একজনের কাছে হারলাম? বলার চেষ্টা করল সে, কিন্তু একটা শব্দও বেরোল না মুখ দিয়ে। অন্ধকার চিরতরে গ্রাস করল তাকে।
কেভিন লপারের দেহের পাশে দাঁড়িয়ে থাকল জেমস, পকেট থেকে সিগার কেসটা বের করে চোখের সামনে তুলে ধরল। ক্ষীণ হাসি ফুটল ওর মুখে, তারপর সেটা ছুঁড়ে দিল লপারের ভূলুণ্ঠিত শরীরের ওপর। তোমার জিনিস তোমাকে ফেরত দিলাম, ইনগ্রস। ওটা এখন আর আমার কোন কাজে আসবে না।
পরদিন বিকেল।
স্যাফের ওপরের তলায় রোজালিনার কামরা। জানালার কাছে দাঁড়িয়ে আছে জেমস অ্যালেন, ফ্লো মাউন্টেনের ওপর স্থির হয়ে আছে ওর চোখ। অনেকক্ষণ ধরে চেয়ে থাকল, আসলে ভাবছে: মেয়েটাকে কি করে বলা যায় কথাটা?
একটু পর ঘুরে তাকাল সে। মেক্সিকান গোলাপ চেয়ে আছে। আমি তোমাকে কিছু কথা বলব।
ছোট্ট করে মাথা ঝকাল রোজালিনা, মুখে কিছুই বলল না।
তোমরা আমার সত্যিকার পরিচয়টা জানো না।
তোমার নাম জেমস এলিসন, এই তো? এরপরও যদি কিছু লুকানোর থাকেও, ওসব নিয়ে ভাবছি না। আমি তোমাকে বুঝতে পারি সেটাই তো বড় ব্যাপার, তাই না?
পুরোটা জানো না তুমি। জেমস ফ্লিন্ট এলিসন। রোজালিনার দিকে তাকাল জেমস, বোঝার চেষ্টা করল নামটা মেয়েটির মধ্যে কি প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে।
সামনে এসে দাঁড়াল রোজালিনা, গভীর দৃষ্টিতে দেখছে জেমসকে। ওকে দেখে মনে হচ্ছে না সারা পশ্চিমে পরিচিত নামটার আলাদা কোন অর্থ আছে ওর কাছে। নামটা আমার কাছে ভাল লাগছে, মৃদু স্বরে বলল ও।
আমার জীবনটা খুব অনিশ্চিত, রোজ। লপারের মতই হয়তো খুন হয়ে যাব কোন একদিন।
আমি একটা বোকা মেয়ে, জেমস। যুক্তি-টুক্তি কম বুঝি। কিন্তু এটুকু নিশ্চিত জানি, আমি ভুল করিনি এবং ঠকবও না। আমার মধ্যে কোন দ্বিধাও নেই। একটু থামল ও, তারপর চঞ্চল চোখজোড়া স্থির হলো জেমসের চোখে। জেমস, এলিসন, তোমার চোখ বলে দিচ্ছে তুমি আমাকে চাও, চাও না? তাহলে দ্বিধা করছ কেন?
অসহায় দেখাল জেমসকে, কি বলতে চেয়েও মাথা নাড়ল। তারপর ঘুরে ফের জানালা গলে তাকাল বাইরে। কাল চলে যাব আমি। তিন বছর আগে বেরিয়ে পড়ার পর নিজের বাড়িতে আর যাওয়া হয়নি।
কাল সকালে গির্জায় যাব। লপারকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছি, ওটা আমি ভাঙতে পারি না।
ঝট করে ঘুরে দাঁড়াল জেমস, বিস্ময় দুচোখে। বুঝতে পারছি না।
ঠিক করেছি মায়ের বিয়ের গাউনটা পরব কাল। আর তুমি যদি বলো কোন স্টোর থেকে না হয় কিনে নেব একটা। লপারকে যখন কথা দিয়েছি বিয়ে করব, সেটা তো রাখতে হবে, তাই না?
বাজে বকছ, রোজ! অস্ফুট স্বরে বলল জেমস, বিছানায় এসে বসেছে।
আমি ভাবছি তুমি বিয়ে করতে রাজি হবে কি-না, মিটিমিটি হাসছে রোজালিনা, জেমসের সামনে এসে দাঁড়িয়ে দুই বাহু রাখল ওর কাঁধে। মজার ব্যাপার কি জানো তুমি বিয়ের প্রস্তাব দেয়ার আগেই আমি পণ করেছি তোমাকেই বিয়ে করব আগামীকাল। আর দেখো, লপারও তাতে সায় দিয়ে দিল কিভাবে! কাগজে কি লিখলাম পড়েও দেখল না সে। জেমস, আমি কি ভুল করেছি? আমি তোমার প্রিয় আরেকটা মোনা হতে চাই!
উঠে দাঁড়িয়ে দুহাতে রোজালিনার কোমর বেষ্টন করল জেমস। খুব বড় ঝুঁকি নিয়েছিলে তুমি। লপার যদি পড়ে দেখত? তারপর কি হত…
অত কিছু ভেবে দেখিনি, বাধা দিল রোজালিনা, উষ্ণ কামরার নীরবতা ছাপিয়ে উঠল ওর রুদ্ধ কণ্ঠস্বর। জীবনে এমন করে আর কিছু চাইনি আমি, মনেপ্রাণে তোমাকে আশা করছিলাম। আমার বিশ্বাস ছিল লপারের বাড়িতে যাবে তুমি, কিন্তু দেরি দেখে খুব কষ্ট হচ্ছিল।
ছোট্ট একটা বাথান আছে আমার, রোজ। কোন রকমে চলে যায়। তোমার তাতে চলবে?
দুবাহু তুলে জেমসের গলা জড়িয়ে ধরল রোজালিনা। খুব চলবে, জেমস! প্রবল আবেগে গলা বুজে আসছে ওর। কিন্তু আগে তোমাকে স্থির করতে হবে আমাকে মোনার মত ভালবাসবে কি-না।
ওকে বুকে টেনে নিল জেমস।
প্রবল নির্ভরতায় তাকে আঁকড়ে ধরল রোজালিনা। ফ্লিন্ট এলিসন? উঁহু, ওর কাছে সে অহঙ্কারী একরোখা অপ্রতিভ জেমস অ্যালেন। নিষ্ঠুর কিন্তু নিজের স্ত্রীকে যে আর দশজনের চেয়ে বেশিই ভালবাসে। রোজালিনার মনে হলো কালকের দিনটা হবে ওর জীবনের সবচেয়ে মধুর দিন। কাল যাবে তুমি?
না, রোজালিনার মুখ তুলে ওর কপালে চুমো খেলো জেমস। তবে তার পরেরদিন। সাথে আমার বউকে নিয়ে যাব। আমার শূন্য বাথানটা পূর্ণতা পাবে এবার।
<