ক্রেস্টলাইন থেকে ছয়-সাত মাইল এসে পশ্চিমে মোড় নিল জুলিয়াস। বিকেলের দিকে কলিন গেইলের বাড়ির উত্তরে পৌঁছল সে। ইচ্ছা করলেই ওখানে গিয়ে রাতের খাওয়াটা সেরে নেয়া যায়। তাছাড়া জিনা নিজেই দেখা করতে বলেছে, সুতরাং তার যাওয়াটা একেবারে অকারণ হবে না।
ভাবতে ভাবতেই একটা সিগারেট ধরাল জুলিয়াস। কি চায় জিনা? কেন সে আবার দেখা করতে বলেছে? যেতে গিয়ে ও ভিতর থেকে কেমন যেন একটা বাধা অনুভব করছে। বুঝতে পারছে ভিতরে ভিতরে জিনা কি বলবে এই ভয়টাই বাধা দিচ্ছে ওকে কিন্তু ভয় পাওয়ারই বা কি আছে? আঙুলে টিপে সিগারেট নিভিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল সে। কলিনের বাড়ির দিকে একবার মুখ তুলে চেয়ে হঠাৎ সোজা পশ্চিম দিকেই আবার ঘোড়া ছুটাল জুলিয়াস। জিনার সাথে পরে দেখা করলেও চলবে-পেপির সাথে দেখা করাই এখন তার প্রথম কাজ। রাত বারোটার দিকে গুহায় পৌঁছল সে। পেপি নেই ওখানে-অবশ্য এই অসময়ে পেপিকে এখানে আশাও করেনি ও। বিশ্রাম নেয়ার একটা জায়গা খুঁজে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল জুলিয়াস।
পরদিন সকাল দশটায় পেপিকে দেখা গেল। ঝর্নার পাশ দিয়ে ঘোড়ায় চড়ে এগিয়ে আসছে সে। আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে পেপিকে কেউ অনুসরণ করেনি দেখে সামনে বেরিয়ে এসে বলল, সুপ্রভাত, পেপি।
ক্লান্ত আর শুকনো দেখাচ্ছে ওকে। তাড়াতাড়ি জুলিয়াসের দিকে ফিরে সে বলল, আমি ভাবিনি…
যে গুহাটার কথা মনে থাকবে আমার? কথার মাঝেই বলে উঠল সে। ছেলেবেলায় পেপিই এই গুহার নামকরণ করেছিল।
না, তুমি খবরটা পাবে কিনা, আর পেলেও আসবে কিনা বুঝতে পারছিলাম না।
কেন?
গতবার আমার সাথে দেখা করতে এসে অনেক ভোগান্তি হয়েছে তোমার।
সেটা তো আর তোমার দোষ নয়।
ঘোড়া থেকে নামল পেপি। মাডি লোকটা আস্ত একটা জানোয়ার। শুনেছি সে নাকি খালি হাতেই একবার একজন লোককে মেরে ফেলেছিল।
ঘোড়াটা গাছের সাথে বেঁধে রেখে ঝর্নার ধারে গিয়ে বসল ওরা। তোমাকে কেউ অনুসরণ করেনি তো? জিজ্ঞেস করল জুলিয়াস।
সুন্দর করে হেসে মাথা নাড়ল পেপি। না, আমার পিছন পিছন কেউ আসবে না। লোকজন বেশির ভাগই বাইরে গেছে, তাছাড়া কেউ আমার পিছু নিলে এডের কাছে তাকে জবাবদিহি করতে হবে। নিজস্ব একজন পুরুষ থাকার এটাই সুবিধা।
এখন কোথায় সে?
বাসায়। আমি কোথায় আর কি জন্যে এসেছি, সব জানে ও। তুমি রাজি থাকলে আজ বিকেলে ওকে নিয়ে আসতে পারি।
সেটা দেখা যাবে। হ্যাঁ বা না, কিছুই বলল না জুলিয়াস।
আমার যা বক্তব্য সেটা ঠিক পছন্দ হবে না তোমার!
বলেই দেখো না।
আমি কি চাই তা আমি জানি। এডকে আমার চাই, তোমাকে আর জারভিসকে আমি আবার আগের মত বাড়িতে দেখতে চাই; চাই মেডক আর তার ভাড়া করা লোকজনকে রকিং এইচ থেকে তাড়িয়ে দেয়া হোক।
হাসল জুলিয়াস। পেপির কথায় অবাক হয়নি সে। বলল, লম্বা অর্ডার।
কিন্তু তা-ই চাই আমি।
এডের কি মত?
ও বলে চেষ্টা করা যায়-তবে ফল কি হবে বলা যায় না।
তুমি কি সত্যিই ওকে ভালবাসো?
হ্যাঁ।
আর সে?
মুখ তুলে জুলিয়াসের দিকে তাকাল পেপি। আমার মনে হয় সে-ও আমাকে ভালবাসে। অন্তত এমন করে আগে আর কেউ আমাকে চায়নি।
তাহলে এখন কি হবে?
জানি না, জুলিয়াস। তবে ওকে বিয়ে করব আমি। বাবার মৃত্যুর পরে খামারের একটা অংশ ভাগে পাব আমি। মেডকের ধারণা এডের মাধ্যমে সেটা হাত করবে সে। তবে এড এত সহজে ছেড়ে দেবে না। ওদের মধ্যে ঠোকাঠুকি লাগতে বাধ্য।
অর্থাৎ তুমি জানতে চাও দরকার পড়লে এডকে আমি সাহায্য করব কিনা?
কেন করবে না? সম্পত্তিতে তোমারও ভাগ আছে।
বাবা তো আমাকে ত্যাজ্যপুত্র করেছেন।
বাবা অসুস্থ অবস্থায় রাগের মাথায় কি না কি বলেছেন-ওটা তার মনের কথা নয়।
কনুই-এ ভর দিয়ে গা এগিয়ে বসল জুলিয়াস। বাবার শরীর কেমন, পেপি?
দুর্বল। গতরাতে তাঁর ঘরে গেছিলাম-সব কথাই খুলে বললাম বাবাকে। কিছুই বাদ দিইনি। এড় আর আমার কথা থেকে শুরু করে তোমার, জারভিনের, মেডকের-সবার কথাই বললাম। মিথ্যে কথাও একটা বললাম-বলেছি নিজেরা আলাপ করে আমরা একটা পন্থা ঠিক করেছি, চিন্তার কিছুই নেই, সব ঠিক হয়ে যাবে। বাবা যে কতটুকু শুনেছেন ঠিক বুঝলাম না, অর্ধেক শোনার পর মনে হলো যেন শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েছেন।
তবে তো বোঝা যাচ্ছে উনি সত্যিই অসুস্থ-তোমার এভাবে সব কথা বলে তাঁকে বিব্ৰত করা ঠিক হয়নি।..হ্যাঁ, জারভিসের কি খবর?
খুব খারাপ। দিন দিন আরও খারাপের দিকেই যাচ্ছে। সেদিন মেডকের সাথে ঝগড়া করেছে ও। নিজেকে বড় কেউ ভাবতে আরম্ভ করেছে সে। এড বলেছিল, ও যদি হিউ হারপারের সাথে মাতব্বরি ফলাতে যায় তবে ওকে করে ফেলবে হিউ।
ওকে বাঁচানো হয়তো আমাদের পরে সম্ভব হবে না, মন্তব্য, জুলিয়াস।
কিন্তু ও যে আমাদেরই ভাই-ওকে বাঁচাতেই হবে।
মাথা নেড়ে আবার উঠে বসে জুলিয়াস বলল, সত্যি কথাটা স্বীকার করতেই হবে, জীবনটা ছেলেখেলা নয়। এখন যে পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে তাতে মেডকের সাথে সংঘর্ষ বাধলে বলা যায় না এডও মারা যেতে পারে। এর সাথে জড়ালে আমারও মৃত্যু ঘটতে পারে–তুমি নিজেও নিরাপদ নও।
এড আর আমি যদি পার্ক ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যাই, তাহলে কি হয়?
এডমন্ড পালাবার লোক নয়। আর তাতেও জারভিসের কোন সুরাহা হচ্ছে। না। সে তো বোকার মত মাতব্বর সেজে মহা আনন্দেই আছে।
তবে কি এই বিয়েতে আমার রাজি না হওয়াই উচিত?
জানি না তুমি রাজি না হলে ওরা কোন পথ ধরবে-তবে কিছু একটা করবেই। সব চাবিকাঠিই এখন ওদের হাতে।
লম্বা করে একটা শ্বাস নিল পেপি। তাহলে বলতে চাও এর থেকে মুক্তি পাওয়ার সহজ কোন রাস্তা নেই?
ঠিকই ধরেছ।
তোমার সাথে দেখা করার জন্যে এডকে নিয়ে আসব?
নিরুৎসাহিতভাবে ধীরে মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানাল জুলিয়াস। ক্ষতি কি? ওকে ভাল করে জানার কৌতূহল হচ্ছে আমার। জানি না, হয়তো সে মেডকের চেয়েও খারাপ।
কেন যেন ওর কথায় রাগল না পেপি। উল্টো হেসে মাথা নেড়ে বলল, তুমি চেনো না ওকে, জুলিয়াস। জানি ওর সম্পর্কে অনেক কথাই তুমি বলতে পারো, কিন্তু ওর সাথে ঘনিষ্ঠভাবে মিশে, প্রচুর সময় একসাথে কাটিয়ে, ওর বাইরের শক্ত খোলসটার ভিতরে একটা সুন্দর রুচিশীল মানুষ খুঁজে পেয়েছি আমি।
ভালমতই মজেছ দেখছি, দুষ্টুমি ভরা মুখে বলল জুলিয়াস।
হ্যাঁ, পুরোই ডুবেছি।
বিয়ে কবে করছ?
সামনের রোববার। অর্থাৎ আর চারদিন।
মুখ সামান্য তুলে আকাশের দিকে চেয়ে আছে পেপি, গালে গোলাপি আভা। স্বপ্নালু চোখে সুখের স্বপ্ন দেখছে সে। ওর কোমল প্রশান্ত মুখ থেকে দুশ্চিন্তার ছায়া মিলিয়ে গেছে। কল্পরাজ্যে হারিয়ে যাওয়া কনের মতই দেখাচ্ছে ওকে। চট করে ওর হাতের ওপর হাত রেখে সস্নেহে মৃদু চাপ দিল জুলিয়াস। পেপি; তুমি সুখী হও, এ-ই আমি চাই। যাও, ওকে নিয়ে এসো।
হাসতে হাসতেই বিদায় নিয়ে রওনা হয়ে গেল পেপি। এতদিন পরে ওকে আবার এমন সুন্দর প্রাণখোলা হাসি হাসতে দেখে জুলিয়াসের মনটা খুশিতে ভরে উঠল। কিন্তু ওর এই হাসি কতদিন থাকবে? এড়ের সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানে না সে-পেপি কি ওকে বিয়ে করে সুখী হবে? বিয়ের পরে গতানুগতিক একাণেয়ে রুটিনে কি নিজেকে মানিয়ে নিতে পারবে এড?
সাথে করে আনা খাবার খেয়ে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছে জুলিয়াস। বিকেলের শেষ ভাগে ওদের দূর থেকে আসতে দেখল সে। ঘোড়ার পিঠে পেপি এডকে পথ দেখিয়ে নিয়ে আসছে। খোলা জায়গাটায় পৌঁছে পিছন ফিরে হাসতে হাসতে এডকে কি যেন বলল পেপি। হাসি মুখেই জবাব দিয়ে ঘোড়া থেকে নেমে পেপিকে দু’হাতে শূন্যে তুলে মাটিতে নামিয়ে দিল সে। নিশ্চিন্ত আত্মহারা এডের চেহারা-কোনরকম দুশ্চিন্তার ছায়া নেই ওর মুখে।
পেপিই প্রথম জুলিয়াসকে দেখতে পেয়ে বলে উঠল, এই যে, জুলিয়াস, ওকে নিয়ে এসেছি।
জুলিয়াস ওদের দিকে কিছুটা এগিয়ে গেল, এসো, পেপি। কি খবর, এড?
এই তো, হাতটা একটু তুলে জবাব দিল এড। তোমার কেমন চলছে?
দু’জনেই দু’জনের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে দাড়িয়ে আছে। একে অন্যকে মেপে দেখছে। ভিতরে ভিতরে কেমন একটা বিরূপ ভাব কাজ করছে জুলিয়াসের মনে। সে বুঝতে পারছে এড়েরও একই অনুভূতি হচ্ছে।
মাটিতে পা ঠুকে প্রতিবাদ করল পেপি। খুব হয়েছে! মনে হচ্ছে তোমরা কঠিন দৃষ্টিতে চেয়েই পরস্পারকে ভস্ম করে ফেলবে।
কই, আমি কঠিন চোখে চাইনি তো? আপত্তি জানাল জুলিয়াস।
সাথে সাথেই এডও বলে উঠল, আমিও না!
এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে দিল এড। আনন্দের সাথেই ওর হাতটাও গ্রহণ করল জুলিয়াস।
খুশি হলাম। এবার আলোচনা শুরু করা যায়, আশ্বস্ত হয়ে বলল পেপি।
ঘোড়া দুটোকে নিয়ে গাছের সাথে বেঁধে রাখল এড়। তারপর ভাল একটা জায়গা বেছে নিয়ে তিনজনে বসল। কোনরকম ভণিতা না করে সরাসরি কাজের কথায় চলে এল এড। জুলিয়াস, আমরা সামনের রোববারে বিয়ে করব বলে ঠিক করেছি।
মাথা ঝাঁকাল জুলিয়াস। হ্যাঁ, শুনেছি। পেপি বলেছে আমাকে।
তোমার কথায় মনে হয় খুশি হওনি তুমি।
মুখ তুলে সোজাসুজি এডের দিকে চাইল জুলিয়াস। পেপি ভুল করছে কিনা সেটাই ভাবছি আমি।
অস্বীকার করে লাভ নেই, পেপির আরও ভাল কোন পাত্র হলেই যোগ্য জুড়ি হত। মিথ্যা বলব না, মেডকের প্ল্যান অনুযায়ী আমি পেপিকে বিয়ে করার উদ্দেশ্য নিয়েই এসেছিলাম। কথা ছিল আমি পেপিকে রাজি করাতে না পারলে ওরা অন্য পথ ধরবে।
তবে তো তোমার গর্ব বোধ করাই উচিত? ফোড়ন কাটল জুলিয়াস।
আমাকে খেপিয়ো না, রাগের সাথে বলে উঠল এড। এই ভাবেই প্ল্যান করা হয়েছিল। প্ল্যানটা আমার নয়, মেডকের। একঘেয়ে কাজ করতে করতে আমি হাঁপিয়ে উঠেছিলাম-এই কাজটা আকর্ষণীয় মনে হওয়ায় এটা নিয়েছি-এতে আমার দোষটা হলো কোথায়?
পেপিকে বিয়ে করতে যাচ্ছ তুমি।
ওকে ভালবেসে ফেলেছি আমি।
হয়তো।
এডের চোখ দু’টো কঠিন হলো। তোমার ভালর জন্যেই বলছি, অমন কথা দ্বিতীয়বার আর উচ্চারণ কোরো না।
গলার স্বরে জুলিয়াসের মনে হলো যথার্থই খেপেছে লোকটা। পেপির দিকে চাইল সে। এতক্ষণ একটা কথাও বলেনি মেয়েটা। ওর চুপ করে থাকতে যে কত কষ্ট হচ্ছে তা স্পষ্ট বুঝতে পারছে জুলিয়াস। হাত দুটো কোলের ওপর মুঠো করে রাখা-মুখটা বেদনায় ক্লিষ্ট।
মেডকের প্ল্যানটাই তাহলে শোনা যাক, সংযত স্বরে বলল জুলিয়াস। তোমাদের বিয়ের পরে কি ঘটবে?
মেডকই আগের মত র্যাঞ্চ চালাবে। পেপি ওর জমি আমার নামে লিখে দেবে, সেটা আমাকে দিয়ে নিজের নামে লিখিয়ে নিয়ে আমার পাওনা মিটিয়ে দেবে মেডক।
অর্থাৎ সবকিছুই শেষ পর্যন্ত মেডকের পেটে যাচ্ছে?
সেই রকমই পরিকল্পনা, জুলিয়াস।
জারভিসের কি হবে?
নিজের বোকামির জন্যে কোন দুর্ঘটনায় মারা পড়বে সে।
পেপি বলেছিল মেডকের সাথে তোমার বিরোধ বাধবে।
মৃদু হাসল এড। অবশ্যই বাধবে, কারণ ওর প্ল্যান অনুযায়ী পেপিকে আমার নামে জমি লিখে দিতে বলব না আমি। আমার মাধ্যমে মেডক কোনদিনই পেপির সম্পত্তি পাবে না।
তোমাকে মেরে ফেলবৈ ও।
চেষ্টা সে অবশ্যই করবে। কিং অ্যালেনবির সাথে রেভ রিভার এলাকায় দলগতভাবে কাজ করার সময়ে মেডকের সাথে আমার পরিচয়। লোকটা পিস্তলের যাদুকর। এছাড়া রয়েছে হিউ হার্পার। তিনবার ওকে নিজের চোখে অ্যাকশনে দেখেছি-আজ পর্যন্ত ওর সাথে তুলনা করার মত কাউকে দেখিনি। এই রকম আরও তিনজন উঁচুদরের বন্দুকবাজ রয়েছে ওদের সাথে-হোয়েল কিড, হোরেস আর চাক। ওদের মধ্যে বিশেষ করে হোয়েল কিড খুব সাংঘাতিক লোক। আরও একজন ছিল, কার, কিন্তু তোমার দৌলতে ওর কথা আর ভাবতে হবে না আমাদের।
এতসবের মোকাবিলা করার চেয়ে পালিয়ে যাওয়াই তো বুদ্ধিমানের কাজ, কি বলো? জানতে চাইল জুলিয়াস।
আমি শুধু পেপির প্রেমেই পড়িনি, জুলিয়াস, পার্ককেও ভালবেসে ফেলেছি। এখানেই ঘর বেঁধে বসবাস করতে চাই আমি। এখানে এত দূরে হয়তো আমার অতীত আর আমাকে বিব্রত করবে না। নতুন করে জীবন আরম্ভ করতে পারব। ছেলেবেলায় র্যাঞ্চেই বড় হয়েছি, র্যাঞ্চের সব কাজই জানা আছে আমার। অতীতে যা কিছু অন্যায় করেছি সব ভুলে নতুন করে বাঁচতে চাই আমি। এর জন্যে দরকার হলে রুখে দাড়াতেও আমি রাজি।
এডের কথাগুলো সত্যি হলে পেপির জন্যে ভালই হয়। কিন্তু জুলিয়াস আর ওর অতীত নিয়ে ঘাটতে চায় না, অন্য কথা পাড়ল সে।
জারভিসের কি হবে? প্রশ্ন করল জুলিয়াস।
ওকে নিয়ে যে কি করা যায় তা নিজেও ভেবে পাই না আমি, নিজের মতামত প্রকাশ করল এড। তোমাদের ভাই হলেও একেবারেই ছেলেমানুষ আর বোকা ও। সেবাস্টিন দত্ত জীবিত আছেন বলেই ওরা এখনও হত্যা করেনি ওকে! ওর মাধ্যমে মেডক এখনও বেশ সুন্দর সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছে।
বাবা আর কতদিন বাচবেন?
কে বলতে পারে? মেডক তাঁকে যে-কোন সময়ে খতম করতে পারে, করছে না, কারণ পেপির সাথে আমার বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত তাঁকে ওর বাঁচিয়ে রাখা প্রয়োজন। তবে একটা কথা না বলে পারছি না, সেদিন তার ঘরে গিয়ে দেখলাম উনি ঘুমাচ্ছেন। যে বইটা তিনি পড়ছিলেন সেটা মাটিতে পড়ে আছে। ওটা তুলে তাকের ওপর রেখে দিয়ে ফিরে আসি আমি। পরে উনি ওটা চাইতে পারেন মনে করে ওটা তার হাতের কাছে এগিয়ে দেয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে ঘরে গিয়ে দেখি, ওই বইটাই তিনি পড়ছেন। জিজ্ঞেস করে জানলাম ঘরে আর কেউ আসেনি। তাহলে বইটা কে এগিয়ে দিল তাকে?
রুদ্ধশ্বাসে উঠে বসল পেপি। একথা আমাকে আগে বলোনি কে তুমি?
এখনও বলা হয়তো ঠিক হলো না, আমি তোমাদের আশা দিয়ে নিরাশ করতে চাই না। কিন্তু আমার ধারণা তাকে আমরা যতখানি দুর্বল আর অসুস্থ মনে করছি আসলে তিনি তা নন।
কিন্তু আমাকেও তো এ ব্যাপারে কোন কথা বাবা বলেননি?
এই কেনর জবাব পেতে হলে তোমার বুঝতে হবে জুলিয়াসের সাথে তিনি কেন দুর্ব্যবহার করলেন।
তার মানে?
আবার হাসল এড। পেপির দিক থেকে জুলিয়াসের দিকে চোখ ফিরাল সে। তুমিও বোঝেনি? তোমার তো বোঝা উচিত ছিল? সেবাস্টিন দও অসুস্থ, সন্দেহ নেই–কিন্তু দেহ অসুস্থ হলেও মাথায় তো আর কোন দোষ হয়নি তার। তিনি জানেন মেডকই সবকিছু চালাচ্ছে, জারভিস বোকা আর পেপি অসহায়। তাই জুলিয়াস যখন ফিরে এল তখন তাকে সাথে সাথেই অমন করে বের করে না দিলে আর একটা দিনও বাঁচার উপায় ছিল না ওর।
জুলিয়াসও পেপির মত সোজা হয়ে বসেছে এখন। ব্যাপারটাকে এই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আগে কখনও ভেবে দেখেনি। এডের ধারণা সত্যি হবার যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে তা ভাল করেই বুঝতে পারছে ও। তাকে বাঁচাবার জন্যে বাবা সবই করতে পারেন। আবেগে রুদ্ধ হয়ে এল জুলিয়াসের গলা। দুর্বল আর অসুস্থ অবস্থায় নিজের বাড়িতে বন্দী থেকেও জুলিয়াসের জীবন বিপন্ন হবে ভেবেই কারও কাছে সাহায্য চাননি তিনি।
সত্যি, সেবাস্টিন দত্ত একজন মানুষ বটে! বলে চলল এড। আমার বাবাও ঠিক এমনই ছিলেন। কঠিন, জেদী আর সৎ। অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে মারা পড়েছিলেন তিনি। এক রাতে সারা দেহে অসংখ্য গুলির জখম নিয়ে বাড়ি ফিরলেন। অন্য যে-কেউ হলে অনেক আগেই নির্ঘাত মারা যেত। কিন্তু আমাদের সাবধান করা আর সেই সাথে নিরাপদে পালিয়ে যাবার কথা বলার উদ্দেশ্যেই যেন জেদ করে বেঁচে ছিলেন তিনি। সেই রাতেই মাকে নিয়ে অন্যখানে চলে যাই আমি। তবে পরে পিতৃহত্যার প্রতিশোধ আমি নিয়েছি-তারপর থেকেই আমি ফেরারী।
নিজের জন্যে একটা সিগারেট বানিয়ে নীরবে এডের দিকে তামাক আর কাগজ বাড়িয়ে দিল জুলিয়াস।
রোববারেই বিয়ে করে ফেলাটা হয়তো আমাদের ঠিক হচ্ছে না, বলে উঠল পেপি।
সিগারেটের কাগজটা জিভের ডগা দিয়ে ভিজিয়ে মাথা নাড়ল এড। না, পেপি, দেরি করার উপায় নেই আমাদের। হয় রুখে দাঁড়াতে হবে, নয়তো পালাতে হবে।
বিয়ের পরে কি ঘটবে? প্রশ্ন করল জুলিয়াস।
সাথে সাথেই কিছু ঘটবে না হয়তো, কিন্তু বিয়ের পরে সেবাস্টিন দত্ত আর জারভিস দু’জনেই বিপদের মুখে পড়বে।
এর প্রতিকার জানা আছে আমার, মন্তব্য করল জুলিয়াস। আমাদের সমস্যার স্থায়ী সমাধান এতে হবে না বটে কিন্তু মেডক আপাতত ঠাণ্ডা থাকবে।
শুনি কি ফন্দি এঁটেছ?
জারভিসকে ঘিরেই আমার প্ল্যান। ধরো রোববার তোমাদের বিয়ে হলো, তোমরা এক সপ্তাহের জন্যে মধু-চন্দ্রিমা যাপন করতে কোথাও চলে গেলে। বিয়ের রাতেই জারভিসও নিরুদ্দেশ হলো।
কিন্তু জারভিস নিরুদ্দেশ হবে কেন? অবাক হয়ে প্রশ্ন করল পেপি।
হাসল জুলিয়াস। ওকে রাজি করানোর ভার আমার। কিন্তু ভেবে দেখো, এমন হলে কিন্তু মেডকের হাত থেকে নিরাপদ থাকছে জারভিস। ওকে হাতে না পেয়ে বাবার বিরুদ্ধে ও কিছু করতে সাহস পাবে না মেডক।
আলাপ আলোচনা আরও কিছুক্ষণ চলল। কিন্তু নতুন কোন প্ল্যান ওদের মাথায় এল না। এড আপত্তি জানাচ্ছিল যে জুলিয়াসের কাঁধেই কাজের গুরুভার পড়ল। কিন্তু সে নিজেও কম ঝুঁকি নিচ্ছে না, তাকে সবসময়ই থাকতে হচ্ছে। মেডক আর তার লোকজনের মাঝে।
জারভিসকে গায়েব করার সময় সাহায্য দরকার হবে না তোমার? প্রশ্ন করল এড।
হ্যাঁ, তবে ভাল লোকের অভাব হবে না আমার।
বিয়ের রাতেই কাজটা সারতে চাইছ?
ওই সময়েই সুবিধা হবে।
মনে রেখো উৎসবের রাতে মদ সবাই বেশি খাবে। নকারের পক্ষ নিয়ে কেউ প্রতিশোধ নেয়ার চেষ্টা করা বিচিত্র নয়। মদের আসরে একটা ঝগড়া বাধিয়ে নেয়া কঠিন হবে না।
সতর্ক থাকব আমি, শান্তভাবেই জবাব দিল জুলিয়াস।
বিয়ের আগে কোন কারণে দরকার হলে কিভাবে যোগাযোগ করব?
বিন্দুমাত্র না ভেবেই জুলিয়াস জবাব দিল, কোন খবর থাকলে সেটা লোলার কানে পৌঁছলেই আমি জানতে পারব। ওর ওপর পুরো বিশ্বাস আছে আমার।
কথা শেষ করে উঠল ওরা। জুলিয়াসও ওদের সাথে এল। ঘোড়ায় চড়ার আগে এডের হাতে হালকাভাবে পেপির হাতের ছোঁয়া লাগল। চট করে পেপির দিকে ফিরে চাইল এড। নীরবেই দৃষ্টি বিনিময় হলো ওদের। ওই দৃষ্টি দেখেই জুলিয়াস মনে মনে বুঝে নিল ওদের ভালবাসা কত গভীর। ওঁরা একে অন্যকে এমন আপন করে জেনেছে যে দৈহিক সংস্পর্শের দরকার পড়েনি ওদের, চোখের দৃষ্টি দিয়ে পরস্পরকে আলিঙ্গন করল ওরা। এগিয়ে এসে পেপির গালে চুমু খেলো জুলিয়াস। সুখী হও। তোমাদের দুজনেরই শুভ কামনা করি।
এডের সাথে হাত মিলিয়ে ওদের বিদায় দিল জুলিয়াস। অদৃশ্য না হওয়া পর্যন্ত ওখানেই দাঁড়িয়ে চেয়ে রইল সে। কয়েক ঘণ্টা আগেও জুলিয়াস বিশ্বাস। করেনি পেপি আর এড বিয়ে করে সত্যিকার সুখ খুঁজে পাবে। কিন্তু ভুল ভেঙেছে ওর। বুঝেছে সুখ এখন ওদের হাতের মুঠোয়-ওদের ভাগ্য প্রসন্ন।
<