খানওয়াহর সেনারা

মার্চের স্যাঁতস্যাতে একটা দিন। সম্ভবত সালটা ১৯৩৬। মসজিদ থেকে নামাজ পড়ে ফিরছি আমরা। এসময়ই হঠাৎ বর্মের সঙ্গে তরোয়াল বাড়ি খাওয়ার আর সৈন্যদের যুদ্ধ করার আওয়াজ পেলাম। প্রচুর শব্দ হচ্ছে। মনে হলো যেন নরক ভেঙে পড়েছে। কিন্তু চৌহদ্দিতে কোনো জনমানব দেখা গেল না। কিছুক্ষণ থ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। কী হয়েছে বোঝার চেষ্টা করছি। তারপরই ভয়ে দৌড়তে দৌড়তে গ্রামে ফিরে এলাম। সংবাদপত্রের এক প্রতিনিধিকে কথাগুলো বলেছিলেন ১১৪ বছরের বৃদ্ধ সরদার আলি। ভারতের রূপবাস এলাকার খানওয়াহ গ্রামের এই বুড়োকে এলাকার লোকেরাও দারুণ শ্রদ্ধা করে।

১১০০ বছর আগে গ্রামটি প্রতিষ্ঠা করেন খান মুহাম্মদ পাঠান। গোটা গ্রামটাতেই এখনও দেখতে পাবেন ঐতিহাসিক বিভিন্ন ধ্বংসাবশেষ। নানা ধরনের গল্প, লোককাহিনি ছড়িয়ে আছে একে ঘিরে। গ্রাম লগোয়া বিশাল এক মাঠে রাজপুতদের সঙ্গে তুমুল লড়াই বেধেছিল মোঘল সেনাদের, তাই পর্যটকদেরও আনাগোনা দেখা যায় এই গ্রামে।

সরদার আলির কাছ থেকে জানা যায় তার অনেক পূর্বপুরুষই রাতের বেলায় মরণপণ যুদ্ধের শব্দ আর অস্ত্রের ঝনঝনানি শুনেছেন। এমনকী তাঁদের কেউ-কেউ ময়দানে লড়াইয়ে মত্ত সেনাদেরও দেখেছেন। তার ছোট বয়সে বাপ-দাদারা বলেছেন রাজপুত আর মোঘল সেনাদের আত্মারা গ্রামের পশ্চিমে পাহাড়ের পিছনের সমতলে ঘোরাফেরা করে। রাজপুত আর মোঘলদের যুদ্ধে যেসব সেনা প্রাণ হারিয়েছে এরা তাদেরই আত্মা।

ইতিহাস বলে ১৫২৭ সালের ১৬ মার্চ, শনিবার রাজপুত শাসক রানা সংগা আর জহিরুদ্দিন বাবরের সেনাদের মধ্যে লড়াই হয়েছে এই এলাকায়। এর বেশিদিন আগের কথা না, ইব্রাহীম লোদীর মুখোমুখি হয়েছিলেন বাবর। ১৫২৬ সালের ২১ এপ্রিলে পানিপথের ওই যুদ্ধে লোদীর সেনাদের ভালমতই নাকানিচুবানি খাইয়েছিলেন বাবর।

খানওয়াহর যুদ্ধে বাবরের সেনারা অবস্থান নিয়েছিল পাহাড়ের ধারের ময়দানে। পিছন থেকে যেন রাজপুতরা আক্রমণ করে ভড়কে দিতে না পারে তাই গভীর পরিখা খনন করা হয় এলাকাটায়। এদিকে সামনে গরুর গাড়ির পিছনে বসানো হয় কামান। মার্চের ১৬ তারিখ সকাল ৯টার দিকে রানা সংগার লোকেরা আক্রমণ চালায়। লড়াই চলে দশ ঘণ্টা। এসময় কামানের গোলার আঘাতে রানা সংগার প্রচুর সেনা মারা পড়ে। রানা সংগা নিজেও মারাত্মকভাবে আহত হন। আর এই আঘাতের কারণেই মাত্র ৪৬ বছর বয়সে মারা যান তিনি।

খানওয়াহর গ্রামবাসীরা আর রাজস্থানের সাধারণ লোকেরা বিশ্বাস করে পরাজিত, ক্রুদ্ধ রাজপুত সেনারা এখনও এই এলাকায় ঘুরে বেড়ায় শত্রুর খোঁজে। রাজস্থানে নিহত রাজপুতদের নিয়ে নানার ধরনের গল্প প্রচলিত আছে। বলা হয় খানওয়াহর অশুভ এই যুদ্ধক্ষেত্রে রাতের বেলা জ্বলন্ত মশাল নিয়ে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায় ছায়ামূর্তিদের। কেউ জানে না কীজন্য তারা ঘুরে বেড়ায় আর কী-ই বা খোঁজে তারা?

<

Super User