পরদিন টেকনের যখন ঘুম ভাঙল তখন চারদিক আলোয় ঝলমল করছে। ক্যাথি ওকে ঘর ছেড়ে দিয়ে মায়ের সঙ্গে শুয়েছিল।

কফির গন্ধ পেল টেকন। নিশ্চয় মেরী রয়েছে রান্নাঘরে। একটা চুরুট ধরাল সে। পরিতৃপ্তি লাগছে। ফুরফুরে একটা অনুভূতি। বিরাট একটা দায়িত্ব পালন করা হয়ে গেলে যেমন লাগে ঠিক তেমনি।

নিচে বারান্দায় নেমে এল সে। ক্যাথি ঘুম থেকে ওঠেনি এখনও। ওর মা-ও নয়।

হিগিন্সের মৃতদেহ পড়ে রয়েছে কালকের জায়গাতেই। তবে একা নয় ওটা, সাথে আরেকজনকে দেখতে পেল টেকন? গ্রিফিথ। হাতড়াচ্ছে হিগিন্সের পকেটগুলো। হঠাৎ মুখ তুলেই দেখতে পেল টেকনকে। ছাই হয়ে গেল মুখ। প্রচণ্ড ভয় পেয়েছে। টেকন চুপ করে চুরুট টানতে লাগল। গ্রিফিথের এক হাতে অনেকগুলো নোট। অন্য হাতে হিগিন্সের সোনার ঘড়িটা। আমতা আমতা করে বলল, আমার পাওনাটা মিটিয়ে নিচ্ছি।

নাও, টেকন বলল। চুরুটটা বার করে আবার বলল, দেখে মনে হচ্ছে পাওনার চেয়ে বেশিই নিচ্ছ। ঠিক আছে, লাশগুলো কবর দেয়ার দায়িত্বও তোমার।

আঁ?

এদের সবার জন্যে কবর খোড়। জলদি। আমি চাই না ক্যাথিরা এসব দেখুক, মৃদু কণ্ঠে আদেশ দিল সে।

একার পক্ষে কি করে সম্ভব, স্যার? আরেকজন লাগবে। তুষার জমে শক্ত হয়ে গেছে, কৈফিয়ত দিল গ্রিফিথ।

যা বলছি কর, কড়া গলায় বলল টেকন।

মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিল গ্রিফিথ, বারান্দা থেকে নেমে টেকন বাইরে বেরিয়ে এলে সে বলল, উইলসন এখনও বেঁচে আছে, স্যালুনের বারান্দার সামনে পড়ে রয়েছে।

অবাক হয়ে গেল টেকন, বেঁচে আছে? এই ঠাণ্ডার মধ্যে ওকে বাইরে ফেলে রেখেছ? পিকোর কি খবর?

বাঙ্কহাউসে আছে। সামান্য আহত। সেরে যাবে। চুরুটটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে স্যালুনের দিকে দ্রুত পা চালাল টেকন।

উইলসন গুলি খেয়ে পড়ে ছিল সে জায়গাতেই। সারা রাত। তাতে একদিক দিয়ে ভালই হয়েছে তার জন্যে। ঠাণ্ডায় জমে গেছে রক্ত। ফলে বন্ধ হয়ে গেছে রক্তপাত। বিশাল কোটটা এখনও চাপানো রয়েছে গায়ে। টেকনকে দেখে হাসার চেষ্টা করল সে। ফুটল না হাসিটা। ওকে কাঁধে তুলে নিল টেকন। হাঁটতে শুরু করল ক্যাথিদের বাড়ির দিকে।

আমাকে ক্ষমা করে দিও, ফিসফিস করে বলল উইলসন।

কেন? প্রশ্ন করল টেকন।

তোমাকে ধোকা দিয়েছি আমি। মিথ্যে বলেছি। প্রায় বুজে এল উইলসনের গলা। টাকার লোভে…

ওসব কথা বাদ দাও, আমি তোমার কাছে কৃতজ্ঞ। তোমার জন্যেই এখনও বেঁচে আছি আমি, ওকে সান্তনা দিল টেকন।

তোমার তুলনা নেই, বন্ধু, নিজেকে সামলাতে পারল না উইলসন। ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল।

ক্যাথিদের বাড়িতে পৌঁছে দোতলায় উইলসনকে নিয়ে গেল টেকন। শুইয়ে দিল, বিছানায়। ক্যাথিকে ডেকে এনে বলল, ওকে শিগগির ব্যাণ্ডেজ বেঁধে দাও,

উইলসনের পা থেকে বুটজোড়া খুলে দিল টেকন।

এসময় এলেন ক্যাথির মা। উইলসনকে দেখে বিশেষ অবাক হলেন না তিনি। সব ঘটনাই জানা আছে তার। টেকনকে বাঁচিয়েছিল উইলসন।

টেকন এসময় ক্যাথিকে বলল, আমি পিকোকে নিয়ে আসছি। ওকেও কিন্তু সেবা করতে হবে তোমার।

কোনও অসুবিধে নেই। নিয়ে এস তুমি। তাছাড়া পিকোর জন্যে মেরী তো রয়েছেই। ক্যাথি বলল-মজা করে।

হেসে ফেলল টেকন। তোমার হাতের কি অবস্থা?

ভাল। সামান্য ব্যথা আছে। সপ্তাহখানেকের মধ্যেই পুরোপুরি শুকিয়ে যাবে।

ক্যাথির হাতটা টেনে নিয়ে দেখল টেকন।

আরও তিনদিন রইল টেকন। ক্যাথিদের সাহায্য করল অসুস্থদের সেবা করার ব্যাপারে।

চতুর্থ দিন আঁধার থাকতেই ক্যাথিকে জাগাল, টেকন। আকাশে তখন তারাদের রূপালী মেলা। চাঁদ আর তারার জ্যোতি ছাড়া আর কোনও আলো নেই।

শোন, আমি আর খানিক বাদেই চলে যাব, টেকন বলল।

ক্যাথি, অবাক হল না মোটেও। টেকনকে যে বাঁধনে জড়ানো যাবে না, এ ক’দিনে বুঝে গেছে সে।

আজই যাবে?

হ্যাঁ।

আমার কথা কিছু ভেবেছ?

ভেবেছি, উইলসনের সঙ্গে কথা হয়েছে আমার। ও সুস্থ হয়ে উঠলে তোমাদের পৌঁছে দেবে। উইলসন ভদ্রলোক। ওর ওপর বিশ্বাস রাখতে পার। ক্যাথির প্রশ্নটা বুঝেও না বোঝার ভান করল টেকন।

কোনদিকে যাবে ঠিক করেছ? হতাশ হয়ে প্রশ্ন করল ক্যাথি।

দক্ষিণে। তুষার আর ভাল লাগছে না।

সারাজীবন কি এভাবেই কাটাবে? খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল ক্যাথি।

ভাবিনি কিছু।

ভাববে না কখনও?

ভাবলে সবার আগে তোমাকে জানাব।

জিনিসপত্র গুছিয়ে নিল টেকন। তাকে সাহায্য করল ক্যাথি। স্যাডলব্যাগটা নিয়ে নিচে বারান্দায় নেমে এল টেকন। সঙ্গে ক্যাথি। ওরা দুজন ছাড়া জেগে নেই আর কেউ। স্যাডল ব্যাগটা নামিয়ে রেখে দু’হাত বাড়িয়ে দিল টেকন। ক্যাথির দিকে। ধরা দিল ক্যাথি। পেরিয়ে গেল বেশ কিছুক্ষণ। কতক্ষণ জানল না ওরা।

টেকন জানে,আর কোনদিন তার দেখা হবে না ক্যাথির সঙ্গে। সে-ই দেখা করবে না। বিদায় মুহূর্তে ক্যাথি বলে দিল তার শহরের নাম, ঠিকানা। শুনল টেকন মনোযোগ দিয়ে।

আসবে তো? ক্যাথির কণ্ঠে ব্যাকুলতা।

দীর্ঘশ্বাস ফেলল টেকন। মিথ্যে বলতে ইচ্ছে করল না তার। শুধু বলল, জানি না।

তখনও ভালমত ফোটেনি ভোরের আলো। তবে কেটে আসছে আঁধার। বার্নের দিকে হাঁটল টেকন। একাই। তাগড়া দেখে বেছে নিল একটা ঘোড়া। হিগিন্সের লোকেরা সবগুলো নিয়ে যেতে পারেনি। স্যাডল চাপাল। বেরিয়ে এল বাইরে। বারান্দায় এখনও দাঁড়িয়ে ক্যাথি। ওর দিকে চেয়ে হাত নাড়ল টেকন। ক্যাথিও নাড়ল। তবে দেখতে পেল না সে। কারণ তার ঘোড়া তখন ছুটে চলেছে আধো অন্ধকারের বুক চিরে। অন্য কোথাও। অন্য কোনখানে।

<

Super User