কারও হাতের স্পর্শ!
মুহূর্তে সম্পূর্ণ জেগে উঠল ইয়াসীন।
‘সার্জেন্ট! আমি কিড। টহলে বেরোচ্ছে লেফটেন্যান্ট সাইমন। তোমাকে সাথে যেতে বলেছে।’
বিছানা ছেড়ে দ্রুত ড্রেস পরল ইয়াসীন। অন্ধকার হাতড়ে গুছিয়ে নিল কিছু। খোঁয়াড়ে আগেই রেডি করা হয়েছে কালো ঘোড়াটা। অন্যদের সাথে নীরবে ঘোড়ায় চড়ল সে। মোরগ বোলের মত লাল হয়ে উঠছে পুব আকাশ।
পাশে এগিয়ে এল কেউ। মোকাটো! সে-ও আছে তা হলে দলে।
‘শুভযাত্রা,’ ইয়াসীনের উদ্দেশে বলল মোকাটো। ‘ওদের পথ চিনিয়ে দিতে হবে। তোমাকে আর আমাকে।’
বারোজন সিপাহী আছে টহলদলে। আর রয়েছে লেফটেন্যান্ট সাইমন, কর্পোরাল উইলিয়াম, মোকাটো আর সে নিজে। ‘ভেগাস স্প্রিং-এর রুট ধরে মাইল দশেক এগোব, আমরা।’ তাকে লক্ষ করে বলল লেফটেন্যান্ট। তারপর পুবে মোড় নিয়ে সোজা গিয়ে উঠব ফোর্ট মোযেভে যাবার পথে।
সকালটা উত্তপ্ত হতে সময় নিল না। পাহাড়ের শীতল ছায়া ছোট হতে লাগল ক্রমশ। কোনও ট্রাকের চিহ্ন নেই। নেই ইন্ডিয়ানদের চলাফেরার অন্য কোনও চিহ্ন। নির্দিষ্ট ট্রেইল ধরে চলে না মোযেভরা।
চারদিক সতর্কতার সাথে পর্যবেক্ষণ করছে, টহলদলটি। ‘শত্রুর সন্ধানে বেরোইনি আমরা,’ বলল লেফটেন্যান্ট। টহলের মূল উদ্দেশ্য ইন্ডিয়ানদেরকে একটু পেশী প্রদর্শন করা।
একজাগায় দেখা গেল পুড়ে যাওয়া কতগুলো ওয়াগনের কঙ্কাল। ইন্ডিয়ান আক্রমণের পরিণতি। জানাল ইয়াসীন। বছর কয়েক আগে ওয়াগনের একটা কাফেলা যাচ্ছিল এপথে। পাহাড়ের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে আক্রমণ করে ওরা।
‘ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ?’ জানতে চাইল সাইমন।
‘একজন যাত্রী নিহত আর তিনজন আহত হয়। ছয়টা মাল বোঝাই ওয়াগন পুড়ে যায় আগুনে। লুট হয় বাকিগুলো। ঘোড়াগুলো ছিনিয়ে নেয় ইন্ডিয়ানরা’।
‘বিনিময়ে?’
ইন্ডিয়ানরা বিনিময়ে বিশ্বাসী নয়, সার। ক্ষতি স্বীকার করতে মোটেই রাজি নয় ওরা। কারণ লোকবল সীমিত ওদের। এদিকে পঙ্গপালের মত ঝাঁকে ঝাঁকে আসছে লোভী সাদা চামড়ার দল।
‘আমরা কি আক্রান্ত হতে পারি?’
‘সে সম্ভাবনা খুব কম। এরকম একটা সশস্ত্র বাহিনীকে ঘায়েল করতে হলে প্রচুর লোকবল প্রয়োজন। অত লোক একসাথে করা সহজে সম্ভব নয়। তবে আমাদের বিশ্রামের সময় ঘোড়াগুলো ভাগিয়ে নেবার মতলব আঁটতে পারে ওরা’।
বিশ্রামের সময় মোকাটো এসে বসল পাশে। ‘আমার মনে হয় আশেপাশেই আছে ইন্ডিয়ানরা সকালে যে স্টেজকোচটা ক্যাম্প থেকে রওনা দেবে সেটা আক্রমণ করতে পারে ওরা’।
‘কথাগুলো লেফটেন্যান্টকে জানানো উচিত।’ মন্তব্য করল ইয়াসীন।
পুবে মোড় নিয়ে কিছুদূর যাবার পর দেখা গেল প্রথম ইন্ডিয়ান ট্রেইল। চারজন ইন্ডিয়ান মধ্যম গতিতে হেঁটে গিয়েছে উত্তর-পশ্চিম দিকে। দ্বিতীয় ইন্ডিয়ান ট্রেইলটা দেখা গেল আরও ছয় মাইল এগিয়ে। এবারে ছয়জনের পায়ের ছাপ। সবাই প্রায় দৌড়ে যাচ্ছে উত্তর-পশ্চিম দিকে।
ঘোড়া থেকে নেমে পায়ের ছাপগুলো ভালভাবে পরীক্ষা করে দেখল লেফটেন্যান্ট সাইমন। ‘কতক্ষণ আগে গেছে ওরা’ মোকাটোকে জিজ্ঞাসা করল সে।
ঘণ্টা দুয়েক। এতক্ষণে স্টেজকোচের রাস্তাটার উপরে পৌঁছে যাবার কথা।
ম্যাপটা বের করল সাইমন। স্টেজের সাথে পাহারাদার থাকবে নিশ্চয়ই, আনমনে বলল সে।
নিবিষ্টচিত্ত সাইমনকে দেখছে ইয়াসীন। আত্মবিশ্বাসে কমতি নেই লেফটেন্যান্টের। সহজে সিদ্ধান্ত পাল্টাবে না সে। তবে যদি প্রয়োজন বোধ করে, নতুন সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধান্বিত হবে না একটুও।
মনে মনে পানির বোতলটা মাপল ইয়াসীন। মরুভূমিতে ওটাই আসলে সব সিদ্ধান্তের চাবিকাঠি। এবং ইন্ডিয়ানরা ভালভাবে জানে কথাটা।
অস্ত্রশস্ত্রে কমতি নেই টহলদলের। প্রত্যেক সৈনিকের সাথে রয়েছে সাত গুলির পয়েন্ট ফাইভ সিক্স, পয়েন্ট ফাইভ জিরো কারবাইন। একটা কার্লিজ কেসে পোরা আছে দশটিউব করে বাড়তি কার্ট্রিজ। এ ছাড়া প্রত্যেকের কোমরে ঝুলছে পয়েন্ট ফোর ফাইভ ক্যালিবারের ভয়ালদর্শন কোল্ট রিভলভার। বাটটা সামান্য বেরিয়ে আছে খাপ হতে। যাতে প্রয়োজনের মুহূর্তে টেনে আনা যায় দ্রুত।
অপ্রয়োজনীয় বোঝা কমাবার জন্য তরবারিগুলো খুলে রাখা হয়েছে ক্যাম্পে। ইন্ডিয়ানদের বর্শার মোকাবিলায় খুব কাজে আসে না ওগুলো।
ক্যাম্পকেডিতে বেশ আগে এসেছে ইয়াসীন। পশ্চিমের ভিন্ন একটা ইনফ্যানট্রি ইউনিট থেকে পাঠানো হয়েছিল তাকে। তাই তার অস্ত্রগুলো একটু ভিন্ন। কোমরে তারও আছে কোল্ট তবে সাত গুলির কারবাইনের পরিবর্তে রয়েছে যোলো গুলির পয়েন্ট ফোর ফোর হেনরী রাইফেল। বুলেটগুলো দুশো ষোলো গ্রেইনের। পিছনে পঁচিশ গ্রেইনের পাউডার চার্জ। এ ছাড়া নিয়ম বহির্ভূত আরও একটা অস্ত্র আছে ইয়াসীনের কাছে। জামার ভিতরে কোমরে লুকানো একটা পিস্তল। শেষ মুহূর্তে ব্যবহৃত হবার অপেক্ষায়। আজ হয়তো সব কিছুই কাজে লাগাতে হবে-মনে হলো তার।
উত্তপ্ত বালিতে কেঁপে কেঁপে যায় বাতাস। কেঁপে যাচ্ছে আদিগন্ত দৃশ্যমান সবকিছু। প্রাণহীন প্রান্তরের একমাত্র ব্যতিক্রম একটা শকুন। আকাশের অনন্ত নীলে অলস চক্রে বিলি কাটছে সেটা।
দুপুরের পরে একটা গিরিখাতের কাছে পৌঁছা’ল ওরা। পশ্চিমে এগুলোকে বলে ক্যানিয়ন। থামতে আদেশ দিল লেফটেন্যান্ট। ছায়ায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিশ্রাম নিতে বসল সবাই।
‘সবকিছু কেমন কাঁপা কাঁপা, অস্পষ্ট। তোমার অভিজ্ঞ চোখেও কি এরকম দেখা যায়, ইয়াসীন?’ লেফটেন্যান্টের কণ্ঠে কৌতূহল।
‘ইয়েস, সার’।
এবং সব জায়গায় একই দৃশ্য?
সামনে কিছু বালিয়াড়ি আছে। আর কয়েকটা মৃত আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ।
শুনলাম, চকিত দৃষ্টি লেফটেন্যান্টের, অফিসার ছিলে তুমি।
অন্য আর্মিতে, সার।
এর আগের সেনানিবাসে আমার ফার্স্ট সার্জেন্ট ছিল তোমার মত। অন্য এক আর্মিতে কর্নেল ছিল সে।
‘ওরকম হয় অনেক সময়।’
মরুযুদ্ধে কতদিনের অভিজ্ঞতা তোমার?
তা-হবে একযুগ। সত্যটা উপলব্ধি করে নিজেই বিস্মিত হলো ইয়াসীন। তবে এবারে সময় শেষ আমার। ছাড়পত্র এলেই বিদায় নেব।
আবার নতুন ভাবে ফিরে আসার জন্য?
না, অফিসার। আর ফিরব না। অন্যের জন্য অনেক লড়েছি। এবারে নিজস্ব যুদ্ধটা শুরু করতে হবে।
না ফিরলে ভালই করবে, সার্জেন্ট। মরুভূমিতে মানুষের কোন স্বপ্নটা সার্থক হয় বলো?
‘এখান থেকে দূর দক্ষিণে।’ অস্পষ্ট সপ্নীল কণ্ঠে বলতে লাগল ইয়াসীন। ‘কলোরাডো মরুভূমি সম্পর্কে একটা গল্প আছে। মুক্তা বোঝাই একটা জাহাজ হারিয়ে যাবার গল্প। মরুভূমি ওখানে সী লেভেল এর নীচে। বন্যার সময় পথ ভুল করে মরুভূমিতে ঢুকে পড়ে জাহাজটা। পানি দ্রুত সরে যাওয়াতে বেরোতে পারেনি আর’।
আরও জানা যায়, অ্যাজটেকদের আদি বাসস্থান ছিল ওটা। পরে ওজায়গা ছেড়ে মেক্সিকোতে চলে যায় তারা।
ঐতিহাসিক কোনও প্রমাণ আছে এসবের?
নির্দিষ্ট কিছু নেই তবে প্রাচীন কয়েকটা স্প্যানিশ দলিলপত্রে কিছু কিছু ঘটনার উল্লেখ আছে। ওরাই প্রথম এসেছিল এ অঞ্চলে।
ফাদার গ্যারেটের লেখা বিলাসিওনে আছে একদল স্প্যানিশ নাবিকের কথা। পথ ভুলে তারা চলে এসেছিল গালফ অভ ক্যালিফোর্নিয়াতে। সেখানে কিছু এশিয়ানের সাথে সাক্ষাৎ হয় তাদের। সেখানকার ইন্ডিয়ানদের সাথেও তাদের সাক্ষাৎ এবং পণ্যের বিনিময় ঘটে। পরে প্রায় পনেরোশো আটত্রিশ সাল পর্যন্ত ওই বাণিজ্য সম্পর্ক অটুট ছিল বলে ধারণা করা হয়।
উঠে দাঁড়াল লেফটেন্যান্ট। ইয়াসীনও উঠল। মরুভূমি অবশ্য যত আজগুবী ঘটনার ডিম পাড়ে। বলল ও। বিশেষ করে এধরনের অল্পবয়স্ক মরু।
অল্পবয়স্ক, তুমি কীভাবে জানো, সার্জেন্ট?
খুঁড়ে দেখুন অফিসার। অল্প কিছুটা খুঁড়লেই উঠে আসবে কালো মাটির স্তর। ইতিহাসের কথা বলবে তা। জীবনের কোলাহল সমৃদ্ধ বনস্থলীর ইতিহাস। মানুষের জ্ঞান তো এক খণ্ড হিমশৈলের মত। আট ভাগের সাতভাগই যার অদৃশ্য!
ও কে, সার্জেন্ট। ঘোড়ায় উঠতে বলো সবাইকে। আমরা আবার শুরু করব।
পথে কোনও ইন্ডিয়ানকে দেখা গেল না। কেবলমাত্র কম্পমান হিটওয়েভ ছাড়া সবকিছুই নিথর। ভেগাস স্প্রিং–এর সাথে দূরত্ব ক্রমশ বাড়ছে।
আবারও দেখা গেল ট্র্যাক। চারজন ইন্ডিয়ান…উত্তর পশ্চিমে যাচ্ছে।
কী ব্যাপার? মোকাটোকে জিজ্ঞাসা করল লেফটেন্যান্ট সাইমন।
ওরা জেনে গেছে, স্টেজটা আসার খবর। খুব সম্ভব হামলা চালাবে ওটার উপর।
হাত উঁচিয়ে দলটাকে দাঁড় করাল লেফটেন্যান্ট। তাই মনে হচ্ছে, মোকাটো?
বেশ কিছু ইন্ডিয়ান যাচেছ ওদিকে। এ পর্যন্ত প্রায় পনেরো জনের কথা জেনেছি আমরা। হয়তো অন্যান্য জায়গা থেকে আরও ইন্ডিয়ান চলেছে ওদিকে। অকারণে নিশ্চয়ই ওদিকে যাচ্ছে না ওরা।
ইয়াসীন, তোমার মতামত?
মোকাটোর সাথে একমত আমি। অকারণে কিছুই করে না ইন্ডিয়ানরা। এ পর্যন্ত তিনটে দলের পায়ের ছাপ পেয়েছি আমরা। সবাই উত্তর পশ্চিমে চলেছে। আর একটাই গন্তব্য আছে ওদিকে। ভেগাস স্প্রিং, অর্থাৎ লাসভেগাসে যাবার রাস্তা।
করণীয় সম্পকে ভাবছে সাইমন। তার এই টহলের উদ্দেশ্য যুদ্ধ নয়। মোযেভদের একটু ভয় দেখানো মাত্র যাতে সরকারী রুটে চলাচলরত স্টেজগুলোর উপরে হামলা করতে সাহস না পায়। তবে টহলের সময়ও যদি ইন্ডিয়ানরা কাফেলা চলাচলের সরকারী রুটগুলোতে বিপত্তি সৃষ্টি করে, তবে তা প্রতিহত করার নির্দেশ রয়েছে।
ভোগাস স্প্রিং-এর রুট ধরে এগিয়েছিল সাইমন। পরে পুবে মোড় নিয়ে লেছে ফোর্টমোযেভের রুটের দিকে। অথচ ইন্ডিয়ানদের কয়েকটা দল যাচ্ছে ভেগাস স্প্রিং রুটের দিকে। এবং মোকাটো ও সার্জেন্টের মতে বিপত্তি সৃষ্টি করতে।
নির্দেশ অনুযায়ী প্রতিহত করতে হবে ওদের। তার জন্যে প্রয়োজন হলে ফিরে যেতে হবে ভেগাস প্রিং রুটে। প্রয়োজন হলে যুদ্ধ করতে হবে মোযেভদের সাথে। যদিও টহলের উদ্দেশ্য যুদ্ধ নয়।
ঠিক কোথায় হামলাটা চালাতে পারে ওরা? জিজ্ঞাসা করল লেফটেন্যান্ট। মোকাটোর দিকে তাকাল ইয়াসীন। বিটার স্প্রিং?
বিটার স্প্রিং। জানাল মোকাটো। ঘোড়াগুলোকে পানি খাওয়াতে সেখানে থামবে স্টেজ।
বিটার স্প্রিং। আদেশ দিল লেফটেন্যান্ট সাইমন। ঘুরে উত্তর পশ্চিমে রওনা হলো টহল দল।
সমুদ্র সমতলের তুলনায় বেশ উঁচু মোযেভ মরুভূমি। গড় উচ্চতা দুই হতে পাঁচ হাজার ফুট। ব্যতিক্রম কেবল ডেথ ভ্যালি। সাড়ে পাঁচশো বর্গমাইলের এই বিশেষ জায়গাটা সীলেভেলের চেয়ে গড়ে প্রায় দুইশো ফুট নিচু।
গ্রীষ্মের গড় তাপমাত্রা একশো চৌত্রিশ ডিগ্রী। কোনও ঢাল বা ক্যানিয়নের কাছে তা আরও পঞ্চাশ ডিগ্রী বেশি হতে পারে। শীতকালে ব্যাপারটা অবশ্য অন্যরকম। সারাদিন হাড়কাঁপানো, হাওয়া বয়। রাতে তাপমাত্রা হিমাঙ্কের কাছে নেমে যায়! কখনও বা হালকা ভাবে পড়ে তুষার। দীর্ঘস্থায়ী হয় না তুষারপাত। তবে মোযেভ মরুভূতিতে শীতকালের মত নির্মম শাস্তি আর কিছু নেই।
উদ্ভিদ একেবারে অনুপস্থিত নয় এ মরুতে। তবে উদ্বাস্তুর মৃত ছড়িয়ে ছিটিয়ে তাদের অবস্থান। তাও কয়েক ধরনের ক্যাকটাস, যোশুয়ার ঝাড় ও গ্রীজউডে সীমাবদ্ধ। প্রত্যেকেই নিজস্ব নিয়মে শিকড় ও শাখা বিস্তার করেছে। মরুভূমিতে টিকে থাকতে হলে প্রত্যেকেরই উদ্ভাবিত পদ্ধতির প্রয়োজন হয়।
গ্রীজউডের ঝোঁপগুলো একটা নির্দিষ্ট এলাকা জুড়ে একটানা জন্মায়। অন্য বৃক্ষের সহঅবস্থান সেখানে বিরল। ওঁধরনের একটা এলাকা উঁচু থেকে চমৎকার দেখায়। ধু-ধু বালির মধ্যে সুদৃশ্য একটা আঙ্গুর বাগানের মত।
বিগত বরফযুগে কিন্তু মোযেভ মরুভূমির রূপ ছিল অন্যরকম। আকাশে তখন চরে বেড়াত জলবতী মেঘ। ভূমিতে বিচরণ করত নানা জাতের প্রাগৈতিহাসিক প্রাণী। ম্যামথ, তিনক্ষুরো ঘোড়া, উট এবং আরও অনেক কিছু।
তখনও ছিল মানুষ। তবে অস্ত্রে বস্ত্রে সুরক্ষিত নয়। শীত মানাত তারা কোনও জন্তুর চামড়ায়, শিকার করত পাথরের হাতিয়ার দিয়ে।
ভূমি বরাবরই প্রায় সমতল। মাঝে মাঝে তার অখণ্ডতা বিঘ্নিত হয়েছে পাহাড়ের সারি, পাথুরে আল কিংবা কোনও ঢালের কারণে।
অধিকাংশ পাহাড় আগ্নেয়শিলায় গড়া। অতীত অগ্ন্যুৎপাতের সাক্ষী হয়ে আছে এখানে ওখানে মৃত আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ। ক্ষতবিক্ষত বাঁধের আকারে বহুদূর চলে গেছে জমাটবাধা লাভা স্রোত। ওগুলো অতিক্রম করা দুরূহ ব্যাপার। তবে মোযেভরা পারে, কারণ খাজ কাটা জায়গাগুলোর খবর জানা আছে তাদের।
হ্রদগুলো অনেক আগে থেকে শুকনো। তার তলায় শূলের মত উঁচু হয়ে আছে। সারি সারি তীক্ষ্ণ সাদা ফলা। পানি শুকিয়ে গেলে লবণ ও ক্ষার জমে ওরকম আকৃতি নিয়েছে। প্লায়া বলা হয় শুকনো হ্রদগুলোকে। অবিরাম মরীচিকা দেখা যায় ওগুলোতে।
বাতাসের ঘনত্বে ভিন্নতার কারণে মরীচিৎকার সৃষ্টি হয়। বাতাসের ঘনত্ব অনুযায়ী বেঁকে যায় সূর্যরশ্মি। ফলে পাহাড়গুলো অনেক কাছে মনে হয়, আর প্লায়াগুলোকে মনে হয় টলটলে জল পরিপূর্ণ হ্রদ।
ছোটবড় ঘূর্ণি তৈরি হয় উষ্ণতার তারতম্যের ফলে। তপ্তবালির সংস্পর্শে হালকা হয়ে যায় নীচের উষ্ণ বাতাস। উঠে যায় উপরে। এবং ওঠার সময় শুষে নেয় আলগা বালি। সাধারণত ছোট হয় ঘূর্ণিবায়ুগুলো। তবে বড়ও আছে। কোনও প্রখর মধ্যাহ্নে মরুভূমিতে দেখা যায় এধরনের একাধিক ঘূর্ণি। নিঃশব্দে প্রেত নৃত্যে মত্ত।
দূরে একটা বিশাল ঘূর্ণি। অশুভ নৃত্যভঙ্গিমায় ক্রমেই নিকটবর্তী হচ্ছে। ওটার দিকে আবারও তাকাল ইয়াসীন। চোখ জ্বালা করছে তার। কপাল বেয়ে ঘাম নামছে চোখের কোণে। কিন্তু চিবুকে পৌঁছা’নোর আগেই পরিণত হচ্ছে, লবণে। রাগী সূর্যটাকে সম্মান জানানোর ভঙ্গিতে সামনের দিকে হেঁট হয়ে আছে তার মাথা। রোদ এড়ানোর বিফল প্রচেষ্টা।
ঘূর্ণিবায়ুটা অস্বস্তিতে ভোগাচ্ছে তাকে। যথেষ্ট বালি পাক খাচ্ছে ওটায়। ফলে ওপাশের সবকিছু অস্পষ্ট। ওর আড়ালে যদি কাছে এগিয়ে আসে ইন্ডিয়ানরা, বোঝা যাবে না সহজে।
মগজ থেকে মরুভূমির অবসাদ জোর করে তাড়াল ইয়াসীন। উত্তাপ আর তৃষ্ণায় কমবেশি দিশেহারা হয়ে পড়েছে দলের সবাই। মন্থর ঘোড়ার পিঠে নুয়ে আছে পরাজিতের মত। এ মুহূর্তে সতর্ক থাকা প্রয়োজন।
কারণ সামনেই কোথাও আছে ইন্ডিয়ানরা। কতজন বলা মুশকিল। বিশ, পঞ্চাশ, ষাট-যে কোনও সংখ্যায় থাকতে পারে। স্টেজটা আক্রমণ করতে যাচ্ছে তারা। আর ইয়াসীনরা চলেছে তাদের বাধা দিতে।
অর্থাৎ আরও একটা মরুযুদ্ধ। কত যুদ্ধ যে করল সে মরুভূমিতে! পাঞ্জাবে লড়েছে বৃটিশদের পক্ষে, আফগানিস্তানে দোস্ত মোহম্মদের পক্ষে-আবার সাহারায় লড়েছে তুরেগদের বিপক্ষে। প্রতিটা যুদ্ধই ছিল রক্ত আর রৌদ্রের প্রখর নির্মমতা। ৩টা যুদ্ধই তীক্ষ্ণধার তরবারির মত শাণিত করেছে তাকে। যুদ্ধ মানুষকে ক্রমাগত শাণিয়ে দেয়!
যুদ্ধে যুদ্ধে গড়ে ওঠে মোযেভ ইন্ডিয়ান সৈনিক। অতীতে যুদ্ধ ছিল সমগোত্রীয় ইন্ডিয়ানদের মধ্যে সীমাবদ্ধ। বর্তমানে যুদ্ধ করতে হয় সাদাচামড়াদের সাথে। আজব ওই সাদাচামড়ার মানুষগুলো। দলে দলে আসে তারা। একটাকে মারলে পরিবর্তে দশটা এসে হাজির হয়। বীরত্ব প্রদর্শনের উদ্দেশে নয়। বেহিসেবী লাভের রণোন্মত্ত আগ্রাসন প্রতিষ্ঠা করতে।
খুব হীন আর স্বার্থপর হয় সভ্য মানুষ। প্রকৃতিদত্ত প্রতিটি জিনিসেই সবার সমান অধিকার, এই ইন্ডিয়ান নীতি মানে না তারা। ওয়াটার হোলগুলোর চারপাশে বেড়া তুলে তার ব্যক্তি মালিকানা দাবি করে। অবাধে চরে বেড়ানো ঘোড়া আর গরুগুলো ধরে নিয়ে বিক্রি করে দেয়। ভাল কোনও জমি দেখলে সেখানে গড়ে তোলে নিজস্ব খামার।
এই জীবনযাত্রা পছন্দ নয় ইন্ডিয়ানদের। সমষ্টিকে বঞ্চিত করে ব্যক্তির সমৃদ্ধি ঘৃণা করে ওরা। ঘৃণা করে সভ্যতার স্বার্থান্বেষী নিয়ম। তাই সুযোগ পেলে সাদা মানুষ মেরে ফেলে ওরা। তবু আসে সাদারা। প্রকৃতির অগাধ ঐশ্বর্য হতে ক্রমাগত বঞ্চিত করে ওদের। গড়ে তোলে অবাক সভ্যতা।
সামনে একটা জমাট লাভার প্রাকৃতিক দেয়াল। সরু ছায়া পড়েছে তার কালে। বিশ্রামের জন্যে দলটাকে থামাল সাইমন। ছায়ার আশ্রয়ে কোনও মতে মাথা গুজল সবাই। মোকাটো উঠে গেল উঁচু দেয়ালটার উপর। চারদিক ভাল করে দেখে নিতে চায়।
কোনওদিকে মানুষের চিহ্ন নেই। তবু সন্দেহ দূর হলো না মোকাটোর। ভূমির কোনও দৃশ্যই সম্পূর্ণ সন্দেহমুক্ত হতে পারে না সে। এবং সেজন্যেই বেচে আছে এতদিন!
ছোট্ট একখণ্ড লাভার উপরে বসে আছে সাইমন। এই প্রবল রোদেও জমাটবাঁধা লাভার খণ্ডটা শীতল রয়েছে, দেখে বিস্মিত হলো সে। পিপাসা বেড়ে গেল তার। পানির বোতলটা কোমর থেকে খুলে হাতে নিল।
কোথাও কাউকে দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু আমার বিশ্বাস কাছেই আছে ওরা। আমাদের আরও সাবধান হওয়া উচিত। দেয়ালের উপর থেকে বলল মোকাটো।
কতদূর এসেছি আমরা? মরুভূমিতে পথ চলার হিসাব গুলিয়ে ফেলেছে অনভ্যস্ত সাইমন। ইয়াসীনকে প্রশ্ন করল সে।
অনেকটা এগিয়েছি। জানাল ইয়াসীন। খুব বেশি হলে আর পাঁচছয় মাইল বাকি।
আরও কিছুক্ষণ বিশ্রামের সিদ্ধান্ত নিল সাইমন। তবে অসতর্ক হওয়া চলবে না, তাই চারজন সৈন্যকে পাহারায় দাঁড় করিয়ে রাখল সে। পালাক্রমে পনেরো মিনিট অন্তর পাহারা পাল্টানোর নির্দেশ দিল। বিশ্রামের পূর্ণ সুযোগ নিয়ে অন্যরা ততক্ষণে শুয়ে পড়েছে বালিতে।
গরমে চোখ জ্বলছে সাইমনের। বন্ধ করলেই চোখের পাতা পুড়ে উঠছে ঘঁাৎ করে। দূরে তাকানো দুষ্কর। তবু দূরে তাকিয়ে থাকতে হবে। সতর্কতার সাথে লক্ষ রাখতে হবে চারদিকে।
এই প্রবল উত্তাপে কী করে ইন্ডিয়ানদের যুদ্ধের নেশা অটুট থাকে ভেবে পেল সাইমন। স্বেচ্ছায় মরুভূমিতে পোস্টিং নিয়ে আসাটাও মনে হলো বিকট বোকামি। আসলে সে চেয়েছিল অ্যাকশন। চেয়েছিল-ক্রোধ, ঘৃণা, হত্যা ও রক্তে জীবনের একটা ভীষণ ওলটপালট! অবশেষে অখণ্ড স্থিতি।
অথচ আশা পূরণ হয়নি তার। কীসে যে জীবনের স্থিতি!
একবার একটা মেয়েকে ঘিরে স্থির হবার কথা ভেবেছিল সাইমন। ভাবতে ভাবতে অন্যের ঘরে চলে গেল মেয়েটা। দীর্ঘকাল তার জন্যে অনুতপ্ত হতে হতে এখন মনে হয় ভালই হয়েছিল! ওভাবে স্থির হতে পারে না কোনও জন্ম যোদ্ধা।
উঠে দাঁড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙল লেফটেন্যান্ট। টুপি খুলে ধুলো ঝাড়ল। কয়েকবার চোখ পিটপিট করে তাকাল দূরে। দিগন্তে একাকার হয়ে আছে মোযেভের বাতাস, রৌদ্র, বালি, আর বৈরী মানুষ!
ওঠো সবাই, নির্দেশ দিল সে। আপাতত পায়ে হেঁটে এগোব আমরা। ভবিষ্যতের জন্য জমা থাকুক ঘোড়াগুলোর শক্তি।
সবার আগে ইয়াসীন। হাঁটতে হাঁটতে পিছনের সৈন্যদের কথা ভাবছে সে দলের বারোজন সৈন্যের মধ্যে চারজন যথার্থ যোদ্ধা। বড় যুদ্ধে অংশ গ্রহণের অভিজ্ঞতা আছে তাদের। অন্য চারজন বেশ কিছুদিন যাবৎ আছে ইন্ডিয়ান ফাইটি আর্মিতে। কিন্তু বাকি চারজন সেনাবাহিনীতে নতুন। যুদ্ধ কিংব মরুভূমি-কোনওটাই আগে দেখেনি ওরা। যদি মরে না যায় তবে এখানে দীর্ঘস্থায়ী হবে না তাদের অবস্থান। শীঘই পালিয়ে ঘরে ফিরবে। মোযেভের যুদ্ধে আনাড়ীদের কোনও স্থান নেই!
একে একে হয়তো সবাই ফিরে যাবে। শুধু মোকাটো ছাড়া। যুদ্ধে বিধ্বস্তু এবং বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে গোত্রের সবাই। ফেরার মত কোনও গন্তব্য নেই তার।
ইয়াসীন নিজে কী করবে বলা মুশকিল। জন্মভূমি বৃটিশের পদানত। ফেরা না ফেরার সীমান্তে দাঁড়িয়ে আছে সে। ফিরে গেলে যুদ্ধ করতে হবে তাকে। না ফিরলেও!
ঘণ্টাখানেক হাঁটার পর থামার নির্দেশ দিল লেফটেন্যান্ট। আর কতদূর? ইয়াসীনকে জিজ্ঞাসা করল।
‘এখনও দূর আছে,’ বলল ইয়াসীন। তবে বিটার স্প্রিং যাবার সরকারী রাস্তাটা আশপাশ দিয়েই গেছে। স্টেজ সেই পথ ধরে যাবে।
অলরাইট, ইয়াসীন। রাস্তাটা খুঁজে দেখো তুমি, বলল অফিসার। তবে সতর্ক থেকো। আমরা কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতে চাই।
সাইমনের সতর্কবাণীটা শুধু ইয়াসীনের জন্যে নয়। তার নিজের নিরাপত্তার জন্যেও বলা। মোযেভ মরুভূমিতে যুদ্ধের অভিজ্ঞতা নেই তার। অথচ নেমে পড়তে হয়েছে ভয়ংকর খেলাতে। হাতে তুরুপের তাস মাত্র দুখানা। ইয়াসীন আর মোকাটো। জেতার জন্যে বড় দানে নামাতে হবে ওদের
ঘোড়ার রেকাবে উঠে দাঁড়াল ইয়াসীন। দূরের ওই পাহাড় পর্যন্ত দেখে আসতে পারি আমি। যাব, সার? অফিসারকে জিজ্ঞাসা করল।
ইয়েস।
জিনে নেমে বসল সে। মুখ নামিয়ে আনল কালো ঘোড়াটার কানের কাছে। ভয় নেই, সাগরেদ। ফিরে আসব আমরা, ফিসফিসিয়ে বলল। পেটের কাছে গোড়ালির চেনা সংকেতে চলতে শুরু করল ঘোড়াটা।
খোলা জায়গায় এমন একাকী এগিয়ে যাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ। সামনের ঢালে নেমে গেল ইয়াসীন। পিছনে আড়াল হয়ে গেছে টহল দল। হয়তো এমনি একটা ঢালে প্রবাহিত হত সেই সোনার নদী!
স্টেজ কোচ চলাচলের রাস্তাটা আছে সামনে কোথাও। আসন্ন বিপদ মাথায় নিয়ে ওই পথে চলবে আজকের স্টেজ। চলেছে তার স্বপ্নের মেয়ে বেলিন্দাকে নিয়ে। আজ যেন কোনও দুর্ঘটনা না ঘটে-প্রার্থনা করল ইয়াসীন।
আজকের প্রতি এই বিশেষ পক্ষপাতিত্ব কেন? নিজেকে শুধায় ইয়াসীন। বেলিন্দার জন্যে? বেলিন্দাকে সে কি ভালবাসে? উত্তরহীন এ এক জ্বালাময় জীবন জিজ্ঞাসা তার। জীবনে কোনও নারীর প্রেম সে পায়নি। পাবে কী করে! সেরকম সময়গুলো তো যুদ্ধে যুদ্ধেই কেটে গেল।
তবুও বুকের মধ্যে ভালবাসার সতেজ মরূদ্যান। কথাটা ভাবলেই কেবল একজনের কথা মনে আসে। আর কেউ নয়। শুধু বেলিন্দা ব্রাউন নামের একজন। জীবনে সত্যিকার ভালবাসার নারী বোধহয় চিরকাল একজনই থাকে!
সামনের পাহাড়টাকে হাতের বাঁয়ে রেখে এগোতেই ট্রেইলটা পাওয়া গেল। কিছুক্ষণের মধ্যে এ পথে আসবে স্টেজ কোচ।
এবং হঠাই বালির কবর খুঁড়ে বেরিয়ে এল ওরা। এক পলকে ছয়জনকে দেখল ইয়াসীন। বাদামী দেহগুলো মাখামাখি হয়ে আছে ধূসর, বালিতে। একটা তীর পিছলে গেল ঘোড়ার জিনে লেগে। অহেতুক বীরত্ব দেখানোর বোকামি না করে পড়িমরি ঘোড়া ছুটাল সে। হঠাৎ গতি বেড়ে যাওয়ায় চুল ছুঁয়ে বেরিয়ে গেল ছুঁড়ে মারা একখানা লম্বা ছোরা। এমন সময় এক তাগড়া ইন্ডিয়ান স্কুলে পড়ল তার পা ধরে। ফেলে দিতে চায় ঘোড়া থেকে। নির্দয়ের মত রাইফেলের কুঁদো চালাল ইয়াসীন। রক্তাক্ত হলো মাথাটা। পা থেকে পিছলে গেল ইন্ডিয়ানের হাত।
বাঁ দিকের পাহাড় বেশ কাছেই। দুরন্ত ক্ষুরে সেদিকে ছুটল তার ঘোড়া। তবু রক্ষে নেই। পথ আগলাতে-সামনে গজিয়ে উঠল আরও দুজন মোযেভ।
ছুটন্ত ঘোড়ার পিঠে বসে লক্ষ্যে অব্যর্থ হওয়া নৈপুণ্যের ব্যাপার। সবাই পারে, কিন্তু ইয়াসীন পারল।
ইন্ডিয়ানটার বুকে লাগল বুলেট। অপরজন দ্রুত কাছিয়ে আসায় গুলি করার সময় মিলল না। তাকে লক্ষ্য করে ঝাঁপ দিল ইন্ডিয়ানটা। কোমরের কাছে হেঁচকা টানে জিনচ্যুত হলো ইয়াসীন। বালিতে দুটো ডিগবাজি খেয়ে উঠে দাঁড়াল সে। হাতের রাইফেল ছিটকে বেরিয়ে গেছে।
খালি হাতে উঠে দাঁড়িয়েছে ইন্ডিয়ানটাও। প্রকাণ্ড পেশল শরীর তার। ইয়া-য়া…। বিকট চিৎকার করে ছুটে এল সে। ডাইনে ঝোঁক দিয়ে বাঁয়ে কাটল ইয়াসীন। দেহের সমস্ত শক্তি নিংড়ানো ঘুসিটা মারল পেটে। তাতে মোটেও কাবু হলো না ইন্ডিয়ানটা। আবার চিৎকার দিয়ে আক্রমণ করতেই তার চোয়ালের ডানে বাঁয়ে কয়েকটা জ্যাব এবং শক্ত একটা আপার কাট মারল ইয়াসীন।
বক্সিং-এর মারগুলো বুঝতে পারল না ইন্ডিয়ান। খালি হাতে লড়াইয়ে জাপটে ধরে ধস্তাধস্তি হবে ধারণা ছিল তার। আহত বিস্ময়ে মুহূর্তের জন্য থমকালো সে। তারপর লাফ দিল।
পিস্তলটা বের করতে ইয়াসীনের জন্য মুহূর্তটাই যথেষ্ট ছিল। পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জে ট্রিগার টিপল সে। হুড়মুড় করে বালিতে পড়ল ইন্ডিয়ানটাকে নিয়ে। আবারও গুলি করতে যাচ্ছিল। বাদামী দেহটা নড়ছে না দেখে ঢিল করল ট্রিগারের, আঙুল। মৃতদেহটা শরীরের উপর হতে সরিয়ে উঠে দাঁড়াল।
আশেপাশে আর কেউ নেই। শিস দিয়ে ঘোড়াটাকে ডেকে নিল ইয়াসীন। রাইফেল কুড়িয়ে নিল। উঠতে যাচ্ছিল ঘোড়ায়। গুলির শব্দে লাফিয়ে উঠল ঘোড়া। ওটার লাগাম ধরে দৌড় দিল ও পাহাড়ের কোলে বিক্ষিপ্ত বোল্ডারগুলোর দিকে।
দক্ষিণ দিকে গোলাগুলির আওয়াজ। সাইমনের দলও আক্রান্ত হয়েছে সম্ভবত।
দুটো বড় পাথরের চাইয়ের ফাঁকে ঘোড়াটাকে দাঁড় করাল ইয়াসীন। ওটার ঘাড়ের কাছে আঁচড় কেটে চেলে গেছে, বুলেটটা। মারাত্মক কিছু নয়।
চুপচাপ দাঁড়া এখানে। ঘোড়ার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল ও। জিনে ঝোলানো কান্ট্রিজ কেস থেকে বুলেট ভরল রাইফেলে।
শেল্টারটা চমৎকার। দুজন ইন্ডিয়ানের পায়ের ছাপ বালিতে। ওই দুজনই হয়তো এখানে পজিশন নিয়েছিল প্রথমে। এবং কাছাকাছি আরও কয়েকজন এখনও আছে।
এখানে কিছুটা বিপদমুক্ত সে। দুপাশে প্রকাণ্ড পাথরের চাই। মাথার উপরে কুঁড়েঘরের চালার মত কিছুটা নেমে এসেছে পাহাড়ের দেয়াল। অর্থাৎ পিছন বা পাশ থেকে আক্রমণের ভয় নেই।
সামনে খাঁ-খাঁ প্রান্তর। স্টেজ চলাচলের রাস্তাটা অনেকদূর পর্যন্ত দেখা যায় এখান থেকে। স্টেজের দেখা নেই।
অপেক্ষা করছে ইয়াসীন। আশেপাশে ওত পেতে আছে সশস্ত্র ইন্ডিয়ানরা। দুপুরের রোদে জ্বলে যাচ্ছে সব।
<