পরের দুটো হপ্তা আমার আর ইয়েলারের জন্যে বড়ই দুঃসময়। আমি শুয়ে থাকলাম ঘরের মধ্যে বিছানায়। ইয়েলার রইল ডগ রানে, গরুর চামড়ায়। দুজনেই ভুগতে লাগলাম। জখমের যন্ত্রণায় গোঙানো ছাড়া আর কিছুই করার সাধ্য নেই। মাঝে মাঝে এতটাই ব্যথা বাড়ে, কি ঘটছে খেয়াল রাখতে পারি না। চিৎকার আর গোঙানি কানে আসে। সেগুলো শুধুই আমার, না ইয়েলারেরও, বুঝতে পারি না। এমন ফোলা ফুলেছে পা-টা মনে হচ্ছে ফেটে যাবে। জ্বরে গা পুড়ে যেতে চায়। উত্তাপ কমানোর জন্যে ঝর্না থেকে গিয়ে ঠাণ্ডা পানি এনে আমার গায়ে ঢালতে হয় আম্মাকে।

পানি ঢালা ছাড়াও আরও অনেক কিছু করতে হয় তাকে। প্রিকলি-পারের মূল তুলে এনে ছেঁচে ভর্তা করে মলম বানিয়ে আমার জখমে লাগায়।

বাড়ির কাছেই অনেক প্রিকলি-পার জন্মে আছে। কিন্তু অনেক বড় আর শক্ত হয়ে গেছে ওগুলো। মূলের গুণও নষ্ট হয়ে গেছে অনেকখানি। ছোট গাছ দরকার। ওপরের অংশটা তত বড় হবে না, কিন্তু মূল হবে অনেক বড় আর মোটা, অনেকটা মিষ্টি আলুর মত। সেগুলো বাড়ির কাছে নেই। আনার জন্যে অনেক দূরে যেতে হয় আমাকে, একেবারে সল্ট লিকের কাছে।

আমাকে দেখলেই হয় না, ইয়েলারের চিকিৎসাও তাকেই করতে হয়। আমাকে যতখানি যত্ন আর দরদ নিয়ে সেবা করে, তাকেও ততটাই করে। রাতে অনেকবার করে উঠতে হয় আমাদের জখমে মলম লাগানো, পানি ঢেলে জ্বর কমানো আর খিদে পেলে খাওয়ানোর জন্যে। শুধু আমাদের সেবা করলেই তো চলে না, বাড়িতে আরও হাজারটা কাজ আছে। দুধ দোয়ানো, আরলিসের দেখাশোনা, কাপড় ধোয়া, কাঠ কাটা সব একহাতে করতে হয়।

তার ওপর বাড়তি ঝামেলা হয়েছে জাম্পার।

আবহাওয়ার ব্যাপারে যে ভবিষ্যদ্বাণী করে গিয়েছিল বাড সারসি সেই খারাপ সময়ও এসে হাজির হলো। সবুজ ঘাস শুকিয়ে গেল। ওগুলো আর খেতে ভাল লাগে না খচ্চরটার। শস্য খেতের বেড়া ডিঙিয়ে ঢুকে পড়ে ভেতরে।

এটা চলতে দেয়া যায় না। ওই শস্য খেয়ে শেষ করে ফেললে শীতকালে রুটির জন্যে, ময়দাই পাব না আমরা। কিছুতেই তাকে ঠেকাতে না পেরে ভয়ই পেয়ে গেল আম্মা। জাম্পারকে খেত থেকে বের করে ঘুরেও সারে না, আবার গিয়ে ঢোকে শয়তানটা।

অনেক ভেবে শেষে এক বুদ্ধি বের করল আম্মা। দড়ি দিয়ে সামনের ডান পায়ে ভারি একটা কাঠ বেঁধে দিল। বেশ খানিকটা লম্বা রাখল দড়িটা। যাতে করে খেতে অসুবিধে না হয় খচ্চরটার, কিন্তু পা তুলে লাফ দিয়ে বেড়া ডিঙিয়ে খেতে ঢুকতে না পারে।

তাতে আরেক ঝামেলা দেখা দিল। শস্য বাঁচল বটে, তবে কাজ আরও বেড়ে গেল আমার। যেখানে সেখানে দড়ি পেঁচিয়ে আটকে বসে থাকে জাম্পার। পাথরে, শেকড়ে, গাছের গোড়ায় আটকে যায়। গেলেই ভয়ে চেঁচানো শুরু করে। আম্মা গিয়ে যে তাকে ছুটাবে সেই সময়টাও দিতে চায় না। ক্রমেই বেড়ে যায় তার গলার জোর। মনে হয় পিটিয়ে তাকে মেরে ফেলা হচ্ছে। চেঁচাননা সইতে না পেরে দৌড়ে গিয়ে তাকে ছাড়ায় আম্মা, তবেই রক্ষা।

আসল কাজেরই অভাব নেই, এগুলো তো বাড়তি ঝামেলা। আরলিস অনেক ছোট, কোন সাহায্যই করতে পারে না। খেলার সঙ্গী না পেয়ে একলা হয়ে গেছে সে। ফলে আম্মা যেখানে যায়, সে-ও পিছে পিছে যায়। ছায়ার মত লেগে থাকে। জ্বালাতন করে। আম্মা তাকে সময় দিতে পারে না। বিরক্ত হয়ে চুপ করতে বললে আমাকে এসে জ্বালাতন শুরু করে। মিনিটও যায় না, এসে আমার হাত ধরে টানতে টানতে বলে, এত শুয়ে থাকিস কেন, ভাইয়া? ওঠ না, ওঠ। একলা একলা আমার যে একটুও ভাল্লাগে না। আমার সাথে খেলবি একটু, ওঠ।

আমাকে পাগলই করে দিত সে। বাঁচাল বাড সারসির নাতনি লিজবেথ। সঙ্গে করে নিয়ে এল একটা কুকুরছানা।

বাচ্চাটা যে আনা হয়েছে বুঝতেই পারিনি প্রথমে। লিজ এসেছে তা-ও টের পাইনি। বাড সারসির গলা শুনতে পেলাম। আম্মার সঙ্গে কথা বলছে। বিছানায় গড়িয়ে গিয়ে যে দরজা দিয়ে উঁকি দেব সেই অবস্থাও নেই আমার। বুড়োটা আসাতে বিরক্তিতে ছেয়ে গেল মন। অকাজের ধাড়ি! কাজ নেই কিছু নেই, এসেছে জ্বালাতে! বড় বড় কথা বলে পিত্তি জ্বালাবে। বলবে সল্ট লিকের মহিলা আর বাচ্চাদের দেখাশোনা করার জন্যে রয়ে গেছে সে। অথচ একটা কুটো রানোর জন্যেও আঙুল নাড়বে না। ভদ্রতার খাতিরেও বলবে না, ঠিক আছে, কাঠগুলো আমিই কেটে দিই। কিংবা খড়গুলো জড় করে আঁটি বাধি। ডগ রানে বসে বসে বকবক করবে, তামাক চিবাবে আর থুথু ছিটিয়ে নষ্ট করবে সমস্ত জায়গা। আশা করে বসে থাকবে অনেক সুখাদ্য রান্না করে খাওয়াবে তাকে আম্মা। দুপুরে তো খাবেই, রাতেও খাওয়ার জন্যে বসে থাকলে অবাক হওয়ার কিছু নেই, এতটাই নির্লজ্জ। আর আম্মার তো লজ্জা-শরম একটু বেশিই। কিছুতেই না বলতে পারবে না।

খানিক পর হালকা পায়ের শব্দ হলো। মুখ ঘুরিয়ে তাকালাম। দরজায় দাড়িয়ে আছে লিজ। দুই হাত পেছনে। বড় বড় চোখ মেলে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।

জিজ্ঞেস করল, খুব কষ্ট হচ্ছে?

হচ্ছে যে সে কথাটা স্বীকার করতে বাঁধল। হাজার হোক, পুরুষ মানুষ ভাবতে শুরু করেছি নিজেকে। বললাম, না।

খবরটা আগে পেলে আরও আগেই দেখতে আসতাম। একথার কি জবাব দেব ভেবে পেলাম না। চুপ করে রইলাম। তোমার জন্যে একটা জিনিস এনেছি। দেখলে চমকে যাবে।

রোগে কাহিল। এখন আমার চমকাতে ভাল লাগবে না। কিন্তু তার চোখের দিকে তাকিয়ে সত্যি কথাটা বলে তাকে আহত করতে পারলাম না। জিজ্ঞেস করলাম, কি?

মিস প্রিসির একটা বাচ্চা।

পেছন থেকে সামনে হাত নিয়ে এল লিজ। ডান হাতে ঝুলছে একটা কুকুরছানা, এক বছর বয়েসী অপোসামের সমান হয়ে গেছে। ময়লা সাদা রঙ। তার ওপর নীল ছোট ছোট দাগ। যেন গরুর পোকায় ছেয়ে আছে সারা গা। সুন্দর বলা যাবে না কোনমতেই। ঘাড়ের টিলা চামড়া ধরে ঝুলিয়ে রেখেছে তাকে লিজ। কিন্তু কোন অভিযোগ নেই বাচ্চাটার। চোখ বোজা। মনে হয় নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়েছে।

একটা ব্যাজারের গর্তে জন্ম হয়েছে ওর, লিজ বলল। সাতটা বাচ্চার মধ্যে সব চেয়ে ভালটা নিয়ে এসেছি তোমার জন্যে।

ওই বাচ্চা যদি সব চেয়ে ভালটা হয় তাহলে মা হিসেবে মিস প্রিসিকে বাহবা দেয়ার কিছুই নেই। তবে সেকথা না বলে বললাম, ভালই।

সত্যিই ভাল। দেখেছ কেমন করে ধরে রেখেছি, অথচ ইকটুও কাঁদে না। এত ভাল বাচ্চা আর দেখেছ?

ভাল কুকুর কি ভাবে বুঝতে হয় সেটার ব্যাপারে একেকজন একেক কথা বলে। কারও মতে ঘাড়ের চামড়া ধরে ঝুলিয়ে রাখলে যেটা চুপ করে থাকে সেটা ভাল। আব্বার মতে, দেখতে হবে মুখের ভেতরটা। মাড়ি কালো হলে সেটা ভাল হবেই। পোষার জন্যে সেটাকেই নেয়া উচিত। যেহেতু আব্বা বলে, আমারও সে রকমই বিশ্বাস।

কিন্তু মাড়ি কালো না লাল দেখার আগ্রহ আমার হলো না। সবুজ হলেও কিছু এসে যায় না। আমার এখন একমাত্র চিন্তা, কি করলে পায়ের যন্ত্রণা একটু কমবে। বললাম, নিয়ে যাও। আরলিস খুশি হবে।

বলেই বুঝলাম, ভুল কথা বলে ফেলেছি। লিজের চোখই বলে দিল সে আহত হয়েছে। অন্য কথা আশা করেছিল সে।

চুপচাপ তাকিয়ে রয়েছে আমার দিকে। পাথরের মূর্তি হয়ে গেছে যেন। তার সেই দৃষ্টি সইতে পারলাম না। চোখ সরিয়ে নিলাম। হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে আর একটাও কথা না বলে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। বাচ্চাটা দিয়ে দিল আরলিসকে।

ওর এই আচরণে রাগ হলো আমার। পচা একটা বাচ্চা নিয়ে এসে আর কি আশা করেছিল? কাহিল হয়ে বিছানায় পড়ে যন্ত্রণায় ককাচ্ছি আমি। দম নিতে গেলেও কষ্ট হয়। এই সময় কুকুরছানা দিয়ে কি করব?

তাছাড়া বড় একটা কুকুর আছে আমার। ওল্ড ইয়েলারের মত কুকুর। হোক না আহত, সেরে তো উঠছে। আম্মা বলেছে আমাকে। ভাল হলে ওকে নিয়ে আবার বনে যেতে পারব। শিকার করতে পারব। ওকেই আমার বেশি দরকার। ছানা দিয়ে আমি কি করব? ওটাকে আরলিসেরই বরং বেশি দরকার। খেলতে পারবে। আমাকে আর বিরক্ত করবে না। তাহলে ভূলটা বললাম কি? কেন এত রাগ?

শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগলাম, লিজবেথ কতটা বোকা। আবার তার আসার অপেক্ষায় রইলাম। এলে বুঝিয়ে বলব, আসলে কেন বাচ্চাটা আমার দরকার নেই। কিন্তু সেই সুযোগ আমাকে দিল না ও। বাইরে রইল। আরলিসের সঙ্গে খেলল। অবশেষে থুথু করে আরেকবার থুথু ছিটিয়ে যাওয়ার জন্যে উঠে পড়ল তার দাদা, শুনতে পেলাম। দরজার সামনে দিয়ে চলে যেতে দেখলাম তাকে আর আরলিসকে। যাওয়ার সময় আমার দিকে একবার তাকিয়েই ঝট করে আবার চোখ ফিরিয়ে নিল লিজ।

হঠাৎ করেই রাগটা চলে গেল আমার। বরং দুঃখ হতে লাগল লিজের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছি বলে। মনেপ্রাণে চাইছি, আরেকবার আসুক আমার কাছে। তাকে বুঝিয়ে বলব।

কিন্তু এল না।

শেষে ডেকেই আনব ঠিক করলাম। কিন্তু আমি মুখ খোলার আগেই তার নানা বলল, মিসেস কোটেল, বুঝতে পারছি সময় খুব খারাপ যাচ্ছে আপনার। তবে ভাববেন না। সবার দেখাশোনার ভার যখন আমার ওপর, ব্যবস্থা তো একটা করতেই হয়। লিজকে রেখে যাচ্ছি। কাজেকর্মে আপনাকে সাহায্য করবে।

অবাক কণ্ঠে আম্মা বলল, বলেন কি! না না, দরকার নেই! আমি একাই সামলাতে পারব। সাহায্য যে করতে চেয়েছেন এতেই খুশি। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।

কি যে বলেন আর না বলেন। এত ঝামেলা একা একজন মেয়েমানুষ করতে পারে? ও খুশি হয়েই আপনার কাজ করবে।

কিন্তু ও এখনও অনেক ছোট। একরাতও নিশ্চয় বাড়ি ছেড়ে থাকেনি।

থাকেনি বলে যে কখনোই থাকবে না তা তো নয়। থাকতে হবে। এখন থেকেই শুরু করুক। আরও একটা গুণ আছে তার। আমার স্বভাব পেয়েছে। অন্যের বিপদে হাত গুটিয়ে থাকতে পারে না। থাকুক ও। দেখবেন, কতটা ঝামেলা কমে গেছে আপনার।

নানা ভাবে মানা করল আম্মা, কিন্তু কানেই তুলল না বাড সারসি। তার এক কথা, লিজবেথ খুব কাজের মেয়ে, লক্ষ্মী মেয়ে, বাড়িঘরের কাজ জানে, অনেক সাহায্য করতে পারবে, ইত্যাদি ইত্যাদি।

লিজকে রেখে ঘোড়ায় চেপে চলে গেল বাড।

<

Super User