বিশাল বনের মধ্যে ঘুরে বেড়ায় শুয়োরের পাল। যতই চিহ্ন দিয়ে রাখো না কেন, কখন কোথায় ওগুলোকে খুঁজে পাওয়া যাবে বলা মুশকিল। তবে দল বেঁধে থাকে বলে বের করা হরিণের চেয়ে সহজ। কাজকে কঠিন ভেবে বসে থাকলে সেটা আর করা হবে না। তাই কষ্ট করেই খুঁজে বের করতে লাগলাম। চিহ্ন দিয়ে কাটা কানের টুকরোগুলো রেখে দিই। সেগুলো বাড়িতে এনে কাঠিতে গেঁথে রোদে শুকিয়ে রাখি গুণে দেখার সুবিধের জন্যে। ছেচল্লিশটা শুয়োরকে চিহ্ন দেয়ার পর আর কোন দল খুঁজে পেলাম না। আম্মা বলল, এ-বছর এই কয়টাই বেড়েছে। শুয়োর খোঁজা বাদ দিয়ে তখন আবার শস্য খেতের দিকে নজর দিলাম। কিন্তু একদিন বার্ড সারসি এসে জানাল, আমাদের একটা দলকে নাকি দেখে এসেছে ব্যাট কেভের ওদিকে।
জায়গাটা আমাদের বসতি থেকে অনেক দূরে। সল্ট ব্রাঞ্চের ওই ধারে কখনও যাইনি আমি। তবে জায়গাটার নাম শুনেছি আব্বার কাছে। সুতরাং পরদিন সকালে উঠেই ইয়েলারকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। খেতে কাজ করার চেয়ে শুয়োর খেদানো অনেক মজার। ভাগ্য ভাল হলে দলটাকে তো পাবই, হয়তো বাদুড়ের দলকেও গুহা থেকে বেরোতে দেখতে পারব। সন্ধ্যায় লক্ষ লক্ষ বাদড় গুহা থেকে বেরোয়, সেটা নাকি এক দেখার মত জিনিস।
সল্ট ব্রাঞ্চের এই ধারে গিয়েছি আমি। উঁচু একটা পাহাড় আছে। এক দিকের ঢাল ওপর থেকে খাড়া করে কাটা, দেয়ালের মত, ওটা বেয়ে ওঠার উপায় নেই। হাজার হাজার বাবুই পাখির বাসা আছে ওখানে। জায়গাটা আমার ভারি পছন্দ।
আরও একটা জায়গা আমার পছন্দ ওখানে। একটা গিরিখাত। অনেকটা ঘোড়ার খুরের আকৃতি। টলটলে পানির একটা পুকুর আছে। স্বচ্ছ সেই পানির দিকে ঝুঁকে ঢালের গায়ে দাড়িয়ে আছে অনেক বড় বড় গাছ। সেই সব গাছে শত শত বকের বাসা। কোনটা নীল, কোনটা সাদা। তবে গায়ের রঙ যা-ই হোক, দুই জাতেরই পাখার ডগা কালো। গাছের ডালগুলো পানির ওপরে অনেকখানি বেরিয়ে এসেছে। সেগুলোর নিচে এসে চুপচাপ পড়ে থাকে গজখানেক লম্বা ক্যাটফিশ। পাখির বাচ্চার লোভে। বাসা থেকে প্রায়ই পানিতে পড়ে যায় বকের বাচ্চা। পড়লে আর রেহাই নেই। টুক করে ধরে গিলে ফেলে রাক্ষুসে মাছ।
চলতে চলতে মনে হতে লাগল আমার, ব্যাট কেভ ওরকমই কোন চমৎকার জায়গা হবে। একটা ডোবার কাছে এসে শুয়োরের গন্ধ নাকে লাগল ইয়েলারের। শুঁকে শুঁকে চলে এল কাটাআপেলের ঝোপে। টকটকে লাল রসালো ফলগুলো দেখলেই খেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু খাওয়া আর যায় না। সারা গায়ে চুলের মত কাটা। তবু কয়েকবার চেষ্টা করে দেখেছি, খেতে খুব স্বাদ বলে। বালিতে ঘষে ঘষে কাটা ফেলে দিয়ে তারপর কামড় দিয়েছি। কিন্তু তারপরেও কি করে যেন কাটা থেকে গিয়েছিল, জিভে গেঁথে যন্ত্রণা দিয়েছে। কি করে যে এগুলো গপগপ করে গেলে শুয়োরেরা সে এক বিস্ময় আমার কাছে। আরও কিছু প্রাণীর পছন্দ ওই ফল। রঙ লাল হয়ে এলেই আসতে আরম্ভ করে বন মোরগ, এক জাতের বিশাল ইদুর আর বড় বড় কানওয়ালা লেজে আংটি আঁকা বনবেড়াল। মজা করে খায়।
সহজেই শুয়োরগুলোকে খুঁজে বের করে ফেলল ইয়েলার। ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে বসেছিল। কুকুরের ঘেউ ঘেউ শুনে ঘোঁৎ ঘোঁৎ শুরু করল। বেরিয়ে এল কয়েকটা ধাড়ি শুয়োর। ঠিকই বলেছে সারসি। ওগুলোর কানে আমাদের চিহ্ন দেখতে পেলাম। চেঁচামেচি করে পুরো দলটাকে বের করে আনল ইয়েলার। আপেলের রসে লাল হয়ে আছে ওগুলোর লম্বা লম্বা নাক। অনেকগুলো বাচ্চা হয়েছে। চিহ্ন দিতে হবে। জুতসই একটা গাছ খুঁজতে শুরু করলাম।
তেমন গাছ কাছাকাছি নেই। রয়েছে সিকি মাইল দূরে। অতদূরে শুয়োরগুলোকে টেনে নিয়ে যাওয়া কঠিন। হয়তো নেয়াই যাবে না। তাই অন্য জায়গা দেখতে লাগলাম। গাছ আর আপেল ঝোপের মাঝামাঝি একটা টিবি চোখে পড়ল। একটা ধার একেবারে সমান, দেয়ালের মত। বৃষ্টির পানি বয়ে যেতে যেতে এই অবস্থা হয়েছে। খুশি হয়ে উঠলাম। এই তো পাওয়া গেছে জায়গা। ঘুরে যদি অন্য পাশ দিয়ে গিয়ে উঠি শুয়োরেরা দেখতে পাবে না আমাকে। ইয়েলার ওগুলোকে টেনে আনবে দেয়ালের মত দিকটায়। নিচে খাদ হয়ে আছে। এদিক দিয়ে আমার কাছে কিছুতেই উঠতে পারবে না ধাড়ি শুয়োরগুলো। ধরতে পারবেনা।
শুয়োরগুলোকে ব্যস্ত রাখার ভার ইয়েলারের ওপর ছেড়ে দিয়ে আমি গিয়ে উঠলাম সেই ঢিবিটায়। কোমর থেকে দড়ি খুলে ফঁাস তৈরি করে নিচে তাকিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম।
শুয়োরগুলোকে সেখানে নিয়ে এল ইয়েলার। আমার অনেক নিচে রয়েছে ওগুলো। এত ওপর থেকে ফাঁস ছুঁড়ে ঠিকমত লাগাতে পারব কিনা বুঝতে পারছি না। শুয়ে পড়লাম উপুড় হয়ে। মনে হচ্ছে এবারে পারব।
সত্যি পারলাম। তুলে নিলাম একটা ছানাকে। বড়ই তঁাদড়। শরীর মুচড়ে পিছলে যেতে চাইল। চিৎকার করছে গলা ফাটিয়ে। ওর চিৎকারে কান দিলাম না। কান কাটতে শুরু করলাম। তারপর দুহাতে ধরে যতটা সম্ভব ঝুঁকে ছেড়ে দিলাম নিচে। নরম বালিতে পড়ল। কোন ক্ষতি হলো না ওটার, ব্যথা পেল না। বুড়ো শুয়োরগুলো ঘিরে এল ওটাকে। রক্তাক্ত কান শুঁকেই খেপে গিয়ে চেঁচাতে শুরু করল। কি করে ঘটল ব্যাপারটা বুঝতে পারেনি। আমাকেও দেখতে পায়নি।
শুয়ে শুয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম। নাগালের মধ্যে আরেকটা এলেই ধরব। খাদের দেয়াল ঘেঁষে একটা গর্ত, অনেকটা গুহার মত। তার মধ্যে ঢুকে গেছে মাদী আর বাচ্চা শুয়োরগুলো। আমি দেখতে পাচ্ছি না।
অবশেষে বেরোল আরেকটা বড় বাচ্চা। ভাল করে দেখার জন্যে হাতে ভর দিয়ে কয়েক ইঞ্চি আগে বাড়লাম। আরও একটু ঝুঁকলাম। হ্যাঁ, এবার দেখতে পাচ্ছি। ফাঁসও পরাতে পারব।
দড়ি নামিয়ে দিলাম। ধরেও ফেললাম শুয়োরটাকে। টেনে তুলতে গিয়েই ঘটল বিপত্তি। চাপ আর আমার ভার সইতে না পেরে ভেঙে গেল বালির ঢিবির কিনার। টন টন বালি ধসে পড়ল খেপা শুয়োরগুলোর ওপর। আমিও পড়লাম সেই সঙ্গে। হুমড়ি খেয়ে মাথা নিচু করে পড়লাম সেই খুনী জানোয়ারগুলোর একেবারে মাঝখানে।
শুয়োরগুলোকে ঢেকে দিয়েছে বালি। কিন্তু আলগা বালিতে কোন ক্ষতি হলো না ওগুলোর। বালির ভেতর থেকে লাফিয়ে বেরোল বিরাট একটা মন্দা। যেন মাটি খুঁড়ে উদয় হলো। ঝাড়া দিয়ে দিয়ে বালি ফেলতে লাগল শরীর থেকে। পড়ার সময় চিৎকার করেছি কিনা মনে নেই। এখন টের পেলাম ভীষণ আতঙ্কে সাংঘাতিক লাফাচ্ছে হৃৎপিণ্ডটা। মনে হচ্ছে বেরিয়ে আসবে বুকের খাঁচা থেকে। প্রাণ বাঁচানোর প্রচণ্ড তাগিদে মরিয়া হয়ে লাফ দিয়ে উঠে দৌড় দিতে গেলাম। কিন্তু দেরি করে ফেলেছি। খ্যাচ করে এসে আমার পায়ে লাগল শুয়োরটার ধারাল দাঁত। ক্ষুর দিয়ে কোপ মারল যেন পায়ের গোছার নরম মাংসে।
তীব্র একটা যন্ত্রণা। চিৎকার করে উঠলাম। বুঝতে পারছি, আর রক্ষা নেই। রেহাই দেবে আমাকে খেপা শুয়োরগুলো।
বাঁচাল ওল্ড ইয়েলার। যেমন করে আরলিসকে বাঁচিয়েছিল ভালুকটার কবল থেকে। প্রচণ্ড রাগে ছুটতে ছুটতে এল সে। ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার আর শুয়োরগুলোর মাঝখানে। দাঁত খিচিয়ে হুমকি দিল দু-একবার। তারপর এগোল কামড়ে দিতে। কিন্তু তার আগেই তার চামড়া চিরে দিল শুয়োরের ধারাল দাঁত। যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে উঠল সে। আমার শাস্তিগুলো নিজের গায়ে তুলে নিয়েছে স্বেচ্ছায়। আমাকে পালিয়ে বাঁচার ক্ষীণ একটা সুযোগ করে দিয়েছে।
সুযোগটা নিলাম। লাফিয়ে উঠে মরিয়া হয়ে দৌড় দিলাম শুকনো নালার বুক ধরে। কিছুদূর এগিয়ে ডানের খাড়া পাড় বেয়ে অনেক কষ্টে ওপরে উঠে ঢুকে পড়লাম কাঁটাঝোপের মধ্যে। সাধারণ সময় যেখানে ঢোকার আগে হাজার বার চিন্তা করতাম, তার মধ্যে দিয়েই ছুটলাম। কয়েক গজ যেতে না যেতে একটা শেকড়ে পা বেঁধে উড়ে গিয়ে পড়লাম মাটিতে।
ঠিক মাটিতে পড়েছি বললে ভুল হবে। পড়েছি আসলে অর্ধেক মাটিতে আর অর্ধেক কাটাঝোপের ডালপাতার ওপর। উঠে বসতে গিয়েও বিপদ। পুট পুট করে চামড়া ছিদ্র করে অনেকগুলো কাটা ঢুকে গেল শরীরের এখানে ওখানে, বিশেষ করে নিতম্বে।
তবুও উঠে বসেছি। হাঁপাচ্ছি। কানের কাছে যেন অনবরত হাতুড়ির বাড়ি মারছে রক্তস্রোত। তবে মাথাটা পরিষ্কার হয়ে গেছে আবার।
ব্যথার ভয় না করে ডাল ধরে হ্যাঁচকা টান দিয়ে খুলে ফেললাম নিতম্বে বেঁধা কাটাগুলো। শুয়োরের দাঁতে কতটা কেটেছে দেখার জন্যে প্যান্ট গুটিয়ে ওপরে তুললাম। চমকে গেলাম এত রক্ত দেখে। আতঙ্ক এসে গ্রাস করল আরেকবার। কাটা জায়গা দিয়ে দরদর করে রক্ত বেরিয়ে গিয়ে ঢুকে যাচ্ছে জুতোর মধ্যে।
হাঁ করে তাকিয়ে আছি। শিউরে উঠল শরীর। জোর করে মন শক্ত করলাম। হাত দিয়ে মুছে ফেললাম রক্ত। ভাল কাটাই কেটেছে। যেমন লম্বা তেমন গভীর। হাড় দেখা যায়। এখনও তেমন যন্ত্রণা নেই। তবে ব্যথাটা আসবে, আমি জানি। আরও পরে যখন রক্তপাত বন্ধ হয়ে যাবে, ফুলে উঠবে জখম, তখন। তার আগেই কাটাটা বেঁধে নিয়ে যত তাড়াতাড়ি পারা যায় বাড়ি চলে যাওয়া দরকার। পায়ের পেশী আড়ষ্ট হয়ে গেলে আর পারব না।
ছুরি দিয়ে শার্ট কেটে কাপড়ের লম্বা একটা চিলতে বের করলাম। সেটা দিয়ে শক্ত করে বাঁধলাম ক্ষতস্থান। উঠে পা লম্বা করে দিয়ে দেখলাম বাঁধনের জন্যে হাঁটতে অসুবিধে হয় কিনা। হয়, তবে হাঁটতে পারছি।
রওনা হলাম। কিন্তু বাড়ির দিকে নয়। কাঁটাঝোপের ভেতর দিয়ে এগোলাম উল্টো দিকে।
কেন যে ওদিকে যাচ্ছি নিজেও ঠিক জানি না। ওল্ড ইয়েলার আমার প্রাণ বাঁচিয়েছে। হয়তো এতক্ষণে মরে গেছে, তবে সেটা দেখে নিশ্চিত না হয়ে আমি বাড়ি ফিরছি না। তাতে যদি দেরি হয়, পায়ের পেশী শক্ত হয়ে যায়, যাক। না দেখে আমি যাব না। এই কথাগুলো ভাবাই আমার পক্ষে স্বাভাবিক ছিল, কিন্তু আমি ভাবলাম না। কেবল সোজা এগিয়ে চললাম সেদিকে যে দিকটাতে ওর থাকার কথা।
শুকনো নালার বুকে ও পড়ে আছে। যেখান থেকে মোড় নিয়ে ঢাল বেয়ে উঠে আমি কাঁটাঝোপে ঢুকেছি। আমাকে অনুসরণের চেষ্টা করেছিল, কিন্তু জখমটা বড় বেশি। সে জন্যেই আর কুলিয়ে উঠতে পারেনি। বড় একটা চ্যাপ্টা পাথরের তলায় ঢুকে আত্মরক্ষা করেছে। ওপর থেকে কোন কারণে গড়িয়ে পড়েছিল পাথরটা। নিচের দিকে মাটিতে একটা ফোকর। ভেতরে অতি খুদে একটা গুহা। ওটা পেয়ে গেছে বলেই এখনও বেঁচে আছে।
চলে গেছে শুয়োরগুলো। মাটিতে, পাথরের চারপাশে ওগুলোর খুরের দাগ। ইয়েলারকে ধরার অনেক চেষ্টা করেছে, বোঝা যায়। পারেনি। আমি ওকে দেখতে পেতাম না। পাথরটাকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতাম। আমি যাওয়ার সময় সে গুঙিয়ে উঠেছিল বলেই জানলাম ওই পাথরের তলায় রয়েছে।
উবু হয়ে বসলাম পাথরটার পাশে। ভেতরে হাত ঢুকিয়ে টেনে বের করলাম ওকে। গুঙিয়ে উঠল সে ব্যথায়, মৃদু কোঁ কোঁ করল। কিন্তু বাধা দিল না। নেতিয়ে পড়ল মাটিতে। রক্তে মাখামাখি। লেজের গোড়াটা নাড়তে গিয়েই কেঁপে উঠল শরীর, এতটা দুর্বল হয়েছে। তার পরেও আমার কাটা জায়গাটা চেটে দেয়ার চেষ্টা করল।
গলার কাছে একটা দলা আটকে গেল যেন আমার। চোখ ফেটে পানি বেরিয়ে এল। আমার জখম হয়েছে একটা, আর ওর অন্তত এক ডজন। তারপরেও আমাকেই সান্ত্বনা দেয়ার জন্যে আমার জখম চেটে দিতে চাইছে। ওর পেটের কাটাটা তো মারাত্মক। চেরা জায়গা দিয়ে নাড়িভুড়ি সব ঠেলে বেরিয়ে আসার হুমকি দিচ্ছে। কিছু কিছু বেরিয়ে পড়েছে।
তাকানো যায় না সেদিকে। উঠে দৌড়ে পালাতে ইচ্ছে করল। এই দৃশ্য আমি সহ্য করতে পারছি না।
কিন্তু পালালাম না। চোখ বন্ধ করে ইয়েলারের মাথায় একটা হাত রেখে বুলিয়ে দিতে লাগলাম। তার আঠা আঠা রক্ত লাগছে আমার হাতে। অনুভূতিটা ভাল নয় মোটেও। তবু হাত তুলে আনলাম না। জানি, আমার হাত বোলানোতে তার জখমের কোন উপকার হবে না। কিন্তু ওভাবে তাকে একলা মরার জন্যে ফেলে রেখে উঠে চলেও যেতে পারলাম না।
এই সময় মনে হলো এখনও মরেনি ও। হয়তো মরতে হবে না। চেষ্টা করলে বাঁচানো যেতেও পারে। জলদি জলদি বাড়ি গিয়ে আমাকে ডেকে আনতে পারলে ওর চিকিৎসা করা যাবে। আম্মা ডাক্তার নয়, তবে জখমের চিকিৎসা মোটামুটি জানে।
শার্টের হাতা দিয়ে চোখের পানি মুছে মনকে শক্ত করলাম। আমি এখানে বসে বসে কাঁদলে ইয়েলারের কোন উপকার হবে না। শার্টটা খুলে নিয়ে কেটে লম্বা লম্বা ফালি করলাম। বড় একটা টুকরো দিয়ে যত্ন করে মুছলাম ওর পেটের জখমে লেগে থাকা বালি। সাবধানে ঠেলে ঢুকিয়ে দিলাম বেরিয়ে যাওয়া নাড়ি। চেরা জায়গাটার দুটো ধার টেনে কাছাকাছি এনে কাপড়ের ফালি দিয়ে পেঁচিয়ে বাঁধলাম।
সহ্য বটে ইয়েলারের। নিশ্চয় প্রচণ্ড ব্যথা পেয়েছে। কিন্তু টু শব্দ করল না। রোদ লাগছে। গরম থেকে বাঁচাতে তাকে আবার ঠেলে ঢুকিয়ে দিলাম পাথরের নিচে। এইবার গোঙাল সে। ব্যথায় নয়। বুঝে ফেলেছে, ওকে ফেলে যাব আমি। হামাগুড়ি দিয়ে গর্ত থেকে বেরিয়ে আসতে চাইল।
বেরোতে দেয়া চলবে না। গর্তের মধ্যেই নিরাপদ। ভারি কিছু দিয়ে মুখটা বন্ধ করে দিতে হবে। বড় একটা পাথর হলেও চলে। তবে পেয়ে গেলাম তার চেয়ে ভাল জিনিস।
শুকনো নালার পাড়ে মরে পড়ে আছে একটা উপড়ে যাওয়া মেসকিট গাছ। গোড়াটা বেশ মোটা আর ভারি। পায়ে চোট না থাকলে বয়ে আনতে খুব একটা অসুবিধে হত না আমার। কিন্তু এই অবস্থায় টানাহেঁচড়া করে আনতে গিয়ে ঘামতে লাগলাম। আবার ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে এল পায়ের কাটা থেকে। থামলাম না। গাছটা নিয়ে এলাম গর্তের কাছে।
ইয়েলারকে গর্তে ঢুকিয়ে দিয়ে গাছটা ঠেলে দিলাম মুখের কাছে। প্রায় ভরে গেল মুখটা। সামান্য যে ছিদ্রটা আছে এখন তা দিয়ে শরীর মুচড়ে মুচড়ে একটা কুকুর হয়তো বেরোতে পারে, তবে সুস্থ কুকুর হলে। ইয়েলারের সেই সাধ্য হবে বলে মনে হয় না।
গর্ত থেকে বেরোনোর চেষ্টা আর করল না সে। আমার দিকে এমন করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল, গলার কাছের দলাটা আবার উঠে এল আমার। আমার দয়া ভিক্ষা করছে, যা কখনও করে না সে।
হাতটা ঢুকিয়ে দিলাম ভেতরে। মাথায় হাত দিয়ে বললাম, ইয়েলার, ভাবিসনে। আমি আম্মাকে আনতে যাচ্ছি। তুই থাক। যত তাড়াতাড়ি পারি ফিরে আসব।
আর দেরি করলাম না। খোঁড়াতে খোঁড়াতে প্রায় দৌড়ে চললাম বাড়ির দিকে। পেছনে হউউ হউউ করে টেনে টেনে চিৎকার করতে লাগল ইয়েলার। কাঁদছে সে। বুকের মধ্যে কেমন করে উঠল আমার। তাকে এভাবে কাঁদতে শুনিনি আর কখনও।
<