বিরতিহীন অ্যালার্মের শব্দকে ছাপিয়ে উঠল গার্ডদের ছুটে আসার আওয়াজ।

ঝট করে ফেল্ট ছেড়ে দিয়ে ঢাকনির কিনারা ধরল রানা, তো ওয়ানের ডেথ সুটের উপর টেনে আনল ওটাকে। অন্তত প্রথমদর্শনে কারও মনে হবে না এখানে কিছু নাড়াচাড়া করা হয়েছে।

তারপর ছুটল রানা। খিলান আর টিকিট ঘর পার হয়ে এল। ওর চারদিক থেকে ভেসে আসছে উত্তেজিত, উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বর-বোঝা যাচ্ছে না কোটা ধ্বনি আর কোটা প্রতিধ্বনি।

একটা থামের আড়ালে একবার থামল রানা। কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে চারজন গার্ডকে ছুটে যেতে দেখল ও। এদের মধ্যে দুজনকে আগেও দেখেছে।

গ্যালারির আরেক প্রান্তে ঝাপসা মত নড়াচড়ার আভাস পাওয়া গেল, তার মানে পাশের কালচারাল ইন্সটিটিউট থেকেও গার্ডরা ছুটে আসছে।

মিউজিয়ামটা দ্রুত একটা পাগলাগারদ হয়ে উঠছে। এরপর নিশ্চয়ই কিউরেটর থাইগন লোবাংকে ডাকা হবে।

 যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, কারও চোখে না পড়ে, মিউজিয়াম। থেকে বেরিয়ে যেতে চাইছে রানা। দেয়াল ঘেঁষে এগোচ্ছে ও, আড়াল হিসাবে পাচ্ছে কেসগুলো, সারাক্ষণ খেয়াল রাখছে কেউ। ওকে পালাতে দেখছে কিনা। আগেই ঠিক করেছে-যে পথ দিয়ে ঢুকেছে বেরুবার জন্য সেটাই সবদিক থেকে ভালো, স্টোর রুমে ফিরে ভাঙা জানালাটা ব্যবহার করবে।

তবে ব্যাপারটা অত সহজ হলো না।

হলের শেষ মাথা পর্যন্ত নির্বিঘ্নেই পৌছাল রানা, তারপর দেখল সিঁড়িতে যাবার পথ বন্ধ। তাই বলে ঘাবড়াল না। সাদা কোট যদি গার্ডদের ফাঁকি দিতে পারে, ওরও না পারার কোন কারণ নেই। অবশ্য ফাঁকি দিতে গিয়ে লোকটা ধরা বা গুলি। খেয়েছে কিনা জানা নেই রানার। জানার কোন উপায়ও নেই। তবে। একটা ব্যাপারে নিশ্চিত ও মিউজিয়াম থেকে বেরুতে না পারলে। ডালে বসা পাখির মত অনায়াসে গুলি করে মারা হবে ওকে।

মেটাল সেফটি ডোরের সামনে পায়চারি করার ভঙ্গিতে টহল। দিচ্ছে প্রকাণ্ডদেহী একজন গার্ড, .৩৮ কোল্টটা হাতে। স্নায়ুর জন্য ভয়ানক পীড়ন, আরেকটা অ্যালার্ম বেজে উঠল। কী চিন্তা করছে না করছে, নিজেরই অসুবিধে হচ্ছে বুঝতে। হয়তো অমূলকই, একটা ভয় ঢুকল মনে।

এভাবে অ্যালার্ম বাজতে থাকলে সামরিক জান্তার নির্দেশে মায়ানমার আর্মি না ছুটে আসে।

গার্ডটাকে গুলি করে ফেলে দিল রানা-ব্যস, ঝামেলা শেষ; এবার নির্বিঘ্নে নিজের হোটেলে ফিরে নরম বিছানায় ঘুম দাও। এটা স্রেফ কল্পনা, অবশ্য রানার জায়গায় অন্য কেউ হলে হয়তো এই কল্পনাই বাস্তবে রূপ নিত, কিন্তু নির্দোষ একজনকে মেরে ফেলা ওর পক্ষে সম্ভব নয়।

এখন পর্যন্ত গার্ডরা দুজন চোর সম্পর্কে সচেতন-সাদা কোট আর সাদা টাই সম্পর্কে। আরও একজন বিনা অনুমতিতে মিউজিয়ামে ঢুকেছে, ভিতরেই লুকিয়ে আছে কোথাও, এটা তাদেরকে জানাবার কোন মানে হয় না।

শোল্ডার হোলস্টার থেকে পিস্তল বের করে একটা গুলি করল রানা। গরম সীসা বাতাস চিরে ছুটল, গার্ডের কাছ থেকে পঞ্চাশ ফুট দূরের একটা মার্বেল পিলারে লেগে বাঁক নিল আরেকদিকে। কয়েনের মত, গুলিটাও ছোড়া হয়েছে দৃষ্টি আর মনোযোগ সরাবার জন্য।

গুলির আওয়াজ হয়েছে, অমনি ডাইভ দিয়ে মেঝেতে পড়ল গার্ড, যেন আহত হয়েছে। তারপর যখন বুঝল অক্ষত আছে সে, যেদিক থেকে গুলি হয়েছে ক্রল করে সেদিকে এগোল, খেয়াল নেই যে সিঁড়ির মাথাটা কয়েক সেকেন্ডের জন্য হলেও অরক্ষিত পড়ে থাকবে।

মাত্র ওই কয়েক সেকেন্ডই দরকার ছিল রানার।

 ত্রিশ ফুটও সরেনি গার্ড, ধাতব দরজা লক্ষ্য করে ছুটল রানা। ধাক্কা দিতেই খুলে গেল ওটা, বেরিয়ে যাবার সময় গার্ডের আঁতকে ওঠার আওয়াজ শুনতে পেল। প্রতিবার দুতিনটে করে ধাপ টপকে নীচে নামার সময় সিকিউরিটি সাইরেন এখন ভোঁতা লাগছে। কানে। ওর পিছু নিয়েছে ছুটন্ত একজোড়া পা। গার্ড ওকে পালাতে দেখেছে, এই পা নিশ্চয় তারই। রানা স্টোররুমে ঢোকার আগে সে বা তার কোল্টের গুলি ওর নাগাল না পেলেই হয় এখন।

ভাগ্যক্রমে স্টোররুমের দরজার তালা এখনও খলা রয়েছে। ভিতরে ঢুকে বোল্ট টেনে দিল রানা। গাঢ় অন্ধকার, টর্চ না জ্বাললে। দেখতে পাবে না নিজের সামনে কী আছে। আলোর টানেলটা নিচু করে রাখল রানা, ধুলো ঢাকা মেঝের দিকে তাক করে। ক্যাটালগে। তোলা হয়নি, কিংবা মেরামত করতে হবে, এরকম প্রচুর আর্টিফ্যাক্ট পড়ে আছে মেঝেতে; সেগুলোর ভিতর দিয়ে পথ করে নিয়ে এগোচ্ছে রানা। জানালার কাছে পৌঁছে টর্চ নিভিয়ে পকেটে রেখে দিল। ওয়ালথারটাও ফিরে গেল শোল্ডার হোলস্টারে। জানালা গলে বাইরে বেরুতে খানিকটা শারীরিক কসরৎ করার। দরকার হলো। বেরিয়ে এসে তারের জালটা জায়গা মত আটকে দিল ও। তারপর রওনা হলো পিয়ারে স্ট্রিটের দিকে।

কী কপাল, এবারও বেশি দূর যেতে পারল না।

গলিটার সরাসরি মুখে আর্মির একটা জিপ দাঁড়িয়ে আছে, সামনেটা ভাসিয়ে দিচ্ছে হলুদ আলোর বন্যায়।

পিছিয়ে এল রানা। তারপর একটা দালানের পাঁচিলে পিঠ ঠেকিয়ে উল্টোদিকে এগোল। ওর কোন ধারণা নেই কোনদিকে যাচ্ছে বা কোন রাস্তা ধরলে তাড়াতাড়ি এলাকাটা ত্যাগ করা সম্ভব।

মিউজিয়ামে চোর বা ডাকাত যাই ঢুকে থাকুক, বোঝা গেল কর্তৃপক্ষ ব্যাপারটাকে অত্যন্ত সিরিয়াসলি নিয়েছে। পুলিশকে না ডেকে, সরাসরি সামরিক বাহিনীকে খবর দিয়েছে। সন্দেহ নেই, তারা ভয় পাচ্ছে আন্তর্জাতিক মহলে না দুর্নাম রটে যায়। অমূল্য চাইনিজ আর্টিফ্যাক্ট-এর নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে মায়ানমারের সামরিক জান্তা, এ-ধরনের একটা খবর বিশ্ব মিডিয়া লুফে নেবে।

তারা যতই ভয় পাক, তাদের চেয়ে বেশি ভয় পাচ্ছে রানা। ওর মাথায় ঢুকছে না কীভাবে হোটেলে ফিরবে, বিশেষ করে যেখানে মনে হচ্ছে কালচারাল ইন্সটিটিউটে গিজগিজ করছে। আর্মি।

নর্দমার উপর দিয়ে হেঁটে একটা মেথর প্যাসেজের শেষ মাথায় চলে এল রানা। উঁকি দিয়ে মন্ত্রণালয়-এর ভবনটার একটা পাশ দেখতে পাচ্ছে এখান থেকে।

হতাশায় ছেয়ে গেল মনটা।

ভবনটার পাশে বড়সড় মাঠ আর বাগান, কাঁটাতারের উঁচু বেড়া দিয়ে ঘেরা। দ্বিতীয়টা আসলে স্কাল্পচার গার্ডেন, পাথর খোদাই করে বানানো প্রাচীন স্ট্যাচু দাঁড়িয়ে আছে চারদিকে। চেহারায় জ্ঞানী মহামানবের ছাপ, চোখে সবজান্তার দৃষ্টি, প্রকাণ্ড একটা বুদ্ধমূর্তি রানার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। ওটার পিছনে তিনতিনটে মাথা নিয়ে একটা হাতি আর স্মার্ট চালবাজ টাইপের একটা সিংহ দেখা যাচ্ছে, দুটোই যুদ্ধের প্রতীক। স্কাল্পচার গার্ডেন কয়েকটা ফ্লাডলাইটের আলোয় ভেসে যাচ্ছে। বাগানের আরেক দিকে মাঠ, সেখানে পুলিশের চার-পাঁচটা জিপ আর মাইক্রোবাস দেখা যাচ্ছে। ওগুলোর হেডলাইট জ্বলছে। সশস্ত্র পুলিশদের দেখা গেল গাড়ি থেকে নেমে লাইন ধরে কালচারাল ইন্সটিটিউটের ভিতর ঢুকছে। তাদের সবাই ইউনিফর্ম পরা নয়।

ছায়ায় সরে এসে কাঁধের উপর দিয়ে পিছন দিকে তাকাল রানা। গলির মুখ বন্ধ করে এখনও সেখানেই দাঁড়িয়ে রয়েছে। সেনাবাহিনীর জিপটা।

চিন্তা করছে রানা। ওর সামনে দুটো রাস্তা খোলা আছে, কোনটাই তেমন উৎসাহব্যঞ্জক নয়।

কাঁটাতারের বেড়া কেটে স্কাল্পচার গার্ডেনে ঢুকতে পারে, তারপর মাঠে। চার-পাঁচজন ড্রাইভার ছাড়াও দুচারজন পুলিশ থাকবে ওখানে, ওকে দেখে তাদের কী প্রতিক্রিয়া হবে বলা। মুশকিল। চোর-ডাকাতদের সদস্য মনে করে গুলি চালালেও। আশ্চর্য হবার কিছু নেই।

আরেকটা উপায় হলো, নিঃসঙ্গ জিপ লক্ষ্য করে সোজা হাঁটা। আশা করা যায় ড্রাইভার ছাড়া আর হয়তো একজন লোক আছে। ওটায়। ভাগ্য প্রসন্ন হলে একা শুধু ড্রাইভার। ওর হাতে যদি পিস্তল থাকে, আর ভাব দেখে মনে হয় চোর-ডাকাতদের ধাওয়া করছে, ড্রাইভারকে বোকা বানানো সম্ভব হলেও হতে পারে।

দেখা যাক।

কোন রকম দ্বিধা না করে সোজা জিপটার দিকে রওনা হয়ে গেল রানা। প্রতিপক্ষ হিসাবে আট-দশজনকে কে চায়, একদুজনকে মেনে নেওয়ার সুযোগ থাকলে?

হনহন করে হাঁটা ধরলেও, জিপটার আড়াল থেকে কর্তৃত্বের সুরে একজনকে কথা বলতে শুনে গতি কমাল রানা, দেয়াল ঘেঁষে এগোল।

এই যে, তুমি, ঘুরে পিছনদিকে চলে যাও, অনুবাদ করল। রানা। তারপর শুনতে পেল, শুধু শুধু দাঁড়িয়ে থেকো না। আমি চাই ফ্লোরগুলোর প্রতি ইঞ্চি সার্চ করবে তমরা। আরেকটা কথা, সন্দেহ হলে পুলিশকেও সার্চ করতে পারবে তোমরা।

আরেকটু এগোতে লোকটাকে দেখতে পেল রানা, নেহাতই বোকার মত হেডলাইটের আলোয় দাঁড়িয়ে রয়েছে। ইউনিফর্ম বলে। দিল ক্যাপটেন। সঙ্গের লোকজন এইমাত্র চলে গেছে, ক্যাপটেন কথা বলছে ওয়াকি-টকিতে।

ইতিমধ্যে হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিয়েছে রানা, হন্তদন্ত একটা ভাব নিয়ে ক্যাপটেনের দিকে এগোচ্ছে, হাতে পিস্তল। নির্দেশ দেবার মাঝপথে ওকে দেখতে পেয়ে সন্দেহ নয়, রাগ হলো তার। ওয়াকি-টকি বন্ধ করে এগিয়ে এল, খেয়াল নেই হেডলাইটের তৈরি আলোর টানেল থেকে বেরিয়ে আসছে। দল ছেড়ে এদিকে কী? খেকিয়ে উঠল সে। থামুন! আপনাকে সার্চ করব আমি!

প্রথমে দুই হাত মাথার উপর তুলল রানা, থামল একটু পরে-ক্যাপটেনের একেবারে সামনে পৌঁছে। কয়েকজনকে ধাওয়া করছি আমরা, বার্মিজ ভাষায় বলল ও, ফলে দলটা ভেঙে গেছে…

পিছন ফিরে দাঁড়ান! নির্দেশ দিল ক্যাপটেন।

তোমার কথা আমি শুনব কেন? জিজ্ঞেস করল রানা। বিশেষ করে তোমার অস্ত্র যখন হিপে, আর আমারটা হাতে?

বিদ্যুৎ খেলে গেল ক্যাপটেনের শরীরে। হিপ হোলস্টার থেকে পিস্তলটা প্রায় বের করে এনেছে। রানার উঁচু করা হাতটা এবারও দ্রুত নেমে এল সরাসরি তার চাদির মাঝখানে। কত জোরে মারতে হবে, দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞতা থেকে মাপটা জানা আছে; ফলে মাত্র ঘণ্টাখানেকের জন্য জ্ঞান হারাল ক্যাপটেন। খপ করে ধরে ফেলায় সটান আছাড় খেয়ে আহতও হলো না।

দেয়াল ঘেঁষে তাকে শুইয়ে দিল রানা, পকেট হাতড়ে চাবিটা বের করল, তারপর স্টার্ট দিয়ে ছেড়ে দিল জিপ।

গুলি হলো পরমুহূর্তেই, তবে জিপের পিছন থেকে। নিশ্চয়ই কেউ কিছু দেখে বুঝে ফেলেছে কী ঘটে গেছে এদিকে। স্পিড বাড়িয়ে গলি থেকে বেরিয়ে এল রানা। আরেকটা গুলি হলো, তবে এটাও টায়ার ছুঁতে পারেনি।

<

Super User