০৬.

সত্যিই দেখার মত, বলল লাবনী।

আগেও বেশ কয়েকবার মিশরে এসেছে রানা, চুপচাপ দেখছে চারপাশ।

মহাকালের গ্রাসে বিলীন হয়েছে প্রাচীন সপ্তাশ্চর্যের ছয়টি মহান কীর্তি, তবে রয়ে আছে গিজার মস্তবড় সব পিরামিড। খুফুর পিরামিড এবং অপেক্ষাকৃত ছোট অন্য দুই পিরামিডও এতই প্রকাণ্ড, বুকে বিস্ময় জাগে। ওই বিশাল আকারের জন্যেই সাড়ে চার হাজার বছর ধরে টিকে আছে ওগুলো। অবশ্য বহু আগেই খসে পড়েছে ম্যানকেউরের পিরামিডের ধবল লাইমস্টোন, এখন দাঁত বের করে হাসছে বালিপাথর ও গ্ল্যানেট।

লাবনীর মত মুগ্ধ নয় বেলা। চুল খুঁজেছে বেসবল ক্যাপের ভেতর। মুখের বেশিরভাগ ঢাকা পড়েছে বড় এক সানগ্লাসে। জমাট বাঁধা বালিতে পা ঠুকল ও। সবই ঘুরে দেখেছি। বিরক্ত হয়ে গেছি দেখতে দেখতে। …ডক্টর মেয়ের সঙ্গে কখন দেখা করবেন, ডক্টর আলম?

খোঁজ নিয়েছি, আপাতত এখানে নেই সে, বলল লাবনী।

টুরিস্ট পুলিশ বা কম্পাউণ্ডের সিকিউরিটি গার্ডদের হাতে ধরা পড়ার ভয়ে রানা ও লাবনীর সঙ্গে যায়নি বেলা।

আইএইচএ টিমের সঙ্গে দেখা করেছিল লাবনী, কিন্তু কম্পাউণ্ড ঘুরে দেখার অনুমতি দেয়নি তারা।

কায়রোয় টিভি শোতে অংশ নিচ্ছে। দুনিয়ার মানুষকে বুঝিয়ে দিচ্ছে কী দুর্দান্ত কাজ করছে সে। আগামী কয়েক ঘন্টার ভেতর ফিরবে না।

কম্পাউণ্ডের উত্তরের রোড ধরে এগোল রানা, লাবনী ও বেলা। দেয়ালের ওপর থেকে নিচের কন্ট্রাকশন সাইট দেখাল মেয়েটা।

ওই শার্ট কোথায়? জানতে চাইল রানা।

দূরের এক তাবু দেখাল বেলা। ওই যে, ওটার ভেতর।

পযিশনটা মনে গেঁথে নিল রানা। বেলা যা বলেছিল, তার চেয়ে ভালভাবে পাহারা দেয়া হচ্ছে। টুরিস্ট পুলিশদেরকে বাদ দিলেও রয়েছে ইউনিফর্ম পরা দুজন গার্ড। তারা প্রাইভেট সিকিউরিটি কন্ট্রাক্টরের লোক, চোখ রাখছে চারপাশে।

স্ফিংসের দিকে তাকাল বেলা। আগের চেয়ে বেশি লোক রেখেছে।

যাতে খনন এলাকায় কেউ যেতে না পারে, বলল রানা। এর ভাল দিকও আছে।

আছে? অবাক হয়েছে বেলা।

এদের কেউ কেউ নতুন। তারা তোমাকে চেনে না। দেয়ালের ওপরের দিকে হাত রাখল রানা। যেন বুঝে নিতে চাইছে পাথরের স্ল্যাবের ওজন কেমন।

কী করবে ভাবছ, রানা? জানতে চাইল লাবনী।

 এখনও কিছুই ঠিক করিনি, বলল রানা।

স্ফিংস থেকে মাত্র সিকি মাইল দূরে গ্রেট পিরামিডের বিশাল ভিত্তি। একেক দিক দৈর্ঘ্যে সাত শ পঞ্চাশ ফুটেরও বেশি। অর্থাৎ, পনেরো শ ফুটেরও বেশি দূরে উত্তরদিকের এন্ট্রান্স। এরই মধ্যে ওখানে জড় হয়েছে কয়েক ডজন টুরিস্ট। তাদের ওপর চোখ রাখছে একদল পুলিশ। দিনে মাত্র দুবার অল্প কজনকে ঢুকতে দেয়া হয় পিরামিডের ভেতর। নিউ ইয়র্কে বিমানে চেপে এগারো ঘণ্টা জার্নির পর কায়রো এয়ারপোর্টে নেমেছে রানারা। বেরিয়ে এসে জেদ ধরল লাবনী। ফলে আর বিশ্রাম হয়নি ওদের। টিকেট অফিস খোলার আগেই হাজির হয়েছে এখানে।

আগে লাবনী ও বেলাকে পিরামিডের পাথুরে স্তরে উঠতে দিল রানা, তারপর অনুসরণ করল।

পিরামিডের ভেতরে ঢুকে লাবনী বলল, ছবিতে যা দেখেছি, সে তুলনায় মেঝে অনেক খাড়া।

দুপাশে মসৃণ পাথুরে দেয়াল, সরু প্যাসেজ ত্রিশ ডিগ্রি নেমে ঢুকেছে পিরামিডের অভ্যন্তরে। ছাত এতই নিচু, বুকে হাঁফ লাগবে যে-কারও।

নেমে গেলে পৌঁছে যাবেন মূল সমাধির ভেতর, কিন্তু ওখানে কিছুই নেই, বলল বেলা, পিরামিড তৈরির এক পর্যায়ে অন্য এক সমাধিকক্ষ ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন ফেরাউন খুফু।

নিশ্চয়ই খুব খেপে গিয়েছিল আর্কিটেক্টরা। বিরক্ত হয়ে ভেবেছে: হারামি এখন অন্য কথা বলছে! এর চেয়ে বদমাশ লোক আর দেখিনি! বলল লাবনী।

ষাট ফুট যাওয়ার পর দুভাগ হলো প্যাসেজ। একটা গেছে নিচে। অন্যটা ওপরে। ওপরেরটার ছাত আরও নিচু।

বেলার পরামর্শে দ্বিতীয় প্যাসেজ বেছে নিল রানা ও লাবনী। বাইরে ফুরফুরে হাওয়া, কিন্তু সুড়ঙ্গের ভেতর গরমে আঁকড়ে আসছে বুক।

যেন শেষ হবে না খাড়াই পথ। লাবনী ও বেলার পেছনে প্রায় আধভাজ হয়ে হাঁটছে রানা। কাফ মাসলে বিশ্রী খিচ ধরতেই মহাবিরক্ত হয়ে বলল, ফেরাউনগুলো বেঁটে আর কুঁজো ছিল নাকি?

আর যা-ই হোক, জীবিত অবস্থায় ঢুকতে আসেনি, বলল লাবনী, তা ছাড়া, রাজাবাদশা, অন্যের দুঃখ বুঝবে কী করে?

কিছুক্ষণ হাঁটার পর একটু প্রশস্ত হলো প্যাসেজ। ছাতও উঠে গেল তিরিশ ফুট ওপরে।

এটা গ্রেট গ্যালারি, বলল বেলা।

বিশাল সব লাইমস্টোন দিয়ে তৈরি চেম্বার।

ধরে আসা কোমর সোজা করে জানতে চাইল রানা, নাম শুনেছি, কিন্তু কী কারণে তৈরি করেছিল?

কাঁধ ঝাঁকাল লাবনী। ধারণা করা হয়, মস্তবড় পাথরের খণ্ড তুলতে ব্যবহার করেছিল কাউন্টার ওয়েইট সিস্টেম… সেজন্যে… আসলে কেউ জানে না কেন তৈরি করেছিল। এটা পিরামিডের আরেকটা রহস্য। সামনের সমতল প্যাসেজ দেখাল লাবনী। নিচে বোধহয় রানির চেম্বার?

হ্যাঁ, সায় দিল বেলা। তবে কখনও কোনও রানি ছিল না। বাইরে তার ছোট পিরামিড। ভেতরে ফালতু অসমাপ্ত চেম্বার।

দক্ষতার দিক থেকে এসব পিরামিডের ধারেকাছেও আসবে না এ যুগের কোনও স্ট্রাকচার, বলল লাবনী। আর ওই আমলে এসব করেছে সামান্য সব যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে।

বইয়ে পড়েছি, হাজার হাজার ক্রীতদাস ছিল সাহায্যের জন্যে, বলল রানা। খুন হয়েছে তাদের বেশিরভাগই।

না, মাথা নাড়ল বেলা। যারা পিরামিড তৈরি করেছে, প্রত্যেকে ছিল দক্ষ কারিগর। কাজের জন্যে যথেষ্ট বেতনও পেয়েছে। খুফু বা চেওন্সের পরের ফেরাউনরা নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে ফেঁদেছে ক্রীতদাসের গল্প। ওরা জানত, চাইলেও তৈরি করতে পারবে না এরকম পিরামিড। তাই প্রচার করত: আমরাও খুফুর মত বিশাল পিরামিড বানাতাম, যদি তার মত লাখে লাখে ক্রীতদাস পেতাম। আসল কথা: অন্য ফেরাউনদের চেয়ে খারাপ ছিল না খুফু।

কেন এসব তৈরি করত, কেউ জানে না, আবারও বলল লাবনী। মিশর রাজ্যে প্রথমে ছিল ধাপ সমেত পিরামিড। তারপর ইঞ্জিনিয়াররা দক্ষ হলে তৈরি করল মসৃণ দেয়ালের পিরামিড। প্রথমে ডাহশুরে লাল একটা তৈরি করেছিলেন সেফেরু, ওটাই সত্যিকারের প্রথম পিরামিড। তারপর তাঁর ছেলে গড়লেন আরও বড় পিরামিড। আমরা এখন আছি ওটারই ভেতরে।

ওপরের স্তরে উঠে হাঁফিয়ে গেছে লাবনী। টের পেল, মোটেও ক্লান্ত নয় রানা ও বেলা। সামনে সমতল প্যাসেজ গেছে সমাধির আরও গভীরে। কয়েক ফুট দূরেই দীর্ঘ এক চেম্বার। ওদিকের দেয়ালের ওপরে সরু প্যাসেজ।

ওই খাঁজটা কেন? জানতে চাইল রানা।

চোর ঠেকাবার জন্যে, জানাল বেলা, এই পিরামিডে বুবি ট্র্যাপ ছিল না, তবে ছিল ছাতে মস্ত এক ভারী পাথর ভল্টের দরজার মত। খুফুকে সমাধিস্থের পর ওপর থেকে ফেলে দেয়া হয়েছিল ওটা। গেল আটকে পথ। আর ভেতরে ঢুকতে পারবে না লুঠেরার দল।

সামনের কক্ষে ঢুকল ওরা। কিছুই নেই ভেতরে। পেছন থেকে এসে ওদেরকে পাশ কাটিয়ে গেল কয়েকজন টুরিস্ট।

তো কোথায় গেল ওই পাথর বা দরজা? জানতে চাইল রানা।

সব লুঠ করেছে সমাধি-লুঠেরারা, বলল বেলা, পাথর খণ্ড সরিয়ে পথ করে নিয়ে পৌঁছে যায় রাজার সমাধিকক্ষে। ওই যে, ওই পথে যেতে হবে।

লাবনী ও বেলার পিছু নিল রানা। কুঁজো হয়ে গেল ছোট এক টানেলে ঢুকে। একটু হেঁটে পৌঁছল ফেরাউন খুফুর সমাধিকক্ষে। আজ থেকে সাড়ে চার হাজার বছর আগে এখানে রাখা হয়েছিল প্রতাপশালী সম্রাটের মৃতদেহ।

সমাধিকক্ষে প্রায় কিছুই নেই। কক্ষের দৈর্ঘ্য প্রায় চল্লিশ ফুট, চওড়ায় বিশ ফুট। ঘরের মাঝে পড়ে আছে বিশাল এক এ্যানেটের সারকোফাগাস। ঢাকনি নেই। হাওয়া হয়েছে সম্রাটের লাশ। দেয়ালেও কোনও কারুকাজ নেই।

তুতেনখামেনের সমাধির মত নয়, নইলে এখানে থাকত অনেক কিছুই,বলল বেলা।

একসময় ঠিকই ছিল খুফুর লাশ, বলল লাবনী, তাকে উপযুক্ত ভাবলে পাতাল জগতে স্থান দেবেন ওসাইরিস। তখন কাজে আসবে বলে সম্রাটের সুখের জন্যে রাখা হয়েছিল প্রয়োজনীয় সব রসদ। বিশেষ করে খাবার ও পানীয়। এ ছাড়া ছিল বিপুল পরিমাণের সোনা-রূপা ও অন্য সম্পদ।

সমাধিকক্ষে ঢুকেছে কজন টুরিস্ট। চারপাশ ঘুরে দেখছে।

সারকোফাগাসের পাশে গিয়ে কী যেন দেখছে লাবনী। একমিনিট পর বলল, মনে হয় না কখনও এটায় ছিল খুফুর মামি।

হাতঘড়ি দেখল রানা। একঘণ্টার বেশি হলো ঢুকেছি পিরামিডের ভেতর। সমাধিকক্ষ তো দেখা হলো, আর কিছু দেখবে?

চলুন, বেরিয়ে যাই, বলল বেলা, এতক্ষণে হয়তো ফিরে এসেছেন ডক্টর মেটয।

মাথা দোলাল লাবনী। ঠিক আছে, ফেরা যাক। যদিও মনে হয় না সে ফিরেছে।

ঢালু প্যাসেজে এবার কষ্ট হলো না নেমে যেতে। পঁচিশ মিনিট পর ওরা ফিরল স্ফিংসের কম্পাউণ্ডে। খোঁজ নিল লাবনী, আসেনি ম্যান মেটয। তবে ওকে জানানো হলো, আশা করা যায় আধঘন্টার ভেতর ফিরবেন তিনি।

স্ফিংসের কাছে দাঁড়িয়ে রইল ওরা। অবশ্য আধঘণ্টা নয়, পঞ্চাশ মিনিট পর এল ম্যান মেটযয। তাকে সরকারী সাদা গাড়ি থেকে নামতে দেখে হাসি-হাসি ভঙ্গি নিল বিরক্ত লাবনী। ওর কানের কাছে নিচু স্বরে বলল রানা, খেয়াল করেছ? পাশের লোকটা বেলার ফোটোয় ছিল। ক্যামেরা দিয়ে থোতা করেছে এরই মুখ।

ঠিক! ম্যান মেটযের সঙ্গী ডক্টর লুকমান বাবাফেমি। লাবনী খেয়াল করল, টেম্পল অভ স্ফিংসের চেয়ে অনেক কম ক্ষতিগ্রস্ত দক্ষিণের ভ্যালি টেম্পল। ওখানে মাথায় হ্যাট ও চোখে সানগ্লাস পরে টুরিস্টদের ভিড়ে মিশে খনন সাইটের কাছে চলে গেছে বেলা। বেলার কথা ঠিক হলে ওই লোক চাইবে না কেউ যাক তাবুটার কাছে।

দেখা যাক তুমি ওদিকে যেতে চাইলে কী করে, বলল রানা।

ম্যান মেটযের দিকে চলল লাবনী। পিছু নিল রানা।

 হাই, মেটয! মেটয! হাই!

প্রথমে বিস্মিত হলো আর্কিওলজিস্ট, অনিশ্চিত। কয়েক সেকেণ্ড পর বুঝল কে ডাকছে। নাক কুঁচকে গেল তার। লাবনী? আপনি এখানে কী করছেন?

ছুটি কাটাতে এসেছি, হালকা সুরে বলল লাবনী। আজ রাতেই তো আপনার দুর্দান্ত খনন টিভিতে দেখাবে, তাই না? ভাবলাম, একবার হ্যালো বলে যাই।

হল অভ রেকর্ডস উন্মোচিত হবে স্থানীয় সময় ভোর চারটেয়, সন্দেহের চোখে লাবনীকে দেখছে মেট। তার মনে হচ্ছে না ছুটিতে এসেছে মহিলা আর্কিওলজিস্ট। সবই ব্রডকাস্ট হবে।

অস্বস্তির অনুভূতি নিয়ে লাবনীকে দেখছে লুকমান বাবাফেমি। আপনার বান্ধবী, ডক্টর মেটয?

কলিগ, জোর দিয়ে বলল মেটয। বলতে পারেন প্রাক্তন কলিগ। লাবনী, ইনি এসসিএ-র রিপ্রেযেন্টেটিভ, ডক্টর লুকমান বাবাফেমি। আর ডক্টর, ইনি লাবনী আলম। আগে ছিলেন আইএইচএতে। আর এঁকে চিনলাম না। রানাকে দেখল মেট।

ইনি মাসুদ রানা, আমার বয়ফ্রেণ্ড, বলল লাবনী। বিব্রত বোধ করছে। খেয়াল করেছে, ওর ডক্টর পদবী উল্লেখ করেনি মেটয।

লাবনী এ বিষয়ে কিছু বলার আগেই বলে উঠল লুকমান বাবাফেমি, ডক্টর আলম! অফ কোর্স! সত্যিই দুঃখিত, প্রথমে চিনতে পারিনি! সরি!

চেনেননি, কারণ বোধহয় আমার হেয়ারস্টাইল, বলল লাবনী, ওটা পাল্টে ফেলেছি।

খুবই খুশি হলাম পরিচিত হয়ে। আন্তরিক হাসল লুকমান বাবাফেমি।

একই কথা খাটে আমার বেলায়, মিশরীয় লোকটার সঙ্গে করমর্দন করল লাবনী। আবারও বলল, ইনি আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু মাসুদ রানা।

আপনার ঘনিষ্ঠ বন্ধু? বিড়বিড় করল মেটয, মাসুদ রানা? আগেও শুনেছি নামটা।…কোথায়?

চুপ থাকল রানা। ওর সঙ্গে করমর্দন করল ম্যান মেট্য ও লুকমান বাবাফেমি। ওদিকে স্ফিংসের একটু দূরের ধ্বংসাবশেষের দিকে চেয়ে আছে লাবনী। নরম সুরে বলল, ভাবছি মূল খনন এলাকা ঘুরে দেখতে পাব কি না। এটা কি সম্ভব?

সরি, বলল ম্যান মেটয। চেপে বসেছে ঠোঁটে ঠোঁট। ওদিকে যেতে পারবে শুধু অথোরাইড় পার্সোনেল।

এর কাছে অনুরোধ করে লাভ হবে না, যা বলার বলে দিয়েছে, তাই এবার লুকমান বাবাফেমির উদ্দেশে মধুঝরা কণ্ঠে বলল লাবনী, খুবই দুঃখজনক। এসসিএ কি পারে না আমার জন্যে সামান্য ব্যতিক্রম করতে, ডক্টর বাবাফেমি?

মৃদু মাথা নেড়ে বলল বাবাফেমি, আসলে উপায় নেই, ডক্টর আলম। একবার হল অভ রেকর্ডস খোলার পর সব ক্যাটালগ করা হলে, পরে সুযোগ দিতে পারব আপনাকে। তখনও খুব কঠোর সিকিউরিটির ভেতর দিয়ে যেতে হবে। একটু দূরের গেটের গার্ডদের দেখাল সে। মাত্র কয়েক দিন আগে এই সাইটে ঝামেলা হয়েছে।

সেরকমই শুনেছি, বলল লাবনী।

আপনি শুনেছেন? ভুরু কুঁচকে ফেলল মেটয।

হ্যাঁ, এক মেয়ে, নাম বেলা আবাসি তাই না?

আগেই আলাপ করেছে রানা ও লাবনী, বেলার কথা তুলবে। লোক দুজনের প্রতিক্রিয়া খেয়াল করছে রানা।

মৌমাছির হুল বিধলে যেমন মুখ হয়, তেমনি করেছে ম্যান মেটয। লাবনীর কাছে সবই ফাঁস হয়েছে বলে লজ্জিত। গাল লালচে। তবে খুব অস্বাভাবিক লুকমান বাবাফেমির চেহারা। নিতম্বে ভোঁতা আস্ত গজাল ঢুকলে এমন করবে যে কেউ।

ওই মেয়ে স্ফিংসের একটা টুকরো চুরি করেছিল, তাই না? নিরীহ সুরে জানতে চাইল লাবনী।

হ্যাঁ… তার চেয়েও বেশি কিছু করেছে, হামলে পড়েছে আমার ওপর, রেগে গিয়ে বলল বাবাফেমি। একবার ডলে নিল নাকের ডগা।

লাবনীকে দেখে নিয়ে একটু কড়া সুরে জানতে চাইল মেট্য, এসব কোথায় শুনেছেন? নিশ্চয়ই এসব তথ্য ফাঁস করেছে প্রফেসর ট্রিপের রিসেপশনিস্ট লিপি গোমেযয?

না, তার কাছ থেকে কিছুই শুনিনি, লিপিকে আড়াল করল লাবনী। যা বলার বলেছে বেলা আবাসি।

ব্যথা যা ছিল মনে, সেটা হজম করছিল বাবাফেমি, কিন্তু লাবনীর শেষকথায় রক্তশূন্য, ফ্যাকাসে হলো তার চেহারা। আপনি কথা বলেছেন তার সঙ্গে? কোথায়?

নিউ ইয়র্কে, অলস সুরে বলল লাবনী। এখানে কী ঘটছে, সেটা নিয়ে অদ্ভুত এক গল্প শোনাল।

বাবাফেমির চোখে তাকাল রানা।

যা শুনলাম, মনে হয়নি মিথ্যা বলেছে সে, বলল লাবনী। আর তারপর যা ঘটেছে, সেসবও প্রমাণ হিসেবে কম নয়।

কী ঘটেছে? জানতে চাইল ম্যান মেটয।

গোলাগুলি, গাড়ির ধাওয়া-ধাওয়ি, বিস্ফোরণ ইত্যাদি ইত্যাদি, বলল রানা।

যাই বলুক, মিথ্যা বলেছে ওই মেয়ে, খুব অস্বাভাবিক দ্রুত জানাল লুকমান বাবাফেমি।

নিচের রাস্তার দিকে তাকাল রানা। মিথ্যা বলছে কি না তা সহজেই প্রমাণ করা যায়। মেট্য, ওই যে ওদিকের তাঁবুটা দেখছেন, আমরা একবার ঘুরে আসতে চাই ওটার ভেতর থেকে। হয়তো ইন্টারেস্টিং কিছু দেখবেন ওখানে।

যেমন?

যেমন, ওখানে হয়তো আছে একটা শাফট, যেটা গেছে হল অভ রেকর্ডসসের দ্বিতীয় এক দরজার কাছে, বলল রানা। হয়তো আপনার আগেই ওই কক্ষে ঢুকতে চাইছে কেউ।

পুরো একমিনিট কড়া চোখে ওকে দেখল ম্যান মেটয, তারপর বলল, একেবারে ফালতু কথা বলছেন আপনি।

কিন্তু এসব যদি সত্যি হয়? জানতে চাইল রানা।

মিথ্যা, সন্দেহ নেই, সম্বোধন পাল্টে গেল মেটযের, লাবনী কী করেছে, সবই শুনেছি আমি প্রফেসর ট্রিপের কাছে। টিভির অনুষ্ঠান বা বিজ্ঞাপন দেখে মাথা খারাপ হওয়ার দশা তার। হিংসায় জ্বলেপুড়ে পাগল হয়ে উঠেছে। ভুলে গেছে নিজের সময়ে কম করেনি। টিভিতে দেখা যায়নি। তাকে? টাইম পত্রিকার প্রচ্ছদে ছাপা হয়নি তার ছবি? বাঁকা হাসল ম্যান মেটয। এবার অন্য কারও ওপরে স্পটলাইট পড়তেই আর সহ্য হচ্ছে না তাই না?

আমাকে নিয়ে নয়, কথা হচ্ছিল আর্কিওলজিকাল ট্রের রক্ষা বিষয়ে, বলল লাবনী, আপনাকে এবং আইএইচএকে মস্তবড় অপমান থেকে রক্ষা করতে চাইছি আমরা।

বাতাসে হাতের ঝাপটা দিল মেট। বাদ দাও! কোনও কারণে আইএইচএ ছোট হয়ে থাকলে, তা হয়েছে তোমার জন্যে, লাবনী আলম! নিজেকে রক্ষা করতে মিথ্যার পর মিথ্যা বলছে বেলা আবাসি। তোমার পথেই হাঁটছে সে।

গম্ভীর হয়ে গেছে রানার মুখ। নিচু স্বরে বলল, আপনি কিন্তু বেশি বাড়াবাড়ি করছেন। ভদ্রতা বজায় রাখুন।

নইলে কী করবেন? বাঁকা হাসল ম্যান মেটয।

যে-কোনও সময়ে রানা কিছু করে বসবে, সে ভয়ে তাড়াহুড়ো করে বলল লাবনী, আমরা কিন্তু বলছি না যে আপনাকে কিছু বিশ্বাস করতে হবে। দেখুন না শুধু ওই তাঁবুর ভেতর? আমরা যদি ভুল বলে থাকি, মুখের ওপর হাসবেন। এর বেশি কিছু চাইছি না আপনার কাছে।

স্রেফ উন্মাদের পাল্লায় পড়েছি, বলল বাবাফেমি, ওদিকে কোনও শার্ট নেই। ডাকাতিও করছে না কেউ।

আপনি তাই বলছেন, কিন্তু এ কথা মিথ্যাও তো হতে পারে, বলল রানা।

রাগী চোখে ওকে দেখল মিশরীয় কর্তৃপক্ষ। আপনি কোনও কারণ ছাড়াই আমাকে অপমান করছেন!

একবার তাঁবু থেকে ঘুরে এলেই জানা যাবে, আসলে কী হচ্ছে, বলল রানা। আপনার ভয় কীসের?

সিকিউরিটি গেটের দিকে হনহন করে চলল বাবাফেমি। না ঘুরে চাপা স্বরে বলল, ডক্টর মেট্য, যার খুশি অপমান করবে, সেজন্যে এখানে অপেক্ষা করব না! আপনার সঙ্গে দেখা হবে এক্সকেভেশন সাইটে! এরা বেয়াড়াপনা করলে ঘাড় ধরে মালভূমি থেকে বের করে দেব। গেটের সামনে যেতেই হাত তুলে তাকে থামতে ইশারা করল এক গার্ড। তার জানা নেই কে এই লোক। অবশ্য, পাশের গার্ড কী যেন বলতে পিছিয়ে গেল সে।

আফসোসের ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল ম্যান মেটয। সত্যি তোমার জন্যে খারলাগছে, লাবনী। এত নিচে নেমে যাবে, ভাবতেও পারিনি। দুঃখ বোধ করব, না হাসব, জানি না!

অর্থাৎ, তুমি ওই তাঁবুর ভেতরটা দেখবে না? জানতে চাইল লাবনী। আপনি থেকে নেমে এসেছে তুমিতে।

ঘুরে রওনা হয়ে গেল ম্যান মেটয। ডক্টর বাবাফেমি, একটু অপেক্ষা করুন, আমিও আসছি!

এবার দুই গার্ড থামাল আর্কিওলজিস্টকে। আইডি দেখে তারপর পথ ছাড়ল।

এত নির্বোধ, উফ, বলল লাবনী, একবার ওখানে উঁকি দিলেই সব পরিষ্কার বুঝত!

সতর্ক করেছ, বলল রানা, একই কথা খাটে প্রফেসর ট্রিপের বিষয়ে। এরপর আমাদের কাজ হওয়া উচিত প্রমাণ করে দেয়া, ওরা ভুল করেছে।

এত বড় কাজ যারা হাতে নিয়েছে, হল অভ রেকর্ডসসের গেট মেট খোলার আগেই সরিয়ে ফেলবে সব প্রমাণ। কেউ জানবে না লুঠ হয়েছে অতিমূল্যবান কিছু। ভ্যালি টেম্পলের দিকে তাকাল লাবনী। ওদের দিকে চেয়ে হাত নাড়ছে বেলা। এবার আবার কী হলো?

কাছে যাওয়ার পর জানতে চাইল বেলা, তারপর? ম্যান মেটয তাঁবুর ভেতরে তল্লাসী করবে?

লুকমান বাবাফেমির ওপর পুরো বিশ্বাস আছে তার, বলল রানা।

ও।

ম্যান মেটয ঘৃণা করে আমাদেরকে, বলল লাবনী।

লাবনী ও রানা ব্যর্থ হবে, ভাবেনি বেলা। ফ্যাকাসে হয়ে গেল ওর মুখ। এখন? আর তো কিছুই করার নেই!

আমাদের কথা শুনবে না মেট, ডাকাতিতে জড়িত বাবাফেমি, ওদিকে ওই কম্পাউণ্ডে ঢুকতে পারব না আমরা, বলল লাবনী।

পকেট থেকে আইডি বের করল বেলা। এটা আছে আমার কাছে। গেটের গার্ডরা নতুন, বে না আমাকে। আমি হয়তো ঢুকতে পারব ওখানে।

তারপর কী করবে? জানতে চাইল লাবনী। নাদির মাকালানির লোক দেখলেই তো খুন কররে তোমাকে। যদি প্রাণে বেঁচে বেরিয়েও আসো, কোনও প্রমাণ হাতে তুলে দিলেই ম্যান মেট্যু,গ্রেফতার করাবে, রক্ষা পাবে না।

কিছুই কি করার নেই? বলল বেলা। আইএইচএ হল অভ রেকর্ডসসের গেট খুলবে মাত্র আঠারো ঘন্টা পর। অর্থাৎ, এরইমধ্যে সব সরিয়ে নেবে ডাকাতরা। যা করার করতে হবে আমাদেরই! যেভাবে হোক ঠেকাতে হবে শয়তানের দলকে!

চাই না লুঠ হোক হল অভ রেকর্ডস, বলল রানা। তবে হাতে শক্ত প্রমাণ না পেলে অনুচিত হবে মিশরীয় কর্তৃপক্ষের কাছে যাওয়া। আমাদেরকে নিয়ে হাসাহাসি করবে। জেলেও পুরে দিতে পারে।

তো হাল ছেড়ে দেব? অবিশ্বাস নিয়ে বলল বেলা। পকেট থেকে নিল একটা ম্যাগাযিনের পাতা। তাকাল লাবনীর দিকে। সবাই বলেছিল আটলান্টিস নেই। আপনি প্রমাণ করেছেন, তা আছে। আপনি আবিষ্কার করেছেন শিবের গুহা। সেই আপনি হার মেনে নেবেন?

ওই দুবার পাশে ছিল ও, বাঙালি গুপ্তচরকে দেখাল লাবনী। ও না থাকলে…

তো আপনিও হেরে যাবেন এদের কাছে? রানার দিকে ফিরল বেলা। আপনার ব্যাপারে যা শুনেছি, সব কি মিথ্যা?

থাক, আমাকে উস্কে দেয়ার জন্যে গরম-গরম বক্তৃতা দিতে হবে না তোমার, মৃদু হাসল রানা, আমরা আমাদের সাধ্য অনুযায়ী কাজে নামব।

কীভাবে? বলল লাবনী, ওই কম্পাউণ্ডে পনেরোজন আর্কিওলজিস্ট, একদল টিভি ক্রু, আর তাদেরকে পাহারা দিচ্ছে দলে দলে গার্ড! আমরা কিছুই করতে পারব না!

এরা সবাই সাইটে উপস্থিত থাকবে, এমন নয়, বলল রানা, ভোরে ব্যস্ত হবে আইএইচএর সদস্যরা। তাদের সঙ্গে যাবে টিভির ক্রুরা। কিন্তু তার আগে ঘুমিয়ে নেবে সবাই। তখন গার্ডও থাকবে কম। উঁচু দেয়াল দেখল রানা। আজও বণ্ডের দ্য স্পাই হু লাভড মি সিনেমার দৃশ্যের মত লাইট শো দেখায়?

মাথা দোলাল বেলা আবাসি।

সবার চোখ থাকবে স্ফিংসের দিকে, বলল রানা।

অবাক চোখে ওকে দেখছে লাবনী। তুমি ভাবছ…

হয়তো উপায় আছে, বলল রানা, তবে, বেলা, ধরা পড়ার ঝুঁকি নিতে হবে তোমার। রাজি আছ?

মানা করে দেয়ার জন্যে তরুণীর দিকে ফিরল লাবনী, কিন্তু আগেই বলে উঠল বেলা, অবশ্যই রাজি! কী করতে হবে?

প্রথম কাজ হবে ধরা না পড়ে ওই গেট পেরিয়ে যাওয়া, একটু দূরের গেট দেখাল রানা। কয়েক সেকেণ্ড পর দূরে তাকাল কায়রো শহরের দিকে। তবে তার আগে চাই সামান্য শপিং।

.

০৭.

 সাউণ্ড অ্যাণ্ড লাইট শো শুরু হওয়ার একটু পর আবারও কায়রো শহর ছেড়ে গিজায় ফিরল রানা, লাবনী ও বেলা।

স্পটলাইটের উজ্জ্বল আলোয় ঝিকঝিক করছে স্ফিংস, ওদিক থেকে চোখ সরিয়ে দর্শক-শ্রোতাদের দেখল রানা। কয়েক সেকেণ্ড পর ওর চোখ পড়ল পেরিমিটারের বাইরে এক দালানের ওপর। লাবনী ও বেলাকে বলল, দেখেছ, স্ফিংস সরাসরি চেয়ে আছে ওই পিযা হাটের দিকে।

ওই পিযা হাট যখন ছিল না, তখনও স্ফিংস ছিল, বলল বেলা, আঠারো শ সাতান্ন সালে একলোক পেল প্রাচীন এক স্ক্রল। ওটা অনুযায়ী খাফ্রে যখন তৈরি করেননি তাঁর পিরামিড, তখনও নাকি ছিল স্ফিংস। চোখ সূর্যোদয়ের দিকে। বাধ্য হয়েই স্ফিংস থেকে সরে পুবে তাক করা হলো পিরামিডের মুখ।

এটা নিয়ে কারও কারও আপত্তি আছে, বলল লাবনী। সবই পরিষ্কার জানা যাবে হল অভ রেকর্ডস খোলা হলে।

তৃতীয় রাজবংশের ফেরাউনরা কিন্তু হল অভ রেকর্ডস সম্পর্কে কিছুই লেখেননি, বলল বেলা, এত আগের কীর্তি, হয়তো জানতেন না এখানে আছে ওটা। খাফ্রের সময়ের চেয়েও পুরনো বলেই হয়তো এত বেখাপ্পা আকারের স্ফিংস। শরীরের সঙ্গে মানানসই নয়, যেন বসিয়ে নিয়েছে বিড়ালের মাথা।

কম্পাউণ্ডের গেট থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে ওরা।

গেটের দিকে তাকাল বেলা। ওখানে দুজন ইউনিফর্ম পরা গার্ড। আগে কখনও এদেরকে দেখিনি।

 তুমি শিয়োর তো? জানতে চাইল রানা।

এরা দেখতে ভাল, শক্তপোক্ত শরীর। আগে দেখলে ভুলতাম না।

ভেবে দেখো, ঝুঁকিটা নেবে কি না, বলল লাবনী।

আমি তৈরি, হাসল বেলা। আইডি বের করে গেটের দিকে পা বাড়িয়েও থামল। খুলে নিল শার্টের ওপরের দুটো বোতাম।

এটা করলে কেন? জানতে চাইল লাবনী।

আইডি থেকে মনোযোগ সরিয়ে নেয়ার জন্যে। টাইট ব্রা আকাশমুখী করেছে বেলার দুই বিশাল স্তনকে। ঠোঁটে ফুটে উঠল লাজুক, মিষ্টি, লোভনীয় হাসি। কোমর দোলাতে দোলাতে গেটের সামনে গিয়ে থামল ও। ওপরে তুলে ধরেছে আইডি কার্ড।

রানা ও লাবনী একটু দূর থেকে খেয়াল করল, বেলার মুখের দিকে মনোযোগ নেই দুই গার্ডের। তাদের চার চোখ চাটছে উদ্যত দুই ফরসা স্তন। কয়েক সেকেণ্ড পর খেয়াল হতে গেট খুলে দিল ডানদিকের যুবক। তাকে দারুণ এক হাসি দিয়ে কম্পাউণ্ডের অভ্যন্তরে ঢুকল বেলা।

এবার রওনা হব আমরা, রাস্তা দেখাল রানা।

ভাবাই যায় না, ভুরু কুঁচকে বলল লাবনী, বুক দেখিয়ে মন জয় করে নিল!

হিংসে লাগছে তোমার? নিরীহ সুরে বলল রানা।

না। আরও গম্ভীর হলো রূপসী লাবনী। তবে দেখেছি তুমিও ড্যাবড্যাব করে দেখছিলে। ব্রার ভেতর ওগুলো কিন্তু নকল।

নকল? সত্যি? মুচকি হাসল রানা।

হ্যাঁ! কাঠির মত সরু শরীরে মস্তবড় দুই তরমুজ ঝুলিয়ে নিলেই হলো? তবে এটাও ঠিক, ওর বাবা প্লাস্টিক সার্জন। অঙ্কটা তো বুঝতেই পারছ। তা ছাড়া, ও তোমার ছোটবোনের মত।

আমার অন্তর ভাঙার জন্যে ধন্যবাদ। লাবনীর হাত ধরে রওনা হয়ে গেল রানা।

রাস্তার যে অংশ কন্ট্রাকশন সাইটের ওপরে, ওখানে পৌঁছে গেল ওরা। নিচে চেয়ে দেখল, ওই তাবুর কাছে দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছে দুই গার্ড। আরও দুজনের দিকে মনোযোগ গেল ওদের। ওই দুই লোক বেরিয়ে এসেছে তাবু থেকে। দুজনের মাঝে বড় একটা কেস। চলে গেল একটু দূরের গেট লক্ষ্য করে।

এরই ভেতর হল অভ রেকর্ডস ফাঁকা করতে শুরু করেছে এরা! বলল লাবনী।

তোমার ধারণা, ওই বাক্সে যোডিয়াক আছে? জানতে চাইল রানা।

হয়তো। বা ওটার অংশ। সুড়ঙ্গের ভেতর দিয়ে সরাতে হলে কেটে ছোট করতে হবে। হায়, আল্লা, আমরা বোধহয় অনেক দেরি করে ফেলেছি!

তিন মিনিট পর আবার ফিরল লোক দুজন। এখন হাত খালি। আবার ঢুকল তাঁবুর ভেতর।

কাজ শেষ হয়নি ওদের, বলল রানা।

গুড, হয়তো ঠেকাতে পারব। বেলাকে দেখেছ?

ওপরের মন্দিরের এক দেয়ালের কাছে ওকে দেখল রানা। আড়াল থেকে দেখেছে বাক্স বয়ে নিয়ে গেছে দুই লোক। ওই যে, ওখানে বেলা, লাবনীকে দেখাল রানা। হাত তুলে ইশারা দিল। গোপন জায়গা থেকে বেরিয়ে কন্ট্রাকশন সাইটের দিকে চলল বেলা। এবার প্রার্থনা করো, লাবনী, আগের দুই গার্ডের মত যেন লোভী হয় এদিকের দুজন।

চামড়ার জ্যাকেট সরিয়ে শার্টের তলা থেকে বিশ ফুটি নাইলন দড়ি বের করছে রানা। ওটা আছে ওর কোমরে জড়ানো। হাতে করে আনলে সন্দেহ করত ঘুমন্ত টুরিস্ট পুলিশও। দড়ির প্যাঁচ খুলে লাবনীকে বলল রানা, রেডি হও, এবার দেখবে আমার আণ্ডারওয়্যারে কী আছে।

ভুরু কোঁচকাল লাবনী। একটা ক্রিকেট ব্যাট আর দুটো বল?

উঁহু, অন্য কিছু। আণ্ডারপ্যান্টের বিশেষ এক বাকলের তলা থেকে বেরোল লোহার হুক। মেটাল ডিটেক্টর খোঁজ পায়নি ওটার। কিছুক্ষণের মধ্যে প্রস্তুত হয়ে গেল দড়ি ও হুক। ওদিকে ওপরের মন্দির থেকে নেমে মেরামতের সাইটের দিকে চলেছে বেলা। টেনে নিয়েছে গার্ডদের দৃষ্টি।

দেয়ালের কাছে বড় এক পাথরের স্ল্যাবে দড়ি পেঁচিয়ে নিল রানা। নার্ভাস চোখে হুক দেখছে লাবনী। এই দড়ি বা হুক সত্যি ওজন নেবে তো তোমার?

তোমারও, ভয় পেয়ো না, বলল রানা।

বেলা কমলা নেটিঙের কাছে যাওয়ার আগেই ওর দিকে এগোল গার্ডরা। চট করে রানা দেখল, অন্ধকারাচ্ছন্ন রাস্তায় কেউ আসছে না। দুসেকেণ্ড পর দড়ি ফেলে দেয়াল টপকে নামতে লাগল ও। গতি বাঁদরের। ওর মুখ দেয়ালের দিকে তাক করা। পাথরে ঘষা লেগে মৃদু কর্কশ আওয়াজ তুলছে হুক। কাঁধের ওপর দিয়ে নিচে তাকাল রানা। বেলার প্রায় কাছে পৌঁছে গেছে দুই গার্ড। ওর নিজের নামতে হবে আরও দশ ফুট… আট… ছয়…

থমকে গেছে বেলা। বাধ্য করছে লোকদুজনকে এগিয়ে আসতে।

শেষ ছয় ফুট বাকি থাকতেই লাফিয়ে নামল রানা। প্রায় কোনও আওয়াজই হলো না। ব্যাঙের মত বসেই পরক্ষণে আবার উঠে দাঁড়াল, একছুটে চলে গেল হঁটের উঁচু এক পাঁজার আড়ালে। এদিকে ক্যামেরা তুলে ধরেছে বেলা। আরেক হাতের ইশারায় দেখাল স্ফিংস। লাইট শো-র বর্ণনাকারীর জোরালো কণ্ঠের নিচে চাপা পড়ল বেলার কথা। বোধহয় গার্ডদের অনুরোধ করছে, যেন তাদের কেউ ছবি তুলে দেয় পেছনের স্ফিংসের সঙ্গে ওর।

মনে হলো না রাজি হলো দুই গার্ড। বামদিকের লোকটা হাত বাড়িয়ে দিল আইডি দেখার জন্যে। নিঃশব্দে ওদিকে ছুট লাগাল রানা। ওদিকে কাঁধ ঝাঁকি দিয়ে আবারও ওর দুই টুইন-টাওয়ার দেখাল বেলা।  এবারের দুই গার্ড অনেক সতর্ক। ডানদিকের লোকটা অধৈর্য হয়ে তুড়ি বাজাল। কই আইডি?

রানা পেছন থেকে গার্ডদের দিকে ছুটে আসছে, দেখতে পেয়েছে বেলা। ব্যস্ত হয়ে পকেট খুঁজতে লাগল। দশ সেকেণ্ড পর বের করল আইডি। প্রায় ছো দিয়ে ওর হাত থেকে ওটা নিল ডানদিকের গার্ড। ফ্ল্যাশলাইটের আলো তাক করল কার্ডের ওপর।

এদিকে প্লাস্টিকের নেটিং পেরিয়ে এল রানা। খেয়াল করল, হোলস্টারের খুব কাছে লোকদুজনের ডান হাত। এখন পায়ের শব্দ পেলে, বা পেরিফেরাল ভিশনে ধরা। পড়লে…

বেলার দিকে তাকাল গার্ড। আলো ফেলল ওর মুখে। ভুরু কুঁচকে গেল লোকটার।

চিনে ফেলতে শুরু করেছে সে…

হায়, ঈশ্বর! বেসুরো চিৎকার দিল বেলা। ঘুরেই তাকান পশ্চিমে। ওই দেখুন! পিরামিড!

কী হয়েছে দেখতে চরকির মত ঘুরল দুই গার্ড। ওই একইসময়ে তাদের পেছনে পৌঁছুল রানা। গায়ের জোরে দুহাতে দুই মাথা ধরে ঠুকে দিল। আওয়াজ হলো: ঠকাস্ লতা গাছের মত মাটিতে নেতিয়ে পড়ল দুই অচেতন গার্ড।

ভয় পেয়ে এক লাফে পিছিয়ে গেছে বেলা। হায়, ঈশ্বর মেরেই ফেলেছেন?

না, মরেনি, বলল রানা। হাত লাগাও আমার সঙ্গে।

মনে হলো সিনেমার মত ঘটল সব! কাজটা করলে কীভাবে?

 সহজ কাজ, দুটো মাথা জোগাড় করো, তারপর আচ্ছামত ঠুকে দাও। অচেতন এক গার্ডের দুই বগলের ভেতর হাত ভরল রানা, তারপর টেনে নিয়ে চলল। লোকট লাশ হয়ে গেছে কি না ভেবে একবার শিউরে উঠল বেলা তারপর সাহায্য করল রানাকে। ধুলোর উঁচু এক স্কুপের ওদিকে গার্ডকে সরিয়ে নিল ওরা।

প্রথম গার্ডকে লুকাবার পর তার সঙ্গীকে নেয়ার জন ফিরল রানা। মুখ তুলে দেখল দেয়াল। খুব দ্বিধা নিয়ে দড়ি বেয়ে নামছে লাবনী। দ্বিতীয় গার্ডকে সরাবার পর রান দেখল, প্রায় মাটির কাছে নেমে এসেছে ওর বান্ধবী।

দড়ি ধরে রেখে ঘুরে লাবনী দেখল, খুব কাছেই হাজি হয়েছে রানা।

পিছনেই বেলা, অবাক হয়ে বলল, সত্যিই দেখার মত মাসের পর মাস ব্যায়াম না করা শরীর নিয়েও…

ওপর থেকে এল মৃদু মটু আওয়াজ। অতিরিক্ত ওজ নেয়ায় ভেঙে গেছে ধাতব হুক। শেষ তিন ফুট ওপর থেবে ধুপ করে বালির ওপর পড়ল লাবনী। চমকে গেছে। যাহ্!

কেউ কারও ওজন নিয়ে কথা বলবে না, মুচকি হেসে নিষেধ করে দিল রানা।

হুঁ, নিজে নেমে দুর্বল করেছ হুক, নইলে… উঠে দাঁড়িয়ে নিতম্ব থেকে বালি ঝাড়ল লাবনী।

দড়ি মুড়িয়ে নিয়ে রওনা হলো রানা। জিনিসটা লুকিয়ে ফেলবে কোথাও।

নরকের এই দুটো কীসের তৈরি? বেলার বুকে তর্জনী দিয়ে খোঁচা দিল লাবনী। আমার চোখের সামনে থেকে সরিয়ে ফেলো!

কেন, কাজ তো ভাল করে, আপত্তি আছে বলে শার্টের ওপরের দুই বোম আটকে নিল রেলা।

রানা কিন্তু বাংলাদেশ আর্মিতে ছিল, নকল জিনিস ঠিকই চিনবে। ওগুলো বেশি চোখা।

উনি আর্মিতে ছিলেন? অবাক হয়েছে বেলা। ও।

 বহুবার আমার প্রাণ বাঁচিয়েছে।

 ইয়ে… তা ওঁর কোনও ছোট ভাইটাই নেই?

নেই। তোমার কপাল মন্দ। তাঁবুর কাছে গিয়ে কান পাতল লাবনী। ওর মনে হলো না ভেতরে কেউ আছে। সরিয়ে ফেলল একদিকের ফ্ল্যাপ। বেলার কথামতই, এক পাশে কাঠ জাতীয় কিছু দিয়ে তৈরি কিউবিকল।

সত্যিই কপাল মন্দ, বিড়বিড় করল বেলা। এখন আর একটু দূরের টেবিলে কিছুই নেই। ওটার ওপর ছিল সব প্ল্যান। সরিয়ে ফেলেছে। ঘুরে তাঁবুর দরজা থেকে দূরে তাকাল বেলা। ওই যে দুই লোক বাক্স নিয়ে গেল, তাদের একজন ছিল সিকিউরিটি চিফ মাধু কামিল। ওদের কাজ হয়তো প্রায় শেষ। দেরি করে ফেলেছি আমরা।

বেলার কথাই ঠিক। মালভূমির মেঝে খুঁড়ে নিচে গেছে একটা কূপ। তলা থেকে আসছে জেনারেটরের চাপা গর্জন। এ ছাড়াও, আছে আবছা কর্কশ আওয়াজ। ড্রিল মেশিন।

ফিরে এসেছে রানা। খুলে ফেলল কিউবিকলের দরজা। পা রাখল মইয়ের ওপরের ধাপে। এবার, চলো, গিয়ে দেখি কী করে এরা।

রানাকে একবার দেখে নিয়ে পনিটেইল বাঁধল লাবনী। গুরুর চুল বাঁধা দেখে হাসছে বেলা। স্পর্শ করল নিজের পনিটেইল। রানা নামতে শুরু করার পর মই বেয়ে নামতে লাগল ওরা।

সোজা বিশ ফুট নিচে ঢালু, পাথুরে মেঝেতে শেষ হয়েছে মই। দুপাশে পাথরের দেয়াল। চারপাশ দেখে নিল রানা। এদিকে নেই কেউ। ওর পাশে পৌঁছে গেল লাবনী ও বেলা।

উত্তরদিকে বালির দেয়াল। হাজার হাজার বছর পর নতুন করে খোলা হয়েছে দক্ষিণের সুড়ঙ্গ, হারিয়ে গেছে দূরে। প্রতি পনেরো ফুট পর পর ছাতে ঝুলছে জ্বলন্ত বাবু।

বৈদ্যুতিক বাতি বা সুড়ঙ্গ গেছে সোজা স্ফিংসের দিকে। বেলা যে নক্সা দেখিয়েছিল, ওটা নিখুঁত।

হল অভ রেকর্ডসসের পুবের সুড়ঙ্গ খুঁড়ে ঢুকতে চাইছে আইএইচএ টিম। কিন্তু আগেই একদল ডাকাত খুলেছে উত্তর দিকের সুড়ঙ্গ। ওটা রাজকীয়। ওসাইরিয়ান টেম্পলের লোক ছাড়া কেউ জানে না ওটার অস্তিত্ব। ম্যান মেটয অন্য কোনও প্রবেশপথের কথা ভাবেইনি। মগজে ছিল ঠিক সময়ে খুলবে প্রাচীন সুড়ঙ্গ। টিভি ক্যামেরায় শত কোটি মানুষ দেখবে তাকে। লোকটা যে ধরনের ভুল করেছে, তাতে হয়তো মস্তবড় ক্ষতি হবে আর্কিওলজিকাল সমাজের।

রানা নাক কুঁচকে কী যেন শুঁকছে।

 ভুরু নাচাল লাবনী।

পাথর কাটছে, বলল রানা।

এবার গন্ধটা পেল লাবনী ও বেলা।

 পাথর কাটলে এমন গন্ধ হয়? জানতে চাইল লাবনী।

বাধ্য হয়ে আগে ওই কাজ করতে হয়েছে, বলল রানা।

জীবনে কী করোনি?

মৃদু হাসল রানা। রহস্যময় পুরুষ, বুঝতেই পারছ।

তাতে সন্দেহ কী!

ঈশ্বর! মনে হচ্ছে পাতালে নেমেছি। চারপাশ দেখছে বেলা। দেয়ালের বালি চিমটি দিয়ে তুলে দুআঙুলে ডলল। দেয়াল থেকে বালি সরে যাওয়ায় বেরিয়ে এসেছে লালচে পাথর। পিঙ্ক গ্র্যানেট। সম্ভবত এসেছে আসওয়ান এলাকা থেকে। রাজকীয় সুড়ঙ্গ। অন্য কারও জন্যে এত খরচ করত ফেরাউনরা।

ঠিক জিনিস চিনেছ? অনিশ্চিত সুরে বলল লাবনী।

অবশ্যই! মিশরীয় ব্যাপারে অনেক কিছুই জেনেছি দাদুর কাছ থেকে। তবে আইএইচএর অন্যদের চেয়ে কম জানি। রানার দিকে তাকাল বেলা। আমরা এবার কী করব?

পিছু নাও, বলল রানা, সতর্ক থাকবে। যে-কোনও সময়ে বিপদ আসতে পারে।

সুড়ঙ্গের তিনভাগের দুভাগ পেরোবার পর ওরা বুঝল, সামনে আছে গ্যাস চালিত জেনারেটর। ওটার একস্ট হোস পাইপ গিয়ে উঠেছে তাঁবুর ভেতর।

জেনারেটর পেরোবার সময় রানা দেখল, একসময়ে ধসে পড়েছিল সুড়ঙ্গ। পরে কাঠের বিম দিয়ে আটকে রাখা হয়েছে ছাত। যে-কোনও সময়ে আবারও নেমে আসতে পারে।

ধস নেমেছিল, বলল রানা। সাবধানে জায়গাটা পেরিয়ে গেল ওরা।

পেছনে আবারও ছাত ধসে যেতে পারে, ভয় পেয়ে বলল লাবনী।

মনে হয় না, দ্বিমত পোষণ করল রানা। নতুন করে ছাত মেরামত করেই কাজ ধরেছে এরা। অন্তত কয়েক সপ্তাহ ধরে চলছে খোঁড়াখুঁড়ি।…কী করছ, বেলা?

চোখের সামনে ক্যামেরা তুলে বাটন টিপল মেয়েটা। প্রমাণ সংগ্রহ করছি।

ফ্ল্যাশ ব্যবহার করবে না! আলো দেখবে কেউ!

জানি, বস! ভিডিয়ো রেকর্ড করছি। খুদে যন্ত্রটার কন্ট্রোল নাড়াচাড়া করছে বেলা। ফিল্ম নিল ছাতের। এগোতে শুরু করেছে রানা ও লাবনী। আরে, একমিনিট!

কয়েক মিনিট হাঁটার পর সুড়ঙ্গের শেষমাথায় পৌঁছে গেল ওরা। সামনে চেম্বারের প্রবেশপথে বালিমাখা, কারুকাজ করা কয়েকটা পুরু পিলার। অনেক জোরালো শোনাল পাথর কাটা ড্রিল মেশিনের গর্জন।

ঘরের ভেতরে উঁকি দিল রানা। এখন আর ওদিকে জ্বলছে না সাধারণ বাল। জায়গায় জায়গায় হেভি-ডিউটি ট্রাইপড থেকে সূর্যের মত অত্যুজ্জ্বল আলো দিচ্ছে রাশি রাশি বাতি। সব আলো গিয়ে পড়ছে পশ্চিমের বড় এক আয়তক্ষেত্রাকার ঘরে। তবে ওখানে কেউ নেই। পশ্চিম দেয়ালের দরজার ওদিক থেকে এল পাথর কাটার আওয়াজ। ওদিকেও উজ্জ্বল আলোর বন্যা। চেম্বারে ঢুকে হাতের ইশারা করল রানা।

ওর পিছু নিল লাবনী ও বেলা।

সর্বনাশ, রানা, এসব কী দেখছি! চাপা স্বরে বলল লাবনী।

বেলা হতবাক।

মস্তবড় ঘরের একমাথা থেকে আরেক মাথা দুসারি পুরু, বৃত্তাকার পিলার। প্রতিটার গায়ে অসংখ্য হায়ারোগ্লিফ। দেয়ালেও একই জিনিস। নানান খোপে শুকনো মাটির বাক্স, ভেতরে সংগ্রহ করা হয়েছে প্যাপিরাস স্ক্রল।

এটাই হল অভ রেকর্ডস!

 মাত্র কদিন আগেও সবাই বলত, পৌরাণিক কাহিনী ওটা। আজ হয়ে উঠেছে জীবন্ত বাস্তব।

অবাক চোখে রানাকে দেখল লাবনী। গা শিরশির করছে ওর। কী কপাল, হাজার হাজার বছর পর যারা প্রবেশ করল হল অভ রেকর্ডসসের কক্ষে, তাদের ভেতর একজন ও নিজে!

প্রাচীন সব নিদর্শনের মাঝে দেখা যাচ্ছে আধুনিক মানুষের তৈরি যন্ত্রপাতি। হুইলওয়ালা এক জ্যাকের ওপরে মস্তবড় এক পাথরের চাই। ওটা দিয়েই বন্ধ ছিল হল অভ রেকর্ডস। ডাকাতি শেষ হলে ওই পাথরের চাই আবারও ঠিক জায়গায় রাখবে ডাকাতের দল।

ধুলোভরা মেঝেতে বেশ কজনের নানান আকতির বুটের ছাপ। প্রবেশপথের পাশে ওয়ার্কবেঞ্চে একটা পোশাক দেখে লাবনীকে নিচু স্বরে বলল রানা, লাবনী, ওটা চিনতে পেরেছ?

মাথা দোলাল লাবনী। হু। সাপের চামড়ার জ্যাকেট।

চেম্বারের পুবে গেল রানার চোখ। আরেকটা দেয়ালের পাশে আরও কিছু পিলার। ওদিকে দ্বিতীয় এন্ট্রান্স। ওই পথে ঢুকবে আইএইচএর ম্যান মেটয এবং তার সহকারীরা।

কক্ষের আরেক পাশে চলে গেছে বেলা।

ওখানে রয়েছে ধুপ-ধুপ শব্দ তোলা কমপ্রেসর এবং একটি ইলেকট্রিকাল জাংশান বক্স। খাটো প্যাসেজ পেরিয়ে পরের কক্ষে গেছে পাওয়ার কেবল ও হোস। বেলা প্যাসেজে পা রাখতেই হাতের ইশারায় ওকে ফিরতে বলল রানা। নিজে চলে গেল রাজকীয় প্রবেশপথের ঠিক উল্টোদিকে।

পিছু নিয়েছে লাবনী। ওরা দেখল এপাশের এন্ট্রান্সের কাছে পায়ের জুতোর কোনও দাগ নেই। আলো নেই কাছের চেম্বারে। হল অভ রেকর্ডসসের আর সব জায়গা বাদ দিয়ে বিশেষ একটি অংশে মনোযোগ দিয়েছে লুঠেরার দল।

এদিকের ঘর ঘুরে গিয়ে মিশেছে ড্রিলের ঘরে, ওদিকে আবছা আলো দেখছি, বলল রানা। হাতে বেরিয়ে এসেছে ছোট পেনলাইট। সরু আলোয় দেখল, ওরা যে কক্ষে দাঁড়িয়ে আছে, তার চেয়ে অপেক্ষাকৃত সামনের কক্ষ ছোট। দেয়ালের অসংখ্য খুপরিতে মাটির বাক্স। রাখা হয়েছে প্রাচীন আমলের জ্ঞান-বিজ্ঞান বিষয়ক স্ক্রল। মহাকালের আগ্রাসনে ক্ষতি হলেও ধসে পড়েনি কক্ষ। অবশ্য, ভূমিকম্পে ভেঙে গেছে একটা পিলারের একাংশ। মেঝেতে পড়ে আছে বড় কয়েক টুকরো পাথর।

ঘুরে ট্রাইপড দেখল রানা। পাশেই ওপরে উঠেছে চওড়া ধাপের সিঁড়ি। রানার দিকে তাকাল লাবনী। আমরা চাইলে ঢুকতে পারব স্ফিংসের দেহে।

আসলে ওটার বুকে, জানাল রানা।

ড্রিল মেশিনের কর্কশ শব্দের ওপর দিয়ে শুনল ওরা মানুষের কণ্ঠ।

যাবে, রানা? বলল লাবনী। খুব কৌতূহল হচ্ছে।

দেখে ফেললে কিন্তু বিপদ হবে।

ওদিকে আলো বেশি, এদিকে কম, দেখবে না।

মৃদু মাথা দোলাল রানা।

বেলা আছে সিঁড়ির একদিকে কক্ষের কাছে। আলো বেশি ওখানে।

সিঁড়ি বেয়ে উঠল রানা ও লাবনী। তবে পাঁচ ধাপ সিঁড়ি থাকতেই লাবনীর হাত ধরল রানা। থেমে গেল ওরা। ওপরের কক্ষ ভালভাবেই দেখছে। দুজনেরই বুকে বইতে শুরু করেছে অ্যাড্রেনালিনের স্রোত। রানা টের পেল, দাঁড়িয়ে গেছে ওর ঘাড়ের খাটো রোম।

ওপরের কক্ষে কজন লোক। সাপের চামড়ার জ্যাকেট না থাকলেও তাদের মধ্যে একজনকে পরিষ্কার চিনল ওরা। এর নাম বলেছিল বেলা আবাসি: ভগলার। একটু দূরে দাঁড়িয়ে কাকে যেন নির্দেশ দিচ্ছে লুকমান বাবাফেমি। রানা ও লাবনী দেখল কীসের জন্যে এত ব্যস্ত এরা।

ওটা আছে ছাতে।

যোডিয়াক।

নক্ষত্রের মানচিত্র।

ব্যাসে ছয় ফুট।

পাথরে খোদাই নক্ষত্রগুলোর নাম প্রাচীন ইজিপশিয়ান দেবতাদের নামে উৎসর্গ করা।

লাবনী চেনে। দুএকটার নাম মনে পড়ল রানারও। প্যারিসে লুত্র জাদুঘরে এমনই একটা যোডিয়াক দেখেছে ও। তবে এটা আজও রঙিন। নেই যোডিয়াকের সম্পূর্ণ অংশ। ছাতে রয়ে গেছে গোটা জিনিসটার শুধু দক্ষিণ প্রান্তের ত্রিকোণ একাংশ। বৃত্তাকার যোডিয়াকটা যেখান থেকে নামিয়েছে, তার আশপাশে রুক্ষ-এবড়োখেবড়ো পাথর। ছাত থেকে নক্ষত্রের মানচিত্র সরাতে গিয়েই এই ক্ষতি। গগলস, ফেস মাস্ক ও ইয়ার প্রোটেক্টর পরে বৃত্তাকার এক করাত হাতে শেষাংশ কাটছে এক লোক।

ছাতের কাছে কাজ করছে মুখোশ পরা আরেকজন। তার হাতে অনেক কম আধুনিক যন্ত্রপাতি একটা হাতুড়ি ও বাটালি। দেখেই রানা বুঝল, কী করছে ওই লোক। করাতের তৈরি খোঁচা-খোঁচা পাথর হেঁটে ফেলছে সে। প্রমাণ থাকবে না ওখানে কোনও যোডিয়াক ছিল। আশপাশের দেয়ালের মতই হবে লাইমস্টোনের ছাত, হল অভ রেকর্ডসসের হাজারো সম্পদের ভেতর কেউ খেয়াল করবে না সামান্য রংচটা ছাত।

লাবনীর দিকে তাকাল রানা।

ঘৃণা নিয়ে লোকগুলোকে দেখছে লাবনী।

এবার দেখা গেল কার সঙ্গে কথা বলছে বাবাফেমি।

নাদির মাকালানি। কপাল থেকে শুরু করে ঠোঁট পর্যন্ত ভয়ঙ্কর ক্ষতচিহ্ন। একসময়ে সহ্য করেছে প্রচণ্ড ব্যথা।

রানা বুঝল, যত ব্যথাই পেয়ে থাকুক ওই লোক, পৃথিবীর সেরা আর্কিওলজিকাল সম্পদ চুরি করছে সে। সেজন্যে তাকে কখনও অন্তর থেকে ক্ষমা করা যায় না।

বৃত্তাকার করাত থেমে যেতে বন্ধ হলো কর্কশ আওয়াজ। করাতওয়ালা ইশারা করল তৃতীয় একজনকে। এরই নাম মাধু কামিল। তাঁবু থেকে নিয়ে গেছে কেস বা বাক্স। ভেতরে ছিল যযাডিয়াকের টুকরো। খাড়া শাফটের কারণে আস্ত জিনিসটা ওপরে তুলতে পারবে না, তাই কেটে নিয়েছে নক্ষত্রের মানচিত্র, পরে সময়মত জুড়ে নেবে নতুন করে।

এখনও হয়তো ওটা আগের জায়গায় ফিরিয়ে দেয়া সম্ভব, ভাবছে রানা। চলো, বেরিয়ে যাই, লাবনীকে বলল ও।

পেছনে এসে থেমেছে বেলা আবাসি।

রানার কথা যেন শুনতেই পায়নি লাবনী, প্রায় ফিসফিস করে বেলাকে বলল, তোমার ক্যামেরাটা দাও। জিনিসটা হাতে পেয়ে জানতে চাইল, রেকর্ড করে কীভাবে?

লাবনী, কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে, জরুরি সুরে বলল রানা। হাতে বেশি সময় পাব না।

একটু পর যাচ্ছি? অনুরোধের কণ্ঠে বলল লাবনী। আগে হাতে প্রমাণ পেয়ে নিই।

কাঁধ ঝাঁকাল রানা। খুব বেশি ঝুঁকি হয়ে যাচ্ছে।

বেলা, রেকর্ড করব কী ভাবে?

বাটন টিপে দেবেন, তারপর থামাতে চাইলে আবারও টিপ দেবেন বাটনটা, বলল বেলা।

ঠিক আছে। বাতির স্ট্যাণ্ডের পাশে দাঁড়িয়ে রেকর্ডিং শুরু করল লাবনী। ইমেজ দেখছে এলসিডি স্ক্রিনে।

আরও সতর্ক হয়ে উঠল রানা। ভাল লাগছে না ওর এই ঝুঁকি নেয়া।

নাদির মাকালানি ও বাবাফেমি আবারও ঘুরে দেখছে যোডিয়াক। ক্যামেরায় ধরা পড়বে শুধু তাদের পিঠ।

বদমাশের বাচ্চারা, ঘুরে দাঁড়া, ফিসফিস করল লাবনী। একবার এদের চেহারা ক্যামেরায় পেলেই বেরিয়ে যাবে এখান থেকে। বেশিক্ষণ লাগবে না টুরিস্ট পুলিশের কাছে যেতে। এরপর শয়তানের দল যাবে জেলে। বাকি জীবন বেরোতে হবে না ওখান থেকে।

কথা বলছে নাদির মাকালানি আর বাবাফেমি।

কান পেতে শুনতে চাইল রানা।

আরবি ভাষা। যোডিয়াক নিয়ে চলছে আলাপ, কিন্তু স্পষ্ট কিছুই শুনতে পেল না ও।

একটু পর সরিয়ে নেয়া হবে যোডিয়াকের শেষাংশ।

যোডিয়াকটার নিচে একটা ইকুইপমেন্ট নিল মাধু কামিল। নিউমেটিক জ্যাকের ওপরে প্যাড দেয়া সাপোর্ট ফ্রেম। চালু করল কন্ট্রোল, যন্ত্র থেকে এল কমপ্রেস করা বাতাস। বদ্ধ ঘরে শুরু হলো তীব্র হিসহিস আওয়াজ। ওপরে উঠছে জ্যাক। দুকানে হাত রেখে পিছিয়ে ক্যামেরার ফ্রেম থেকে বেরিয়ে গেল লুকমান বাবাফেমি।

ছাতে চোখ রেখেছে নাদির মাকালানি।

উঠে জ্যাকের ফ্রেমের প্যাড চেপে ধরছে যোডিয়াকের অংশটা। একটু পর প্রাচীন শিল্পের ওপর ভালভাবে এঁটে বসল স্পঞ্জ। থেমে গেল জ্যাকের হিসহিস।

নতুন করে শুরু হলো বৃত্তাকার করাতের কান ফাটিয়ে দেয়া আওয়াজ। পাথর কাটছে মুখোশ পরা লোকটা। প্যাড দিয়ে চেপে রাখা হয়েছে, মেঝেতে পড়বে না যোডিয়াকের শেষাংশ। অনায়াসেই কাটা হচ্ছে ওটাকে।

চিৎকার করে নাদিরকে কী যেন বলল কিলিয়ান ভগলার। দুজনই সরে গেল আড়ালে।

বিড়বিড় করে অভিশাপ দিল লাবনী। ক্যামেরায় তুলছে যোডিয়াকের টুকরোর ছবি। পরে দেখাবে কোথা থেকে চুরি হয়েছে জিনিসটা। নির্বোধ না হলে সবই বুঝবে মিশরীয় কর্তৃপক্ষ।

হঠাৎ লাবনীর হাত ধরে সিঁড়ি বেয়ে নেমে যেতে লাগল রানা। আরেক হাতে ইশারা করেছে বেলাকে।

আরে, কী হলো? তাড়া খেয়ে জানতে চাইল লাবনী।

বিশেষ একজন আসছে, লাবনীকে দুধাপ করে নামতে বাধ্য করছে রানা। মেয়েরা ভয় পাবে তাই বলেনি, ওই লোক ককেশিয়ান, হাতির মত শক্তিশালী, পেশিবহুল; তার চেয়েও খারাপ দিক: হাতে মারাত্মক এক চেইন সও। জঙ্গল সাফ করতে আসেনি। পাথর কাটতে ওই জিনিসের তুলনা নেই।

নিচের কক্ষের মেঝেতে নেমেই দৌড় দিল রানা, একহাতে লাবনীর হাত, অন্যহাতে বেলার কনুই।

লুকিয়ে পড়ল ওরা একটু দূরের অন্ধকার চেম্বারের কাছে।

সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল শ্বেতাঙ্গ। গুটিয়ে নিচ্ছে পাওয়ার কেবল। চলল কক্ষের প্রবেশদ্বারের দিকে।

সব গুছিয়ে সরে পড়বে, নিচু গলায় বলল রানা, আমাদেরও কেটে পড়া উচিত।

বাটন টিপে রেকর্ডিং বন্ধ করেছে লাবনী।

রানার পিছু নিয়ে অন্ধকারে দুটো কক্ষ পেরোল মেয়েরা। অবশ্য, থামল ওরা প্রথম ঘরের প্রবেশপথের অনেক আগে।

সর্বনাশ! কী করে লোকটা! বিড়বিড় করল লাবনী।

মস্তবড় পাথরের চাঁই ধরে রাখা জ্যাক দেখছে শ্বেতাঙ্গ লোকটা।

এক দৌড়ে হরিণের বেগে বেরিয়ে যাব, অনুমতি নেয়ার সুরে রানাকে বলল বেলা।

কিন্তু ওর কাছে আগ্নেয়াস্ত্র থাকতে পারে, মাথা নাড়ল রানা। সরু সুড়ঙ্গে ফুটো হবে পিঠ। বেরোতে হবে সবার অগোচরে।

আজ রানার ওপর অপ্রসন্ন ভাগ্যদেবী।

হেলতে দুলতে এন্ট্রান্স চেম্বারে ঢুকল কিলিয়ান ভগলার। দাড়ি থেকে ঝাড়ছে ধুলো। থেমে গেল বৃত্তাকার করাতের হুঙ্কার। শুরু হলো সাপের ফোঁস-ফোঁস। নামিয়ে নেয়া হচ্ছে জ্যাক।

কয়েক মিনিট পর আরেকটা কেস নামিয়ে আনল দুই লোক। তাদের পেছনেই আছে নাদির মাকালানি ও লুকমান বাবাফেমি।

জরুরি আর কিছু নেই তো? জানতে চাইল ভগলার, …এবার?

সব আগের মত রেখে বেরোতে হবে হল অভ রেকর্ডস থেকে, দামি রিস্টওয়াচ দেখল নাদির মাকালানি। হাতের ইশারায় দেখাল পুবের এন্ট্রান্স। মোটামুটি সোয়া পাঁচ ঘণ্টা পর ওই দরজা খুলবে আইএইচএ টিম। তার আগেই গুছিয়ে নিয়ে বেরিয়ে যাব। …কতক্ষণ লাগবে রয়েল এন্ট্রান্স বুজে দিতে?

জ্যাক থেকে চোখ তুলল ধূসর চুলের হাতি। শুধু পাথরের ব্লক ঠিক জায়গায় রাখতে লাগবে পুরো একঘণ্টা।

তার উচ্চারণ থেকে রানা বুঝল, সে ডাচ।

একটা পায়ের ছাপও যেন না থাকে, নার্ভাস সুরে বলল বাবাফেমি। ধুলো ভরা মেঝেতে দেখছে অসংখ্য পদচিহ্ন।

এটা সমস্যা নয়, কমপ্রেসরের পাশে রাখা কয়েকটা গ্যাস সিলিণ্ডার দেখাল নাদির মাকালানি, কমপ্রেসড় এয়ার পরিষ্কার করবে মেঝে। আইএইচএ যখন ভেতরে ঢুকবে, ততক্ষণে থিতিয়ে যাবে, ধুলো। মাধু কামিলের পাশের লোকটার উদ্দেশে মাথা দোলাল সে। আম্মু তালাত, কাজ শুরু করো।

রেডি হও, চাপা স্বরে লাবনী ও বেলাকে বলল রানা। এরা ওপরে জিনিসপত্র গোছাতে গেলেই বেরিয়ে যাব।

কয়েক সেকেন্ড পর কাজ ধরল আবু তালাত। কমপ্রেস বাতাস মেরে উধাও করছে পদচিহ্ন। লালচে মেঘের মত ধুলো উড়ছে বলে দেরি না করে সরে গেল অন্যরা।

ধুলোর মাঝ দিয়ে পালিয়ে যাব? জানতে চাইল লাবনী।

আপাতত সম্ভব নয়, বলল রানা; দরজার পাশেই গণ্ডার। ভারী জ্যাক দেখছে ডাচ লোকটা। তবে এ সরে গেলেই…

হঠাৎ কাজ থামিয়ে দিল আবু। অবাক চোখে দেখছে এন্ট্রান্সের কাছের মেঝে।

লোকটা কেন এত চিন্তিত, বুঝে গেল রানা।

ওদের জুতোর ছাপ দেখেছে সে!

পেছাতে শুরু করো, পেছাও, চাপা স্বরে বলল রানা।

নতুন চিহ্ন অনুসরণ করে এন্ট্রান্সের সামনে থামল আবু। ওখান থেকে চোখ বোলাল ছায়ার ভেতর।

ভাঙা এক পিলারের পেছনে লুকিয়ে পড়ল রানা ও লাবনী। ভাঙা পাথরের ছোট এক স্কুপের আড়ালে সরে গেছে বেলা। এক সেকেণ্ড পর ওটার ওপর দিয়ে গেল আবু তালাতের ফ্ল্যাশলাইটের জোরালো আলো। মেঝেতে পড়ল বৃত্তাকার রশ্মি। চুপ করে কী যেন দেখছে লোকটা। তারপর নির্দিষ্ট দুসারি ছাপ অনুসরণ করল সে।

বেলা যেখানে লুকিয়ে পড়েছে, সোজা ওই ভাঙা পাথরের স্কুপের ওপর স্থির হলো আলো।

ভয় পেয়ে সামান্য পিছিয়ে কুঁকড়ে গেছে বেলা। কিন্তু ওর সোলের নিচে পড়েছে মাটির ভাঙা বাক্সের ছোট এক টুকরো। থমথমে পরিবেশে পরিষ্কার শোনা গেল মুড়মুড়-কটাং শব্দ।

চমকে গেছে তালাত। মেঝেতে এয়ার সিলিণ্ডার নামিয়ে রেখে কোমর থেকে বের করল রুপালি রঙের চকচকে এক ধারালো ছোরা। ঠোঁটে ঝুলছে ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুর হাসি।

পাথরের মূর্তি হয়ে গেছে বেলা।

 ওর দিকে এগিয়ে এল পায়ের আওয়াজ।

কী করবে ভাবছে বেলা, এমনসময় এক লাফে স্কুপের এদিকে হাজির হলো আবু তালাত। ঝট করে মাথার ওপর তুলল ছোরা, এবার নামিয়ে আনবে…

খটাং!

আবু তালাতের মাথায় নামল পাঁচ হাজার বছর আগের মাটির পুরু এক পোক্ত ঘটি!

এতই জোরে মেরেছে, ঝনঝন করে উঠেছে রানার কবজি। বিস্ফোরিত হয়েছে ঘটি।

চোখে হাজারো রঙিন নক্ষত্র দেখছে আবু। কাত হয়ে ধরাশায়ী হলো মেঝেতে। তখনই ঘাড়ে নামল রানার বেদম এক লাথি।

ঠুং! শব্দে মাথা ঠুকে গেল তালাতের। জিভ কেটে দরদর করে বেরোল রক্ত। আর নড়ছে না লোকটা।

সোজা হয়েই রানা শুনল, কড়া সুরে এন্ট্রান্স চেম্বারে বলে উঠেছে নাদির মাকালানিঃ আবু তালাত! তালাত! তালাত?

জবাব নেই।

দূরের দরজা দিয়ে দেখল রানা, ডাচ লোকটার দিকে ইশারা করল নাদির মাকালানি। ব্যাপারটা বুঝে এসো, লা ভার্নে।

একটা পিকঅ্যাক্স তুলে বীরযোদ্ধার ভঙ্গিতে তদন্তে নামল ডাচ গণ্ডার।

এসো! লাবনী ও বেলাকে তাড়া দিল রানা। একটু দূরের দরজা লক্ষ্য করে ছুটল ওরা।

এদিকের ঘরে ঢুকেই আবু তালাতের জ্বলন্ত ফ্ল্যাশলাইট চোখে পড়েছে লা ভার্নের। একটু দূরে অচেতন মিশরীয়। ঘুরেই আবছা আলোয় কয়েকটা ছায়ামূর্তিকে পালাতে দেখেছে। সে। আরে! অ্যাই, তোমরা কারা!

বাপু, আমরা কেউ না, মনে মনে বলল রানা। লাবনী ও বেলাকে নিয়ে ঢুকে পড়েছে পরের অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘরে। নিভিয়ে দেয়া হয়েছে সিঁড়ির পাশে লাইটের স্ট্যাণ্ডের সব বাতি। ঝড়ের বেগে ওটা পাশ কাটাল ওরা। তার ফাঁকে সিঁড়ির দিকটা দেখল রানা। এখন বোধহয় যোডিয়াকের চেম্বারে কেউ নেই। কিন্তু ওদিক দিয়ে বেরোতে পারবে না কেউ।

প্রাণপণে দৌড়ে চলেছে ওরা। ঢুকল শেষ ঘরে। চারটে পিলারের মাঝে খুপরির ভেতর দেখা গেল রেকর্ড করার মাটির সব ছোট বাক্স। পাশেই জ্বলন্ত বাতির স্ট্যাণ্ড। পুবের দেয়ালে দরজা দেখে ওদিকে ঢুকল ওরা। আবারও ফিরে এসেছে এন্ট্রান্স চেম্বারে।

তাতে মোটেও কাটল না বিপদ। হাতুড়ি হাতে ছুটে এল সিকিউরিটি চিফ মাধু কামিল। ভয় পেয়ে পেছাতে গিয়ে আরেকটু হলে রানার ভারসাম্য নষ্ট করে দিত লাবনী। ফুঁপিয়ে উঠল, সামনের পথ বন্ধ!

এদিকটাও! ফুঁপিয়ে উঠল বেলা। পেছন থেকে তেড়ে আসছে ডাচ গণ্ডার।

ওপরে ওঠো! তাড়া দিল রানা। একেকবারে তিনটে করে ধাপ ভেঙে সিঁড়ি বেয়ে উঠছে।

ওর পিছু নিল লাবনী ও বেলা।

একইসময়ে সিঁড়ির গোড়ায় পৌঁছল ভার্নে ও কামিল। কয়েকটা করে ধাপ টপকাতে লাগল তারা। বুঝে গেছে, কোণঠাসা হয়েছে ওদের অসহায় তিন শিকার!

খুশিতে বাচ্চা ছাগলের মত লাফ দিতে দিতে ওপরে উঠছিল তারা, কিন্তু হঠাৎ করে ঘুরেই তিনগুণ বেগে নেমে যেতে লাগল।

পেছনে সিঁড়ির ওপরে হাজির হয়েছে সাক্ষাৎ মৃত্যুদূত!

রানার দুহাতে প্রচণ্ড বেগে ঘুরন্ত, বৃত্তাকার করাত! খ্যার খ্যার শব্দ তুলছে ওটা! কই, কী হলো, ধাওয়া করবি না? জানতে চাইল রানা। পলায়নরত দুই শত্রুকে তাড়িয়ে নিয়ে নেমে এল ঘরের মেঝেতে। আয়, কে নেবে মামাবাড়ির মোয়া?

শখ মিটে গেছে মাধু কামিলের, মাথার ওপরে হাতুড়ি ধরে রেখে তুমুল একদৌড়ে এন্ট্রান্স চেম্বারে ফিরল সে। কিন্তু রানাকে মোকাবিলা করতে ঘুরে দাঁড়াল লা ভার্নে। হাতে পিকঅ্যাক্স। রানার কবজির ওপরে ওটা নামাতে চাইল সে। ছুটিয়ে দেবে করাত। লাফিয়ে পিছিয়ে গেল রানা। এক সেকেণ্ড পর সই করে ওর মাথা লক্ষ্য করে এল লা ভার্নের চোখা পিকঅ্যাক্স।

একপাশে সরে প্রাণ বাঁচাল রানা। হাতের ঘুরন্ত স্টিলের ব্লেড বেকায়দা করেছে ভারী করাতটাকে। ভারসাম্য রক্ষা করা কঠিন। তার ওপর দুপায়ের মাঝে এদিক ওদিক সরছে পাওয়ার কেবল। ওটা টেনে এগোল রানা, চোখ ডাচ শত্রুর ওপর। কুস্তিগীরের মত ঘুরছে একে অপরের দিকে তাকিয়ে। বুঝে গেছে রানা, বাঁচতে হলে চট করে সরে যেতে হবে।

লাফিয়ে সামনে বাড়ল ভানে।

চোখা লোহার দণ্ড থেকে বাঁচতে কোমর মুচড়ে সরল রানা। একইসময়ে ওপরে তুলেছে করাত। মুহূর্তের জন্যে আওয়াজ হলো: স্ক্রিযযট!

করাতের দাঁত কেটে দিয়েছে পিকঅ্যাক্সের হ্যাণ্ডেল।

 লোহার দণ্ড ছিটকে গিয়ে পড়ল ঘরের দূরে।

নিজের ওপর বিরক্ত রানা। করাত তাক করেছিল ভার্নের কবজি লক্ষ্য করে।

অবশ্য, যা চেয়েছে, তাই হলো– কাটা হ্যাণ্ডেল হাত থেকে ফেলে পিছিয়ে গেল ডাচ। ঘুরেই দৌড়ে গিয়ে ঢুকল এন্ট্রান্স চেম্বারে।

কাঁধের ওপর দিয়ে পেছনে তাকাল রানা। ঘুরন্ত করাতের ঘুস-ঘুস-খ্যার-খ্যার শব্দ ছাপিয়ে বলল, দৌড়ের জন্যে তৈরি হও! …এহহে!

কী হলো? জানতে চাইল লাবনী।

রানাকে কিছুই বলতে হলো না, নিজেই দেখল ওরা।

ওদিকের ঘরে ওয়ার্কবেঞ্চ থেকে সাপের চামড়ার জ্যাকেট তুলে নিয়েছে ভগলার। পরের সেকেণ্ডে তার হাতে দেখা গেল রিভলভার। তার চেয়েও খারাপ কিছু আছে। বিপদ ডেকে আনছে মাধু কামিল। ভার্নেকে পাশ কাটিয়ে ছুটে আসছে সে, হাতে চেইন সও!

.

০৮.

 মাধু কামিল ঘরে ঢুকতেই পিছিয়ে গেছে রানা, ঝুলছে ওর অস্ত্রের কে। বৃত্তাকার করাতের চেয়ে অনেক হালকা ও ছোট চেইন সও- ওটার ফলা দীর্ঘ!

লাবনী ও বেলা আলাদা হয়ে গেছে, টের পেল রানা। ঘরগুলোর মাঝ দিয়ে অন্যদিকে যাও! সিঁড়ির কাছে ঘরের দরজার কাছে লাবনী, ওদিকে রিভলভারের ভয়ে দৌড়াতে শুরু করে ঘরের মাঝে পৌঁছে পাথুরে মূর্তি হয়েছে বেলা। পরে টের পেয়েছে বিপদ। এখন পেছনে লাবনী, মাঝে রানা, ওদিকে বেলা। রানার দিকে এগোচ্ছে মাধু কামিল।

সরাসরি রানার পেট লক্ষ্য করে চেইন সওর ফলা চালাল লোকটা। ভারী অস্ত্র ধীর করেছে রানার নড়াচড়া। বৃত্তাকার করাত নিচে নামিয়ে নিজেকে বাঁচাতে চাইল রানা।

কর্কশ কড়াং! শব্দে লাগল দুই অস্ত্রের ইস্পাত। চেইন সওর ধারালো ফলায় বৃত্তাকার করাতের দাঁত বসতেই প্রচণ্ড এক ঝটকা খেল রানার হাত। গোল করাত কাত হয়ে নেমে এল ওর পায়ের কাছে। যে-কোনও সময়ে পঙ্গু হবে রানা।

এদিকে ওর পেট লক্ষ্য করে আবারও চেইন সও চালাল কামিল। আহত রয়েল বেঙ্গল টাইগারের মত হুঙ্কার ছেড়ে ভারী করাত ওপরে তুলল রানা। প্রচণ্ড শব্দে আবারও ঘষা খেল দুই ইস্পাতের ফলা। এবার এত জোরে লেগেছে, তাল হারিয়ে হুমড়ি খেল রানা। পায়ে লাগল জ্যাকের এয়ার হোস, কিন্তু পড়তে পড়তেও একেবারে শেষ সময়ে সামলে নিল ও।

বিজয়ীর হাসিমুখে সামনে বাড়ছে মাধু কামিল।

এই কক্ষে আবার এসে ঢুকেছে ভার্নে। দেখে ফেলল বেলাকে। ঘরের কোণে হাতদুটো ওপরে তুলে বিড়বিড় করছে বেচারি: ইয়ে… মাফ করে দিন! কুঁকড়ে গেছে ভয়ে।

বেলার কাছে যাওয়ার জন্যে পা বাড়িয়েও থেমে গেল লাবনী। এ ঘরের দিকে ছুটে আসছে কিলিয়ান ভগলার, হাতে উদ্যত রিভলভার! পিছিয়ে গিয়ে সিঁড়ির নিচের ধাপে পা বেধে আছাড় খেল লাবনী। ওর মাথা থেকে একটু দূরে মাটির তৈরি এক স্কুলের বাক্সে বিঁধল ভগলারের বুলেট।

পিছিয়ে এক বাতির স্ট্যাণ্ডের কাছে চলে গেছে বেলা। খুব কাছেই পৌঁছে গেছে ডাচ গণ্ডার। মাঝপথে বাধা দেয়ার জন্যে এগোল রানা। কিন্তু ও যদি হামলা করে ভার্নেকে, ওকে অনায়াসেই চেইন সও দিয়ে গেঁথে ফেলবে কামিল।

রানার চোখ গেল জ্যাকের হোসের ওপর। ভার্নের দিকে তাক না করে করাত ঘুরিয়ে চালাল হোসের বুকে। ফুস শব্দে কেটে গেল এয়ার লাইন। করাতের ফলা লাগতে বিকট খড় খড় আওয়াজ হলো পাথরে। তবে ওই আওয়াজ কিছুই না কমপ্রেস করা বাতাসের প্রচণ্ড হিসহিসের কাছে। কাটা পড়তেই পাগলা সাপ হয়ে উঠল হোস লাইন। নানানদিকে ছুটল ওটা।

হোস লাইনের ডগা ছিটকে লাগল ভার্নের চোয়ালে। গভীরভাবে কেটে দিল গাল। লোকটা সরার আগেই চোখে ঢুকল বালিভরা তীব্রগতি বাতাস। করুণ এক আর্তনাদ ছেড়ে টলতে টলতে পিছিয়ে গেল সে। আপাতত অন্ধ। ভুলে গেছে বেলার কথা। ঠাস করে মাথা লাগল একটা পিলারে। হুমড়ি খেয়ে মেঝেতে পড়ল সে। গোঙাতে শুরু করেছে আহত পশুর মত।

শয়তানের কাটা লেজের মত নানাদিকে নাচছে সাপ সদৃশ হোস। ভয় পেয়ে পিছিয়ে গেছে মাধু কামিল। বুঝে গেল, চাইলেও হামলা করতে পারবে না। গলা ফাটাল সে, বন্ধ করো কমপ্রেসর!

ওদিকে যাও! হাতের ইশারায় লাবনীকে অন্ধকার ঘর দেখাল রানা।

জেদ প্রকাশ পেল লাবনীর কণ্ঠে, তোমাকে ছাড়া যাব না!

আরে, বোকা মেয়ে, আমি পরে আসছি! ধমক দিল রানা। ওদিকের ঘরে, জলদি!

ছুটন্ত হোস হঠাৎ করেই লুটিয়ে পড়ল মরা সাপের মত। কমপ্রেসর বন্ধ করে দিয়েছে কিলিয়ান ভগলার। আবারও ছুটে এল ঘরের দরজায়, হাতে রিভলভার।

ঘুরেই দৌড় দিল লাবনী। এক সেকেণ্ড আগে যেখানে ছিল, তার পেছনের দেয়ালে নাক খুঁজল ম্যাগনাম রাউণ্ড।

আবারও হামলা করল কামিল। করাত সরিয়ে আত্মরক্ষা করতে চাইল রানা। দুই যন্ত্রের ফলা লেগে ছিটকে উঠল লাল-হলদে ফুলকি। ভীষণ ভয় পেয়ে একটা পিলারের পেছনে লুকিয়ে পড়ল বেলা। একটু দূরেই রানা ও কামিল। তবে কাজের জিনিস সিকিউরিটি চিফের করাতের দীর্ঘ ফলা। সামনে বেড়ে রানাকে ঘরের কোণে আটকে ফেলল লোকটা।

পায়ে ঘষা লাগতেই নিচে তাকাল বেলা। দুলছে-নড়ছে দুই করাতের কে। ওদিকে খেয়াল নেই রানা ও কামিলের। বেলার মনে পড়ল, যন্ত্রগুলোর কে এসেছে এন্ট্রান্স চেম্বার থেকে। ওখানে আছে বিদ্যুতের জাংশন-বক্স।

এখন যদি বেলা একবার অফ করে দেয় চেইন সও…

দুই কেবলই কমলা রঙের। তবে চেইন সওরটা বোধহয় একটু গাঢ় রঙের। কালচে লাইন খামচে ধরে প্রাণপণে টানতে লাগল বেলা।

লাবনীর পিছু নেয়ার জন্যে দৌড় দেবে কিলিয়ান ভগলার, এমনসময় তার দৃষ্টি আকর্ষণ করল দুই করাতওয়ালার লড়াই। রানার দিকে রিভলভার তাক করল সে, কিন্তু একপাশে সরে লাইন অভ ফায়ারে চলে এল কামিল। সামনে বেড়ে হামলা করেছে রানার ওপর। বিরক্ত হয়ে ট্রিগারের ওপর থেকে আঙুল সরাল ভগলার। অপেক্ষা করছে অধৈর্য হয়ে। সুযোগ বুঝে গুলি করবে শত্রুর বুকে।

গোল করাত কাত করে কামিলের কনুই কেটে নিতে চাইল রানা। তবে অনায়াসেই হামলা ঠেকিয়ে দিল লোকটা। তার চেইন সও কামড় বসাল বৃত্তাকার করাতের কেসিঙের ওপর। প্ল্যাস্টিকের অসংখ্য ছোট ছোট টুকরো ছিটকে এসে লাগল রানার নাকে-মুখে। ব্যথায় মুখ কুঁচকে ফেলল ও। ভারী করাত তুলে ধরতে গিয়ে হয়ে উঠেছে ক্লান্ত। চোখের কোণে দেখল কিলিয়ান ভগলারকে। রিভলভারের নল তাক করছে ওর পিঠ বরাবর! সামনের দিকে চেইন সও ঠেলে দিল কামিল। বাধ্য হয়ে পেছাতে হলো রানাকে। মাথায় তাপ লাগতেই টের পেল, ওর ঠিক পেছনেই স্ট্যাণ্ডভরা জ্বলন্ত সব হাই পাওয়ারের বাতি।

কোণঠাসা হয়ে গেছে, বুঝে গেল রানা।

ওদিকে বেলা দেখল, আর আসছে না বৈদ্যুতিক কর্ড। গায়ের জোরে লাইন ধরে টান দিল ও।

জাংশন বক্স থেকে খুলে গেল যন্ত্রের প্লগ…

তাতে হঠাৎ করেই নীরব হলো রানার করাত!

না, চেইন সওর বৈদ্যুতিক তার গাঢ় রঙের নয়! ওটা ধুলোয় মাখা ছিল বলে ওরকম মনে হয়েছে! মারাত্মক ভুল করেছে বেলা। বৃত্তাকারকরাতের ধুলোভরা পাওয়ার কেবল টান দিয়ে খুলে দিয়েছে ও!

আরে! আঁৎকে উঠে বেলাকে দেখল বিস্মিত রানা। মেয়েটা উজবুকের মত চেয়ে আছে হাতের কেবলের দিকে। ভয়ঙ্কর খুনি লাশের কাছে ধরা পড়লে যেমন চেহারা করে, ওভাবে তাকাল রানার দিকে।

বিড়বিড় করল রানা, সেরেছে!

এখনও বনবন করে ঘুরছে গোল করাত, কিন্তু ক্রমেই কমছে গতি। নিজের কপাল দেখে খুব খুশি মাধু কামিল, পেয়ে গেছে সুযোগ! রানার বুক লক্ষ্য করে সামনে বাড়াল চেইন সওর ক্ষুরধার, ভয়ঙ্কর ফলা। ভারী, গোল করাতের মেশিন ওপরে তুলে নিজেকে বাঁচাতে চাইল রানা। কিন্তু চেইন সওর দাঁত লাগল ওর করাতের ফলার এক্সেল অ্যাসেমব্লিতে। চুরমার হলো ওটা। মৃত্যুবাহী ফ্রিসবির মত ঘরের আরেক দিকে ছিটকে গেল স্টিলের বৃত্তাকার করাত। লাগল গিয়ে এক পিলারের গায়ে, তারপর সাঁই করে গেল সুড়ঙ্গের দিকে ঠিক সময়ে ওটার গতিপথ থেকে সরে না গেলে কাটা পড়ত ভগলারের গলা। প্রাণের ভয়ে পেছনে। ডাইভ দিয়েছে সে। তার ওপর দিয়ে গিয়ে আরেক পিলারে লাগল করাতের ব্লেড। ওখানে না থেমে ঢুকে পড়ল এন্ট্রান্স চেম্বারে। কুঁজো হয়ে বসে পড়ল নাদির মাকালানি। ওরে! করুণ আর্তনাদ ছাড়ল লুকমান বাবাফেমি। তাদের দুজনের মাঝ দিয়ে গেছে স্টিলের মারাত্মক ফলা।

এদিকে বেকার যন্ত্রটা কামিলের দিকে ছুঁড়ল রানা। আশা করছে, ভুল করে চেইন সও দিয়ে ভারী যন্ত্র ঠেকাবে লোকটা। কিন্তু হুঁশিয়ার বান্দা কামিল, এসবের ভেতর গেল না সে, ঘুরেই লাফিয়ে সরে গেল মিসাইলের গতিপথ থেকে। আবার মুখোমুখি হলো। এবার বাগে পেয়েছে অরক্ষিত রানাকে!

চেইন সও দুলিয়ে সামনে বাড়ল কামিল। বাতির স্ট্যাণ্ডে ঠেকে গেল রানার পিঠ।

চওড়া হাসি সিকিউরিটি চিফের ঠোঁটে, সোজা রানার বুক লক্ষ্য করে করাত চালিয়ে দিল সে…

কিন্তু চেইন সওর কেবল ধরে হ্যাচকা টান দিয়েছে বেলা। হঠাৎ এই কাণ্ডে কামিলের করাতের ফলা সরল টার্গেট থেকে। করাতের ডগা ভেদ করল রানার কাঁধের কাছে চামড়ার জ্যাকেট। ত্বক চিরে বেরোল রক্ত। কিন্তু ওই সামান্য ক্ষত পাত্তা দিল না রানা। শত্রু ভারসাম্য হারাতেই তাকে ধরে কাঁধের ওপর দিয়ে থ্রো করল বাতির স্ট্যাণ্ডের ওপর।

চেইন সওর ডগা ফাটিয়ে দিল হাই পাওয়ারের কয়েকটা বাব। কেটে গেছে পাওয়ার লাইন। বিস্ফোরিত হলো বালবৈর পাতলা সব কাঁচ। ঝলসে উঠল ঝলমলে ফুলকি ও নীল শিখা। তীব্র বৈদ্যুতিক স্রোত বইল মাধু কামিলের দেহে। প্যারালাইযুড় হয়েছে লোকটা, টু শব্দ করতে পারল না। কাটা কলাগাছের মত হুড়মুড় করে পড়ল ট্রাইপডের ওপর। তার নাক-চোখ থেকে ভক-ভক করে বেরোল মশার কয়েলের মত নীলচে ধোয়া। পুড়ে ভাজা হচ্ছে জীবন্ত লোকটা!

প্রাণের ভয়ে লাফিয়ে সরে গেছে রানা। বেলাকে এক টানে দাঁড় করিয়ে বলল, চমৎকার রঙিন ফুলকি! তবে দেখার সময় নেই, চলো!

.

আঁধার ঘরের মাঝ দিয়ে ছুটে চলেছে লাবনী। আবু তালাতের ফ্ল্যাশলাইটের আবছা আলোয় দেখল, এইমাত্র জ্ঞান ফিরেছে লোকটার। ধসে পড়া এক পিলার ঝড়ের বেগে টপকে যেতেই ঝট করে তাকাল সে। তখনই ওর পিঠ মাড়িয়ে চলে গেল লাবনী। ঠাস্ করে মেঝেতে মুখ থুবড়ে পড়ল আবু তালাত।

সংক্ষিপ্ত প্যাসেজ পেছনে ফেলল লাবনী। দূরে দেখল, রয়েল এন্ট্রান্সের কাছে নাদির মাকালানি। কিন্তু ওর একটু দূরেই এক পিলারে ঠেস দিয়ে হাঁপিয়ে চলেছে বাবাফেমি। ফ্যাকাসে সাদা ভূত। চমকে গেল লাবনীকে দেখে। ডক্টর আলম?

ডক্টর বাবাফেমি, আপনার বোধহয় কিছু কৈফিয়ত দেয়া উচিত, জবাবে বলল লাবনী।

দুপা সামনে বাড়ল বাবাফেমি। আপনি যদি ভেবে থাকেন…

গায়ের জোরে লোকটার নাকে ঘুষি বসিয়ে দিয়ে নাদির মাকালানির দিকে এগোল লাবনী। পেছনে শুনল, নাক চেপে ধরে কো-কোঁ করছে ভ্রষ্ট আর্কিওলজিস্ট। একটা পিলারের পাশে ক্রোবার দেখে তুলে নিল লাবনী, ধরেছে তলোয়ারের মত করে। ওর মনে হলো, কিছুই পাত্তা না দিয়ে কদর্য, বাঁকা হাসছে লোকটা। তোমার এত হাসি কীসের? বলল লাবনী। একটু দূরে পড়ে থাকা কেসটা দেখাল। ওটা নিয়ে বেরোতে পারবে না।

জবাব দিল না মাকালানি। আড়চোখে দেখছে ওকে। ঘাপলা আছে মনে হতেই সতর্ক হলো লাবনী। ঘুরে দেখল পশ্চিমের এক্সিট। ফিরে এসেছে কিলিয়ান ভগলার। তাক করছে রিভলভার…

লাবনী ছুট দিতেই বুলেটের আঘাতে পেছনের পিলার থেকে ছিটকে উঠল পাথরের টুকরো। কারুকাজ করা এক পিলারের আড়াল নিল ও।

কড়া সুরে বলল নাদির, খুন করো একে!

.

দ্বিতীয় অন্ধকারাচ্ছন্ন চেম্বার থেকে গুলির আওয়াজ শুনেছে রানা। লুকিয়ে পড়ো, বেলাকে বলেই মৃদু আলোর ঘর লক্ষ্য করে ছুটল ও। এদিকে আবারও উঠে বসছে আবু তালাত। তার পিঠে পা দিয়ে টপকে গেল রানা। নতুন করে ভেঁচে গেল লোকটার মুখ। সেদিকে খেয়াল নেই রানার, মেঝেতে পড়ে থাকা ফ্ল্যাশলাইটের আলোয় দেখেছে ছোরা। তুলে নিল ওটা।

.

ওদিকে বাতির স্ট্যাণ্ডের নিচে কষে লাথি মেরেছে লাবনী। স্ট্যাণ্ডের ওপরের অংশ বেশি ভারী, হুড়মুড় করে মেঝেতে পড়ল ওটা। ঝনঝন করে ভাঙল সব বা। আঁধার নামল ঘরের পুবে। বন্ধ এন্ট্রান্সের কাছে আরেকটা পিলার পেরোল লাবনী। জগিঙের ভঙ্গিতে পিছু নিয়েছে কিলিয়ান ভগলার।

এদিকে টলতে টলতে ঘরে ঢুকল লা ভার্নে। রক্তে মেখে আছে নাক-মুখ।

ঘরে কারা উপস্থিত, সেটা দেখে লাবনী পরিষ্কার বুঝল, এভাবে বেশিক্ষণ লুকিয়ে থাকতে পারবে না।

দৌড়ে ঘরে ঢুকেই ভগলারের অস্ত্রের নল লক্ষ্য করে রানা বুঝে গেছে, কোনদিকে আছে লাবনী।

অ্যাই যে! গলা ছাড়ল বিসিআই এজেন্ট।

ওকে দেখেছে ভগলার, ঘুরেই টিপে দিল ট্রিগার।

একটা পিলারের আড়াল নিয়েছে রানা, পাশ দিয়ে গেল বুলেট। দেয়াল থেকে খসে পড়ল পাথরের টুকরো।

যোডিয়াক সরাও! হাতের ইশারায় ভার্নেকে নির্দেশ দিল মাকালানি। তাড়া খাওয়া তেলাপোকার মত পিছলে তার পাশে পৌঁছুল বাবাফেমি।

শিকারের কাছে পৌঁছে গেছে কিলিয়ান ভগলার।

একটা পিলারে পিঠ ঠেকিয়ে অপেক্ষা করছে রানা, হাতে ছোরা। আমেরিকান খুনির কোল্ট পাইথন রিভলভার জাদু দেখাতে পারবে আর মাত্র দুবার। রানার হিসাব অনুযায়ী, আর দুটো বুলেট আছে ওই অস্ত্রে। এমন কী স্পিডলোডার ব্যবহার করেও কয়েক সেকেণ্ড লাগবে রি-আর্ম করতে। ওই সময়ে পাল্টা আক্রমণ করতে পারবে রানা।

অবশ্য, তার আগে খরচ করাতে হবে ওই দুই বুলেট।

কাছের দরজায় পায়ের আওয়াজ পেল রানা। শেষমেশ মেঝে ছেড়ে উঠতে পেরেছে আবু তালাত। রক্তাক্ত চেহারায় ভীষণ রাগ। টলতে টলতে আসছে রানার দিকেই।

বিরক্ত রানা টের পেল, বাধ্য হয়েই পিছিয়ে যেতে হবে ওকে। কিন্তু ওদিকে আছে ভগলার।

আবছা আলোয় আমেরিকান খুনির চোখে হত্যার ফুর্তি দেখল লাবনী। রানা! চিৎকার করে উঠেই পরক্ষণে গায়ের জোরে ক্রোবার ছুঁড়ল গানম্যানের দিকে।

ভারী দণ্ড লাগল লোকটার কাঁধে। ট্রিগারে আঙুলের চাপ পড়তেই বু! শব্দে বেরোল ৩৫৭ ম্যাগনাম বুলেট। নাকের কাছে এক পিলারে বুলেট লাগতেই বিরাট একলাফে পিছিয়ে গেল আবু তালাত। একইসময়ে আঁধারে ছুটে গিয়ে লাবনীর পাশে পৌঁছুল রানা।

তালাত! ভার্নে! যোডিয়াক সরাও! চিৎকার ছাড়ল নাদির মাকালানি। অধৈর্য হয়ে আরও রেগে উঠছে সে।

দ্বিধায় পড়েছে আবু তালাত, তবে কয়েক সেকেণ্ড পর গেল ঘরের আরেক পাশে। নিচু হয়ে তুলে নিল কেসের একদিক। অন্যদিক তুলে ধরল ভার্নে। একহাতে রক্তাক্ত নাক চেপে ধরে, ঘুরেই সুড়ঙ্গ ধরে দৌড় দিল লুকমান বাবাফেমি। কেস বয়ে তার পেছনে চলল তালাত ও ভার্নে।

চোখের সামনে যোডিয়াক নিয়ে যাচ্ছে দেখে রানাকে বলল লাবনী, শয়তানের দল সব নিয়ে যাচ্ছে! ছুরি দিয়ে কী করবে পিস্তলের বিরুদ্ধে!

ওটা পিস্তল নয়, রিভলভার, ভুল ধরিয়ে দিল রানা, শেষ গুলি ফুরিয়ে গেলে ওকে লড়তে হবে খালি হাতে। কিন্তু আমার হাতে থাকবে ছোরা।

খুব কাছে পৌঁছে গেছে ভগলার, কিন্তু তার উদ্দেশে চেঁচাল নাদির মাকালানি, কিল! চলো!

ওদের কী হবে?

যোডিয়াক হাতে পাওয়াই মূল কথা, এসো! সুড়ঙ্গ ধসিয়ে দেব। আটকা পড়বে ওরা!

পরস্পরের দিকে তাকাল রানা ও লাবনী।

বিড়বিড় করল রানা, ব্যাটা বলে কী!

তাই তো বলল! শুকনো গলায় বলল লাবনী।

সুড়ঙ্গে ঢুকে পড়ল নাদির মাকালানি।

পিছু নিয়ে এন্ট্রান্সের কাছে চলে গেল ভগলার। পাশেই পাথরের মস্তবড় চাই। রিভলভার উঁচু করে রেখেছে লোকটা, রানা বা লাবনী বেরোলেই গুলি করবে।

ওই ঘটিগুলোর একটা দাও তো, লাবনী, বলল রানা।

অমূল্য আর্টিফ্যাক্ট ভাঙবে ভাবতে গিয়ে ফ্যাকাসে হলো লাবনী, তবে একটা বড় ফুলদানি ধরিয়ে দিল রানার হাতে।

ওজনটা বুঝে নিয়ে ওটা উঁচু করে ধরল রানা।

সুড়ঙ্গের দূর থেকে এল মাকালানির কণ্ঠ: কিল! চলে এসো!

গলার আওয়াজ অনুসরণ করে ঘুরে তাকাল কিলিয়ান ভগলার। আর তখনই লাফিয়ে বেরিয়ে এসেই ভারী ফুলদানি ছুঁড়ল রানা। পরক্ষণে মেঝেতে পড়ে গড়িয়ে দিল শরীর, চলে গেল পরের পিলারের আড়ালে। দুসেকেণ্ড পর গুলি করল ভগলার। ক্লে পিজিয়নের মত মাঝপথে চুরমার হলো উড়ন্ত ফুলদানি। কয়েকটা টুকরো লাগল গায়ে, তবে পাত্তা দিল না রানা। মগজে ঘুরছে শুধুমাত্র একটা চিন্তা: শেষ হয়েছে ছয়টা গুলি!

লাফিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে ভাবছে, ভুল হয়নি তো, রিভলভারের বদলে ভগলারের হাতে হয়তো সেভেন শুটার…

নাহ্। ঘুরেই সুড়ঙ্গ ধরে ছুটল লোকটা।

ক্ষিপ্র চিতার বেগে পিছু নিল রানা, পাশ কাটাচ্ছে জ্বলন্ত সব বাতি। কয়েক সেকেণ্ড পর বুঝল, করেছে মস্তবড় ভুল! এইমাত্র জ্যাকেট থেকে দ্বিতীয় রিভলভার বের করেছে। ভগলার! থেমে ঘুরে দাঁড়াল সে!

একইসময়ে ঝাঁপ দিয়ে তাকে ট্যাকল করল রানা। ধুপ ধুপ শব্দ তুলছে জেনারেটর, ওটার পাশে হুড়মুড় করে পড়ল ওরা দুজন। অস্ত্র তুলল ভগলার, কিন্তু থাবা মেরে তার হাত থেকে রিভলভার ফেলে দিল রানা। অস্ত্রটা আবারও হাতে পেতে হাঁচড়েপাঁচড়ে এগোতে চাইল তেলতেলে চুলের খুনি, তবে কিডনির ওপরে রানার প্রচণ্ড এক ঘুষি খেয়ে পড়ে গেল।

কিন্তু লড়াই শেষ হয়নি। মেঝেতে ঘুরেই কনুই চালাল সে রানার বুকে। প্রচণ্ড ব্যথায় দম আটকে গেল ওর। আট মাস আগে বিপজ্জনক এক অ্যাসাইনমেন্টে পাঁজরের দুটো হাড় ভেঙেছিল, সেখানে পড়েছে কনুইয়ের বেদম খোঁচা!

রানার দুর্বলতা বুঝে গেছে ভগলার। দ্বিতীয়বার মারল একই জায়গায়। পেছনের এক পিলারের ওপর পিঠ দিয়ে ধড়াস্ করে পড়ল রানা।

সুযোগ পেয়ে ধড়মড় করে উঠতে গেল ভগলার, কিন্তু তখনই তার শুকনো পাছায় খেল রানার জোরালো লাথি। টলে গিয়ে আবারও হুড়মুড় করে পড়ল লোকটা। মুখ তুলে দেখল, পায়ের কাছে হাজির হয়েছে নাদির মাকালানি।

মুখ তুলে চেয়েছে রানাও।

মেঝে থেকে আগেই রিভলভার তুলে নিয়েছে মাকালানি। সরাসরি তাক করল রানার বুকে। তবে ট্রিগার টিপে দেয়ার আগেই ঝাঁপ দিয়ে জেনারেটরের ওদিকে পড়ল রানা। কানের কাছে বুম! করে উঠল রিভলভার। প্রথম গুলি মেঝেতে লেগে পিছলে গেল সুড়ঙ্গের দূরে। দ্বিতীয় বুলেট লাগল জেনারেটরের বুকে। ভীষণ ঝাঁকি খেয়ে বিশ্রী আওয়াজ তুলল যন্ত্রটা। নষ্ট হয়েছে ভেতরের কলকজা। নিভে আবার টিপটিপ করে জ্বলে উঠল বাতি। তৃতীয় গুলি ফাটাল ফিউয়েল ট্যাঙ্ক। মেঝের ওপর দিয়ে গলগল করে বয়ে গেল গ্যাসোলিন।

ঠোঁটে ভয়ঙ্কর হাসি নিয়ে ভগলারকে বলল মাকালানি, পিছিয়ে যাও!

কী করা হবে বুঝে খলখল করে হেসে উঠে মেঝে ছাড়ল আমেরিকান খুনি।

পিছিয়ে যেতে শুরু করেছে তারা দুজনই।

সেরেছে! বিড়বিড় করল রানা।

বুলেটের আঘাতে মরবে, না জ্বলেপুড়ে, তাই স্থির করতে হবে এখন!

পরক্ষণে গুলি করল নাদির মাকালানি। তপ্ত সীসা জ্বেলে দিল ফিউয়েলের বাম্পকে দপ করে ধরেছে নীল আগুন!

মেঝে থেকে উঠেই আহত সিংহের মত ছুটল রানা। এক সেকেণ্ড পর বিস্ফোরিত হলো জেনারেটর। দপ করে নিভে গেল সব বাতি। পেছনের কমলা আগুনের উজ্জ্বল আলোয় সবই দেখছে রানা। গোল এক বল তেড়ে এল ওর দিকে। পুড়তে শুরু করেছে গায়ের ত্বক ও মাথার চুল। ডাইভ দিয়ে মেঝের দূরে গিয়ে পড়ল রানা। তেলতেলে স্রোতের মত আগুনের হলকা গেল ওর ওপর দিয়ে ছাতের দিকে।

মিলিয়ে গেল বিস্ফোরণের ভোতা প্রতিধ্বনি। অন্য বিষয়ে মাথা ঘামাচ্ছে রানা। সমস্যা হচ্ছে ছাতে ঠেক দেয়া কাঠের পিলার ও বিম কড়কড় আওয়াজে পুড়ছে ওগুলো!

মৃদু কুড়মুড় শব্দ ছাড়ল ছাতের পাথর…

ধসে পড়তে শুরু করেছে সব!

ধড়মড় করে উঠে অন্ধকার লক্ষ্য করে দৌড় দিল রানা। পেছনে বিকট এক আওয়াজ তুলে ধসে পড়ল ছাতের বড় এক অংশ। মস্ত এক লাফে এন্ট্রান্স চেম্বারে ঢুকল ও। ওকে ধাওয়া করেছে দম আটকে দেয়া ধুলো-বালির ঘন মেঘ।

একটু দূরে কোথাও খুকখুক করে কাশছে লাবনী। বিড়বিড় করে বলছে, ও, রানা! মরে যেয়ো না! প্লিয!

নাক-মুখ টি-শার্টে চেপে বলল রানা, ভাবলে কী করে যে খুন হবে দ্য গ্রেট মাসুদ রানা? এহূহে! গলা তো সাহারা মরুভূমির মত শুকিয়ে গেল!

রানা খুঁজতে শুরু করার আগেই ওর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল লাবনী। নাক গুঁজেছে রানার বুকের কালো অরণ্যে।  

ওকে একহাতে ধরে রাখল রানা।

থেমে গেছে ছাতের ধস। তবে ওপর থেকে ঝরঝর করে ঝরছে সুড়ঙ্গে বালি।

কী হয়েছিল? মুখ তুলে তাকাল লাবনী।

মাথা নাড়ল রানা। সহজ কথায়: জেনারেটর ফেটেছে। আগুন ধরে গেল। মেঝেতে নেমে এল ছাত।

তার মানে আটকা পড়েছি? চমকে গেছে লাবনী।

তাই তো মনে হচ্ছে।

তুমি ঠিক আছ তো, রানা? জানতে চাইল লাবনী।

প্রায়। তবে ছাগলা দাড়িওয়ালা ভগলারের শুঁটকি পাছায় কষে আরেক লাথ মারতে পারলে মিটত জীবনের প্রায় সব শখ-আহ্লাদ!

ওটা তোমার জীবনের…।

 হু। তখন তেমনই মনে হয়েছে।

ভাসমান ধুলোর মাঝে বলের মত বৃত্তাকার আবছা আলো এল ওদের দিকে। আবু তালাতের ফ্ল্যাশলাইট বেলার হাতে। ককিয়ে উঠল মেয়েটা, হায়, ঈশ্বর! বাতাস ফুরিয়ে গেলে মরব তো আমরা!

রানার বুক ছেড়ে সরে গেল লাবনী।

প্রকাণ্ড জায়গা, বলল রানা, যথেষ্ট অক্সিজেন আছে। ভয় নেই।

ভয় পাচ্ছি কই! করুণ সুরে বলল বেলা, ভয়ের কী আছে? মনেই নেই, আছি হাজার হাজার টনি স্ফিংসের নিচে! কেউ জানল না শেষ হয়ে গেলাম!

তোমার ফ্ল্যাশলাইট দাও তো, হাত বাড়িয়ে বেলার কাছ থেকে ওটা নিল রানা। আলো তাক করল সুড়ঙ্গের দিকে। বাতাসে ভাসছে ঘন ধুলোর মেঘ। পুরো বুজে গেছে সুড়ঙ্গ।

পাথর খুঁড়ে বেরোতে না পারলে মরব! বলল বেলা।

ভুলে গেলে? মৃদু হেসে কারুকাজ করা পিলারের মাঝে পুব এন্ট্রান্স দেখাল রানা। আমরা অপেক্ষা করব সঠিক সময়ে বিখ্যাত হওয়ার জন্যে!

.

সুড়ঙ্গের শেষমাথায় ভাঙা পাথর সরাবার আগে বিরতি নিল দাম্ভিক আর্কিওলজিস্ট ম্যান মেট্য। টিভি ক্যামেরার দিকে চেয়ে গলা মোটা করে নাটকীয় সুরে বলল, এবার আপনারা দেখবেন অবিশ্বাস্য এক দৃশ্য…।

সংকীর্ণ প্যাসেজে আছে, মাত্র ছয়জন। তাদের কপাল ভাল, নিজ চোখে দেখছে কীভাবে উন্মোচিত হচ্ছে পাঁচ হাজার বছর আগের হল অভ রেকর্ডস। ক্যামেরার সাইক্লোপিয়ান কাঁচের চোখ একই দৃশ্য দেখাবে বিশ্বের কোটি কোটি উৎসুক দর্শককে। ম্যান মেটযের প্রতিটি কথা গিলরে তারা। একসময় এভাবেই চাঁদে পা দিয়ে পুলকিত হয়েছিলেন নিল আর্মস্ট্রং।

হাতঘড়ি দেখল মেট। ভোর চারটে ছিচল্লিশ মিনিট। নিউ ইয়র্কে রাত নয়টা ছিচল্লিশ। স্কেজুয়ালে ভুল হয়নি তার।

ক্রোবার হাতে নিয়ে ক্যামেরার দিকে তাকাল সে। আপনারা দেখছেন, এবার সরিয়ে নেয়া হবে এন্ট্রান্স থেকে শেষ পাথর। আরও ভারী করে তুলল কণ্ঠ, স্ফিংসের তলের গোপন সুড়ঙ্গে হল অভ রেকর্ডসসের প্রবেশপথে শেষ বাধা এই পাথর। পাঁচ হাজার বছর পর প্রথম মানুষ আমরা, যারা পা রাখব ওই রাজকীয় গ্রন্থাগার কক্ষে। কারও জানা নেই, কী সম্পদ রয়ে গেছে ওখানে। তবে এটা ঠিক, যা-ই থাকুক, তা আছে হাজারো বছর ধরে। এবার আমরা দেখব সেসবই!

ক্যামেরাম্যানের পেছন থেকে অধৈর্য হয়ে ইশারা করল প্রোগ্রাম প্রডিউসার লোগান ক্যাসপাস। তার অত্যন্ত মূল্যবান সময় নষ্ট করছে ম্যান মেটয।

গম্ভীর মুখে ক্রোবার ঢুকিয়ে পাথরের স্ল্যাবের ফাঁকে চাড় দিল আর্কিওলজিস্ট, খসে পড়ল একপাশের পাতলা আস্তর। আবারও ক্যামেরার দিকে তাকাল ম্যান মেটয। চলুন, দেখা যাক কী রয়েছে ওদিকে।

ক্রোবারের আরেক চাড় দিতেই নিচু গুড়গুড় শব্দে একটু সরে গেল পাথরের স্ল্যাব। উত্তেজিত হয়ে উঠল ম্যান মেটয। আবার কাজে নামতেই আরও খানিকটা সরল স্ল্যাব।

শেষপর্যন্ত উন্মোচিত হচ্ছে হল অভ রেকর্ডস!

প্রথমে দেখবে কে?

দুনিয়ার সেরা আর্কিওলজিস্ট ম্যান মেটয!

আইএইচএর এই বিশেষ অ্যাসাইনমেন্টে নেতৃত্ব দিতে কম লড়াই করেনি সে!

তার ওপর ঝামেলা করেছিল ওই লাবনী আলম!

মরুক বেটি!

স্ল্যাব আরেকটু সরতেই ওদিকে দেখা গেল নিকষ কালো আঁধার। গর্ত থেকে বেরোল সামান্য লালচে ধুলো।

বুক ধুকপুক করছে ম্যান মেটযের। আরও জোরে চাড় দিল। ছুটিয়ে ফেলল পাথরের স্ল্যাব। ওটা ঠেলে সরিয়ে ঘুরে তাকাল।

এগিয়ে এল ক্যামেরাম্যান।

 উজ্জ্বল আলো গিয়ে পড়ল কক্ষের ভেতর…

দেখা গেল কালিঝুলি মাখা লাবনী আলমের হাসিমুখ! পাশেই মাসুদ রানা ও বেলা আবাসি!

হ্যাঁ, কী, মেটয? খুশি-খুশি স্বরে বলল লাবনী। মেট্য ভাবল, বুলেটের বেগে পায়ের পাতা ভেদ করে পাথুরে জমির গভীরে গিয়ে ঢুকল তার হৃৎপিণ্ডটা! এসো, ওয়েলকাম টু দ্য হল অভ রেকর্ডস! তোমার আসতে এত দেরি কীজন্যে?

.

০৯.

 এরা প্রত্যেকে ভয়ঙ্কর দুর্ধর্ষ আর্টিফ্যাক্ট লুঠেরা, কর্তৃপক্ষের উচিত অন্তত বিশ বছর এদেরকে জেলে আটকে রাখা! রাগ ঝাড়ছে লুকমান বাবাফেমি, তবে একইসময়ে কণ্ঠে রয়েছে চাপা ভীতি।

রানা, লাবনী ও বেলা জানে, লোকটার ভয় পাওয়ারই কথা। যদি প্রমাণ হয় যোডিয়াক চুরির সঙ্গে জড়িত, সোজা তাকে ভরা হবে বিশ বছরের জন্যে আঁধার কুঠরিতে।

কপাল মন্দ, রানাদের হাতে যথেষ্ট প্রমাণ নেই। অন্তত এমন কিছু নেই, যেটা টিকবে আদালতে।

স্ফিংস থেকে বেরোলে কর্তৃপক্ষ আঁচ করেছে, হল অভ রেকর্ডসসে কিছু করছিল ওরা। অপরাধের ধরন বুঝতে না পারলেও সঙ্গে সঙ্গে গ্রেফতার করা হয়েছে। সরাসরি নিয়ে এসেছে মিনিস্ট্রি অভ কালচার-এ মন্ত্রী মহোদয়ের অফিসে। বাদ পড়েনি উজবুক মেট ও ভীত লুকমান বাবাফেমি। প্রথম থেকেই ক্রোধ ঝাড়ছে আমেরিকান আর্কিওলজিস্ট। কর্তৃপক্ষের প্রতারিত ন্যায়নিষ্ঠ অফিসারের ভঙ্গি বাবাফেমির।

এরা যাই বলুক, এটা প্রমাণিত, আইএইচএকে কাঁচকলা দেখিয়ে হল অভ রেকর্ডসসের ভেতর আগে ঢুকেছে একদল লুঠেরা। বেলার ক্যামেরা থেকে সমস্ত ডেটা নেয়া হয়েছে কমপিউটারে। এখন দেখা হচ্ছে মন্ত্রী মহোদয়ের অফিসের বিশাল টিভি স্ক্রিনে। ফ্রি করা হয়েছে একটা দৃশ্য। ছাতে যোডিয়াকের অংশ। সামনে দাঁড়িয়ে আছে মাকালানি ও বাবাফেমি। কিন্তু যেহেতু যোডিয়াকের ঘরে উজ্জ্বল আলো, এবং তাদের পিঠ ক্যামেরার দিকে, তাই প্রায় দেখাই যাচ্ছে না দুজনকে।

এটা প্রমাণিত যে আমরা লুঠ করিনি হল অভ রেকর্ডস, বলল রানা। তাতে আপনাদের কোনও সন্দেহ আছে?

মাথা নাড়লেন মন্ত্রী ইউসুফ কোন্তার।

মাত্র গতকাল সকালে এসেছি এ দেশে, বলল লাবনী, কিন্তু ওই সুড়ঙ্গ খোঁড়া হয়েছে সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে। তা করা হয়েছে স্ফিংসের কম্পাউণ্ডে। সুতরাং ধরে নেয়া যায় গিজার কারও হাত আছে এতে। বাবাফেমির দিকে তাকাল লাবনী। আপনি এতে একমত?

মন্ত্রী ইউসুফ কোন্তার বয়স্ক লোক, ঘোড়ার মুখের মত লম্বাটে মুখ। মন দিয়ে দেখছেন লাবনী ও বেলার, তোলা ফোটোগ্রাফ। ওই মৃত মাধু কামিল ছিল সিকিউরিটির দায়িত্বে। ধরে নেয়া যায়, লুঠেরাদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল সে।

প্রাইভেট কন্ট্রাক্টরদের দায়িত্ব দেয়া ছিল মস্তবড় ভুল, বললেন সুপ্রিম কাউন্সিল অভ অ্যান্টিকুইটির সেক্রেটারি জেনারেল শরিফ হামদি। আর্মি ডাকা দরকার ছিল। থাকা উচিত ছিল অ্যান্টিকুইটির স্পেশাল প্রোটেকশন স্কোয়াড।

আমার ধারণা, ডক্টর আলম ও তার ডাকাতের দলের পিছু নিয়েছিল মাধু কামিল, আর তখনই গ্রেফতার করতে গিয়ে খুন হয় সে, বলল বাবাফেমি।

এ কথা শুনে এমন কী ম্যান মেটযও অবাক হয়ে তাকে দেখল।

লুঠেরাদের ফেলে যাওয়া ইকুইপমেন্টের ফোটো হাতড়ে দেখছেন মন্ত্রী। একজনের কাজ নয় এটা। এক যুবতী, মিস্টার রানা বা এক বাচ্চা মেয়ে এসব করতে পারত না।

রানাকে একবার দেখে নিলেন। ভুলে যাননি মিশরের জাতীয় একাধিক জটিল সমস্যায় সাহায্য করেছে বাঙালি ওই যুবক। তখন রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে পরিচয় হয়েছে দুজনের।

আমি বাচ্চা মেয়ে নই, আপত্তি তুলল বেলা।

ওর বাহুতে হালকা চাপড় দিল লাবনী। ঠিক আছে।

মন্ত্রীর দিকে ফিরে বলল রানা, ছিল অন্তত দশজন। ভিড়িয়োতে আছে ছয়জন। আরও ছিল কনস্ট্রাকশন সাইটে দুগার্ড ও কম্পাউণ্ডের গার্ডরা। গিজার সবাইকে তদন্তের আওতায় নিলে, উচিত হবে একেবারে ওপরের পর্যায় থেকে। সন্দেহ করা।

লুকমান বাবাফেমির দিকে তাকাল লাবনী।

পাগলের মত কথা বলছে এরা! ফুঁসে উঠল বাবাফেমি, আমাকে অপরাধী হিসেবে দেখিয়ে আড়াল করতে চায় নিজেদেরকে!

বলুন তো, আপনাকে এত চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন? বলল লাবনী, কীভাবে পেলেন নাকে ব্যথা? কী হয়েছিল? হাত তুলে আঙুলের ছড়ে যাওয়া কড়া দেখল ও। আরে, অবাক কাণ্ড, আমার হাতে দেখি নাক আকৃতির লাল দাগ!

মিস্টার মিনিস্টার, গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক এলাকায় অনধিকার প্রবেশের জন্যে লাবনী আলম বা তার সঙ্গের এই দুজনের বিরুদ্ধে মামলা হওয়া উচিত, লালচে চেহারায় বলল ম্যান মেটয। কড়া চোখে দেখল লাবনীকে। আমার চূড়ান্ত সাফল্য সহ্য হলো না? তাই ধ্বংস করে দিলে আমার সুনাম? …প্রশংসা পেয়ে মধ্যমণি হতে হবে, তাই না?

আগে অন্তত মানুষ হও, মেট, ধমকের সুরে বলল লাবনী।

আরামদায়ক চেয়ারে হেলান দিলেন শরিফ হামদি। আমরা অত্যন্ত গুরুতর অপরাধের বিষয়ে কথা বলছি, ডক্টর মেটয, কাজেই দয়া করে অপ্রাসঙ্গিক বিষয় টেনে আনবেন না। যোডিয়াকের ছবি দেখালেন তিনি। ডাকাতি হয়েছে জাতীয় মূল্যবান সম্পদ। এবং তা হয়েছে আপনার নাকের ডগার তলা দিয়ে! সবাই জানতে চাইবে, কী কারণে আপনি জানলেন না ওখানে আছে আরেকটা সুড়ঙ্গ! আগেই তারা ওই সাইট থেকে মহামূল্যবান আর্টিফ্যাক্ট সরায় কীভাবে?

যে কেউ এটাও ভাবতে পারে, সবই জানতেন আপনি, আবছা হুমকি আছে মন্ত্রী মহোদয়ের কথার ভেতর।

ভয় পেয়ে ফ্যাকাসে হলো ম্যান মেটযের মুখ। কিন্তু… এসব কিছুই জানি না আমি! নইলে এভাবে শেষ করে দেয় কেউ নিজের ক্যারিয়ার ঝুঁকি নেয় কেউ জেলে যাওয়ার?

টাকার জন্যে বহু কিছুই করে অনেকে, বলল লাবনী। ওর মনে হয়েছে, লুঠেরাদের সঙ্গে জড়িত নয় মেট, তবে তাকে কুঁকড়ে যেতে দেখে ভাল লাগল।

টাকার কথা শুনে অস্বস্তিতে পড়ে গেলেন মন্ত্রী ইউসুফ কোন্তার। ডক্টর আলম, আপনার ধারণা এসবের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ওসাইরিয়ান টেম্পল?

অবশ্যই! বলল লাবনী, বামদিকের লোকটা নাদির মাকালানি।

সে যে-কেউ হতে পারে, চাপা স্বরে বলল বাবাফেমি।

ডানে তার ঘনিষ্ঠ দোস্ত, তাই না, ডক্টর বাবাফেমি? মৃদু হাসল রানা।

ডক্টর বাবাফেমির কথায় কিন্তু যুক্তি আছে, বললেন সেক্রেটারি জেনারেল শরিফ হামদি।

ওই লোক নাদির মাকালানি, জোর দিয়ে বলল লাবনী, এই ডাকাতির পেছনে আছে ওসাইরিয়ান টেম্পল।

ওই ধর্মের লোক নই, বিশ্বাসও করি না তাদের ধর্মপথ, তবে মিশরে বড় দাঁতব্য সংস্থা তারা, বললেন মন্ত্রী। কাদির ওসাইরিস শুধু যে মিশরের আর্কিওলজিকাল পোজেক্টে টাকা ঢেলেছেন, তা নয়, অঢেল অর্থের সাহায্য করেন স্বাস্থ্য ও কৃষি কার্যক্রমে। খুব জনপ্রিয় মানুষ। ভুরু কুঁচকে ফেললেন। এ দেশ ত্যাগ করে বর্তমানে বাস করেন প্রায় আয়করবিহীন স্বর্গ সুইটয়ারল্যাণ্ডে।

 নাটকীয়ভাবে কাঁধ ঝাঁকাল বাবাফেমি। লাবনী আলম বলতে চাইছে, এই ডাকাতির সঙ্গে জড়িত নাদির মাকালানি। এরপর কার কথা বলবে? প্রেসিডেন্ট?

হামদি জিজ্ঞেস করলেন, এরা কেন শুধু যোডিয়াক নিল? হল অভ রেকর্ডসসের আর সবকিছুর মূল্য তো ব্ল্যাক মার্কেটে কয়েক শ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি।

আর্থিক দিক থেকে লাভবান হবে বলে যোডিয়াক লুঠ করেনি, বলল লাবনী। ল্যাপটপে সংযুক্ত পাশের টিভিতে বেলার ভোলা একটা ছবি আনল। ওটা চতুর্থ প্যাপিরাস স্ক্রল। এটা ওসাইরিয়ান টেম্পল গোপন করেছে আইএইচএ থেকে। এখানে লেখা, ওই যযাভিয়াক ওসাইরিসের পিরামিডের মূল চাবি। ওটাই চেয়েছে লুঠেরা-দল। পিরামিডের ভেতরের সব সম্পদ চাই তাদের।

টিটকারির হাসি হাসল বাবাফেমি। ওসাইরিসের পিরামিড? মিনিস্টার, হামদি, আপনারা এখনও শুনছেন এই বদ্ধউন্মাদ মহিলার কথা? ওটা তো পুরাণের কল্পকাহিনী! বাস্তববুদ্ধি আছে এমন কেউ এসব শুনলে হাসবে!

আপনি যার কাছ থেকে ঘুষ নিয়েছেন, সে কিন্তু মনে করে সত্যিই আছে ওসাইরিসের পিরামিড! পাল্টা জবাব দিল লাবনী।

চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল পেটমোটা, প্রায়-টাক পড়া বাবাফেমি। ফুঁসে উঠে বলল, বিদ্বেষমূলক, মিথ্যা, ভিত্তিহীন অভিযোগ আনছে এই কপট মহিলা আর্কিওলজিস্ট! কোনও প্রমাণ নেই, তবুও যা খুশি বলছে! ডক্টর আলম, আপনার সঙ্গে আমার দেখা হবে আদালতে!

বসে পড়ো, বাবাফেমি, বললেন হামদি। আহত চেহারা করে বসের নির্দেশ মেনে বসল বাবাফেমি। ডক্টর আলম, দয়া করে এরপর থেকে প্রমাণ হাতে নিয়ে অভিযোগ তুলবেন। জটিল লুঠের ব্যাপারে তদন্ত করছি আমরা। যারা এসবে জড়িত, ঠিকই শাস্তি পাবে, এতে মনে কোনও সন্দেহ রাখবেন না। তবে যথেষ্ট প্রমাণ না পেলে উচিত নয় কোনও সিদ্ধান্তে যাওয়া।

আপনারা যখন ফুলস্কেল তদন্তে নামবেন, ততক্ষণে ডাকাতের দল সরিয়ে ফেলবে ওসাইরিসের পিরামিডের সব মূল্যবান আর্টিফ্যাক্ট, মুখ খুলল রানা।

ডেস্কে দুহাত রাখলেন মন্ত্রী কোন্তার। আমরা কাজে নেমে পড়তে দেরি করব না। ডাকাতির সঙ্গে জড়িত সবাইকে ধরা হবে, বিচারের হাত থেকে রক্ষা পাবে না কেউ। সবাইকে দেখে নিয়ে লাবনীর ওপর স্থির হলো তাঁর চোখ। পরক্ষণে কঠোর দৃষ্টিতে দেখলেন বাবাফেমিকে। রানা টের পেল, ঘুষখোর লোকটাকে সন্দেহ করছেন মন্ত্রী। ঠিক আছে, এবার যে যার মত যেতে পারেন। অনেক কাজ পড়ে আছে, ডক্টর হামদি।

রানা, লাবনী ও বেলাকে আঙুল তুলে দেখালবাবাফেমি। স্যর, গ্রেফতার করা হবে না এদেরকে?

এ ডাকাতিতে জড়িত বলে মনে হলে গ্রেফতার করতে হয় সবাইকেই, ধমকের সুরে বললেন ইউসুফ কোন্তার, সেক্ষেত্রে সবচেয়ে আগে গ্রেফতার করা উচিত আপনাকে! এঁরা মিথ্যা বলেননি, মিশরে এসেছেন গতকাল। কিন্তু হল অভ রেকর্ডসসে যাওয়ার ওই সুড়ঙ্গ নতুন করে খুঁড়ে নেয়া হয়েছে কয়েক সপ্তাহ ধরে। এবার এই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যান। আপনারা সবাই।

হাত তুলে দরজা দেখিয়ে দিয়েছেন মন্ত্রী। একে একে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এল প্রায় সবাই। তবে ডেস্কের কাছে রয়ে গেছে বেলা, কাকুতির সুরে বলল, এক্সকিউয মি, মিনিস্টার?

কড়া চোখে ওকে দেখলেন কোন্তার। বাচ্চা মেয়েটার চোখে অনুরোধ দেখে নরম হলো তার চোখের দৃষ্টি। তোমার জন্যে কী করতে পারি, পিচ্চি মেয়ে?

ল্যাপটপের দিকে দেখল বেলা। টিভির পাশেই হল অভ রেকর্ডস থেকে সংগ্রহ করা সব প্রমাণ। তার ভেতর রয়েছে ওর ক্যামেরা। আমি কি ফেরত পাব আমার ক্যামেরাটা?

আপাতত প্রমাণ হিসেবে রাখা হয়েছে, সরি, বললেন মন্ত্রী।

ও। থরথর করে কাঁপল বেলার নিচের ঠোঁট। আমার দাদা-দাদীর জন্যে ছবি আর ভিডিয়ো তুলেছি, সব ওখানে… গভীর বিষাদ ওর মুখে। তারা এ দেশ থেকেই গেছেন আমেরিকায়। আজও ভালবাসেন এ দেশকে প্রাণের চেয়েও বেশি। জানতে চেয়েছিলেন কেমন আছে…।

সরি, আবারও বললেন মন্ত্রী। তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত ক্যামেরা ফেরত দিতে পারব না। কয়েক মুহূর্ত কী যেন ভাবলেন। তবে ওটার মেমোরি কার্ডের কপি দিতে পারি ডিভিডিতে। তাতে সবই দেখতে পাবেন তোমার দাদু ও দাদীমা।

খুশির হাসি হাসল বেলা। তাতেই হবে! অনেক-অনেক ধন্যবাদ, মিস্টার কোন্তার।

কাউকে দিয়ে কপি করিয়ে দিচ্ছি, এবার হলো তো? স্নেহের সুরে বললেন মন্ত্রী। তাঁর নাতনি বয়সে বেলার সমানই।

অনেক ধন্যবাদ, দুর্দান্ত ভাল মানুষ আপনি, মিষ্টি হেসে বলল বেলা।

অদ্ভুত প্রশংসা পেয়ে নাখোশ হলেন না মন্ত্রী।

বেলা অফিস থেকে বেরোতেই লাবনী বলল, কী করছিলে ভেতরে?

হাসল বেলা। এখনও সম্ভব যোডিয়াকের ভিডিয়ো ক্লিপ পাওয়া।

আদায় করছ কীভাবে? জানতে চাইল লাবনী।

ডেস্কে মিস্টার কোন্তারের নাতনির ছবি দেখেননি? বলেছি, দাদা-দাদীর জন্যে ছবি তুলেছি। মন গলে গেল এই দাদুর। ক্যামেরা ফেরত পেলাম না, তবে ওটার পেটের সবই পাব।

মেমোরি কার্ডের সবই কমপিউটারে কপি করে, তারপর তাদের দরকারী ডেটা ডিলিট করে ডিভিডিতে ভরে তোমার অন্যসব ছবি দিতে পারে দাদা-দাদীর জন্যে, বলল বেরসিক লাবনী।

সেক্ষেত্রে ভিডিয়ো বা সব ছবি পাব না, বলল রানা। তবে ভদ্রলোক এত ভেবে কাজ করবেন বলে মনে হয় না। দেখা যাক।

ভিডিয়ো পেলেও লাভ হবে না, বলল লাবনী, এতক্ষণে এ দেশ থেকে সরিয়ে ফেলেছে যোডিয়াক। তা ছাড়া, আমরা দেখতে পেয়েছি ওটার মাত্র এক টুকরো। ওসাইরিসের পিরামিড, আবিষ্কার করতে হলে লাগবে পুরোটা। নাদির মাকালানির জন্যে সহজই হবে সব বুঝে নেয়া।

অত হতাশ হওয়ার মত কিছু দেখছি না, বলল রানা, একটু আগে আবিষ্কার করেছ হল অভ রেকর্ডস, তারপর জেলখানায় না গিয়ে বেরিয়ে এসেছ মুক্ত বাতাসে। এবার দেখা যাক, খুঁজে পাও কি না ওসাইরিসের পিরামিড!।

লোকগুলো যোডিয়াক কোথায় নেবে, তা নিয়ে আলাপ করছিল, উত্তেজিত সুরে বলল বেলা।

তবে করাতের আওয়াজে কিছুই বুঝতে পারিনি আমরা, আগুনে পানি ঢালল লাবনী।

বারান্দা থেকে বহু দূরের নীলাকাশ দেখল রানা। আমি বোধহয় জানি, কার সাহায্য নিলে বেরোবে কোথায় গেছে যোডিয়াক।

তোমাকে আবারও দেখে খুব ভাল লাগছে, লাবনীকে জড়িয়ে ধরল সুন্দরী জাবাইরাহ্ আহদি। দেড় বছর আগের মতই এখনও ফুলে আছে পেট। নতুন করে সন্তান-সম্ভবা। নয় মাস আগে ইরানিয়ান সরকারের চাকরি নিয়ে মিশরে এসেছে। নতুন খরর কী? কী আবিষ্কার করলে এবার?

কিছুই না!

ভয়ঙ্কর অর্থ-পিশাচ, চরম নিষ্ঠুর, কবর-লুঠেরা আরাশ খানসারির কাছ থেকে আটলান্টিসের দরকারি এক আর্টিফ্যাক্ট কিনতে ইরানে গিয়ে মস্ত বিপদে পড়েছিল রানা, লাবনী ও মউরোস। তখন জাবাইরাহ্ আহদির সাহায্য নিয়েছিল ওরা। সেই অভিযানেই প্রথমবারের মত লাবনী জেনেছিল, দুনিয়া জুড়ে প্রায় প্রতিটি দেশে আছে রানার বান্ধবী! তারা কোনও না কোনও বিপদে সাহায্য পেয়েছে বলেই কৃতজ্ঞ বাঙালি অকৃত্রিম বন্ধুর প্রতি। তাই সাহায্য করতে মুখিয়ে থাকে।

পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি, পরের বিশটা ছেলেমেয়েরও বাবা, আমার স্বামী, খালিদ জামসি, কালো ঝোপ সদৃশ চুলের দুর্দান্ত সুপুরুষ মিশরীয় এক যুবককে দেখাল জাবাইরাহ্।

মুচকি হাসল যুবক। সব মিলে বাইশটা? সংসারের জন্যে যে টাকা চাইবে, পাগল হয়ে পালিয়ে যাব! রানা, লাবনী ও বেলার সঙ্গে হ্যাণ্ডশেক করল সে।

কাজের কথায় আসা যাক, বলল জাবাইরাহ্। রানা ফোনে বলেছে, স্ফিংসের নিচে পাঁচ হাজার বছরের এক দালানে আটকা পড়েছিল। ভুরু কপালে তুলল সে। এসব অবশ্য রানার জন্যে কিছুই না। মহাবিপদ না হলে নষ্ট হয়, ওর রাতের ঘুম!

আসলে বেলার কারণেই এখানে আসা, বলল লাবনী। ও জেনে গিয়েছিল, লুঠ হবে হল অভ রেকর্ডস। হাতের ডিভিডি-আর দেখাল। কথা রেখেছেন মন্ত্রী কোন্তার। কপি করিয়ে দিয়েছেন ক্যামেরার মেমোরি কার্ডের সব। এটার ভেতর ডাকাতির ভিডিয়ো আছে।

চোখদুটো জ্বলে উঠল জামসির। প্রত্নতত্ত্বে মাস্টার্স ডিগ্রি নিলেও কাজ করে সে দৈনিক পত্রিকায়। তার দিকে চেয়ে মাথা নাড়ল জাবাইরাহ্। আগেই বলেছি, ঘুণাক্ষরেও এসব লেখা চলবে না পত্রিকায়।

জামসি কী ধরনের সাহায্যে আসবেন? জানতে চাইল লাবনী।

এ কথায় মেসেঞ্জার ব্যাগ থেকে অ্যাপল ল্যাপটপ বের করল যুবক। কি-বোর্ডের বাটনগুলোয় সেঁটে রাখা নানান রঙের লেবেল। প্রফেশনাল ভিডিয়ো এডিটিং সফওয়্যারের শর্টকাট, মুচকি হাসল সে। এখন নিজেকে জিজ্ঞেস করুন, দুনিয়ার কোন কাজে আমি আসব না?

হোটেল ঘরে রানার বিছানায় বসে পুরো আধঘণ্টা ডিভিডির সব ভিডিয়ো নিয়ে কাজ করল মিশরীয় যুবক, তারপর সোজা করল পিঠ। টের পেল, কাঁধের ওপর দিয়ে ল্যাপটপের দিকে চেয়ে আছে ওর বউ, লাবনী ও বেলা।

জানতাম, আমার কোলনের গন্ধে পাগল হয়ে ছুটে আসে মেয়েরা, চওড়া হাসি দিল জামসি। তবে কাজ করতে হলে একটু বাতাসও পেতে হবে।

সরি, পিছিয়ে গেল লাবনী। কী দেখবে ভাৰতে গিয়ে কৌতূহলে মরছে।

অনিচ্ছাসত্ত্বেও টেবিল ফ্যানের কাছ থেকে সরল বেলা।

এখনও সফল হয়নি জামসি। শুধু সামান্য বড় করতে পেরেছে ইমেজ। বেলার ক্যামেরার ভিডিয়ো মোড ডিযাইন করা ইন্টারনেট-ফ্রেণ্ডলি ছোট ক্লিপের জন্যে। জিনিসটার সাধ্য ছিল না হাই-ডেফিনেশন ফুটেজ তুলৰে। উজ্জ্বল আলোয় আবছাভাবে দেখা যাচ্ছে, এদিকে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নাদির মাকালানি ও বাবাফেমি।

রানা বুঝতে পারছে, যত শক্তিশালী সফটওয়্যার হোক, যতই চালু হোক ইউযার, ডিজিটাল ইনফর্মেশন না পেলে কিছুই করার নেই।

অবশ্য; আরেকটু পর অডিয়োর বিষয়ে কপাল খুলল জামসির। ইয়ারফোন পরে রেকর্ডিং অ্যাডজাস্ট শেষ করে ব্যবহার করছে ফিল্টার। করাতের আওয়াজ এখন সামান্য, একটা উইণ্ডোয় কম্পমান ওয়েভফর্ম দেখাল। পুরো গায়েব করতে পারছি না। তবে এখন শুনতে পাব তাদের কথা।

তুমি শুনলেই হবে? মুখ গোমড়া করল জামসির বউ। আমাদেরকে শুনতে দাও!

স্ত্রীর ধমকের ভয়ে নিজের কানের একটা ইয়ারফোন তার হাতে দিল জামসি। ওটা বুড়ো আঙুল দিয়ে মুছে নিয়ে কানে পুরল জাবাইরাহ্।

সবই দেখেছি, নালিশের সুরে বলল জামসি।

 কী দেখেছ?

এইমাত্র আমার ইয়ারবাড মুছে নিয়েছ।

চাই না তোমার কানের মোম আমার কানে ঢুকুক।

আমার কানে ওই জিনিস নেই!

হ্যাঁ, তোমরা বিবাহিত, তাতে সন্দেহ নেই, হাসল লাবনী।

অডিয়োতে কী বলছে ওরা? জানতে চাইল রানা।

কিছুক্ষণ শুনল জাবাইরাহ, তারপর বলল, ডানদিকের লোকটা বাবাফেমি, খুব চিন্তিত, সঠিক সময়ে পরিষ্কার করা যাবে কি না হল অভ রেকর্ডস। কেউ সন্দেহ করলে সব দোষ পড়বে তার কাঁধে। নালিশ করছে আসলে। আবার শুরু হলো অডিয়ো। চুপ করে শুনছে স্বামী-স্ত্রী।

আর কী বলছে লোকগুলো? জানতে চাইল বেলা।

 এখনও নালিশ চলছে! চুপ হয়ে গেল জাবাইরাহ্। একটু পর বলল, হ্যাঁ, বলছে ওসাইরিসের পিরামিডের ব্যাপারে। অন্য লোকটা, নাদির মাকালানি, সে বলছে ওটা অবশ্যই তাদেরকে পৌঁছে দেবে ওখানে। তারা… ভালভাবে শুনলাম না। ডিসপ্লের ওয়েভফর্ম লাফ দিয়েছে ড্রিল মেশিনের আওয়াজে। জামসি, পিছিয়ে যাও তো! …বলছে… গ্রহ আর নক্ষত্রের কথা… কিন্তু ঠিক শুনতে পাচ্ছি না। কীসের সঙ্গে যেন তুলনা করে দেখতে চায় যোডিয়াকের।

আবারও রেকর্ডিং চালু করল জামসি। আওয়াজ শুনতে শুনতে ভুরু কুঁচকে ফেলল বিরক্ত জাবাইরাহ্। অনেক আওয়াজ, তবে মনে হয় যোডিয়াকটা তুলনা করবে… ডেনডারা কনস্টেলেশনের সঙ্গে?

ডেনডারা নামে কোনও কনস্টেলেশন নেই, অন্তত আমি কখনও শুনিনি, বলল লাবনী।

ডেনডারা কোনও কনস্টেলেশন নয়, বলল বেলা। ওটা একসময়ে ছিল মিশরের ওপরদিকের প্রাদেশিক রাজধানী। ওখানেই আছে হাথোরের মন্দির… বুঝতে শুরু করেছে সব।

বুঝে গেছে লাবনীও। ওই লোক ডেনডারা এলাকার কথা বলেনি, বলেছে ডেনডারা যোডিয়াক!

ডেনডারা যোডিয়াক কী? জানতে চাইল রানা।

এবার বলল বেলা, ওটা টেম্পল অভ হাথোরের ছাতে একটা নক্ষত্রের মানচিত্র।

আগে মন্দিরের সিলিঙে ছিল আসল যোডিয়াক, বলল লাবনী, এখন আছে নকল। আসলটা লুঠ করেছিল সতেরো শ নব্বই সালে নেপোলিয়ন।

রেকর্ডিং পয করল জামসি। এরা তা হলে ডেনডারা যাচ্ছে? হয়তো ওদের আগেই ওখানে পৌঁছতে পারবেন।

মাথা নাড়ল লাবনী। তাতে কাজ হবে না। নকলটা প্রায় আসলের মত হলেও ওই দুটো এক জিনিস নয়। এরা চাইবে স্ফিংসের যোডিয়াকের সঙ্গে সত্যিকারের যোডিয়াক মিলিয়ে দেখতে।

ওটা আছে কোথায়, লুভর মিউযিয়ামে? আন্দাজ করল রানা।

হাসল লাবনী। হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছ!

.

১০.

 রূপসী প্যারিস। লুভর মিউযিয়াম।

অলস পায়ে মাঝের প্রাঙ্গণে কুওর (কোর্ট) নেপোলিয়ন পেরোল রানা, লাবনী ও বেলা।

কবছর পর আবার এলাম, বলল লাবনী, কীভাবে যে চড়ুই পাখির মত ফুড়ত করে বেরিয়ে যায় সময়!

পাশ কাটাল ওরা পরের কোর্টইয়াডের মাঝে সত্তর ফুটি কাঁচ ও অ্যালিউমিনিয়ামের পিরামিড। পৌঁছে গেল কারুকাজ করা নোংরা ইজিপ্ট উইঙে। তবে আজ স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি গার্ড। গত কয়েক মাসে পৃথিবীর নানান মিউযিয়াম থেকে নামকরা বেশকিছু শিল্পকর্ম লুঠ হওয়ায় সতর্ক হয়েছে। কর্তৃপক্ষ। চায় না একই ঘটনা ঘটুক লুভর মিউযিয়ামে।

ডেনডারা যোডিয়াক দেখতে হলে যেতে হবে ১২এ রুমে, টুরিস্ট গাইড ভাঁজ করে রাখল বেলা। বেশ খানিকটা দূরে। প্রথমে বাঁক নিতে হবে, ওই যে ওখানে, তারপর যেতে হবে বামে। এরপর সোজা সামনে গেলেই পৌঁছে যাব।

পুরো লুভর ঘুরব না, বলল রানা, শুধু দরকারি যোডিয়াক দেখেই বেরিয়ে যাব।

সমস্যা নেই, বলল বেলা। মোনা লিসার ছবি দেখতে দেখতে পচে গেছে চোখ। তবে অন্যসব…

হয়তো এরই মধ্যে ওসাইরিসের পিরামিডের কাছে পৌঁছে গেছে নাদির মাকালানি বা তার দলের লোক, বলল লাবনী, প্যারিসে এসে পরেও দেখতে পারবে লুভর। ওসাইরিসের পিরামিডের আর্টিফ্যাক্ট সরিয়ে ফেললে আর কখনও সেগুলোর খোঁজ পাব না। আমাদের প্রথম কাজ হওয়া উচিত সবার আগে ওখানে পৌঁছে যাওয়া।

পথে সাধারণ মিশরীয় প্যাপিরাস স্কুল থেকে শুরু করে প্রমাণ সাইজ মূর্তি ও কারুকাজ করা মন্দিরের কলাম দেখছে ওরা। তবে চুম্বকের মত টানছে ডেনডারা যোডিয়াক।

১২এ কক্ষ থেকে একটু দূরে ছোট অ্যান্টিরুম। ভেতরে একপাশে কাৰ্যাকের টেম্পল অভ আমুনের বালিপাথরের সব প্রাচীন কীর্তি। ঘরের আরেক পাশে…

ওটা মেঝেতে নেই, ঝুলছে সরাসরি ছাতে।

মুখ তুলে ওরা দেখল, নয় ফুট ওপরে পুরু কাঁচের ওদিকে ডেনডারা যোডিয়াক।

ফ্যাকাসে বাদামি পাথরের স্ল্যাব বললেও দোষ হবে না। উজ্জ্বল আলো পড়েছে ওটার ওপর। দেখা যাচ্ছে প্রতিটি খাজ-ভাঁজ। হল অভ রেকর্ডসসের যোডিয়াকের চেয়ে বড়। পাথরের আকাশে নক্ষত্রের মেলা।

ওই যে লিয়ো আর স্করপিয়ো, হারকিউলিসের খুন করা সিংহের আকৃতির নক্ষত্ররাশি এবং বৃশ্চিক নক্ষত্ররাজি দেখছে বেলা। কিন্তু আরও অনেক আছে, সেগুলো চিনলাম না।

কই, দেখছি না ঋক্ষমণ্ডল, বলল লাবনী।

আঙুল তুলে যযাডিয়াকের মাঝের একটু দূরের এক চিহ্ন দেখাল বেলা। ওই যে ওটার চিহ্ন!

ভেড়ার বাচ্চার ঠ্যাং? ভুরু ওপরে তুলল লাবনী।

প্রাচীন মিশরীয়রা ভেবেছে দেখতে ওটা অমনই, জানাল বেলা।

একইরকম আছে নক্ষত্রমণ্ডলী, বলল লাবনী, লিবরা, টরাস, এরিয… তবে খোদাই একটু অন্যভাবে। পশ্চিমা যোডিয়াক তৈরি করা হয়েছে মিশরীয়দের যোডিয়াক দেখেই। পরে সামান্য বদলে নিয়েছে নাম। ছাতে আঙুল তাক করল। যেমন ওরিয়ন বা কালপুরুষ। মিশরীয়রা ভাবত পুরাণের গুরুত্বপূর্ণ দেবতা সে।

মৃদু হাসল রানা। ওসাইরিস?

 দশে দশ দেয়া হলো তোমাকে, হাসল লাবনী।

রঙিন প্রিন্টআউট নেয়া হয়েছে যোডিয়াকের ভিডিয়ো থেকে, ওই কাগজটা খুলল বেলা। জামসি যতটা পেরেছে, বড় করেছে ছবি ও ছায়াছবি। দুধরনের ছবি দিয়েছে। একটা ভিডিয়ো ফ্রেম থেকে নেয়া সরাসরি ব্লোআপ, অন্যটায় ব্যবহার করেছে ফোটোশপ। শেষেরটা সরাসরি নিচে থেকে তোলা ছবির মত। ইমেজ নিম্ন শ্রেণীর ছিল বলে ভাল হয়নি ছবি। অবশ্য পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে স্ফিংসের যোডিয়াকের অংশ।

মাথার ওপরের যযাডিয়াকের সঙ্গে প্রিন্টআউট মেলাল বেলা। দুটো কাছাকাছি হলেও তফাৎ আছে, প্রিন্টআউটের লাল বৃত্ত কিন্তু ডেনডারা যোডিয়াকে নেই।

লাল বোধহয় মঙ্গল গ্রহকে বোঝাতে, বলল লাবনী। তবে আমার জানা নেই, গত কয়েক হাজার বছরে কতটা বদলে গেছে নক্ষত্ররাজি। কয়েক সপ্তাহ পর পর নানাদিকে সরছে পৃথিবী। একটা যোডিয়াক কখন তৈরি হয়েছে, সেটা জানতে হলে কমপিউটারে অঙ্ক কষে বের করতে হবে, কোথায় ছিল আকাশের নক্ষত্রমণ্ডলের অবস্থান। মঙ্গল যদি থাকে অ্যাকুয়েরিয়াস-এ, শনি থাকবে ক্যাপরিকর্নে… ইত্যাদি ইত্যাদি।

প্রিন্টআউট ও ছাতের যোডিয়াক মিলিয়ে দেখছে রানা। সামান্য কুঁচকে গেছে ভুরু। সেটা খেয়াল করেছে লাবনী, রানা কী ভাবছে জিজ্ঞেস করবে, এমনসময় তুড়ি বাজাল বেলা। ও-ও! এখানে তো অন্যরকম! প্রিন্টআউটের একটা প্রতাঁকে আঙুল ঠুকল। ওখানে কালো পটভূমিতে হালকা ছাপের মিল্কি ওয়ে। আমার ভুল না হলে এটা আবারও সেই ওসাইরিস। অন্য নক্ষত্রটার মতই একই রঙ। সবুজ।

ওসাইরিস কি সবুজ ভূত? হাসল লাবনী।

মিশরীয়দের ধারণা ছিল, সবুজ মানে নতুন জীবন, বলল বেলা, কিন্তু ওই লোক… আবারও আঙুল রাখল প্রতাঁকে, এখানের বড় যোডিয়াকে নেই সে।

প্রিন্টআউট ও ছাতের যোডিয়াক দেখল লাবনী, তারপর বলল, তার পাশে ওটা কে? সবুজ ওসাইরিসের পাশেই হলদে-কমলা ছোট আরেক আকৃতি। আরেকটা গ্রহ?

মনে হয় না… লো রেসোলিউশন হলেও পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে বৃত্তাকার মঙ্গল গ্রহ। কিন্তু হলদে-কমলা আকৃতি প্রায় ত্রিকোণ।

পিরামিডের মত।

না তো! হঠাৎ চমকে উঠল বেলা। কিন্তু… চুপ হয়ে গেল।

লা-জওয়াব কেন? একটু অপেক্ষার পর জানতে চাইল রানা।

ওটা… ওটা পিরামিড অভ ওসাইরিস!

তাই হবে, সায় দিল লাবনী। নিশ্চিত হতে মুখ তুলে দেখল ছাতের যোডিয়াক। বহু আগেই মুছে গেছে ডেনডারা প্রস্তর লিপির রঙ। তবে পরিষ্কার দেখা গেল খোদাই করা সব আকৃতি। ওসাইরিসের ফিগার বা ওপরের কোথাও নেই ত্রিকোণ পিরামিড। এখন স্ফিংস যোডিয়াকের নক্ষত্রমণ্ডলীর পযিশন বেরোলে, পেয়ে যাব পিরামিড অভ ওসাইরিসের লোকেশন!

কিন্তু আনমনে মাথা নাড়ছে রানা।

জানতে চাইল লাবনী, কী ভাবছ?

ওভাবে বের করা যাবে বলে মনে হয় না, বলল রানা। নক্ষত্র ন্যাভিগেট করে দেখা যেতে পারে, কিন্তু নক্ষত্রমণ্ডলীর মানচিত্র দেখে ঠিক জায়গায় পৌঁছুবে না। আগে তোমার চাই সেক্সট্যান্ট আর একটা বর্ষপঞ্জী। শুধু তাই নয়, জানতে হবে অতীতের সেই তারিখ, যখন তৈরি হয়েছে যোডিয়াক। নইলে বেরোবে না নক্ষত্রের পযিশন।

উত্তেজনা হারিয়ে গেল লাবনীর। ও?

আরও আছে। স্ফিংসের বুক থেকে যে যোডিয়াক ওরা নিয়ে গিয়ে ভাবছে, ওটা মানচিত্র, ওটা তা না-ও হতে পারে।

তাই? রানার কথা বুঝতে পারছে না লাবনী।

সম্ভাবনা খুব বেশি, ওটা নক্ষত্রমণ্ডলীর মানচিত্রই নয়। অন্য ধরনের ম্যাপ। সিলিঙের দিকে তাকাল রানা। ওই যোডিয়াকের মূল সমস্যা হচ্ছে, ওটা বহনযোগ্য নয়। কাজেই যখন যাবে ওসাইরিসের পিরামিড খুঁজতে, চাই ওই যোডিয়াকের একটা নকল। কাজেই তা তৈরি করবে কাগজে। আর তখনই হবে মস্তবড় ভুল। …লাবনী, তোমার কাছে কলম আর কাগজ আছে?

লাবনী কিছু বলার আগেই পার্স থেকে বলপয়েন্ট কলম ও ছোট প্যাড বের করে রানার হাতে দিল বেলা।

মৃদু মাথা নাড়ল রানা। নিজেই ম্যাপ তৈরির চেষ্টা করো, লাবনী। কাজটা যখন করবে, দেখব তোমার অনিন্দ্য সুন্দর মুখ।

কলম ও কাগজ নিয়ে অবাক চোখে রানাকে দেখল লাবনী। হঠাৎ রোমান্টিক হয়ে উঠলে যে?

এবার কাগজ তুলে আঁকতে শুরু করো সিলিঙের যোডিয়াক আর এই ঘর, মৃদু হেসে বলল রানা।

ঘাড় কাত করে যোডিয়াক দেখে নিয়ে ঘর দেখল লাবনী, তারপর নেমে পড়ল কাজে। কিছুক্ষণ পর বলল, হ্যাঁ, এবার কী?

ফাঁকা ঘরের শেষমাথায় গেল রানা। ধরে নিলাম এটা উত্তরদিকের দেয়াল। এবার মানচিত্রে লিখে নাও উত্তরদিক। কাগজ কিন্তু তুলে রাখবে আগের মত করেই।

ড্রয়িং করা কাগজে উত্তরদিকে এন লিখল লাবনী।

এখন ওটা যদি নর্থ হয়, অবশ্যই উল্টোদিকটা সাউথ, বলল রানা। সেটাও লিখে নাও। এবার… ডানহাত তাক করল একপাশের দেয়ালের দিকে। তার মানে এই দেয়াল পুব, আর ওদিকের দেয়াল পশ্চিম ঠিক?

হ্যাঁ, ঠিক। কাগজে পুব ও পশ্চিম লিখে নিল লাবনী। কোথাও কোনও ভুল নেই।

ওকে দেখল রানা, ঠোঁটে মৃদু হাসি। ঘড়ির কাঁটার মত ঘুরল প্রতিটি দেয়ালের দিকে। তা হলে পেলে নর্থ, ইস্ট, সাউথ ও ওয়েস্ট। সব ঠিক আছে তো তোমার ড্রইঙে?

হ্যাঁ। মটকে যাচ্ছে, এবার ঘাড় নিচু করতে পারি? নিশ্চয়ই, বলল রানা।

ঘাড় সোজা করে পাতায় নিজের অসাধারণ শিল্প দেখল লাবনী।

সমস্যা এখান থেকেই শুরু, বলল রানা, ম্যাপ ঘুরিয়ে ওটার উত্তরদিক তাক করো উত্তর দেয়ালের দিকে। কাজটা করল লাবনী। তা হলে এবার বুঝে নাও কোথায় ত্রুটি হয়েছে মানচিত্রে।

কাগজ দেখল লাবনী। ঠিকভাবেই লিখেছে প্রতিটি দিক। আরও কয়েক সেকেণ্ড দেখার পর কপালে চাপড় দিল। ও! উত্তর আছে উত্তর দিকে, দক্ষিণ আছে দক্ষিণ দিকে। কিন্তু কাগজে পুরো উল্টে গেছে পুর্ব ও পশ্চিম! বিদঘুটে সমস্যা তো!

ন্যাভিগেশন ট্রেইনিঙে শেখানো হয় এসব, বলল রানা। এতই সহজ সমস্যা, কেউ ধরিয়ে না দিলে বোঝার উপায় থাকে না।

লাবনীর কাগজের দিকে চেয়ে আছে বেলা। আমি ঠিক বুঝলাম না।

ওর হাতে কাগজ ও কলম ধরিয়ে দিল লাবনী। নিজেই বুঝে নাও।

কাগজ হাতে যোডিয়াকে চোখ রাখল বেলা।

কিন্তু ওসাইরিসের পিরামিড খুঁজতে এতে কী সুবিধা হবে? জানতে চাইল লাবনী।

সত্যি বলতে, সেটা এখনও জানি না, বলল রানা, তবে একটা কথা তো মানবে, স্ফিংসের যোডিয়াক সহজ মানচিত্র নয়? পিরামিড খুঁজতে শুরু করে নতুন করে ভাবতে হবে নাদির মাকালানিকে।

তাই তো মনে হচ্ছে।

নোটবুক নিচু করে দেয়াল দেখল বেলা। বুঝে গেছে। ও, তার মানে ওপরের যোডিয়াক আঁকতে গেলে পাল্টে যায় পুব ও পশ্চিম। পাগলের কাণ্ড!

কী যেন বলতে যাচ্ছিল লাবনী, এমনসময় ঘরের দরজায় এসে থামল সুট পরা এক অফিশিয়াল। ঝড়ের বেগে ফ্রেঞ্চ বলল সে।

ফ্রেঞ্চ ভাষা জানা আছে রানার, তবে বক্তব্য শুনে বিরক্ত হয়েছে, তাই ইংরেজিতে বলল, সরি, ইংরেজি বলুন। আমার সঙ্গে দুই ভদ্রমহিলা আমেরিকান।

ও, আমেরিকান। ইংরেজি? বুঝলাম। পাত্তা না দিয়ে বলল লোকটা, আশা করি ভাল লেগেছে লুভর মিউযিয়াম? তবে দুঃখিত, বিশিষ্ট এক ভিআইপি অনুরোধ করেছেন, একা দেখবেন ডেনডারা যোডিয়াক। কাজেই এবার আপনাদেরকে বিদায় নিতে হবে এই ঘর ছেড়ে।

ভিআইপি? মৃদু হাসল রানা। তারা তো আর আমাদের মত সাধারণ মানুষের সঙ্গে একই ঘরে থাকবেন না! তো চলে যেতেই হয়!

ঠিক কথাই বলেছ, সায় দিল লাবনী। আমাদের নাক থেকে বের হওয়া কার্বন-ডাই-অক্সাইড শেষ করে দিতে পারে তাঁদের অমূল্য জীবন! রানার বাহুতে হাত রেখে দরজার দিকে রওনা হয়ে গেল ও।

বিরক্ত চেহারায় দাঁড়িয়ে আছে মিউযিয়াম অফিশিয়াল। পাশ কাটাবার সময় বলল বেলা, আমরা আপনাদের অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছি বলে মাফ করে দেবেন, নইলে নরকেও ঠাই হবে না আমাদের।

ফ্রেঞ্চ লোকটার সরু দুই ঠোঁট চেপে বসল পরস্পরের ওপর। কয়েক সেকেণ্ড পর কাকে যেন ডাক দিল।

এদিকে মেইন হলে বেরিয়ে চমকে গেল রানা, লাবনী ও বেলা। পেছনে কয়েকজনকে নিয়ে ডেনডারা যোডিয়াকের ঘরের দিকে হেঁটে আসছে নাদির মাকালানি। পাশেই খুনে কিলিয়ান ভগলার!

খুব খুশি হলাম দেখা হয়ে, বলল রানা।

সাপের চামড়ার জ্যাকেটে হাত ভরে দিয়েছে বডিগার্ড। কিন্তু কড়া চোখে তাকে দেখল নাদির মাকালানি।

লুভর মিউযিয়ামে গোলাগুলি পছন্দ করবে না ফ্রেঞ্চ পুলিশ, সান্ত্বনা দিল রানা।

রানার দল এবং নাদির মাকালানির দলের মাঝে থমকে গেছে মিউযিয়াম অফিশিয়াল। আপনারা পরস্পরকে চেনেন?

কেউ কখনও পরিচয় করিয়ে দেয়নি, তবে পরস্পরকে চিনি, বলল রানা। ইনি সম্ভবত মিস্টার নাদির মাকালানি। সঙ্গে তাঁর প্রিয় বন্ধু কিলিয়ান ভগলার।

কারও সঙ্গে পরিচয়ের ইচ্ছে আমাদের নেই, আড়ষ্ট কণ্ঠে বলল নাদির মাকালানি, তবে ডক্টর লাবনী আলমকে ঠিকই চিনেছি। স্ফিংসের ঘরে ছিল। দুনিয়ার অনেকেই চেনে এখন। চোখ পিটপিট করে কয়েক সেকেণ্ড দেখার পর লাবনীকে চিনে ফেলল লুভর অফিশিয়াল। তার সঙ্গে ছিল বেলা আবাসি ও মাসুদ রানা। কী কারণে এসেছে, তা-ও বুঝতে পারছি।

আপনারা এখানে কেন? প্রায় ফিসফিস করে জানতে চাইল বেলা।

চোখ সরু করল মাকালানি। আপনারা এখানে কেন, ডক্টর আলম?

বোধহয় একই কাজে, বলল লাবনী, প্রাচীন নক্ষত্র নিয়ে সমান আগ্রহ আমাদেরও।

আচ্ছা! আরও কঠোর হলো লোকটার চোখ।

লাবনী ওর বাহু ধরে রওনা হতে চাইছে দেখে বলল রানা, আশা করি আবারও দেখা হবে।

এখনই বাইরে গিয়ে দেখা করি না কেন দুজন? খেপা গোখরো সাপের দৃষ্টিতে রানাকে দেখল কিলিয়ান ভগলার। বোধহয় ভুলতে পারেনি, নিতম্বে বেদম এক লাথি দিয়েছিল বাঙালি যুবক। আবারও চলে গেল তার হাত হোলস্টারের কাছে।

তার কাঁধ চাপড়ে দিল নাদির মাকালানি। অধৈর্য হয়ে, কিল। আবার হাতের কাছে পাবে ওকে। তখন আর এত ভদ্রতাও করতে হবে না।

অপেক্ষা আমিও করব, বলল রানা, ওরও হাত কোমরের কাছে। যদিও নেই ওয়ালথার পি.পি.কে.।

পাথরের মূর্তি হয়েছে মাকালানি ও ভগলার। তাদের চোখ দেখছে রানা। লাবনী ও বেলা ঘর থেকে বেরোতেই নিজেও বেরোল ঘর ছেড়ে। চাপা স্বরে বলল, চলো, সুযোগ বুঝে দলের লোককে লেলিয়ে দেয়ার আগেই বেরিয়ে যেতে হবে।

লাবনী ও বেলাকে বিপদে ফেলতে রাজি নয় ও।

পাতাল-ঘর থেকে মিউযিয়ামের পুবে প্লেস দু লুভর-এ বেরোল ওরা।

একটু দূরে রেস্ট্রিকটেড যোনে টিন্টেড জানালার কালো এক বড় মার্সিডিয এসইউভি।

নাদির মাকালানির? জানতে চাইল লাবনী।

 তাই তো মনে হয়, বিড়বিড় করল বেলা।

আমরা গোপনে পিছু নিতে পারি, বলল রানা।

এইমাত্র না খুন হয়ে যাচ্ছিলাম? আপত্তি তুলল বেলা।

রানা কিন্তু ঠিকই বলেছে, বলল লাবনী। পিরামিড অভ ওসাইরিস বের করতে হলে চাই ওই যোডিয়াক, আর সেটা আছে নাদির মাকালানির কাছে।

লাবনী ও বেলার সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে একটা কোণ ঘুরে থমকে গেল রানা। দেয়ালের পাশ থেকে উঁকি দিল পেছনের পথে। পিছু নিয়ে আসছে না কেউ।

গাড়িটা তার না-ও হতে পারে, বলল বেলা।

সেক্ষেত্রে আর কিছু করার থাকবে না, বলল রানা।

তবে নাদির মাকালানি না ভিআইপি? বলল লাবনী। তারই তো দামি গাড়ি থাকার কথা। পার্কিংলটে ওরকম আর একটাও নেই।

কথাটা চুপচাপ মেনে নিল বেলা।

নাদির মাকালানি আসবে সেজন্যে তীর্থের কাকের মত অপেক্ষায় থাকল ওরা।

দশ মিনিট পর লুভর থেকে বেরোল বিকৃত মুখের মিশরীয়। পেছনে খাস বডিগার্ড। দুজন উঠে পড়ল মার্সিডিয গাড়িতে। পেছনের গাড়িতে চাপল আরও তিনজন।

আপনাদের কি মনে হচ্ছে, ওই পিরামিড কোথায় আছে, তা জেনে গেছে এরা? জানতে চাইল বেলা।

সেটা জানতে হলেও পিছু নিতে হবে, বলল রানা।

 রওনা হয়ে গেছে এসইউভি এবং পেছনের গাড়ি।

হনহন করে হেঁটে মোড়ে পৌঁছে মাথার ওপর হাত তুলল রানা। ট্যাক্সি!

<

Super User