দেয়ালের গা থেকে বেরিয়ে আছে চার ইঞ্চি পাথর। হাত বাড়িয়ে ওটা খামচে ধরল জিম। ওপর দিকে তাকাল। তারপর উঠতে শুরু করল।

দেয়ালের মাঝে মাঝে ছোট ছোট খাঁজ, পাথর। ওগুলোতে আঙুল আর জুতোর ডগা বাঁধিয়ে উঠে চলল সে। কোথাও জন্মেছে শক্ত ঝোপ, ওগুলোও সাহায্য করছে উঠতে। পেছনে হঠাৎ গর্জে উঠল রাইফেল, একবার। পরমুহুর্তে গুলি চলল ছয়বার, দূরে গিরিপথের দিকে। কিছু একটা নিশ্চয় চোখে পড়েছিল, গুলি করেছিল বেলিন্দা, জবাব এসেছে সঙ্গে সঙ্গে।

খাড়া দেয়াল, কিন্তু আঙুল বাঁধানোর জায়গা আছে প্রচুর। ফলে উঠতে তেমন অসুবিধে হচ্ছে না। বরং এতটা তাড়াতাড়ি উঠতে পারবে ভাবেনি জিম। তার কাপড় আর পাথরের রঙ এক হয়ে মিশে গেছে। দূর থেকে সহজে আলাদা করে চেনা যাবে না। যতটা সম্ভব নড়াচড়া কম করে উঠছে সে। বেশি নড়লে শত্রুদের চোখে পড়ে যেতে পারে। সুযোগ একটা পাওয়া গেছে যখন, যে করেই হোক কাজে লাগাতে হবে এটাকে।

দু-শো ফুটমত উঠে থামল জিম। চ্যাপ্টা একটা পাথর সামান্য বেরিয়ে আছে দেয়ালের গা থেকে। আশেপাশে জন্মে আছে ছোট ছোট লতা জাতীয় গাছ। পাথরটায় উঠে বসল সে। জিরিয়ে নেবে খানিকক্ষণ।

ওপরের দিকে তাকাল। প্রায় খাড়া উঠে গেছে দেয়াল। কয়েক ফুট ওপরে দেয়ালের গায়ে চওড়া একটা ফাটল। দেয়ালের গা মসৃণ, চকচকে। পাথরের রঙ কালচে-নীল। দমে গেল জিম। জায়গাটা পার হওয়া বড় কঠিন। প্রায় অসম্ভবই মনে হলো। কিন্তু এতখানি উঠে আসার পর হাল ছেড়ে দেবে? কিছুতেই না। দুটো অসাধ্য সাধন করতে হবে এখন তাকে। ওই ফাটল বেয়ে ওঠা, এবং শত্রুর চোখকে ফাঁকি দেয়া। ওখানে কোন আড়াল নেই, শত্রুর চোখে পড়ার সম্ভাবনা ষোল আনা। চোখ তুলে কেবল এদিকে তাকালেই হয় ওদের কেউ, ঠিক দেখে ফেলবে।

দেখলে ওরা গুলি করবে। পাল্টা গুলি করে যে সে ঠেকাবে তারও উপায় নেই। তবু, ঝুঁকিটা নিতেই হবে।

চ্যাপ্টা পাথরে খাড়া হয়ে দাড়াল জিম, দেয়ালের দিকে মুখ। ভাল করে তাকিয়ে মাথার ওপরের ফাটলটা পরীক্ষা করল আরেকবার। তারপর আবার বসে পড়ল পাথরে। জুতো খুলে নিল পা থেকে। দুটোরই ফিতে এক করে বেঁধে গলায় ঝুলিয়ে নিল। বুকের ওপর ঝুলে রইল বুটজোড়া। মন শক্ত করে নিয়ে আবার উঠে চলল ওপরে।

ফাটলটায় পৌঁছে গেল সে। নিচের দিকটা ঢাল, অনেকটা পার্কের স্লিপারের মত। অতি ছোট ছোট কয়েকটা খাঁজ। ওগুলোতেই কোনমতে আঙুল বাধিয়ে ফাটলে ঢুকে পড়ল, শত্রুর রাইফেলের সামনে নিজেকে পুরোপুরি উন্মুক্ত করে দিয়ে।

পাথরের আড়াল থেকে বেলিন্দা তাকে দেখছে কিনা বুঝতে পারল না জিম। কিন্তু সে ফাটলে ঢুকে পড়তেই শুরু হলো গুলি। বার তিনেক গুলি করল বেলিন্দা, জবাব এল ডজনখানেক বুলেট দিয়ে।

সেদিকে কান দেয়ার সময় নেই জিমের, দেখারও কোন উপায় নেই। ওপরে ওঠায় মন দিল সে।

ছয় ফুট গভীর ফাটল, চওড়া কম। একটাই মাত্র উপায় আছে ওঠার। ফাটলের এক দেয়ালে পিঠ দিয়ে আরেক দেয়ালে পা ঠেসে ধরতে হবে। চাপ রাখতে হবে সারাক্ষণ। অতি ধীরে এক ইঞ্চি এক ইঞ্চি করে ওপরে তুলতে হবে পা, দেয়ালে ঠেসে রাখতে হবে পিঠ। ভীষণ কঠিন কাজ, মারাত্মক ঝুঁকি। কিন্তু উঠতে চাইলে এছাড়া আর কিছু করারও নেই।

একপাশের দেয়ালে পিঠ রাখল জিম। বাঁ পা তুলে চেপে ধরল উল্টোদিকের দেয়াল, শক্ত করে ফেলল শরীরটা। ডান পা তুলল, বাঁ পায়ের ফুটখানেক ওপরে। চেপে ধরল দেয়ালে। পেছনে পিঠের চাপ রেখে মসৃণ দেয়ালে ঘষটে তুলে ফেলল শরীরটা কয়েক ইঞ্চি। বা পা তুলল আবার ফুটখানেক। ইঞ্চি ইঞ্চি করে উঠে চলল সে। নিচে তাকানোর সাহস নেই। জানে, পা ফসকালে কি ঘটবে। আছড়ে পড়বে ফাটলের তলায়, স্লিপারে পিছলে উড়ে গিয়ে পড়বে দু-শো ফুট নিচে।

নিচে তো তাকালই না, কি ঘটবে ভাবতেও চাইল না সে। ঘামছে দরদর করে। কপালের ঘাম ফোটা ফোটা ঝরে পড়ছে চোখে, জ্বালা করছে। সড়সড় কর ঘাম ঢুকে যাচ্ছে বুকে, পেটে। উলের শার্টের তলায় অস্বস্তিকর এক অনুভূতি।  শত বাধা সত্ত্বেও উঠে চলল ধীরে ধীরে।।

প্রতিটি মুহূর্তকে একেকটা যুগ বলে মনে হচ্ছে জিমের। সময়ের হিসেব রাখতে পারছে না, প্রয়োজনও মনে করছে না। ভাবনা একটাই, ওপরে উঠে যাওয়া। কিন্তু মনের সেই জোরও হারাল একসময়। বিচিত্র একটা ইচ্ছে হতে লাগল, পা সরিয়ে এনে শরীরটাকে ছেড়ে দিতে। এরপর যা হয় তোক। এই কষ্টের চেয়ে মরাও যেন এখন মহাশান্তি।

জোর করে ইচ্ছেটাকে দমন করল সে। ওপর দিকে তাকাল। আরি, পৌঁছে গেছে তো! আর মাত্র ফুট বিশেক বাকি।

নতুন উদ্যমে আবার উঠতে লাগল। কিন্তু ফুট দুয়েক ওঠার পরই উদ্যম শেষ। অবশ হয়ে গেছে পিঠের মাংসপেশী। আর মাত্র আঠারো ফুট, কিন্তু মনে হতে লাগল আঠারো মাইল।

আরেক ফুট উঠেছে, এই সময় গর্জে উঠল আবার রাইফেল। কয়েক ইঞ্চি দূরে শাট করে এসে লাগল বুলেট, চিলতে উঠে গেল পাথরের! ভীষণ চমকে গেল জিম, পায়ের চাপে ঢিল পড়ল। সড়সড় করে নেমে চলে এল ফুটখানেক। ধড়াস ধড়াস করছে বুকের ভেতর। প্রাণপণ চেষ্টায় পায়ের চাপ আবার বাড়িয়ে পতন রোধ করল কোনমতে। হৎপিণ্ডটা এত জোরে লাফাচ্ছে, ভয় হচ্ছে ওটার ঝাঁকুনিতেই নিচে পড়ে যাবে।

আর নিচের দিকে না তাকিয়ে পারল না সে। প্রায় তিনশো ফুট নিচের দিকে তাকিয়ে মুখ বাঁকাল নিজের অজান্তেই। পড়লে কি দশা হবে আন্দাজ করতে পারছে। ভর্তা হয়ে যাবে শরীরটা। বেলিন্দাও হয়তো তখন তার কুৎসিত লাশটার দিকে তাকিয়ে শিউরে উঠবে।

বেলিন্দাকে কথা দিয়ে এসেছে সে, মরবে না। অপেক্ষা করতে বলে এসেছে। জীবনে কখনও প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করেনি জিম। যাকে যা কথা দিয়েছে অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে। বেলিন্দার সুন্দর মুখটার কথা মনে পড়তেই সাহস ফিরে এল মনে। নতুন উদ্যমে আবার পা বাড়াল ওপর দিকে।

ঠিক এই সময় আবার গুলির শব্দ।

চড়াৎ করে মুখের কয়েক ইঞ্চি দূরে পাথরের চিলতে উঠে গেল। গিরিপথের দিক থেকে ভেসে এল সম্মিলিত চিৎকার। গর্জে উঠল রাইফেল। বেলিন্দা গুলি করছে। হটানোর চেষ্টা করছে ডাকাতগুলোকে।

একনাগাড়ে কয়েকবার গুলি চালানোর পর চুপচাপ। হয়তো ম্যাগাজিনে নতুন গুলি ভরছে বেলিন্দা।

প্রাণপণে উঠে চলল জিম।

হঠাৎ যেমন থেমে গিয়েছিল, তেমনি হঠাৎই আবার গর্জে উঠল রাইফেল। পাথরের আড়াল থেকে লোকগুলোকে বেরোতেই দিচ্ছে না বেলিন্দা। ভাল নিশানা করার সুযোগ দিচ্ছে না। তাহলে জিমকে মিস করত না।

বেলিন্দার গুলির পাল্টা জবাব দিতে লাগল ওরা। তবে অযথা! কিছুই যে করতে পারছে না, লাগাতে পারছে না, বোঝা যাচ্ছে।

হঠাৎ থেমে গেল গোলাগুলি। একেবারে নীরব। ভয় পেয়ে গেল জিম। গুলি খেলো না-তো বেলিন্দা! না তাকিয়ে আর পারল না সে। দেখল, পাথরের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল বেলিন্দা। গুলি খায়নি। সামান্য কুঁজো হয়ে ছুটল গিরিপথের দিকে। ছুটতে ছুটতেই গুলি চালাল।

তাকে কভার দেয়ার জন্যে মস্ত ঝুঁকি নিয়ে ফেলেছে বেলিন্দা। ওরা গুলি করলেই এখন মেরে ফেলতে পারে। তারপর বড়জোর আর একটা গুলি, ব্যস, জিমও শেষ।

গায়ে যেন অসুর ভর করল এসে জিমের। কি করে এর পরের কয়েকটা ফুট উঠল, বলতে পারবে না। হঠাৎ বাতাসের হালকা পরশ লাগল গালে। মুখ ফিরিয়ে চেয়ে দেখল চূড়ায় পৌঁছে গেছে।

উপত্যকার দিক থেকে রাইফেল গর্জে উঠল একবার। শাট করে এসে চুড়ার কিনারে লাগল বুলেট। পাথরের চিলতে ছিটিয়ে তীক্ষ্ণ শিস কেটে বেরিয়ে গেল।

থাবা মারল জিম। আকড়ে ধরল ফাটলের কিনারা। জোরে একবার দোলা দিয়ে শরীরটাকে ডিগবাজি খাওয়াল। মিস করলেই গিয়েছিল। কিন্তু করল না।

আছড়ে এসে পড়ল চুড়ার পাথুরে সমতলে।

হাত-পা কাঁপছে থরথর করে। শরীর অবশ। বুকের খাঁচায় প্রচণ্ড লাফালাফি করছে হৃৎপিণ্ডটা। শুয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে। কিন্তু নষ্ট করার মত সময় নেই। জিরানোর সময়ও নেই। তাকে বাঁচাতে প্রাণের ঝুঁকি নিয়েছে বেলিন্দা।

হামাগুড়ি দিয়ে কয়েক ফুট সরে এল জিম। উঠে দাঁড়াল। মাথা ঘুরছে, টলছে শরীর।

মাথা ঝাড়া দিয়ে জড়তা দূর করার চেষ্টা করল সে। আশপাশে, নিচে তাকাল। দক্ষিণে অনেক দূরে চোখে পড়ছে টাকার শহর।

বসে গলায় ঝোলানো বুট খুলে নিয়ে পরল। নামতে শুরু করল ঢাল বেয়ে।

নামতে বিন্দুমাত্র অসুবিধে হচ্ছে না। এখনও কাঁপছে হাত-পা, কেয়ার করল না। লাফিয়ে লাফিয়ে নেমে চলল দ্রুত। লক্ষ্য দক্ষিণে। শহরে পৌঁছতে হবে।

মনে পড়ল, নিচে কোথাও রয়েছে ঝর্নাটা। একটা গিরিসঙ্কটের ভেতর দিয়ে বয়ে গিয়ে বেরিয়েছে উপত্যকায়। তৃণভূমিকে দুভাগ করে এগিয়ে গেছে মরুভূমির দিকে। এখান থেকে দেখা যায় না ওটা।

নিচে, দক্ষিণে তাকাল জিম। একটা মালভূমি চোখে পড়ছে। সিডার গাছের ঘন জঙ্গল। ওটার ওপারেই নিশ্চয় রয়েছে ঝর্নাটা। তারপরেই চলে গেছে পায়ে চলা পথ, শহরের দিকে।

একটা ঘোড়া হলে অতি সহজেই পৌঁছে যেতে পারত শহরে। কিন্তু নেই যখন হেঁটেই যেতে হবে। পাহাড়ী পথ ধরে শর্টকাটেও দূরত্ব দশ মাইলের কম হবে না। পথটা পেরোতেই হবে, শহরে পৌঁছে দেখা করতে হবে উকিলের সঙ্গে।

বেলিন্দা কি বেঁচে আছে! আর কোন গুলির শব্দ নেই কেন? মেরে ফেলল না তো?

দরদর করে ঘামছে জিম, হাঁপাচ্ছে জোরে জোরে। থেমে রুমাল বের করল পকেট থেকে। কপালের ঘাম মুছল। সামনেই কয়েক গজ নিচে গিরিসঙ্কট। এপাশের দেয়াল তত খাড়া নয়, মোটামুটি ঢালু।

শুয়ে পড়ল জিম। গড়াতে শুরু করল ঢাল বেয়ে। গড়াতে গড়াতেই নেমে এল নিচে। কনুই আর হাঁটুর কাছে কাপড় ছিড়ে গিয়ে চামড়া ছিলে গেছে। কাঁটালতায় লেগে কেটে গেছে মুখের চামড়া, রক্ত বেরোচ্ছে। কিন্তু গ্রাহ্যই করল না সে। নিচে নেমেই ছুটতে শুরু করল সামনের মালভূমির দিকে।

আধ ঘণ্টা পর। রক্ত আর ঘামে কালচে হয়ে গেছে শার্টের জায়গায় জায়গায়। গিরিপথ চওড়া হয়ে এল সামনে হঠাৎ একটা মোড় নিয়েই শেষ হয়ে গেল। সামনে বিস্তৃত মালভূমি। ধুলো উড়ছে। কেউ আছে নিশ্চয়।

গিরিপথের মুখের কাছে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ল জিম। হামাগুড়ি দিয়ে চলে এল একটা ঝোপের আড়ালে। কান খাড়া।

বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। কথা বলে উঠল কেউ, ‘আর কোন সাড়াশব্দ নেই ওদের! কি হলো?’

‘কি জানি?’ জবাব দিল আরেকটা কণ্ঠ। হালকা গলা, নাকে লাগিয়ে কথা বলে। ‘হয়তো দূরে কোথাও চলে গেছে। এতদূর থেকে এখানে পৌঁছাচ্ছে না গুলির আওয়াজ।’

‘চলো শেরিফ,’ বলল প্রথম কণ্ঠটা। ‘গরম খুব বেশি এখানে। চলো, হার্ভে র্যাঞ্চের কুয়া থেকে পানি খেয়ে আসি।’

উঠে দাঁড়াল জিম। বেরিয়ে এল খোলা জায়গায়। ‘শেরিফ, একটু দাঁড়ান। আমাকে খুঁজছিলেন?’

লম্বা মানুষ শেরিফ। ধূসর চুল। ইয়া বড় গোঁফ, চোখা হয়ে গালের ওপর উঠে গেছে দু-দিকের প্রান্ত। নীল চোখে ঈগলের দৃষ্টি। ‘বোম্যান? চেহারায় অবশ্য তাই মনে হচ্ছে। হ্যাঁ, তোমাকেই খুঁজছি। কিন্তু যেচে এসে ধরা দেবার এত সাধ কেন?’

দ্রুত কারণ ব্যাখ্যা করল জিম। বেলিন্দা গ্যাটলিনকে আটকে রেখেছে ওরা। ‘শেরিফ, জলদি চলুন আমার সঙ্গে, প্লীজ! জলদি…’

‘কে আটকেছে?’ তীক্ষ্ণ চোখে জিমকে দেখছে শেরিফ। ‘ড্যাগা গালুশ আর তার দল।’

 ‘ড্যাগা? এই একটু আগে তাকে টাকারের দিকে চলে যেতে দেখলাম।’

‘তাহলে তো আরও তাড়াতাড়ি করতে হবে। নিশ্চয় উকিলের কাছে টাকা জমা দিতে গেছে। আর কয়েক ঘণ্টা পরেই শুরু হবে নিলাম! আনমনে বিড় বিড় করল জিম, বেলিন্দাকে ওরা মারবে না। শুধু সন্ধ্যা পর্যন্ত আটকে রাখবে।’ শেরিফের দিকে তাকাল। ‘শেরিফ, প্লীজ, আপনি যান। বেলিন্দাকে নিয়ে আসুন। আর দয়া করে আমার সঙ্গে একজন লোক দিন। টাকারে যেতে হবে।’

‘কি হবে টাকারে গিয়ে? ভুরু কোঁচকাল শেরিফ।

‘বেলিন্দা গ্যাটলিনের নামে টাকা জমা দেব। র্যাঞ্চটা কিনতে হবে। দু’ দু-বার আমার প্রাণ বাঁচিয়েছে সে। তার জন্যে কিছু করতে চাই…’

‘কিন্তু তোমাকে তো জেলে ভরা হবে। জিম স্যাবারকে খুন করেছ…’

‘আমি করিনি। সে সব কথা পরে হবে, শেরিফ। আগে আমার কথা শুনুন, লোক দিন। আপনি যান, বেলিন্দার কোন ক্ষতি হওয়ার আগেই…’

 ‘বেলিন্দাকে বড়জোর আটকে রাখবে ওরা। র্যাঞ্চ কিনে এ-অঞ্চলেই বাস করতে হবে ড্যাগাকে। মেয়েমানুষ খুন করলে কেউ সহ্য করবে না, টিকতেই পারবে না সে এখানে…’

‘ঠিক আছে, তার ব্যাপারে যা ভাল বোঝেন করুন। লোক দিন আমাকে। দেরি হয়ে গেলে নিলাম শুরু হয়ে যাবে। আমার কাছে দশ হাজার ডলার আছে। ওটা উকিলের হাতে পৌঁছে দিই আগে। তারপর আমাকে জেলে ভরেন, যা-ই করেন, কোন আপত্তি নেই।’

হাড়ি-সর্বস্ব চিবুকে হাত বোলাল শেরিফ। ‘অনেক দিন আগে আমাকে সঙ্গে নিয়েই এখানে এসেছিল বিল হার্ভে। আমিই তাকে পছন্দ করে দিয়েছিলাম জায়গাটা, র্যাঞ্চ করার জন্যে। সে কি চাইত, খুব ভাল করেই জানি আমি।’ হঠাৎ ফিরল সহকারীর দিকে, ‘হোরউইক, হার্ভে-র্যাঞ্চ তো তুমি চাও না, নাকি?’

‘না, শেরিফ, মাথা নাড়ল হোরউইক। বুড়ো হার্ভের দীর্ঘশ্বাস মঙ্গল আনবে না আমার। টাকা আছে, খরচ করব। চোর ডাকাত দমন করব। আর কিছুই চাই না আমি। তোমার সহকারী হয়ে থাকাই পছন্দ আমার। জীবনে একঘেয়েমী থাকে না।’

‘তাহলে আজ আর কুয়ার পানি খেতে পারছ না। এই ছেলেটাকে নিয়ে যেতে হবে। উকিলের কাছে টাকা পৌঁছে দেয়ার পর নিয়ে গিয়ে হাজতে ভরবে।’

লম্বা হালকা-পাতলা লোক হোরউইক। নিচের দিকে ঝুলে পড়া চোয়াল। শেরিফের দিকে চেয়ে মাথা ঝাঁকাল। ‘কুয়ার পানি খুব খেতে ইচ্ছে করছিল। ঠিক আছে, তুমি যখন বলছ, আরেক দিন খাওয়া যাবে। জরুরী কাজটাই সারি আগে।’ জিমের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এসো হে, স্যাবারই হও আর বোমানই হও, জিমটা তো ঠিক। ওই নামেই ডাকব। চলো, যাই।’

ঘোড়া দেয়া হলো জিমকে। দলের অন্যদের নিয়ে গিরিসঙ্কটের দিকে রওনা হয়ে গেল শেরিফ।

জিমকে নিয়ে হোরউইক চলল টাকারে! 

ফ্যাকাসে-সবুজ সেজঝোপ আর সিডারের জঙ্গল পেরিয়ে এল ওরা। নামল মালভূমি থেকে। সামনে মরুভূমি।

‘এদিক দিয়ে গেলে তাড়াতাড়ি হবে,’ বলল হোরউইক। ‘এখানে সহজে কেউ আসতে চায় না, তাই কারও ওত পেতে থাকার ভয় কম।’

ঠিক দুপুর। ঝা ঝা করছে রোদ। আগুন ছড়াচ্ছে যেন সূর্য। আগে আগে চলেছে হোরউইক, শুরুতে কয়েকবার ঘন ঘন পেছনে ফিরে তাকাল। দেখল, জিম আসছে কিনা।

অবাকই হলো জিম। তাকে যেন একটু বেশিই সুযোগ দিচ্ছে লোকটা! পালানোর সুযোগ? সে পালায় কিনা পরীক্ষা করছে নাকি?

হোরউইক যা ভাবে ভাবুক, জিমের কিছু না। একজন সঙ্গী আর ঘোড়া পেয়ে গিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে সে। তার এখন একটাই উদ্দেশ্য, তাড়াতাড়ি টাকারে গিয়ে উকিলের সঙ্গে দেখা করা।

দ্রুত এগিয়ে চলল দুই ঘোড়সওয়ার। চোখের সামনে নাচছে বাতাস, তাতে এক ধরনের অদ্ভুত ঝিলিমিলি। মরুভূমিতে প্রচণ্ড রৌদ্রতাপের ফলে ঘটে এটা। একবিন্দু হাওয়া নেই। স্থির হয়ে আছে বালির সমুদ্র গনগনে চুল্লির ওপর দিয়ে ছুটে চলেছে যেন দুটো ঘোড়া।

গতি একটু কমিয়ে জিমের পাশে চলে এল হোরউইক। ‘বেশি জোরে চালিও না হে, ঘোড়াগুলো সইতে পারবে না। এরা মরলে আমরাও মরব।’

কয়েক কদম পাশাপাশি হাঁটল দুটো ঘোড়া। ফিরে তাকাল আবার হোরউইক। আমার মনে হয়, লোকটা তুমি সই। পালিয়ে যাওয়ার যথেষ্ট সুযোগ দিয়েছি, যাওনি।’ হাসল। ‘ভালই করেছ। বেশিদূর যেতে পারতে না। গুলি করে কখনও মিস করেছি কিনা, মনে নেই।’

‘পালানোর কোন কারণ নেই আমার,’ জবাব দিল জিম। ‘কোন অন্যায় করিনি। জীবনে প্রথম এসেছি টাকারে। গোলমালে জড়িয়ে পড়েছি যে, এটা নিতান্তই একটা দুর্ঘটনা।’

পরের আধমাইল পাশাপাশি এগোল ওরা। নীরবে।

সামনে পাথর আর টিলার ছড়াছড়ি। কপালে হাত রেখে রোদ বাঁচিয়ে তাকাল দু-জনেই। হলুদ মাটির একটা টিলার পাশে কয়েকটা গাছ। বড় একটা গাছের ডালে বসে আছে ছয়টা বিশাল কুৎসিত পাখি, মরুর শকুন।

‘মড়া দেখেছে,’ বলল হোরউইক। ‘এসো তো, দেখেই যাই কি দেখল?’

সামান্য মোড় নিয়ে এগোল ওরা। শ-দুয়েক গজ এসে রাশ টেনে দাড় করাল ঘোড়া।

সিডার গাছগুলোর ঘেরের ভেতরে বালিতে ছড়ানো একটা গর্ত, বিশাল পিরিচের মত দেখতে। ওটাতে পড়ে আছে একটা ঘোড়া। ছিড়েখুঁড়ে ফেলেছে শকুনের দল। ঘোড়াটার চামড়ার রঙ ধূসর। বাঁকানো ধারাল ঠোট দিয়ে মাংস ছিড়ে খাচ্ছে এখনও কয়েকটা শকুন। আগন্তুকদের দেখে বিশাল ডানা ঝাপটে উড়ে গিয়ে বসল গাছে।

ছিন্নভিন্ন ঘোড়াটার দিকে চেয়ে বালিতে থুথু ফেলল হোরউইক। জিম স্যাবারের ঘোড়া। ওই যে, জিনটা পড়ে আছে।

এগিয়ে গিয়ে পিরিচটার চারপাশে একবার চক্কর দিল দুজনে। হঠাৎ হাত তুলে দেখাল জিম। দেখুন, এখানে মরেনি স্যাবার! হামাগুড়ি দিয়ে চলে গেছে!

‘হ্যাঁ,’ হোরউইক গম্ভীর। ‘তবে বেশিদূর যেতে পারেনি, বোঝা যায়। অনেক বেশি রক্তক্ষরণ হয়েছে, দেখতে পাচ্ছ?’

ঘোড়া থেকে নামল দু-জনে। মুখ থমথমে। কি দেখতে পাবে, জানা আছে। এগোতে চাইছে না। দেখতে চাইছে না বীভৎস দৃশ্যটা।

কিন্তু দেখা দরকার। অবশেষে কাঁধে ঝোলানো রাইফেল খুলে নিল হোরউইক। জিম স্যাবার আমার বন্ধু ছিল, নিজেকেই বোঝাল যেন সে। কি হলো ওর, দেখতেই হচ্ছে।

প্রচুর চিহ্ন রেখে গেছে বালিতে। সহজেই এগোনো গেল।

দু-বার হুমড়ি খেয়ে পড়ে বিশ্রাম নিয়েছে আহত লোকটা। বেশ অনেকক্ষণ করে। বালিতে শুকিয়ে আছে কালচে রক্ত।

 এক জায়গায় ছেড়া শার্ট পাওয়া গেল। থেমে শার্ট ছিড়েছে সাবার। ক্ষতস্থানে ব্যান্ডেজ বেধেছে।

চিহ্ন ধরে ধরে এগিয়েই চলল ওরা। সামনে টিলা। পথ রোধ করে দাঁড়িয়েছে খাড়া দেয়াল। সমান করে চেঁছে ফেলা হয়েছে যেন দেয়ালটা। এটা বেয়ে উঠে ওপাশে যাওয়ার কোন উপায় নেই।

‘হাত তুলল হোরউইক, দাঁড়াও।’ আঙুল তুলে নিচে দেখাল, ‘ওই দেখো।’

বালিতে জুতোর ছাপ, হামাগুড়ি দিয়ে যাওয়া আহত লোকটার পাশে পাশে এগিয়ে গেছে।

খুদে একটা সেজঝোপের কাছে এসে দাঁড়াল দুজনে। রক্তের ছিটে শুকিয়ে আছে ফ্যাকাসে-সবুজ লতাপাতায়। ঝোপের পাশে এক জায়গায় বালি সামান্য ডেবে গেছে। তার পাশেও জুতোর ছাপ। একটা ছাপের গোড়ালি বেশি গভীর হয়ে বসেছে বালিতে।

 চোয়াল শক্ত হয়ে গেছে হোরউইকের। ওই ছিটানো রক্ত আর জুতোর গোড়ালি বেশি ডেবে যাবার একটাই ব্যাখ্যা। পাশে পাশে এগিয়ে এসে এখানে থেমেছিল খুনী। লাথি মেরেছিল আহত লোকটাকে।

বেশি দূর আর এগোতে পারেনি। তবু, আহত লোকটার স্নায়ুর জোর বোঝ গেল। কোন বাধাই তার এগোনো থামাতে পারেনি।

 টিলার খাড়া দেয়ালের ধার ঘেঁষে জন্মে আছে সেজঝোপ, কোথাও ঘন, কোথাও পাতলা। আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে নানা আকারের পাথর।

ঠিক দেয়ালের গা থেকে তেরছা হয়ে বেরিয়ে থাকা ঘন একটা ঝোপের নিচে পাওয়া গেল লোকটাকে। মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। এখানে পৌঁছেও বেশ কিছু সময় হুঁশ ছিল তার, আশেপাশের চিহ্ন দেখে বোঝা যায়। বাঁচবে না, এটা বুঝেছিল জিম স্যাবারও, তবে মৃত্যুর পর কিংবা অধমৃত অবস্থায়ই যাতে শকুনে টেনে ছিড়তে না পারে, সেজন্যেই এই কষ্টটা করেছে সে।

হঠাৎ ঘুরে দাঁড়াল হোরউইক। তাকাল জিমের দিকে। সাদাটে-ধূসর চোখ দুটো বরফের মত শীতল। ‘জুতোর ছাপের পাশে গিয়ে দাঁড়াও দেখতে চাই আমি!’ রাইফেল তুলে নিয়েছে। নলটা চেয়ে আছে জিমের পেটের দিকে। পাথরের মত স্থির হয়ে আছে রাইফেল ধরা হাত।’

হোরউইকের চোখ থেকে চোখ সরিয়ে নিল জিম। অস্বস্তি বোধ করছে। বুঝতে পারছে, কি অসামান্য এক ব্যক্তিত্বের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে, প্রয়োজনে কতখানি ভয়ঙ্কর হতে পারে এই লোক। স্যাবারের খুনী নয় বলে মনে মনে নিজের ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিল সে।

হোরউইকের রাইফেলের দিকে চোখ রেখে ধীরে ধীরে পিছিয়ে গেল জিম। জুতোর ছাপের পাশে দাঁড়াল। ওর জুততার সঙ্গে মিলে গেলেই সর্বনাশ।

কিন্তু না, মিলল না। তার জুতোর যে ছাপ পড়ল তার চেয়ে ইঞ্চিখানেক বড় খুনীর জুতোর ছাপ। সোলও অন্যরকম। হাঁপ ছাড়ল সে।

‘হুঁ,’ আস্তে আস্তে মাথা দোলাল হোরউইক। ‘মিলছে না। কিন্তু আরও শিওর হতে চাই। কি করে হব…’ গাল চুলকাতে শুরু করল সে।

‘বাধা দিয়ে জিম বলল, দেখুন, দেয়ালে কি যেন লেখা…’

জিমের দিক থেকে চোখ সরাল না হোরউইক। চালাকির চেষ্টা করছে কিনা বুঝে নিল রাইফেলের নলের মুখ একটুও না সরিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল দেয়ালের দিকে। মিথ্যে বলেনি জিম, সত্যিই কিছু লেখা রয়েছে।

এগিয়ে গিয়ে টিলার গোড়ায় দাঁড়াল দু-জনে। স্যাবার যে ঝোপটায় পড়ে আছে, তার সামান্য দূরে সুেট পাথরের কালচে দেয়ালে সাদাটে পাথরের চোখা মাথা দিয়ে লেখাঃ

ড্যাগা আমাকে খু

অসমাপ্ত রয়ে গেছে বাক্যটা। এর বেশি আর লিখতে পারেনি। মারা গেছে।

আগুন ঝিলিক দিয়ে উঠল হোরউইকের চোখে। স্যাবারের লাশটার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কিছু মনে কোরো না, বন্ধু, আরও কয়েকটা ঘন্টা থাকতে হবে তোমাকে এখানে। জিমের দিকে ফিরল, চলো। ড্যাগাকে দরকার আমার!’

চূড়ায় উঠে জিমকে অদৃশ্য হয়ে যেতে দেখল বেলিন্দা। তাকে সুযোগ দেয়ার জন্যে পাথরের আড়াল থেকে বেরিয়েছিল। প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে গুলি করতে করতে ছুটেছিল সামনে। সহজেই তাকে গুলি করে মেরে ফেলতে পারত তখন ড্যাগার লোকেরা। মারেনি। কেন? আরেকটা পাথরের আড়ালে আবার লুকিয়ে পড়ার সুযোগ কেন দিল?

হঠাৎ বুঝে গেল বেলিন্দা কারণটা। আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা সময় আছে, এর মধ্যে টাকা দিতে না পারলে শুরু হয়ে যাবে নিলাম ডাকা। ড্যাগা নিশ্চয় চলে গেছে। বেলিন্দাকে আটকে রাখার নির্দেশ দিয়ে গেছে দলের লোকদের।

জিম বেরিয়ে গেছে, কিন্তু ঘোড়া নেই। হেঁটে যেতে হবে। অনেক সময় লাগবে তাতে। নিলাম ডাকা শুরু হবার আগে কিছুতেই পৌঁছুতে পারবে না টাকারে। তাছাড়া শেরিফের লোকেরাও ছড়িয়ে পড়েছে। ধরা পড়ে যাবে জিম।

এতক্ষণে পরিষ্কার হলো বেলিন্দার কাছে, ওদেরকে মারার ইচ্ছে ছিল না ড্যাগার। চালাকি করে এনে ঢুকিয়েছে এই বক্স ক্যানিয়নে। আটকে রেখে সময় নষ্ট করার জন্যে এবং সফল হয়েছে সে।

আর কোন আশা নেই হার্ভে-র্যাঞ্চ পাওয়ার। নিজের অজান্তেই বুক ভেঙে বেরিয়ে এল দীর্ঘশ্বাস।

টাকারের পথে আজ লোক চলাচল বেশি। সাধারণত এতটা থাকে না। উকিলের অফিসের সামনে ভিড়।

ঘোড়া থেকে নামল জিম এবং হোরউইক। ঘোড়া দুটো বাধল খুঁটির সঙ্গে।

‘তুমি ভেতরে যাও,’ জিমকে বলল হোরউইক। ‘উইনচেস্টারের গায়ে থাবা দিল। আমি ড্যাগাকে খুঁজতে যাচ্ছি।’

‘আমি আসব সঙ্গে?’ বলল জিম।

‘যাও তো, নিজের কাজ সারোগে,’ ধমক লাগাল হোরউইক। ‘বুড়ো হয়েছি বটে। কিন্তু ড্যাগার মত একটা শয়তানকে সামলাতে কারও সাহায্য লাগবে না আমার।’

সুইং তোর ঠেলে খুলে ঘরের ভেতর পা রাখল জিম।

বিরাট ডেস্কের ওপাশে বসে আছেন এক বৃদ্ধ। লম্বা, রোগাটে শরীর। ধূসর হয়ে এসেছে চুল। চোখ তুলে তাকালেন।

‘আপনি উকিল বেন রাউনি?’ জিজ্ঞেস করল জিম।

মাথা ঝাঁকালেন বৃদ্ধ।

এগিয়ে গিয়ে টেবিলের সামনে দাঁড়াল জিম। কোমরের বেল্টের গোপন ভাঁজ থেকে বের করল একতাড়া নোট! টেবিলের ওপর রেখে ঠেলে দিল। ‘এখানে দশ হাজার আছে। হার্ভে-র্যাঞ্চের জন্যে প্রথম কিস্তি। নাম বদলে বেলিন্দা অ্যাণ্ড বোমান র্যাঞ্চ লিখুন।’

উজ্জল হলো বেন রাউনির চোখ। ‘তুমি মেয়েটার পার্টনার? ওর হয়ে টাকা জমা দিচ্ছ?’ জবাবের অপেক্ষা না করেই বললেন, ‘বেশ বেশ। খুব খুশি হলাম। তুমি ছেলে একটা কাজের কাজই করলে।’

‘নামেই শুধু পার্টনার,’ বলল জিম। ‘দলিলে আমার নাম লিখবেন না।

‘বেলিন্দার একজন সাহায্যকারী দরকার, সাহায্য করছি আমি, ব্যস।’

নোটের তাড়া টেনে নিয়ে গুণলেন উকিল। ড্রয়ারে রেখে চাবি আটকালেন। সামনে ঝুঁকে মাথা সামান্য কাত করে তাকিয়ে হাসলেন। ‘বেলিন্দাকে তুমি ভালবাস, না?’

ঘাড় চুলকাল জিম। হেসে মাথা ঝাঁকাল।

‘কিন্তু স্যারকে খুন করতে গেলে কেন?’

সোজা হয়ে গেল জিম। হাসি চলে গেল মুখ থেকে। ‘কে বলেছে?’

‘ড্যাগা গালুশ। এই তো মিনিট বিশেক আগে এসেছিল। বলল সব কথা।’

‘মিথ্যে বলেছে?’

সংক্ষেপে উকিলকে জানাল সব জিম। লাশটা কোথায় পড়ে আছে তা-ও বলল।

মাথা দোলালেন উকিল। ‘হুঁ, আমারও এরকমই একটা সন্দেহ হচ্ছিল। ড্যাগার কথা বিশ্বাস করিনি। বুড়ো হার্ভেও দুর্ঘটনায় মরেনি, ও-ই খুন করেছে। যাক, শেষ পর্যন্ত নিতে পারল না র্যাঞ্চটা… আচ্ছা, এখন এসো। জরুরী কিছু কাজ আছে।’

উকিলকে ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে এল জিম। গালে হাত বোলাল একবার। বিচ্ছিরি খোঁচা খোঁচা দাড়ি। না কামালেই নয়।

চোখের ওপর হ্যাটের কানা টেনে নামাল হোরউইক, রোদ বাঁচানোর জন্যে। তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল একবার ডানে, একবার বাঁয়ে। অনেক লোক আছে পথে, ওদের মধ্যে দেখা গেল না ভ্যাগাকে। উকিলের অফিসের সামনে ভিড় বাড়ছে। নিলাম দেখতে এসেছে। ওরা জানে না, হার্ভে-র্যাঞ্চের জন্যে আর নিলাম ডাকা হবে না।

একটা লোককে ধরে জিজ্ঞেস করল হোরউইক, ড্যাগাকে দেখেছে কিনা।

লোকটা জানাল, বিশ-পঁচিশ মিনিট আগে উকিলের অফিসে ঢুকেছিল ড্যাগা। তারপর বেরিয়ে গেছে। কোথায় গেছে, জানে না।

দ্রুত হেঁটে চলল হোরউইক। পাথর বিছানো পথে ভারি বুটের মশমশ শব্দ হচ্ছে। হাতের রাইফেলটা বাকা করে আড়াআড়ি ধরে রেখেছে বুকের ওপর। যেন মানুষখেকো বাঘের সন্ধানে বেরিয়েছে সে, ঝোপের আড়াল থেকে জানোয়ারটা লাফ দিলেই গুলি চালাতে প্রস্তুত। মুখ-চোখ শান্ত, শুধু ঠোঁটজোড়া চেপে বসেছে একটা আরেকটার সঙ্গে।

এখানে ওখানে কিছুক্ষণ ড্যাগাকে খুজল সে। না পেয়ে শেষে চলে এল বাজারে।

এক জায়গায় একসারিতে কয়েকটা দোকান। বড় একটা দোকানের সামনে এসে দাঁড়াল হোরউইক। জোরে ধাক্কা দিয়ে খুলল সুইং ডোর। ঘরের সব কটা মুখ একসঙ্গে ঘুরে গেল দরজার দিকে। ড্যাগা নেই এখানেও।

‘ড্যাগা গালুশকে দেখেছ কেউ?’ জিজ্ঞেস করল হোরউইক। নীরবে মাথা নাড়ল লোকগুলো।

বুড়ো দোকানদার জানতে চাইল, ‘কেন? কিছু করেছে নাকি?’

‘জিম স্যাবারকে খুন করেছে।’ স্তব্ধ হয়ে গেল ঘরের প্রতিটি লোক।

এক পা এগিয়ে এল দোকানদার। মাথা ঝাঁকুনি দিয়ে চিবুক তুলে ইঙ্গিতে পাশের সেলুনটা দেখিয়ে বলল, ‘চুল কাটছে। নিলামের জন্যে রেডি হচ্ছে।’

সবটা শোনার দরকার মনে করল না হোরউইক। বেরিয়ে এল দোকান থেকে।

রাস্তায় নামল জিম। প্রথমেই চোখ পড়ল রাস্তার ওপাশের বাড়িটার দিকে। কামারশালা। লম্বা এক লোক দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে তাকে দেখছে।

ইতস্তত করল জিম। মোড় নিয়ে হাঁটতে শুরু করল বাজারের দিকে। দাড়িগোঁফের যা অবস্থা, আর না কামালেই নয়।

নাপিতের দোকানটা খুঁজে বের করতে সময় লাগল না। দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। আস্তে ঠেলা দিয়ে পাল্লা খুলে পা রাখল ভেতরে।

চেয়ারে মাথা এলিয়ে দিয়ে ঘুমাচ্ছে একজন লোক। হাঁ করে শ্বাস নিচ্ছে। পেছনটা দরজার দিকে ফেরানো।

এদিকে পেছন করে বসা আরেকজনের চুল ছাঁটছে নাপিত।

দরজায় শব্দ শুনে ফিরে তাকাল নাপিত। টাক মাথা তার। গোলগাল চেহারা। জিমকে দেখে বড় বড় হয়ে গেল চোখ। ঢোক গিলল।

চেয়ারে বসে আছে যে লোকটা তার বিশাল শরীর। অর্ধেক ছাঁটা হয়েছে চুল। গায়ে জড়ানো একটা সাদা কাপড়। দরজা খোলার শব্দের পর পরই নাপিতের হঠাৎ হাত থেমে যাওয়া সতর্ক করে তুলল তাকে। ফিরে তাকাল। পরক্ষণেই এক ঝটকায় ঘুরে গেল চেয়ারসহ, তার চোখও বড় বড় হয়ে গেছে।

‘জিম বোম্যান! ধরা পড়েনি এখনও?’ কর্কশ কণ্ঠ লোকটার।

গলা শুনেই চিনে ফেলল জিম, এই লোকই ড্যাগা গালুশ। কোমরের কাছে হাত চলে গেল তার। পড়েছিলাম, কিন্তু ছেড়ে দিয়েছে হোরউইক।

‘ছেড়ে দিয়েছে।’

‘হ্যাঁ,’ হাসল জিম। ‘তোমার জন্যে আরও দুঃসংবাদ আছে, ড্যাগা। বেলিন্দার নামে টাকাটা জমা দিয়ে এসেছি আমি উকিলের কাছে।’

ড্যাগাকে খবরটা হজম করার সময় দিল জিম। তারপর বলল, ‘জিম স্যাবারের লাশটাও খুঁজে পেয়েছি আমরা। মরার আগে দেয়ালে তোমার নাম লিখে গেছে ও। বাঁচতে চাইলে জলদি পালাও। হোরউইক এখন খেপা কুকুর। পাগলের মত খুঁজে বেড়াচ্ছে তোমাকে।’

‘হুঁ!’ ঠোটে ঠোট চেপে বসল ড্যাগার। ‘সব কিছুর মূলে তুমি, বোম্যান। আমার সর্বনাশ করেছ তুমি! সব শেষ করেছ…’

কথা শেষ হলো না তার। গুলির শব্দ হলো।

ড্যাগার শরীরে জড়ানো সাদা কাপড়ের নিচে হাতটা নড়ে উঠতে দেখল জিম। তবে সরতে দেরি করে ফেলল সামান্য। বুকে লাগল না গুলিটা, লাগল কাঁধে। প্রচণ্ড ঝাঁকুনি। লাটিমের মত পাক খেয়ে ঘুরে গেল শরীরটা। এবং এই পাক খাওয়াতেই বেঁচে গেল দ্বিতীয় গুলিটা থেকে। ঘুরে গিয়ে দরজার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল সে।

কোলের ওপর রিভলভার রেখেছিল ড্যাগা, তুলে নিয়ে গুলি করেছে কাপড়ের নিচ থেকেই। চোখ দুটো উজ্জ্বল, দাঁত বেরিয়ে পড়েছে বিকৃত আনন্দে।

ঘুম ভেঙে গেল চেয়ারে বসা লোকটার। একবার তাকিয়েই বুঝে নিল পরিস্থিতি। একটা মুহূর্ত সময় নষ্ট করল না, ডাইভ দিয়ে জানালার কাচ ভেঙে উড়ে গিয়ে পড়ল বাইরে।

স্তব্ধ হয়ে গেছে যেন সময়। ঘোরের মধ্যে থেকে দেখল জিম, ড্যাগার গায়ের সাদা কাপড়ে ছোট গোল একটা ফুটো, ধোঁয়া বেরোচ্ছে।

কখন টিগার টিপল সে, বলতে পারবে না। হাতে অনুভব করল রিভলভারের ঝাঁকুনি। একবার দু-বার বিকৃত হয়ে যেতে দেখল ড্যাগার চেহারা। রিভলভারের নল ঘুরে যাচ্ছে মেঝের দিকে। গুলি বেরোল প্রচণ্ড শব্দে, মেঝেতে গিয়ে বিধল। অল্পের জন্যে মিস করল ড্যাগারের পা।

উঠে দাঁড়াচ্ছে ড্যাগা।

তৃতীয়বার গুলি করল জিম।

যে চেয়ারটায় বসেছিল সেটাতেই পড়ে গেল ডাাগা। কানের নিচ থেকে রক্ত ছুটছে। ফোয়ারার মত ছিটকে গিয়ে পড়ল সাবান গোলানোর বাটিতে। সাদা ফেনাকে লাল করে দিল।

ঘরের কোণে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে নাপিত। একটা চেয়ার টেনে নিয়েছে সামনে, আড়াল করে রাখতে চাইছে নিজেকে।

বাইরে রাস্তায় পদশব্দ। ছুটে আসছে লোকজন। ঝটকা দিয়ে খুলে গেল সেলুনের দরজা। প্রথম ঢুকল হোরউইক।

কাঁধ চেপে ধরে মেঝেতে বসে পড়েছে জিম।

ছুটে এসে তার পাশে বসে পড়ল হোরউইক। ‘জিম-বেশি লেগেছে?… জিম…’

চোখ তুলে তাকাল জিম। চোখে চোখ পড়তে হাসল। আস্তে করে থুতনি রাখল হারউইকের কাঁধে। শুনতে পেল, হোরউইক বলছে নাপিতকে, ‘ডক ড্যাগার চুল ছাটার পয়সাটা জিমের কাছ থেকে আদায় করে নিও।’

নিশ্চিন্তে জ্ঞান হারাল জিম।

মস্তবড় চাঁদ উঠেছে পাহাড়ের মাথায়। দূর থেকে ভেসে আসছে কয়োটের ডাক।

র্যাঞ্চ হাউসের বারান্দায় পাশাপাশি বসেছে বোলিন্দা আর জিম। চুপচাপ দেখছে অপরূপ প্রকৃতি। চাঁদের আলোয় চিকচিক করছে শিশির-ভেজা তৃণভূমি। মাঝখান দিয়ে বয়ে চলেছে যেন গলিত রূপার চওড়া ফিতে

‘জিম?’ মৃদুকণ্ঠে ডাকল বেলিন্দা।

‘উঁ!’ দূরের পাহাড়ের দিকে চেয়ে স্বপ্নের জাল বুনছে জিম। জ্যোৎস্নায় কালো দেখাচ্ছে লাল পাহাড়।

‘কালই চলে যাবে?’

‘হ্যাঁ।

আবার কিছুক্ষণ নীরবতা।

‘কেন যাবে, জিম? এখানে তোমার কি অসুবিধে?’

জিম চুপ।

‘কই, বললে না?’

‘তুমি চাও, আমি থাকি?’

‘জোর করেই ধরে রাখতাম, যদি জানতাম তোমাকে ভালবাসে এমন কেউ নেই তোমার। যার কাছে ফিরে যেতেই হবে তোমাকে।’

জবাব দিল না জিম। ভাবছে।

‘বলো না, জিম, কেউ আছে তোমার? যার কাছে যেতে হবে?’

‘আছে। বেশ কিছু।’

 ‘মানে?’

‘গরু। অনেক দুধ দেয়। ওরাই আমার আপনজন। অনেক দিন দেখি না, মনটা বড় ছটফট করছে।’ হেসে উঠল জিম।

লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল বেলিন্দা। পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল জিমের গলা। ‘উহ্, বাঁচালে আমাকে! কি যে দুশ্চিন্তায় ছিলাম একটা দিন! কেউ নেই তোমার, আগে বলোনি কেন?’

‘তুমি তো জিজ্ঞেস করোনি।’

‘জিম?’ গালে গাল ঘষতে ঘষতে বলল বেলিন্দা।

‘কি?’

‘তোমাকে এক মুহূর্তের জন্যে ছাড়তে ইচ্ছে করে না। এক কাজ করো না। লিখে র্যাঞ্চের কাউকে পাঠিয়ে দাও। গরুগুলো গিয়ে নিয়ে আসুক।’

‘মন্দ বলোনি। ঠিক আছে, কাল সকালেই পাঠাব।’

মৃদু ডাক ভেসে এল আস্তাবল থেকে। জবাবে মোলায়েম আরেকটা ডাক। জিমের কালো ঘোড়াটার সঙ্গে ভাব হয়ে গেছে বেলিন্দার সুন্দরী ঘোটকীর। এই নিশুথি রাতে প্রেমালাপ চলছে ঘোড়া দুটোর।

কান পেতে শুনল মানব-মানবী।

মৃদু হাসি ফুটল জিমের ঠোটে।

হাত ধরে টানল বেলিন্দা। ‘ওঠো, ঘরে যাই! ভীষণ ঠাণ্ডা এখানে।’

* * *

<

Super User