৫. প্রতিমাদের আরেক জগৎ
রত্নেশ্বরী গ্রামে পাকা দালান বলতে একটাই, সেটা হলো প্রতিমাদের। লোকে রায় বাড়ি বলে, পুরোনোরা বলে জমিদার বাড়ি। পুরোনো আমলের বনেদি চেহারার দোতালা বাড়ি, তবে আগেকার সেই জৌলুস আর নেই। বহু কাল বাইরে রং দেয়া হয়নি, কোথাও দেয়ালের আস্তর খসে লাল ইট বেরিয়ে গেছে, ফাঁকে ফাঁকে বট গাছের নধর চারাও উঁকি দিচ্ছে। দূর থেকে দেখলে গা ছম ছম করে। এ বাড়িতেই থাকে প্রতিমা, ওর বাবা, মা আর ছোট বোন প্রতিভা যখন ছুটি কাটাতে আসে।
তানিয়া লক্ষ্য করেছে বাড়ির বাইরে যতটা জীর্ণদশা, ভেতরটা তেমন নয়। সাদা চুনকাম করা দেয়াল, শ্বেত পাথরের মেঝে, বসার ঘরে ঝাড়বাতি, দামী মেহগনি কাঠের নকশা তোলা আসবাবপত্র, সব কিছুতেই জমিদারি ছাপ লেগে আছে।
দুপুরে খাওয়ার পর প্রতিমার ঘরে এক মানুষ সমান উঁচু বিশাল মেহগনি কাঠের পালঙ্কে শুয়ে ওরা দুজন কথা বলছিলো। পালঙ্কের গায়ে আঙুর লতার নকশার গায়ে হাত বুলিয়ে তানিয়া বললো, জীবনে প্রথম এ দামী খাট চোখে দেখলাম। অনেক বড় জমিদার ছিলে তোমরা?
প্রতিমার কাছে এ ধরনের কথা শুনতে মোটেই ভালো লাগে না। তানিয়াকে বললো, সকাল থেকে তুই অনেক বার এ কথা বলেছিস। জমিদারদের সম্পর্কে তুই ভাবিস কী বলতো? এই যে দালান কোঠার বাহার দেখছিস প্রত্যেকটা ইটের গায়ে গরিব প্রজাদের ঘাম আর রক্ত মাখা। যে জমিদার যত অত্যাচারী আর যত পাজী ছিলো তাদের বাড়িঘরের বাহারও তত বেশি। ঠাকুরদার কাছে শুনেছি আমাদের পূর্ব পুরুষরা ভীষণ অত্যাচারী ছিলেন। ঠাকুর্দার যিনি ঠাকুর্দা ছিলেন তাঁর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে প্রজারা তাকে জ্যান্ত আগুনে পুড়িয়ে মেরেছে। তার এক ভাই মরেছে অপঘাতে। বংশী নদীর তীরে আমাদের পুরোনো পোড়ো বাড়িটা এখনও আছে। এ বাড়ি বানিয়েছেন ঠাকুরদার বাবা। এসব জমিদারি নিয়ে বড়াই করার কিছু নেই তানিয়া, বরং জমিদারের বংশধর হওয়াটা লজ্জার কথা। এই লজ্জা ঢাকার জন্যেই বাবা স্কুলে মাস্টারি করেন।
প্রতিমার কথা শুনে তানিয়ার খুব ভালো লাগলো। বললো, সব বড়লোকের ছেলেমেয়েরা যদি তোমার মতো ভাবতে পারতো, তাহলে তো কথাই ছিলো না। আনন্দময়ী স্কুলে আমাদের ক্লাসে পড়তো শায়লা পারভীন। জমিদারের বংশ বলে অহংকারে মাটিতে পা পড়ে না।
কয়েক ঘন্টার আলাপে তানিয়া আর প্রতিমা আপনি তুমি বলা থেকে তুমি আর তুই-এ নেমে এসেছে। বনেদি জমিদারের রূপসী নিরহংকারী মেয়েটিকে তানিয়ার যেমন ভালো লেগেছে, তেমনি প্রতিমারও ভালো লেগেছে স্কুল মাস্টারের মা হারা সরল ও আত্মমর্যাদা সচেতন মেয়েটিকে।
প্রতিমা বললো, তোর কি ঘুম পাচ্ছে তানিয়া?
মোটেও না। দিনে আমি কখনও ঘুমোই না। তুমি কি ঘুমোব?
না রে! তোর সঙ্গে গল্প করতে ভালোই লাগছে। সারা গ্রামে কথা বলার কেউ নেই। মাসে দু মাসে দেলদুয়ারের মাসিরা বেড়াতে এলে যা একটু সময় কাটে।
তোমাদের বাড়ি পর্যন্ত তবু ইলেকট্রিক লাইন এসেছে। টেলিভিশনটা অন্তত দেখতে পারো। আমাদের বাড়িতে যে কবে ইলেকট্রিসিটি যাবে কে জানে!
চেয়ারম্যান চেষ্টা করছে নিজের বাড়িতে নিতে। তখন আপনা থেকেই তোরা লাইন পেয়ে যাবি।
ইলেকট্রিকের আলো না থাকলে অন্ধকার যে এত ঘন আর কালো হতে পারে ভাবতেই পারতাম না।
শহরে যখন ইলেকট্রিসিটি চলে যায় তখন অন্ধকার কি সাদা আর পাতলা থাকে?
প্রতিমার কথা বলার ধরন দেখে তানিয়া হেসে ফেললো–হ্যাঁগো প্রতিমাদি, শহরের অন্ধকার কখনও এত ঘন হয় না। শহরের ইলেকট্রিসিটি চলে গেলেও রাস্তায় গাড়ি চলে। গাড়ির আলো আছে, প্রায় বাড়িতে চার্জার আছে। অন্ধকার জমাট বাঁধার সুযোগ পায় না।
ভালো বলেছিস তো তানিয়া। আমি কখনও তোর মতো ভাবিনি। শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত পড়েছিস?
হ্যাঁ পড়েছি। কেন বলতো?
টেনের বইতে শ্রীকান্তের একটা অংশ পড়ায়। এসএসসিতে প্রশ্ন আসে শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত অবলম্বনে আঁধারের রূপ বর্ণনা কর। মনে হয় তুই ভালোই লিখতে পারবি।
কাল রাতে বিছানায় শুয়ে শহর আর গ্রামের অন্ধকারের পার্থক্য নিয়ে ভেবেছিলো তানিয়া। হঠাৎ মনে পড়াতে বললো, কাল রাত্রে আমার কালো ছায়ামূর্তি দেখার কথা শুনে কাকাবাবু সকালে এমন কথা কেন বললেন প্রতিমাদি?
কোন কথা?
তোমরা নাকি সারা বছর এসব দেখো?
গ্রামে এসব দেখা অস্বাভাবিক নয়। ঘরে ঘরে এমন কথা শোনা যায়।
কী দেখা যায় খুলেই বলো না!
তানিয়াকে সব কথা বলা যায় কিনা কিছুক্ষণ ভাবলো প্রতিমা। কথা শুনে মনে হয় তানিয়া খুবই বুদ্ধিমতি মেয়ে, সাহসীও বটে। ওর বয়সী কোনও মেয়ে পথের পাঁচালী আর অপরাজিত পড়ে মুগ্ধ হয়েছে–এরকম কদাচিৎ দেখা যায়। ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রতিমা বললো, শোন তাহলে। আমাদের পূর্বপুরুষরা যে খুব অত্যাচারী জমিদার ছিলেন তোকে তো বলেছি। ইংরেজদের দালালী করে সেই আমলে ওঁরা বিস্তর টাকা জমিয়েছিলেন। আমাদের আগের বাড়িতে কয়েদখানা ছিলো, গুমঘর ছিলো। ঠাকুরদার কাছে শুনেছি প্রজারা খাজনা দিতে না পারলে কয়েদখানায় আটক করে চাবকানো হতো। কাটা জায়গায় নুন ছিটিয়ে মজা দেখতো। শাস্তির মাত্রা বেশি হলে, যদি কেউ জমিদারের হুকুম অমান্য করতো তাকে গুম ঘরে ফেলে দিতো। গুমঘরের কোন জানালা ছিলো না। একটাই দরজা ছিলো ছাদের কাছে। সেই দরজার কাছে কেউ পৌঁছতে পারতো না। পারলেই বা কী! লোহা দিয়ে বানানো ছিলো সেই দরজা। বেচারা প্রজারা, বেশির ভাগ ভয়ে হার্টফেল করে মরতো, নাহলে মরতো না খেয়ে। লাশ সেখানেই পড়ে থাকতো। দরজা খুললে ভয়ঙ্কর দুর্গন্ধ বেরুততা। নিচে দেখা যেতো কঙ্কাল আর কঙ্কাল, এলোমেলো ছড়িয়ে রয়েছে। কে যেন দেখেছে গুমঘরে অনেক ইঁদুর ছিলো, একেকটা বেড়ালের মতো বড়।
প্রতিমার কথা শুনতে শুনতে তানিয়া যে কখন শোয়া থেকে উঠে বসেছে নিজেও টের পায়নি। একটু থেমে প্রতিমা বললো, তোরা বিশ্বাস করিস কিনা জানি না। মারা যাওয়ার পর মানুষের যদি সকার না হয় তাহলে তাদের আত্মা মুক্তি পায় না। আমরা যেমন কাশীতে গিয়ে আত্মার উদ্দেশ্যে পিণ্ড দান করি–তবেই আত্মা মুক্তি পায়। নইলে এসব আত্মা পৃথিবীতে ঘুরে বেড়ায়। মুক্তির জন্য সারাক্ষণ ছটফট করে। জীবিত মানুষের ওপর ওদের ভীষণ রাগ। গুমঘরে যারা মরেছে তাদের কারোই সদগতি হয়নি। আমাদের পুরোনো মহলের চারপাশে বহু কাল ধরে এসব আত্মা ঘুরে বেড়াচ্ছে। ঠাকুরদার এক ঠাকুরদা যে অপঘাতে মরেছেন তোকে বলেছি?
হ্যাঁ বলেছে। কী ধরনের অপঘাত?
সুস্থ সবল মানুষ সন্ধ্যেবেলা বেরিয়েছিলেন ঘোড়ায় চেপে। সারা রাত ফেরেননি। সকালে বংশী নদীর তীরে দেখা গেলো লাস পড়ে আছে ধলা কর্তার। অসম্ভব ফর্শা ছিলেন বলে সবাই তাকে ধলা কর্তা ডাকতো। খুবই অত্যাচারী ছিলেন। গ্রামের বউ ঝিরা তাঁর অত্যাচারে বাড়ি থেকে বেরুতে পারতো না। তার লাশের গায়ে আঘাতের কোনও চিহ্ন ছিলো না। চেহারাটা শুধু নীল হয়ে গিয়েছিলো। চোখ দেখে মনে হয়েছিলো মরার আগে ভীষণ ভয় পেয়েছিলেন। তার ঘোড়াটাও পাশে মরে পড়েছিলো। পুরোনো মহলের আশে পাশে হঠাৎ হঠাৎ কালো কালো ছায়ার মতো মানুষ ঘুরে বেড়াতে আমাদের অনেকেই দেখেছে। অল্প কিছুক্ষণের জন্য দেখা যায়। বিশেষ করে পূর্ণিমার রাতে। দেখার সঙ্গে সঙ্গে বাতাসে মিলিয়ে যায়।
তোমাদের এ বাড়িতে গুমঘর নেই?
না। বংশের দুজন পর পর অপঘাতে মারা যাওয়াতে ঠাকুরদার বাবা শুধু পুরোনো মহলই ছাড়েননি, প্রজাদের ওপর অত্যাচার করাও বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তবে অত্যাচার না করলে জমিদারিও রাখা যায় না। ঠাকুরদার আমলেও প্রজাদের ধরে এনে মারধোর করা হতো, জমিজমা কেড়ে নিয়ে পথের ভিখিরি বানিয়ে দিতো। এসব কথা ঠাকুরমার কাছে শুনেছি। ঠাকুরমা ছিলেন গরিব পণ্ডিত বংশের মেয়ে। এসব জমিদারি অনাচার দুচোখে দেখতে পারতেন না। তবে এ বাড়িতে মানুষ খুন করার ঘটনা যে কখনও ঘটেনি এমন কথাও বলা যাবে না। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের বাড়িটা পাকিস্তানী সৈন্যদের ক্যাম্প ছিলো। বাবা তো চলে গেলেন নূরু কাকুদের সঙ্গে যুদ্ধে। ঠাকুরদা আর ঠাকুরমারা ছিলেন কলকাতায়। যুদ্ধের পর ফিরে এসে গ্রামের লোকদের কাছে শুনেছেন কাঁচারিবাড়ির সামনে অনেক মানুষকে মেরে এক সঙ্গে মাটিতে পুঁতে রেখেছে। ঠাকুরদা লোকজন লাগিয়ে খুঁড়ে অনেক লাশ পেয়েছিলেন। লাশের যা অবস্থা দেখে বোঝার উপায় ছিলো না কে হিন্দু আর কে মুসলমান। সব লাশ তুলে বংশী নদীর তীরে আলাদা করে কবর দেয়া হয়েছে। ওদের জন্য হিন্দু মতেও পিণ্ডদান করা হয়েছে।
বলতে গিয়ে প্রতিমার গলা ভারি হয়ে গেলো। তানিয়া কিছুক্ষণ পর বললো, তুমি যে বললে পাকিস্তানী সৈন্যরা যাদের মেরেছিলো তাদের তোমার ঠাকুরদা সত্ত্বার করেছিলেন। সংস্কার না করলে কি তাদের আত্মা মুক্তি পেতো না?
পেতো। দেশের জন্য যারা জীবন দেয় তাদের আত্মা মৃত্যুর পর পরই স্বর্গবাসী হয়। ঠাকুরদা সত্ত্বারের ব্যাপারে মসজিদের ইমাম সাহেবের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। তিনিও নাকি ঠাকুরদাকে বলেছিলেন, তিনি চাইলে মসজিদে মিলাদ পড়াতে পারেন, তবে শহীদদের জন্য বেহেশতের সেরা জায়গা রাখা আছে। কবর দেয়ার পর ইমাম সাহেব সবার জন্য দোয়া করেছেন।
কথা বলতে বলতে কখন যে বিকেল হয়ে গেছে ওরা টের পায়নি। বাড়ির পুরোনো ঝি মোক্ষদাদি এসে বললো, কর্তামা ডাকতাছে নিচে। চা দেওয়া ওইছে।
তানিয়াকে নিয়ে প্রতিমা নিচের খাবার ঘরে এসে দেখলো সবাই ওদের জন্য অপেক্ষা করছে। বিভূতি কাকা তানিয়াকে বললেন, চেহারা দেখে তো মনে হয় এক ফোঁটা ঘুম হয়নি।
কাকিমা মৃদু হেসে বললেন, তোমরা বড়রা সারাক্ষণ গল্প করে কাটালে। ছোটরা কোন দুঃখে ঘুমোবে!
টেবিলে খাবারের বহর দেখে আঁতকে উঠলো তানিয়া। দুপুরে খাওয়ার সময় এগারো পদ রান্না নিয়ে অনেক রসিকতা হয়েছে। চার ঘন্টা না যেতেই লুচি, আলুর দম, সুজির মোহনভোগ আর সন্দেশ খেতে হবে–এ কী রাক্ষুসে কারবার! তানিয়ার চেহারা দেখে কাকিমা নরম গলায় বললেন, তোমার যা ইচ্ছে করে তাই খাও। সন্দেশটা আমি নিজ হাতে বানিয়েছি।
তানিয়া করুণ গলায় বললো, আমি শুধু এক টুকরো সন্দেশ খাবো।
তাই খাও মা। বলে কাকিমা ওর প্লেটে দুটো সন্দেশ তুলে দিলেন।
তানিয়ার প্রথমে মনে হয়েছিলো একটার বেশি খেতে পারবে না। চামচে কেটে একটুখানি মুখে দিয়ে দেখলো এত ভালো সন্দেশ জীবনে খায়নি। কথাটা বলতে গিয়ে চেপে গেলো। দুপুরের অভিজ্ঞতা থেকে বুঝেছে ভালো বললেই কাকিমা আরও দুটো সন্দেশ ওর প্লেটে তুলে দেবেন। খেতে খেতে মনে হলো আনন্দময়ী স্কুলে পড়ার সময় বিকেলের দিকে মাঝে মাঝে ক্ষিদেয় চোখে কী অন্ধকার দেখতো!
চা খাওয়ার পর বিভূতি কাকা বললেন, নূরউদ্দিন, চলো নদীর ধারে একটু হাঁটি।
প্রতিমা বললো, আমরাও একটু ঘুরতে যাবো বাবা।
যেতে পারো। বিভূতি কাকা মৃদু হাসলেন, সঙ্গে বনমালীকে নিতে ভুলে যেও না।
আমি ভুললেও বনমালী ভুলবে না। এই বলে তানিয়ার হাত ধরে খাবার ঘর থেকে বেরিয়ে এলো প্রতিমা।
বনমালী নিঃশব্দে ওদের অনুসরণ করলো। ওর হাতে পাকা বাঁশের লাঠি। পেটানো শরীর। বছর তিনেকের ওপর রায়বাড়ির পাহারাদারের চাকরি নিয়েছে। খুবই বিশ্বস্ত আর সাহসী পেয়াদা।
তানিয়া এ বাড়িতে ঢুকেই লক্ষ্য করেছে বাইরে যে রকম জীর্ণ দশা বাড়ির ভেতরটা তেমন নয়। সবুজ ঘাসে ঢাকা আঙিনায় হাঁটতে হাঁটতে ও বললো, প্রতিমাদি, বাড়ির বাইরের চেহারাটা এরকম রেখেছো কেন? রঙ করলে রাজপ্রাসাদের মতো লাগবে।
কী হবে করে!
বাড়িটা মজবুত হবে। দেখতেও সুন্দর হবে।
আর সুন্দর! দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রতিমা বললো, দু বছর আগে ইণ্ডিয়ার বাবরি মসজিদ ভাঙার পর এখানে হিন্দুদের ওপর কী অত্যাচার হয়েছে কাগজে পড়িস নি?
শুনেছি। কিন্তু তোমাদের তো এ গ্রামের সবাই ভালো বলে জানে!
যাদের ওপর অত্যাচার করছে তারা কি খারাপ ছিলো? আমাদের বাড়িও লুট করতে এসেছিলো পাশের গায়ের লোকেরা। রত্নেশ্বরীর মন্দিরেও আগুন দিতে গিয়েছিলো। এ গাঁয়ের লোকজন বাধা দেয়াতে পারেনি। বাবা অবশ্য আগে থেকে পুলিশ এনে রেখেছিলেন বাড়িতে। নইলে মন্দির আর বাড়ির ইট কাঠ সব খুলে নিয়ে যেতো। রত্নেশ্বরীর মন্দিরে বিগ্রহের অনেক অলঙ্কার আগেই চুরি হয়েছে। সেবারও গুণ্ডাদের লক্ষ্য ছিলো দেবীর গলার নবরতের হার।
অনেক দামী হার?
এখন লাখ চারেকের মতো দাম হবে।
সব সময় দেবীর গলায় থাকে?
না, বিশেষ বিশেষ দিনে ওটা লোহার সিন্দুক থেকে বের করা হয়। রাতে ছ জন লোক মন্দির পাহারা দেয়।
গ্রামের লোকরা যদি গুণ্ডাদের বাধা দেয় তাহলে তো এদের ভালো বলতে হবে।
ভালো বটে, তবে সবাই নয়। এ গাঁয়ের অনেকে পাশের গায়ে গেছে লুট করতে। পাশের গাঁয়ে দুটো মন্দির ছিলো। একটাও আস্ত নেই। দু তিন বছর পর পর যদি এরকম হামলা হয়, বাড়িঘর মেরামত করে লাভ কী বল?
তানিয়া গম্ভীর গলায় বললো, শুনেছি বাবরি মসজিদ ভাঙার পর ইণ্ডিয়াতে অনেক মুসলমানকে মেরেছে।
ম্লান হেসে প্রতিমা বললো, আমরা কি ইণ্ডিয়া গিয়ে সেখানকার মুসলমানদের মেরেছি? নাকি আমরা বাবরি মসজিদ ভেঙেছি? যারা ভেঙেছে তাদের কিছু করতে পারবে না, মিছেমিছি এখানকার অসহায় হিন্দুদের ওপর চোটপাট করবে।
এসব ধর্ম টর্ম না থাকলে মানুষ অনেক ভালো থাকতো প্রতিমাদি।
কিছুটা হয়তো থাকতো। তবে জমিদার প্রজা কিংবা কারখানার মালিক শ্রমিক নিশ্চয় থাকতো। সাদা চামড়ার মানুষ আর কালো মানুষদের বিরোধ থাকতো। আরও অনেক বিরোধ থাকতো। থাকতোই বা বলছি কেন? এসব তো এখনও আছে। একটু থেমে প্রতিমা বললো, মানুষ আসলে খুব নিষ্ঠুর প্রাণী। অন্য কোনও প্রাণী মানুষের মতো নিষ্ঠুর নয়।
প্রতিমা যে বিষয় নিয়ে কথা বলছিলো, নদীর তীরে হাঁটতে হাঁটতে ওর বাবা একই বিষয়ে নিয়ে তানিয়ার বাবার সঙ্গে কথা বলছিলেন। সব শুনে তানিয়ার বাবা বললেন, বিভূতি, তুমি হতাশ হচ্ছে কেন? বাংলাদেশ আমরা স্বাধীন করেছি কটা জামাতী আর মৌলবাদী গুণ্ডার ভয়ে কুঁকড়ে থাকার জন্য? আমরা সবাই জোট বেঁধে দাঁড়ালে ওরা পালাবার পথ খুঁজে পাবে না।
তুমি জানো না নূরউদ্দিন, ওরা কতটা নৃংশস! গত চার পাঁচ বছরে হিন্দুদের ওপর অত্যাচার কী পরিমাণ বেড়েছে শুনলে চমকে উঠবে। তোমাকে কি বলেছি সরকার আমাদের বাড়িটাকে অর্পিত সম্পত্তি বলে নিয়ে নিতে চাইছে?
অর্পিত সম্পত্তি মানে?
পাকিস্তান আমলে যেটাকে শত্রু সম্পত্তি বলা হতো এখন বলা হয় অর্পিত সম্পত্তি। কোন হিন্দু দেশ ছেড়ে চলে গেলে তার সম্পত্তির মালিক হবে সরকার।
তোমরা তো যাওনি। যাবেও না। তোমাদের বাড়ি কেন সরকার নিতে যাবে?
সরকারের কথা হচ্ছে চোষট্টির দাঙ্গার পর যে সব হিন্দু ইণ্ডিয়া চলে গেছে তাদের কিংবা আরও আগে যারা দেশ ছেড়েছে তাদের সম্পত্তির মালিক সরকার। আমাদের ছোটকা পাকিস্তান হওয়ার পাঁচ বছর পর তাঁর এ বাড়ির অংশ আমাদের কাছে বিক্রি করে চলে গেছেন। এটা সরকারী লোকদের বোঝানো যায় না। আজকাল এমন দাঁড়িয়েছে, কোনও বাড়ির মালিক হিন্দু হলেই সেটা অর্পিত সম্পত্তি বলে ঘোষণা করে দিচ্ছে। এ নিয়ে যে কী হয়রানি হতে হচ্ছে ভাবতেও পারবে না। এ ছাড়া গুণ্ডা বদমাশদের হুমকি তো আছেই।
বহুদিন পর জানুয়ারির হিমেল বাতাসে কুয়াশা ঢাকা বংশী নদীর তীরে হাঁটতে ভালোই লাগছিলো তানিয়ার বাবার। ছোটবেলার অনেক কথা মনে পড়ছিলো। কতদিন স্কুল ছুটির পর বিভূতির সঙ্গে ওদের পুরোনো মহলে গিয়েছেন গুপ্তধন খোঁজার জন্য, সেসব কথা ভাবতে গিয়ে হারিয়ে গিয়েছিলেন ছোটবেলার দিনগুলোতে। ছোটবেলার প্রিয় বন্ধু বিভূতি, যার সঙ্গে একাত্তরের নয় মাস এক তাঁবুর নিচে শুয়ে দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছেন তার এমন বিপদ শুনে তানিয়ার বাবার বুকটা ব্যথায় ভরে গেলো। বন্ধুর একটা হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললেন, বিভূতি, এখন আর তুমি একা নও। আমি আছি তোমার পাশে। আশে পাশের দশ গাঁয়ের মুক্তিযোদ্ধারা একজোট হয়ে আবার লড়বো এসব অন্যায়ের বিরুদ্ধে।
জানি নূরউদ্দিন। আমার কোনও বিপদ হলে তুমি পাশে থাকবে। আজকাল শুধু গুণ্ডা বদমাশ নয়, অশরীরী আত্মারাও আমাদের পেছনে লেগেছে।
তুমি এসব বিশ্বাস কর বিভূতি?
না করে উপায় কী! ভালো করেই জানো আমাদের পূর্বপুরুষরা কী রকম অত্যাচারী ছিলো। গুমঘরে ফেলে যাদের মেরেছে তাদের অভিশাপ এখনও কাটেনি।
আমি বলছি বিভূতি, হয় তোমাদের চোখের ভুল, নয়তো কোনও খারাপ লোক তোমাদের ভয় দেখাবার জন্য এসব করছে।
তুমি তো গ্রামে থাকবে বলে এসেছে। নিজের চোখেই দেখো। কাল রাতে তানিয়া যে ওদের দেখেছে এ নিয়ে আমার কোনও সন্দেহ নেই।
খারাপ লোক ভয় দেখাবার জন্য করতে পারে।
তোমাকে কেন ভয় দেখাবে?
আমার ভাইটিকে ভালো করেই চেনো। ওরা চায় না আমি গ্রামে থাকি।
হ্যাঁ শুনেছি, ও নাকি এখন জামাত করে।
রত্নেশ্বরীর আকাশে অন্ধকারের কালো ছায়া ঘনিয়ে এলো। ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে তানিয়ার বাবা বললেন, বিভূতি, চলো ফিরে যাই।
.
৬. নতুন স্কুল নতুন বন্ধু
ভাই পারু,
বলেছিলাম নতুন স্কুলের প্রথম দিনই তোকে চিঠি লিখবো। প্রথম দিন দূরে থাক কাল পর্যন্ত দম ফেলার সময় পাইনি। ভাবতে পারিস ঘুম থেকে উঠতে হয় সূর্য ওঠার আগে! সকাল বিকাল যে রকম ড্রিল করায় মনে হয় ক্যান্টনমেন্টের আর্মিদের হার মানাবে। প্রথম দিন ড্রিল করে মনে হয়েছিলো আরেক দিন এরকম করতে হলে নির্ঘাৎ মরে যাবো। এখনও মরিনি। মনে হচ্ছে আস্তে আস্তে সয়ে যাবে।
স্কুলে কড়াকড়ির কথা আগে শুনেছিলাম বটে, এসে দেখি পান থেকে চুন খসার জো নেই। সব কাজ নিজেদের করতে হয়। এমন কি রান্নার কাজও পালা করে করতে হয়। সবচেয়ে খারাপ লাগে বারোয়ারি বাথরুম পরিষ্কার করতে । খারাপ লাগলেও উপায় নেই, সবাইকে করতে হয়। আনন্দময়ী স্কুল থেকে এসে আমি এই স্কুলের নাম রেখেছি নিরানন্দময়ী স্কুল। গত শনিবার বাবা আর বিভূতি কাকা আমাকে এখানে রেখে গেছেন। এত বড় নামী স্কুলে পড়বে ভেবে রীতিমতো রোমাঞ্চ হচ্ছিলো। শনিবার আমাদের হোস্টেলের মিসেস পেরেরা নিয়ম কানুন সব কিছু বুঝিয়ে দিয়েছেন। তখনও ভালোই লেগেছিলো, মনটা শুধু খুঁত খুঁত করছিলো রাত সাড়ে চারটায় ঘুম থেকে উঠতে হবে বলে। রোববার থেকে শুরু হয়েছে পরিপূর্ণ হোমস জীবন। সারা শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা নিয়ে রাতে বিছানায় শুয়ে ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছিলো। আমাদের আনন্দময়ী স্কুলে আমি ইংরেজিতে কখনো আশির নিচে নম্বর পাইনি। এখানকার ইংরেজির বহর থেকে মনে হচ্ছে পাশ করতেই প্রাণ বেরিয়ে যাবে। টিচারদের সঙ্গে ক্লাসে ইংরেজিতে কথা বলতে হয়। আমাদের আনন্দময়ী স্কুলের মতো টিচারদের আপা দিদি এসব বলা যাবে না। বলতে হবে মিস না হলে মিসেস। কী অস্বস্তি লাগে ষাট বছরের রাশভারি মহিলা অঙ্কের টিচারকে মিসেস সরকার ডাকতে। এখানে সবার আগে বন্ধুত্ব হয়েছে ক্লাস নাইনের প্রতিভার সঙ্গে। বাবার বন্ধু আমাদের গ্রামের বিভূতি কাকার ছোট মেয়ে প্রতিভা। এই নিরানন্দময়ী স্কুলে প্রতিভা আমার একমাত্র আশ্রয়। বিভূতি কাকারা এক কালে মস্ত জমিদার ছিলেন। গত শুক্রবার সারাদিন কাটিয়েছিলাম ওঁদের বাড়ি। কাকা কাকিমা ছাড়া বাড়িতে থাকেন বড় মেয়ে প্রতিমাদি। বিভূতি কাকার দুটো মেয়েই ডানা কাটা পরি। প্রতিমাদিকে প্রথম দেখে ভেবেছিলাম বুঝি কলেজে পড়েন। পরে শুনি গত বছর দিল্লী থেকে এম এ পাশ করে এসেছেন। জমিদারের বাড়ির মেয়ে হলে কী হবে, দুজনের ভেতর এক রত্তি অহংকার নেই। আমাদের শায়লা কথায় কথায় কেমন মনে করিয়ে দেয় ওর দাদা জমিদার ছিলেন। কেউ অন্যায় কিছু করলে বলে দেখতে হবে তো কোন বংশের মেয়ে। অথচ নিজে যে লাইব্রেরি থেকে বই চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়লো তা নিয়ে কোন লজ্জা নেই। প্রতিমাদি আর প্রতিভাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় বাবা কী করেন বলে স্কুলে শিক্ষকতা করেন। আসলেই তাই । প্রতিমাদি বলেছেন, জমিদারের ছেলে–এই অপবাদ ঘোচানোর জন্য বিভূতি কাকা গ্রামের স্কুলে মাস্টারি করেন। ওদের দেখে মনে হয়েছে জমিদারদের বংশে ভালো লোকও জন্মাতে পারে। খাওয়ার সময় দেখেছি মুসলমান বলে ছোঁয়াছুয়ির কোন বালাই নেই। আরতিদের বাড়িতে ওর ভাইয়ের বিয়ের নেমন্তন্ন খেতে গিয়ে তোর মনে আছে কী হয়েছিলো। হিন্দু মেয়েদের এক টেবিলে আর মুসলমান মেয়েদের আলাদা টেবিলে খেতে দিয়েছিলো। হিন্দুদের ভেতর যারা উঁচু জাতের তারা বসেছিলো বাড়ির ভেতরে। বিভূতি কাকারাও ব্রাহ্মণ। ওদের ভেতর এ নিয়ে কোন বাড়াবাড়ি নেই। সেদিন খাবার টেবিলে বাবা ছোঁয়াছুয়ি নিয়ে কী একটা কথা বলাতে কাকিমা বলেছিলেন, আমাদের হিন্দু না ভেবে শুধু মানুষ ভাবুন না নূরুদা। তাহলে দেখবেন অনেক ঝামেলা মিটে যাবে। এ কথাটা আমারও মনে হয়, আমাদের ভেতর যদি ধর্মে ধর্মে ভেদাভেদ না থাকতো তাহলে অনেক ভালো হতো।
এতক্ষণ তো আমার কথা বললাম। এবার তোদের কথা বল। রাতে বাতি নিভিয়ে বিছানায় শুলেই তোদর কথা মনে পড়ে। বিশেষ করে তোর কথা। তোর মতো বন্ধু পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। আমি জানি আমাকে ওভাবে ফেয়ারওয়েল দেয়া, এত সব উপহার সবই তোর জন্য। শুয়ে শুয়ে ভাবি তুই আমার জন্য এত কিছু করেছিস, কিন্তু তোর জন্য কিছুই করতে পারিনি। আমি জানি একদিন আনন্দময়ী স্কুলের সবাই আমার কথা ভুলে যাবে, শুধু তুই আমাকে মনে রাখবি। আমিও তোকে কোনদিন ভুলতে পারবো না………….
নতুন স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর প্রথম ছুটির দিন দুপুরে তানিয়া ওর বিছানার পাশে পড়ার টেবিলে বসে পারুলকে চিঠি লিখছিলো। চিঠি লেখা তখনও শেষ হয়নি, ঘাড়ের ওপর গলা বাড়িয়ে প্রতিভা বললো, এত মনোযোগ দিয়ে যাকে চিঠি লিখছিস তানিয়া? কাকে কোনও দিন ভুলবি না? ছেলে বন্ধু বুঝি। ঢাকায় ফেলে এসেছিস?
ঝট করে খাতার আড়ালে চিঠি লুকিয়ে তানিয়া লজ্জাভরা গলায় বললো, কী আবোল তাবোল বকছিস প্রতিভা! ছেলে বন্ধু কেন হবে? চিঠি লিখছিলাম আমাদের আনন্দময়ী স্কুলের পারুলকে। আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু!
প্রতিভার সঙ্গে পরিচয়ের প্রথম দিনই ওরা তুমি থেকে তুইতে নেমে এসেছে। প্রতিভাই প্রথম বলেছে, নতুন স্কুলে আমি তোমার প্রথম বন্ধু। কী আপত্তি নেই তো?
তানিয়া বলেছে, বন্ধু হলে আর তুমি তুমি বলা কেন। তুই বললেই তো হয়।
তুই যদি বলিস তাহলে আমিও বলবো।
তুই যদি আপত্তি না করিস–
গত কদিনে ওদের সম্পর্ক আরও গম্ভীর হয়েছে। পারুলের কথা তানিয়া পরিচয়ের প্রথম দিনই প্রতিভাকে বলেছে। পারুলকে চিঠি লিখছে শুনে প্রতিভা বললো, কী লিখেছিস দেখাবি না?
পারুলের চিঠি, তুই কেন দেখবি!
ঠিক আছে। তানিয়ার বিছানায় বসে ভারি গলায় প্রতিভা বললো, আমি তোের কে? আমাকে কেন তোর বন্ধুকে লেখা চিঠি দেখাবি!
তানিয়া জানে কী অসম্ভব অভিমানী মেয়ে প্রতিভা। এরপর নিজে থেকে কথা বলবে না। তানিয়া কিছু জিজ্ঞেস করলে গম্ভীর হয়ে দায়সারা জবাব দেবে। নিজে কষ্ট পাবে, তানিয়াকেও কষ্ট দেবে।
তানিয়া হেসে খাতার নিচে লুকিয়ে রাখা চিঠিটা বের করে বললো, অমনি রাগ হয়ে গেলো! নে পড়।
প্রতিভা উদাস গলায় বললো, করুণা করছিস? চাই না তোর করুণা। তোর চিঠি তুই পড়গে।
চেয়ার থেকে উঠে প্রতিভার পাশে বসে তানিয়া বললো, তুই তো জানিস প্রতিভা, তুই যদি আমার ওপর রাগ করিস তখন আমার কী রকম খারাপ লাগে। প্লীজ, রাগ করিস না।
কোন অধিকারে তোর চিঠি পড়বো?
বন্ধু হওয়ার অধিকারে। পারুলকে আমি তোর কথা লিখেছি।
সত্যি! প্রতিভার সব রাগ কর্পূরের মতো উবে গেলো। দেখি তো কী লিখেছিস!
এক নিঃশ্বাসে চিঠি পড়া শেষ করে প্রতিভা আনন্দে আত্মহারা হয়ে–তুই আমাকে এত ভালোবাসিস, বলে জড়িয়ে ধরলো তানিয়াকে।
তানিয়া হাসলো, আরে ছাড় ছাড়। মিসেস পেরেরা দেখলে কী ভাববেন বলতো!
পাশের বিছানায় ঘুমোচ্ছিলো তানিয়াদের ক্লাসের ফারজানা। ওদের খুনসুটি শুনে কখন যে ওর ঘুম ভেঙেছে তানিয়ারা টের পায়নি। ফারজানা হাই তুলে বললো, তানিয়ার বন্ধু ভাগ্য দেখে আমার হিংসে হচ্ছে।
ফারজানার পাশের বিছানা থেকে চুমকি বললো, আমারও।
ফারজানা আর চুমকির কথা শুনে তানিয়ারা হাসতে হাসতে ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। তানিয়ার চিঠি তখনও প্রতিভার হাতে। পিটি গ্রাউন্ডের পাশে কাঁঠাল গাছের নিচে বাধানো বেদিতে বসে তানিয়া বললো, চিঠিটা পোস্ট করতে দিয়ে দিই।
স্কুলের নিয়ম হচ্ছে ছাত্রীরা ওদের চিঠি খোলা খামে হোস্টেল সুপারের কাছে জমা দেবে। সব চিঠি সেন্সর হয়ে জায়গা মতো যাবে। তানিয়ার কথা শুনে প্রতিভা হেসে ফেললো–আসলে তুই এত সরল না! স্কুল সম্পর্কে যেসব কথা লিখেছিস এর পরও আশা করিস এ চিঠি ডাকে দেয়া হবে?
এসব কথা বাদ দিলে লিখবো কী। পারুলরা জানতে চাইবে না নতুন স্কুল কেমন?
তুই ভাবিস না। বনমালী আসার সময় হয়েছে, ওকেই দিস ঠিক মতো স্ট্যাম্প লাগিয়ে ডাক বাক্সে ফেলে দেয়ার জন্য।
শুক্রবারে ছুটির দিনটায় স্কুলের লৌহকঠিন শৃঙ্খলায় কিছু নরম থাকে। লৌহকঠিন শৃঙ্খলা শব্দটা মিসেস পেরেরা প্রায়ই ব্যবহার করেন। সামান্য অনিয়ম দেখলেই কপালের চামড়ায় কয়েকটা ভাঁজ ফেলে বলবেন, এটা শৃঙ্খলার ব্যাপার। আমাদের লৌহকঠিন শৃঙ্খলার ভেতর মানুষ হতে হবে। তবেই আমরা শক্ত মাটির ওপর নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবো।
ছুটির দিনের শেষ দুপুরে সারা স্কুল সুনসান। মেয়েরা সবাই যে যার বিছানায়। তানিয়ার চিঠি পড়ে প্রতিভার ভালো লেগেছে নিজের প্রসঙ্গটুকু, খারাপ লেগেছে স্কুলের ব্যাপারে তানিয়ার মন্তব্য। প্রতিভা মনে করে ভারতেশ্বরী হোমস-এর চেয়ে ভালো স্কুল বাংলাদেশে দ্বিতীয়টি নেই। তানিয়াকে বললো, স্কুল কি তোর ভালো লাগছে না?
আমি কখনও বোর্ডিং-এ থাকিনি প্রতিভা। নিচু গলায় তানিয়া বললো, বায়োয়ারি বাথরুম পরিষ্কার করাটা আমার মোটেই ভালো লাগে না।
কোনও কাজকে ছোট ভাবতে নেই তানিয়া।
আমি ছোট কাজ বলছি না। আমার খারাপ লাগে তাই বলছি।
কিছুদিন পর দেখবি স্কুল ঠিকই ভালো লাগবে।
ঠিক আছে, তখন পারুলকে ভালো লাগার কথা লিখবো।
.
তানিয়ার মা মারা যাওয়ার পরই ওর বাবা ঠিক করেছিলেন মেয়েটার লেখাপড়া শেষ হলে ভালো একটা ছেলে দেখে ওর বিয়ে দিয়ে নিজে শহরের পাট চুকিয়ে গ্রামে গিয়ে থাকবেন। স্কুলের চাকরি ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন শহরে আর নয়। কদিন পরে মেয়েকে বিয়ে দিয়ে একাই তো থাকতে হবে। তানিয়াকে বোর্ডিং স্কুলে দিলে একা থাকার সময়টা শুধু এগিয়ে আসবে। স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে তানিয়াকে ছেড়ে একা কিভাবে থাকবেন ভাবতে গিয়ে তাঁর মনে হয়েছিলো ওর মা মারা যাওয়ার পর থেকে মেয়েটার সঙ্গে মোটেই ভালো ব্যবহার করেননি। আসলে স্নেহ মমতা সব কিছু থেকেই নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন। ভালোবেসে কী লাভ যদি ধরে রাখা না যায়? তানিয়ার মাকে হারিয়ে বাবার জীবনটা একেবারেই অর্থহীন হয়ে পড়েছিলো।
গ্রামে এসে ছেলেবেলার বন্ধু বিভূতিকে নিয়ে মাছ আর সবজির খামার আরম্ভ করলেন। খামার করতে গিয়ে এত ব্যস্ত হয়ে পড়লেন যে ছুটির দিনে তানিয়াকে দেখতে যাওয়ার সময়ও তাঁর হয়নি। প্রতিভাদের বাড়ির বনমালী অবশ্য প্রতি শুক্রবার আসে। কাকীমা ওর হাতে টিফিন ক্যারিয়ার ভর্তি নাড়, নারকেলের চিড়া, নিমকি আর মোহনভোগ পাঠান। মোহনভোগটা রাখা যায় না, সঙ্গে সঙ্গে শেষ হয়ে যায়। নিমকি, নাড়, চিড়া–এগুলো কৌটোয় ভরে অনেক দিন রাখলেও নষ্ট হয় না। অনেক দিন রাখা সম্ভব হলেও রাখা যায় না। তানিয়া ছাড়াও প্রতিভার আরও বন্ধু আছে। ওদেরও দিতে হয়।
বিভূতিরঞ্জনের মতো ভালো মানুষ পৃথিবীতে দুটো থাকতে পারে বলে বিশ্বাস করেন না তানিয়ার বাবা। তানিয়াকে স্কুলে রেখে ফেরার পথেই তিনি বন্ধুকে বলেছেন, নূরউদ্দিন শোন, ভেবে দেখলাম তোমার বাড়িটাই খামারের অফিস করার জন্য উপযুক্ত জায়গা। ভিটেটাতো পাকা আছেই। দুটো ঘর বাড়িয়ে দেয়াল তুলে ফেল। ওপরে টিনই থাকলো। খামারের অফিসটা মজবুত হওয়া দরকার।
আমি ভেবেছিলাম টাকা যেটা দেবে নদীর ধারে কয়েক বিঘা জমি লীজ নেবো। একটা পাহারাদারও রাখা দরকার। এত টাকা কোথায় পাবো? চিন্তিত গলায় কথাগুলো বলেছিলেন বাবা।
আমার এত জমি থাকতে লীজ নিতে যাবে কেন? পাহারাদার একটা নয়, দুটো লাগবে। দিন রাত চব্বিশ ঘন্টা পাহারা লাগবে। এ ছাড়া একজন পিয়নও লাগবে ছুটোছুটির কাজ করার জন্য।
পিয়নের দরকার হবে কেন? ছুটোছুটির কাজ আমিই করতে পারবো।
নিশ্চয় পারবে। তবে পিয়নের কাজে যে সময়টা ব্যয় করবে সে সময়টা যদি খামারের আয় বাড়ানোর জন্য মাথা ঘামাও সেটা অনেক লাভের ব্যাপার হবে। .
গ্রামে রাজমিস্ত্রি পাওয়া যাবে?
গ্রামে পাওয়া যাবে না। মিস্ত্রি, ইট, বালি সব মীর্জাপুর থেকেই আনতে হবে।
দুদিনের ভেতর জিনিষপত্র সব জোগাড় হয়ে গেলো। তিন দিনের মাথায় মিস্ত্রিরা কাজ আরম্ভ করলো। তানিয়ার বাবা আর বিভূতি কাকা–দুই বন্ধু মিলে সারাক্ষণ তদারক করলেন। বুয়ার ছেলে কালার চাকরি হয়ে গেলো খামারে। বুয়ার উৎসাহের অন্ত নেই। শুনেছে জমিদার বাবু ঘন ঘন চা খান। ডাক না পড়লেও ঘণ্টায় ঘন্টায় কালাকে ডেকে চা বানিয়ে পাঠিয়ে দেয়। কতগুলো ঘটনার পর বিভূতিরঞ্জনের মনে হয়েছিলো রত্নেশ্বরীকে তিনি যত আপন ভাবুন, গ্রামের অনেক মানুষই তাঁকে আপন ভাবে না। ছেলেবেলার বন্ধু নূরউদ্দিনের সঙ্গে খামার করতে গিয়ে নতুন করে নিজের গ্রামটাকে আপন ভাবা আরম্ভ করলেন।
বাইশ দিন পর তানিয়াদের পুরোনো বাড়ির জায়গায় নতুন যে বাড়িটা উঠলো দেখে সবার চোখ জুড়িয়ে গেলো। রঙের কাজ শেষ হওয়ার পর প্রতিমা আর ওর মা এসেছিলেন দেখতে। ছবির মতো সুন্দর বাড়িটা দেখে প্রতিমা বললো, বাবা তোমরা আলাউদ্দিনের প্রদীপ পেয়েছিলে? সেদিন কী দেখলাম আর এখন কী দেখছি!
বিভূতিরঞ্জন বললেন, মিস্ত্রি বেশি লাগিয়েছিলাম। রাজমিস্ত্রি আর কাঠমিস্ত্রি এক সঙ্গে কাজ করেছে।
তানিয়ার বাবা মৃদু হেসে বললেন, পানির মতো টাকাও খরচ করতে হয়েছে।
প্রতিমার মা বললেন, টাকা খরচ করলেই কি জিনিষ ভালো হয়! রুচিও থাকা দরকার।
বাড়ি বানাবার বাজেট প্রথমে দেড় লাখ ধরা হয়েছিলো। রঙের কাজ শেষ হওয়ার পর টাকার অঙ্ক দু লাখ ছাড়িয়ে গেলো। পুরোনো বাড়ির টিনগুলো শুধু কাজে লেগেছে। তারপরও ঘর বাড়ানোর জন্য নতুন টিন কিনতে হয়েছে। রঙ করার পর নতুন আর পুরোনো সব এক রকম হয়ে গেছে। পুরোনো বাড়ির বাঁশের বেড়াগুলো টিনের নিচে সিলিং দেয়া হয়েছে। এতে গরম কম লাগবে। তানিয়ার ঘরের সঙ্গে লাগোয়া বাথরুমও হয়েছে। তবে ইলেকট্রিসিটি আসা পর্যন্ত শাওয়ার আর বেসিনের কল ব্যবহার করা যাবে না, বালতির পানিতে কাজ সারতে হবে।
প্রতিমা ওর মাকে নিয়ে বাড়ির চারদিকে ঘুরে দেখলো। বুয়া মহা উৎসাহে ওদের বীজতলা পর্যন্ত ঘুরিয়ে আনলো। পেঁপের চারা গজিয়েছে। দূর থেকে দেখে মনে হয় টিয়া পাখির পালক বিছিয়ে রেখেছে কেউ। তানিয়ার ঘরটাও ভালো লাগলো প্রতিমার। জানালা খুললে একদিকে বাঁশঝাড়, আরেক দিকে পুকুর। মনে মনে ভাবলো তানিয়া দেখলে খুবই অবাক হবে। বাবার কাছে শুনেছে তানিয়ার মা মারা যাওয়ার পর নূরু কাকু মেয়েকে নিয়ে কী কষ্টই না করেছেন।
প্রতিমার মা জানতে চাইলেন, গৃহপ্রবেশ কখন হবে নূরুদা?
তানিয়ার বাবা বিব্রত হলেন–প্রতিভা আর তানিয়া আসুক।
বিভূতিরঞ্জন বললেন, আর মাত্র পাঁচ দিন বাকি রোজার বন্ধ শুরু হতে। তানিয়াকে দারুণ একটা সারপ্রাইজ দেয়া যাবে।
প্রতিমা বললো, বাবা, বনমালী আবার তানিয়াকে বলে দেয়নি তো?
না, আমি বারণ করে দিয়েছিলাম।
নূরুদা আপনি কি রোজা রাখেন? তানিয়ার বাবার কাছে জানতে চাইলেন প্রতিমার মা।
ছোটবেলায় মাঝে মাঝে রাখতাম। বড় হয়ে কখনও রাখিনি।
তাহলে গৃহপ্রবেশের রান্নাটা আমিই করবো। তানিয়া আর প্রতিভা যেদিন আসবে সেদিনই গৃহপ্রবেশ হবে।
<