০৫.

পেঙ্গুইন টিলার কাছে খাঁড়িতে নোঙর ফেলেছে মউল, তা সত্ত্বেও খোলা সাগরের উত্তাল ঢেউয়ের ছোবল থেকে রক্ষা পাচ্ছে না সে। এখন যদি উত্তর-পশ্চিম থেকে ঝড় শুরু হয়, সাংঘাতিক বিপদ হবে। কনগ্রে চিন্তায় পড়ে গেল। ইতিমধ্যে সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, পরদিন ভাটার টান শুরু হওয়া মাত্র খাড়ি থেকে বের করে নিয়ে যাবে জাহাজটাকে। তবে তার আগে ভাল করে দেখে নিতে হবে জাহাজের কোথাও কোন ফুটো আছে কিনা। খোলা সাগরকে সব সময় শত্রু বলেই মনে করা উচিত, বেরুবার আগে নিশ্চিত হতে হবে শত্রুর হামলা ঠেকাবার মত শক্তি-সামর্থ্য জাহাজটার আছে কিনা।

সেরেসান্তেকে সঙ্গে নিয়ে গোটা জাহাজটা খুঁটিয়ে পরীক্ষা করল কনগ্রে। ওদেরকে সাহায্য করল ভার্গাস। ভার্গাস একজন চিলিয়ান, ভালপারাইসোর একটা জাহাজ তৈরির কারখানায় এক সময় কাঠমিস্ত্রির কাজ করত। যে-কোন জাহাজের আঙ্গিক ও কাঠামো সম্পর্কে তার ভাল অভিজ্ঞতা আছে।

পরীক্ষা করে জানা গেল মউল মোটামুটি অক্ষতই আছে। এখানে সেখানে সামান্য ত্রুটি থাকলেও কোনটাই মারাত্মক নয়, তবে সংখ্যায় সেগুলো অনেক। সংখ্যায় বেশি বলেই মেরামত করতে সাত দিন সময় লাগবে বলে মন্তব্য করল ভার্গাস। তারমানে সে বলতে চাইছে, কাল মউলকে এই জায়গা থেকে সরানো যাবে না।

শুনে খুব রেগে গেল কনগ্রে, মুখ খারাপ করে গাল দিল ভাগ্যকে। তার শিষ্য ডাকাতরাও খুব হতাশ হয়ে পড়ল। এত কষ্ট করে বালিয়াড়ি থেকে মুক্ত করে পেঙ্গুইন টিলার কাছে আনা হলো, অথচ এই মুহূর্তে ওটাকে কাজে লাগানো যাচ্ছে না।

সেরেসান্তের সঙ্গে আলোচনায় বসল কনগ্রে। তার বক্তব্য মন দিয়ে শুনল সবাই। সাগর পাড়ি দেয়ার আগে ছোটখাট মেরামতের কাজগুলো অবশ্যই সারিয়ে নেয়া দরকার, বলল সে।

সেরেসান্তে জিজ্ঞেস করল, রওনা হবার পর মেরামতের কাজে হাত দিলে ক্ষতি কি?

মাথা নেড়ে কনগ্রে বলল, মউলের যে হাল দেখছি, তার ওপর আস্থা রাখা যায় না। এই করুণ অবস্থার জন্যেই নাবিকরা এটাকে ফেলে রেখে পালিয়েছে। না, সেরেসান্তে, আমরা কোন ঝুঁকি নিতে পারি না। প্যাসিফিক আইল্যান্ড কি এখানে! কয়েকশো মাইল দূরে। মেরামত না করে ভোলা সাগরে বেরুলে ডুবে মরারই বেশি সম্ভাবনা। সে ঝুঁকি কেন আমরা নিতে যাব?

ভার্গাস বলল, বেশ, মেরামতই আগে করা হোক। কিন্তু মেরামতের কাজটা আমরা করব কোথায়? এখানে, এই ফাঁকা জায়গায়, খাড়ির মধ্যে? ভেবে দেখেছেন, যে-কোন মুহূর্তে, ঝড় উঠতে পারে? তখন কি হবে?  

চিলির আরেকজন লোক তাকে সমর্থন করে বলল, এরকম খোলা জায়গায় জাহাজ মেরামতের কাজে হাত দেয়া উচিত হবে না। মেরামত যদি করতেই হয়, অন্য কোন জায়গায়।

কনগ্রে তখন বলল, বেশ। চলো তাহলে মউলকে ইগোর উপসাগরে নিয়ে যাই।

সবাই চুপ করে আছে দেখে প্ল্যানটা একটু ব্যাখ্যা করল সে। ইগোর উপসাগরে তার পছন্দ মত জায়গায় মউলকে নিয়ে যেতে আটচল্লিশ ঘণ্টা লাগবে। প্ল্যানটা শুনে জলদস্যুদের মনে খানিকটা আস্থা আর উৎসাহ ফিরে এল। শুরু হলো প্রস্তুতি, পরদিন জোয়ারের সময় যাতে নির্দিষ্ট জায়গায় মউলকে নিয়ে পৌঁছানো যায়।

বাতিঘরের রক্ষীদের নিয়ে ওরা কেউ মাথা ঘামাল না। কনগ্রে তার শিষ্যদের জনিয়েছে, মেরামতের কাজ শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে, যাত্রা শুরুর আগে, ইগোর উপসাগর, নিজেদের দখলে আনব আমরা।  

সে তার এই প্ল্যানটা আরও পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করল সেরেসান্তেকে একা পেয়ে। দ্বীপটায় আমরা আর লুকিয়ে থাকছি না। আগের সিদ্ধান্তই বহাল আছে, তবে প্ল্যানটা একটু সংশোধন করেছি।  

কি সংশোধন, ওস্তাদ? জানতে চাইল সেরেসান্তে।

পাহাড় ডিঙিয়ে নয়, সাগরপথেই যাব আমরা-মউলকে নিয়ে। ওখানে পৌঁছে স্বাভাবিকভাবে নোঙর ফেবে স্কুনার। তাতে করে কেউ কিছু সন্দেহ করতে পারবে না, ধরে নেবে আমরা ভালপারাইসো থেকে আসছি।  

কিন্তু আমাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে কি ভাববে ওরা?  

ওরা ভাববে সাগরপাড়ি দেয়ার সময় বিপদে পড়ে নোঙর ফেলেছি। কাজেই ওরা আমাদেরকে খাতিরই করবে। তারপর…

তারপর, ওস্তাদ? প্রশ্নটা সেরেসান্তে না করলেও পারত, কারণ সে তার ওস্তাদকে খুব ভালভাবে চেনে, কাজেই জানে তারপর কি ঘটবে।

কনগ্রে চুপ করে থাকল, অপ্রয়োজনীয় মনে করে সেরেসান্তের প্রশ্নের জবাব দিল না। দুজন মিলে এই যে ষড়যন্ত্র করল তারা, এর সাফল্য সম্পর্কে তাদের মনে কোন সন্দেহ নেই।

যাত্রার প্রস্তুতি নিতেই বিকেল হয়ে গেল। প্রথমে প্রয়োজনীয় রসদ তোলা হলো জাহাজে। তারপর গুহা থেকে সমস্ত মালপত্র বের করে ভরা হলো হোন্ডে। চারটের মধ্যে সব কাজ শেষ, জাহাজ নোঙর তোলার জন্যে তৈরি।

কনগ্রে নতুন করে হিসাব কষে বলল, গন্তব্যে পৌঁছাতে ত্রিশ ঘণ্টার বেশি লাগবে না। রাতে জাহাজ চালানো নিরাপদ নয়, তাই সিদ্ধান্ত হলো কাল সকালে রওনা হবে তারা।

ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নামল। আবহাওয়া এক রকম শান্তই বলা যায়। সূর্য ডোবার পরও, কুয়াশা না থাকায়, আকাশ আর সাগর পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। ধারণা করা হলো রাতটা নির্বিঘ্নেই কাটবে। জলদস্যুরা বেশিরভাগই জাহাজের খোলা ডেকে রাত কাটাল, দুএকজন ঘুমাল বার্থে। ক্যাপটেনের চেয়ারটা দখল করল কনগ্রে। সেরেসান্তে বসল লেফটেন্যান্টের চেয়ারে। রাত একটু গম্ভীর হতে ডেকে বেরিয়ে এসে বাতাসের মতিগতি পরীক্ষা করে গেল কনগ্রে। না, ঝড়ের কোন আভাস নেই।

ভোরে সূর্য উঠল সোনালি আলোয় চারদিক উদ্ভাসিত করে দিয়ে। সারা বছরে এরকম সূর্যোদয় খুব কমই দেখা যায়। স্বচ্ছ ও নির্মল আকাশ টলটলে নীল, তাতে যেন নিস্তরঙ্গ সাগর প্রতিবিম্বিত হচ্ছে। একটা নৌকায় চড়ে তীরে নামল কনগ্রে, টিলার মাথায় উঠে চারদিকের সাগরে চোখ বোলাবে। দক্ষিণ দিকে সাগর এমনিতেই শান্ত থাকে, শুধু প্রণালীর প্রবেশমুখে ঢেউগুলোকে খানিকটা উদ্দাম হতে দেখা গেল। ইতিমধ্যে বাতাস বেশ জোরালো হয়েছে। চারদিকে কোথাও কোন জলযান নেই। মউল রওনা হলে পথে অন্য কোন জাহাজের সঙ্গে দেখা হবার প্রায় কোন সম্ভাবনাই নেই।

পরিবেশ পরিস্থিতি দেখার পর কনগ্রে সিদ্ধান্ত নিল দ্বীপের পশ্চিম তীর দিয়েই গন্তব্যস্থলের দিকে যাবে সে, একে একে ওয়েবস্টার, সেভারেল পয়েন্ট ইত্যাদি অন্তরীপ ঘুরে। টিলা থেকে নেমে গুহার ভেতর ঢুকল সে, উদ্দেশ্য কিছু ফেলে যাচ্ছে কিনা। দেখা।

সাতটার দিকে শুরু হলো ভাটার টান। কনগ্রের নির্দেশে স্কুনারের নোঙর তোলা হলো। বাতাস বইছে উত্তর-পুব থেকে, সেই বাতাসে ভর করে রওনা হলো তারা। খাড়ি থেকে বেরিয়ে খোলা সাগরে পড়তে দশ মিনিট লাগল। পানি কেটে দ্রুত এগোচ্ছে মউল। আধ ঘণ্টা পর সেইন্ট বার্থোলোমিউর পাহাড় ঘুরে পুবদিকে বাঁক নিল তারা।

মউলের আচরণে খুব খুশি কনগ্রে আর সেরেসান্তে। কনগ্রে বলল, এভাবে এগোতে পারলে সন্ধের আগেই তারা ইগোর উপসাগরের মুখে পৌঁছে যাবে। তবে সেটা তার ইচ্ছা, নয়। উপকূলের কোথাও নোঙর ফেলতে চায় সে, গন্তব্যে পৌঁছাবে পরদিন সূর্য ওঠার পর। তার নির্দেশে মউলের গতি কমিয়ে আনা হলো।

সারাদিন সাগরে অন্য কোন জাহাজ দেখা গেল না। সন্ধের ঠিক আগে ওয়েবস্টার অন্তরীপের পুবদিকে পৌঁছাল তারা। যাত্রার প্রথম ভাগ নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হয়েছে। তীর থেকে সামান্য দূরে নোঙর ফেলা হলো মউলের।

আবহাওয়া অনুকূল হওয়ায় জলদস্যুদের নিষ্ঠুর ষড়যন্ত্র সফল হবার মোলোআনা সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। রাত দশটার দিকে নিস্তেজ হয়ে পড়ল বাতাস। তবে ভোরের আলো ফোঁটার ঠিক আগে আবার বেশ জোরালো হয়ে উঠল। আকাশে রোদ উঠতেই নোঙর তোলার নির্দেশ দিল কনগ্রে। মউল তার দ্বিতীয় পর্বের যাত্রা শুরু করল।

তবে মউলকে ফুলস্পীডে চালানো হচ্ছে না। যতটা ক্ষমতা তার মাত্র অর্ধেকটা ব্যবহার করা হচ্ছে। তীরের সঙ্গে সমান্তরাল একটা রেখা ধরে এগোচ্ছে জাহাজ, তবে সব সময় এক মাইল দূরত্ব বজায় রেখে। এদিককার উপকূল কি প্রকৃতির তা তাদের জানা নেই বলেই সাবধানের মার নেই ভেবে তীর ঘেঁষে যাচ্ছে না।

বেলা দশটার দিকে ব্লসম উপসাগরে পড়ল মউল। এবার উত্তাল সাগরের কাছে আত্মসমর্পণ না করে উপায় থাকল না। সাগর এখানে যেন প্রচণ্ড আক্রোশে ফুঁসছে। কনগ্রে দক্ষ নাবিক, খুব সাবধানে স্কুনার চালাচ্ছে। বিকেল হলো। কম্পাসের সাহায্যে মাপজোক করল সে। অনুকূল বাতাস পাবার আশায় দিক পরিবর্তন করতে হয়েছে, তাই গন্তব্য ছাড়িয়ে খানিকটা দূরে সরে এসেছে তারা। জাহাজ ঘুরিয়ে নেয়ার নির্দেশ দিল সে। আবার ইগোর উপসাগরের দিকে ফিরে চলল মউল। সেই মুহূর্তে পয়েন্ট সেভারেল তাদের কাছ থেকে মাত্র চার মাইল উত্তর-পশ্চিমে। আরও দূরে সান হুয়ান অন্তরীপও দেখা যাচ্ছে, যদিও অস্পষ্ট।

এখান থেকেই দেখা গেল দুনিয়ার শেষ প্রান্তের সেই আলোক স্তম্ভের চুড়া। ক্যাপটেনের কামরায় টেলিস্কোপ আছে, সেটায় চোখ লাগিয়ে বাতিঘরটার দিকে তাকাল কনগ্রে। একজন রক্ষীকে দেখা গেল, লণ্ঠন-ঘরে বসে সাগরের দিকে তাকিয়ে আছে।

সূর্য ডুবতে তখনও অনেক দেরি, অন্তত তিন ঘণ্টা। কনগ্রে সিদ্ধান্ত নিল রাত নামার আগেই গন্তব্যে পৌঁছাতে চেষ্টা করবে সে।

বলাই বাহুল্য, বাতিঘর থেকে রক্ষীরাও স্কুনারটিকে দেখতে পেয়েছে। প্রথমে ওরা ভাবল, জাহাজটা ফকল্যান্ড আইল্যান্ডের দিকে যাচ্ছে। কিন্তু একটু পরই পরিষ্কার বোঝা গেল, স্টাটেন আইল্যান্ডেই আসছে তারা।

মউলকে রক্ষীরা দেখল কি দেখল না তা নিয়ে কনগ্রের কোন মাথাব্যথা নেই। যাত্রার দ্বিতীয় পর্ব সফল হতে যাচ্ছে দেখে আনন্দেই আছে সে। তবে এই পর্বের যাত্রাটা ঝামেলামুক্ত নয়। পানির নিচে লুকিয়ে আছে ডুবোপাহাড়ের চূড়া, তার একটায় ঘষা খেলে বা ধাক্কা লাগলে মউল টুকরো টুকরো হয়ে যাবে।

গন্তব্যে পৌঁছাতে আর বেশি দেরি নেই, এই সময় জলদস্যুদের একজন রিপোর্ট করল, জাহাজে একটা ফুটো তৈরি হয়েছে, সেটা দিয়ে পানিও ঢুকছে হু হু করে। না, খুব বড় ফুটো নয়। রিপোর্ট পেয়েই ভার্গাসকে তাড়া লাগাল কনগ্রে। ভার্গাস ছুটল ফুটো বন্ধ করতে। আপাতত কোন রকমে পানি ঢোকা বন্ধ করা হলো, পরে ভালভাবে মেরামত করতে হবে।

সন্ধে ঠিক ছটায় ইগোর উপসাগরের মুখে পৌঁছাল মউল। আরও আধ ঘন্টা পর বাতিঘরের উজ্জ্বল আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠল সাগর। এই বাতিঘর মাত্র সেদিন তৈরি হয়েছে, এরইমধ্যে সেটাকে লক্ষ্য করে ছুটে আসছে চিলির একটা জাহাজ। বাতিঘরের জীবনে এটাই তো প্রথম জাহাজ। কিন্তু বাসকেথ আর তার সহকারীরা জানে না জাহাজটার মালিক একদল দয়ামায়াহীন জলদস্যু। জানে না তাদের কপালে কি সাংঘাতিক বিপদ ঘনিয়ে আসছে। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে ওরা। ধীরে ধীরে তীর লক্ষ্য করে এগিয়ে আসছে স্কুনার মউল।

ডেকে দাঁড়িয়ে রয়েছে কনগ্রে। তার ঠিক পিছনেই রয়েছে সেরেসান্তে। সে হাসতে হাসতে বলল, আমাদের প্ল্যানের প্রথম পর্যায়টা সফল হলো-কি বলল, ওস্তাদ?

হ্যাঁ, প্রথম পর্যায়টা সফল হলো। ঠোঁটে বাঁকা হাসি ঝুলিয়ে মাথা ঝাঁকাল কনগ্রে। আশা করি বাকি পর্যায়গুলোও শতকরা একশো ভাগ সফল হবে।

বিশ মিনিট পর তীরের কাছাকাছি থামল মউল। নোঙর ফেলার প্রস্তুতি চলছে।

ইতিমধ্যে বাতিঘর থেকে সৈকতে এসে দাঁড়িয়েছে দুজন রক্ষী-ফিলিপ আর মরিস। গলা চড়িয়ে মউলকে ওরা অভিনন্দন জানাল। রশি খুলে একটা নৌকা নামানো হলো পানিতে, মউলে যাবে। ওদের সঙ্গে বাসকেথ নেই, সে লণ্ঠন-ঘরে নিজের কাজে ব্যস্ত।

ঘড়ঘড় বিকট আওয়াজ তুলে নোঙর পড়ছে পানিতে, এই সময় মউলের ডেকে পৌঁছাল ফিলিপ আর মরিস। কনগ্রে ইঙ্গিত করতে যা দেরি, চোখের পলকে মরিসের ঘাড়ে চকচকে একটা কুড়াল নেমে এল। বেচারা এতটুকু আওয়াজ করারও সময় পায়নি, ছিটকে পড়ে গেল ডেকের ওপর। পরমুহূর্তে একসঙ্গে গর্জে উঠল একজোড়া রিভলভার। মরিসের বন্ধু ফিলিপও ডেকের ওপর লুটিয়ে পড়ল গুলি খেয়ে। পড়ার সঙ্গে সঙ্গে মারা গেছে ওরা।

কাজে ব্যস্ত ছিল বাসকেথ, হঠাৎ কি মনে করে থামল সে, জানালার সামনে এসে সাগরের দিকে তাকাল। আর ঠিক তখনই গর্জে উঠল একজোড়া রিভলভার। গুলির শব্দ শুনে ছ্যাঁৎ করে উঠল তার বুক। কি ঘটছে চোখের সামনেই দেখতে পেল সে। সহকারীদের এভাবে খুন হতে দেখে বিস্ময়ে শোকে একেবারে পাথর হয়ে গেল সে। একসঙ্গে অনেকগুলো প্রশ্ন ভিড় করল মনে। জাহাজে চড়ে কারা এসেছে? মরিস আর ফিলিপ তো কোন অপরাধ করেনি, তাহলে ওদেরকে মারল কেন?

চিন্তা করার সময় নেই, আত্মরক্ষার প্রবল তাগাদা অনুভব করল বাসকেথ। এদের পরিচয় জানা নেই তার, তবে বুঝতে পারছে ওরা খুনী, ওকেও দেখতে পাবার সঙ্গে সঙ্গে খুন করবে। ফিলিপ আর মরিসের কথা ভেবে কান্না পাচ্ছে, হতভাগাদের জন্যে কিছুই সে করতে পারল না। এখন কি করলে খুনীদের হাত থেকে বাঁচা যায় বুঝতে পারছে না সে। হতভম্ব হয়ে ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকল। চিলির ভালপারাইসো বন্দর থেকে এসেছে লোক, এসেই কি কারণে নিরীহ দুজন লোককে একটা কথা পর্যন্ত বলতে দিয়ে মেরে ফেলল, ব্যাপারটা কোনমতে ওর মাথায় ঢুকছে না।

যেভাবে হোক প্রাণে বাঁচতে হবে, এই চিন্তাটা অস্থির করে তুলল বাসকেথকে। ভাবল, খুনীরা হয়তো জানে না এই দ্বীপে আরও একজন রক্ষী আছে। জানে না, কিন্তু জানতে কতক্ষণ? জাহাজ তীরে ভিড়তে যা দেরি, ছুটে বাতিঘরে ঢুকবে তারা। কোন সন্দেহ নেই, বাতিঘরের আলোও নিশ্চয় নিভিয়ে দেবে। পূর্ব শত্রুতার প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে ফিলিপ আর মরিসকে খুন করেছে ওরা, এ হতেই পারে না। ওরা বাতিঘরের আলোকরক্ষী, সেজন্যেই খুন করেছে। তারমানে লোকগুলোর শত্রুতা আসলে আলোটার সঙ্গেই।

মাথাটা এখন কাজ করছে। আর সময় নষ্ট না করে তর তর করে সিঁড়ি বেয়ে লণ্ঠন-ঘর থেকে নিচে নেমে এল সে।

ওদিকে খুনী লোকগুলো পানিতে নৌকা নামাবার চেষ্টা করছে। অর্থাৎ বাঁচতে হলে এখুনি পালাতে হবে বাসকেথকে। দ্রুত হাত চালাল সে। সামনে যে-কটা রিভলভার পেল সব খুঁজে নিল কোমরের বেল্টে। একটা ব্যাগে নিল প্রচুর গুলি আর বারুদ। ওই ব্যাগেই ভরল কিছু খাবার ও প্রয়োজনীয় অন্য দুএকটা জিনিস। বাতিঘর সংলগ্ন ঢালু জমিতে নামল সে। হারিয়ে গেল অন্ধকারে। এভাবেই শুরু হলো তার অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম। এখন দেখা যাক জলদস্যুদের সে ফাঁকি দিতে পারে কিনা।

.

০৬.

দ্রুত সন্ধ্যা ঘনাল, কালো অন্ধকারে ঢাকা পড়ে গেল স্টাটেন আইল্যান্ড। বাতিঘরের আলোটা জ্বলছে না, ফলে অন্ধকার যেন আরও গাঢ় হয়ে উঁকিয়ে বসল। তার ওপর আজ-আবার কুয়াশা পড়ছে। বাতাসের বেগও বেশ জোরালো। সম্ভবত একটা ঝড় উঠবে। আজ রাতটা ভীতিকর ও অভিশপ্ত। নিজের চোখেই তো দেখল বাসকেথ, ফিলিপ আর মরিস বিনা কারণে খুন হয়ে গেল।

সময়টা শীতকাল নয়, অথচ ঠাণ্ডায় কাঁপছে সে। এটা আসলে তার ভয়ের কাঁপুনি। প্রিয় সহকারীদের কথা স্মরণ করে আবার তার চোখ ফেটে পানি বেরিয়ে এল। বাতিঘর থেকে স্পষ্টই দেখেছে সে, ওদের সাশগুলো জাহাজ থেকে ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে পানিতে। শিউরে উঠে সে ভাবল, ওকেও এভাবে খুন করে ফেলে দেয়া হত পানিতে-ভাগ্যের নেহাতই জোর বলতে হবে যে ওই সময় লণ্ঠন-ঘরে জরুরী একটা কাজে ব্যস্ত ছিল সে।

চেষ্টা করেও মনটাকে শান্ত করতে পারছে না বাসকে। ফিলিপ আর মরিসকে খুব বেশি দিন থেকে চেনে না সে, কিন্তু অল্প এই কদিনেই ওদেরকে সে ভালবেসে ফেলেছিল। তিনজন ওরা একসঙ্গে চাকরির জন্যে এসেছিল, বাতিঘরের দায়িত্বও বুঝে নিয়েছিল। এখন বাসকেথ একা হয়ে গেছে। শুধু যে একা হয়ে গেছে তা নয়, একদল খুনী তাকে খুঁজে বেড়াবে এই দ্বীপে।

বাসকেথ ভাবছে স্কুনারটা স্টাটেন আইল্যান্ডে নোঙর ফেলল কেন? ওটা আসলে কাঁদের? লোকগুলো কি উদ্দেশ্যে এল এখানে? এই দ্বীপে প্রথম পা ফেলেছে, হাবভাব দেখে তা মনে হয়নি। দ্বীপে পা দিয়েই বাতিঘরের আলোটা নিভিয়ে দিল কেন? বাতিঘরের প্রতি এই বৈরি মনোভাবের কারণ কি? লোকগুলো কি চাইছে তাদেরকে অনুসরণ করে অন্য কোন জাহাজ যেন স্টাটেন আইল্যান্ডে আসতে না পারে?

এ-সব প্রশ্নের উত্তর বাসকেথের জানা নেই। জানতে হলে সরাসরি প্রশ্ন করতে হবে। সেটা সম্ভব নয়। দেখামাত্র তারা খুন করবে ওকে। হঠাৎ একটা কথা মনে পড়তে নিজেকে তিরস্কার করল বাসকেথ। ভয় পেয়ে যাওয়ায় মাথাটা ঠিকমত কাজ করেনি, মারাত্মক একটা ভুল করে বসেছে। বাতিঘর থেকে পালিয়ে আসার সময় কোন কাগজ-পত্ৰই সে সঙ্গে করে নিয়ে আসেনি। ওগুলো নাড়াচাড়া করলে অনায়াসে দ্বীপে তার উপস্থিতির কথা জেনে ফেলবে জলদস্যুরা। আর একবার জানতে পারলে…

এরপর আর ভাবতে পারছে না বাসকেথ।

তীর থেকে দুশো গজ দূরে রয়েছে সে, প্রকাণ্ড একটা পাথরের আড়ালে। এখান থেকে তিন জায়গায় জলদস্যুদের নড়াচড়া দেখতে পাচ্ছে–স্কুনারের ডেকে, বালিয়াড়ির ওপর, আর বাতিঘরের জানালায়। মাঝে মধ্যে তাদের কর্কশ গলার আওয়াজও শুনতে পাচ্ছে সে।

রাত দশটার মধ্যে এক এক করে সব আলো নিভে গেল। স্টাটেন আইল্যান্ডে নিচ্ছিদ্র অন্ধকার। বাসকেথ চিন্তা করে দেখল, এই জাহাজে তার আর থাকা উচিত নয়। লুকোবার জন্যে ভাল একটা জায়গা খুঁজে বের করতে হবে তাকে। এই পাথরের আড়ালে থাকলে দিনের আলো ফোঁটার সঙ্গে সঙ্গে তারা দেখে ফেলবে ওকে। কিন্তু এখান থেকে সরবেই বা কোথায়? দ্বীপের আরও ভেতর দিকে? নাকি উপসাগরের প্রবেশমুখে?

এই দ্বীপ থেকে পালানো সম্ভব নয়। লুকিয়েই বা কদিন থাকবে সে? সান্তা ফে ফিরে আসতে এখনও বহু দেরি, ততদিন কি লুকিয়ে থাকা সম্ভব তাড়াহুড়ো করে অল্পই রসদ নিয়ে এসেছে, খুব বেশি হলে তিনদিন চলা যাবে। তারপর খাবে কি? লুকিয়ে থাকা যদি সম্ভবও হয়, খাদ্য যোগাবে কে? মাছ ধরতে হলে খোলা জায়গায় বেরুতে হবে তাকে, আর খোলা জায়গায় বেরুলেই খুনীদের চোখে ধরা পড়ে যাবার ভয় আছে। তাছাড়া, আগুন পাবে কোথায় যে মাছ বেঁধে খাবে?

নিজেকে পরামর্শ দিল বাসকেথ, মাথা ঠাণ্ডা রাখো। আগে থেকে উদ্বিগ্ন হয়ে কোন লাভ নেই, যখন যে সমস্যা আসবে তখন সেটার সমাধান খুঁজতে হবে। আপাতত সান হুয়ান অন্তরীপের সৈকতে রাত কাটাতে কোন অসুবিধে নেই। রাতের বেলা নিশ্চয়ই তারা ওকে খুঁজতে বেরুবে না। ভোরের আলো ফোঁটার আগে অন্য কোথাও সরে গেলেই হবে। সিদ্ধান্ত নিতে পারায় মনটা খানিক হালকা হয়ে এল। আবার স্কুনারের দিকে তাকাল সে। জাহাজের ডেকে লোকজনের হাঁটাচলা বন্ধ হয়ে গেছে। ওদিকে কোন আলোও দেখা যাচ্ছে না। একটু আগে গলার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিল, এখন কিছুই শোনা যাচ্ছে না। শয়তান লোকগুলো কোন রকম বিপদের আশঙ্কা করছে না, তাই নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে।

টিলার পাশ ঘেঁষে উত্তর দিকে যাচ্ছে বাসকেথ। অভিশপ্ত রাতটা কেমন যেন ভৌতিক লাগছে, বাতাস আর পানির আওয়াজ ছাড়া আর কিছু শোনা যাচ্ছে না।

রাত এগোরোটার দিকে অন্তরীপের শেষ প্রান্তে পৌঁছাল বাসকেথ। সমতল একটা জায়গা বেছে বের করল, রাতটা কাটিয়ে দিল বালির ওপর শুয়ে।

ঘুম ভাঙল অনেক ভোরে, তখনও সূর্য ওঠেনি। চোখ রগড়ে চারদিকটা ভাল করে দেখে নিল বাসকেথ। যত দূর দৃষ্টি যায় কোথাও কেউ নেই। সাগর তীরে নৌকাও দেখা যাচ্ছে না। স্কুনারের নিজস্ব নৌকা আর রক্ষীদের ডিঙি, সবই এখন জলদস্যুদের দখলে। সাগরের যত দূর দেখা গেল, একদম ফাঁকা।

বাসকেথের মনে পড়ল, বাতিঘর তৈরি হবার আগে এদিকের পানিতে জাহাজ চালানো কী সাংঘাতিক কঠিন কাজ ছিল। এখন যদি এদিকে কোন জাহাজ আসে, তারা বাতিঘরের কোন সাহায্যই পাবে না। অসহায় বোধ করল সে, সেই সঙ্গে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল। কোন জাহাজ যদি এদিকে আসে, জলদস্যুরা আলো জ্বেলে পথ দেখাবে না। আলোটা শুধু নিজেদের প্রয়োজনে জ্বালবে তারা। দাঁতে দাঁত চেপে গাল দিল সে, শয়তানের বাচ্চারা!

বাসকেথের মাথার ভেতর এবার অন্য রকম একটা বিপদ সঙ্কেত বেজে উঠল। জলদস্যুরা এই যে আলোটা নিভিয়ে রেখেছে, এর পরিণতি ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে। একটা পাথরের ওপর ধপ করে বসে পড়ল সে, সমস্ত ঘটনা এক এক করে স্মরণ করে উপলব্ধি করল জলদস্যুরা আরও অনেক বড় ধরনের অঘটন ঘটাতে চায়। এদিকে যদি কোন জাহাজ আসে, সেগুলোকে দুর্ঘটনায় পড়তে বাধ্য করবে তারা। আলো নিভিয়ে রাখার সেটাই কারণ। দুর্ঘটনা ঘটলে আগন্তুক জাহাজ ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে। আরোহী আর নাবিকদের খুন করে জাহাজের সমস্ত মালপত্র লুঠ করবে তারা। প্রশ্ন হলো, ওদের ঠেকাবার উপায় কি? একা সে কি করতে পারে?

সান্তা ফে ফিরতে এখনও অনেক দেরি, দুমাস। এই দুমাস জলদস্যুদের হাতে সে যদি ধরা না-ও পড়ে, বেঁচে থাকবে কিভাবে?

প্রথম কাজ নিরাপদ একটা আশ্রয় খুঁজে বের করা। জলদস্যুরা নিশ্চয়ই এতক্ষণে জেনে ফেলেছে যে বাতিঘরে তিনজন রক্ষী ছিল। আজ সকাল থেকে তারা নিখোঁজ তৃতীয়জনকে পাগলের মত খুঁজতে শুরু করবে।

হতাশায় মুষড়ে পড়লে চলবে না, নিজেকে পরামর্শ দিল বাসকেথ। বসে না থেকে কাজ শুরু করল সে। একটানা অনেকক্ষণ খোঁজাখুঁজি করার পর সরু একটা গুহা দেখতে পেল। ভেতর দিকে দশ ফুট লম্বা, পাঁচ ফুট চওড়া। গুহার মেঝেতে বালি আছে। ভাল করে দেখে বুঝতে পারল, ভেতরে জোয়ারের পানি, ঢুকবে না, ঝড়ের ঝাঁপটাও লাগবে না। গুহায় ঢুকে বসল সে, বাতিঘর থেকে বয়ে আনা ব্যাগটা নামিয়ে রাখল পাশে। কাছেই বরফ গলা পানি থেকে তৈরি হয়েছে একটা ঝিল, কাজেই পানীয় জলের কোন অভাব হবে না।

খানিকটা শুকনো মাংসের ফালি আর কয়েকটা বিস্কিট খেলো বাসকেথ। শরীর খানিকটা ঝরঝরে হয়ে উঠল। গলা শুকিয়ে গেছে, পানি খাওয়া দরকার। গুহা থেকে বেরুতে যাবে, কি একটা আওয়াজ শুনে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। হায় ঈশ্বর, তারমানে জলদস্যুরা এরইমধ্যে ওর খোঁজে বেরিয়ে পড়েছে। গুহার আড়াল, থেকে না বেরিয়ে উঁকি দিয়ে বাইরে তাকাল সে। অমনি ছ্যাঁৎ করে উঠল বুক। সর্বনাশ! চারজন লোক! একটা নৌকা করে এদিকেই আসছে!

দুজন লোক বসে আছে, বাকি দুজন নৌকা চালাচ্ছে। নৌকাটা বাসকেথ চিনতে পারল না। তারমানে ওটা বাতিঘরের নৌকা নয়, স্কুনারের নৌকা। লোকগুলো যে এই দ্বীপে নতুন নয়, সেটা তাদের হাবভাব দেখেই বোঝা যাচ্ছে। একটা লোক হাল ধরে আছে, বাসকেথের মনে হলো সে-ই দলের লীডার-হয়তো স্কুনারের ক্যাপটেনও সে। ওর কাছ থেকে এখনও প্রায় একশো গজ নিচে তারা। চোখে পলক পড়ছে না, লোকগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে ও। লীডারের ইঙ্গিতে তীরে ভেড়ানো হলো নৌকা। সৈকতে নামল তারা। অস্পষ্টভাবে তাদের গলা পাচ্ছে বাসকেথ।

ঠিক জানো তো এই জায়গাই কিনা?

হ্যাঁ, ঠিক জানি। এখান থেকে বিশ গজ দূরে, পাহাড়টার বাকে।

এ আমাদের নেহাতই সৌভাগ্য যে বাতিঘরের রক্ষীরা গুহাটা আবিষ্কার করতে পারেনি।  

রক্ষীদের আগে এখানে দেড় বছর ধরে ছিল বাতিঘরের নির্মাতারা, তারাও ওটার খোঁজ পায়নি।

নিজেদের কাজে ব্যস্ত ছিল তারা, এদিক-ওদিক তাকাবার ফুরসত পায়নি।

খুঁজলেও পেত না, কারণ গুহার মুখ তো আমরা পাথর ফেলে ঢেকে রেখেছি।  

চলো, যাওয়া যাক,  বলল লীডার।

সঙ্গীদের দুজনকে নিয়ে আড়াআড়িভাবে সৈকত ধরে এগোল লীডার। আড়াল থেকে তাদের ওপর তীক্ষ্ণ নজর রাখছে বাসকেথ। এখনও তারা কথা বলছে, কিছু কিছু শুনতেও পাচ্ছে ও। তবে খানিক পরই তাদের পায়ের আওয়াজ দূরে মিলিয়ে গেল। নৌকার কাছে একজন লোককে রেখে গেছে তারা, সৈকতে পায়চারি করছে সে।

বোঝা গেল কাছাকাছি কোথাও ওদের একটা গোপন গুহা আছে। লোকগুলো জলদস্যু, এটা আগেই সন্দেহ করেছিল বাসকেথ। সন্দেহটা এখন সত্যি প্রমাণিত হলো। এ-ও পরিষ্কার হয়ে গেল, বাতিঘর তৈরি শুরু হবার আগে থেকেই স্টাটেন আইল্যান্ডে আছে তারা। এই দ্বীপ আসলে জলদস্যুদের আস্তানা। একটা গুহায় তারা তাদের লুঠ করা ধন-সম্পদ লুকিয়ে রেখেছে। সেই ধন-সম্পদ এখন সম্ভবত তারা স্কুনারে তুলে নিয়ে যাবে।

বাসকেথের মাথায় হঠাৎ একটা বুদ্ধি এল। গুহায় কি শুধু ধন-সম্পদই লুকিয়ে রাখা হয়েছে? সঙ্গে কিছু রসদ-পত্র নেই? থাকারই তো কথা। সেক্ষেত্রে ওগুলো ওর হাত করা উচিত। বেঁচে থাকার জন্যে কাজে আসবে। মনটা খুশি হয়ে উঠল ওর। চেষ্টা করলে বেঁচে থাকার একটা উপায় তাহলে হতে পারে। লোকগুলো নৌকা নিয়ে চলে যাক, তাদের গুহায় ঢুকে কিছু খাবারদাবার বের করে নেবে ও। রসদ হয়তো প্রচুর পরিমাণেই আছে, যখন খুশি প্রয়োজন মত বের করা যাবে। এভাবে যদি সান্তা ফে ফিরে না আসা পর্যন্ত চালিয়ে দেয়া যায়, মন্দ কি! মনে মনে প্রার্থনা করল বাসকেথ, সান্তা ফে না ফেরা পর্যন্ত খুনীরা যেন দ্বীপেই থাকে। তখন দেখা যাবে কতটুকু ক্ষমতা তাদের। দুজন নিরীহ লোককে বিনা কারণে খুন করেছে, এর শাস্তি তাদেরকে পেতেই হবে।

এখন জানার চেষ্টা করতে হবে লোকগুলো কত দিন দ্বীপে থাকার প্ল্যান করেছে।

.

প্রায় এক ঘণ্টা পার হয়ে গেল। গুহা থেকে বেরিয়ে আবার সৈকতের ওপর দিয়ে হেঁটে নৌকার দিকে ফিরে যাচ্ছে লোকগুলো। আড়াল থেকে তাদের কথা কান পেতে শুনছে। বাসকেথ।

রক্ষী লোকগুলো কিন্তু খারাপ ছিল না, কি বলো? দ্বীপের কোথায় কি আছে তা নিয়ে তারা মাথা ঘামায়নি। সেজন্যেই আমাদের জিনিসপত্র সব ঠিক আছে।

স্কুনার একেবারে ভরাট হয়ে যাবে। আমাদের মাল-পত্র তো কম নয়।

বুদ্ধি করে প্রচুর রসদ জমিয়ে রাখায় এখন কাজে লাগবে।

হ্যাঁ। তবে সাবধানে খরচ করতে হবে। প্যাসিফিক আইল্যান্ডে পৌঁছাবার আগে যেন সব শেষ হয়ে না যায়।  

কথা বলছে আর হাসাহাসি করছে লোকগুলো। বাসকেথের শরীরে যেন আগুন ধরে গেল। ইচ্ছে হলো গুলি করে লোকগুলোর হাসি থামিয়ে দেয়। অনেক কষ্টে নিজেকে দমন করল ও। জলদস্যুরা খুন করতে পারে, কারণ খুন করাই তাদের পেশা। কিন্তু সে, বাসকেথ, খুনী নয়। কাজেই সুযোগ থাকা সত্ত্বেও গুলি করে কাউকে মারা তার পক্ষে সম্ভব নয়। অন্তত যতক্ষণ না সে আক্রান্ত হচ্ছে।

আহা-হা, দুনিয়ার শেষ প্রান্তে এই একটাই বাতিঘর, সবেধন নীলমণি, সেটাও কেমন অন্ধ হয়ে গেছে!  কথাটা বলে জলদস্যুদের একজন গলা ছেড়ে হেসে উঠল।

আমরা এখানে থাকতে থাকতেই দুএকটা জাহাজডুবির ঘটনা ঘটবে বলে আশা করছি। বাতিঘর আলো না ফেলায় জাহাজের ক্যাপটেন পাহাড়গুলোকে দেখতে পাবে না, ফলে নির্ঘাত ধাক্কা খাবে। সেই সঙ্গে শুরু হবে আমাদের লুঠপাট। কোন খাটনি ছাড়াই পেয়ে যাব গাদা গাদা সোনা-রূপা।

আসলে আমাদের কপাল না খুলে গেছে! এমন একটা স্কুনার এসে সেইন্ট বার্থোলোমিউ-এর তীরে ঠেকল, যাতে কোন লোকজন নেই। এ যেন না চাইতেই বর পাওয়া। ব্যাপারটা এখনও আমার কাছে স্বপ্নের মত লাগছে।

বাসকেথ বুঝতে পারল স্কুনারটা কিভাবে জলদস্যুদের হাতে এসে পড়েছে।

একজন প্রশ্ন করল, এখন আমাদের প্ল্যান কি, কনগ্রে?

বাসকেথ যাকে লীডার বলে আন্দাজ করেছিল, সে-ই জবাব দিল, পরবর্তী প্ল্যান যেখানে আছে সেখানেই থাক, অর্থাৎ আমার মাথায়। আপাতত চলো মউল ফিরে যাই।

গুহার মাল-পত্র জাহাজে তুলতে হবে না?  

না, এখুনি নয়। জাহাজে টুকিটাকি মেরামতের কাজ বাকি আছে, ওগুলো আগে শেষ হোক।

মেরামতের কাজ শেষ হতে কদিন লাগবে?

ঠিক জানি না। কয়েক হপ্তাও লাগতে পারে।  

আরেকজন বলল, মেরামত করতে হলেও তো যন্ত্রপাতি লাগবে, ওস্তাদ? তুমি বললে ওগুলো আমরা নৌকায় তুলি।

হ্যাঁ, ঠিক আছে, তা তুলতে পারো। তবে শুধু যে-সব জিনিস মেরামতের কাজে লাগবে।

তাহলে আর সময় নষ্ট করি কেন। জোয়ার আসতে খুব বেশি দেরি নেই আর। এই ফাঁকে কাজটা সেরে ফেলা দরকার।

ঠিক আছে,  জবাব দিল কনগ্রে। জাহাজ মেরামত না হওয়া পর্যন্ত সব জিনিস-পত্র গুহাতেই থাকুক। এখানে তো আর চোর নেই।

চোর নেই ঠিক,  একজন বলল, কিন্তু ওস্তাদ, মনে আছে তো, বাতিঘরে লোক ছিল তিনজন। একজনকে আমরা ধরতে পারিনি।  

কনগ্রে বুলল, তার কথা বাদ দাও, সেরেসান্তে। একা সে কি করতে পারবে আমাদের? আমি জানি, ভয়ে কোথাও লুকিয়ে আছে লোকটা। বলো তো কিভাবে পটল তুলবে সে?

কিভাবে, ওস্তাদ?

খেতে না পেয়ে।

সেরেসান্তে হেসে উঠল।

কনগ্রে আবার বলল, তবে সাবধানের মার নেই, সেরেসান্তে। গুহার আশপাশেই থাকতে হবে আমাদের।

নৌকার কাছাকাছি চলে এসেছিল জলদস্যুরা, যন্ত্রপাতি আনার জন্যে আবার গুহার দিকে ফিরে গেল। খানিক পর দেখা গেল যন্ত্রপাতিগুলো নৌকায় তুলছে। কাজটা শেষ হতে টিলার আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল নৌকাটা।

এক সময় বাসকেথ বুঝতে পারল আপাতত বিপদ কেটে গেছে। গুহা থেকে বেরিয়ে এসে সৈকতে দাঁড়াল ও। ওর হাতে এখন দুটো কাজ। প্রথম কাজটা সহজ, দ্বিতীয় কাজটা অত্যন্ত কঠিন। গুহা থেকে খাবার বের করতে পাঁচ-সাত মিনিটের বেশি লাগবে না ওর। কিন্তু মউলকে দ্বীপে আটকা রাখার কি ব্যবস্থা করা যায়?

বাসকেথ চিন্তা করছে। কি করলে সান্তা ফে ফিরে না আসা পর্যন্ত স্কুনারটাকে দ্বীপে থাকতে বাধ্য করা যায়? অনেক চিন্তা করেও কোন উপায় দেখতে পাচ্ছে না ও। তবে মাথায় অন্য একটা বুদ্ধি এল। সান হুয়ান অন্তরীপের কিনারা ঘেঁষে অন্য কোন জাহাজকে আসতে দেখলে সেটাকে সঙ্কেত দিয়ে থামাবার চেষ্টা করতে পারে ও। থামলে ভাল, না থামলে পানিতে নেমে সাঁতার কাটবে ও, যেভাবে হোক জাহাজটায় চড়বে। তারপর কি ঘটেছে সব খুলে বলবে ক্যাপটেনকে। একমাত্র এভাবেই প্রতিশোধ নেয়ার চেষ্টা করতে পারে ও। কিন্তু এই মুহূর্তে সাগরে অন্য কোন জাহাজ নেই। আগে কোন জাহাজ আসুক, তখন তাতে চড়ার চেষ্টা করা যাবে।

প্রথম কাজটা অবশ্য এখুনি সেরে ফেলা যায়। রসদ সগ্রহের উদ্দেশ্যে জলদস্যুদের গুহাটার দিকে এগোল বাসকেথ।

.

জাহাজ মেরামতের কাজ পুরোদমে শুরু হয়েছে। তবে কাজটা বেশ কঠিন, তার ওপর দ্বীপে জাহাজ মেরামত করার কোন কারখানা নেই। ছুতোর মিস্ত্রি হিসেবে ভার্গাস দক্ষ, কিন্তু একা সে কতটুকু করবে। কাজ এগোচ্ছে, তবে গতি খুব মন্থর।

প্রথমে গোটা জাহাজ খালি করা হলো। প্রচুর সময় লাগল তাতে। সময়ের অবশ্য কোন অভাব নেই তাদের। বাতিঘরের সাহায্য আসবে আরও দুমাস পর। এই তথ্যটা তারা জানতে পেরেছে লগবুক থেকে। তাতে লেখা আছে প্রতি তিন মাস পর পর সান্তা ফে বাতিঘরের জন্যে সাহায্য নিয়ে আসবে। সেই হিসেবে মার্চ মাসে ফিরে আসবে সান্তা ফে। এখন ডিসেম্বর চলছে, তবে শেষ হতে আর মাত্র কটা দিন বাকি। ওই লগবুক থেকেই রক্ষীদের নাম জানতে পেরেছে কনগ্রে-বাসকেথ, ফিলিপ আর মরিস।

একজন যে পালিয়ে গেছে, এটা আগেই জেনেছে কনগ্রে। সেজন্যে অবশ্য তার কোন মাথাব্যথা নেই। একটা লোক একা তাদের কি ক্ষতি করবে! বেঁচে থাকতে হলে খাবার দরকার হবে, সেটাই তো তার নেই।

হঠাৎ জানুয়ারির তিন তারিখে আবহাওয়া খুব বেয়াড়া হয়ে উঠল। দক্ষিণ দিগন্তের কাছে দ্রুত জমে উঠল কালো মেঘ। একটুপরই ঝড় শুরু হয়ে গেল। তাপমাত্রা প্রায় এক লাফে বেড়ে গেল ষোলো ডিগ্রী। গোটা আকাশ জুড়ে বিদ্যুৎ চমকাতে শুরু করল। বাজ পড়ল বিকট শব্দে। সেই সঙ্গে সাগরও যেন খেপে উঠল।

কনগ্ৰে ভয় পেল মউল না তীরে আছড়ে পড়ে। তাহলে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে স্কুনারটা। তবে ভাগ্য ভাল যে এমন জায়গায় নোঙর ফেলেছে তারা, ঝড়ের মূল ধাক্কাটা সেখানে লাগল না। তবু সাবধানের মার নেই ভেবে কনগ্রে আরেকটা নোঙর ফেলল, মউল যাতে তীরের সঙ্গে ধাক্কা না খায়। নিজেদের নিরাপত্তার কথা ভেবে কগ্রে উদ্বিগ্ন হয়নি, কারণ সবাই তারা বাতিঘরে আশ্রয় নিয়েছে। ইতিমধ্যে সেখানে প্রচুর রসদও জড়ো করা হয়েছে। রক্ষীদের রসদও কম নয়। তারপরও যদি লাগে, গুহা থেকে আনা যাবে।

ঝড়টা শুরু হবার পর আর থামতেই চায় না। আবহাওয়ার এই খেপামি জানুয়ারির বারো তারিখ পর্যন্ত একটানা চলল। উপায় নেই, এই কটা দিন হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতে হলো তাদেরকে।

বারো তারিখ রাতে হঠাৎ বাতাসের গতিপথ বদলে গেল। এবার বাতাস বইছে দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে। তারমানে দ্বীপের আরেক দিকে শুরু হয়েছে ঝড়ের তাণ্ডব।

গত দশ দিনে একটাই মাত্র জাহাজ স্টাটেন আইল্যান্ডকে পাশ কাটিয়েছে। রাতে নয়, দিনে। জাহাজটার ক্যাপটেন বুঝতে পারেনি বাতিঘরটা ঠিকমত কাজ করছে কিনা।

জাহাজটাকে দেখামাত্র সঙ্কেত দিতে শুরু করল বাসকেথ। কিন্তু তিন মাইল দূরে থেকে জাহাজের কেউ তার সঙ্কেত দেখতে পেল না।

<

Super User