০৬.
উত্তেজনায় ভাল ঘুম হলো না সে রাতে। দুঃস্বপ্ন দেখলাম। পাহাড়ের গুহায় আলিবাবার রত্ন খুঁজে পেয়েছি যেন আমরা, কিন্তু বের করে আনার আগেই কেড়ে নিল চল্লিশ ডাকাত। আমাদের ধরে বেঁধে ফেলল। মুসাকে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করাল পাথরের বেদিতে। তার মুণ্ডু কাটবে। হাউমাউ করে চিৎকার করতে লাগল মুসা। আরেক ডাকাত এসে আমার কাধ চেপে ধরে ঝাঁকাতে লাগল।
ভেঙে গেল ঘুম। দেখি, ওঠার জন্যে আমার কাঁধ ঝাঁকাচ্ছে কিশোর।
নাস্তা সেরে দাদা চলে গেলেন শহরে, দাদী রান্নাঘরে। আমরা চলে এলাম হলঘরে। আগের রাতের অসমাপ্ত কাজটা শেষ করার জন্যে। কিশোরের ধারণা, রহস্যের সমাধান রয়েছে আমিন উদ্দিন সরকারের ছবিটাতে। গুপ্তধনের চাবিকাঠি ওটাই।
কিন্তু তাকিয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে চোখ ব্যথা করে ফেললাম। অাভাবিক কিছুই বের করতে পারলাম না ছবিটার। নিরেট কাঠে তৈরি ফ্রেম, ফাপাও নয় যে তার ভেতর কোন নকশা জাতীয় কিছু ভরে রাখা যাবে।
কিন্তু কিশোর হাল ছাড়ল না। সামনে এগিয়ে, পিছিয়ে গিয়ে, মাথা এপাশে কাত করে, ওপাশে কাত করে দেখতে লাগল। সেই সঙ্গে চলল তার নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটা।
আচমকা আনমনে বলে উঠল, ব্যাপারটা অদ্ভুত!
কি অদ্ভুত? জানতে চাইলাম আমি আর মুসা।
আমিন উদ্দিন সরকারের বাবরি চুল।
চুলে আবার কি করল? বুঝতে পারলাম না।
হয়তো কোন ফকির কিংবা পীরের মুরিদ ছিলেন, মন্তব্য করল মুসা। এ দেশে অনেককেই তো ও-রকম রাখতে দেখি, যেন মুরিদ হলে বাবরি না রাখলে চলে না।
পীরের অনুকরণ করে আরকি, কিশোর বলল। আমিন উদ্দিন সরকার কেন ও রকম চুল রেখেছিলেন, সেটা তার ব্যাপার, আমাদের মাথাব্যথা নেই। আমার প্রশ্ন হলো, বাক্সের ছবিটাতে খাটো করে ছাঁটা চুল এঁকেছেন কেন তিনি?
আঁকার সময় হয়তো তার ছোট চুল ছিল।
সেই কথাটাই ভাবছি। কি করে জানব? দীর্ঘ একটা মুহূর্ত আবার ছবিটার দিকে তাকিয়ে রইল কিশোর। দু-বার চিমটি কাটল নিচের ঠোঁটে। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল, রবিন, ম্যাগনিফাইং গ্লাসটা নিয়ে আসবে? ছবিটাও নিয়ে এসো।
ঘর থেকে ওগুলো এনে দিলাম তাকে।
দুটো ছবি মিলিয়ে মিলিয়ে দেখতে লাগল সে।
বাবরির ওপর ম্যাগনিফাইং গ্লাসটা ধরে রাখল দীর্ঘক্ষণ। ধীরে ধীরে হাসি ফুটল তার মুখে। মাথা দুলিয়ে বলল, ই, বুঝেছি! এত্তো সহজ, অথচ…
কি বুঝেছ! প্রায় চিৎকার করে উঠলাম আমি আর মুসা।
কিন্তু কিশোর জবাব দেয়ার আগেই ঝটকা দিয়ে খুলে গেল সদর দরজা। ছুটে ঘরে ঢুকল আক্কেল আলী। ভীষণ উত্তেজিত। চিৎকার করে ডাকতে লাগল, মা, ও মা, জলদি বেরোন! সাংঘাতিক কাণ্ড হয়ে গেছে! মা-আ!
রান্নাঘর থেকে তাড়াহুড়ো করে বেরোলেন দাদী। আঁচলে হাত মুছতে মুছতে জিজ্ঞেস করলেন, কি হয়েছে রে! অত চিৎকার করছিস কেন?
সর্বনাশ হয়ে গেছে, মা! সাহেব অ্যাক্সিডেন্ট করেছেন। লোক এসে খবর দিল, এখুনি হাসপাতালে যেতে হবে আপনাকে!
কিসের গুপ্তধন খোঁজা, আর কিসের ছবি-রহস্যের সমাধান, দল বেঁধে হাসপাতালে ছুটলাম আমরা।
খুব ব্যথা পেয়েছেন মতিদাদা। সারা গায়ে ছোট-বড় ব্যান্ডেজ, বা পায়ে প্লাস্টার। হাড় ভেঙে গেছে। তবে হুঁশ আছে তার। আমাদের দেখে মলিন হাসি হাসলেন। প্রথমেই দাদীকে সাবধান করে দিলেন চিৎকার করে কান্নাকাটি না করতে।
তাঁর মুখেই জানলাম, রঙ সাইড থেকে একটা ট্রাক এসে গুঁতো মেরেছিল তার গাড়িকে। ভাগ্যিস তিনি আস্তে চালাচ্ছিলেন, তাই অনেকটা সামলে নিতে পেরেছেন। নয়তো মুখোমুখি সংঘর্ষেই ভর্তা হয়ে যেত গাড়িটা। রাস্তার পাশের খাদে উল্টে পড়াও বিচিত্র ছিল না। যা-ই ঘটুক না কেন, এ কাহিনী বলার জন্যে আর বেঁচে থাকতেন না তাহলে। ট্রাকের নম্বর রাখতে পারেননি তিনি। তবে একটা ব্যাপার তার মনে হয়েছে, ইচ্ছে করেই এসে তো লাগিয়েছে ট্রাকটা। যেন মারার জন্যেই রাস্তার মোড়ে ওত পেতে বসে ছিল।
ব্যাপারটা রহস্যময় মনে হলো আমার কাছে। প্রশ্ন জাগল, এই দুর্ঘটনার সঙ্গে গুপ্তধনের কোন সম্পর্ক নেই তো? কিন্তু আমরা যে গুপ্তধন খুঁজছি কে জানে? কারও তো জানার কথা নয়!
হাসপাতালের ভিজিটিং আওয়ার শেষ হলো। বাড়ি ফিরে যেতে হবে। দাদাকে দেখাশোনার জন্যে তাঁর কাছে রয়ে গেলেন দাদী। বার বার দুঃখ প্রকাশ করলেন, আমাদের খুব অসুবিধে হয়ে যাবে। কিন্তু আমরা সে-কথা উড়িয়ে দিয়ে বললাম, কোন অসুবিধে হবে না। আক্কেল আলী থাকলেই যথেষ্ট। সে না থাকলেও অসুবিধে নেই, আমরাই রান্না করে খেতে পারব। বাড়িটা খালি হয়ে যাওয়ায় মনে মনে খুশি হলো বরং কিশোর–পরে বলেছে আমাকে আর মুসাকে, রহস্যটার সমাধান করতে সুবিধে হবে।
সকালে চমৎকার রোদ ছিল, কিন্তু হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এখন দেখি কেমন যেন মুখ গোমড়া করে রেখেছে আকাশ। গুমোট গরম, বাতাস স্তব্ধ। আকাশের ঈষাণ কোণে একটুকরো সুরমা রঙের মেঘ যেন গ্যাট হয়ে বসে আছে। ভাবেসাবে। মনে হলো, কোন কারণে যেন রেগে গেছে প্রকৃতি, ফেটে পড়ার অপেক্ষায় আছে। সন্দেহ হলো, কালবোশেখি আসছে না তো?
বাড়ি ফিরে উঠানে ঘুঘুর পালকে দানা খুঁটতে দেখলাম না। কবুতরগুলো গিয়ে বসেছে ছাতের কার্নিশে, বকবকম নেই, চুপ করে থাকার মধ্যেও যেন কি এক ধরনের অস্থিরতা। বিপদের আশঙ্কা করছে বোঝা গেল।
যাই হোক, খাওয়া-দাওয়া সেরে আর কোন কাজ না থাকায় কিশোরের উৎসাহে ছবি-রহস্য সমাধানের কাজে লেগে গেলাম আমরা। দাদার এখন অনেক টাকা দরকার। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব গুপ্তধনগুলো উদ্ধার করা গেলে ভাল।
যে কথাটা তখন বলতে গিয়ে বলতে পারেনি কিশোর, দাদার অ্যাক্সিডেন্টের কথায় থেমে যেতে হয়েছিল, সেটাই বলল, বাক্সে পাওয়া ছবির চুলের ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছ? খাটো করে আঁকা-ই হয়েছে দেয়ালে ঝোলানো ছবিটার বাবরি চোখে পড়ানোর জন্যে। আর এর মধ্যেই করে রাখা হয়েছে কারসাজি। ভাল করে দেখো আরেকবার, তোমরাও বুঝতে পারবে।
দেখলাম, যতভাবে সম্ভব। সেই আগের মতই অন্ধকারে রইলাম। মুসা বলল, দেখো, পারলে আগেই পেরে ফেলতাম; ঝুলিয়ে না রেখে বলেই ফেলো না ছাই!
কিশোর বলল, যত কারসাজি চুলের মধ্যে করে রাখা হয়েছে। দেখো, ভিন্ন ভিন্ন রঙে অতি খুদে খুদে অক্ষর আর নম্বর লেখা।
প্রায় ছোঁ মেরে কিশোরের হাত থেকে ম্যাগনিফাইং গ্লাসটা কেড়ে নিলাম। সত্যিই তো! খুব সরু নিবের কলম দিয়ে এমন করে আঁকা হয়েছে ওগুলো, মিশে রয়েছে কোঁকড়া চুলের মধ্যে। জানা না থাকলে মনে হবে চুলের অলঙ্করণ করার জন্যে ওসব এঁকেছে আর্টিস্ট। ভাল বুদ্ধি করেছিলেন আমিন উদ্দিন সরকার।
নিশ্চয় কোন তথ্য দিয়েছেন! মুসা বলল। গুপ্তধনের খোঁজ!
তা দিয়েছেন, কিশোর বলল। তবে খুবই গোলমেলে জিনিস। সাঙ্কেতিক। সঙ্কেতের মানে বের করতে না পারলে বোঝা যাবে না কোথায় আছে।
তাহলে বসে আছো কেন? শুরু করে দাও না। আমরা যে পারব না, অন্তত আমি পারব না এ তো জানা কথাই।
আবার ম্যাগনিফাইং গ্লাস তুলে নিল কিশোর। দেখতে লাগল খুদে অক্ষর আর নম্বরগুলো।
দেখো, একটা নিয়ম মেনে চলা হয়েছে। চুলের দুটো করে ভাজের ফাঁকে, মাঝখানে একসারিতে রয়েছে অক্ষরগুলো। একেক সারির একেক রঙ। লালচে, ধূসর, বাদামী, ছাই রঙ…রঙের এই বিভিন্নতা কেন? একেকটা রঙ কি একেকটা বাক্য গঠন করেছে?
অক্ষরগুলো এত ছোট, ঠিকমত পড়া যায় না, বললাম।
ইচ্ছে করেই অত ছোট করেছে, নইলে তো যে কারোই চোখে পড়ে যেত। গ্লাস দিয়ে চেষ্টা করলে পড়া যাবে। এক কাজ করো, কাগজ কলম নিয়ে এসো।
নোটবুক আর পেন্সিল পকেটেই থাকে আমার। বের করে তৈরি হয়ে বসলাম।
বলা নেই কওয়া নেই, হঠাৎ বাজ পড়ল প্রচণ্ড শব্দে। ভীষণ চমকে গেলাম। ছুটে দরজার বাইরে বেরিয়ে এলাম আমি আর মুসা। তাজ্জব হয়ে দেখলাম আকাশের রূপ। সেই সুরমা রঙের মেঘের টুকরোটাই বিরাট-বিশাল হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে প্রায় আধখানা আকাশ জুড়ে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে তার ভেতর। আরও কিছু ছেঁড়া মেঘের টুকরো ছুটাছুটি করছে আকাশের ইতিউতি।
কালবোশেখি আসছে, পেছন থেকে বলে উঠল কিশোর।
মালীর ঘর থেকে বেরিয়ে এল আক্কেল আলী আর কালু। আক্কেল আলী বলল, ঘরে যান, ঝড়বৃষ্টি হবে।
আমি বললাম, আসুক। ঝড় দেখব আজ।
হাসল আক্কেল আলী। বলল, আম কুড়ানোর ইচ্ছে আছে নাকি?
আছে! লাফিয়ে উঠল মুসা। অসুবিধে হবে?
কিছু হবে না, যদি আসল ঝড়টা আসার আগেই ঘরে ঢুকে যান। বেশি ঝড়ে ডাল ভেঙে পড়ে, গাছ উপড়ায়, মাথায় পড়লে মরবেন।
শাই শাই একটা আওয়াজ কানে আসছিল, বুঝতে পারছিলাম না কিসের, গাছের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তেই বুঝলাম বাতাসের শব্দ শুনছিলাম। অনেক জায়গায় অনেক রকমের ঝড় দেখেছি, কিন্তু এর যেন তুলনা হয় না। স্তব্ধ হয়ে থাকা গাছের ডালপাতা আচমকা ভীষণ দুলতে আরম্ভ করল। প্রচণ্ড আঘাতে শুকনো পাতা উড়তে লাগল। টুপটাপ খসে পড়তে লাগল পাকা আম।
লাফ দিয়ে বারান্দা থেকে নেমে গেলাম আমরা তিনজন। পাকা আম কুড়াতে শুরু করলাম। কিন্তু কটা কুড়াব! দু-হাতে দুটো তুলে নিতে না নিতেই আশপাশে আরও দশ-বিশটা করে পড়ে। আম কুড়াতে যে এত মজা জানতাম না। মহাআনন্দে আমাদের সঙ্গে এসে যোগ দিল কালু। আম তো তুলতে পারে না, চারপাশে নাচানাচি আর ঘেউ ঘেউ জুড়ে দিল। খানিক দূরে দাঁড়িয়ে হাসছে আক্কেল আলী।
কয়েক মিনিট পর ক্ষণিকের বিরতি দিয়ে আবার বইতে শুরু করল বাতাস। আগের চেয়ে দ্বিগুণ জোরে। সেই সঙ্গে বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা পড়তে লাগল। এইবার শঙ্কা দেখা দিল আক্কেল আলীর চোখে। জরুরী গলায় বলল, জলদি ঘরে যান! তুফান এসে গেছে!
বারান্দায় গিয়ে উঠলাম। কিন্তু প্রবল বাতাস আর বৃষ্টির দাপটে সেখানেও টিকতে পারলাম না। ঘরে ঢুকে যেতে হলো। আমাদের সঙ্গে ঢুকল আক্কেল আলী আর কালু।
প্রায় ঘন্টাখানেক ধরে বইল ভয়াবহ ঝড়। তারপর হঠাৎ যেমন এসেছিল তেমনি করেই থেমে গেল আবার। কমে গেল বাতাস, আস্তে আস্তে বৃষ্টি পড়াও থেমে গেল। বাইরে বেরিয়ে অবাক হয়ে গেলাম। পশ্চিম আকাশে বিশাল এক মেঘের পাহাড়ের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছে পড়ন্ত সূর্য। আশ্চর্য তার রূপ আর রঙ! বিশ্বাসই হতে চায় না–এই কয়েক মিনিট আগেও কালিগোলা অন্ধকারে ঢেকে গিয়েছিল এখানে পৃথিবী। মাটিতে পড়ে থাকা ঝরাপাতার স্তূপ, ভেঙে পড়া ডাল আর পানি জমা না থাকলে ঝড় হয়ে গেল যে সেটাই বোঝা যেত না।
অনেক আম পাওয়া গেল। খেতে খেতে গলা পর্যন্ত ভরে গেল আমাদের। দু হাত, মুখ রসে মাখামাখি। ফল যে কোনদিন এত মজা করে, এভাবে খাওয়া যায়, তা-ও জানতাম না। এত মায়া, এত মাধুর্য আছে যে এই দেশটাতে, এখানে কেউ না এলে, বাস না করলে অনুভব করা তো দূরের কথা, আন্দাজও করতে পারবে না।
সন্ধ্যা হলো। প্রচণ্ড ঝড়ের পর কেমন নিস্তব্ধ হয়ে গেছে প্রকৃতি। দূর থেকে আজান শোনা গেল। ধ্যানমগ্ন হয়ে গেছে বুঝি সবাই-ওই যে গোধূলির কালচে আকাশ, নিচের গাছপালায় ছাওয়া প্রকৃতি, পোকামাকড়, পশুপাখি, সব, সবাই যেন স্রষ্টার প্রার্থনায় মগ্ন। দেখতে দেখতে মনটা বিষণ্ণ হয়ে যায় অকারণে।
আলো জ্বেলে দিল আক্কেল আলী। রাতের জন্যে রান্না করতে গিয়ে ঢুকল রান্নাঘরে। আমরা তিন বন্ধু আবার ফিরে এলাম হলঘরে, আমিন উদ্দিন সরকারের ছবির কাছে। সাঙ্কেতিক অক্ষরের সমাধান করতে বসলাম।
অক্ষর আর নম্বরগুলো সাজিয়ে ফেলতে লাগল কিশোর। সে বলতে লাগল, আমি লিখে নিলাম। প্রথমে লালচে রঙে লেখা অক্ষর, লাইনটা দাঁড়াল এ রকম:
নিজচে২ খোঁজজো৪ আধাজর৩ জালেজর১
তারপর বাদামী:
আজছে২ তাজাহার৩ ভেজতর৪ সিজন্দুক১
একেক রঙে লেখা অক্ষরের একেকটা লাইন, সব মিলিয়ে হলো চারটে:
নিজচে২ খোঁজজোঃ আধাজরত জালেজর১
আজছে২ তাজাহার ভেজতরঃ সিন্দুক
সাজত তিন২ পাঁজচে৩ মিজলিয়ে দেজখো৫
রজতুরাজি৩ পেজয়ে যাজবেহ
অক্ষরগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলাম বোকার মত, কিছুই বুঝতে পারলাম না।
মুসা তো বলেই ফেলল, খাইছে! এ কোন ভাষা!
কারও কথার জবাব দিল না কিশোর। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অক্ষরগুলোর দিকে। তারপর নীরবে আমার হাত থেকে পেন্সিলটা নিয়ে বলল, মনে হয় বুঝতে পারছি। এক, দুই, তিন করে নম্বর দেয়া আছে। নম্বর অনুসারে অক্ষরগুলোকে পর পর সাজিয়ে ফেলা যাক।
সাজিয়ে লেখার পর দাঁড়াল:
জালেজর নিজচে আধাজর খোঁজজো
সিজন্দুক আজছে তাজাহার ভেজতর
সাজত তিজন পাজচ মিজলিয়ে দেজখো
পেজয়ে যাজবে রজতুরাজি
মুসা বলল, এতেই বা কি হলো? সহজ কি হয়েছে?
হাসি ফুটল কিশোরের মুখে। মাথা নেড়ে বলল, হয়েছে। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, এখনও বুঝতে পারছ না? একটা ব্যাপার লক্ষ করেছ? প্রতিটি শব্দেই একটা করে বর্গীয় জ জুড়ে দেয়া হয়েছে, জটিল করে তোলার জন্যে। বাদ দিয়ে দাও…
বুঝে গেছি! প্রায় চিৎকার করে উঠলাম। পানির মত সহজ হয়ে গেছে এখন। তাড়াতাড়ি নোটবুকে লিখে ফেললাম:
জালের নিচে আধার খোজো
সিন্দুক আছে তাহার ভেতর
সাত তিন পাঁচ মিলিয়ে দেখো
পেয়ে যাবে রত্নরাজি
লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল কিশোর। বলল, মেসেজ পেয়ে গেছি! কোথায় খুঁজতে হবে বলে দিয়েছে। কাল থেকেই শুরু করব খোঁজা!
.
০৭.
সারাদিন অনেক পরিশ্রম গেছে। রাতের খাওয়া সেরে শোয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়লাম।
মাঝরাতে হঠাৎ করে ঘুম ভেঙে গেল আমার। কালুর ডাকে। নিচতলায় আক্কেল আলীর সঙ্গে ছিল সে। এখন বাইরে চলে গেছে। তার ঘেউ ঘেউ শুনে আক্কেল আলীর ঘুমও ভাঙল। ডাকতে ডাকতে বাইরে বেরোল সে।
মুসা আর কিশোরও জেগে গেল। সবাই বেরোলাম। কি হয়েছে জিজ্ঞেস করলাম আক্কেল আলীকে। সে বলল, মনে হয় চোর ঢুকেছিল!
জিজ্ঞেস করলাম, কিছু নিয়েছে?
বুঝতে পারছি না!
ঘরে ফিরে এসে দেখতে লাগল সে, কিছু নিয়েছে কিনা। দেখা গেল সব ঠিকঠাকই আছে। কিছু খোয়া যায়নি। সময়মত কালু জেগে যাওয়াতেই বোধহয় খালিহাতে পালিয়েছে।
তবে খালি হাতে যে যায়নি, যা নিতে এসেছিল, নিয়েই গেছে, সেটা জানতে পারলাম পরদিন সকালে। আমাদের ঘরে টেবিলের ওপর রেখেছিলাম পোড় বাড়িতে পাওয়া বাক্স আর তার ভেতরের কাগজটা। অনেক খুঁজেও আর পেলাম না সেটা। বুঝলাম, ওটা নিতেই এসেছিল চোর।
আরও নিশ্চিত হয়ে গেলাম, সঠিক পথেই এগোচ্ছি আমরা। গুপ্তধনগুলো এখনও খোয়া যায়নি, এ বাড়িতেই আছে। তবে দুঃখের বিষয়, আমরা ছাড়াও আরও কেউ জানে সে-খবর। ছবিটাও নিয়ে গেছে। আমাদের আগেই যদি গুপ্তধন কোথায় আছে, বের করে ফেলে?
কিশোর বলল, ফেললে ফেলুক। সিন্দুকের চাবি আমাদের কাছে। খুলবে কি করে?
তালা ভেঙে, জবাব দিল মুসা।
দেখা যাক কি করে। আমরাও তো আর বসে থাকব না। আমাদের অনেক সুবিধে। বাড়ির যেখানে-সেখানে যখন-তখন খোঁজাখুঁজি করতে পারব, সে পারবে না। তাকে আসতে হবে রাতের অন্ধকারে লুকিয়ে।
তা-ও বটে।
খাবার তৈরি করে, টিফিন ক্যারিয়ারে ভরে হাসপাতালে রওনা হয়ে গেল আক্কেল আলী। আমরা বাড়িতেই রয়ে গেলাম। বলে দিলাম, বিকেলে ভিজিটিং আওয়ারে দাদাকে দেখতে যাব।
সকালের নাস্তা সেরেই আর দেরি করল না কিশোর, মেসেজটার মানে বের করতে বসে গেল। কয়েকবার করে পড়ল ছড়াটা। তারপর বলল, প্রথম লাইনটা থেকে শুরু করি-জালের নিচে আধার খোজো!
আধার মানে তো পাত্র, তাই না? মুসার প্রশ্ন।
মাথা ঝাঁকাল কিশোর, হ্যাঁ।
কি বলতে চায়? কোন জালটালের নিচে লুকিয়ে রেখেছে সিন্দুকটা?
মনে হয় না, মাথা নাড়ল কিশোর। জাল এমন কোন জিনিস নয় যার নিচে দেখা যায় না। তা ছাড়া সুতার জাল আর কতদিন টেকে? ব্যবহার করলে তো যায়ই, পড়ে থাকলেও নষ্ট হয়ে যায়।
তাহলে?
সেটাই তো ভাবছি, আনমনে নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল একবার কিশোর।
আমি বললাম, আচ্ছা, দেখতে ভুল করোনি তো? হয়তো জল লিখেছে, তুমি পড়েছ জাল…
তীক্ষ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে তুড়ি বাজাল কিশোর, ঠিক বলেছ! জলই হবে! তাহলে মিলে যায়! জলের নিচে আধার খোজো, তার ভেতরে সিন্দুক আছে। তার মানে কোন জলাশয় বা পানির নিচে লুকানো আছে একটা বড় পাত্র, তার মধ্যে রাখা হয়েছে সিন্দুকটা।
পুকুরের নিচে না তো? মুসা বলল, মজা পুকুরটা! আমি বাবা ওর মধ্যে নামতে পারব না। সাধারণ সিন্দুক থাকলেই ওতে ভূত হয়ে যাবে, আর রত্ন ভরা লোহার সিন্দুক হলে তো কথাই নেই, ভূতুড়ে সিন্দুকদের রাজা হবে!
ওই পুকুরে ডুব দিতে আমারও ভয় লাগবে, স্বীকার করল কিশোর। এক কাজ করতে পারি আমরা। আক্কেল আলী এলে, জেলে এনে মাছ ধরার ছুতোয় বেড়জাল নামিয়ে দিতে পারি। নিচে থাকলে জালে আটকাবেই সিন্দুকটা।
যদি দীঘিটাতে ফেলে দিয়ে থাকে? আমি প্রশ্ন তুললাম।
আমার তা মনে হয় না। এত বড় দীঘি থেকে যে সিন্দুক তোলা সহজ হবে না, এত নিচে নেমে কেউ খুঁজতে পারবে না, এটা জানা ছিল আমিন সরকারের। নিজেকে দিয়েই ভাবি, তার পরিস্থিতিতে আমি হলে কি করতাম? এমন কোথাও রাখতাম, যেখানে খোঁজার কথা সহজে মনে আসবে না কারও, কিন্তু জেনে গেলে বের করে আনতে আর অসুবিধে হবে না। দীঘির তলা থেকে তুলে আনা বেজায় কঠিন। একমাত্র উপায়, সমস্ত পানি সেঁচে ফেলা। তারপরেও কথা থাকে, কাদায় বেশিদিন জেগে থাকবে না ভারি সিন্দুক, দ্রুত তলিয়ে যাবে। তখন পানি সেঁচলেও আর পাওয়ার উপায় থাকবে না। দীঘির নিচে লুকানোটা মোটেও নিরাপদ না। এমন কোথাও রেখেছেন, যেখানে সহজে খুঁজে পাবে না কেউ, আবার নিরাপদে থাকবে দীর্ঘদিন।
পুকুরের বেলায়ও তো এ কথা খাটে?
তা খাটে। তবে ছোট পুকুর তো, পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। তা ছাড়া তখন তাড়াহুড়োয় কোনমতে সিন্দুকটা লুকিয়ে ফেলার কথাই কেবল ভেবেছেন আমিন সরকার…
আচ্ছা, বাধা দিয়ে মুসা বলল, আরও সহজ জায়গার কথা ভাবছি না কেন আমরা?
কোথায়? জানতে চাইলাম আমি আর কিশোর।
পোড়ো বাড়িটার পাশের মাছের অ্যাকোয়ারিয়াম! ওটাও তো জলাশয়…
তাই তো! লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল কিশোর, আজকে আমার মাথাটার হলো কি? এটা ভাবলাম না কেন? জলদি চলো! শাবল, কোদাল নিয়ে যাব!
কালুকে সঙ্গে করে সেই পোড়োবাড়ির কাছে চলে এলাম আমরা। অগভীর নালার মুখটা মাটি দিয়ে বন্ধ করে দিতেই পুকুরের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। অ্যাকোয়ারিয়ামের সামান্য পানি সেঁচে ফেললাম আমরা। নিচে কাদা। কোদাল দিয়ে তুলে ফেলতে যথেষ্ট কষ্ট হলো। তারপরে মাটি খোঁড়া অবশ্য সহজ হয়ে গেল, ভেজা মাটি বেশ নরম। কোপ দিলেই উঠে চলে আসে।
কিন্তু ছয়…সাত…আট ফুট গর্ত করে ফেলার পরও কিছুই পাওয়া গেল না। শাবল কিংবা কোদালের ফলায় লেগে ঠং করে উঠল না লোহার সিন্দুক। আরও ফুট দুয়েক খুঁড়ে দেখল মুসা। গলগল করে পানি উঠে আসছে এখন গর্তের নিচে। ভরে যাচ্ছে।
বোঝা গেল, এখানে নেই সিন্দুকটা।
ক্লান্ত হয়ে বেতবন থেকে বেরিয়ে এলাম আমরা। সারা গা কাদায় মাখামাখি। দীঘির পানিতে ধুয়ে ফেললাম। খিদে ততটা পায়নি, কারণ কাজ করার ফাঁকে ফাঁকে প্রচুর আম খেয়েছি।
খানিকক্ষণ জিরিয়ে নিয়ে বাড়িতে এসে ভাত খেয়ে নিলাম। সকালেই রান্না করে রেখে গেছে আক্কেল আলী। তারপর আবার বেরোলাম গুপ্তধন খুঁজতে।
পুকুর আর দীঘিটা বাদে যত রকম জলাশয়, অর্থাৎ পানির আধার আছে ও বাড়িতে, সমস্ত জায়গায় খুঁজলাম। পানির ট্যাংকের ওপর উঠে ঢাকনা তুলে ভেতরটা দেখল মুসা। বাগানের ট্যাপের নিচে মাটি খুঁড়ে দেখা হলো। এমনকি ঘরে বাইরে যতগুলো কল আছে, সবগুলোর আশপাশের, নিচের দেয়াল ঠুকে ঠুকে দেখলাম কোথাও ফাপা জায়গা আছে কিনা। টর্চের আলো ফেলে পুরানো। পাতকুয়াটার নিচেটা দেখলাম। পানি নেই এখন। শুকনো। সিন্দুক জাতীয় কিছু চোখে পড়ল না।
বেশ হতাশ হয়েই বিকেল বেলা হাসপাতালে রওনা হলাম তিনজনে। কালুকে রেখে গেলাম বাড়ি পাহারায়। টিক্কা খানও রইল, তবে তাকে দিয়ে কোন কাজ হবে না। চোর এলে ঠেকাতে পারবে না সে, ঠেকাতে যাবেও না। সে নিজেই একটা বড় চোর।
মতিদাদার অবস্থা আজকে বেশ খারাপ মনে হলো। দাদীর মখ শুকনো। কি ব্যাপার? ডাক্তার বললেন, না, ভয় পাওয়ার কিছু নেই। জখমগুলো ফুলেছে, প্রচণ্ড ব্যথা, সেজন্যেই কষ্ট পাচ্ছেন দাদা। ব্যথা কমানোর ইনজেকশন দেয়া হয়েছে, সেই সঙ্গে ঘুমের ওষুধ, সেরে যাবে। অল্পক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়বেন দাদা।
দুঃখ করে দাদী বলতে লাগলেন, আমরাও বেড়াতে এলাম, আর এ রকম একটা অঘটন ঘটল। আটকে বসে থাকতে হচ্ছে তাকে, আমাদের জন্যে কিছুই করাতে পারছেন না।
তাঁকে নানা ভাবে সান্তনা দিলাম। কিশোর ইঙ্গিত দিল, খুব তাড়াতাড়িই গুপ্তধনগুলোও বের করে ফেলা যাবে। ও বাড়িতেই যে আছে ওগুলো, এখন এ ব্যাপারে সে নিশ্চিত।
ভিজিটিং আওয়ার শেষ হলে বাড়ি ফিরলাম আমরা।
সিংহ দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। ভেবেছিলাম, গেটের কাছে বসে থাকবে কাল, কিন্তু তাকে দেখলাম না। উঠানে এসে দেখি নিশ্চিন্ত মনে খাবার খুঁটছে একজোড়া ঘুঘু আর কয়েকটা কবুতর। কালু নেই। গেল কোথায়? হঠাৎ তার ঘেউ ঘেউ শোনা গেল মালীর ঘর থেকে, আমাদের সাড়া পেয়েই বোধহয় ডেকেছে।
গিয়ে দেখি বাইরে থেকে দরজায় শেকল তুলে দিয়ে ঘরে আটকে রাখা হয়েছে তাকে। অবাক কাণ্ড! কে করল এ কাজ?
গম্ভীর হয়ে কিশোর বলল, ওই চোরটা এসেছিল। কোন ভাবে কুত্তাটাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে নিয়ে গিয়ে ঘরে আটকে রেখে গুপ্তধন খুঁজেছে! জলদি এসো, দেখি কি করল!
আর কোথাও কোন পরিবর্তন দেখলাম না, কেবল হলঘরে আমিন উদ্দিন সরকারের ছবিটা মেঝেতে নামানো। তারমানে আমাদেরই মত ওটার পেছনে গুপ্তপথ আছে কিনা দেখতে চেয়েছে চোর। বোধহয় আমাদের সাড়া পেয়েই আর তোলার সময় পায়নি, তাড়াহুড়ো করে পালিয়েছে।
আচ্ছা, আক্কেল আলী কিছু করছে না তো? মুসার প্রশ্ন। মাথা নাড়ল কিশোর, মনে হয় না। এ বাড়ির অনেক পুরানো চাকর সে…
পুরানো চাকরেরা যে অঘটন ঘটায় না, এমন তো কোন কথা নেই। হাসপাতাল থেকে আমাদের অনেক আগে বেরিয়ে এসেছে সে।
সে তো বাজারে যাবে বলে।
আমরা তো আর সঙ্গে যাইনি। দেখব কি করে? বাজারে যাওয়ার ছুতো করে হয়তো এখানে চলে এসেছিল।
চুপ হয়ে গেল কিশোর। হা-না কিছু আর বলল না।
আমরা আসার ঘণ্টাখানেক পর ফিরল আক্কেল আলী। হাসল আমাদের দিকে তাকিয়ে। বলল, আজ পাঙ্গাস মাছ রান্না হবে। অনেক বড় দেখে এনেছি। টমেটো দিয়ে মাছ, ফুলকপি ভাজি, ডাল। আম-কাঁঠাল-দুধ তো আছেই। চলবে?
মুহূর্তে চোরের খাতা থেকে তাকে খারিজ করে দিল মুসা। তাড়াতাড়ি বলল, চলবে মানে! জলদি যাও, ভাই, রান্নাটা সেরে ফেলো! এতটা খিদে পেয়েছে বুঝিনি
আক্কেল আলী রান্নাঘরে চলে গেল। আমরা বেরিয়ে এসে বসলাম দীঘির ঘাটে। সূর্য তখন প্রায় ডুবে গেছে। পশ্চিম আকাশের বিশাল মেঘটা একটা লাল-কালো বিচিত্র পাহাড়ের মত লাগছে।
গুপ্তধনের ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করতে লাগলাম আমরা।
কিন্তু কোন মানে বের করতে পারলাম না। মুসা বলল, দেখো, আমার মনে হয় ওই মজা পুকুরটাতেই খোঁজা দরকার। জেলে নামিয়ে দিয়ে দেখা উচিত।
দাদা থাকলে সুবিধে হত, কিশোর বলল। বেকায়দা হয়ে গেল। দেখি আক্কেল আলীকে জিজ্ঞেস করে, সে কোন ব্যবস্থা করতে পারে কিনা।
.
০৮.
খাবার টেবিলে বসে জিজ্ঞেস করা হলে আক্কেল আলীকে। কেন জাল ফেলতে চাই, জানতে চাইল সে। সব শুনে বলল, তা জেলের ব্যবস্থা করা যায়। নগদ টাকা দিতে হবে না। মাছ যা উঠবে তার অর্ধেক দিয়ে দিলেই হবে। কিন্তু ওই পুকুরটাতে ভাল জাতের মাছ কিছু নেই। শোল, গজার এসব ছাড়া।
ওসব মাছের ভাগ নিয়ে কোন জেলে জাল ফেলতে রাজি হবে না? কিশোর জানতে চাইল।
হয়তো হবে। শোল-গজারেরও মেলা দাম। মাছই পাওয়া যায় না আজকাল মোটে। ভোরবেলা বেরোব। পেয়ে যাব কাউকে না কাউকে।
রাতটা নিরাপদেই কাটল।
পরদিন সকালে জেলের ব্যবস্থা ঠিকই করে ফেলল আক্কেল আলী।
তিনবার করে বেড়া দেয়া হলো পুকুরটাতে। ভকভক করে নিচ থেকে কাদা উঠে ওপরের পানিও ঘোলা করে দিল, সর্বনাশ হয়ে গেল শাপলার। মাছ ধরা পড়ল প্রচুর–কই, শিং, মাগুর, টাকি, শোল এসব মাছ। জেলেরা অখুশি হলো না। অখুশি হলাম আমরা। সিন্দুক তো দূরের কথা, ছোটখাটো একটা বাক্সও পাওয়া গেল না।
মাছের ভাগ নিয়ে চলে গেল জেলেরা। ভাগে পাওয়া বাকি অর্ধেক মাছের বেশির ভাগই আবার পুকুরে ছেড়ে দিল আক্কেল আলী, কিছু জিইয়ে রাখল খাওয়ার জন্যে।
দাদা আর দাদীর জন্যে খাবার নিয়ে হাসপাতালে চলে গেল সে। আমরা আবার এসে বসলাম পুকুর পাড়ে।
কিশোর হাত বাড়াল আমার দিকে, দেখি, দাও তো তোমার নোটবইটা। মেসেজের মানে বুঝতে হয়তো ভুল করেছি আমরা। অন্য কিছু বোঝাতে চেয়েছে।
কয়েকবার করে ছড়াটা পড়ল সে।
আমি বললাম, আচ্ছা, তোমার দেখার ভুল না তো? লিখেছে এক অক্ষর, তুমি পড়েছ আরেকটা, এমন হতে পারে না?
লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল কিশোর। তা তো পারেই! চলো, দেখি!
ভুল একটা সত্যিই হয়েছে, বেরোলো সেটা। প্রথম লাইনে জানের নিচে আধার খোজোর জায়গায় হবে জালের নিচে আঁধার খোজো। মাত্র একটা চন্দ্রবিন্দুর গোলমাল। কিন্তু ওই একটা চন্দ্রবিন্দুই যে এভাবে ভোগাবে আমাদের, তা কি আর জানতাম!
মুসা বলল, লাভটা কি হলো? আগের মতই গ্রীক ভাষা হয়ে আছে। জালের নিচে আঁধার কোথায়? জাল নিজেই তো একটা ফাঁকওয়ালা জিনিস…
লেখাটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে উঠল কিশোর। বলল, বোধহয়, বুঝেছি! এসো!
সোজা আমাদের থাকার ঘরে চলে এল সে। চৌকাঠের নিচ থেকে বের করল লুকিয়ে রাখা চাবিটা। টর্চ নিয়ে এগোল আলমারির দরজার মত দরজাটার দিকে। কোন প্রশ্ন করলাম না। জানি, নিজে থেকে কিছু সে না বললে প্রশ্ন করে তার কাছে থেকে জবাব পাব না।
দরজা খুলে আমাদের নিয়ে চলে এল সিঁড়ির নিচে। জালের মত ঢাকনাটার কাছে এসে কিশোর বলল, দেখো, এইটাকে যদি জাল ধরে নিই, তাহলে এর নিচে কি আছে?
কয়লা, নিরীহ স্বরে জবাব দিল মুসা।
আমি চেঁচিয়ে উঠলাম, অন্ধকার!
হ্যাঁ, অন্ধকার, মাথা ঝাঁকাল কিলোর, মানে, আঁধার। জালের নিচে আঁধার খুঁজতে বলা হয়েছে। চলো, সেটাই এখন খুঁজি।
একটানে ঢাকনাটা খুলে নিয়ে সবার আগে নেমে পড়ল মুসা। আমি আর কিশোর নামলাম তার পেছনে। দেয়াল ঠুকে ঠুকে পরীক্ষা করলাম আমরা। মেঝে পরীক্ষা করলাম–জায়গায় জায়গায় ছাল-চামড়া ওঠা, মেরামত করার কথাও আর মনে হয়নি কারও। এখানে নামেই না কেউ। প্রায়োজন পড়ে না। কোথাও কোন ফাপা শব্দ হলো না। ঘরে কোন জানালা দরজা নেই, আলো আসার পথ নেই, ঢোকার একমাত্র পথ ওই জালিকাটা ঢাকনাটা।
সিন্দুকটা আছে কোথায়? প্রশ্নটা আমাদের সবারই মনে।
এককোণে অযত্নে ফেলে রাখা হয়েছে কিছু কয়লা, ছোট একটা ভূপ। সেদিকে তাকিয়ে নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটতে লাগল কিশোর।
বাইরে কালুর ঘেউ ঘেউ শোনা গেল। সে যে উত্তেজিত হয়ে ডাকছে, গুপ্তধনের চিন্তা আমাদের মাথায় না থাকলে হয়তো বুঝতে পারতাম। কিন্তু এ-মুহূর্তে কোন গুরুত্বই দিলাম না ডাকটাকে।
কয়লার স্তূপের দিকে হাত তুলল কিশোর, ওর নিচে দেখতে হবে।
মরচে পড়া একটা বেলচা পড়ে আছে। সেটা তুলে নিল মুসা।
কয়লা সরাতে দেরি হলো না। মেঝেতে দেখা গেল খানিকটা জায়গার প্লাস্টার নেই। ইট বেরিয়ে আছে। ওরকম ইট ঘরের অনেক জায়গাতেই বেরিয়ে আছে। আলাদা কিছু না। খুব একটা আশা করতে পারলাম না।
শাবল দিয়ে চাড় মেরে সেগুলো তোলার পরই কিন্তু বেরিয়ে পড়ল একটা খুদে আয়রন সেফ। চিত করে শোয়ানো। ডালা এবং হাতল ওপরের দিকে করা।
উত্তেজনায় প্রায় কাঁপছি আমি। মুসার অবস্থাও আমারই মত।
আমাদের দিকে তাকিয়ে হাসল কিশোর। বলল, জালের নিচে আঁধার খোজো, সিন্দুক আছে তাহার ভেতর। এটুকু মিলে গেল। এবার পরের লাইন–সাত তিন পাঁচ মিলিয়ে দেখো। এটা সহজ, নিজেই যেন নিজেকে বোঝাচ্ছে সে, লক কম্বিনেশন। চাবির ফুটোয় চাবি ঢুকিয়ে মোচড় দিল। ঘুরল না। নব ধরে কম্বিনেশন মেলাতে শুরু করল-সাত…তিন…পাঁচ। কট করে একটা আওয়াজ হলো। আবার চাবিতে মোচড় দিতেই খুলে গেল তালা।
হাতল ধরে বাঁকা করে চাপ দিয়ে টেনে ডালা খুলল কিশোর।
হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম আমরা। টর্চের আলোয় যেন জ্বলতে লাগল সোনা আর পাথরে তৈরি মহামূল্যবান জিনিসগুলো।
দীর্ঘ একটা মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে থাকার পর নীরবতা ভাঙল মুসা, খাইছে, কি জিনিসরে বাবা! দাম কত হবে?
খড়খড়ে গলায় জবাব এল ওপরের ঢাকনার কাছ থেকে, অনেক! কোটিখানেক টাকা হলেও অবাক হব না। অনেক ধন্যবাদ তোমাদেরকে, খুঁজে বের করার জন্যে।
ঝট করে ফিরে তাকালাম আমরা। অপরিচিত একটা লোক। হাতে পিস্তল। ধীরপায়ে সরু সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসতে শুরু করল সে।
কয়লার ঘরের মেঝেতে এসে দাঁড়াল লোকটা।
কে আপনি? কণ্ঠস্বর স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছে কিশোর, বুঝতে পারছি।
বললেই কি আর চিনবে? খড়খড়ে গলায় বলল লোকটা, আমার নাম রবিউল। কিন্তু অনেকেই আমাকে দেখতে পারে না, বলে রবিগুণ্ডা। তাতে অবশ্য আমি কিছু মনে করি না, আড়ালে বলে তো। সামনে বলার সাহস কারও নেই।
কি চান?
সেটা আবার বলে দিতে হবে নাকি? হাতে করে আনা একটা চটের ব্যাগ ছুঁড়ে দিয়ে বলল রবিগুণ্ডা, অনেক করেছ, ছোট্ট আরেকটা কাজ করো, জিনিসগুলো ভরে দাও, নিয়ে বিদেয় হই।
তারমানে আপনিই লেগেছিলেন পেছনে। ছবি চুরি করেছেন, খালি বাড়িতে এসে কালুকে মালীর ঘরে ভরে রেখে অনুসন্ধান চালিয়েছেন…
কালু কি কুত্তাটার নাম নাকি? ভীষণ পাজি। এখন ও তো ঢুকতেই দেবে না। শেষে মাথায় বাড়ি দিয়ে বেহুশ করে ফেলে রেখে আসতে হলো।
মতিদাদার গাড়িতেও আপনিই ধাক্কা লাগিয়েছিলেন নাকি?
খিক খিক করে হাসল রবিগুণ্ডা। না, আমি না, আমার এক দোস্ত।
ও। একটা মুহূর্ত চুপ করে রইল কিশোর। গালে হাত ডলল। তারপর বলল, তার মানে একা কাজ করছেন না আপনি। দলে আরও লোক আছে। আপনাদের বস কে?
হাসি হাসি ভাবটা দূর হয়ে গেল রবিগুণ্ডার মুখ থেকে। আচমকা খেঁকিয়ে উঠল, এত কথা জিজ্ঞেস করো কেন! যা বলছি, করো, জিনিসগুলো ব্যাগে ভরে দাও গুলি খেতে না চাইলে! জলদি!
আচ্ছা আচ্ছা, যাচ্ছি! তাড়াতাড়ি বলল কিশোর। গুলি করবেন না!
এক ধমকেই কাবু হয়ে গেল! এটা তো তার স্বভাব না। কোন চালাকি করছে না তো? পরস্পরের দিকে তাকালাম আমি আর মুসা।
আড়চোখে দেখলাম, সেটার কাছে গিয়ে আবার বসে পড়ল কিশোর। লোকটার দিকে পেছন করে। হাঁ হয়ে খুলে থাকা ডালার নিচে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে বের করে আনল চাবিটা, আলগোছে ফেলে দিল বুক পকেটে, লোকটার অলক্ষে। তারপর এক ঝটকায় ডালাটা আবার লাগিয়ে দিয়ে কম্বিনেশনের নব ঘুরিয়ে সব নম্বর দিল এলোমেলো করে।
অ্যাই, কি করো, কি করো! বলে চিৎকার করে উঠল লোকটা।
হাত ঝাড়তে ঝাড়তে উঠে দাঁড়াল কিলোর। ডালাটা বন্ধ করে দিলাম।
খোলো, নইলে গুলি করব!।
পা বাড়াতে গেল মুসা। ঝট করে তার দিকে পিস্তল ঘুরিয়ে ধমক দিল রবিগুণ্ডা, খবরদার!
থেমে গেল মুসা।
কঠিন কঠে বলল লোকটা, এক থেকে তিন পর্যন্ত শুনব। এর মধ্যে না খুললে প্রথমে পায়ে গুলি করব, তারার… কি করবে পিস্তল নাচিয়ে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিল সে।
শুনল, এক!
চুপ করে রইলাম আমরা। কিশোর কি করে দেখছি।
কয়েক সেকেন্ড বিরতি দিয়ে আবার বলল রবিগুণ্ডা, দুই!
কিশোর চুপ।
উসখুস করছে মুসা। আমারও অস্থির লাগছে।
ঠিক এই সময় একটা নড়াচড়া লক্ষ করলাম ওপরে। দেখলাম, ঢাকনার কাছে নীরবে এসে দাঁড়িয়েছে কাল। লোকটা তিন গোনার সঙ্গে সঙ্গে ঘাউ করে একটা হাঁক ছেড়ে বাঘের মত ঝাঁপিয়ে পড়ল তার ওপর।
.
০৯.
একসঙ্গে ঘটে গেল কয়েকটা ঘটনা। আমাকে ওপর দিকে তাকাতে দেখেই সন্দেহ হওয়ায় রবিগুণ্ডাও তাকিয়েছিল। সরে যাওয়ার চেষ্টা করল সে। তাতে লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো কালু, টুটি কামড়ে ধরতে পারল না। তবে একেবারে বিফল হলো না তার। আক্রমণ। ঝাড়া লেগে হাত থেকে পিস্তলটা উড়ে চলে গেল নোকটার।
এ রকম একটা সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিল মুসা। চোখের পলকে গিয়ে পড়ল লোকটার ওপর। জাপটে ধরে এক ল্যাঙ মেরে ফেলে দিল মেঝেতে। আমিও চুপ রইলাম না। তুলে নিলাম পিস্তলটা।
আবার গলায় কামড় বসাতে গেল কালু। মার খেয়ে হিংস্র হয়ে উঠেছে, প্রতিশোধ নিতে চাইছে লোকটার ওপর। গলার কলার টেনে তাকে আটকাল কিশোর।
পিস্তলটা আমাদের দখলে চলে আসায় আর কিছু করতে পারল না রবি। তা ছাড়া একা সে, আমাদের তিনজনের সঙ্গে পারবে না, তার ওপর রয়েছে সাংঘাতিক খেপে যাওয়া একটা কুকুর। আর গোলমাল করল না সে।
তাকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম আমরা। ছাড়া রাখতে সাহস পাচ্ছি না। তাই একটা গাছের সঙ্গে বেঁধে ফেলার ব্যবস্থা করলাম। এরপর বসলাম আলোচনায়, কি করা যায়?
কিশোর বলল, থানা অনেক দূরে। অতটা পথ তাকে হটিয়ে নিয়ে যাওয়া নিরাপদ না। তা ছাড়া একটা লোককে পিছমোড়া করে বেঁধে পিতলের মুখে নিয়ে চললে ভিড় করে আসবে লোকে। কেন নিয়ে চলেছি, কি করেছে সে, জিজ্ঞেস করে করে জান অস্থির করে দেবে। বলতে হবে আমাদের। গুপ্তধনের খোঁজ পেয়েছি যে জানাজানি হয়ে যাওয়ার ভয় আছে। চোর-ডাকাতের তো অভাব নেই। আরও অনেকেই এসে লুট করার চেষ্টা করবে তখন।
তাহলে কি করব? বললাম, একে এখানে এভাবেই বেঁধে রেখে যাই। থানায় গিয়ে পুলিশকে খবর দিই, পুলিশই এসে ধরে নিয়ে যাক।
এটাই ভাল, মুসা বলল। রবিগুণ্ডার দিকে তাকাল সে। হেসে বলল, কি মিয়া, থাকতে পারবে না? কালুকে পাহারায় রেখে যাব। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এখানে পাখি দেখবে। সময়টা খারাপ কাটবে না।
থানায় এসে দাদায় পরিচয় জানিয়ে, আমরা তার কি হই বলে, চোর ধরার খবরটা দিলাম। গাড়ি নিয়ে রওনা হলেন একজন সাব ইন্সপেক্টর। তাঁর নাম ফারুক হোসেন।
কিন্তু সাংঘাতিক একটা চমক অপেক্ষা করছিল আমাদের জন্যে। গাছের কাছে। এসে দেখলাম, রবিগুণ্ডা পালিয়েছে। কয়েক টুকরো কাটা দড়ি পড়ে আছে গোড়ায়। কালুকে ছেড়ে রেখে গিয়েছিলাম, তাকে এখন বেঁধে রাখা হয়েছে গাছের সঙ্গে। আমাদের দেখেই কেউ কেউ করে উঠল।
অপদার্থ কুকুর! মার খায়, ধরা পড়ে, এ একটা কুকুর হলো নাকি! গাধা! বিরক্ত হয়ে বলল মুসা। হত যদি জিনার রাফিয়ান, কিংবা আমাদের চিতা, টের পেত বাছাধন। পালাতে আর হত না। কিন্তু ছুটল কি করে লোকটা?
গম্ভীর হয়ে কিশোর বলল, গিটগুলো হয়তো শক্ত করে দাওনি। ভুল হয়ে গেছে। আমাদের একজনের থাকা উচিত ছিল এখানে।
আমরা যে মিথ্যে বলিনি, বিশ্বাস করলেন সাব-ইন্সপেক্টর। কাটা দড়িগুলো আছে। সবচেয়ে বড় প্রমাণ হলো পিস্তলটা। ওটা তার হাতে তুলে দিলাম আমরা। চোরটাকে ধরার সব রকম চেষ্টা করা হবে-এই আশ্বাস দিয়ে চলে গেলেন তিনি।
আপাতত আর কোন কাজ নেই। খাওয়া-দাওয়া সেরে হাসপাতালে রওনা হলাম আমরা। দাদার খোঁজও নেব, গুপ্তধন পাওয়ার সুখবরটাও তাঁকে জানাব।
বলো কি বিশ্বাসই করতে পারলেন না দাদা। সত্যি পেয়েছ! গোয়েন্দা বটে তোমরা! কিন্তু আর ও বাড়িতে ফিরে যাওয়া চলবে না তোমাদের। হোটেলে থাকবে। বলা যায় না, দলবল নিয়ে আবার ফিরে আসতে পারে রবিগুণ্ডা। ক্ষতি করবে তোমাদের।
তা পারবে না, কিশোর বলল। সাবধান থাকব। ওর মত গুণ্ডাকে কেয়ার করি না আমরা। এর চেয়ে অনেক বড় বড় চোর-ডাকাতের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়েছে। আমাদের। ও কিছু করতে পারবে না। হোটেলে থাকলে গুপ্তধনগুলো পাহারা দেবে কে?
পুলিশকে বলোনি ওগুলোর কথা? অবাক হলেন দাদা।
না। বলেছি, পিস্তল দেখিয়ে ঘরে ডাকাতি করতে এসেছিল রবিশুণ্ডা। কালুর সাহায্যে আটকে ফেলেছি।
ইস, অ্যাক্সিডেন্ট করার আর সময় পেলাম না। এখন বাড়ি থাকা উচিত ছিল আমাদের।
অ্যাক্সিডেন্টটা ইচ্ছে করে ঘটানো হয়েছে, আপনাকে সরিয়ে দেয়ার জন্যে। রবিগুণ্ডা একা নয়, আরও লোক আছে। আমার বিশ্বাস, দলের নেতা অন্য কেউ। আড়ালে থেকে যে কলকাঠি নাড়ছে। ওরা ভেবেছিল, আপনি হাসপাতালে গেলে দাদীও বাড়ি থাকবে না। তাহলে আমাদেরকেও অন্য কোথাও চলে যেতে হবে। এই সুযোগে গুপ্তধনগুলো বের করে নিয়ে যেতে পারবে ওরা। আমরা যে থেকেই যাব, বাগড়া দেব, এটা ভাবেনি।
সেই জন্যেই তো ভয়। রাগ করে এখন তোমাদের ওপর শোধ তোলার চেষ্টা করবে। অ্যাক্সিডেন্টে আমি মরেও যেতে পারতাম। কেয়ার করেনি ওরা। তারমানে তোমাদের খুন করতেও হাত কাপবে না ওদের। তাই বলছি…
বলাবলির কিছু নেই, দৃঢ়কণ্ঠে বলল কিশোর, আমরা ও বাড়িতেই ফিরে যাব। দেখাই যাক না, ওদের কতখানি দৌড়। গিয়েই জিনিসগুলো নিরাপদ কোথাও সরিয়ে ফেলব। আগের জায়গায় রাখা ঠিক হবে না।
কোথায় সরাবে?
দেখি গিয়ে। জায়গা একটা পেয়েই যাব। এতবড় বাড়িতে লুকানোর জায়গার অভাব হবে না।
আক্কেল আলীকে নিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম আমরা। দেখি, গাছেই বাধা রয়েছে। কালু। আমরা বেরোনোর সময় ওকে ছেড়ে দিতে ভুলে গিয়েছিলাম। আমাদের দেখে কুঁই কুঁই শুরু করল।
রাগ করে মুসা বলল, ঠিক হয়েছে! তোর মত একটা অপদার্থ গর্দভের ওরকম শাস্তিই হওয়া উচিত। গলায় দড়ি বেঁধে থাকতে কেমন লাগল?
গুপ্তধনগুলো দেখার জন্যে ভেতরে ভেতরে তড়পাচ্ছে আক্কেল আলী। বাড়ি এসে আর থাকতে পারল না। বলল, চলুন না, জিনিসগুলো দেখি।
তাকে নিয়ে কয়লা রাখার ঘরে ঢুকলাম আমরা। ঢুকেই চক্ষু স্থির। আয়রন সেফের ঢাকনা হাঁ হয়ে খুলে আছে। ভেতরে নেই জিনিসগুলো।
তাড়াতাড়ি গিয়ে হুমড়ি খেয়ে বসে পরীক্ষা করতে লাগল কিশোর। মুখ না তুলেই বলল, কোন ধরনের এক্সপ্লোসিভ দিয়ে তালা ভেঙে খোলা হয়েছে!
তারমানে অহেতুকই এত কষ্ট করলাম আমরা! তিক্তকণ্ঠে বলল মুসা। গেল জিনিসগুলো! আর পাওয়া যাবে না!
বাতাসে বারুদের কড়া গন্ধ। নাক উঁচু করে শুঁকতে শুঁকতে কিশোর বলল, বেশিক্ষণ হয়নি গেছে।
তাতে কি? ধরা তো আর যাবে না।
তবু এখুনি গিয়ে পুলিশকে জানানো দরকার।
থানায় গিয়ে সেই সাব ইন্সপেক্টরকে পাওয়া গেল-ফারুক হোসেন, তাঁর ডিউটি শেষ হয়নি। এইবার সব কথা, অর্থাৎ গুপ্তধনের কথাটাও খুলে বলতে হলো। মৃদু অনুযোগ করলেন তিনি, তখন জিনিসগুলোর কথা তাকে না জানানোয়। তাহলে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে পারতেন। ভুল যে হয়ে গেছে, স্বীকার করতেই হলো আমাদের।
ওয়্যারলেসে আশপাশের সমস্ত ফাঁড়িতে খবরটা জানিয়ে দিলেন তিনি। রেলস্টেশন, বাস স্টেশন আর যেদিকে যে-কটা মহাসড়ক বেরিয়ে গেছে, সবগুলোতে কড়া পাহারার ব্যবস্থা হলো। রবিগুণ্ডার চেহারার বর্ণনা দিয়ে দেয়া হলো। ওরকম চেহারার লোকের ব্যাপারে সতর্ক থাকবে পুলিশ।
দু-জন কনস্টেবলকে সঙ্গে করে নিয়ে এসে সরেজমিনে তদন্ত করে দেখে গরমের ছুটি গেলেন সাব ইন্সপেক্টর। বললেন, চোরটার কোন খবর পেলে আমাদের জানামো হবে।
আক্কেল আলী হাসপাতালে গিয়ে দাদাকে খবরটা জানানোর কথা বলল। কিশোর রাজি হলো না। অসুস্থ অবস্থায় তাকে সুখবর দেয়া যায়, কিন্তু দুঃসংবাদ জানানোটা উচিত নয়।
.
১০.
এরপর কয়েক দিন কেটে গেল। আর কোন ঘটনা ঘটল না। জমিদার বাড়িতে আছি আমরা। খাইদাই, ঘুরে বেড়াই আর গুপ্তধনগুলো পেয়েও হাতছাড়া হয়ে গেল বলে দুঃখ করি। ওগুলো উদ্ধারের আর কোন ব্যবস্থা করতে পারিনি।
দাদার অবস্থা ভাল হয়ে আসছে। পায়ের হাড় জোড়া লাগতে আরও দেরি হবে। তবে সে-জন্যে হাসপাতালে আর থাকার প্রয়োজন পড়বে না। শুনলাম, শথ্রি তাকে ছেড়ে দেয়া হবে।
রবিগুণ্ডা ধরা পড়েনি। তার কোন হদিসই করতে পারেনি পুলিশ। হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে যেন সে।
আমাদেরই খুঁজে বের করতে হবে ওকে, একদিন বলল কিশোর।
কি করে? মুসার প্রশ্ন। কোন সূত্র নেই আমাদের হাতে। কোথায় খুঁজব? পুলিশই যেখানে বিফল হয়েছে, আমরা কি করতে পারি?
তা জানি না। তবে কিছু একটা করা দরকার।
কোন ব্যাপারেই সহজে নিরাশ হওয়া কিশোরের ধাতে নেই।
যাই হোক, সুত্রটা হঠাৎ করেই পেয়ে গেলাম। কিংবা বলা যায় সূত্রের মালিককেই পাওয়া হয়ে গেল। সেদিন হাটের দিন। দুপুরের পর আক্কেল আলী কল, হাটে যাবে। আমরাও রওনা হলাম তার সঙ্গে।
বিরাট হাট বসেছে ময়নামতি বাজারের আশপাশ জুড়ে। ঘুরে ঘুরে সওদা করতে শুরু করল আক্কেল আলী! সব পাওয়া যাচ্ছে এখানে–মাছ, তরিতরকারি, ডিম, নানা রকম ফল। খুবই ভাল লাগত আমাদের, কিন্তু মজা অনেকখানি নষ্ট করে দিল আমাদের প্রতি মানুষের অস্বাভাবিক কৌতূহল। বিদেশী দেখলেই বোধহয় এ রকম করে ওরা। দল বেঁধে শুধু যে ছোট ছেলেরা পেছনে লাগল, তা নয়, অনেক বড় মানুষও আমাদের পিছে পিছে ঘুরতে লাগল। কোথায় যাই, কি করি, দেখে। শেষে ধমক দিয়ে ওদের সরাতে হলো আক্কেল আলীকে। তা-ও কি আর পুরোপুরি সরে। কয়েকটা ছেলে লেগেই রইল, এমন ভাবভঙ্গি ওদের, আমরা যেন চিড়িয়াখানার জীব, কিংবা ভিনগ্রহ থেকে নেমেছি।
এক জায়গায় গরম গরম জিলিপি ভাজা হচ্ছে দেখে লোভ সামলাতে পারল না মুসা, খেতে বসে গেল। আমি আর কিশোরও বসলাম। লোকের কৌতূহলী নজর আমাদের দিকে মুহূর্তের জন্যেও যেন সরাতে ইচ্ছে করছে না ওদের। আড়ষ্ট বোধ করতেন রকম ফুল মানুষের অস্থাটি করতে লাগলাম আমি। তবে মুসা ওসব কেয়ার করল না। কুড়মুড় করে খেয়েই চলল। দেখতে দেখতে সাবাড় করে দিল কেজিখানেক।
হঠাৎ এক চানাচুরওয়ালার ওপর চোখ পড়ল আমাদের। রঙিন বিচিত্র পোশক পরনে, মাথায় লম্বা চোখা টুপি, মুখে চোঙ। সেটাতে ফুঁ দিয়ে বো বো আওয়াজ করছে, অদ্ভুত ভঙ্গিতে কথা বলছে। যেন সার্কাসের সঙ। তার চোখও আমাদের ওপর। আমরা তাকাতেই দ্বিধা করল, চোখ নামিয়ে নিল, তারপর সরে চলে গেল আরেক দিকে।
লোকটাকে চেনা চেনা লাগল না? লোকটার পেছনটা দেখা যাচ্ছে, সেদিকে তাকিয়ে আছে কিশোর।
কিসের চেনা, জিলিপির আমেজে রয়েছে এখনও মুসা। পাশের দোকানে কদমা বিক্রি হচ্ছে। কদমার স্তূপের দিকে খেয়াল এখন তার। এখানে ওরকম সাজ সেজেই চানাচুর বিক্রি করে তো, পোশাকের জন্যে সবাইকেই এক রকম দেখা যায়।
আমি সেটা মানতে পারলাম না। লোকটাকে পরিচিত মনে হয়েছে আমারও। নিচু গলায় বললাম, রবিগুণ্ডা নয় তো? ছদ্মবেশে আছে?
উঠে দাঁড়াল কিশোর। এগিয়ে গেল লোকটার দিকে। আমিও এগোলাম তার সঙ্গে।
চানাচুর কেনার ছুতোয় লোকটাকে ভালমত দেখলাম আমরা। চুল কেটে, গোঁফ কামিয়ে, মুখে রঙ মেখে অনেক পরিবর্তন করে ফেলেছে চেহারার, কিন্তু কিশোরের তীক্ষ্ণ চোখকে ফাঁকি দিতে পারল না।
সরে এসে ফিসফিস করে আমাকে বলল সে, রবিগুণ্ডাই, কোন সন্দেহ নেই।
কি করব? পুলিশকে খবর দেব?
না, চোখ রাখতে হবে। বাজারের পর সে কোথায় যায় দেখব।
আক্কেল আলীকে লাগিয়ে রাখলাম তার পেছনে। আমরা লাগলে সন্দেহ করবে। সে ছদ্মবেশে থাকা সত্ত্বেও আমরা যখন তাকে চিনেছি, আমাদেরকেও নি চিনে ফেলেছে।
সন্ধ্যা হয়ে এল। বড় বড় কুপি বাতি জ্বেলে নিতে লাগল দোকানিরা, বাইরে যারা বসেছে। তবে আর বেশিক্ষণ চলল না হাট। ভেঙে গেল দ্রুত। বাজার থেকে বেরিয়ে একটা পায়েচলা মেঠোপথ ধরে রওনা হলো চানাচুরওলা। পিছু নিল আক্কেল আলী। তার সঙ্গে বেশ খানিকটা দূরত্ব রেখে অনুসরণ করলাম আমরা তিনজন।
শুরুতে পিছু নেয়াটা খুব একটা কঠিন হলো না, কারণ হাটফেরতা প্রচুর লোক চলেছে, তাদের সঙ্গে মিশে গেলাম আমরা। আকাশে চাঁদ আছে বটে, তবে চারু পাঁচদিনের। আলো যা আছে তাতে রাস্তা দেখা যায়, কিন্তু কয়েক গজ দূর থেকেও মানুষ চেনা যায় না। চানাচুরওলাকে চেনা যাচ্ছে তার বিচিত্র পোশাকের জন্যে, বিশেষ করে মাথার চূড়াওয়ালা টুপিটাই তার অস্তিত্ব ফাঁস করে দিচ্ছে।
এক জায়গায় এসে দু-ভাগ হয়ে গেছে রাস্তাটা। মূল পথটা চলে গেছে গায়ের দিকে, লোকজন সব সে-দিকে চলে গেল। রবি চলল অন্য পথটা ধরে নদীর দিকে। ভাগ্যিস এখানে চষা খেত আর নেই, ঝোঁপঝাড়ের ভেতর দিয়ে এগিয়েছে পথ, নইলে আমাদেরকে দেখে ফেলত সে। মাথা নুইয়ে ঝোঁপঝাড়ে গা ঢেকে নিঃশব্দে এগোলাম আমরা।
বেশ কাছে থেকেই তাকে অনুসরণ করে চলেছে আক্কেল আলী। কাজটায় ভয় যেমন লাগছে তার, মজাও পাচ্ছে। চমৎকার রোমাঞ্চ বোধ করেছে তার অনুভূতির কথা পরে সব বলেছে আমাদের।
হঠাৎ কি যেন ভেবে পেছন ফিরে তাকাল চোরটা। ঝট করে একটা ঝোঁপের পাশে বসে পড়ল আক্কেল আলী। তাকে আর দেখল না রবিগুণ্ডা।
এ কোথায় চলেছে সে?-অবাক হয়ে ভাবল আক্কেল আলী। ভাব দেখে তো মনে হচ্ছে নদীর পাড়ের শোনের দিকে চলেছে। সর্বনাশ! লোকটার কি ভয়ডর বলে কিছু নেই? ওখানেই তো আছে ভয়ঙ্কর এক কালী মন্দির, পারতপক্ষে ওদিকে ঘেষে না লোকে। এমনকি গরু চরাতেও যায় না রাখালরা। নেহায়েত বাধ্য হলে কোন কারণে দিনের বেলায়ও লোকে ওটার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দোয়া-দরূদ পড়ে বুকে ফুঁ দিতে দিতে যায়।
বিশাল এক নারকেল-সুপারির বাগানে ঢুকে গেছে পথটা। বাগানটার দুই পাশে বিরাট জঙ্গল। আম-কাঁঠাল-জাম ছাড়াও আরও নানা রকম গাছ আছে, মাঝে মাঝে বাশঝাড়। ভয়ানক জায়গা।
আক্কেল আলীকে অবাক করে দিয়ে একেবারে ওই কালী মন্দিরের সামনেই গিয়ে দাঁড়াল রবিগুণ্ডা। আরেক বার পেছনে তাকিয়ে দেখে নিশ্চিত হয়ে নিল কেউ পিছু নিয়েছে কিনা। কাউকে না দেখে ভাবল, নেয়নি। সেজন্যেই চোঙাটা নামিয়ে রেখে পকেট থেকে মোম আর দেশলাই বের করে ধরাল। আলো হাতে ঢুকে পড়ল মন্দিরের ভেতর।
পিছিয়ে এল আক্কেল আলী। ভয় পেয়েছে সে। দুই হাতে বাজারের ব্যাগ নিয়ে আরেকটু হলেই পড়েছিল আমাদের গায়ের ওপর।
কি হলো? জানতে চাইল কিশোর।
কা-কা-কালী মন্দিরে ঢুকল লোকটা!
তাতে কি?
বুঝতে পারছেন না? কাছেই শ্মশান, মড়া পোড়ানো হয়। আর ওই মন্দিরে কালীদেবীর পূজা হয়। বছরে একবার। বাকি সময়টায় খালিই পড়ে থাকে। লোকে বলে, ওই শশ্মশানের যত ভূতের আড্ডা ওই মন্দিরে।
খাইছে! আক্কেল আলীর চেয়ে বেশি ভয় পেয়ে গেল মুসা। আমি যাই!
ঘুরতে গেল সে। খপ করে তার হাত চেপে ধরল কিশোর। দাঁড়াও! রবিগুণ্ডাকে যখন ভূতে কিছু করে না, আমাদেরও করবে না। চলো, দেখি।
আগে আগে চলল কিশোর। তার পেছনে আমি। আমাদের পেছনে ভয়ে ভয়ে আসতে লাগল মুসা আর আক্কেল আলী।
মন্দিরের ভাঙা দরজা দিয়ে ভেতরের মোমের আলো দেখতে পেলাম। গাছপালার আড়ালে লুকিয়ে রইলাম আমরা।
ফিসফিস করে কিশোর বলল, এখানেই কোথাও লুকিয়ে রেখেছে গুপ্তধনগুলো। বেরও করতে পারছে না পুলিশের ভয়ে, নিয়ে পালাতেও পারছে না। নিতে পারলে এতদিনে পালিয়ে যেত। পুলিশকে ফাঁকি দেয়ার জন্যেই চানাচুরওয়ালার ছদ্মবেশে থাকতে হচ্ছে।
কিন্তু এই ব্যাটা এখানে থাকে কি করে! সাংঘাতিক অবাক লাগছে মুসার, এই ভূতের আড্ডায়!
তার মানেই তো বোঝা যাচ্ছে ভূতফুত কিছু নেই এখানে। কেউ আসেও না, নিরাপদ ভেবেছে জায়গাটা।
কি করব এখন আমরা? জিজ্ঞেস করলাম। লোকটাকে ধরার চেষ্টা করব?
না। ভয়ানক লোক সে। আরও পিস্তল থাকতে পারে তার কাছে। গুলি খেতে যাওয়ার মানে হয় না। তার চেয়ে এক কাজ করা যাক, তুমি আর আমি এখানে থাকি, মুসা আর আক্কেল আলী গিয়ে পুলিশকে খবর দিক। এখানে থেকে চোরটার ওপর নজর রাখব আমরা। আর তাকে পালাতে দেয়া যাবে না।