যে কালের উপর চিরবিস্মরণের পদ পড়িয়া গিয়াছে, সেকাল মিলনোৎকণ্ঠিত নবযৌবনা নাগরী যখন সন্ধ্যাসমাগমে ভবনশীর্ষে উঠিয়া কেশপ্রসাধনে প্রবৃত্ত হইতেন, তখন তাঁহার স্বর্ণমুকুরে যে উৎফুল্ল-উৎসুক স্মিত-সলজ্জ মুখের প্রতিবিম্ব পড়িত, তাহা এ কালেও আমরা সহজে অনুমান করিতে পারি। চিরন্তনী নারীর ঐ মূর্তিটিই শুধু শাশ্বত-যুগে যুগান্তরে অচপল হইয়া আছে। কেবলমাত্র ঐ নিদর্শন দ্বারাই তাঁহাকে সেই নারী বলিয়া চিনিয়া লইতে পারি।

কিন্তু অন্য বিষয়ে—?

সে যাক। প্রসাধনরতা সুন্দরীর দ্রুত অধীর হস্তে গজদন্ত-কঙ্কতিকা কেশ কর্ষণ করিয়া চলিতে থাকে। ক্ৰমে দুটি একটি উন্মুলিত কেশ কঙ্কতিকায় জড়াইয়া যায়; প্রসাধনশেষে সুন্দরী কঙ্কতিকা হইতে বিচ্ছিন্ন কেশগুচ্ছ মুক্ত করিয়া অন্যমনে দুই চম্পক-অঙ্গুলীর দ্বারা গ্ৰন্থি পাকাইয়া দূরে নিক্ষেপ করেন। ক্ষুদ্র কেশগ্রন্থি অবহেলার লক্ষ্যহীন বায়ুভরে উড়িয়া কোন বিস্মৃতির উপকূলে বিলীন হইয়া যায়, কে তাহার সন্ধান রাখে?

তেমনই, বহু বহু শতাব্দী পূর্বে একদা কয়েকটি মানুষের জীবন-সূত্র যেভাবে গ্রন্থি পাকাইয়া গিয়াছিল, ইতিহাস তাহার সন্ধান রাখে না। মহাকালভুজগের যে বক্ষচিহ্ন একদিন ধরিত্রীর উপর অঙ্কিত হইয়াছিল, তাহা নিশ্চিহ্ন হইয়া মুছিয়া গিয়াছে। মৃন্ময়ী চিরনবীনা, বৃদ্ধ অতীতের ভোগ-লাঞ্ছন সে চিরদিন বক্ষে ধারণ করিয়া রাখিতে ভালবাসে না। নিত্য নব নব নাগরের গৃহে তাহার অভিসার। হায় বহুভতুকা, তোমার প্রেম এত চপল বলিয়াই কি তুমি চিরযৌবনময়ী?

দুই সহস্ৰ বৎসরেরও অধিক কাল হইল, যে কয়টি স্বল্পায়ু নর-নারীর জীবনসূত্র সুন্দরীর কুটিল কেশকুণ্ডলীর মতো জড়াইয়া গিয়াছিল, তাহদের কাহিনী লিখিতে বসিয়াছি। লিখিতে বসিয়া একটা বড় বিস্ময় জাগিতেছে। জন্মজন্মান্তরের জীবন তো আমার নখদপণে, সহস্ৰ জন্মের ব্যথা-বেদনা আনন্দের ইতিহাস তো এই জাতিস্মরের মস্তিষ্কের মধ্যে পুঞ্জীভূত হইয়া আছে, তবু যতই পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে আমার বিগত জীবনের আলোচনা করি না কেন, দেখিতে পাই, কোনও না কোনও নারীকে কেন্দ্ৰ করিয়া আমার জীবন আবর্তিত হইয়াছে; জীবনে যখনই কোনও বৃহৎ ঘটনা ঘটিয়াছে, তখনই তাহা এক নারীর জীবনের সঙ্গে জড়াইয়া গিয়াছে। নারীদ্বেষক হইয়া জন্মিায়াছি, কিন্তু তবু নারীকে এড়াইতে পারি নাই। বিস্ময়ের সহিত মনে প্রশ্ন জাগিতেছে—পৃথিবীর শত কোটি মানুষের জীবন কি আমারই মতো? ইহাই কি জীবনের অমোঘ অলঙ্ঘনীয় রীতি? কিংবা-আমি একটা সৃষ্টিছাড়া ব্যতিক্রম?

 

ন্যুনাধিক চব্বিশ শতাব্দী পূর্বের কথা। বুদ্ধ তথাগত প্রায় শতাধিক বর্ষ হইল নির্বাণ লাভ করিয়াছেন। উত্তর ভারতে চারিটি রাজ্য—কাশী কোশল লিচ্ছবি ও মগধ। চারিটি রাজ্যের মধ্যে বংশানুক্রমে অহি-নকুলের সম্বন্ধ স্থায়িভাব ধারণ করিয়াছে। পাটলিপুত্রের সিংহাসনে শিশুনাগবংশীয় এক অশ্রুতকীর্তি রাজা অধিরূঢ়।

শিশুনাগবংশের ইতিবৃত্ত পুরাণে আদ্যন্ত ধারাবাহিক ভাবে লিপিবদ্ধ হইতে পায় নাই, তশত্রুর পর হইতে কেমন যেন এলোমেলো হইয়া গিয়াছে। তাহার কারণ, অমিতবিক্রম অজাতশত্রুর পর হইতে মৌর্য চন্দ্রগুপ্তের অভু্যদয় পর্যন্ত মগধে এক প্রকার রাষ্ট্রীয় বিপ্লব চলিয়াছিল। পিতাকে হত্যা করিয়া রাজ্য অধিকার করা শিশুনাগরাজবংশের একটা বৈশিষ্ট্য হইয়া দাঁড়াইয়াছিল, বিপুল রাজপরিবারের মধ্যে সিংহাসনের জন্য হানাহানি অন্তর্বিবাদ সহজ ও প্রকৃতিসিদ্ধ হইয়া পড়িয়াছিল। বংশের একজন শক্তিশালী ব্যক্তি রাজাকে বিতাড়িত করিয়া নিজে সিংহাসনে অধিরোহণ করিলেন, ইহার কিছুকাল পরে পূর্ববর্তী রাজা শক্তি সংগ্ৰহ করিয়া আবার সিংহাসন পুনরুদ্ধার করিলেন—এইভাবে ধারাবাহিক শাসন-পারম্পর্য নষ্ট হইয়া গিয়াছিল। বলা বাহুল্য, প্রজারাও সুখে ছিল না। তাহারা মাঝে মাঝে মাৎস্যন্যায় করিয়া রাজাকে মারিয়া আর একজনকে তাহার স্থানে বসাইয়া দিত। সেকালে প্রকৃতিপুঞ্জের সহিষ্ণুতা আধুনিক কালের মতো এমন সর্বংসহা হইয়া উঠিতে পারে নাই, প্রয়োজন হইলে ধৈর্যের শৃঙ্খল ছিঁড়িয়া যাইত। তখন শ্ৰীমন্মহারাজের শোণিতে পথের ধূলি নিবারিত হইত, তাঁহার জঠর-নিষ্কাশিত অন্ত্র দ্বারা রাজপুরী পরিবেষ্টিত করিয়া জিঘাংসু বিদ্রোহীর দল প্রতিহিংসা চরিতার্থকরিত।

সে যাক। পুরাণে শিশুনাগবংশীয় মহারাজ চণ্ডের নাম পাওয়া যায় না। চণ্ডের প্রকৃত নাম কি ছিল তাহাও লোকে ভুলিয়া গিয়াছিল। মহিষের মতো আকৃতির মধ্যে রাক্ষসের মতো প্রকৃতি লইয়া ইনি। কয়েক বৎসর মগধে রাজত্ব করিয়াছিলেন। তার পর—কিন্তু সে পরের কথা।

 

রাজ-অবরোধে এক দাসী একটি কন্যা প্রসব করিয়াছিল। অবশ্য মহারাজ চণ্ডই কন্যার পিতা; সুতরাং সভাপণ্ডিত নবজাত কন্যার কোষ্ঠী তৈয়ার করিলেন।

কোষ্ঠী পরীক্ষা করিয়া পণ্ডিত বলিলেন—শ্ৰীমন, এই কন্যা অতিশয় কুলক্ষণা, প্রিয়জনের অনিষ্টকারিণী—সাক্ষাৎ বিষকন্যা। ইহাকে বর্জন করুন।

সিংহাসনে আসীন মহারাজের বন্ধুর ললাটে ভীষণ ভ্রূকুটি দেখা দিল; পণ্ডিত অন্তরে কম্পিত হইলেন। স্পষ্ট কথা মহারাজ ভালবাসেন না; স্পষ্ট কথা বলিয়া অদ্যই সচিব শিবমিশ্রেীর যে দশা হইয়াছে, তাহা সকলেই জানে। পণ্ডিত স্থলিত বচনে বলিলেন—মহারাজ, আপনার কল্যাণের জন্যই বলিতেছি, এ কন্যা বর্জনীয়া।

কিন্তু মহারাজের ভ্রূকুটি শিথিল হইল না। তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন—কোন প্রিয়জনের অধিক অনিষ্ট হওয়া সম্ভব?

পণ্ডিত পুনরায় কোষ্ঠী দেখিলেন, তারপরে ভয়ে ভয়ে বলিলেন—উপস্থিত পিতা-মাতা সকলেরই অনিষ্ট-সম্ভাবনা রহিয়াছে। মঙ্গল সপ্তমে ও শনি অষ্টমে থাকিয়া পিতৃস্থানে পূর্ণদৃষ্টি করিতেছে।

কে কোথায় দৃষ্টি করিতেছে তাহা জানিবার কৌতূহল মহারাজের ছিল না। তাঁহার মুখে স্ফরিত-বিদ্যুৎ বৈশাখী মেঘ ঘনাইয়া আসিল। মহারাজের সাম্যদৃষ্টির সম্মুখে অপরাধী ও নিরপরাধের প্রভেদ নাই—অশুভ বা অপ্রীতিকর কথা যে উচ্চারণ করে সেই দণ্ডাহঁ। এ ক্ষেত্রে শনি-মঙ্গলের পাপদৃষ্টির ফল যে জ্যোতিষাচার্যের শিরে বর্ষিত হইবে না, তাহা কে বলিতে পারে? পণ্ডিত প্ৰমাদ গণিলেন।

সভা-বিদূষক বটুকভট্ট সিংহাসনের পাশে বসিয়াছিল। সে খর্বকায় বামন, মস্তকটি বৃহদাকার, কণ্ঠস্বর এরূপ তীক্ষ্ণ যে, মনে হয় কর্ণের পটহ ভেদ করিয়া যাইবে। পণ্ডিতের দুরবস্থা দেখিয়া সে সূচ্যগ্রসূক্ষ্ম কণ্ঠে হাসিয়া উঠিল, বলিল—বিষকন্যা! তবে তো ভালই হইয়াছে, মহারাজ! এই দাসীপুত্রীকে সযত্নে পালন করুন। কালে যৌবনবতী হইলে ইহাকে নগর-নটির পদে অভিষিক্ত করিবেন। আপনার দুষ্ট প্রজারা অচিরাৎ যম-মন্দিরে প্রস্থান করিবে।

বটুকভট্টকে রাজ-পাৰ্ষদ সকলেই ভালবাসিত, শুধু তাহার বিদূষণ-চাতুর্যের জন্য নয়, বহুবার বহু বিপন্ন সভাসদকে সে রাজরোষ হইতে উদ্ধার করিয়াছিল।

তাহার কথায় মহারাজের ভ্রূগ্রন্থি ঈষৎ উন্মোচিত হইল, তিনি বামহস্তে বটুকের কেশমুষ্টি ধরিয়া তাহাকে শূন্যে তুলিয়া ধরিলেন। সূত্রাগ্রে ব্যাদিত-মুখ মৎস্যের ন্যায় বটুক ঝুলিতে লাগিল।

রাজা বলিলেন—বটু, তোর জিহ্বা উৎপাটিত করিব।

বটুক তৎক্ষণাৎ দীর্ঘ জিহ্বা বাহির করিয়া দিল। রাজা হাস্য করিয়া তাহাকে মাটিতে নামাইলেন। পণ্ডিতের ফাঁড়া কাটিয়া গেল।

ভুঙ্গারে মাধবী ছিল। রাজার কটাক্ষমাত্ৰে কিঙ্করী চষক ভরিয়া তাঁহার হস্তে দিল। চষক নিঃশেষ করিয়া রাজা বলিলেন—এখন এই বিষকন্যাটাকে লইয়া কি করা যায়?

গণদেব নামক একজন চাটুকার পার্ষদ বলিল—মহারাজ, উহাকেও শিবমিশ্রের পথে প্রেরণ করুন—রাজ্যের সমস্ত অনিষ্ট দূর হউক।

মহারাজ চণ্ডের রক্ত-নেত্রে একটা ক্রুর কৌতুক নৃত্য করিয়া উঠিল, তিনি স্বভাবস্ফীত অধর প্রসারিত করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন-মহাসচিব শিবমিশ্র মহাশয় এখন কি করিতেছেন, কেহ। বলিতে পার?

গণদেব মুণ্ড আন্দোলিত করিয়া মুখভঙ্গি সহকারে বলিল—এইমাত্ৰ দেখিয়া আসিতেছি, তিনি শ্মশানভূমিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হইয়া শ্মশান-শোভা নিরীক্ষণ করিতেছেন। ব্ৰাহ্মণভোজন করাইব বলিয়া কিছু মোদক লইয়া গিয়াছিলাম, কিন্তু দেখিলাম ব্ৰাহ্মণের মিষ্টান্নে রুচি নাই। বলিয়া নিজ রসিকতায় অতিশয় উৎফুল্ল হইয়া চারিদিকে তাকাইল।

মহারাজ অট্টহাস্য করিয়া উঠিলেন, বলিলেন-ভাল। আদ্য নিশাকালে শিবাদল আসিয়া শিবমিশ্রের মুণ্ড ভক্ষণ করিবে। তারপর ভীষণ দৃষ্টিতে চতুর্দিকে চাহিয়া বলিলেন—শিবমিশ্র আমার আজ্ঞার প্রতিবাদ করিয়াছিল, তাই আজ তাহাকে শৃগালে ছিঁড়িয়া খাইবে।–তোমরা এ কথা স্মরণ রাখিও।

সভা স্তব্ধ হইয়া রহিল, কেহ বাক্য উচ্চারণ করিতে সাহসী হইল না।

রাজা তখন সভা-জ্যোতিষীকে বলিলেন-পণ্ডিতরাজ, আপনার অভিমত রাজ্যের কল্যাণে এ কন্যা বর্জিত হউক। ভাল, তাহাই হইবে। কন্যা ও কন্যার মাতা উভয়েই আদ্য রাক্রিতে শ্মশানে প্রেরিত হইবে। সেখানে কন্যার মাতা স্বহস্তে কন্যাকে শ্মশানে প্রোথিত করিবে। তাহা হইলে দৈব আপদ দূর হইবে তো?

পণ্ডিত শিহরিয়া উঠিয়া বলিলেন——মহারাজ, এরূপ কঠোরতা নিষ্প্রয়োজন। কন্যাকে ভাগীরথীর জলে বিসর্জন করুন, কিন্তু কন্যার মাতা নিরপরাধিনী—তাহাকে—

রাজা গৰ্জিয়া উঠিলেন—নিরপরাধিনী! সে এরূপ কন্যা প্ৰসব করে কেন?-যাক, আপনার বাগবিস্তারেতে প্রয়োজন নাই, যাহা করিবার আমি স্বহস্তে করিব। বলিয়া মহারাজ সিংহাসন হইতে উঠিয়া দাঁড়াইলেন।

যাহার দুৰ্দমা দানবপ্রকৃতি মত্যলোকে কোনও বস্তুকে ভয় করিত না, দৈব আপদের আশঙ্কা তাহাকে এমনই অমানুষিক নিষ্ঠুরতায় জ্ঞানশূন্য করিয়া তুলিয়াছিল যে, নিজ ঔরসজাত কন্যার প্রতি তাহার চিত্তে তিলমাত্র মমতার অবকাশ ছিল না।

 

পাটলিপুত্র নগরের চৌষট্টি দ্বার, তন্মধ্যে দশটি প্রধান ও প্রকাশ্য। বাকিগুলি অধিকাংশই গুপ্তপথ।

এই গুপ্তপথের একটি রাজপ্ৰসাদসংলগ্ন; রাজা বা রাজপরিবারস্থ যে কেহ ইচ্ছা করিলে এই দ্বারপথে নগর-প্রাকারের বাহিরে যাইতে পারিতেন। তাল-কাণ্ডের একটি শীর্ণ সেতু ছিল, তাহার সাহায্যে পরিখা পার হইতে হইত। এই স্থানে গঙ্গাপ্রবাহের সহিত খনিত পরিখা মিলিত হইয়াছিল।

পরিখার পরপারে কিছু দূর যাইবার পর গঙ্গাতটে পাটলিপুত্রের মহাশ্মশান আরম্ভ হইয়াছে;—যত দূর দৃষ্টি যায়, তরুগুল্মহীন ধুধু বালুকা। বালুকার উপর অগণিত লৌহশূল প্রোথিত রহিয়াছে; শূলগাত্রে কোথাও অর্ধপথে বীভৎস উলঙ্গ মনুষ্যদেহ বিদ্ধ হইয়া আছে, কোথাও শুষ্ক নরকঙ্কাল শূলমূলে পুঞ্জীভূত হইয়াছে। চারিদিকে শত শত নরকপাল বিক্ষিপ্ত। দিবাভাগেই এই মহাশ্মশানের দৃশ্য অতি ভয়ঙ্কর; অপিচ, রাত্রিকালে নগরীর দ্বার রুদ্ধ হইয়া গেলে এই মনুষ্যহীন মৃত্যুবাসরে যে পিশাচ-পিশাচীর নৃত্য আরম্ভ হয়, তাহা কল্পনা করিয়াই পাটলিপুত্রের নাগরিকরা শিহরিয়া উঠিত। দণ্ডিত অপরাধী ভিন্ন রাত্রিকালে মহাশ্মশানে অন্যের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল—চণ্ডালরাও মহাশ্মশানের অনির্বাণ চুল্লীতে কাষ্ঠ নিক্ষেপ করিয়া সন্ধ্যাকালে গৃহে প্ৰতিগমন করিত।

সে-রাত্রে আকাশে সপ্তমীর খণ্ড চন্দ্ৰ উদিত হইয়াছিল। অপরিস্ফুট আলোক শ্মশানের বিস্তীর্ণ বালুকারাশির উপর যেন একটা শ্বেতাভ কুজ্বাটিকা প্রসারিত করিয়া দিয়াছিল। তাঁটলেহী গঙ্গার ধূসর প্রবাহ চন্দ্রালোকে কৃষ্ণবর্ণ প্রতিভাত হইতেছিল। শ্মশান ও নদীর সন্ধিরেখার উপর দূরে অনির্বাণ চুল্লীর আরক্ত অঙ্গার জ্বলিতেছিল।

প্রথম প্রহর রাত্ৰি—প্রাকাররুদ্ধ পাটলিপুত্রে এখনও নগরগুঞ্জন শান্ত হয় নাই; কিন্তু শ্মশানে ইহারই মধ্যে যেন প্রেতলোকের অশরীরী উৎসব আরম্ভ হইয়া গিয়াছে। চক্ষে কিছু দেখা যায় না, তবু মনে হয়, সূক্ষ্মদেহ পিশাচী-ডাকিনীরা চক্ষু-খদ্যোত জ্বালিয়া লুব্ধ লালায়িত রসনায় গলিত শবমাংস অন্বেষণ করিয়া ফিরিতেছে। আকাশে নিশাচর পক্ষীর পক্ষশব্দ যেন তাহদেরই আগমনকাতা ঘোষণা করিতেছে।

এই সময়, যে দিকে রাজপ্রাসাদের গুপ্তদ্বার, সেই দিক হইতে এক নারী ধীরে ধীরে শ্মশানের দিকে যাইতেছিল। রমণীর এক হস্তে একটি লৌহখনিত্ৰ, অন্য হস্তে বক্ষের কাছে একটি ক্ষুদ্র বস্ত্ৰপিণ্ড ধরিয়া আছে। ক্ষীণ চন্দ্রের অস্পষ্ট আলোকে রমণীর আকৃতি ভাল দেখা যায় না; সে যে যুবতী ও এক সময় সুন্দরী ছিল, তাহা তাহার রক্তহীন মুখ ও শীর্ণ কঙ্কালসার দেহ দেখিয়া অনুমান করাও দুরূহ। অতি কষ্টে দুর্ভর দেহ ও লৌহখনিত্র বহন করিয়া জরাজীর্ণ বৃদ্ধার মতো সে চলিয়াছে। রুক্ষ কেশজাল মুখে বক্ষে ও পৃষ্ঠে বিপর্যস্তভাবে পড়িয়া আছে। রমণী মাঝে

শ্মশানের সীমান্তে পৌঁছিয়া সে জানু ভাঙিয়া পড়িয়া গেল। তাহার কণ্ঠ হইতে একটি কাতর আর্তস্বর বাহির হইল; সেই সঙ্গে বক্ষের বস্ত্ৰপিণ্ডের ভিতর হইতেও ক্ষীণ ক্ৰন্দনধ্বনি শ্রুত হইল।

কিছুক্ষণ পড়িয়া থাকিবার পর রমণী আবার উঠিয়া চলিতে লাগিল। ক্ৰমে সে শ্মশানের বীভৎস দৃশ্যাবলীর মাঝখানে আসিয়া উপস্থিত হইল।

একবার সে চক্ষু তুলিয়া দেখিল, সম্মুখে দীর্ঘ শূল প্রোথিত রহিয়াছে; শূলশীর্ষে বিকট ভঙ্গিমায় এক নরমূর্তি বিদ্ধ হইয়া আছে, শূলনিন্নে দুইটা শৃগাল উর্ধ্বমুখ হইয়া সেই দুপ্তপ্রাপ্য ভক্ষ্যের দিকে তাকাইয়া আছে। চন্দ্রালোকে তাহাদের চক্ষু জ্বলিতেছে।

রমণী চিৎকার করিয়া পলাইবার চেষ্টা করিল, কিন্তু অধিক দূর যাইতে পারিল না, কয়েক পদ গিয়া আবার বালুর উপর পড়িয়া গেল।

এবার দীর্ঘকাল পরে রমণী উঠিয়া বসিল। বোধ হয়। সংজ্ঞা হারাইয়াছিল, উঠিয়া বসিয়া ভয়ার্তা দৃষ্টিতে চারিদিকে চাহিল। বক্ষের বস্ত্ৰপিণ্ড ভূমিতে পড়িয়া গিয়াছিল, সেদিকে দৃষ্টি পড়িতেই সে উন্মত্তের মতো উঠিয়া খনিত্র দিয়া বালু খনন করিতে আরম্ভ করিল।

অল্পকালমধ্যে একটি নাতিগভীর গর্ত হইল। তখন রমণী সেই বস্ত্ৰপিণ্ড তুলিয়া লইয়া গর্তে নিক্ষেপ করিল—আমনই ক্ষীণ নির্জীব ক্ৰন্দনধ্বনি উত্থিত হইল। রমণী দুই হাতে কান চাপিয়া কিয়ৎকাল বসিয়া রহিল, তারপর বালু দিয়া গর্ত পূরণ করিবার চেষ্টা করিল। কিন্তু পারিল না। সহসা দুই বাহু বাড়াইয়া বস্ত্রকুণ্ডলী গর্ত হইতে তুলিয়া লইয়া সজোরে নিজ বক্ষে চাপিয়া ধরিল। একটা ধাবমান শৃগাল তাহার অতি নিকট দিয়া তাহার দিকে গ্ৰীবা বাঁকাইয়া চাহিতে চাহিতে ছুটিয়া গেল; বাহ্য-চেতনাহীন রমণী তাহা লক্ষ্য করিল না।

অতঃপর মৃগতৃষ্ণিকাভ্রান্ত মৃগীর মতো নারী আবার এক দিকে ছুটিতে লাগিল। তখন তাহার আর ইষ্টানিষ্ট-জ্ঞান নাই—কোন দিকে ছুটিয়াছে তাহাও জানে না; শুধু পূর্ববৎ এক হস্তে খনিত্র ধরিয়া আছে, আর অপর হস্তে সেই বস্ত্ৰাবৃত জীবনকণিকাটুকু বক্ষে আকড়িয়া আছে।

কিছু দূর গিয়া সে থমকিয়া দাঁড়াইয়া পড়িল; সম্মুখে দূরে গঙ্গার শ্যামরেখা বােধ করি তাহার দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছিল। কয়েক মুহূর্ত বিহ্বল-বিস্ফারিত নেত্রে সেই দিকে তাকাইয়া থাকিয়া, যেন সহসা উদ্ধারের পথ খুঁজিয়া পাইয়াছে, এমনই ভাবে সে হাসিয়া উঠিল। তারপর অসীমবলে অবসন্ন দেহ সেই দিকে টানিয়া লইয়া চলিল।

মানব-মানবীর জীবনে এরূপ অবস্থা কখনও কখনও আসে—যখন তাহারা মৃত্যুকে বরণ করিবার জন্য হাহাকার করিয়া ছুটিয়া যায়।

জাহ্নবীর শীতল বক্ষে পৌঁছিতে আর বিলম্ব নাই, মধ্যে মাত্র ছয়-সাত দণ্ড বালুভূমির ব্যবধান, এই সময় রমণীর মুহামান চেতনা পাশ্বের দিকে এক প্রকার শব্দ শুনিয়া আকৃষ্ট হইল। শব্দটা যেন মনুষ্যের কণ্ঠস্বর—অর্ধব্যক্ত তর্জনের মতো শুনাইল। রমণীর গতি এই শব্দে আপনিই রুদ্ধ হইয়া গেল। সে মুখ ফিরাইয়া দেখিল, চন্দ্রালোকে শুভ্ৰ বালুকার উপর একপাল শৃগাল কোনও অদৃশ্য কেন্দ্রের চারিধারে বৃহ রচনা করিয়া রহিয়াছে। তাহাদের লাঙ্গুল বহির্দিকে প্রসারিত। ঐ শৃগালাচক্রের মধ্য হইতে মনুষ্যকণ্ঠের তর্জন মাঝে মাঝে ফুসিয়া উঠিতেছে, অমনি শৃগালের দল পিছু হটিয়া যাইতেছে। আবার ধীরে ধীরে অলক্ষিতে তাহাদের চক্র সঙ্কুচিত হইতেছে।

রমণী যন্ত্রচালিতের মতো কয়েক পদ সেই দিকে অগ্রসর হইল। শৃগালের একজন জীবন্ত মনুষ্যকে আসিতে দেখিয়া দংষ্ট্রবিকাশ করিয়া দূরে সরিয়া গেল। তখন মধ্যস্থিত বস্তুটি দৃষ্টিগোচর হইল।

মাটির উপর কেবল একটি দেহহীন মুণ্ড রহিয়াছে। মুণ্ডের দুই বিক্ষত গণ্ড হইতে রক্ত ঝরিতেছে, চক্ষে উন্মত্ত দৃষ্টি। মুণ্ড রমণীর দিকেই তাকাইয়া আছে।

রমণী এই ভয়াবহ দৃশ্য দেখিয়া অস্ফুট চিৎকার করিয়া দাঁড়াইয়া পড়িল।

মুণ্ড তখন বিকৃত স্বরে বলিল—তুমি প্ৰেত পিশাচ নিশাচর যে হও, আমাকে উদ্ধার কর।

মানুষের কণ্ঠস্বরে রমণীর সাহস ফিরিয়া আসিল। সে আরও কয়েক পদ নিকটে আসিল; রুদ্ধ শুষ্ক কণ্ঠ হইতে অতি কষ্টে শব্দ বাহির করিল—কে তুমি?

মুণ্ড বলিল—আমি মানুষ, ভয় নাই। আমার দেহ মাটিতে প্রোথিত আছে—উদ্ধার কর।

রমণী তখন কাছে আসিয়া ভাল করিয়া তাহার মুখ দেখিল, দেখিয়া সংহত অস্ফুট স্বরে বলিল—মন্ত্রী শিবমিশ্র!–তারপর খনিত্ৰ দিয়া প্ৰাণপণে মাটি খুঁড়িতে আরম্ভ করিল।

মৃত্তিকাগৰ্ভ হইতে বাহিরে আসিয়া শিবমিত্ৰ কিয়ৎকাল মৃত্যুবৎ মাটিতে শুইয়া রহিলেন। তারপর ধীরে ধীরে দুই হস্তে ভর দিয়া উঠিয়া বসিলেন। রমণীর ক্ষীণ অবসন্ন দেহ তখন ভূমিশয্যায় লুটাইয়া পড়িয়াছে।

শিবমিশ্রের শৃগালদ্রষ্ট গণ্ড হইতে রক্ত ঝরিতেছিল, তিনি সন্তৰ্পণে তাহা মুছিলেন। রমণীর রক্তলেশহীন। পাংশু মুখের দিকে চাহিয়া বলিলেন—দুভাগিনি, তুমি কোন অপরাধে রাত্রিকালে মহাশ্মশানে আসিয়াছ?

রমণী নীরবে পাশ্বস্থা বস্তুপিণ্ড দেখাইয়া দিল, শিবমিশ্র দেখিলেন—একটি শিশু। পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলেন–তোমার পরিচয় কি? তুমি আমার প্রাণদাত্রী, তোমার নাম স্মরণ করিয়া রাখিতে চাহি।

রমণী নির্জীব কণ্ঠে বলিল—আমার নাম মোরিকা—আমি রাজপুরীর দাসী।

শিবমিশ্র সচকিত হইলেন, বলিলেন—বুঝিয়াছি। তুমি কবে এই সন্তান প্রসব করিলে?

আজ প্রভাতে।

শিবমিশ্র কিছুক্ষণ স্তব্ধ রহিলেন। হতভাগিনি! কিন্তু তুমি শ্মশানে প্রেরিত হইলে কেন? পরমভট্টারকের সন্তান গর্ভে ধারণ করা কি এতই অপরাধ?

মোরিকা বলিল—সভাপণ্ডিত গণনা করিয়া বলিয়াছেন, আমার কন্যা রাজ্যের অনিষ্টকারিণী বিষকন্যা—তাই—

বিষকন্যা! শিবমিশ্রেীর চক্ষু সহসা জ্বলিয়া উঠিল—বিষকন্যা! দেখি!

শিবমিশ্র ব্যগ্রহস্তে শিশুকে তুলিয়া লইলেন। তখন চন্দ্ৰ অস্ত যাইতেছে, ভাল দেখিতে পাইলেন না। তিনি শিশুকে ক্রোড়ে লইয়া দূরে চুল্লীর দিকে দ্রুতপদে চলিলেন।

চুল্লীর অঙ্গারের উপর ভস্মের প্রচ্ছদ পড়িয়াছে। শিবমিশ্র একখণ্ড অর্ধদগ্ধ কাষ্ঠ তাহাতে নিক্ষেপ করিলেন—অগ্নিশিখা জ্বলিয়া উঠিল।

তখন সেই শ্মশান-চুল্লীর আলোকে শিবমিশ্র নবজাত কন্যার দেহলক্ষণ পরীক্ষা করিলেন। পরীক্ষা করিতে করিতে তাঁহার রক্তলিপ্ত মুখে এক পৈশাচিক হাস্য দেখা দিল।

তিনি মোরিকার নিকট ফিরিয়া গিয়া বলিলেন—হাঁ, বিষকন্যা বটে।

মোরিকা পূর্ববৎ ভূশয্যায় পড়িয়া ছিল, প্রত্যুত্তরে একবার গভীর নিশ্বাস ত্যাগ করিল।

শিবমিশ্র আগ্রহকম্পিত স্বরে বলিলেন—বৎসে, তুমি তোমার কন্যা আমাকে দান কর, আমি উহাকে পালন করি। কেহ জানিবে না।

মোরিকা পুনরায় অতি গভীর নিশ্বাস ত্যাগ করিল।

শিবমিশ্র বলিলেন—তুমি ফিরিয়া গিয়া বলিও কন্যাকে বিনষ্ট করিয়াছ। আমি অদ্যই উহাকে লইয়া গঙ্গার পরপারে লিচ্ছবিদেশে পলায়ন করিব। তারপর–

মোরিকা উত্তর দিল না। তখন শিবমিশ্র নতজানু হইয়া তাহার মুখ দেখিলেন। তারপর করাগ্রে শীর্ণ মণিবন্ধ ধরিয়া নাড়ি পরীক্ষা করিলেন।

ক্ষণেক পরে তিনি উঠিয়া দাঁড়াইলেন। দুই হস্তে শিশুকে বুকে চাপিয়া ধরিয়া উদ্দীপ্ত চোখে দূরে অর্ধদৃষ্ট রাজপ্রাসাদশীর্ষের দিকে চাহিলেন। কহিলেন—এই ভাল।

এই সময় আকাশের নিকষে অগ্নির রেখা টানিয়া রক্তবর্ণ উল্কা রাজপুরীর ঊর্ধ্বে পিণ্ডাকারে জুলিয়া উঠিল,—তারপর ধীরে ধীরে মিলাইয়া গেল।

সেই আলোকে শিশুর মুখের দিকে চাহিয়া শিবমিশ্র বলিলেন—এ নিয়তির ইঙ্গিত। তোমার নাম রাখিলাম-উল্কা!

তারপর মগ্নচন্দ্ৰা রাত্রির অন্ধকারে জাহ্নবীর তীররেখা ধরিয়া শিবমিশ্র পাটলিপুত্রের বিপরীত মুখে চলিতে আরম্ভ করিলেন।

মোরিকার প্রাণহীন শব মহাশ্মশানে পড়িয়া রহিল। যে শিবাকুল তাহার আগমনে সরিয়া গিয়াছিল, তাহারা আবার চারিদিক হইতে ফিরিয়া আসিল।

Sharadindu Bandyopadhyay ।। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়