রাজভবনে ময়ূরের প্রথম রাত্রিটা সুখনিদ্রায় কাটিল। যে ঘরটি তাহার জন্য নির্দিষ্ট হইয়াছিল তাহা রাজভবনের নিম্নতলে পশ্চাদ্দিকের এক কোণে। অঙ্গনের দিকে তাহার দ্বার, রাজভবনে প্রবেশ না করিয়াও ঘরে প্রবেশ করা যায়। ঘরের মধ্যে একটি খট্টাঙ্গ পাতা হইয়াছে, তদুপরি নব শয্যা। নূতন বস্ত্রাদিও উপস্থিত। রাজার রন্ধনশালা হইতে সুপক্ক খাদ্য আসিয়াছে, তাহাই সেবন করিয়া দ্বার-গবাক্ষ খোলা রাখিয়া ময়ূর শয়ন করিয়াছিল, একেবারে ঘুম ভাঙিল পাখির ডাকে। পঞ্চমপুরে তাহার কর্মজীবন আরম্ভ হইল।

কর্মজীবনের প্রথম অধ্যায় প্রায় দুই মাসব্যাপী।

অশ্বারোহণ বিদ্যা শিখিতে ময়ুরের তিনদিন লাগিল। তাহার শোণিতে অশ্ববিদ্যার বীজ নিহিত ছিল, অশ্বপৃষ্ঠে চড়িয়া সে অপূর্ব হর্ষ অনুভব করিল। রাজভবনের পশ্চাৎভাগে বিহারভূমির প্রাচীরের পাশ দিয়া অশ্ব ছুটাইয়া দিয়া সে দেখিতে পাইত কুমারী সোমশুক্লা দ্বিতলের বাতায়ন হইতে তাহাকে লক্ষ্য করিতেছেন। আনন্দের আতিশয্যে সে এক হাত তুলিয়া হাসিত, দেখিতে পাইত কুমারীর সুন্দর মুখেও স্নিগ্ধ হাসি ফুটিয়াছে।

অশ্ববিদ্যা সম্পূর্ণ আয়ত্ত করিবার পরও ময়ূর রাজ-মন্দুরা হইতে প্রত্যহ নূতন অশ্ব লইয়া অভ্যাস করিত। একদিন সায়াহ্নে বিহারভূমির একপ্রান্তে রাজকন্যার সহিত তাহার দেখা হইয়া। গেল। বিহারভূমিতে এক জোড়া ক্ষুদ্রাকৃতি হরিণ ও কয়েকটি শশক ছিল; কুমারী মাঝে মাঝে আসিয়া তাহাদের খাইতে দিতেন। কুমারীকে বিহারভূমিতে দেখিলেই তাহারা ছুটিয়া আসিয়া ঘিরিয়া দাঁড়াইত।

সেদিনও তাহারা কুমারীকে ঘিরিয়া ধরিয়াছিল। কুমারী চারিদিকে শস্য ছড়াইয়া দিতেছিলেন, তাহারা কাড়াকাড়ি করিয়া খাইতেছিল। সহসা অদূরে অশ্বের দড়বড় শব্দ শুনিয়া তাহারা ভয় পাইয়া পলায়ন করিল।

ময়ূর লতাবিতানের অন্তরালে সোমশুক্লাকে দেখিতে পায় নাই, দেখিতে পাইয়া ত্বরিতে অশ্ব থামাইয়া তাঁহার কাছে আসিল, জোড়হস্তে বলিল—রাজনন্দিনি, আমাকে ক্ষমা করুন।

সোমশুক্লা একটু হাসিলেন, শুচিস্মিত মুখের উপর একটু অরুণাভা দেখা দিল। তিনি বলিলেন—ওরা বনের প্রাণী, বড় ভীরু। কিন্তু আপনি বিব্রত হবেন না, ওরা এখনি ফিরে আসবে।

ময়ূর লক্ষ্য করিল, রাজকুমারী তাহাকে সমকক্ষের ন্যায় সম্বােধন করিলেন, ভৃত্য-পরিজনের মতো নয়। তাহার আর কিছু বলিবার ছিল না, তবু সে একটু ইতস্তত করিল। তাহাকে দ্বিধাগ্রস্ত দেখিয়া সোমশুক্লা বলিলেন—আপনি তো অশ্ববিদ্যা শীঘ্র অধিগত করেছেন।

ময়ূর একটু লজ্জিত হইয়া পড়িল, বলিল—কি জানি। সত্যই কি শীঘ্র? আমার ধারণা ছিল সকলেই অতি সহজে ঘোড়ায় চড়া শিখতে পারে।

রাজকুমারী শুধু হাসিলেন, তারপর অন্য কথা বলিলেন—আপনার অসিশিক্ষা কতদূর?

ময়ূর অবাক হইয়া চাহিল, রাজকুমারী তাহার সব খবর রাখেন। একটু অপ্রতিভ হইয়া বলিল—অসিশিক্ষা এখনো চলছে। অস্ত্রগুরু বলেছেন আরও দুই-তিন সপ্তাহ লাগবে।

ইতিমধ্যে হরিণ মিথুন আবার গুটিগুটি কুমারীর দিকে অগ্রসর হইতেছিল। তাই দেখিয়া ময়ূর আর সেখানে দাঁড়াইল না, ঘোড়ার রাশ ধরিয়া মন্দুরার দিকে চলিয়া গেল।

তারপর আরও কয়েকবার রাজকুমারীর সহিত দেখা হইল; দুই-চারিটি সামান্য বাক্যালাপ হইল। একদিন সে দেখিল কুমারীর মণিবন্ধে একটি নূতন কঙ্কণ শোভা পাইতেছে। চম্পাকলির ন্যায় সুন্দর ক্ষুদ্র শঙ্খটি এই কঙ্কণের মধ্যমণি। ময়ূর উৎসুক নেত্রে সেই দিকে চাহিল।

কুমারী বলিলেন—শঙ্খটি আপনার চেনা, আপনার সামনেই পিতা এটি আমাকে দিয়েছিলেন। —অলঙ্কার কেমন হয়েছে? বলিয়া তিনি মৃণালবাহু তুলিয়া দেখাইলেন।

ভাল। ময়ূর উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে আরও অনেক কথা বলিতে চাহিল, কিন্তু তাহার মুখ দিয়া বাক্য সরিল না। রাজকুমারী মৃদু হাসিলেন।

দিন কাটিতেছে। অশ্বারোহণ ও অসিবিদ্যা অভ্যাস করা ছাড়াও ময়ূর রাজার কাছে যাতায়াত করে, রাজা যে কক্ষে থাকেন সেই কক্ষদ্বারে ধনুবাণ হস্তে দাঁড়াইয়া থাকে। রাজা মাঝে মাঝে তাহার প্রতি দীর্ঘ দৃষ্টিপাত করেন, যেন চক্ষু দিয়া তাহার যোগ্যতার পরিমাপ করেন। ভট্ট নাগেশ্বরের সঙ্গেও প্রত্যহ দেখা হয়; ব্রাহ্মণ দুদণ্ড দাঁড়াইয়া তাহার সহিত বাক্যালাপ ও রঙ্গরসিকতা করেন।

এই তো গেল দিনচর্যা। রাত্রিকালেও ময়ূরের কক্ষে কিছু ব্যাপার ঘটিতে আরম্ভ করিয়াছিল, তাহাকে উদ্বিগ্ন করিয়া তুলিয়াছিল; কিন্তু শঙ্কা ও সংকোচে সে কাহাকেও কিছু বলিতে পারিতেছিল না।

রাত্রিকালে সে ঘরের দ্বার-গবাক্ষ উন্মুক্ত করিয়া শয়ন করিত, আবদ্ধ ঘরে শয়ন করা তাহার অভ্যাস নাই। প্রথম কয়েক রাত্রি নির্বিঘ্নে কাটিয়াছিল, তারপর একদা গভীর রাত্রে তাহার ঘুম ভাঙিয়া গেল। সে দীপ নিভাইয়া শুইয়াছিল, সুতরাং ঘর অন্ধকার; কিন্তু ঘরের বাহিরে মুক্ত দ্বারপথে নক্ষত্রের আলোকবিদ্ধ তমিস্রা ঈষৎ তরল। জাগিয়া উঠিয়া ময়ূর পঞ্চেন্দ্রিয় সজাগ করিয়া শুইয়া রহিল। ঘরের অভ্যন্তরে অতি লঘু পদপাতের শব্দ আসিতেছে। সে সহসা উঠিয়া বসিয়া তীব্র স্বরে বলিল—কে?

প্রশ্নের উত্তর আসিল না। কে যেন ভয় পাইয়া দ্রুত চরণে ঘর ছাড়িয়া পলায়ন করিল।

ময়ূর ভাবিল, হয়তো বিড়াল। তারপর সে অনুভব করিল, ঘরের বাতাসে কেশতৈলের মৃদু গন্ধ ভাসিয়া বেড়াইতেছে। সে বিস্মিত হইয়া ভাবিল, স্ত্রীলোক তাহার ঘরে প্রবেশ করিয়াছিল! কে সে? রাজপুরীতে দাসী-কিঙ্করী আছে, তাহাদের মধ্যে কেহ? কিন্তু কেন?

সে-রাত্রে ময়ূর অনেকক্ষণ জাগিয়া রহিল, কিন্তু আর কিছু ঘটিল না। কয়েকদিন কাটিয়া

গেল, কৃষ্ণপক্ষ গিয়া শুক্লপক্ষের তিথি আসিল। একদিন ময়ূর দ্বার খুলিয়া ঘুমাইতেছিল, ধীরে ধীরে জাগিয়া উঠিল। চাঁদ তখনও অস্ত যায় নাই, ঘরের বাহিরে আবছায়া আলো। ময়ূর চক্ষু মেলিয়া অস্পষ্টভাবে দেখিল, তাহার শিয়রে কেহ তাহার পানে চাহিয়া আছে। মুখ দেখা গেল না, কিন্তু কেশতৈলের গন্ধ নাকে আসিল। ময়ূর গম্ভীর স্বরে কহিল—কে তুমি?

শীৎকারের ন্যায় নিশ্বাস টানার শব্দ হইল, তারপর ছায়ামূর্তি দ্বার দিয়া বাহির হইয়া গেল। পলকের জন্য একটা আকৃতির ছায়াচিত্র বাহিরের স্বল্পালোকে দেখা দিয়াই অন্তর্হিত হইল। আগে যদি বা সন্দেহ ছিল এখন আর সন্দেহ রহিল না। তাহার অদৃশ্য অভিসারিকা নারীই বটে।

ময়ূর শয্যা হইতে নামিল না, মাথায় হাত দিয়া বসিয়া চিন্তা করিতে লাগিল। নারীর হাত হইতে তাহার নিস্তার নাই। নারীর জন্য তাহাকে গ্রাম ছাড়িতে হইয়াছে, এখন কি রাজ-আশ্রয় ছাড়িতে হইবে! কিন্তু কে এই নারী? রাজপুরীর দাসী-কিঙ্করীদের সকলকেই সে দেখিয়াছে; তাহাদের মধ্যে কয়েকটি নববয়স্কা যুবতী আছে। তাহারা তাহার পানে সাভিলাষ কটাক্ষ হানিয়াছে, কিন্তু সে দূরে সরিয়া গিয়া তাহাদের এড়াইয়া গিয়াছে। তাহাদেরই মধ্যে কেহ কি? কিন্তু যদি দাসী-কিঙ্করী না হয়। যদি—ময়ূর শিহরিয়া উঠিল—যদি রাজকুমারী হয়!

এখন সে কী করিবে! রাজাকে বলিবে? কিন্তু তিনি যদি বিশ্বাস না করেন! ভট্ট নাগেশ্বরকে বলিবে? না, বাচাল ব্রাহ্মণ এই কথা সর্বত্র রাষ্ট্র করিবেন; তাহাতে সুফল অপেক্ষা কুফলই অধিক ফলিতে পারে। অনেক চিন্তা করিয়া ময়ূর স্থির করিল, অভিসারিণী যদি আবার আসে তাহাকে ধরিতে হইবে, তারপর অবস্থা বুঝিয়া কার্য করিতে হইবে।

তৃতীয়বার অভিসারিকা আসিল আরও চার-পাঁচ দিন পরে। এবার ময়ূর প্রস্তুত ছিল। ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে সে এক লাফে উন্মুক্ত দ্বারের বাহিরে দাঁড়াইল। নারী হঠাৎ ভয় পাইয়া ঘর হইতে ছুটিয়া বাহির হইয়া তাহার পাশ কাটাইয়া পলাইবার চেষ্টা করিল। ময়ূর তাহার হাত ধরিয়া ফেলিল। পুষ্টাঙ্গ চাঁদের আলোয় চিনিতে কষ্ট হইল না, কুমারী সোমশুক্লার পরিচারিকা চঞ্চরী।

ময়ূর চঞ্চরীকে আগে কয়েকবার দেখিয়াছে, কিন্তু তাহার উগ্র রূপ ময়ূরকে আকর্ষণ করিতে পারে নাই, বরং প্রতিহত করিয়াছে। বিশেষত সে ভট্ট নাগেশ্বরের মুখে চঞ্চরীর জন্মবৃত্তান্ত শুনিয়াছিল, দুবৃত্ত ম্লেচ্ছ রাজার জারজ কন্যা। ইহাতে তাহার মন আরও বিমুখ হইয়াছিল।

ময়ূর চাপা তর্জন করিয়া বলিল—তুমি কেন আমার ঘরে এসেছিলে?

চঞ্চরী উত্তর দিল না, আঁকিয়া-বাঁকিয়া ময়ূরের হাত ছাড়াইবার চেষ্টা করিল। সে কেন ময়ূরের ঘরে আসিয়াছিল নিজেই বোধ হয় জানে না; সে অনূঢ়া অনভিজ্ঞা, কেবল অন্ধ প্রকৃতির তাড়নায় ময়ূরের সংসর্গ কামনা করিয়াছিল। তাহার বুদ্ধি বেশি নাই, কিন্তু যৌবনের ক্ষুধা-তৃষ্ণা পূর্ণমাত্রায় দেখা দিয়াছে।

ময়ূর বলিল—চল, তোমাকে রাজার কাছে নিয়ে যাই।

এই সময় পিছন হইতে কণ্ঠস্বর আসিল—ময়ূরভদ্র!

ময়ূর ঘাড় ফিরাইয়া দেখিল অচ্ছাভ চাঁদের আলোয় দুটি নারীমূর্তি অদূরে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে। একজন রাজকন্যা সোমশুক্লা, অন্যজন দাসী সীমন্তিনী। ময়ূর চঞ্চরীর হাত ছাড়িয়া দিল, চঞ্চরী অধোমুখে দাঁড়াইয়া রহিল।

চঞ্চরী রাত্রে তাহার মাতার কক্ষে শয়ন করে। আজ রাত্রে সীমন্তিনী হঠাৎ ঘুম ভাঙিয়া দেখিল চঞ্চরী শয্যায় নাই। সে ছুটিয়া রাজকুমারীর কক্ষে গিয়াছিল, রাজকুমারীও জাগিয়া উঠিয়াছিলেন। কিন্তু চঞ্চরী সেখানে নাই। তখন দুইজনে চুপি চুপি চঞ্চরীকে খুঁজিতে বাহির হইয়াছিলেন।

সীমন্তিনী অগ্রসর হইয়া আসিয়া চঞ্চরীর চুলের মুঠি ধরিল, অনুচ্চস্বরে ময়ূরকে বলিল—ভদ্র, এবার চঞ্চরীকে ক্ষমা করুন। ও আমার কন্যা। আমি ওকে শাসন করব। আর কখনো ও আপনাকে বিরক্ত করবে না।

ময়ূর স্থির দৃষ্টিতে রাজকন্যার পানে চাহিয়া ছিল, সেইভাবে থাকিয়াই বিরসকণ্ঠে বলিল—ভাল।

সীমন্তিনী চঞ্চরীর চুলের মুঠি ধরিয়া নির্মমভাবে টানিয়া লইয়া গেল। সোমশুক্লা দাঁড়াইয়া রহিলেন।

ময়ূর মুখ তুলিয়া চাঁদের পানে চাহিল। চাঁদ হাসিতেছে, চারিদিকে শারদ রাত্রির স্নিগ্ধ শীতলতা। একটি গভীর নিশ্বাস ত্যাগ করিয়া ময়ূর মুখ নামাইল, দেখিল কুমারী তাহার কাছে আসিয়া দাঁড়াইয়াছেন, তাঁহার উন্নমিত মুখে বিচিত্র হাসি। তিনি লঘু স্বরে বলিলেন—ময়ূরভদ্র, আপনার জীবনে এরূপ অভিজ্ঞতা বোধ হয় নূতন নয়।

ময়ূর চকিত হইয়া বলিল—না। আমার জীবনকথা আপনি জানেন?

শুক্লা বলিলেন—ভট্ট নাগেশ্বরের মুখে শুনেছি।

ময়ূর প্রশ্ন করিল—সব কথা শুনেছেন? আমি অজ্ঞাতকুলশীল তা জানেন?

শুক্লা বলিলেন—জানি। আপনি স্ত্রীজাতির প্রতি বিরূপ, তাও জানি।

ময়ূর ব্যস্ত স্বরে বলিল—বিরূপ নয় দেবি! আমি—আমি—

স্ত্রীজাতিকে এড়িয়ে চলেন। তা চলুন, কিন্তু কাজটি সহজ নয়। কুমারীর কণ্ঠে অতি মৃদু হাসির মূৰ্ছনা উখিত হইয়াই মিলাইয়া গেল। তাঁহার দেহটিও যেন চন্দ্রকিরণে গলিয়া অদৃশ্য হইয়া গেল।

ময়ূর অনিমেষ চক্ষে চাহিয়া রহিল।

<

Sharadindu Bandyopadhyay ।। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়