চাচা-কাহিনী

বার্লিন শহরের উলান্ড স্ট্রীটের উপর ১৯২৯ খ্ৰীষ্টাব্দে হিন্দুস্থান হৌস নামে একটি রেস্তোরাঁ জন্ম নেয় এবং সঙ্গে সঙ্গে, বাঙালির যা স্বভাব, রেস্তোরাঁর এক কোণে একটি আড্ডা বসে যায়। আড়ার গোসাঁই ছিলেন চাচা, বরিশালের খাজা বাঙালি মুসলমান, আর চেলারা— গোসাঁই, মুখুজ্জে, সরকার, রায়, চ্যাংড়া গোলাম মৌলা ইত্যাদি।

রায় চুক চুক করে বিয়ার খাচ্ছিলেন আর গ্রাম-সম্পর্কে তাঁর ভাগনে গোলাম মৌলা ভয়ে ভয়ে তার দিকে মিট মিট করে তাকাচ্ছিল, পাছে তিনি বানচাল হয়ে যান। এ-মামলা চাচা রোজই দেখেন, কিছু বলেন না, আজ বললেন, ‘অত ডরাচ্ছিস কেন?’

মৌলা লাজুক ছেলে। মাথা নিচু করে বললে, ‘ওটা খাবার কী প্রয়োজন? আপনি তো কখনও খান নি, এতদিন বার্লিনে থেকেও। মামুরই বা কী দরকার?’

চাচা বললেন, ‘ওর বাপ খেত, ঠাকুরদা খেত, দাদামশাই খেত, মামারা খায় এ দেশে না এসেও। ও হল পাইকারি মাতাল, আর পাঁচটা হিন্দুস্থানীর মত পেচী মাতাল নয়। আর আমি কখনও খই নি তোকে কে বললে?’

আড্ডা একসঙ্গে বললে, ‘সে কী চাচা?’

এমন ভাবে কোরাস গাইলে, মনে হল, যেন বছরের পর বছর তারা ওই বাক্যগুলোই মোহোড়া দিয়ে আসছে।

ডান হাত গলাবন্ধ কোটের মধ্যিখোন দিয়ে ঢুকিয়ে, বাঁ হাতের তোলো চিত করে চাচা বললেন, ‘মদকে ইংরিজিতে বলে স্পিরিট, আর স্পিরিট মানে ভুত। অর্থাৎ মদে রয়েছে ভূত। সে-ভূত কখন কার ঘাড়ে চাপে তার কি কিছু ঠিক-ঠিকানা আছে? তবে ভাগ্যিস, ওভূত আমার ঘাড়ে মাত্র একদিনই চেপেছিল, একবারের তরে।’

গল্পের সন্ধান পেয়ে আড্ডা খুশ! আসন জমিয়ে সবাই বললে, ‘ছাডুন চাচা।’

রায় বললেন, ‘ভাগিনা, আরেকটা বিয়ার নিয়ে আয়।’

মৌলা অতি অনিচ্ছায় উঠে গেল! উঠবার সময় বললে, ‘এ নিয়ে আঠারটা।’

রায় শুধালেন, ‘বাড়তি না কমতি?’

ফিরে এলে চাচা বললেন, ফ্রিলাইন ফন ব্ৰাখেলকে চিনিস?’

লেডি-কিলার পুলিন সরকার বললে, ‘আহা, কৈসন সুন্দরী,
রূপসিনী ব্লন্দিনী
নরদিশি নন্দিনী।’

শ্ৰীধর মুখুজ্জে বললে, ‘চোপ-’

চাচা বললেন, ‘ওর সঙ্গে প্রেম করতে যাস নি। চুমো খেতে হলে তোকে উদুখল সঙ্গে নিয়ে পেছনে ঘুরতে হবে।’

বিয়ারের ভুড়ভুড়ির মত রায়ের গলা শোনা গেল, ‘কিংবা মই।’

গোসাঁই বললেন, ‘কিংবা দুই-ই। উদূখলের উপর। মই চাপিয়ে।’

শ্ৰীধর বললে, ‘কী জ্বালা! শাস্ত্র শ্রবণে এরা বাধা দিচ্ছে কেন? চাচা, আপনি চালান।’

চাচা বললেন, ‘সেই ফন ব্ৰাখেল আমায় বড় স্নেহ করত, তোরা জানিস। ভরাগ্রীষ্মকালে একদিন এসে বললে, ‘ক্লাইনার ইডিয়ট (হাবা-গঙ্গারাম), এবারে আমার জন্মদিনে তোমাকে আমাদের গায়ের বাড়িতে যেতে হবে। শহরে থেকে থেকে তুমি একদম পিলা মেরে গেছ, গায়ের রোদে রঙটিকে ফের একটু বাদামির আমেজ লাগিয়ে আসবে।’

আমি বললুম, ‘অর্থাৎ জুতোতে পালিশ লাগাতে বলছ? রোদুরে না বেরিয়ে বেরিয়ে কোনও গতিকে রঙটা একটু ভদ্রস্থ করে এনেছি, সেটাকে আবার নেটিভ-মার্কা করব? কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা, তুমি না হয় আমাকে সয়ে নিতে পোর; কিন্তু তোমার বাড়ির লোক? তোমার বাবা, কাক?’

ব্ৰাখেল বললে, ‘না হয় একটু বাঁদর-নাচই দেখালে।’।

চাচা বললেন, ‘যেতেই হল। ব্ৰাখেল আমার যা-সব উপকার করেছে তার বদলে আমি কনসেনট্রেশন ক্যাম্পেও যেতে পারি।’

মৌলা চট করে একবার ডাইনে বাঁয়ে তাকিয়ে নিলে।

চাচা বললে, ‘অজ পাড়াগাঁ ইস্টিশন। প্যাসেঞ্জারে যেতে হল। গাড়ি থেকে নামতেই দেখি, স্বয়ং স্টেশনমাস্টার সেলাম ঠুকে সামনে হাজির। তার পিছনে ছোটবাবু, মালবাবুঅবশ্য দাশের মত খালি গায়ে আলপাকার ওপর ব্রেসট্ৰিকেট পরা নয়, টিকিট-বাবু, দুচারজন তামাশা দেখনেওলা, পুরো পাক্কা প্রসেশনে বলেই হয়। ওই অজ স্টেশনে আমিই বোধ হয় প্রথম ভারতীয় নামলম, আর আমিই বোধ হয় শেষ।

স্টেশনমাস্টার বললে, ‘বাইরে গাড়ি তৈরি, এই দিকে আজ্ঞা হোক।’

বুঝলুম, ফন ব্ৰাখেলেরা শুধু বড়লোক নয়, বোধ হয় এ-অঞ্চলের জমিদার!

বাইরে এসে দেখি, প্রাচীন ফিটিং গাড়ি, কিন্তু বেশ শক্তসমখ। কোচম্যান তার চেয়েও বুড়ো, পরনে মনিং সুট, মাথায় চোঙার মত অপরা হ্যাট, আর ইয়া হিন্ডেনবুগি গোঁফ, এডওয়াড়ী দাড়ি, আর চোখ দুটো এবং নাকের ডগাটি সুজি রায়ের চোখের মত লাল, জবাকুসুমসঙ্কাশং।

কী একটা মন্ত্র পড়ে গেল; দাড়ি-গোঁপের ছাঁকনি দিয়ে যা বেরোল তার থেকে বুঝলুম, আমাকে ফিউডাল পদ্ধতিতে অভিনন্দন জানানো হচ্ছে। এ চাপানের কী ওতোর মন্ত্র গাইতে হয়। ব্ৰাখেল আমাকে শিখিয়ে দেয় নি। কী আর করি, ‘বিলক্ষণ, বিলক্ষণ’ বলে যেতে লাগলুম, আর মনে মনে ব্ৰাখেলকে প্ৰাণ ভরে অভিসম্পাত করলুম, এ-সব বিপাকের জন্য আমাকে কায়দা—কেতা শিখিয়ে দেয় নি বলে।

আমি গাড়িতে বসতেই কোচম্যান আমার হাঁটুর উপর একখানা ভারী কম্বল চাপিয়ে দু-দিকে গুঁজে দিয়ে মিলিটারি কায়দায় গটগট করে গিয়ে কোচাবাক্সে বসল। তারপর চাবুকটা

মধ্যিখান দিয়ে গাড়ি চালিয়ে দিলে। ইতিমধ্যে স্টেশনমাস্টারের ফুটফুটে মেয়েটি আমার অটোগ্রাফ আর স্ন্যাপ দুইই তুলে নিয়েছে।

মাঠের পর ঈষৎ খাড়াই, তারপর ঘন পাইন বন; বন থেকে বেরুতেই সামনে উঁচু পাহাড় আর তার উপর যমদূতের মত দাঁড়িয়ে এক কাসল। মহাভারতের শাস্তিপর্বে শরশয্যায় শুয়ে শুয়ে ভীষ্মদেব মেলা দুর্গের বয়ান করেছেন, এ দুর্গ যেন সব কটা মিলিয়ে লাবড়ি-ভর্তা।

আমি ভয় পেয়ে শুধালুম, ‘ওই আকাশে চড়তে হবে?’

কোচম্যান ঘাড় ফিরিয়ে গর্বের হাসি হেসে বললে, ‘ইয়াঃ মাইন হের!’ দেমাকের ঠ্যালায় তার গোঁপের ডগা দুটো আরও আড়াই ইঞ্চি প্রমোশন পেয়ে গেল। তারপর ভরসা। দিলে, ‘এক মিনিটে পৌঁছে যাব স্যারা’ আমি মনে মনে মৌলা আলীকে স্মরণ করলুম।

এ কী বিদঘুটে ঘোড়া রে বাবা, এতক্ষণ সমান জমিতে চলছিল আমাদের দিশী টাটুর মত কদম আর দুলকি চাল মিশিয়ে, এখন চড়াই পেয়ে চলল লাষী চালে। রাস্তাটা অজগরের মত পাহাড়টাকে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে উপরে উঠে যেন কাস্লটায় ফণা মেলেছে; কিন্তু ফণার কথা থাক, উপস্থিত প্রতি বীকে গাড়ি যেন দুচাকার উপর ভর দিয়ে মোড় নিচ্ছে।

হঠাৎ সামনে দেখি বিরাট খোলা গেট। কঁকারের উপর দিয়ে গাড়ি এসে যেখানে দাঁড়ালো তার ওপর থেকে গলা শুনে তাকিয়ে দেখি, ভিলিকিনি থেকে-’

মৌলা শুধাল, ‘ভিলিকিনি মানে?’

চাচা বললেন, ‘ও ব্যালকনি, আমাদের দেশে বলে ভিলিকিনি-সেই ভিলিকিনি থেকে ফন ব্ৰাখেল চেঁচিয়ে বলছে, যোহানেস, ওঁকে ওঁর ঘর দেখিয়ে দাও; গুস্টাফ টেবিল সাজাচ্ছে।’

তারপর আমাকে বললে, ‘ডিনারের পয়লা ঘণ্টা এখুনি পড়বে, তুমি তৈরি হয়ে নাও।’

চাচা বললেন, ‘পরি তো কারখানার চোঙার মত পাতলুম আর গলাবন্ধ কোট, কিন্তু একটা নেভি-ব্ল সুট আমি প্রথম যৌবনে হিম্মৎ সিং-এর পাল্লায় পড়ে করিয়েছিলুম, তার রঙ, তখন বাদামীতে গিয়ে দাঁড়িয়েছে, এর পর কোন রঙ নেবে যেন মনঃস্থির করতে না পেরে নি যযৌ ন তস্থে হয়ে আছে। হাতমুখ ধুয়ে সেইটি পরে বেডরুমটার ফেন্সি জিনিসপত্রগুলো তাকিয়ে দেখছি। এমন সময় ব্ৰাখেল আমাকে নক করে ঘরে ঢুকল। আমার দিকে তাকিয়ে বললে, ‘এ কী? ডিনার-জ্যাকেট পর নি?’

আমি বিরক্ত হয়ে বললুম, ‘ওসব আমার নেই, তুমি বেশ জানি।’

ফন ব্ৰাখেল বললে, ‘উঁহু, সেটি হচ্ছে না। এ বাড়িতে এসব ব্যাপারে বাবা জ্যাঠা দুজনাই জোর রিচুয়াল মানেন, বড্ড পিটপিটে। তোমাদের পুজোপাজা নেমাজ-টেমাজের মত সসেজ থেকে মাস্টার্ড খসবার উপায় নেই।’ তারপর একটু ভেবে নিয়ে বললে, ‘তা তুমি এক কাজ কর। দাদার কাবার্ড ভর্তি ডিনার-জ্যাকেট, শার্ট, বো—তারই এক প্রস্থ পরে নাও। এটা তারই বেডরুম; এই কাবার্ডে সাব-কিছু পাবে।’

আমি বললুম, ‘তওবা, তোমার দাদার জামা-কাপড় পরলে কোট মাটি পৌঁছে তোমার ডিনার গাউনের মত টেল করবে।’

বললে, ‘না, না, না। সবাই কি আমার মত দিক-ধেড়েঙ্গে! তুমি চটুপটু তৈরি হয়ে নাও, আমি চললুম।’

চাচা বললেন, ‘কী আর করি, খুললুম কাবার্ড। কাতারে কাতারে কোট পাতলুম বুলিছে-সদ্য প্রেসড, দেরাজ ভর্তি শার্ট, কলার, বো হীরে-বসানো শ্ৰীভ-লিনাক্স, আরও কত কী!

‘মানিকপীরের মেহেরবানি বলতে হবে, জুতোটি পর্যন্ত ফিট করে গেল দস্তানার মত।

মানিকপীরের মেহেরবানি বলতে হবে, জুতোটি পর্যন্ত ফিট করে গেল দস্তানার মত। মাথার মধ্যিখানে সিঁথি জুতসই হবে না, ব্যাকব্রাশ করলেই মানাবে ভাল। আর আশ্চর্য বিশ বছরের দুফাঁক করা চুল বিলকুল বেয়াড়ামি না করে এক লম্ফে তালুর উপর দিয়ে পিছনে ঘাড়ের উপর চেপে বসল, যেন আমি মায়ের গর্ভ থেকে ওই ঢঙের চুল নিয়েই জন্মেছি। আয়নাতে চেহারা দেখে মনে হল, ঠিক জংলীর মত তো দেখাচ্ছে না, তোরা অবিশ্যি বিশ্বাস করবি নে।’

চাচার ন্যাওটা ভক্ত গোসাঁই বললে, ‘চাচা, এ আপনার একটা মস্ত দোষ; শুধু আত্মনিন্দা করেন। ওই যে আপনি মহাভারতের শাস্তিপর্বের কথা বললেন, সেখানেই ভীষ্মদেব যুধিষ্ঠিরকে আত্মনিন্দার প্রচণ্ড নিন্দা করে গেছেন।’

চাচা খুশি হয়ে বললে, ‘হেঁ-হেঁ, তুই তো বললি, কিন্তু ওই পুলিনটা ভাবে সে-ই শুধু লেডি-কিলিং লিটবর। তা সে কথা যাক গে, ঈভনিং-ড্রেসে কালা কেষ্ট সেজে আমি তো শিস দিতে দিতে নোমলাম নীচের তলায়—’

পুলিন শুধালে, ‘স্যার, আপনাকে তো কখনও শিস দিতে শুনি নি, আপনি কি আদপেই শিস দিতে পারেন?’

চাচা বললেন, ‘ঠিক শুধিয়েছিস। আর সত্যি বলতে কী, আমি নিজেই জানি নে, আমি শিস দিতে পারি কি না। তবে কি জানিস, হাফপ্যান্ট পরলে লাফ দিতে ইচ্ছা করে, জোব্বা পরলে পদ্মাসনে বসে থাকবার ইচ্ছা হয়, ঠিক তেমনি ঈভনিং ড্রেস পরলে কেমন যেন সাঁঝের ফষ্টি-নিষ্টি করবার জন্য মন উতলা হয়ে ওঠে, না হলে আমি শিস দিতে যাব। কেন? শিস কি দিয়েছিলুম। আমি, শিস দিয়েছিল বিকাটে সুন্টটা। তা সে কথা যাক।’

ততক্ষণে ডিনারের শেষ ঘণ্টা পড়ে গিয়েছে। আন্দাজে আন্দাজে ড্রইংরুম পেরিয়ে ঢুকলুম গিয়ে ব্যানকুয়েট-হলে।

কাসলের ব্যানকুয়েট-হল আমাদের চণ্ডীমণ্ডপ-সাইজ হবে। তার আর বিচিত্র কী এবং সিনেমার কৃপায় আজকাল প্রায় সকলেরই তার বিদঘুটে ঢাপ-ঢং দেখা হয়ে গিয়েছে; কিন্তু বাস্তবে দেখলুম। ঠিক সিনেমার সঙ্গে মিলল না। আমাদের দিণী সিনেমাতে চণ্ডীদাস পাঞ্জাবির বোতাম লাগাতে লাগাতে টিনের ছাতওলা বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসেন, যদিও বোতাম আর টিন এসেছে ইংরিজি আমলে। আর হলিউড যদি ব্যানকুয়েট-হল দেখায় অষ্টাদশ শতাব্দীর, তবে আসবাবপত্র রাখে সপ্তদশ শতাব্দীর, জাস্ট টু বী অনাদি সেফ সাইড।

ফন ব্ৰাখেলদের কাসল কোন শতাব্দীর জানি না। কিন্তু হলে ঢুকেই লক্ষ্য করলুম, মান্ধাতার আমলের টেবিল-চেয়ারের সঙ্গে বিংশ শতাব্দীর সুখ-সুবিধার সরঞ্জামও মিশে রয়েছে। তবে খাপ খেয়ে গিয়েছে দিব্যি, এদের রুচি আছে কোনও সন্দেহ নেই। এসব অবশ্য পরে খেতে খেতে লক্ষ্য করেছিলুম।

টেবিলের এক প্রান্তে ক্লারা ফন ব্ৰাখেল, অন্য প্রান্তে যে ভদ্রলোক বসেছেন তাকে ঠিক ক্লারার বাপ বলে মনে হল না, অতখানি বয়স যেন ওঁর নয়।

প্রথম দর্শনেই দুজন কেমন যেন হ’কচাকিয়ে গেলেন। বাপের হাত থেকে তো ন্যাপকিনের আংটিটা ঠং করে টেবিলের উপর পড়ে গেল। আমি আশ্চর্য হলুম না, ভদ্রলোক হয়তো জীবনে এই প্রথম ইন্ডার (ভারতীয়) দেখেছেন, কালো ঈভনিং-ড্রেসের ওপর কালো চেহারা-গোসাঁইয়ের পদাবলীতে—

‘কালোর উপরে কালো।’

হকচাকিয়ে যাওয়া কিছুমাত্র বিচিত্র নয়। কিন্তু ক্লারা কেমন যেন অদ্ভুতভাবে তাকালে ঠিক বুঝতেই পারলুম না। তবে কি বোটা ঠিক হেডিং মাফিক বীধা হয় নি! কই, আমি তো একদম রেডিমেডের মত করে বেঁধেছি, এমন কি হালফ্যাশান মাফিক তিন ডিগ্রি ট্যারীচাও করে দিয়েছি। তবে কি ঈভনিং ড্রেস আর ব্যাকব্রাস করা চুলে আমাকে ম্যাজিসিয়ানের মত দেখাচ্ছিল?

সামলে নিয়ে ক্লারা ভদ্রলোককে বললে, ‘পাপা, এই হচ্ছে আমার ইন্ডিয়ার আফে!’

অর্থাৎ, ভারতীয় বাঁদর।

বাপও ততক্ষণে সামলে নিয়েছেন। মিষ্টি হেসে আমাকে অভ্যর্থনা জানিয়ে শেক-হ্যান্ড করলেন। ক্লারাকে বললেন, ‘পফূই-ছিঃ, ও-রকম বলতে নেই।’

আমি হঠাৎ কী করে বলে ফেললুম, ‘আমি যদি বাঁদর হই। তবে ও জিরাফ।’

বলেই মনে হল, তওবা, তওবা, প্রথম দিনেই ও-রকম জ্যাঠামো করা উচিত হয় নি।

পিতা কিন্তু দেখলুম, মন্তব্যটা শুনে ভারি খুশ। বললেন ‘ডাঙ্কে—ধন্যবাদ-ক্লারাকে ঠিক শুনিয়ে দিয়েছ। আমরা তো সাহস পাই নে।’

পালিশ-আয়নার মত টেবিল, স্বচ্ছন্দে মুখ দেখা যায়। তার উপর ওলন্দাজ লেসের গোল গোল হালকা চাকতির উপর প্লেট পিরিচ সাজানো। বড় প্লেটের দুদিকে সারি বাঁধা অন্তত আটখানা ছুরি, আটখানা কাঁটা, আধা ডজন নানা ঢঙের মদের গেলাস। সেরেছে। এর কোন ফর্ক দিয়ে মুরগী খেতে হয়, কোনটা দিয়ে রোস্ট আর কোনটা দিয়েই বা সাইডু ডিশ?

আসল খাবার পূর্বের চাট—’আর দা অভূরে’র নাম দিয়েছি আমি চাট, তখন দেওয়া হয়ে গিয়েছে। খুঞ্চার ছ। পদ থেকে আমি তুলেছি মাত্র দুপদ, কিঞ্চিৎ সসেজ আর দুটি জলপাই, এমন সময় বাটলার দুহাতে গোটা চারেক বোতল নিয়ে এসে শুধাল, শেরি? পোর্ট? ভোরমুট? কিংবা হুইস্কি সোডা?

আমি এসব দ্রব্য সসম্রামে এড়িয়ে চলি। হঠাৎ কী করে মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, ‘নো বিয়ার!’

বলেই জিভ কাটলুম। আমি কী বলতে কী বললুম! একে তো আমি বিয়ার জীবনে কখনও খই নি, তার উপরে আমি ভাল করেই জানি, বিয়ার চাষাড়ে ড্রিঙ্ক, ভদ্রলোকে যদিবা খায়। তবে গরমের দিনে, তেষ্টা মেটাবার জন্যে। অষ্টপদী ব্যানকুয়েটে বিয়ার! এ যেন বিয়ের ভোজে কালিয়ার বদলে শুটকি তলব করা!

ক্লারা জানত, আমি মদ খাই নে, হয়তো বোপকে তাই আগের থেকে বলে রেখে আমার জন্যে মাফ চেয়ে রেখেছিল, তাই সে আমার দিকে অবাক হয়ে তাকালে।

বাটলার কিন্তু কিছুমাত্র অপ্রতিভ না হয়ে এক ঢাউস বিয়ারের মগ নিয়ে এল, তার ভিতর অনায়াসে দু বোতল বিয়ারের জায়গা হয়।

যখন নিতান্তই এসে গিয়েছে তখন খেতে হয়। ভাবলাম, একটুখানি ঠোঁটে ভেজাব মাত্র, কিন্তু তোমরা বিশ্বাস করবে না, খেতে গিয়ে ঢক ঢক করে প্রায় আধ মগ সাফ করে দিলুম।

মৌলা এক বিঘাত হাঁ করে বললে, ‘এক ধাক্কায় এক বোতল? মামুও তো পারবে না।’

চাচা বললেন, ‘কোন শরম দিচ্ছিস, বাবা? ওরকম ঈভনিং-ড্রেস পরে ব্যানকুয়েট হলে বসলে তোর মামাও এক ঝটিকায় দু পিপি বিয়ার গিলে ফেলত। বিয়ার কি আমি খেয়েছিলুম? খেয়েছিল ওই শালার ড্রেস!’

গোসাঁই মর্মাহত হয়ে বললে, ‘চাচা।’

চাচা বললেন, ‘অপরাধ নিস নি গোসাঁই, ভাষা বাবদে আমি মাঝে মাঝে এটুখানি বে-এক্তেয়ার হয়ে যাই। জানিস তো আমার জীবনের পয়লা গুরু ছিলেন এক ভশচয, তিনি শকার ব’–কার ছাড়া কথা কইতে পারতেন না। তা সে কথা থাক।’

তখনও খেয়েছি মাত্র আড়াই চাক্তি সসেজ আর আধখানা জলপাই, পেট পদ্মার বালুচর। সেই শুধু-পেটে বিয়ার দু মিনিট জিরিয়েই চচ্চড় করে চড়ে উঠল মাথার ব্ৰহ্মরন্ধে।

এমন সময় হের ফন ব্ৰাখেল জিজ্ঞেস করলেন, ‘বার্লিনে কী রকম পড়াশোনা হচ্ছে?’

বুঝলুম এ হচ্ছে ভদ্রতার প্রশ্ন, এর উত্তরে বিশেষ কিছু বলতে হয় না, হুঁ হুঁ করে গেলেই চলে। কিন্তু আমি বললুম, ‘পড়াশোনা? তার আমি কী জানি? সমস্ত দিন, সমস্ত রাত বললেও বাড়িয়ে বলা হয় না, তো কাটে হৈ হৈ করে ইয়ার-বকশীদের সঙ্গে।’

বলেই অবাক হয়ে গেলুম। আমার তো দিনের দশ ঘণ্টা কাটে স্যাটস বিবলিওটেকে, স্টেট লাইব্রেরিতে, ক্লারারও সে খবর বেশ জানা আছে। ব্যাপার কী? সেই গল্পটা তোদের বলেছি?—পিপের ছাদা দিয়ে হুইস্কি বেরুচ্ছিল, ইঁদুর চুক চুক করে খেয়ে তার হয়ে গিয়েছে নেশা, লাফ দিয়ে পিপের উপরে উঠে আস্তিন গুটিয়ে বলছে, ‘ওই ড্যাম ক্যাটটা গেল কোথা? ব্যাটাকে ডেকে পাঠাও, তার সঙ্গে আমি লড়াব।’

কিন্তু এত সাত-তাড়াতাড়ি কি নেশা চড়ে?

ইতিমধ্যে আপন অজানাতে বিয়ারে আবার লম্বা চুমুক দিয়ে বসে আছি।

করে করে তিন-চার পদ খাওয়া হয়ে গিয়েছে। যখন রোস্ট টার্কীতে পৌঁছেছি, তখন দেখি অতি ধোপদূরস্ত ঈভনিং-ড্রেস-পরা আর এক ভদ্রলোক টেবিলের ওদিকে আমার মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ালেন। ক্লারা তাকে বললে, ‘জ্যাঠামশাই, এই আমাদের ইন্ডার।’ বড় নার্ভাস ধরনের লোক। হাত অল্প অল্প কাঁপছে। আর বার বার বলছেন, ‘তোমরা ব্যস্ত হয়ো না, সব ঠিক আছে, সব ঠিক আছে, আমি শুধু ইয়ে—’ তারপর আমার দিকে একটু তাকিয়ে নিয়ে বললেন, ‘আমি শুধু রোস্ট আর পুডিং খাই বলে একটু দেরিতে আসি।’

তারপর আমি কী বকর-ব্যকর করেছিলুম আমার স্পষ্ট মনে নেই। সঙ্গে সঙ্গে চলছে বিয়ারের পর বিয়ার, কখনও বা বেশ উঁচু গলায় বলে উঠি, ‘গুস্টাফ, আরও বিয়ার নিয়ে এস।’

এ কী অভদ্রতা! কিন্তু কারও মুখে এতটুকু চিত্তবৈকল্যের লক্ষণ দেখতে পেলুম না, কিংবা হয়তো লক্ষ্য করি নি। আর ভাবছি, ডিনার শেষ হলে বাঁচি।

শেষ হলও। আমরা ড্রইংরুমে গিয়ে বসলুম। কফি লিকার সিগার এল। আমি অভদ্রতার চূড়ান্তে পৌঁছে বললুম, ‘নো লিকার, বিয়ার প্লীজ!’

বাবা হেসে বললেন, ‘আমাদের বিয়ার তোমার ভাল লাগাতে আমি খুশি হয়েছি। কিন্তু একটু বিলিয়ার্ড খেললে হয় না? তুমি খেলো?’

বললুম, ‘আলবত!’ অথচ আমি জীবনে বিলিয়ার্ড খেলেছি মাত্র দুদিন, কলকাতার ওয়াই.এম.সি.এ-তে। এখানকার বিলিয়ার্ড টেবিলে আবার পকেট থাকে না, এতে খেলা অনেক বেশি শক্ত।

জ্যাঠামশাই দাঁড়িয়ে বললেন, ‘গুড বাই, তোমরা খেলোগে।’

ক্লারাও আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে ‘গুড নাইট’ বললে।

খুব নিচু ছাতওয়ালা, প্রায় মাটির নীচে বিরাট জলসাঘর, তারই এক প্রান্তে বিলিয়ার্ডটেবিল। দেওয়ালের গায়ে গায়ে সারি সারি বিয়ারের পিপে। এত বিয়ার খায় কে? এরা তো কেউ বিয়ার খায় না দেখলুম।

ইতিমধ্যে লিকারের বদলে ফের শ্যাম্পেন উপস্থিত। আমি বললুম, ‘নো শ্যাম্পেন।’ আবার চলল বিয়ার।

মার্কার কিউ এনে দিলে। আমি সেটা হাতে নিয়ে একটু বিরক্তির সঙ্গে বললুম, ‘এ আবার কি কিউ দিলে?’

মার্কারের মুখ কোন অসহিষ্ণুতা ফুটে উঠল না। বরঞ্চ যেন খুশি হয়েই আলমারি খুলে একটি পুরনো কিউ এনে দিলে! আমি পাকা খেলোয়াড়ির মত সেটা হাতে ব্যালানস করে বললুম, ‘এইটেই তো, বাবা, বেশী; তবে ওই পচা মাল পাচার করতে গিয়েছিলে কেন?’

আমার বেয়াদবি তখন চুড়া ছেড়ে আকাশে উঠে ঢলাচলি আরম্ভ করে দিয়েছে। অবশ্য তখনও ঠিক ঠিক ঠাহর হয় নি, মালুম হয়েছিল অনেক পরে।

গ্রামের একঘেয়ে জীবনের ঝানু খেলোয়ারকে আমি হারাব এ আশা অবিশ্যি আমি করি নি; কিন্তু খেলতে গিয়ে দেখলুম, খুব যে খারাপ খেলছি তা নয়, তবে আমার প্রত্যাশার চেয়ে ঢের ভাল। আর প্রতিবারেই আমি লীড পেয়ে যাচ্ছিলুম অতি খাসা, স্বপ্নের বিলিয়ার্ডেও মানুষ ও রকম লীড পায় না।

রাত কটা অবধি খেলা চলেছিল বলতে পারব না। আমি তখন তিনটি বলের বদলে কখনও ছটা কখনও নটা দেখছি, কিন্তু খেলে যাচ্ছি ঠিকই, খুব সম্ভব ভাল লীডের লাকে।

হের ফন ব্ৰাখেল শেষটায় না বলে থাকতে পারলেন না, ‘তোমার লাক বড় ভাল।’

অত্যন্ত বেকসুর মন্তব্য। আমি কিন্তু চটে গিয়ে বেশ চড়া গলায় বললুম, ‘লাক, না। কচুর ডিম! নাচতে না জানলে শহর বাঁকা। আই লাইক দ্যাট্‌!’

ব্ৰাখেল কী যেন বলতে যাচ্ছিলেন, আমিও অষ্টমে উঠে আরও কথা শুনিয়ে দিলুম। ওদিকে দেখি মার্কার ব্যাটা মিটমিটিয়ে হাসছে। আমি আরও চটে গিয়ে হুঙ্কার দিলুম, ‘তোমার মুলোর দোকান বন্ধ কর, এখন রাত সাড়ে তেরোটায় কেউ মূলো কিনতে আসবে না।’ অথচ বেচারি বুড়ো থুত্থুড়ো, সব কটা দাঁত জগন্নাথ দেবতাকে দিয়ে এসেছে।

চিৎকার-চেল্লাচেল্লির মধ্যিখানে হঠাৎ দেখি সামনে জ্যাঠামশাই, পরনে তখনও পরিপাটি ঈভনিং-ড্রেস।

আবার সেই নার্ভাস স্বরে বললেন, ‘সরি সরি, তোমরা কিছু মনে কোর না, আমি শব্দ শুনে এলুম।’ তারপর ক্লারার বাপের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তুই বড় ঝগড়াটে, ভালফগাঙ, নিত্য নিত্য এর সঙ্গে ঝগড়া করিস।’ তারপর আমার দিকে ফিরে বললেন, ‘তার চেয়ে বরঞ্চ একটু তাস খেললে হয় না? আমার ঘুম হচ্ছে না।’

আমি বললুম, ‘হুঁ হুঁ হুঁ।’

তাসের টেবিল এল।

আমি স্কট খেলেছি বিলিয়ার্ডের চেয়েও কম।

জ্যাঠা বললেন, কী স্টেক?’

বাপ বললেন, ‘নিত্যিকার।’

‘নিত্যিকার’ বলতে কী বোঝাল জানি নে। ওদিকে আমার পকেটে তো ছুঁচো ডিগবাজি খেলছে। জ্যাঠা হিসাব করে বললেন, ‘হানস পনেরো মার্ক ভলফগাঙ দুই।’

আপনার থেকে আমার বাঁ হাত কোটের ভিতরকার পকেটের দিকে রওনা হল। তখনই মনে পড়ল, এ কোটি তো ক্লারার দাদার। আমার মানিব্যাগ তো পড়ে আছে আমার খাটে, উপরের তলায়। কিন্তু তারই সঙ্গে সঙ্গে হাত গিয়ে ঠেকাল এক তাড়া করকরে নোটে। ঈশ্বর পরম দয়ালু, তাহার কৃপায় টাকা গজায়, এই টাকা দিয়েই আজকের ফাড়া কাঁটাই, পরের কথা পরে হবে। ক্লারাকে বুঝিয়ে বললে সে নিশ্চয়ই কিছু মনে করবে না। আর নিজের মনিব্যাগে রেস্ত আছেই বা কী? দশ মার্ক হয় কি না-হয়।

এদিকে রেস্ত নেই, ওদিকে খেলার নেশাও চেপেছে। পরের বাজিতে আবার হারলুম, এবার গেল আরও কুড়ি মার্ক, তারপর পঞ্চাশ, তারপর কত তার আর আমার হিসেব নেই। নোটের তাড়া প্রায় শেষ হতে চলল। আমি যুধিষ্ঠির নই, অর্থাৎ কোন রমণীর উপর টুয়েন্টি পার্সেন্ট অধিকারও আমার নেই, না হলে তখন সে রেস্তও ভাঙাতে হত, এমন সময় আস্তে আস্তে আমার ভাগ্য ফিরতে লাগল। দশ কুড়ি করে সব মার্ক তোলা হয়ে গেল, তারপর প্রায় আরও শ দুই মার্ক জিতে গেলুম।

ওদিকে মদ চলছে পাইকারি হিসেবে আর জ্যাঠামশাই দেখি হারার সঙ্গে সঙ্গে আরও বেশি নার্ভাস হয়ে যাচ্ছেন। আমি তো শেষটায় না থাকতে পেরে খলখল করে হোসে উঠলুম। কিছুতেই হাসি থামাতে পারি নে। গলা দিয়ে এক ঝলক বিয়ার বেরিয়ে এল, কোন গতিকে সেটা রুমাল দিয়ে সামলালুম। কিন্তু হাসি আর থামাতে পারি নে। বুঝলুম, এরেই কয় নেশা।

জ্যাঠামশাই নার্ভাস সুরে বলেন, ‘হেঁ-হেঁ, এটা যেন, কেমন যেন,–হেঁ-হেঁ, তোমার লাক—হেঁ-হেঁ-নইলে আমি খেলাতে—’

আবার লাক! এক মুহূর্তে আমার হাসি থেমে গিয়ে হল বেজায় রাগ। বিলিয়ার্ডের বেলায়ও আমাকে শুনতে হয়েছিল ওই গুডুড্যাম লাকের দোহাই।

টং হয়ে এক ঝটিকায় টেবিলের তাস ছিটকে ফেলে বললুম, ‘তার মানে? আপনারা আমাকে কী পেয়েছেন? ইউ অ্যান্ড ইয়োর ড্যাম লাক, ড্যাম, ড্যাম—’

বাপ-জ্যাঠা কী বলে আমায় ঠাণ্ডা করতে চেয়েছিলেন আমরা সেদিকে খেয়াল নেই। কতক্ষণ চলেছিল তাও বলতে পারব না, আমরা গলা পর্দার পর পর্দা চড়ে যাচ্ছে আর সঙ্গে সঙ্গে দুনিয়ার যত কটুকটব্য।

এমন সময় দেখি, ক্লারা।

কোথায় না। আমি তখন ইশে ফিরব-আমি তখন সপ্তমে না, একেবারে সেঞ্চারির নেশায়। শেষটায় বোধ হয়, ‘ছোটলোক’, ‘মীন’, এইসব অশ্রাব্য শব্দও ব্যবহার করেছিলুম। ক্লারা আমার কাঁধে হাত দিয়ে নিয়ে চলল। দরজার দিকে। অনুনয় করে বললে, ‘অত চটছ কেন, ওঁদের সঙ্গে না খেললেই হয়, ওঁরা ওই রকমই করে থাকেন।’

বেরুবার সময় পর্যন্ত শুনি ওঁরা বলছেন, ‘সিরি, সরি, প্লীজ প্লীজ। আমাদের দোষ হয়েছে।’

তবু আমার রাগ পড়ে না।’

 

চাচা কফিতে চুমুক দিলেন। রায় বললেন, ‘ঢের ঢের মদ খেয়েছি, ঢের ঢের মাতলামো দেখেছি, কিন্তু এরকম বিদঘুটে নেশার কথা কখনও শুনি নি।’

চাচা বললেন, ‘যা বলেছ! তাই আমি রাগ ঝাড়তে ঝাড়তে গেলুম শোবার ঘরে! ঈভনিং-কোট, পাতলুন খোলার সঙ্গে সঙ্গে মাথা কিন্তু ঠাণ্ডা হতে আরম্ভ করেছে, বিয়ারের মগও হাতের কাছে নেই।

বালিশে মাথা দিতে না দিতেই স্পষ্ট বুঝতে পারলুম, সমস্ত সন্ধ্যা আর রাতভোর কী ছুচোমিটাই না করেছি!’ ছি-ছি, ক্লারার বাপ-জ্যাঠামশায়ের সামনে কী ইতরোমেই না করে গেলুম ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে!

আর এদেশে সবাই ভাবে ইন্ডিয়ার লোক কতই না বিনয়ী, কতই না নম্ৰ!

যতই ভাবতে লাগলুম, মাথা ততই গরম হতে লাগল। শেষটায় মনে হল, কাল সকলে, আজ সকালেই বলা ভাল, কারণ ভোরের আলো তখন জানলা দিয়ে ঢুকতে আরম্ভ করেছে, এঁদের আমি মুখ দেখোব কী করে? জানি, মাতালকে মানুষ অনেকখানি মাফ করে দেয়, কিন্তু এ যে একেবারে চামারের মাতলামো!

তা হলে পালাই।

অতি ধীরে ধীরে কোন প্রকারের শব্দটি না করে সুটকেসটি ওখানেই ফেলে গাছের আড়ালে আড়ালে কাসল থেকে বেরিয়ে স্টেশন পানে দে ছুটি। মাইলখানেক এসে ফিরে তাকালুম; নাঃ, কেউ পিছু নেয় নি।

চোরের মত গাড়িতে ঢুকে সোজা বার্লিন।’

মৌলা বললে, ‘শুনলেন, মামা?’

চাচা বললেন, ‘আরো শোনই না শেষ অবধি।’

সেদিন সন্ধ্যেবেলায় তখন ঘরে বসে মাথায় হাত দিয়ে ভাবছি, এমন সময় ঘরের দরজায় টোকা, আর সঙ্গে সঙ্গে ক্লারা। হায়, হায়, আমি ল্যান্ডলেডিকে একদম বলতে ভুলে গিয়েছিলুম, সবাইকে যেন বলে, আমি মরে গিয়েছি কিংবা পাগলা-গারদে বন্ধ হয়ে আছি কিংবা ওই ধরনের কিছু একটা!

শেষটায় মর-মর হয়ে ক্লারার কাছে মাতলামোর জন্য মাফ চাইলুম।

ক্লারা বললে, ‘অত লজ্জা পোচ্ছ কেন? ও তো মাতলামো না, পাগলামো। কিংবা অন্য কিছু, তুমি সব কিছু বুঝতে পার নি, আমরাও যে পেরেছি তা নয়।

‘তুমি যখন দাদার সুট পরে ডিনারে এলে তখনই তোমার সঙ্গে কোথায় যেন দাদার সাদৃশ্য দেখে বাবা আর আমি দুজনাই আশ্চর্য হয়ে গেলুম, বিশেষ করে ব্যাকব্রাশ করা চুল আর একটুখানি ট্যারীচা করে বাঁধা বো। দেখে। তার পর তুমি জোর গলায় চাইলে বিয়ার, দাদাও বিয়ার ভিন্ন অন্য কোন মদ খেত না; তুমি আরম্ভ করলে দাদারই মত বকতে, ‘লেখাপড়ার সময় কোথায়? আমি তো করি হৈ হৈ’–আমি জানতুম একদম বাজে কথা; কিন্তু দাদা হৈ হৈ করত। আর বলতেও কসুর করত না।’

‘শুধু তাই নয়। দাদাও ডিনারের পর বাবার সঙ্গে বিলিয়ার্ড খেলত এবং শেষটায় দুজনাতে ঝগড়া হত। জ্যাঠামশাই তখন নেমে এসে ওদের সঙ্গে তাস খেলা আরম্ভ করতেন এবং আবার হত ঝগড়া। অথচ তিনজনাতে ভালবাসা ছিল অগাধ।’

‘তোমাকে আর সব বলার দরকার নেই; তুমি যে ঘরে উঠছিলে ওই ঘরেই একদিন দাদা আত্মহত্যা করে।’

‘কিন্তু আসলে যে কারণে তোমার কাছে এলুম, তুমি মনে কষ্ট পেয়ে না; বাবাজ্যাঠামশাই আমাকে বলতে পাঠিয়েছেন, তারা তোমার ব্যবহারে কিছু মাত্র আশ্চর্য কিংবা দুঃখিত হন নি।’

 

চাচা থামালেন।

রায় বললেন, ‘চাচা, আপনি ঠিকই বলেছিলেন, শিস দিয়েছিল সুন্টটাই, বিয়ারও ও-ই খেয়েছিল।’

চাচা বললেন, ‘হক কথা। মদ মানে স্পিরিট, স্পিরিট মানে ভুত, তাই স্পিরিট স্পিরিট খেয়েছিল।’

<

Syed Mujtaba Ali ।। সৈয়দ মুজতবা আলী