রাজা-রাণীর গল্পো

এক ছিল রাজা। রাজা শুধু নামেই রাজা।

রাজার না ছিল কোন প্রজা, না ছিল কোন মন্ত্রী, না সেনাপতি, না কোন সৈন্য সামন্ত।

রাজার না ছিল রাজ অট্টালিকা, না প্রাসাদ, না কোন দাস-দাসী, কোন রাণী।

রাজা শুয়ে শুয়ে স্বপ্ন দেখত। তার এক রাণী হয়েছে, হয়েছে এক চলন্ত রাজবাড়ী, এক রাজপুত্তুর আর এক রাজকন্যা।।

আসলে এই রাজা শুধু নামেই রাজা। বলতে গেলে এক উলঙ্গ রাজা। নিঃস্ব বিত্তহীন গরীব অতি সাধারণ এক মানুষ।

এমনই একজন সাধারণ মানুষ যে এই রাজার নামের পিছনে কোন পদবী পর্যন্ত জোটে নি। রাজা নিজেই জানে না বা মনে নেই কে ছিল তার বাবা আর কেই বা ছিল তার মা। কোথায় ছিল তাদের ঘরবাড়ী। এসব কিসসু মনে নেই রাজার।

তবে এইটুকু মনে পড়ে যখন সে হাফপ্যান্ট পরত তখন থেকেই সে একটা চায়ের দোকানে কাজ করত।

দোকানটা ছিল একটা বড় রাস্তার ধারে।।

সেখানে কত রকমের গাড়ী এসে দাঁড়াত। কারণ দোকানের পাশেই ছিল একটা মোটর গ্যারেজ। গাড়ীগুলো এই গ্যারেজে এসে টুকিটাকি কত কি সব রিপেয়ার এর কাজ করাত তারপর এই চায়ের দোকানে বসে চা বিস্কুট খেয়ে ওপাশের পেট্রল পাম্প থেকে গাড়ীতে তেল ভরে নিয়ে আবার হুস করে বেরিয়ে যেত যে যার গাড়ী নিয়ে।

আট-ন’ বছরের রাজা ক্রমে বড় হয়ে উঠল।

আরও আট বছর পরে এক জোয়ান মদ্দ হয়ে উঠল। সুন্দর সুঠাম চেহারার এক নব্য যুবক। হাফ প্যান্ট ছেড়ে ফুল প্যান্ট ধরেছে। শুধু তাই নয় চায়ের দোকানের চাকরী ছেড়ে দিয়ে পাশের মোটর গ্যারেজে কাজে ঢুকেছে। ইতিমধ্যে ভাল কাজকর্মও শিখে নিয়েছে রাজা। তেল চিটচিটে গেঞ্জী আর ফুল প্যান্ট পরে অনায়াসে বাস মিনিবাস, ট্রাকের তলায় ঢুকে অতি সহজে গাড়ীর বিবিধ রিপেয়ারিং-এর কাজ কর্ম করে দিতে তার এতটুকু কষ্ট হয় না।

গ্যারেজের মালিক ছিলেন একজন পাঞ্জাবী ভদ্রলোক। নাম সর্দার হরগোবিন্দ সিং। বয়স পঞ্চাশ ঊৰ্দ্ধ। রাজার কাজে সন্তুষ্ট হয়ে একদিন হরগোবিন্দ সিং রাজাকে বলে বসলেন রাজা তুই ড্রাইভিং শিখবি?

রাজাতো মহাখুশী একথা শুনে। বলল গুরুজী কবে থেকে শেখাবেন আমায় ড্রাইভিং?

রাজা হরগোবিন্দ সিংকে শুধুই গুরু বলে ডাকে।

হরগোবিন্দ সিং বললেন চল আজ থেকেই তোকে ড্রাইভিং এ হাতে খড়ি দিয়ে আসি।

হরগোবিন্দ সিং বললেন—ভাল একটা মারুতি কার এসেছে হাতে। মালিক গাড়ীটা কাল ফেরৎ নিতে আসবে। গাড়ীর রিপেয়ারিং এর কাজ হয়ে গেছে। আজ তোর জন্য বুকড় ওই গাড়ী।

রাজা একথা শুনে আহ্লাদে আটখানা। হরগোবিন্দ সিংয়ের পায়ের ধূলো নিয়ে বসল হঠাৎই। বলল আমি ময়লা এই প্যান্ট আর গেঞ্জীটা ছেড়ে আসছি গুরুজী।

একটু পরেই রাজা এল। পরিষ্কার জামা প্যান্ট পরে। হরগোবিন্দ সিং বললেন—নে ওঠ। ড্রাইভারের সিটে গিয়ে বোস। আমি পাশেই বসছি। যা বলব, যা দেখাব ভাল করে দেখবি, শুনবি। আর সেই মত কাজ করবি। ড্রাইভিংটা এমন একটা কিছু শক্ত ব্যাপার নয়।

হরগোবিন্দ সিং তার শিষ্য রাজাকে নিয়ে মারুতি কারে স্টার্ট দিল।

মারুতি চলতে শুরু করল।

গাড়ী ছুটল। ফাস্ট গীয়ার, সেকেণ্ড গীয়ার, থার্ড গীয়ার আবার ফাস্ট গীয়ার। ব্রেক, হর্ণ, স্পীডোমিটার এক্সিলেটর, ফুল ব্রেক সবের কাজই দেখিয়ে দিলেন সিংজী। তাছাড়া রাজার হাত দুটোকে নিজের হাতের মধ্যে চেপে ধরে স্টিয়ারিং ঘোরান ফেরানোর কাজও শিখিয়ে দিলেন। আর কেমন করে সামনে আসা গাড়ীকে পাশ দিতে হয়, ওভারটেক করা গাড়ীকে কেমন ভাবে পাশ দিতে হয় এ সবও শিখিয়ে দিলেন। তা প্রায় ৮/১০ মাইল প্র্যাকটিস ট্রেনিং করিয়ে সিংজী যখন বুঝলেন রাজা নিজেই গাড়ী চালাচ্ছে ঠিক ঠাক তখন হঠাৎ বলে উঠলেন সাবাস রাজা। বহুৎ আচ্ছা বেটা! আমি কখন স্টিয়ারিং থেকে হাত সরিয়ে নিয়েছি তুই বুঝতেই পারিস নি।

রাজা হঠাৎ ব্রেক কষে গাড়ী থামাল।

রাজার চোখে মুখে আনন্দ যেন ছিটকে পড়ছে। সে যেন একটা বিরাট যুদ্ধ জয় করে ফেলেছে। তার জীবনের স্বপ্নই ছিল সে একদিন গাড়ী চালানো শিখবে। তারপর বাস, ট্যাক্সি, ট্রাক যাতে কাজ জুটবে তাতেই লেগে পড়বে।

তারপর আর কি কেবল গাড়ী চাপা।

এক রাস্তা থেকে আর এক রাস্তা। এক রাজ্য থেকে আর এক রাজ্যে। বিভিন্ন সড়ক, বিভিন্ন নগর,শহরে কেবল ঘুরে বেড়ানো। কেবল গাড়ী চেপে বেড়াননা।

রাজাকে চুপ করে থাকতে দেখে সিংজী বললেন–কিরে রাজা চুপ চাপ হয়ে গেছিস কেন? কথা বলছিস না কেন? কি এত চিন্তা ভাবনা ঢুকল মাথার মধ্যে?

–না গুরুজী। একটু অন্য কথা ভাবছিলাম আর কি।

সিংজী বললেন–নে চ এবার ফেরা যাক। কাল আবার গাড়ীটা ফেরৎ দিতে যেতে হবে, যদি না মালিক আসেন। গাড়ীটা কিন্তু জব্বর, কি বলিস রাজা? স্টিয়ারিং এ হাত দিলেই মনে হবে প্লেন চালাচ্ছি।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সিংজী বললেন ওই শখটা আর মিটল নারে রাজা। আমারও একটা স্বপ্ন ছিল ওই রকম প্লেন চালাব। আকাশে পাখীর মত উড়ে বেড়াব। কিন্তু হোল না। নে চ এবার। ফিরতি রাস্তাটা তুই ড্রাইভ কর। ডরিস না। দেখি কেমন শিখলি তুই গাড়ী চালানো।

রাজা সিংজীর কথা মত গাড়ীতে উঠে স্টাট দিল। মুহূর্তে পাকাপোক্ত ড্রাইভারের মত গাড়ী চালিয়ে রাজা তার গুরুজীকে নিয়ে নিজেদের ডেরায় ফিরল।

গাড়ী থেকে নেমেই রাজা সিংজীকে আবার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল। সিংজী রাজার মাথায় হাত রেখে বললেন তোর মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হোক এই কামনা করি।

এবার বলি এক রাণীর গল্প।

এক যে ছিল রাণী।

এই রাণী কোন রাজার বেটি না হলেও মস্ত এক বড়লোকের বেটি।

রাণীর বাবা একজন নাম করা ফরেষ্ট অফিসার। নাম শিবশঙ্কর রায় চৌধুরী। রাণীর মা নেই। ছোট বেলায় রাণীর মা মারা গেছেন। শিবশঙ্কর বাবু তার মেয়ে রাণীকে ছোট বেলা থেকে আদর আহ্বাদে রেখে যেমন লেখাপড়া শিখিয়েছেন, তেমনই ঘোড়ায় চড়া, মোটর ড্রাইভিং, সাঁতার কাটা, বন্দুক চালানো, ক্যারাটে এসবও শিখিয়েছেন।

রাণীদের বাড়ীতে কত দাস দাসী।

সবাই রাণীর কথায় ওঠে বসে। রাণীকে তারা একধারে যেমন ভয়ও করে তেমনি আবার ভালও বাসে।

শিবশঙ্কর বাবুও তার মেয়েকে খুবই ভালবাসেন। মেয়ে রাণীর যখন যা পছন্দ, যখন যা বলে বা করে শিবশঙ্কর বাবু তা মেনে নেন। কোন প্রতিবাদ করেন না।

এই রাণীর জন্যই কেনা হয়েছিল একটা মারুতি গাড়ী।

রাণী বড় হয়েছে। সে একাই হাজারীবাগের ওই ঢেউ খেলান পিচ ঢালা রাস্তা দিয়ে একা স্কুলে যেতে পারে, বাড়ী ফিরতে পারে। কোন বডিগার্ডের প্রয়োজন মনে করে না।

একদিন নতুন কেনা এই মারুতির এক্সিলারেটরটা ঠিকমত কাজ করাতে শিবশঙ্কর বাবু গাড়ীটাকে হাজারীবাগের স্টেশন ধারের ওই সিংজীর গ্যারেজে দিয়ে এসেছিলেন। বলে এসেছিলেন গাড়ীটা হয়ে গেলে যেন সিংজী ওটাকে বাংলোয় পৌঁছে দেয়। সিংজী বলেছিলেন অবশ্যই পৌঁছে দেবহুজুর।কিন্তু বিশেষ কোন কারণে পরের দিন হরগোবিন্দ সিং নিজে শিবশঙ্কর বাবুর গাড়ীটি দিতে যেতে পারেন নি। কাজেই মারুতি কারটিকে রাজাই চালিয়ে নিয়ে এসেছিল শিবশঙ্কর রায় চৌধুরীর ডাক বাংলোয়।

গাড়ী বারান্দায় গাড়ী ঢুকিয়ে দু-বার হর্ণ বাজাতেই ছুটে এসেছিল রাণী। পরে স্বয়ং শিবশঙ্কর বাবুও।

রাজা শিবশঙ্কর বাবুর হাতে রিপেয়ারিং চার্জের বিলটা দিতেই উনি রাণীকে বললেন ওকে একশোটা টাকা এনে দিতে।

রাণী ছুটে গিয়ে একশোটা টাকা এনে রাজার হাতে দিয়ে বলল এই নাও ধর।

রাজা টাকাটা রাণীর হাত থেকে নিল।

টাকাটা হাতে পেয়ে রাজা টাকাটাতে একটা চুমু খেল।

রাণী তা দেখল। হাসল। বলল এই ড্রাইভার তোমার নাম কি?

রাজা বলল—’রাজা’।

রাণী বলল–বাঃ বেশ নাম তো তোমার।

রাজা হঠাই বলে বসল আপকা নাম মেম সাব?

রাণী বলল–রাণী।

রাজার মনে তোলপাড় শুরু হোল।

মেয়েটার নাম রাণী। তার স্বপ্নে দেখা সেই রাণী। আহা কি সুন্দর নাম। কি সুন্দরই না দেখতে রাণীকে। কি সুন্দর চোখ, কি সুন্দর চুল কি সুন্দর মুখশ্রী আর তার হাসি।।

রাজা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ।

রাণী বলল— এই ড্রাইভার চলত দেখি গাড়ীটা কেমন সারা হয়েছে একবার দেখে নিই। উঁহু তুমি নয় আমি ড্রাইভ করব। তুমি এদিকে এসে বসো।

শিবশঙ্কর বাবুর দিকে তাকিয়ে রাণী বলল ড্যাডি আমি এখনি আসছি— টা-টা।

শিবশঙ্কর বাবু হাত নাড়লেন বললেন–বাই।

মারুতি গাড়ীতে চেপে রাজা রাণী দুজনেই বেরিয়ে গেল ফটক পেরিয়ে।

গাড়ী চলছে। দু-পাশে শুধু বড় বড় গাছ। তার মাঝখান দিয়ে মসৃণ রাস্তা চলে গেছে রাঁচী, হাজারীবাগ ফরেষ্ট ওদিকে দুমকা বর্ধমান আসানসোল।

রাস্তায় গাড়ী চালাতে চালাতে রাণী প্রশ্ন করল–তুমি ওই একশ টাকা দিয়ে কি করবে?

রাজা বলল–কি আর করব একটা মিনিবাস কিনব।

রাণী হো হো করে হেসে উঠল। বলল এই একশ টাকা দিয়ে মিনিবাস কিনবে? বুদ্ধ কোথাকার।।

রাজা ঢোঁক গিলে এবার বলল–প্রথমে এটা দিয়ে আমি একটা বাম্পার লটারীর টিকিট কিনব।

রাণী ঘাড় বেঁকিয়ে বলল–বাঃ খুব ভাল কথা। তারপর লটারীতে টাকা উঠলে কি করবে?

রাজা বলল–মিনিবাস কিনব। রাজা আরও বলল মিনিবাস কিনে ওতেই আমি চলন্ত ঘরসংসার পাতব। তারপর কেবল ঘুরে বেড়াব। দিল্লী, মাদ্রাজ, মুম্বাই, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, খাজুরাহ, পশ্চিমবাঙ্গাল।

রাণী বলল বাঃ। খুব ভাল কথা। তা তুমি দেখছি দিনের বেলাতেও স্বপ্ন দেখ। তা বিয়ে থা করবে না?

রাজা লজ্জামাখা মুখে বলল আপনার মত মেয়ে পেলেই বিয়ে সাদি করব নচেৎ নয়।

-তাই নাকি?

—হ্যাঁ মেম সাব। এটা মরদকা বাত।

—তা তোমার ইচ্ছে তো বড় মন্দ নয়। আচ্ছা ধর আমি যদি তোমায় বিয়ে করতে চাই তুমি বিয়ে করবে?

রাজা চুপ করে থাকে, আর কিছু বলে না।

রাণী বলে তোমার আর কে আছে?

রাজা বলে আমার নিজের বলতে কেউ নেই।

মা নেই, বাবা নেই, আছে শুধু গুরুজী। স্টেশন ধারে হরগোবিন্দ সিংজীর মোটর গ্যারেজ। আমি ওখানেই গুরুজীর কাছে থাকি।

রাণী প্রশ্ন করে তুমি কতদূর লেখা পড়া শিখেছ?

রাজা বলে তেমন কিছু শিখিনি। তবে মিশনারী স্কুলে গিয়ে একটু আধটু ইংরাজী ও বাংলা লিখতে ও পড়তে শিখেছি।

তাই নাকি! আচ্ছা তুমি আমার এই হাতে আমার নামটা ইংরাজীতে লেখ দেখি।–রাণী তার বাঁ হাতটা বাড়িয়ে দেয়।

রাজা তার পকেট থেকে ডট পেনটা বার করে রাণীর হাতে লিখে দিল Rani এবং আরও লিখে দিল—I Love You.

রাণী খুব খুশী। আবার রাগও হোল ওই বেশী লেখার জন্য। বলল তুমি ওটা লিখলে কেন। বদমাইস্।

রাজা মাথা হেঁট করল।

রাণী বলল এবার তুমি নেমে যাও। আমি একাই ফিরতে পারব। আর তোমার সাধের গাড়ী কেনা হলে পর আমার সাথে দেখা করো।

এরপর আর কি।

রাজা রাণীর গল্প প্রায় শেষ হতে চলল। তবে বাকী ঘটনা গুলো বললে গল্পের শেষ হয়ই বা কি করে। তাই গল্পের শেষটুকু বলা।–

রাজা সত্যি সত্যিই সেবার একশ টাকা দিয়ে দশটা কালী পূজো বাম্পার টিকিট কেটেছিল। তারপর ভুলেও গিয়েছিল টিকিট কাটার ব্যাপারটা।

কিন্তু রাজার কপাল ভাল।

সত্যি সত্যি ওর কেনা একটি টিকিটে প্রথম পুরস্কার উঠল বিশ লাখ টাকা।

আর যায় কোথা। হৈ হৈ কাণ্ড রৈ রৈ ব্যাপার।

রাজা তো আনন্দে আটখানা! হরগোবিন্দ সিং এর আনন্দও কম নয়।

হরগোবিন্দ বললেন–রাজা, ভগবান জিসকো দেতা ছপ্পড় ফাড়কেএসাহি দেতা হ্যায়। ভগবানকে লাখো সেলাম জানা বেটা। তোর স্বপ্ন সার্থক হোক বেটা এ আশীর্বাদ করি। চল দেখি যাই এজেন্টের কাছে। কিভাবে টাকাটা তোলা যায় দেখি। এরপর ব্যাঙ্কে একটা অ্যাকাউন্ট খুলতে হবে। তার পর তোর সখের গাড়ী মিনিবাস কেনা।

রাজা বলল গুরুজী বাসটা আমি আমার মনের মত করে ডিজাইন করিয়ে তৈরী করাব। সামনের দিকে ড্রাইভারের কম্পার্টমেন্টে শুধু আমরা থাকব। আমাদের ঘর সংসার। চলন্ত ঘর বাড়ী বাসা। সেখানে পাবলিক নট এলাউড। আর বাকিটা যেমন হয় তেমনি। আপনি বরং এজেন্টের কাছে যান এই টিকিটটা নিয়ে। আমি ফরেষ্ট বাংলোয় গিয়ে রাণীকে খবরটা দিয়ে আসি। কিন্তু আজ তো একটা গাড়ীও নেই যে ড্রাইভ করে যাব ওখানে। শুধু আপনার মোটর বাইকটা।

হরগোবিন্দ সিং বললেন —যা বেটা তুই ওটাই নিয়ে চলে যা। আমি এদিকটা দেখছি।।

রাজা মোটর সাইকেলে স্টার্ট দিল।

মোটর সাইকেল ছুটছে। রাজা ছুটছে, তার স্বপ্ন ছুটছে। বন্ বন্ করে মোটর সাইকেলের চাকা ঘুরছে। রাজার স্বপ্নের চাকাও বন্ বন্ করে ঘুরছে। উঃ বড় দেরী হয়ে যাচ্ছে এই আট মাইল রাস্তা পার হতে। রাজার মন তোলপাড়।

যাই হোক শেষ পর্যন্ত রাজা শিবশঙ্কর বাবুর ডাক বাংলোর ফটকে এসে পৌঁছল।

গেটের দরোয়ান রাজাকে চেনে। তবু সে টেলিফোন করে রাজার উপস্থিতির কথা জানিয়ে গেট খুলে দিল।।

লাউঞ্জে বাইকের শব্দ শুনেই ‘কে’ বলে রাণী এসে দাঁড়াল হাসিমুখে। বলল কি ব্যাপার রাজা, তুমি এই সাত সকালে এখানে?

রাজা বলল ভাল খবর মেম সাব। আমি লটারী জিতেছি মেম সাব। আমার টিকিটে ফার্স্ট প্রাইজ উঠেছে। হ্যাঁ মেম সাব বিশ লাখ টাকা।

রাণী বিস্ময়ে চোখ বড় বড় করে বলল সত্যি?

রাজা বলল সত্যি!

রাণী বলল খুব ভাল কথা। তুমি দাঁড়াও, আমি বাবুজীকে খবরটা দিয়ে আসি। বাবুজীর খুব অসুখ নইলে তিনি নিজেই এতক্ষণ ছুটে আসতেন। তা তুমিও এস না, আমার সঙ্গে।

রাজা যেন ধন্য হয়ে গেল।

রাণীর সঙ্গে তাদের ডাক বাংলোর অন্দর মহলে গিয়ে রোগশয্যায় শায়িত শিবশঙ্কর বাবুকে প্রণাম করল।

শিবশঙ্কর বাবুহাত তুলে আশীর্বাদ করলেন—তোমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হো। ভগবান তোমার ভাল করুন। তারপর রাজা তুমি কি করবে ভেবেছ অত টাকা দিয়ে? শিবশঙ্কর বাবু প্রশ্ন করেন।

রাজা শিবশঙ্কর বাবুর মাথার কাছে সরে এসে বলে খুব ছোট বেলা থেকেই আমার একটা সখ ছিল। একটা চলন্ত ঘর-বাড়ী বানাব। তা ভেবেছি একটা খুব সুরত মিনিবাস বানাব। ওতেই থাকা খাওয়ার সব বন্দোবস্ত থাকবে। আবার পিকনিক পার্টি, ম্যারেজ পার্টি নিয়ে যাওয়ার বন্দোবস্ত থাকবে। লাক্সারি মিনিবাস। এই আমার স্বপ্নের ঘর বাড়ী এতে করেই আমি সারা দেশ ঘুরব। সারা ভারত ঘুরব। ইনকা ভি হবে। কেমন হবে বাবুজী?

খুব ভাল হবে। শিবশঙ্কর বাবু বললেন। আরও বললেন—বাসটা তৈরী হলে পর একদিন নিয়ে এসে দেখাও কেমন হোল তোমার মিনিবাস। আমার নামেই বুক করা থাক প্রথম ট্রিপটা। প্রথম দেশ বিদেশ ভ্রমণে আমরাই যাব তোমার লাক্সারী বাসে চড়ে মনে থাকে যেন। এখন এস।।

এরপর রাজা হরগোবিন্দ সিং এর সহযোগিতায় এক মাসের মধ্যে লটারীতে পাওয়া টাকা তুলে সত্যি সত্যি একটা মডেল লাক্সারী মিনিবাস কিনে ফেলল।ইতি মধ্যে ওর গুরুজী রাজার নামে একটা লংরুট সার্ভিস এর পারমিটও করিয়ে দিয়েছে যাতে করে হাজারীবাগ হয়ে পাটনা-রাঁচী মধ্যপ্রদেশ দিল্লী সব যাওয়া যাবে।

এরপর একদিন রাজা মিনিবাসটা হাতে পেয়েই নিজে চালিয়ে নিয়ে শিবশঙ্কর বাবুর ডাক বাংলোতে এসে হাজির।

রাজা হর্ণ বাজাল বাইরে থেকে।

একবার, দুবার, তিনবার।

কিন্তু কেউ এল না।

কেউ মানে রাণী এসে আজ আর স্বাগত জানাল না। কারণটা এদিনই ভোর রাতে শিবশঙ্কর বাবু হার্ট স্ট্রোক হয়ে মারা গেছেন। বডি তখনও ভেতরে পড়ে। খবর পেয়ে রাজা ভেতরে গেল।

দেখল শিবশঙ্কর বাবুর বুকের উপর উপুড় হয়ে পড়ে রাণী কাঁদছে। কঁদছে কত দাস দাসী।

রাজা হায় হায় করল। রাণীর সঙ্গে রাজাও কাঁদল।বেদনায় তার সমস্ত স্বপ্ন যেন চুরমার হয়ে যেতে বসল।

তারপর আর কি।

মহা সমারোহে শিবশঙ্কর বাবুর সৎকার সম্পন্ন হোল। যথা নিয়মে শ্রাদ্ধ শান্তি চুকল। এরপর একদিন সদাশিব বাবুর পারসোনাল এটর্নি ভক্তিভূষণ গাঙ্গুলী রাণীকে ডেকে বললেন রাণী মা এবার যে তোমায় আমার কাছে এসে একটু বসতে হবে।

রাণী এসে ভক্তিভূষণ বাবুর পাশে বসল।

ভক্তিভূষণ বাবু বললেন তোমার বাবা মারা যাবার আগেই এই চিঠিটা রেখে গেছেন। তুমি পড়ে দেখতে পার।

রাণী লেখাপড়া জানা মেয়ে। শোক সন্তপ্ত হলেও তার বাবার লেখা শেষ চিঠিখানা ভাল করেই পড়ে দেখল। যতই পড়ে ততই রাণী আশ্চর্য হয়ে পড়ে।

চিঠিতে শিবশঙ্কর রায় চৌধুরী রাণীর জন্ম বৃত্তান্তের কথাও উল্লেখ করে বলেছেন রাণী মা, তুমি আমার আদরের পালিতা কন্যা বিশেষ। তোমাকে আমি ও আমার স্ত্রী একদা পথের ধার থেকে কুড়িয়ে পাই। তোমার জাত ধর্ম কিছুই আমরা জানতে পারি নি। এবং যেহেতু আমরা অপুত্রক ছিলাম তাই তোমাকে আমরা এতাবৎ আমাদের কন্যা রূপেই লালন-পালন করেছি। আমরাই তোমার নাম দিই রাণী বলে। প্রসঙ্গতঃ বলি আমি খুবই লিবারেল মাইণ্ডেড লোক। তুমি যাকে পছন্দ করে বিয়ে করতে চাও করতে পারো। জাতি ধর্ম, মানা না মানা তোমার ব্যাপার বা ইচ্ছে। তবে সবাই আমরা একই ভগবানের সন্তান। আমি ইদানীং লক্ষ্য করছিলাম তুমি রাজা নামে ওই ছেলেটার প্রতি বেশ একটু আসক্ত হয়ে পড়ছিলে। তাই আমি নিজেই লিখিত ভাবে একথা জানিয়ে দিয়ে গেলাম যে যদি সত্যিই রাজাকে তোমার মনে ধরে ওকে স্বচ্ছন্দে গ্রহণ করে রেজেস্ট্রি বিয়েটা প্রথমে করে নিও পরে রাজার মন পছন্দভাবে দুজনে ঘরসংসার বেঁধে ঘর করো। তোমাদের দু’জনার প্রতি আমার ভালবাসা ও আশীর্বাদ রইল। আর দেওয়ান কেশব ভট্টাচার্যের কাছে রইল আমার স্টেটের যাবতীয় দলিল-পত্র। সেখানেও সব কিছু তোমার নাম বরাবর করে রেখে গেলাম। এখন থেকে তুমি তোমার ইচ্ছামত রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে রইলে। আমার অবর্তমানে তোমরা এখান থেকে উঠে গিয়ে স্টেটের বাড়ীতেই বসবাস করবে এটাই আমার শেষ ইচ্ছা।

ইতি
তোমার পালক পিতা শিবশঙ্কর রায় চৌধুরী।

শিবশঙ্কর বাবুর মৃত্যুর পর রাণী খুবই ভেঙ্গে পড়ে ছিল। তবুও সবদিক সামাল দিতে রাণী নিজেকে অচিরেই তৈরী করে নিয়ে রাজাকে ডেকে পাঠাল।

রাজা এল।

রাণী দেওয়ান কেশব ভট্টাচাৰ্য্য এবং এটর্নী ভক্তিভূষণ গাঙ্গুলীর সামনে রাজার হাতে একটা হীরের আংটী পরিয়ে দিল। বলল রাজা তুমি জান বাবা চলে গেছেন। বাবা চিঠি লিখে তার মনের কথা লিখে গেছেন এবং একটা দলিলও দিয়ে গেছেন। কাজেই বাবার শেষ ইচ্ছা মতো আমি তোমাকে এঁদের দু’জনার সামনে আমার স্বামী রূপে স্বীকার করে নিচ্ছি তুমিও আমায় গ্রহণ কর।

রাজার স্বপ্ন যে এমন মূর্তহয়ে দাঁড়াবে এতটা সে অবশ্যই ভাবেনি। তবুও রাণীর কথা মত এগিয়ে এসে রাণীর হাত ধরে বলল রাণী, আমি তোমায় সত্যি ভালবাসি। বাবার ইচ্ছামতো আমি তোমাকে আমার স্ত্রীরূপে গ্রহণ করলাম। পরে রাজা তার নিজের হাতের আংটিটা রাণীর হাতে পরিয়ে দিল।

দেওয়ানজীর পরামর্শমতো এদিন ম্যারেজ রেজিষ্ট্রেশন অফিসারও এসে ছিলেন। তিনি তাঁর বাকী কৰ্তব্যটুকু করিয়ে নিলেন। পরে ওই খানেই সাধারণ মতে উপস্থিত সবার মাঝে মাল্যদান পর্বটুকুও সম্পন্ন হোলো।

তিনদিনের মাথায় রাজার গুরুজী হরগোবিন্দ সিং এলেন নতুন কেনা নতুন ডিজাইনের সেই লাক্সারী মিনিবাসটি নিয়ে। যার বডিতে লেখা আছে রাজারাণী পিকনিক বাস। পাটনা রাঁচী হাজারীবাগ দিল্লী। গাড়ীটা আষ্টে পৃষ্ঠে ফুল দিয়ে সাজানো। একে নতুন গাড়ীর উদ্বোধন তাতে আবার সত্যিকার রাজারাণীর হনিমুন যাত্রা।

বিকেল হবার আগেই ডাক বাংলোর আশ পাশের সব প্রতিবেশীরা এসে এদেরকে আশীর্বাদকরল। শুভেচ্ছা জানালো। রাজারাণী, ভক্তিভূষণ ও কেশব বাবুর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে গাড়ীতে উঠল।

রাজা রাণী হঠাৎ গাড়ী থেকে নেমে এল।

একটু দূরে হরগোবিন্দ সিং চোখের জল মুছছিল। রাজা রাণী এসে হরগোবিন্দ সিংকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল।

রাজা বলল গুরুজী আপহি মেরা গুরু, মেরা পিতা, আশীর্বাদ কিজিয়ে। মেরা স্বপ্ন সার্থক হুয়া কেবল আপহিকা দেখ ভালকে লিয়ে।

হরগোবিন্দ সিং রাজা রাণীর মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করল। বলল যাও বেটা। ফিন লোটনা শিগঘিরই।

রাজা এসে বাসের স্টিয়ারিং ধরল। রাণীকে প্রশ্ন করল আগে কোথায় যাবে বলো–দিল্লী আগ্রা মথুরা না রাজস্থান?

রাণী বলল বুন্ধু কোথাকার। হনিমুন করতে কেউ এই গরমে ওসব জায়গায় যায়। চল যাই সিমলা। যাওয়া যাবে তো?

রাজা রাণীকে কাছে টেনে নিয়ে বলল নিশ্চয়ই যাওয়া যাবে। তারপর দেখ কেমন মনের মত করে চলন্ত ঘরবাড়ী বানিয়েছি। আমাদের ছেলে-মেয়ে হলেও এই গাড়ীতে এখানেই থাকবে ওরা। এখন কেমন। হয়েছে বলো, তোমার পছন্দ হয়েছে তো?

রাণী বলল খুব ভাল হয়েছে। এখন দেখে গাড়ী চালাও।

রাজা-রাণীর গল্পটি ফুরোল। নটে গাছটি মুড়োল।

<

Syed Mujtaba Ali ।। সৈয়দ মুজতবা আলী