ভাসানের সুরে বোধনের গান

এই বাড়িটা তার পিতামহের তৈরি। সেকেলে বাড়ি, কিন্তু ভারি মজবুত। বাড়ির গায়ে যে মেহগিনি গাছদুটো তিনি লাগিয়েছিলেন সত্তর বছর আগে, তাদের স্বাস্থ্য এখন উপচে পড়ছে। ওই গাছের কাঠ খুব মূল্যবান। দুটো গাছ বিক্রি করলে বেশ কয়েক লক্ষ টাকা পাওয়া যাবে বলে বড়ছেলে তাঁকে জানিয়ে দিয়ে গেছে। তবে এখন ওইসব গাছ ইচ্ছেমতো লাগানো যায়, কিন্তু কাটা যায় না। তার জন্যে মিউনিসিপ্যালিটির অনুমতি নিতে হয়। শহরের মিউনিসিপ্যালিটির যিনি চেয়ারম্যান তিনি একদা তাঁর সহপাঠী ছিলেন। অতএব এক কলম লিখে দিলেই চেয়ারম্যান অনুমতি দিয়ে দেবেন বলে বড়ছেলের বিশ্বাস।

তিনতলায় তাঁর ঘর। সামনে অনেকটা খোলা ছাদ। বছর আটেক আগে পড়ে গিয়ে পায়ের হাড়ে চিড় ধরেছিল। চিকিৎসার পর ব্যথা কমেছে, কিন্তু হাঁটতে গেলেই ভয় হয় পড়ে যাবেন। তাই লাঠি ব্যবহার করেন। লাঠি নিয়ে ছাদে ঘুরে বেড়ান। সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামতে ইচ্ছে করে না। ফলে সমস্ত পৃথিবীর সঙ্গে তাঁর যোগাযোগের একমাত্র সূত্র হল টেলিফোন। তবে আজকাল তাঁর ফোন কদাচিৎ বাজে। বিরাশি বছরের বৃদ্ধকে ফোন করার মতো মানুষের সংখ্যা দ্রুত কমে আসছে।

একটা টিভি আছে, আছে প্রচুর বইপত্র। খবরের কাগজ আসে দুটো। দিব্যি চলে যাচ্ছে। স্ত্রী গত হয়েছেন বছর পনেরো আগে। দোতলায় দুই ছেলে বাস করে। পুত্রবধূরা পালা করে আসেন। কোনও প্রয়োজন আছে কিনা জিজ্ঞাসা করে যান। কাজের লোক তাঁর দেখাশোনা করে। না। ছেলেদের বিরুদ্ধে তাঁর কোনও অভিযোগ নেই। বরং এই একাকী থাকাটাই তাঁর ভারি পছন্দ। বিরাশি বছর পৃথিবীতে বেঁচে আছেন। এখন শেষ সময়ের প্রতীক্ষা। নিজেকে তৈরি রাখার জন্যে একাকিত্বের বড় প্রয়োজন।

আজ সকালে চমৎকার রোদ উঠেছে। ক’দিন থেকেই দুটো চড়ুই একটু-একটু করে সাহসী হয়ে তাঁর কাছাকাছি চলে আসছে। পাখিরাও বুঝতে পারে মানুষ কখন গাছ হয়ে যায়। ওদের। নামকরণ করেছেন তিনি, পাখি-পাখিনী। পাখিনী বড় আদুরে।

বড়বউমা এলেন জলখাবার নিয়ে। টেবিলে পাত্রগুলো সাজিয়ে ডাকলেন, ‘আসুন বাবা। কাল বলেছিলেন নিরামিষ খাবেন, তাই এনেছি।’

‘ভালো করেছ।’ লাঠি হাতে চেয়ার ছেড়ে উঠে খাবারের টেবিলে এলেন তিনি। ঘড়ি দেখলেন, ঠিক পৌনে ন’টা। বড়বউমা সময় রাখতে জানেন।’

‘একটা কথা বলব বাবা?’

তাকালেন তিনি।

বড়বউমা বললেন, ‘আপনার ছেলে বলছিল ওর পরিচিত একটা সংস্থা আছে, যারা খুব যত্ন করে বেড়াতে নিয়ে যায়। আপনি তো অনেকদিন বাইরে বের হননি। দিন দশেকের জন্যে ঘুরে এলে একটু পরিবর্তন হবে।’

‘দেখছ এই ছাদের ওপর হাঁটাহাঁটি করি, নিচে নামতে ভরসা পাই না–।’

‘আপনার কোনও অসুবিধে হবে না। ওরাই সব ব্যবস্থা করবে। হরিদ্বারে তো কখনও যাননি।

এখন ওখানে আবহাওয়াও বেশ ভালো।’

‘না-না। আমার তীর্থ করতে যাওয়ার কোনও বাসনা নেই।’

‘তীর্থ করতে যাবেন কেন? হরিদ্বারে গঙ্গার পাশে বসলে মন ভালো হয়ে যায়। ওরকম দৃশ্যের সামনে গেলে সময় কখন কেটে যাচ্ছে টের পাওয়া যায় না।’ বড়বউমা বললেন, ‘আমরা তো বছরে দুবার বেড়াতে যাই। আপনি যেতে চান না শরীরের জন্যে। এদের সঙ্গে গেলে সেটা সমস্যা হবে না।’

‘বলছ যখন তখন ভেবে দেখি।’ কথা শেষ করেছিলেন তিনি।

ভেবে দেখলেন। ভালো ভ্রমণসংস্থা হলে চিন্তার কারণ নেই। তবু বঙ্কুবাবুকে ফোন করলেন তিনি। ভদ্রলোক এখন চুরাশি, একই অফিসে কাজ করতেন। বিয়ে করেননি, সারাজীবন শুধু ঘুরে। বেড়িয়েছেন ছুটি পেলেই।

‘বন্ধুদা, আমি প্রশান্ত বলছি। প্রশান্ত সেন।’

‘আরে! কী খবর? খুব ভালো সময়ে ফোন করলে। আমি একটু বাদেই বেরিয়ে যাচ্ছি। এবার বাংলাদেশ। সেই কোন কালে চলে এসেছিলাম, এবার গিয়ে দেখব স্মৃতির সঙ্গে মেলে কিনা। তা কী ব্যাপার বলো?’ বন্ধুদা জিজ্ঞাসা করলেন।

‘আপনি তো জানেন, আমার একটা পায়ে একদম জোর নেই। লাঠি ছাড়া হাঁটা মুশকিল। ছেলে বউমা বলছে ভ্রমণসংস্থার সাহায্য নিয়ে একটু বেড়িয়ে আসতে। আপনার কোনও ধারণা আছে। ওদের সম্পর্কে?’ জিজ্ঞাসা করলেন তিনি।

‘অবশ্যই আছে। দুটো সংস্থার নাম বলছি, ট্যুর এবং সি অর স্কাই। এদের ওপর চোখ বন্ধ করে নির্ভর করতে পারো।’ বন্ধুদা বললেন।

যাত্রার দিন স্থির হয়ে গেল। টাকাটা তিনিই দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ছেলেরা কিছুতেই রাজি হল না। এরমধ্যে ভ্রমণসংস্থা থেকে টেলিফোন করে জেনে নিয়েছে তিনি কী-কী খাবার অপছন্দ। করেন, কোন খাবার পছন্দের। কোন সময়ে খেলে শরীর ঠিক থাকে। একা থাকতে চান না কারও সঙ্গে রুম-শেয়ার করতে আগ্রহী? এসব তথ্য দিয়ে খুশি হলেন তিনি। ওরা যখন আগাম জেনে নিচ্ছে তখন কোনও সমস্যা না হওয়ারই কথা।

সেদিন বিকেলে ছোটছেলে একটি ভদ্রলোককে নিয়ে এল।

 ‘বাবা। এর নাম প্রদীপ, ওর বাবাকে তুমি চিনতে। অনিরুদ্ধ মুখার্জি।’

‘ও। তোমাকেও দেখেছি, চেহারা অনেক বদলে গেছে।’

প্রদীপ বলল, ‘শুনলাম আপনি হরিদ্বার বেড়াতে যাচ্ছেন।’

‘আর বোলো না। ল্যাংড়া মানুষকে এরাই পাঠাচ্ছে। কী যে হবে কে জানে।‘

ছোটছেলে বলল, ‘এখনও ওই কথা ভাবছ? কিছুই হবে না।’

প্রদীপ বলল, ‘আমার পিসিমা বিধবা হওয়ার পর বাবা আমাদের বাড়িতে নিয়ে এসেছিলেন। সে অনেক কাল হয়ে গেল। বাবাও চলে গেছেন। পিসিমা সেই যে বাড়িতে ঢুকেছেন আর বের হননি। ওঁকে ফেলে আমরা কোথাও যেতে পারি না। ওঁরও কোথাও যাওয়া হয় না। অনেক কষ্টে পিসিমাকে রাজি করিয়েছিভ্রমণসংস্থার সঙ্গে হরিদ্বারে যেতে। ওরাই সব দেখাশোনা করবে, তবু আপনি যদি একটু খেয়াল রাখেন তাহলে নিশ্চিন্ত হব আমরা।’

‘তিনি কি অসুস্থ?’

‘না-না। এমনি ঠিক আছেন, তবে মাঝে-মাঝে পেটে যন্ত্রণা হয়।’

‘কেন?’

‘আর কেন? একবেলা খাবেন, তাও আবার আতপ চাল। ডাক্তার দেখিয়েছি। বলছেন, আলসার হওয়ার সম্ভাবনা আছে। ওষুধ দিয়েছেন।’

‘দিয়েছেন।’

‘এসব কথা সংস্থাকে জানিয়েছ?

‘হ্যাঁ।’

‘দ্যাখো, আমি খোঁড়া মানুষ। কতটুকুই-বা করতে পারব। ঠিক আছে–’।

ওরা চলে গেলেও নড়তে পারলেন না তিনি। এটা কী হল? জীবনের নাটক ঈশ্বর লেখেন, কিন্তু নাট্যকারের এ কী রসিকতা?

ষাট বছর আগের কথা। তখন বাইশ বছর বয়স। পাড়ার এক রবীন্দ্রজয়ন্তীর সন্ধ্যায় বাইশ বছরের প্রশান্ত আঠারো বছরের নিরুপমাকে একটু আড়ালে পেয়ে বলেছিল, ‘আমি যে-কথাটা বলতে চাই, সে-কথা কি তুমি বুঝেছ?’

নিরুপমা ঠোঁট মুচড়ে হেসেছিল, ‘হু।’

‘কী বুঝেছ বলো?’

নিরুপমা তাকিয়েছিল, ‘চিৎকার করে বলব?’ তারপর সুখ। বুকের গভীরে টলটলে ঢেউ। দূর থেকে চোখে-চোখে কথা, দু-তিনটি চিরকুট। এক-দুপুরে দুজনে ভিক্টোরিয়ায় গাছের ছায়ায় পাশাপাশি বসা। প্রশান্ত হাত ধরেছিল নিরুপমার। ফরসা লম্বা আঙুল, কী নরম!

‘জানো, মা আমাকে সন্দেহ করছে।’ নিরুপমা বলেছিল।

‘কেন?’

‘জানি না। আজকাল আমার দিকে অদ্ভুত চোখে তাকায়।’

‘আজ কী বলে বেরিয়ে এলে?’

‘এখন তো আমার কলেজে থাকার কথা।’

‘দাঁড়াও। আর একটা বছর। চাকরি পাওয়ামাত্র তোমার মায়ের কাছে যাব।’

গিয়ে কী বলবে? ‘বলব, আমি আপনার মেয়েকে বিয়ে করতে চাই।’

প্রশান্তর হাত আঁকড়ে ধরেছিল নিরুপমা।

সারাজীবনে ওই একবারই স্পর্শ। অথচ এই বয়সেও সেই স্পর্শটিকে স্পষ্ট অনুভব করেন তিনি। কিন্তু মুখ? মুখ যে কীরকম  ঝাঁপসা হয়ে গেছে। সেই আঠারো বছরের মুখটাকে মনে করার চেষ্টা করলেন তিনি। ফর্সা, আদুরে, নাকটি বড় সুন্দর। চুল ছিল প্রচুর। কিন্তু সব মিলিয়ে গোটা। মুখটাকে মনে করতে তিনি পারছেন না। না। তাঁর বয়স হয়ে গিয়েছে।

সময়ে তো এমনই হত। কারও সঙ্গে মেয়ের প্রেম হচ্ছে জানলে ক্ষিপ্ত হয়ে যেতেন অভিভাবকরা। তার ঢেউ ছড়িয়ে পড়ত পাড়ায়। প্রশান্ত যে ভয়ানক ক্রাইম করেছে, তা পাড়ার লোকের মুখ দেখে। মনে হত তখন। অনিরুদ্ধ, যে এতদিন বন্ধু ছিল, আঙুল তুলে শাসিয়ে গেল। নিরুপমার বাবা। এসে দেখা করলেন প্রশান্তর বাবার সঙ্গে। ওদের বংশে কখনও এমন ঘটনা ঘটেনি। তা ছাড়া তাঁরা ব্রাহ্মণ। নিচু জাতির মানুষকে জামাই হিসেবে ভাবতে পারেন না। অতএব ছেলেকে যেন শাসন করেন।

আশ্চর্যজনকভাবে নিরুপমা পরদার আড়ালে চলে গেল। মাসছয়েক বাদে সানাই বাজিয়ে বিয়ে হয়ে গেল তার। বরের বাড়ি কলকাতা থেকে বহুদূরে।

বঙ্কিম লিখেছিলেন বাল্যপ্রেমে অভিশাপ আছে। প্রশান্ত ভাবলেন, মানুষের বাল্যকাল কতদিনে শেষ হয়?

না। আর দেখা হয়নি। চাকরি নিয়ে বাইরে যেতে হয়েছিল। বিয়ের পর ফিরে এসেছিলেন কলকাতায়। নিরুপমা নামের তরুণীর খোঁজ রাখার দরকার মনে হয়নি। বিধবা হওয়ার খবর পেয়েছিলেন বন্ধুদের মুখে। খারাপ লেগেছিল।

বহুঁকাল বাদে বাড়ির বাইরে এলেন তিনি। ভ্রমণসংস্থার লোক খুব যত্ন করে তাঁকে ওপর থেকে নামিয়ে গাড়িতে চাপিয়ে নিয়ে এল স্টেশনের ভেতরে। কামরার সামনে গাড়ি থেকে নেমে একটু হাঁটতে কষ্ট হল না তাঁর। ওরাই ট্রেনে উঠতে সাহায্য করল। দুজনের কুপে। বয়স্করা ওপরে। উঠতে পারবেন না, শোবেন নিচের বার্থে, তাই এই ব্যবস্থা। জিনিসপত্র গুছিয়ে দিয়ে ছেলেটি বলল, ‘এই রইল বেল। যখনই দরকার হবে বেল বাজাবেন, বাজালে আমি চলে আসব। এখন কিছু খাবেন দাদু?’

‘না। থ্যাঙ্ক ইউ।’

ছেলেটি চলে গেলে একটি পত্রিকা বের করে চোখ রাখলেন তিনি। জানালা বন্ধ, কারণ কামরা শীততাপনিয়ন্ত্রিত। কিন্তু পড়া হল না। ভাবনাটা আবার মাথায় ফিরে এল। সকাল থেকে। কয়েকবার ভেবেছেন। প্রদীপ যা বলে গিয়েছিল তা যদি সত্যি হয়, তাহলে নিরুপমা এই ট্রেনেই হরিদ্বার যাচ্ছে। ভ্রমণসংস্থা দুটো কামরা রেলের কাছ থেকে নিয়েছে। এই দুটোর কোনও একটায় তার থাকার কথা। দ্বিতীয় কামরাটি শীততাপনিয়ন্ত্রিত নয়। প্রদীপ যদি পিসির যাওয়ার ব্যাপারে কার্পণ্য করে, তাহলে ওখানেই তার জায়গা হয়েছে। এই সময়ে স্যুটকেশ নিয়ে ঢুকল কুলি, ভ্রমণ-সংস্থার ছেলেটির নির্দেশে সিটের নিচে ঢুকিয়ে দিয়ে চলে গেল। ছেলেটি ডাকল, ‘আসুন দিদিমা। এই বার্থ আপনার। এই রইল বেল। কোনও প্রয়োজন হলেই বেল বাজাবেন, আমি চলে আসব। বসুন।’

ছেলেটি চলে গেল। একজন অপরিচিত বৃদ্ধাকে তাঁর কুপেতে দেখে বিরক্ত হলেন তিনি। এদের কি কাণ্ডজ্ঞান নেই। মহিলার মাথাভরতি পাকা চুল, চশমা, গায়ের রং ময়লা, মুখ গম্ভীর। তিনি বেল বাজাতেই ছেলেটি চলে এল, ‘বলুন দাদু?’

‘অনেকটা পথ। ওঁর অসুবিধে হতে পারে। কোনও মহিলার কুপেতে ওঁর ব্যবস্থা করতে পারবে না?নাহলে আমাকে কোনও ছেলের সঙ্গে দাও।’ গম্ভীর গলায় বললেন তিনি। ‘আপনাদের অসুবিধে হবে? দেখুন কাণ্ড। যাঁরা আপনাদের টাকা দিতে এসেছিলেন। তাঁরা অনুরোধ করেছিলেন একসঙ্গে ব্যবস্থা করতে। আচ্ছা দেখি–।’

বৃদ্ধা জিজ্ঞাসা করলেন ছেলেটিকে, ‘প্রদীপ কেন বলেছে জানি না, ওঁর মনে হচ্ছে অসুবিধে হবে। দেখুন যদি অন্য ব্যবস্থা করতে পারেন!’

‘প্রদীপ? প্রদীপ মানে–।’

‘আমার ভাইপো।’

স্থির হয়ে গেলেন তিনি। শেষপর্যন্ত ছেলেটিকে বললেন, ‘থাক। তুমি যেতে পারো। আমার কোনও অসুবিধে হবে না।’

ছেলেটি চলে গেলে তিনি হাসলেন, ‘তোমাকে চিনতে পারিনি নিরুপমা।’

‘অ্যাঁ?’ চমকে উঠলেন নিরুপমা, ‘তুমি?’

‘হু।’ মাথা নাড়লেন তিনি।

‘একী চেহারা হয়েছে তোমার?’

‘কেন? আমি তো ঠিকই আছি।’ তিনি বললেন, ‘তুমিই একদম বদলে গেছ।’

কথাটায় আমল দিলেন না নিরুপমা, ‘প্রদীপ জানে আপনি হরিদ্বারে যাচ্ছেন?কী আশ্চর্য! সে তো একবারও আমাকে একথা বলেনি।’

তিনি শুনলেন, নিরুপমা প্রথমে তুমি বলেছিলেন, এবার আপনি।

‘বললে কি তুমি আসতে না?’

এবার হাসলেন নিরুপমা, ‘অদ্ভুত!’

‘কীরকম?

‘ষাট বছর আগে সম্পর্ক হচ্ছে জেনে ওদের মাথায় বাজ পড়েছিল। তাড়াতাড়ি পাত্র খুঁজে বিয়ে দিয়ে তবে স্বস্তি পেয়েছিল ওরা। অথচ ষাট বছর পরে ওই বাড়ির ছেলে জেনেশুনে একসঙ্গে হরিদ্বারে বেড়াতে পাঠাচ্ছে। এর চেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার আর কী হতে পারে!’ নিরুপমার কথা শেষ হতেই ট্রেন ছাড়ল।

‘তুমি কেমন আছ নিরুপমা।’

‘একজন বাঙালি বিধবা, যার কোনও সন্তান নেই, যেমন থাকে তেমন আছি।’ গম্ভীর মুখে বললেন নিরুপমা।

তিনি উঠলেন। ছেলেটা যে বেল বাজাবার কথা বলে গিয়েছিল, তা ভুলে গিয়ে লাঠি টেনে নিয়ে দাঁড়াবার চেষ্টা করতেই ট্রেনের ঝাঁকুনিতে টলমল হলেন।

নিরুপমা দ্রুত ধরে ফেললেন তাঁকে, ‘একী! তোমার পায়ে কী হয়েছে?’

‘ভেঙেছিল। বুড়ো হাড় ঠিকঠাক জোড় মেনে নেয়নি।’

‘কোথাও যাবে?’

‘টয়লেটে।’

‘দাঁড়াও, ওই ছেলেটিকে ডাকি।’ নিরুপমা বেল টিপলেন।

তিনি বললেন, ‘ট্রেনটা দুলছে বলে, প্লেন জায়গায় হাঁটতে অসুবিধে হয় না।’

ছেলেটি ছুটে এল, ‘বলুন দাদু।’

‘একটু টয়লেটে যাব।’

‘আসুন।’ হাত বাড়িয়ে তাঁকে ধরে ধীরে-ধীরে বের করে নিয়ে গেল ছেলেটি।

তিনি ফিরে এসে দেখলেন এরমধ্যে সংসার গুছিয়ে ফেলেছে নিরুপমা। ভ্রমণসংস্থার দেওয়া শোওয়ার সরঞ্জাম সাজিয়েছে দুটি বার্থে।

নিরুপমা জিজ্ঞাসা করল, ‘কখন খাবে জিজ্ঞাসা করতে এসেছিল?

‘ওদের তো সময় দেওয়া আছে।’ তিনি বিছানায় গেলেন।

তাঁকে ভালো করে দেখলেন নিরুপমা, ‘আর কী-কী বাধিয়েছ?’

‘তেমন কিছু না। হৃদয় এখনও অটুট আছে।’

‘চশমার পাওয়ার মনে হচ্ছে বেশ।’

‘ও হ্যাঁ। ছানি কাটিয়েছি, তবু–।’

‘ব্লাডসুগার?’

‘বোধহয় নেই।’

‘বোধহয় কেন? ছানি কাটাবার আগে পরীক্ষা করাওনি?’

‘সে তো অনেক বছর আগের কথা। তোমার কথা বলো।’

‘আমি?যমেও ছোঁবে না।’

‘পেটে তো আলসার বাধিয়েছ। ওষুধ এনেছ তো।’

অবাক হয়ে গেলেন নিরুপমা, ‘তুমি কী করে জানলে?’

‘একবেলা খেলে তো আলসার হবেই।’

‘প্রদীপ বলেছে নিশ্চয়ই। আর লোক পেল না।

‘তার মানে?’

‘কাছাকাছি থেকেও ষাট বছরে যে খোঁজ নিল না একবারও, তাকে এসব কথা বলার কোনও মানে হয়?’ ছোট্ট হাসল নিরুপমা।

‘একজন বিবাহিতা মহিলাকে বিরক্ত করা ভদ্রতায় বেধেছে।’

‘তারপরে?’

‘আমার ঘরে যে এসেছিল তাকে অসম্মান করা হত।’ ‘আমি তাকে দেখেছি।’

‘ও।’

‘তোমার সঙ্গে চমত্তার মানাত। কয়েকবার দেখেছি।’ নিরুপমা বললেন, ‘যেদিন শুনলাম উনি চলে গেছেন, সেদিন খুব খারাপ লেগেছিল।’

তার মানে তুমি আমার খবর রাখতে?

‘না। কানে এলে শুনতাম।’

ছেলেটি এল, ‘এবার আপনাদের ডিনার দিতে বলি?

নিরুপমা বললেন, ‘কী দেবে বাবা?

‘আপনার জন্যে রুটি, দুটো নিরামিষ তরকারি, সন্দেশ। আর দাদুর জন্যে রুটি-তরকারি আর চিকেন কারি। মিষ্টি।’ ছেলেটি হাসল।

‘তুমি ওসব না দিয়ে আমাকে শুধু একটা মিষ্টি দিও।’ নিরুপমা বললেন।

‘সেকি! শুধু একটা মিষ্টি খেয়ে সারারাত থাকবেন? ছেলেটি জিজ্ঞাসা করল।

‘শোনো ভাই’, তিনি বললেন, ‘আমাকেও ওই একটা মিষ্টি দিও। একজন না খেয়ে থাকবে আর তার সামনে বসে আমি পেট ভরাতে পারব না।’

‘আশ্চর্য!’ নিরুপমা রেগে গেলেন, ‘বিকেল তিনটের সময় খেয়েছি। রাত্রে আমি কখনওই খাই না।

যে-যার নিয়মে তো চলবে।’

‘চলে তো চেহারার ওই হাল হয়েছে। চিনতেই পারিনি। দাঁড়িয়ে কী দেখছ? যাও, দুটো মিষ্টি নিয়ে এসো।’ ধমকালেন তিনি ছেলেটিকে।

‘দাঁড়াও।’ ছেলেটিকে হাত তুলে থামতে বলে তাকালেন নিরুপমা, ‘তুমি কি আমাকে জব্দ করতে চাইছ?’

‘না তো।’

‘তাহলে?

‘তুমি তো চিরকাল একবেলা খেয়ে থাকনি! নিজেকে কষ্ট দেওয়ার জন্যে এই অভ্যেসটা করেছ। এইটে মানতে পারছি না।’ তিনি বললেন।

ছেলেটি হাসল, ‘তাহলে দিদিমা, দুজনের খাবার নিয়ে আসছি।’ সে চলে গেলে নিরুপমা বলল, ‘আজ রাত্রে ঘুম হবে না। পেটে যন্ত্রণা হবেই।’

‘কি হবে না। আমি তো তোমাকে চিকেন খেতে বলিনি। জানি, বললেও খাবে না। তোমার স্বামী নেই বলে তুমি শরীরটাকে কষ্ট দিচ্ছ, আমি তো স্ত্রী চলে যাওয়ার পর সে-কথা ভাবিনি।’

উত্তর দিলেন না নিরুপমা। মুখ গম্ভীর করে বসে রইলেন। এই বিশেষ ভঙ্গিটিকে তিনি চেনেন। স্ত্রীর সঙ্গে কোনও ব্যাপারে দ্বিমত হলে তাঁকে দেখতে হত এই ভঙ্গিটিকে। অনেক অনুনয়ে সেই মুখ সহজ হত। আজ এই বয়সে ওসব ভাবলে হাসি পায়।

ছেলেটি এল। খাবার দিয়ে গেল।

তিনি ডাকলেন, ‘এসো, খাওয়া যাক।’

‘আমাকে খেতেই হবে?মুখ ফেরালেন নিরুপমা।

‘তুমি খেলে আমার খেতে ভালো লাগবে।’

‘কেন? রোজ তোমার খাওয়ার সময় কে থাকেন?

‘বউমারা।’

‘আমি একা খাই। সবারই কাজ থাকে।’

‘অসময়ে খেলে তো একা খেতে হবেই। খাও।’

শেষপর্যন্ত হাত বাড়ালেন নিরুপমা, ‘কতদিন পরে রাত্রে খাচ্ছি।’

‘কতদিন পরে ট্রেনে উঠেছ? কখনও কি এই সন্ধের পরে আমার সঙ্গে একা এভাবে গল্প করেছে?

‘কল্পনা করেছিলাম। ভেবেছিলাম তুমি আমাকে নিয়ে ট্রেনে চেপে অনেক দূরে চলে যাবে। বিয়ের আগের দিনও ভেবেছিলাম। বাঃ, তরকারিটা ভালো করেছে।’

‘তুমি যে ওরকম ভেবেছিলে তা আমি বুঝতে পারিনি।’

‘ওটা কী দিয়েছে? চিকেন?’ নিরুপমা আঙুল তুলে বাটি দেখালেন।

‘হ্যাঁ।’

‘ওমা। এ তো একেবারে সাদা ঝোল।’

‘আমি রিচ রান্না খাই না।’

‘টেস্ট পাও?

তিনি তাকালেন, ‘মন্দ লাগে না। তুমি এক টুকরো নেবে?

‘আমি?’ চোখ বড় হয়ে গেল নিরুপমার।

‘আমি তো আমিষ খাই না।’

‘কেন? কেউ খেতে বলেনি?’

‘না। বিধবাদের খেতে নেই বলেই বলেনি।’

‘এই নেই কথাটা কোথায় লেখা আছে? নিশ্চয়ই জানো আজকাল ওটা উঠে গেছে।’

‘জানি।’

তিনি একটা টুকরো ঝোলসমেত চামচে তুলে নিরুপমার প্লেটে রাখলেন।

‘তুমি আমার সব লণ্ডভণ্ড করে দিচ্ছ।’

‘এই তো ক’টা দিন–! তারপর আবার যে কে সেই।’ তিনি বললেন।

রাতের ট্রেন একনাগাড়ে ছুটে যাচ্ছে। ঘুম ভেঙে গেল তাঁর। কুপেতে নীল আলো জ্বলছে। মুখ ফিরিয়ে অবাক হলেন। নিরুপমা চুপচাপ বসে আছেন।

‘একি! ঘুমাওনি?

নিরুপমা উত্তর দিলেন না।

‘শরীর খারাপ লাগছে? পেটে কি ব্যথা শুরু হয়েছে? ওষুধ খেয়েছ?’

‘আমার শরীর ঠিক আছে।’

‘তাহলে?’

‘আমি ভাবতে পারছি না।’

‘কী?’

‘যখন চেয়েছিলাম তখন ওরা জোর করে আলাদা করেছিল। তোমার কাছে যেতে দেয়নি। আর এখন ওরাই একসঙ্গে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিল। কেন? সেই তুমি আর আমি তো একই আছি। তখন যৌবন ছিল আর এখন বার্ধক্য এসেছে। মানুষ যৌবনকে ভয় করে আর বার্ধক্যকে। অবহেলা? এখন আমরা এমনকিছু করতে পারব না, যাতে ওরা বিপদে পড়তে পারে। ওদের অসম্মানিত করার ক্ষমতা আর আমাদের নেই, এটা জেনেই কি এই কাজটা করল। আমার আর ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে না। কাশীর মতো হরিদ্বারের কোনও আশ্রমে কি বাকি জীবনটা আমি থেকে যেতে পারি না?’ নিরুপমার গলার স্বরে কান্না মিশল। তিনি উঠলেন। লাঠি ছাড়াই টলতে টলতে চলে এলেন নিরুপমার পাশে। কাঁধে হাত রেখে বললেন, ‘এসব ভাবার অনেক সময় পাওয়া যাবে। আমি তোমার পাশে বসছি। তুমি শুয়ে পড়ো।’

প্রায় জোর করেই শুইয়ে দিলেন নিরুপমাকে। তারপর মাথায় হাত বোলাতে-বোলাতে বললেন, ‘ঘুমিয়ে পড়।’

‘এই ক’টা দিন চলে গেলে কী হবে?’ নিরুপমা ফিসফিস করে বলল।

তিনি কোনও উত্তর দিলেন না। কপালে হাত বুলাতে-বুলাতে একসময় বুঝলেন নিরুপমা জেগেই আছেন। তাঁর হাত ব্যথা করছিল। হাত সরাতে নিরুপমা বললেন, ‘যাও, শুয়ে পড়।’ লাঠিটা দূরে পড়ে আছে। আসার সময় মনে হয়নি, নিজের জায়গায় ফিরে যাওয়ার সময় খুব ভয় হল। লাঠিছাড়া ফিরবেন কী করে!

<

Samaresh Majumdar ।। সমরেশ মজুমদার