মানুষের মেটে

এতকাল বাবুর যত রোগ ছিল মনে, এবার শরীরেও। রাত তিনটে পর্যন্ত মাল খেলে সারাটা সকাল পেট চেপে পড়ে থাকে বাবু। তখন ওই বিশাল শরীর থেকে কুঁই-কুঁই শব্দ বের হয়। ঘনঘন ওষুধ ঢালে মুখের গর্তে। ইদানীং এই অবস্থা চলে দু-তিনদিন ধরে। হরিমাধব ডাক্তার এসে গম্ভীর মুখে বলে, এবার ওসব ছাড়ুন। লিভারের আর দোষ কি! পচে গেল বলে।

তা বাবু যখন শুয়ে-শুয়ে ওষুধ গেলে তখন পারোর ছুটি। কিন্তু ছুটি বলতে যে বাড়ি ছেড়ে যাবে তার উপায় নেই। বাবুকে বিশ্বাস নেই। যন্ত্রণা কখন কমবে কেউ বলতে পারে না। আর কমলেই কমলি এসে মুখ নাড়বে, যাও, গাড়ি বের করো। বাবুর বেরুবার মন হয়েছে।

এ তল্লাটে বাবুর বাড়ি যে দ্যাখে তারই বুকে বেড়াল আঁচড়ায়। অনেকখানি বাগান, সিমেন্ট কাঠ মিশিয়ে প্রাসাদের মতো দোতলা বাড়ি। বাগানের কোণে ছোট্ট ঘরে ডায়নামো আছে। জলঢাকা যখন আলো দিতে পারে না তখন এই ডায়নামো চলে। বাবুর কেউ নেই। বাচ্চা হয়নি। বউ গিয়েছে বছরখানেক আগে পরপুরুষের সঙ্গে ভেগে। আড়াল-আবডাল পেলে কমলি বলে, ভাগবে না কেন? আমি হলেও ভাগতাম।

মালিকদের ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই। কিন্তু বাবুর দৌলতে পারোকে চেনে না একশো কিলোমিটারের মধ্যে কেউ নেই। দশ বছর চাকরি হয়ে গেল এ-বাড়িতে। দুটো জিপ কেনাবেচা হয়ে গেল। কিন্তু কখনও আগবাড়িয়ে কথা বলার অভ্যেস তৈরি হল না। ভোররাতে জিপ নিয়ে ছুটেছিল হরিমাধব ডাক্তারের বাড়ি। হেঁটে আসলে বুড়ো সাতকাহন গাইবে। জিপে বসে বলল, আবার মাল খেয়েছে বুঝি? আর বাঁচানো গেল না হে! এত টাকা নয়ছয় করছে, ভেলোরে গিয়ে চিকিৎসা করিয়ে আনে না কেন বুঝি না। লিভার খসবে এবার।

শব্দটা কদিন এতবার কানে এসেছে যে অজান্তেই নিয়মভঙ্গ করল, লিভার কী?

ডাক্তার বললেন, অ্যা? লিভার জানোনা? মেটে। মেটে বোঝো? খাসির মেটে খাও না? তা ওরকম মেটে মানুষের পেটেও থাকে। লাল টুকটুকে। যেই ঘোচে লাল অমনি আসে কালো।

ওষুধপত্র দিয়ে যাওয়ার আগে ডাক্তার বলে গেল, আর আমাকে ডাকবেন না। কোনও কথা শুনছেন না, এর পরে যদি আর এক ফোঁটা অ্যালকোহল পেটে যায় তো শিবের সাধ্যি নেই কিছু করে।

দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে পারো কথাগুলো শুনল। বাবু পড়ে আছে মড়ার মতো। কে বলবে কাল বিকেলে সেজেগুঁজে ওই মানুষ তার জিপে উঠেছিল। উঠে বলেছিল, অনেকদিন জুয়ো খেলিনি রে। চল একটু শিবু রায়ের জোতে। যতই সাজুক বাবুর চোখের তলায় পোড়া হাঁড়ির ছোঁয়া, গায়ের চামড়ায় কালচে ছাপ মাখামাখি। কুড়ি কিলোমিটার জঙ্গুলে রাস্তা পেরিয়ে ডায়না নদীর গায়ে শিবু রায়ের জোতে পৌঁছে দেখতে পেয়েছিল, আরও গোটাতিনেক গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। নামবার আগে একশো টাকার একটা বান্ডিল ছুঁড়ে দিল বাবু পারোর কোলে, এটা সামলে রাখ। বলে নেমে গেল। ইস্ত্রি করা ঝকঝকে একশো টাকাগুলো কেমন টাইট হয়ে শুয়ে আছে তারের। বাঁধনে। এত টাকা সে রাখবে কোথায়? বাকি তিনটে গাড়ির কোনও ড্রাইভার নেই। শিবু রায়ের এই জোত হল জঙ্গলের এক ধারে। অন্তত এক মাইলের মধ্যে জনবসতি নেই। মেরুদন্ড সোজা করে বসে রইল পারো। বাবু যখন বের হল তখন শিয়ালদের ডাকাডাকি শেষ হয়ে গেছে। অন্ধকারে জোনাকি ছিটকে দিচ্ছে আলো। বাবুর পা জড়ায়নি, গলাও। তবে মদের গন্ধ বড় কড়া। গাড়িতে উঠে বসে হাসল বাবু, লাকটা খারাপ গেল। দু-হাজার ফুড়ুৎ। চল এবার বিনাগুঁড়ি।

এইরকমই আশঙ্কা করছিল পারো। কিন্তু শিবু রায়ের জোত থেকে বেরিয়ে হাইওয়ে ধরে। বিনাগুঁড়ি ছাড়িয়ে নয়াবস্তি পর্যন্ত আসতে একটাও কথা বলেনি, বরং শুনেছে। গাড়িতে হেলান। দিয়ে বাবু একটা লাইন বারংবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে গেয়েছে, এবার কালী তোমায় খাব।

পারো জানে কালী মানে কালীমার্কা। শিবু রায়ের জোতে বাবু খেয়েছে ভুটানের মদ। বিউটির। ওখানে কালীমার্কা হাঁড়িয়া। মেয়েছেলেটার বয়স হয়েছে। গায়ের রং ফরসা। এককালে। শিলিগুঁড়িতে ছিল। বাবুই এই নয়াবস্তিতে এনে তুলেছে। নাক মুখ চোখ ভালো। কিন্তু গতর যা, তিন বাঘ বলবে কাল আবার খাব। যেমন গতর তেমন গলা। ওই গলার দাপটে বস্তির সবাইকে। কেঁচো বানিয়ে রেখেছে বিউটি। বাবু গেলেই একপ্রস্ত গালাগাল শুরু হয়ে যায়। তারপর হাত ধরে ভেতরে ঢুকিয়ে নেয়। মাঝরাত্রে পারো যখন জিপে বসে ঢুলছে তখন কানের কাছে চিৎকার শুরু হয়, আরে এ বাদশাকা বেটা, এটা তোর ঘুমোবার জায়গা? নে, ধরে তোল বাবুকে। ঠিকঠাক নিয়ে যাবি। জোরে চালাবি না। হ্যাঁ, কাল যেন ঠিক সময়ে নিয়ে আসিস।

পারোকে হাত লাগাতে হয়। বাবু তখন সিটে ঢলে পড়ে। পড়তে-পড়তে বলে, গুডনাইট বিউটি।

তারপর গাড়ি চলতে শুরু করলে হাসল, কিছু মনে করিস না পারো। আমাকে তো কেউ বকে না, তাই এখানে আসি। মাঝে-মাঝে বকুনি খেতে খারাপ লাগে না।

দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে কালকের রাত্রের ঘটনাটা দু-তিনবার ভাবল। ডাক্তারকে পৌঁছে দিয়ে এসে বাগানে ঢুকে ওর মন খুব খারাপ হয়ে গেল। বাবুর মেটের রং পালটাচ্ছে? নিজের পেটে হাত দিল সে। প্রত্যেক মানুষের পেটে মেটে আছে?যতক্ষণ টুকটুকে লাল ততক্ষণ কোনও অসুবিধে নেই, যেই রং পালটায় তখনই গোলমাল। বাবুর বাড়িতে মাংস সপ্তাহে তিনদিন। কমলির মন ভালো থাকলে মাঝেমধ্যে তার ভাগ্যে মেটে জোটে। শেষ কামড় দেবে বলে সে সরিয়ে রাখে পাতের ধারে। মানুষের মেটে আর পাঁঠার মেটেতে তফাত কি? কোনও-কোনও মানুষ নাকি মানুষ খায়। তারা মেটেও খায়? নাভিতে হাত বোলালো পারো। চোখের তলায় কালি নেই, মুখে ছায়া নেই, শরীরে তাগদ আছে এরকম মানুষ মানেই তার মেটে টুকটুকে লাল। ব্যাপারটা মাথার মধ্যে ক্রমশ ঢুকে যাচ্ছিল পারোর। কাঠের কল পরিয়ে শের আলির দোকানে ঝুলিয়ে রাখা মাংসের সঙ্গে মেটেও থাকে। দেখতে কি মোলায়েম। তা সবগুলোই যে খুব লাল তা নয়, কিন্তু যে-গুলোয় হলদে ছিটে লেগেছে সেগুলো বিক্রি হতে চায় না। শেষমেশ কেটেকুটে মিশিয়ে দেয় শের আলি। পাঁঠা তো মাল খায় না, তাহলে তাদের মেটে অমন হয় কেন? অবশ্য হলদে ছিটে-লাগা আর পচে যাওয়া এক জিনিস নয়। পেটের ভেতর মেটে পচলে কি চেহারা হয় ঠাহর করতে পারল না পারো।

বাগানে দাঁড়িয়ে সে যখন পেটে হাত বোলাচ্ছে তখন কমলি বেরিয়ে এল। হনহন করে হেঁটে আসছে বাড়ি থেকে। ওর স্পষ্ট মনে হল, কমলির মেটে নিশ্চয়ইটুকটুকে লাল। চেহারা যা তাতে খুব বড় সাইজের মেটে আছে বলে মনে হয় না। কমলি যে দাঁড়িয়ে পড়েছে, কোমরে হাত রেখেছে তা খেয়াল করেনি পারো। ধমকানিতে চটক ভাঙল, ও মাগো! অমন ড্যাবডেবিয়ে আমার পেটের দিকে তাকিয়ে আছ কেন?

থতমত খেয়ে সত্যি কথা বলে ফেলল পারো, মেটে দেখছিলাম।

মেটে? আকাশ থেকে পড়ল কমলি, কীসের মেটে?

সম্বিৎ ফিরে পেল পারো। মাথা নেড়ে বলল, কিছু না।

অ, বাবু মরছে যন্ত্রণায় আর উনি মেটের স্বপ্ন দেখছেন! বাবু দেহ রাখলে কি হবে ভাবতে পারছ? কার জিপ চালাবে তখন? কেন নিয়ে গিয়েছিলে কাল ওই বিনাগুঁড়ির রক্তচোষার কাছে? কমলির প্রশ্নের কোনও জবাব দিল না সে। কি উত্তর হবে এর!

জবাবের জন্যে বসে রইল না কমলি, ভয়ে আমার হাত পা পেটের ভেতর সেঁধিয়ে যাচ্ছে। আমার কি! এ-বাড়িতে ঝি-গিরি করি। বাবু মরলে আর এক বাড়ি কাজ খুঁজে নেব। কিন্তু যতক্ষণ আছি ততক্ষণ তো একটা কিছু করতে হবে। কি বলো?

সে মাথা নাড়ল। বাবুর জন্যে যদি ওষুধ আনতে কলকাতায় যেতে হয় তাও সে রাজি। কমলি খুশি হল, তাই বলি কি, যার জিনিস তাকে ফিরিয়ে আনেনা।

কাকে? পারোর চোখের সামনে বিউটির বিশাল চেহারা ভেসে উঠল।

বউদিকে। এখনও তো বিয়ে করা বউ। আইনের ছাড়াছাড়ি তা হয়নি।

তিনি তো নিজেই চলে গেছেন, আসবেন কেন আবার?

কিছুই বলা যায় না। গিয়ে বলতে দোষ কি!

বাবু বলেছিল, আর মুখ দেখবে না। আমি নিজের কানে শুনেছি। শিবু রায়ের জোতে বসে এক বন্ধুকে বলেছিল, খাঁচা থেকে যে পাখি উড়ে যায় আমি তার মুখ দেখি না।

ওসব রক্ত গরম থাকলে পুরুষমানুষ বলে।

ও। তিনি কোথায় আছেন তা তো আমি জানি না।

আমি জানি। বউদির বোনের বাড়ি জলপাইগুঁড়িতে। সিনেমা হলের বাঁ-দিকে তিনতলা হলুদ বাড়ি। এই বেলা চলে যাও।

জলপাইগুঁড়িতে তিন-তিনটে সিনেমা হল, কোনটার পাশে?

সে আমি জানি না। যে সিনেমা হলের সব কথা বাড়িতে বসে শোনা যায়। বলেই ছুটল কমলি। পারো ওর পিছু নিল। বাবুর শোওয়ার ঘরে কমলি যত সহজে ঢোকে, সে পারে না। দরজায় দাঁড়িয়ে দেখল বাবু যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। কমলিকে দেখে কাতর গলায় বলল, ডাক্তারবাবুকে ডাক।

কমলি মুখ ফিরিয়ে পারোর দিকে তাকাল, তারপর বলল, আচ্ছা।

বাবু বলল, পাপ! আমি তো কোনও পাপ করিনি কমলি। তবে আমার এই দশা কেন?

কমলি জবাব না দিয়ে হাওয়া করতে লাগল। মাথার ওপর পাখা ঘুরছে, তবু। এবং তখনই দরজার পাশে দাঁড়িয়ে পারোর মনে পড়ল সেই একশো টাকার নোটের বান্ডিলটা বাবু চেয়ে নিয়েছিল বিনাগুঁড়িতে বস্তিতে নামার আগে, সেটা তো ফিরে আসেনি। এইভাবে টাকা বিলিয়ে দেওয়া পাপ কিনা তা তার বোধগম্য হল না। সে দেখল কমলি তাকে ইশারা করছে যাওয়ার জন্যে।

গাড়িতে তেল না থাকলেও অসুবিধে নেই। মন্টুর পাম্প থেকে অ্যাকাউন্টে তেল নেওয়ার ব্যবস্থা আছে। আজ কিন্তু মন্টু মাথা নাড়ল, গতমাসের টাকা এখনও পাইনি, ওটা ক্লিয়ার না করলে দিতে পারব না।

এই গলায় কখনও কথা বলে না মন্টু। পায়রা বলল, বিশলিটার দিয়ে দাও, পরে কথা হবে।

পরে আর চান্স পাব নাকি? হরিমাধব ডাক্তার তো জবাব দিয়ে দিয়েছে, কেঁসে গেলে দাম কে দেবে?

প্রায় মিনিট পাঁচেক চেষ্টার পর বিশ লিটার তেল ট্যাঙ্কে ভরতে পারল পারো। গতকালও যে ফুল ট্যাঙ্কিতে আপত্তি করত না, আজ তার পরিবর্তন দেখে সে হিসাব মেলাতে পারছিল না। পাঁচজন সাক্ষী খাড়া করে রাখল মন্টু আজ। মোড়ে দাঁড়াতেই যার সঙ্গে দেখা হল সে-ই জিজ্ঞাসা করে। বাবুর খবর। যেন কখন মরবে সেটাও পায়রা বলতে পারে। মানুষগুলো একটা মৃত্যুর খবর নিচ্ছে অথচ মুখেচোখে একটুও দুঃখ নেই। যে লোকের টাকা থাকে আর সেইসঙ্গে মনের রোগ, তার। শরীরের কলকবজা বিকল হলে সাধারণ মানুষের এত সুখ হয় কেন? জিপটা নিয়ে শের আলির দোকানের সামনে পৌঁছে সে ব্রেকে পা রাখল। শব্দ শুনে শের আলি মুখ তুলে তাকাল। মাংস যা বিক্রি হওয়ার সকালেই হয়ে গেছে। কাজের দিনে একটার বেশি কাটে না শের আলি। আজ। অর্ধেকও বিকোয়নি। জিপে বসেই ও পাঁঠার মেটে দেখতে পেল। অর্ধেক বিক্রি হয়ে গেছে কিন্তু টুকটুকে লাল ফুলের মত জ্বলছে বাকিটা। নেমে এল পারো। তাকে নামতে দেখে শের আলি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, কী ব্যাপার? আজ নিশ্চয়ই মাংস চাই না!

কেন? পারো একবার শের আলি আর একবার ঝুলন্ত মাংসের সঙ্গে লেগে থাকা মেটের দিকে তাকাল।

শেষ আলির চোখের তলায় কালো ছাপ, শির বের করা রোগাটে শরীর। পারো শের আলির নিজস্ব মেটেটা পরিষ্কার দেখতে পেল। ফ্যাকাশে মেরে গেছে, শুকনো, ছিবড়ে-ছিবড়ে। যে রেটে হাঁড়িয়া খায় তাতে এতকাল পচেনি কেন সেটাই বোঝা যায় না। ওর দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে শের আলি খুব অস্বস্তিতে পড়ল, অ্যাই, কি দেখছ? বাবু তো শুনলাম মরবে আজই, এখন মাংস নিয়ে কি হবে? মনে-মনে শের আলির জন্যে একটা কষ্ট তৈরি হল। লাল টুকটুকে মেটে বিক্রি করছে যে তার নিজের মেটের অবস্থা তেরোটা। দরদস্তুর করে সে পাঁঠার মেটে কিনল তিনশো গ্রাম। চকচকে লাল বস্তুটি হাতে নিয়ে আজ বড় মোলায়েম ঠেকল। কি আদুরে! ধারগুলো নেমে গেছে পাতলা হয়ে। মানুষেরা যে দেখতে যত কুৎসিত অথবা সুন্দরই হোক তাদের পেটের মেটে নিশ্চয়ই একরকম থাকে। মাথা নাড়ল পারো, না, মানুষই তা ভিন্ন রকম করে দেয়। কিন্তু পাঁঠারা? তারা কেন নিজেদের মেটে নষ্ট করে?

শের আলি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, অ্যাই পারো, কি বলছ মনে-মনে?

শালপাতার মোড়া বস্তুটির জন্যে তার নটাকা বেরিয়ে গেল। মাইনের অবশিষ্ট টাকাটা। খাওয়া পরা বাবুর বাড়িতে, টাকাও জমে যাওয়া উচিত। কিন্তু জমে না। বড্ড খাওয়ার লোভ পারোর। ফাঁক পেলেই গঞ্জের দোকানগুলোয় বসে যায়। কিন্তু জিপে ফিরে গিয়ে মেটেটার দিকে তাকিয়ে ওর মনে হল আজ এটা না কিনলেই হত। রাঁধবে কে?কমলিকে বললে ঝাঁটা নিয়ে তেড়ে আসবে। পারো ঠিক করল আগে জলপাইগুঁড়ি থেকে ফিরে আসা যাক, তারপর এর একটা বিহিত করবে।

ভালো স্পিডে জিপ চালাচ্ছিল পারো। শালপাতার ঠোঙাটা সে রেখেছে ড্যাসবোর্ডের ওপর। পারো ভাবছিল, বউদির বোনের বাড়িটা সে খুঁজে বের করতে পারবে কিনা। বাবুকে নিয়ে জলপাইগুঁড়ি শিলিগুঁড়ি করেছে অজস্রবার কিন্তু সিনেমা হলে যায়নি। বাবুর সিনেমা দেখার রোগটাই যা ছিল না। বিনাগুঁড়ির মোড় ছাড়াতেই খচর-খচর শব্দ শুনতে পেল পারো। তার গাড়ি নিঃশব্দে চলে। যত্নের হাত সব জায়গায় বোলানো। সামান্য শব্দ হলেই কান খাড়া হয়ে ওঠে তাই। দ্বিতীয়বারের শব্দ বোঝালো এটা গাড়ির কোনও অংশ থেকে নয়। এবং তখনই শালপাতাটার দিকে নজর গেল। শালপাতাটা কি নড়ছে? আচমকা ব্রেক কষে রাস্তার এক পাশে গাড়ি থামাল পারো। মুখ নিয়ে গেল শালপাতার কাছে। স্থির হয়ে আছে ওটা এখন। কিন্তু একটু আগে শুধু শব্দই শোনেনি, নিজের চোখে দেখেছে ওটাকে নড়তে। মিনিট খানেক অপেক্ষা করল পারো। না, আর কোনও নড়নচড়ন নেই। তবে কি ভুল দেখল সে? এমন হতে পারে গাড়ির। ঝাঁকুনিতে শব্দটা হচ্ছিল, শালপাতা নড়ছিল। কোনও-কোনও মাছ নাকি মরে গিয়েও মরে না। কড়াইতেও লাফায়। এটা কি সেইরকম কিছু? মেটেসুষ্ঠু শালপাতাটাকে ক্লাচের দিকে ঠেলে দিল পারো যাতে ঝাঁকুনি লাগলে কম নড়ে। ফের স্টার্ট দিতে গিয়ে ডান হাতের বস্তিটাকে নজরে পড়ল। কাল রাত্রেও বাবু এখানে এসেছিল। একশো টাকার ইস্ত্রি করা নোটগুলো এখন বিউটির দখলে। বাবু মরতে বসেছে অথচ বিউটি সেই টাকায় ফুর্তি করবে। হঠাৎ খুব রাগ হয়ে গেল পারোর। বাবু যদি মরে যায় তাহলে কার পরোয়া? সে জিপ থেকে নেমে বস্তিতে ঢুকল। এখন বস্তিটা ফাঁকা। কিছু কুচো খেলছে। জোয়ান মেয়েপুরুষরা কাজে বেরিয়েছে। বিউটির ঘরের দরজা খোলা। সেখানে দাঁড়াতেই কথা খুঁজে পাচ্ছিল না পারো। রাগ যেটা মাথায় এসেছিল সেটা কেমন নেতিয়ে পড়েছে। পারো দেখল কেউ তাকে লক্ষ করেনি। সুড়সুড় করে সে ফিরে এল জিপে।

স্টার্ট নিয়ে নিশ্বাস ফেলল। ভালোই হল, বাবু যদি ভালো হয়ে এখানে এসে শোনে পারো এসেছিল, তাহলে চাকরি খতম হয়ে যাবে। তা ছাড়া বিউটিকে সে কি-ই বা বলতে পারত?

জিপ চলছে ফুল স্পিডে। গয়েরকটা ডুড়ুয়া পেরিয়ে ধুপগুঁড়ির কাছাকাছি পৌঁছাতেই আবার সেই খচর-খচর শব্দটা কানে এল। পারো তখন ভাবছিল বিউটির মেটের কথা। অত বড় বুক, পাছা আর ধারালো গলার মেয়েছেলে সে জীবনে দেখেনি। অতএব তার মেটের সাইজটা কিছুতেই আন্দাজ করতে পারছিল না। কিন্তু বিউটির মেটে কীরকম?বাবু মাল খেয়ে আউট হয়ে গেলেও বিউটি ঠিক থাকে। ওর চোখের তলায় কালি পড়েনি, বরং গালে কিছুদিন হল মেচেতার দাগ। ফুটেছে। মেচেতা ঢাকতে আজকাল জোর পাউডার মাখে বিউটি। আর এইসময় শব্দটা কানে যেতেই সে একটা চোখ রাখল শালপাতার ওপর। গাড়ির ঝাঁকুনিতে যতটা কাঁপা উচিত ততটাই কাঁপছে ওটা কিন্তু ওর ভেতরের বস্তুটা যেন নড়ছে। খচর-খচর শব্দটা আসছে সেই কারণে। শালপাতার ফাঁক দিয়ে লালচে মেটে দেখা দিয়েই যেন মিলিয়ে গেল। আবার জিপ থামাল পারো। সঙ্গে-সঙ্গে নড়াচড়া বন্ধ। হাত বাড়িয়ে শালপাতার ঠোঙাটা তুলে নিয়ে সে মেটেটাকে দেখল। শের আলি দেওয়ার সময় মুখ থেকে কেটেছিল। আর এক পাশ কেটেছিল সম্ভবত আগেই, অন্য খদ্দেরকে দেওয়ার সময়। কিন্তু দুটোর বদলে একদিকে এখন কাটার দাগটা দেখা যাচ্ছে, অন্য দিকটা আর এবড়ো-খেবড়ো ঠিক নেই। যদিও মোলায়েম হয়ে এপাশের মতো পাতলা হয়ে যায়নি, কিন্তু কেনার সময় সে স্পষ্ট দেখেছিল দু-দিকেই কাটার দাগ স্পষ্ট। হতভম্ব হয়ে গেল পারো। সে কি ভুল দেখেছিল। মেটেটাকে এখন আরও লাল দেখাচ্ছে। শালপাতায় মুড়ে সে বাঁ-দিকের খোপের চাবি খুলে যন্ত্রপাতির মধ্যে ওটাকে রেখে দিয়ে ফের চাবি দিয়ে দিল।

তিস্তা ব্রিজ পেরিয়ে জলপাইগুঁড়িতে পৌঁছাতে আর বেশি সময় লাগেনি। সারাটা পথ ছিল নিরুপদ্রব। শহরে ঢুকে প্রথম দুটো সিনেমা হলের আশেপাশে হলুদ বাড়ি দেখতে পেল না। তৃতীয় হলটির সামনে এসে সে খুশি হল। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে বাড়িটা। জিপ থেকে নামবার সময় হঠাৎ খচর-খচর শব্দটা কানে এল। ড্যাশবোর্ডের বন্ধ ড্রয়ার থেকে আওয়াজ আসছে। পারোর শরীরে আচমকা হিম লাগল। গাড়ি এখন চলছে না, কানকে অবিশ্বাস করার কোনও কারণ নেই। মরে যাওয়া পাঁঠার মেটে কি কখনও নড়াচড়া করে? ছাই মাখিয়ে কইমাছ কেটে ফেলার পরেও সেটাকে নড়াচড়া করতে দেখেছে সে। এ পাঁঠাটা কি সেইরকম? পারোর মনে হল সে একটা। মেটেভূতকে ওই বাক্সে বন্দি করে রেখেছে। খুলে রাস্তায় ফেলে দেওয়াই ভালো। কিন্তু তখনই শব্দটা থেমে গেল। কান খাড়া করেও কোনও শব্দ শুনতে পেল না সে। এই সময় একটা লোক প্রায় তার ঘাড়ের কাছে এসে বলে উঠল, আরে, চেনা-চেনা মনে হচ্ছে! তুমি বাবুর বাড়ির ড্রাইভার না?

মুখ ফিরিয়ে পারো পরপুরুষটিকে দেখতে পেল। মুঠোর মধ্যে সিগারেট নিয়ে ফুক-ফুক করে টানতে টানতে কথা বলছে। সে মাথা নেড়ে নীরবে হ্যাঁ বলল। পরপুরুষ বলল, তা এখানে কি করছ চাঁদু? সিনেমার টাইম হয়নি।

লোকটার সঙ্গে কীরকম ব্যবহার করবে ভেবে পাচ্ছিল না পারো। চুলটুলের কায়দা আছে। কোঁচানো ফরসা ধুতি আর কলারতোলা পাঞ্জাবি। চেহারাটি অবশ্য স্বাস্থ্যবান নয়। এর মেটেটা কীরকম? আঃ, তার যদি একটা চোখ থাকত যা দিয়ে জামাকাপড়ের আড়াল ভেদ করে মানুষের পেটের মধ্যে মেটে দেখে নিতে পারত, তাহলে কি আরামটাই না হত। একে সে দেখেছে। কয়েকবার। বাবুর সঙ্গে আলাপ ছিল। কমলির কাছে শুনেছে, বাবু যখন বাড়ি থাকত না তখনই বউদির কাছে আসত।

আমি সিনেমা দেখতে আসিনি, বউদির কাছে এসেছি। পারো শক্ত মুখে জানাল।

সঙ্গে-সঙ্গে লোকটার মুখে বিস্ময় ফুটে উঠল, অ্যা বলো কি! বাবু পাঠিয়েছে? পাখি খাঁচা থেকে সরে বেরিয়েছে, এবার ফুড়ুৎ করে ওড়ার জন্যে তৈরি! তা কী ব্যাপার?

পারো উত্তর দিল না। লোকটা বুঝল। বুঝে বলল, তাহলে চলো আমার সঙ্গে। দেখা করে কি না দ্যাখো। এখন আমার সঙ্গেও চট করে দেখা করে না। বিশ্বাস হচ্ছে না? গাঁ-গঞ্জের সবাই তো আমাকে দুষছে। পরের বউ ফুসলেছি। আরে আমি হলাম মই। মই বেয়ে উঠে যেই ডালের নাগাল পেয়ে যায় তখন আর মইয়ের দরকার কি? বলতে-বলতে লোকটা পারোকে নিয়ে হলুদ বাড়ির ভেতরে ঢুকল। বসার ঘরে ঢুকে বলল,এই অবধি আমার অধিকার, বুঝলে? এই যে সোনার মা, না-না, আমি নই, তেনাকে বলো তার স্বামীর ড্রাইভার এসেছে দেখা করতে। দরকারটা বলছে না।

পারো দেখল ভদ্রলোক আয়াস করে বসে সিগারেট খাচ্ছেন। সে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে ইতিউতি তাকাচ্ছে। এটা যাদের বাড়ি তাদের কাউকেই তো দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। মিনিট তিনেক অপেক্ষা করার পর বউদি এল। খুব বিরক্ত চোখে তার দিকে তাকিয়ে বলল, ও! কী ব্যাপার? এখানে কে পাঠিয়েছে?

খুব ঘাবড়ে গেল পারো। সত্যি কথাটা বলতে দেরি করল না, কমলি।

কমলি! তার এত সাহস হল? কেন এসেছ? বউদি দরজায় দাঁড়িয়েই প্রশ্ন করছিল।

বাবুর শরীর খুব খারাপ। বিনীত হয়ে জবাব দিল পারো।

শরীর খারাপ তো আমার কাছে কেন? ডাক্তার দেখাও!

হরিমাধব ডাক্তার জবাব দিয়ে গেছে।

এতক্ষণ লোকটা হাঁ করে শুনছিল। এবার তড়াক করে লাফিয়ে উঠল, জবাব দিয়ে গেছে? কি জবাব?মাল যদি আবার খায়, তাহলে বাঁচানো যাবে না, তাই তো?

মাথা নাড়ল পারো, না বাবু আর এমনিতেই বাঁচবে না।

তোমাকে কে বলল কথাটা? লোকটা কাছে এগিয়ে এল।

সবাই জানে। গঞ্জের সবাই। বিছানায় পড়ে আছে বাবু। তাই কমলি পাঠালো।

বাঃবাঃ, ও রানি, এখন কলকাতায় নয়, তোমার গঞ্জেই ফিরে যাওয়া উচিত। যা গেছে তা যাক, যা আছে তাই বিক্রি করলেও কলকাতায় বাড়ি হয়ে যাবে। মরার আগে যাওয়া দরকার তোমার। হাজার হোক তুমি ওর বিয়ে-করা বউ, প্রকৃত উত্তরাধিকারী। লোকটা হাসল।

বউদি ঠোঁট কামড়ালেন, সে আমার মুখ দেখবে না বলেছিল।

অ্যাই, চোখ চেয়ে দেখে কথা বলার অবস্থায় আছে নাকি তোমার বাবু?

আজ্ঞে না। পারো জবাব দিল। যদিও এই ব্যাপারটা সে স্পষ্ট জানে না।

লোকটা খুশি হল, ব্যাস, যে চলে যাচ্ছে সে আর কি বলবে। বরং পাঁচ পাবলিক বলবে কি সতীসাধ্বী স্ত্রী গো, স্বামী নিশ্বাস ফেলার আগে ফিরে এল।

কি যা-তা বলছ? বউদি গলা তুলল।

ঠিকই বলছি। এখন না গেলে সম্পত্তি কে কোথা থেকে হাতিয়ে নেবে তার হদিশ পাবে না। খুড়তুতো মামাতুতোরা নেই?তখন মামলা করে খোসা পাবে। আমার কি? এখন আমি তো আঁটি। কলকাতায় যাওয়ার আগে গুছিয়ে নাও।

বেশ। যখন এত করে বলছ। কিন্তু আমার বাসনা ছিল না। যে বাড়ি একবার ছেড়ে এসেছি অত্যাচারিত হয়ে, সেখানে আবার পা রাখব–! তা বলছ যখন এত করে! বউদি নিজের মনে বলছিল।

তাহলে বিলম্বের দরকার নেই। আমি জিনিসপত্র গুছিয়ে আনি!

তুমি যাবে? বউদিকে চিন্তিত দেখাল, আচ্ছা চলো, একা যেতে ঠিক সাহস হচ্ছেনা।

সমস্ত পথ পারো মুখ বুজে জিপ চালাল। লোকটা কত রকমের পরামর্শ দিল বউদিকে তার হিসেব নেই। বউদি কিন্তু জিপে ওঠার পর মাথায় ঘোমটা দিয়েছে আর চুপটি করে রয়েছে। সে লোকটাকে এও বলতে শুনল, আমি তোমার উপকার করে যাব। জানি বাবুর প্রতি প্রতিশোধ। নেওয়ার জন্যে তুমি আমায় বেছেছিলে, মনে নাওনি একবারও, তবু। তা বলি কি, কলকাতা হল বিরাট জায়গা। তোমার ভগ্নীপতির বন্ধু যতই স্বপ্ন দেখাক, তোমার থাকা উচিত এখানেই। চেনা পরিবেশে মানুষ স্বচ্ছন্দে থাকে।

বাড়ির কাছাকাছি এসে বুক ঢিপঢিপ করতে লাগল। যদি গিয়ে দেখে বাবু আর নেই তো হয়ে গেল। বউদি গাড়ি রাখবে বলে মনে হয় না। স্টার্ট বন্ধ করতেই বউদি বলল, শোনো, তুমি একবার ওপরে গিয়ে দেখে এসো আগে।

আমি যাব? লোকটা খুব ঘাবড়ে গেল।

কি জানি, যদি ফাঁদ হয়, যদি ওকে মিথ্যে শিখিয়ে পাঠিয়ে থাকে–!

তাহলে আমি গেলে তো হাড় ভেঙে দেবে! অ্যাই, তুই সত্যি বলছিস?

হ্যাঁ।

পারো গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াল। আর এই সময় কমলি ছুটে এল বাইরে, বউদি এসেছে? তাকে ঘাড় নাড়তে দেখে কমলি চিৎকার করল, ও বউদি তাড়াতাড়ি আসুন, বাবু খাবি খাচ্ছে। ও বউদি–।

সঙ্গে-সঙ্গে গাড়ি থেকে নেমে বউদি ছুটল বাড়ির ভেতর। পেছন-পেছন লোকটা। বাবু খাবি খাচ্ছে! তার মানে শেষ সময় এগিয়ে এসেছে। পারোর মন খুব খারাপ হয়ে গেল। এই এতদিনের আরামের চাকরি চলে গেলে তার খুব কান্না পাচ্ছিল। এবং তখনই সে খচর-খচর শব্দটা শুনতে পেল। সারাটা পথ খেয়ালই ছিল না ওটার কথা। তাড়াতাড়ি চাবি ঘুরিয়ে খোপের ভেতর থেকে শালপাতার ঠোঙাটাকে টেনে বের করতেই দেখল ফক্কা। ওটা খালি। ঝুঁকে ক্রু-ড্রাইভারের ওপর লালচে মেটেটাকে দেখতে পেল। সন্তর্পণে শ্রু-ড্রাইভার ধরে ওটাকে বাইরে বের করে আনতেই মনে হল মেটেটা একবার কেঁপে উঠল। হয়তো চোখের ভুল, কিন্তু যেটা সত্যি সেটা হল মেটের শরীরের কোথাও আর শের আলির ছুরির দাগ নেই, একেবারে নিটোল হয়ে গেছে ওটা। যেন একটা ছোট্ট কাছিম। ঠিক মাঝখানে উঁচু আর চারপাশে পাতলা হয়ে নেবে গেছে। কোথাও কোনও খাঁজ নেই, কোথাও কাটার চিহ্ন নেই। অথচ এসবই ছিল। এত মোলায়েম গোলাকার ছিল না মেটেটা। পারোর মাথা ঘুরতে লাগল। জিপের গায়ে হেলান দিয়ে সে এবার হাতের তেলোয় মেটে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল খানিক। না, কোনও খচর-খচর শব্দ নেই, নড়ছেও না একটু। এতক্ষণ ওসব যদি শোনার ভুল হয়ে থাকে, তাহলে মেটের চেহারা পালটে গেল কি করে? কিন্তু সেইটুকটুকে লাল রঙটা কি জেল্লা হারিয়েছে? অতটা লাল আর নয় বলে মনে হচ্ছে! কেন এমন হল? হয়তো অনেকক্ষণ পাঁঠার শরীর থেকে আলাদা হয়ে থাকায় রঙটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

মেটের গায়ে কোনও রক্ত বা রস নেই। সে যত্ন করে বুকপকেটে রেখে দিল ওটাকে। তারপর ধীরে-ধীরে ভেতরে পা বাড়াল। সিঁড়ির মুখেই দেখা হয়ে গেল লোকটার সঙ্গে। চোরের মতো নেমে আসছে। চোখাচোখি হতেই জিজ্ঞাসা করল, কি করি বলো তো? জলপাইগুঁড়িতে নিয়ে যাওয়া উচিত ওঁকে।

কেন? প্রশ্নটা করতেই বুক কেঁপে উঠল, নাকি মেটেটা নড়ল? বাবু তাহলে মরেনি এখনও?

এখানে থাকলে রাত পোহাবে বলে মনে হয় না। লোকটা সত্যি উদ্বিগ্ন, এদিকে সন্ধে হয়ে এল।

এই সময় কমলি এসে দাঁড়াল সিঁড়ির মুখে, বউদি বলল আপনাকে আজ চলে যেতে। বাবুকে নড়ানো যাবে না। তারপর পারোর দিকে তাকিয়ে বলল, সারাদিন তো মুখে কিছু দাওনি। ঘরে ভাত ঢাকা আছে।

কমলি চলে যেতে লোকটা চোখ ছোট করল। আমেদুধে মিশে যাচ্ছে। লাস্ট বাস কখন?

আমি জানি না। পারো কথা শেষ করতে-না-করতেই লোকটা বেরিয়ে গেল।

বাবুর গায়ের রং কালচে হয়ে গেছে। মুখ হাঁ হয়ে বিছানায় পড়ে রয়েছে এখন। মাথার পাশে একটা চেয়ারে বউদি বসে। বাবুর পেটের দিকে তাকাল পারো। নির্ঘাত বাবুর মেটে পচে গলে যাচ্ছে এখন। এই মানুষটি জুয়া খেলে বিউটির ঘরে মাল খেয়েছে কে বলবে! বউদির শরীর। ভারী। কমলির মতো কাঠি-কাঠি নয়। পারো বউদির পেটের কাছে খোলা চামড়া দেখতে পেল খানিক। ঝুঁকে পড়ে বউদি তখন বলছিল, খুব কষ্ট হচ্ছে? হ্যাঁগো, খুব কষ্ট হচ্ছে?

বাবু মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল। বউদি বলল, খাও, আরও মদ খাও! আমার কথা তো শোননি!

বউদির মেটে কীরকম হবে? পারোর মনে হল, নির্ঘাত বউদির মেটে লাল নয়। শুধু শরীর ভালো হলেই মেটে লাল হবে, মনটাকে সেই সঙ্গে ভালো হতে হবে না? পাঁঠারা কারও ক্ষতির কথা ভাবে না, শরীর ভালো হলেই ওদের মেটে লাল হয়। হঠাৎ বুকপকেটটা থরথরিয়ে উঠল। এবার। আড়চোখে পকেটের দিকে তাকিয়ে শক্ত হয়ে দাঁড়াল পারো। মেটেটানড়ছে, তার বুকপকেট থেকে যেন বেরিয়ে আসতে চাইছে। চট করে বাঁ-হাত দিয়ে সে মেটে সুদ্ধ পকেটটাকে চেপে ধরতে চাইল। আর তখনই কমলি এসে দাঁড়াল পাশে, উঃ, একেই বলে পুরুষমানুষের মন! বাবু যাচ্ছে স্বর্গে আর তুমি জুলজুলিয়ে বউদির শরীর দেখছ? অন্য সময় এমন ভান করে থাকো–পকেটে কি আছে?

এত বড় একটা অভিযোগের ধকল সামলে উঠতে পারল না পারো। কথাগুলো এমন গলায়। বলেনি কমলি যাতে বউদির কানে যাবে না। কাঁটা হয়ে সে দেখল বউদি বাবুকে ছেড়ে এবার তার দিকে মুখ ঘোরাল। আর একটু আড়ালে সরে যেতেই বউদির গলা ভেসে এল, ওখানে কে কমলি?

ইয়ে, পারো এসেছে।কমলির জবাব এবার নরম গলায়।

বউদি কথা বাড়াল না, কিন্তু কমলি ছাড়ার মেয়েছেলে নয়, বুকপকেটে কি রেখেছ, হাত সরাচ্ছ যে বড়?

কিছু না। জবাবটা দিতেই মেটেটা নড়ে উঠল আচমকা।

তুমি আমাকে মিছে কথা বলছ, অ্যাঁ! তোমার জন্য ভাত ঢেকে রাখি না আমি?

মেটে আছে, মেটে। সমস্যা চাপা দিতে জবাব দিল পারো।

মেটে? ওমা, মেটে কেউ পকেটে রাখে নাকি? কি অনাসৃষ্টির কথা গো! দেখি! হাত বাড়াল কমলি। অতএব ওটাকে বের করতে বাধ্য হল পারো। সঙ্গে-সঙ্গে হিসহিসিয়ে উঠল কমলি, তুমি কি মানুষ, অ্যাঁ! বাড়ির কর্তা মরতে বসেছে তবু তোমার খাওয়ার এত নোলা!

পারো কাঁটা হয়ে ছিল। কমলির সামনে যদি মেটেটা লাফিয়ে ওঠে! কিন্তু তার আগেই কমলি সেটাকে ছোঁ মেরে নিয়ে নিল, রাঁধতে তো হবে আমাকেই। বাবুর যদি রাত কাটে, তাহলে কাল দুপুরে খেতে পাবে। এবার ভাতগুলো গেলো গিয়ে।

পুরো ভাত খেতে পারল না পারো। মেটেটাকে হাতছাড়া করার পর থেকেই মন খিচড়ে গেছে। খিদেটাও চলে গেল। হাত-মুখ ধুয়ে দাওয়ায় বসতেই সে চাঁদের আলো আর ব্যাঙের ডাক শুনতে পেল। কাল সন্ধেবেলায় যখন চাঁদ উঠেছিল, আজ না ওঠার কোনও কারণ নেই। আর ব্যাঙগুলো খিদে পেলেই এই সময় ডাকে। শুধু খিদে নয়, মৃত্যু-ভয়েও তো ডাকে। দরজায় ফাঁক থেকে। লাঠিটা নিয়ে সে পা টিপেটিপে বাগানে নামল। বাতিল একটা চৌবাচ্চায় বসে ডাকছে ব্যাঙগুলো। এই বিশেষ ধরনের প্রাণিগুলোকে সেই ধরে এনেছে আঙরাভাসা নদীর ধার থেকে। বঁড়শিতে বিধিয়ে ভোররাত্রে ডুডুয়ার জলে ফেলে দিলেই মাছ আসবে ধেয়ে। ব্যাঙগুলো ধরাই আছে, মাছ ধরতে যাওয়ার সময় পাচ্ছে না সে। দু-দিন আগে একটা ঢোঁড়া সাপকে দেখেছিল চৌবাচ্চার কাছে আসতে। সে ব্যাটাই এসেছে আজ। লাঠিটা উঁচিয়ে কয়েক পা এগোতেই সে থমকে দাঁড়াল। লোকটা বলল,এর মধ্যে ব্যাং আছে নাকি? আমি কাছে আসতেই এমন চেঁচিয়ে উঠল যে ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। ইয়ে হল কি, বাস পেলাম না। লাস্ট বাস চলে গেছে। তোমার বউদি কি চিজ জানো তো, তাই তোমার সঙ্গে আলোচনা করতে এলাম।

লোকটা তাকে পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢুকে যাওয়া মাত্র যে ব্যাঙগুলো চুপ করে গেল তা টের পেল পারো। বাবুর বাড়ির লাগোয়া বাগানের শেষপ্রান্তে তার এই ঘর। এখানে যে লোকটা সেঁধোবে তা। সে ভাবতে পারছে না। ঘরে ফিরে গিয়ে দেখল লোকটা খাঁটিয়ার ওপর আরাম করে বসেছে, বাঃ, খাসা ঘরটি! ডাইরেক্ট চাঁদ থেকে আলো আসে। কাউকে বলার দরকার নেই এখানে আমি আছি। তুমি আমাকে দ্যাখো আমিও দেখব। ওই ঝি-টা এই ঘরে আসে নাকি? আসে না? যাক, তবু। বাঁচোয়া।

লোকটা এবার সিগারেট ধরালো, ব্যাং পুষছ?

পারো মাথা নাড়ল, হ্যাঁ।

লোকটা বলল, ভালো, বড় মাছ ব্যাং খায়। আমি অবশ্য দেখিনি কখনও। যে মাগিটার কাছে তোমার বাবু যায় তার নাম বিউটি, না?

পারো আবার মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল। লোকটা কিছুক্ষণ সিগারেট টানল, দু-পয়সা যদি রোজগার করতে চাও তো আমার কথা শোনো। তুমি তো লোক খারাপ নও। যার জন্যে চুরি করলাম সেই এখন চোর বলছে। বিউটির কাছে আমাকে নিয়ে চলো, বুঝলে?

অবাক হয়ে লোকটার দিকে তাকাল পারো। বিউটির কথা অবশ্য এ-তল্লাটে সবাই জানে। কিন্তু এ কেন সেখানে যেতে চায়? পারো মাথা নাড়ল, বাবু জানতে পারলে মেরে ফেলবে।

যে লোকটা খাবি খাচ্ছে সে জানবে কি করে?

আমি বাবুর নুন খেয়েছি, আপনার কথা শুনতে পারব না।

অ। লোকটা মাথা নাড়ল, তা ভালো। রাতটা আমায় এই ঘরে কাটাতে দেবে তো? পারো কিছু বলল না। লোকটা তার খাঁটিয়ায় শরীর এলিয়ে দিল, বড় ফুটফুটে জ্যোৎস্না উঠেছে হে। তবে তোমার এই ব্যাপোষা ভালো জিনিস নয়। ব্যাঙের লোভে সাপ আসে।

পারো নিজের ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এল। লোকটাকে কি বউদি তাড়িয়ে দিল? তাই কি, যার জন্যে চুরি করি কথাটা আওড়ালো লোকটা? কিন্তু সঙ্গে-সঙ্গে বিউটির কথা মনে পড়ল ওর। লোকটা বিউটিকে খুঁজছিল। মেয়েছেলেটা বাবুর অনেক টাকা ঝেড়ে নিয়েছে। এখন মরার সময় হয়তো জানতেও পারছে না খবরটা। আর জানলেই যেন ছুটে আসবে এখানে! এলেই বা কি, তাতে বাবুর জীবন তো ফিরবে না!

আজ রাত্রে ঘুমের যখন চান্স নেই তখন মাছ ধরতে যেতেই হয়। ব্যাঙের চৌবাচ্চার পাশে বসে চাঁদ দেখতে-দেখতে কথাটা ভাবল পারো। তারপরেই জিভ কামড়ালো। বাবুর যখন মরণের। সময় তখন মাছ ধরার কথা ভাবছে ছি! পারো উঠে বাগান পেরিয়ে ভেতর-বাড়িতে ঢুকল। সন্ধে হয়ে যাওয়ার পর এই বাড়ি আরও নিঝুম। অবশ্য বাবু সুস্থ থাকলে এ-বাড়িতে বসে সন্ধে দেখা হয় না। সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে সে বারান্দায় পা দিল। কোথাও কোনও শব্দ নেই। কমলি। নিশ্চয়ই রান্নাঘরে। বাবুর ঘরের দরজার দিকে এগোতে সে খচর-খচর শব্দটা শুনতে পেল। সারাদিনে শব্দটায় এমন অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে যে পারো চমকে চারপাশে তাকাতে লাগল। এবং তখনই দরজার সামনে ওটাকে দেখতে পেল। চটজলদি মেটেটাকে তুলে নিল পারো। চেহারাটা একই রকম আছে, শুধু আকারে সামান্য বড় লাগছে। কিন্তু এটা এখানে এল কি করে? রান্নাঘরে নিয়ে যাওয়ার সময় কমলির হাত থেকে কি পড়ে গেছে? শালপাতাটা তো আলগা ছিল। মেটেটাকে বুকপকেটে রেখে দিল পারো। তারপর দরজা দিয়ে মুখ বাড়াল। বাবু শুয়ে আছে চোখ খুলে। খাবি খাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। বউদিকে দেখা যাচ্ছে না। বাবুর জন্যে খুব কষ্ট হল পারোর। সে পায়ে-পায়ে ঘরে ঢুকল। সঙ্গে-সঙ্গে বুকের ভেতর খচর-খচর আরম্ভ হল। বাঁ-হাতে বুক চাপল পারো। জামার আড়াল সত্বেও হাতের মুঠোয় মেটেটার বিক্ষোভ সে টের পাচ্ছে।

এবার বাবুর নজর পড়ল তার ওপর। যেন চিনতেই পারছেনা। পারোর গলা ভেঙে গেল, বাবু!

বাবুর ঠোঁটে হাসি ফুটল। তারপর ফ্যাসফেসে গলায় বলল, বিউটিকে বলিস আর যেতে পারলাম না।

এ কি কথা শুনছে সে? শেষ সময়ে মানুষ মেয়েছেলের কাছে যাওয়ার চিন্তা করে? আর তখনই বউদি ঘরে ঢুকল। বাবু তার দিকে তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিল। মুখচোখ বেঁকে গেল আবার। বউদি এর মধ্যে কী পোশাক পালটেছে? বাবুর মাথার কাছে বসে ওষুধ গ্লাসে ঢেলে বলল, এটা খেয়ে নাও। যতক্ষণ প্রাণ আছে ততক্ষণ ওষুধ খেতেই হবে। আমার সেবায় যদি মন না ভরে, তাহলে তোমার বিউটিকে ডেকে পাঠাব।

বাবু এবারও জবাব দিল না। বউদি একবার পারোর দিকে আড়চোখে দেখে নিল, সেই লোকটাকে তাড়িয়ে দিয়েছি এ-বাড়ি থেকে। কলকাতায় যাব ভেবেছিলাম, আর যাব না। এ-বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার পর কেউ আমার শরীর ছোঁওয়ার সুযোগ পায়নি, বুঝলে?নাও, ওষুধ খাও।

বাবু বলল, আমাকে একটু মদ দাও। মদ খেলে ব্যথা কমে।

সঙ্গে-সঙ্গে ঝাঁঝিয়ে উঠল বউদি, ইল্লি আর কী!

হঠাৎ নিচের বাগানে কমলির চিৎকার ভেসে এল। কমলি চেঁচাচ্ছে, কে? কে আপনি?

আর তারপরেই সব চুপচাপ। বউদি ওষুধ রেখে তড়াক করে উঠে পড়ল। তারপর লম্বা-লম্বা পা ফেলে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। পারো কমলির আর্তনাদ শুনেছিল। কিন্তু বাবুর জন্যে এত মন খারাপ হয়েছিল যে সে নড়ল না। বিছানার নিচে বসে বাবুর পায়ে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল সে। আর তখনই বউদির চিৎকার ভেসে এল, পারো!

এক ঝটকায় নিজেকে তুলে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে সিঁড়ি ডিঙিয়ে বাগানে নেমে এল পারো। বউদি তার ঘরের সামনে। মা কালীর মতো ভঙ্গি, শুধু জিভটা বের করা নেই। ওকে দেখামাত্র বউদি চিষ্কার করল, একটা পুরুত ডেকে আনতে পারবি?

সন্ধে পেরোনো রাত্রে এমন হুকুম শুনবে ভাবতে পারেনি পারো। সে কাছে এগিয়ে দেখল কমলি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে খাঁটিয়ার পাশে, আর লোকটা সেখানে বসে। বউদি বলল, নিয়ে আয় পুরুত। আজ রাত্রেই এদের বিয়ে দিয়ে তবে ছাড়ব। এবার কমলি হাউমাউ করে কেঁদে উঠল, বিশ্বাস করো বউদি, আমার কোনও দোষ নেই।

দোষ নেই?তুই এই ঘরে কি মতলবে এসেছিলি?

পারো আমাকে মেটে দিয়েছিল, সেটা পাচ্ছিলাম না রান্নাঘরে। তাই জিজ্ঞাসা করতে এসেছিলাম।

মেটে দিয়েছিল? ঘরের মানুষ মরতে বসেছে আর তোকে মেটে দিয়েছিল?

দিব্যি করে বলছি। তা আমি কি জানি অন্ধকারে এ মিনসে শুয়ে আছে? ডাকছি পারো ভেবে, উঠছে না। তখন পিঠে হাত দিয়ে ডাকতেই আমাকে জড়িয়ে ধরল। কমলি মুখ নামাল।

জড়িয়ে ধরল! তা একবার চিৎকার করে থেমে গেলি কেন? বউদি চাপা গলায় জিজ্ঞাসা করল।

মুখ নামিয়ে কমলি বলল, উনি চিৎকার করতে দিচ্ছিলেন না। তুমি বকবে সেই ভয়ও হচ্ছিল।

ছি-ছি-ছি! তোমার চরিত্র এই? আমাকে বের করে নিয়ে যাওয়ার আগে দিনরাত গুজুর-গু জ্বর করে প্রেমের বাক্যি শোনাতে, আর একটা ঝি-এর সঙ্গে এসব করছ? বউদি ধিক্কার দিল।

এবার মুখ খুলি সুন্দরী! রাজভোগ বাসি ঠান্ডা হলে তার চেয়ে গরম-গরম আলুসেদ্ধ ভাত ঢের বেশি উপাদেয়। তোমার বুকের মধ্যে হিমালয়ের সব বরফ জমা, বাবু পারেনি গলাতে, আমিও না। যাকে ঝি বলছ তার ভেতরে যা উত্তাপ তা তুমি এ-জীবনে সঞ্চার করতে পারবে না।লোকটা রসিয়ে-রসিয়ে কথাগুলো বলে উঠে দাঁড়াল।

দূর হও, দূর হও সামনে থেকে। এই মুহূর্তে এ-বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যাও।

বউদি আর দাঁড়াল না। হনহনিয়ে বাগান ডিঙিয়ে চলে গেল ভেতর-বাড়িতে। লোকটা কমলির দিকে তাকাল, শুনলে তো। তা তুমি যদি চাও তো আমার সঙ্গে যেতে পারো।

কমলি কোনও জবাব দিল না। লোকটা ওর পাশে এসে দাঁড়াল, আমি মানুষ মন্দ নই। তবে বিয়ে থা করতে পারব না বাপু। যাবে তো চলো।কমলি সরে দাঁড়াল। মুখ তুলল না।

লোকটা এবার বাইরে বেরিয়ে এল। উদাস গলায় বলল, দেখি বিউটির ওখানে কি করে। পৌঁছানো যায়। আমেদুধে মিশে যায় কিন্তু আঁটি থেকে গাছ বেরোয়। জ্যোৎস্না মেখে লোকটা চলে যাওয়ার পর পারো কান্না শুনল। তার ঘরের মেঝেতে বসে কমলি কাঁদছে। মেয়েটার মুখ যাই হোক, তার যত্নআত্তি তো কিছু-কিছু করত। লোকটা যে কথাটা বলল সেটা কি ঠিক?বউদি যদি বরফ তবে ওর ভেতরে উত্তাপ আছে?নতুন চোখে কমলির দিকে তাকাতেই ওর বুকটা যেন নড়ে উঠল। পারো বুকে হাত দিল। আর তখনই তার খেয়াল হল বুকপকেটে মেটেটা নেই। সে চকিতে পায়ের দিকে তাকাল। সবকিছু বিস্মরিত হয়ে যে পথ দিয়ে এসেছিল জ্যোৎস্নার আলোয় সেই পথটা খুঁজে দেখল। তারপর প্রায় সম্মোহিতের মতো দোতলায় উঠে এল, কোথাও নেই। মহামূল্যবান কিছু হারিয়ে যাওয়ার যন্ত্রণা এখন তার বুকে। ঘরে উঁকি মারল সে।

বউদি খাটের পাশে চেয়ারে বসে দু-হাতে মুখ ঢেকে কাঁদছে। বাবু শুয়ে আছে টানটান। পারো কাঠ হয়ে গেল। বাবু কি মরে গেল? সে পায়ে-পায়ে বাবুর কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই বউদি মুখ তুলল। সারা মুখে জল। বউদি জিজ্ঞাসা করল, আপদ বিদেয় হয়েছে?

তাহলে কি বাবু মরেনি?মৃতদেহের সামনে বসে কি কেউ এ প্রশ্ন করে? সে মাথা নাড়ল। বউদি আবার জিজ্ঞাসা করল, হারামজাদিটা গিয়েছে সঙ্গে? পারো মাথা নেড়ে না বলল।

বউদি নিশ্বাস ফেলল, তারপর বলল, তুমি এখানে বসো। আমি বাথরুম থেকে আসছি।

বউদি চলে গেলে সে বাবুর মুখের দিকে তাকাল। না, নিশ্বাস পড়ছে। বাবু মরেনি। ঘুমোচ্ছে, কিন্তু বাবুর মুখের সেই কালচে ভাবটা কমল কি করে? অতটা অসুস্থ তো দেখাচ্ছে না? এটা কি তার চোখের ভুল? এই সময় বাবু ঘুমের ঘোরে ককিয়ে উঠল, আঃ! বাবুর একটা হাত পেটে পড়তেই খচর-খচর শব্দটা উঠেই মিলিয়ে গেল। সঙ্গে-সঙ্গে চমকে উঠল পারো। শব্দটা এসেছে বাবুর পেট থেকে। সে ঝুঁকে পড়ল। বাবুর পরনে এখন লুঙ্গি আর গেঞ্জি। ওপরে চাদর ঢাকা। চাদর সরালো সে। কোমরে গিঁট আলগা। হাত দিতেই সেটাও নেমে এল। এবং তখনই তার চক্ষু স্থির হয়ে গেল। বাবুর পেটের বাঁ-দিকে মেটেটা চেপে বসে আছে। ঘরের মাঝারি আলোয় সেটাকে আরও চ্যাপটা দেখাচ্ছে। চ্যাপটা এবং কালচে। পারো খপ করে মেটেটাকে ছিনিয়ে নিতে গেল বাবুর পেটের ওপর থেকে, তুলবার সময় ওটা এমন আঁকড়ে ছিল, বাবু যন্ত্রণায় কাতরে উঠল। মেটেটাকে পকেটে পুরে পারো চাদর টেনে দিল। এটা ওখানে গেল কি করে? বুকপকেটে খচর-খচর করছে এবং মেটেটা। বোঝা যাচ্ছে, খুব অসন্তুষ্ট হয়েছে। যন্ত্রণায় মুখে বাবু চোখ মেলল, পারো, একটু মদ দিবি?

পারো জবাব দিতে পারল না। বাবু জিজ্ঞাসা করল, কীরে?

এবার পারো পলল, মদ নেই।

আছে। তোর জিপের সিটের তলায়।

এই সময় বউদি ঘরে ঢুকল। বেশ তাজা দেখাচ্ছে এখন। ঘরে ঢুকেই ছুটে এল বউদি, ওগো, তুমি কথা বলছ? কেমন লাগেছ? দ্যাখো আমি এসেছি, ফিরে এসেছি।

বাবু মুখ ফিরিয়ে নিল। বউদি দু-হাতে বাবুকে জড়িয়ে ধরল, মুখ ফিরিও না। আমি কি এতই খারাপ? আমি কি শুধুই বরফ?

পারোকে বলো মদ আনতে।

না-না, তুমি এখন মদ খাবে না। আমি তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। কেমন লাগছে?

এতক্ষণ ভালো ছিলাম, আবার যন্ত্রণা–। বাবু মুখ বিকৃত করল।

বুকপকেটে খচর-খচর আরম্ভ হল। বাবু এতক্ষণ ভালো ছিল? এতক্ষণ তো এই মেটে বাবুর। শরীরে লেগে ছিল। সরিয়ে নিতেই যন্ত্রণা বাড়ছে। বউদির পেছনদিকে সে। সন্তর্পণে বুকপকেট থেকে মেটেটা বের করে চাদরের তলা দিয়ে বাবুর পেটের ওপর রাখতেই সেটা পিছলে খানিকটা সরে গিয়ে সেঁটে বসল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে বাবু যেন স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল, আঃ!

বউদি এখন বাবুর মুখে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। বাবু সেটা উপভোগ করছে। বাবু বলল, তুমি যে চলে এলে বড়!

বউদি বলল, কথা বলো না। আমি আর যাব না।

কিন্তু আমি তো মরে যাব।

তোমাকে আমি মরতে দেব না।

কেন?

আমি জানি না।

বাবু ধীরে-ধীরে ঘুমিয়ে পড়ল। বউদি তৃপ্তির হাসি হাসল। পারোর দিকে ফিরে জিজ্ঞাসা করল, মুখটা এখন অনেক পরিষ্কার দেখাচ্ছে, না?

পারো মাথা নাড়ল। বউদি বলল, কাল সকালে হরিমাধব ডাক্তারকে ডেকে এনো।

পারো আবার মাথা নাড়ল। বউদি বলল, কমলিকে বলো, আর যেন না হয়, এবার ক্ষমা করলাম।

পারো চুপ করে রইল। বউদি জিজ্ঞাসা করল, সে কি রান্নাবান্না করেছে?

পারো মাথা নেড়ে বলল, জানি না।

মেটের কথা বলছিল। মেটের ঝোল আর ভাত হলেই তো হয়। বাবুর যদি ঘুম না ভাঙে তাহলে ওষুধ দেব না। আর হ্যাঁ, বিউটিকে কাল একবার ডেকে এনো তো!

ঘুমন্ত বাবুর দিকে তাকিয়ে পারো জিজ্ঞাসা করল, বিউটিকে?

হ্যাঁ। বাবু বেঁচে থাকলে তারও তো লাভ। ওখানে গেলে যেন মদ না গেলায়, বলব।

পারোর মাথায় কিছু ঢুকছিল না। বউদি এত পালটে গেল কি করে! তখনই বাবু চোখ মেলল। মুখে যন্ত্রণার চিহ্ন নেই। বাবু বলল, বিউটিকে যা টাকা দিয়েছি তারপর আর ওর কাছে যাওয়ার দরকার হবে না। কথাটা শোনামাত্র বউদি বাবুর মাথায় মুখ রাখল। রেখে কেঁদে উঠল। পারো যে পেছনে দাঁড়িয়ে সেই খেয়ালও নেই। পারো ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় দেখল চাদরের একটা পাশ যেন কিছুর চাপে ঝুলে পড়েছে। সে সন্তর্পণে দুজনের চোখ এড়িয়ে হাত ঢোকাতেই মেটেটাকে পেল।

মুঠোয় ওটাকে নিয়ে নিচে নেমে এল পারো। সেই পেলব মোলায়েম অনুভূতিটা আসছে না কেন? জ্যোৎস্নায় মুঠো খুলতে অবাক হয়ে গেল পারো। মেটেটার সর্বাঙ্গে কাঁটা-কাঁটা খাঁজ। অনেকটা কাঁঠালের শরীরের মতো। সেই মসৃণ তুলতুলে ব্যাপারটা উধাও। আর ওর শরীরের কোথাও লাল রং খুঁজে পাওয়া গেল না। একটা পাতায় জড়িয়ে মাটিতে রেখে উবু হয়ে বসল পারো। ঘণ্টাখানেক নজর রাখল। কিন্তু খচর-খচর শব্দ দূরের কথা, একটুও নড়াচড়া করল না বস্তুটা। দুঃখিত মুখে পারো চাঁদ দেখল। মাঝ আকাশে চলে এসেছে। ওটাকে নিয়ে জিপের কাছে চলে এল সে। তারপর বাবু যে সিটে বসত তার তলায় হাত ঢোকাতে একটা হাঁড়িয়ার বোতল খুঁজে। পেল। এটাকে কখন রেখেছিল বাবু? আর এটার কথা যখন খেয়াল আছে তখন বাবুর মাথা ঠিক কাজ করছে। পারো নিজে কখনও মদ খায়নি। হাঁড়িয়ার বোতলটাকে ছুঁড়ে দিল দেওয়ালের দিকে। ঠং করে  কাঁচ ভাঙার শব্দ আর সেই সঙ্গে মদের গন্ধ ভেসে এল। পারো অবাক হয়ে দেখল পাতায় রাখা মেটেটা একটু নড়ে উঠল। সঙ্গে-সঙ্গে ওটাকে নিয়ে দেওয়ালের ধারে ছুটে গেল সে। বোতলের অর্ধেকটা উড়ে গেছে। মদ ছড়িয়ে আছে মাটিতে। মেটেটা যেন তার গন্ধ পেয়ে পাগল। হয়ে উঠেছে। পাতা থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে। বোতলের বাকি অংশ খানিকটা মদ নিয়ে। তেরচা করে পড়েছিল। সন্তর্পণে সেটাকে তুলে নিয়ে মদের ভেতর মেটেটাকে ছেড়ে দিল পারো। সাঁতার কাটছে এমন ভঙ্গিতে পাক খেল মেটেটা। কিন্তু চাঁদের আলোয় মদের রং পালটে যাচ্ছে বলে মনে হয়। আলকাতারায় মতো কিছু বেরিয়ে আসছে মেটের শরীর থেকে।

মদটা ফেলে দিয়ে মেটেটাকে বের করে দেখল ওটা নরম হয়ে গেছে। পাতায় মুড়ে সে ব্যাঙের চৌবাচ্চার কাছে এল। ভেতর-বাড়ির ওপরের ঘরে আলো জ্বলছে। এখন মধ্যরাত। বউদি কি। জেগে আছে বাবুর পাশে? এখন ব্যাং তুলে মাছ ধরতে গেলে কেমন হয়?

ছিপ নেওয়ার জন্যে ঘরে ঢুকতেই সে কমলিকে দেখতে পেল, সেই একই ভঙ্গিতে বসে আছে। মেয়েটা। বড় দুঃখ হল পারোর। কাছে গিয়ে সে ডাকল, কমলি, এই কমলি?

কমলি মুখ তুলল, পারো বলল, বউদি তোর খোঁজ করছিল।

আমি–আমি মরে যাব।কমলি কেঁদে উঠল।

কেন?

আমাকে জোর করে–। কমলি কথা শেষ করল না।

বউকি তোকে তাড়াবে না।

তুই?

হাঁ হয়ে গেল পারো। সে তাড়াবার কে?কমলি এগিয়ে এল তার পাশে, তুই আমাকে ঘেন্না করবি, বল? তাহলে আমার বেঁচে থেকে কোনও লাভ নেই।

শরীরে তাপ লাগল যেন। লোকটা বলেছিল কমলির শরীরে উত্তাপ আছে। এর আগে কমলি তার এত কাছে কখনও আসেনি। পারো মাথা নাড়ল, না।

সঙ্গে-সঙ্গে পারোকে জড়িয়ে ধরল কমলি, বাবু কি মরে যাবে?

না। চেহারা অনেক ফরসা হয়ে গেছে। বউদি সেবা করছে।

আমার ওপর তোর রাগ হয়েছে?

না।

পারোর উত্তাপ তাকে স্থির থাকতে দিচ্ছিল না। কিন্তু কমলি তাকে বাধা দিল, আজ না।

কেন? আজ আমার ঠোঁট এঁটো হয়ে আছে। সকাল হোক, মুখ ধুই, তবে–।

পারো নিশ্বাস ফেলল। কমলি বলল, একটা রাত তো। কিছু খাসনি?

না।

রান্না নেই কিছু? খিদে পেয়েছে খুব।

খাবি?

পারোর মনে পড়ল। পাতার ভেতর থেকে কুচকুচে কালো মেটেটা বের করল সে।

কি? কমলি প্রশ্ন করল।

অন্ধকার এখন এ-ঘরে ঢুকছে। চাঁদ চলছে। চাপ দিতেই মেটেটা দু-ভাগ হল। একভাগ মুখে দিতেই গলে যেতে লাগল। পারো অন্য ভাগটা কমলির মুখে ঢুকিয়ে দিয়ে বলল, খেয়ে নে, বেশ নরম।

কমলি জিজ্ঞাসা করল, কিরে এটা?

সেই মেটেটা।

<

Samaresh Majumdar ।। সমরেশ মজুমদার