শিকার কাহিনি

আঠারো বছরের এই বাড়িটার মালিক পাণ্ডেজি। অত্যন্ত সজ্জন ব্যক্তি। কথা বলেন সুন্দর হিন্দিতে, অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে। বছর চল্লিশের মধ্যেই বয়স কিন্তু কথাবার্তায় এমন ভদ্রলোক আজকাল দেখা যায় না। লোকে বলে ওঁর বাবাও নাকি ওইরকম বিনয়ী ছিলেন। মাথা ঠান্ডা, একটুতে উত্তেজিত হওয়ার লোক নন বলে কানপুর থেকে কলকাতায় এসে এরকম তিনখানা বাড়ির মালিক হয়েছেন। খিদিরপুরের এই মহল্লায় ওঁর তিনটে বাড়ির মধ্যে এই বাড়িটাই বড়, ঘর অনেক, ভাড়াটে বেশি। তাই ভেতরে ঢোকার মুখেই যে ঘরটি তা কাউকে ভাড়া দেননি পাণ্ডেজি। বাড়িওয়ালার সঙ্গে বাড়ির যদি কোনও সম্পর্ক না থাকে তাহলে ভাড়াটেরা মতলব আঁটবেই। বরং তাদের সঙ্গে মিলেমিশে থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ। এটাও বাবার কাছ থেকেই শেখা। তাই ওই ঘরে রোজ বিকেলে মজলিশ বসে। বাড়ির ভেতরে যারা যায় আসে, তাদের ওপর নজর রাখা যায়। বাইরের উটকো লোক হলে এই ঘরে বসতে হবে প্রথমে।

আঠারো ঘরের এই বাড়ির ভাড়াটেরা সুনির্বাচিত। নিজে উত্তরপ্রদেশের মানুষ বলে উত্তরপ্রদেশীয়রাই সংখ্যায় ভারী। দু-ঘর বিহারি আর বাঙালি আছে। বাঙালিকে রাখা নিয়ে। আপত্তি ছিল পাণ্ডেজির। কিন্তু বাবা এ-ব্যাপারেও তাকে শিক্ষা দিয়ে গেছেন। এই শহরটা যেহেতু বাংলাদেশে তাই আমাদের হাবভাবে বাঙালি ছাপটা রাখা দরকার। একজন বাঙালি ভাড়াটে থাকলে তার সঙ্গে কথা বললে সেই ছাপটা আসবেই। তাছাড়া কোনওদিন বাঙালি অবাঙালি ঝামেলা হলে সে-ই তোমাকে বাঁচাবে। তবে হ্যাঁ, এমন লোককে ভাড়াটে নিসাবে নির্বাচন করো যে মেরুদণ্ড সোজা করতে পারে না, একশটা ঝামেলায় অষ্টপ্রহর জড়িয়ে আছে। পাণ্ডেজির এই বাঙালি ভাড়াটেটি একটি স্কুলে পিওনের চাকরি করে, পাঁচটি কন্যাসন্তানের জনক, সবসময় মাটির সঙ্গে মিশে আছে। তার সঙ্গে দেখা হলে অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে কুশল জিজ্ঞাসা করেন। তিনি। লোকটি বিগলিত হয়। দু-বেলা হাত তুলে নমস্কার করে তাকে। অন্য ভাড়াটেদের নির্দেশ দিয়েছেন যেন বাঙালিটির সঙ্গে কেউ খারাপ ব্যবহার না করে। সাধারণত জল-কল-পায়খানা। নিয়েই তো ওদের ঝগড়াঝাটি শুরু হয়। সে ব্যাপারে পাণ্ডেজির কাছে সমস্যা হলেই আসতে হবে এবং তাঁর সিদ্ধান্ত সবাইকে মানতে হবে।

যেহেতু উত্তরপ্রদেশের এবং বিহারের মানুষজন এখানে শান্তিতে থাকতে চায় তাই পরদাপ্রথা সবাই সঙ্গত বিবেচনা করে। আঠারোজনের কোনও দর্শনপ্রার্থী এলে তার হুট করে ভেতরে যাওয়ার নিয়ম নেই। পাণ্ডেজি তাকে হাসিমুখে আপ্যায়ন করেন, ভাড়াটেকে খবর দেন। সে এসে যদি প্রয়োজন মনে করে তবে নিজের দায়িত্বে অতিথিকে ভেতরে নিয়ে যাবে। কারণ, এই বাড়ির মেয়েদের ইজ্জত রক্ষা করা একটি পবিত্র কর্তব্য।

পাণ্ডেজির আর একটি নিয়ম সবাইকে মানতে হয়। আঠারো ঘরের বাসিন্দাদের মধ্যে সতেরজনের আয় অত্যন্ত সীমিত। বেশির ভাগই আশেপাশের কলকারখানার শ্রমিক। ক্লাস থ্রির বেশি বিদ্যে নেই কারও। দেশে চিঠি লিখতে হলে পাণ্ডেজির সামনে এসে উবু হয়ে বসতে হয়। তা এই ধরনের মানুষ নেশা করে, ঝামেলায় ফেলে সবাইকে। খিদিরপুরে নেশা করার জায়গার অভাব নেই। কিন্তু পাণ্ডেজির হুকুম নেশা করে কেউ হল্লা করতে পারবে না। যদি তেমন হয়। তাহলে বাড়ি ছেড়ে যেতে হবে। কোনও নিয়ম দীর্ঘকাল চালু থাকলে তা সহজে কেউ ভাঙতে চায় না। নেশা করে আসা মানুষ চুপচাপ শুয়ে থাকে ঘরে।

পাণ্ডেজি এই সতেরজন সম্পর্কে অত্যন্ত নিশ্চিত। এরা ধর্মপ্রাণ এবং তাঁর অত্যন্ত বশংবদ। উত্তরপ্রদেশের উচ্চবর্ণজাত সবাই। তিনি নির্দেশ দিয়েছেন এই বাড়িতে সবাইকে আত্মীয়ের মতো থাকতে হবে। সদরে একটি বারোয়ারি পাপপাসে পা মুছে সবাইকে ঢুকতে হবে। স্ত্রীলোকেরা যখন কলঘর ব্যবহার করবে তখন পুরুষরা সেদিকটা সম্মানের সঙ্গে পরিহার করবে। কিন্তু আঠারোতম ভাড়াটেটিকে নিয়ে ইদানীং দুশ্চিন্তায় পড়েছেন পাণ্ডেজি।

লোকটি উত্তরপ্রদেশের নয়, বিহারের সমস্তিপুর জেলার মানুষ। মাত্র বিশ-বত্রিশ বছর বয়স। দুই কন্যার জনক। ছিমছাম সুন্দর চেহারা। নাম নাগেশ্বর।

এ বাড়ির এই একটিমাত্র লোক প্যান্ট-সার্ট পরে। টেরিকটের মোজাসহ জুতো পায়ে দেয়। ঘরে বড় আয়না ছাড়া দুটো চেয়ার এবং টেবিল আছে। সমস্তিপুর কলেজ থেকে বি. এ. পাশ করেছে। ধর্মতলার একটি কেন্দ্রীয় সরকারি অফিসে বাবু চাকরি করে। এ বাড়ির গোত্রছাড়া ভাড়াটে। পাণ্ডেজি এই একটি ব্যাপারে বাবাকে সমর্থন করে না। তিনিই মৃত্যুর আগে এই ভাড়াটেটিকে মাত্র ষাট টাকায় বাড়িতে স্থান দিয়েছিলেন। তারপর অবশ্য দু-খেপে পাণ্ডেজি আশি টাকায় সেই ভাড়াকে তুলে এনেছেন। কিন্তু মনে শান্তি আসেনি। অন্যান্য ভাড়াটেরা নাগেশ্বর স্পর্কে অত্যন্ত ইর্ষা পোষণ করে এ তিনি জানেন। নাগেশ্বরের স্ত্রী খুবই সাদামাটা মেয়েছেলে, কোনও পুরুষ। আজও তাকে ঘোমটার আড়ালে দেখতে পায়নি। কিন্তু ওই পরিবার অন্য ভাড়াটেদের সঙ্গে। মেলামেশা করে না, এমনকী বাচ্চাগুলোও ঘরেই থাকে সবসময়। প্রথম প্রথম এটাকে অহঙ্কার বলে মনে করত সবাই। একবার কাউকে অহঙ্কারী মনে হলে তাকে সহ্য করা মুশকিল হয়ে পড়ে। এ বাড়ির মেয়েদের ইন্ধনে পুরুষেরা নাগেশ্বরকে তাই এড়িয়ে চলত। সে বি. এ. পাশ জানা সত্বেও কেউ তার কাছে চিঠি লেখাতে আসত না। কিন্তু ক্রমশ সবাই বুঝতে পারল নাগেশ্বর লোকটা নিরীহ প্রকৃতির, একমাত্র স্ত্রীকে শাসন করার সময়েই তার পৌরুষ প্রকাশ পায়। এতে বৈরীভাবটা কমে এলেও ঈর্ষা গেল না। নাগেশ্বরের ঘরে খুব নিচু স্বরে রেডিও বাজে, পুজোর। আগে রকমারি জামাকাপড় কিনে তারা দেশে যায়। কখনও-সখনও যখন নাগেশ্বরের মা দেশ থেকে আসে তখন জমিজমার গল্প শোনায়। তার ওপরে খুব সম্প্রতি নাগেশ্বর তার এগারো বছরের বড় মেয়েটির বিবাহ দিয়ে এসেছে সমস্তিপুরে গিয়ে। ঈর্ষা তো হাওয়া পাবেই।

পাণ্ডেজি খবর নিয়েছেন। নাগেশ্বর যে অফিসে কাজ করে সেখানে ভালো উপরির ব্যবস্থা আছে। যদিও নাগেশ্বরের চাকরি সামান্যই তবু সেই উপরির খুদকুঁড়ো তার হাতে আসে। পাণ্ডেজি এ। ধরনের ভাড়াটেকে পছন্দ করতে পারছিলেন না। কোনও ভাড়াটেকেই তিনি বাড়িভাড়ার রসিদ দেন না, কেউ চায়ও না। সম্প্রতি নাগেশ্বরের অফিসে প্রয়োজন হওয়ায় সে পাণ্ডেজিকে বিনীত ভঙ্গিতে বলল, একটা রসিদ যদি দেন তাহলে আমার উপকার হয়।

পাণ্ডেজি অত্যন্ত বিরক্ত হলেও মুখে তা প্রকাশ করলেন না, বললেন অবশ্যই দেব, কমাসের চাই বলুন?

নাগেশ্বর বলল, গতমাসেরটা হলেই কাজ চলবে। পাণ্ডেজি তাকে রসিদ দিয়ে স্থির করলেন। নাগেশ্বরকে এখান থেকে সরাতে হবে। সরাতে হলে একটা যুক্তি চাই। নাগেশ্বর সেই সুযোগ। দিচ্ছে না। দেবদ্বিজে তার খুব ভক্তি, প্রায়ই ঘরে পুজো করে। কন্যার বিবাহ দেওয়ার আগে যে পুজো করেছিল তার প্রসাদ দিয়ে গিয়েছিল পাণ্ডেজিকে। অত্যন্ত সুস্বাদু এবং পরিচ্ছন্ন করে পরিবেশন করেছিল সে। খেয়ে তৃপ্ত হলেও মন খুঁতখুঁত করেছিল।

বড়মেয়ের বিয়ে দিয়ে নাগেশ্বর স্ত্রীকে রেখে এল দেশে। উপরি থাকলেও তার আয় খুব বেশি নয়। ফলে তাকে কর্জ করতে হয়েছিল অনেক। ঋণগ্রস্ত নাগেশ্বর স্থির করল কলকাতায় সে একা। থাকবে। তার স্ত্রী স্বভাবতই দেশে থাকতে চায় না। মাত্র ছাব্বিশ বছর বয়স তার। কলকাতায়। বেশির ভাগ ঘরে থাকলেও সে এখানে স্বাধীনভাবেই থাকে। মাঝেমধ্যে নাগেশ্বর তাকে কোনও ভগবানের বায়োস্কোপ অথবা কালীঘাটের মন্দিরে নিয়ে যায়। দেশে থাকলে তাকে বন্দিদশায় কাটাতে হবে। কারণ সেখানে পরদাপ্রথা অত্যন্ত কড়া। এমনকী নাগেশ্বরের সঙ্গেও রাত না হলে ওখানে সে কথা বলতে পারে না। তার ওপর বিরাট সংসারের হাজারটা কাজ সামলাতে হয়। তাকে। যেহেতু সে স্বামীর সঙ্গে কলকাতায় থাকে, তাই দেশের বাড়ির লোক সেখানে গেলে এই চাপ দিয়ে বেশ সুখ পায়। তাই সে মেয়ের বিয়ের পর স্বামীর সঙ্গে চলে আসতে চেয়েছিল, কিন্তু নাগেশ্বর রাজি হয়নি। সে কলকাতায় একা থাকলে অনেক পয়সা বেঁচে যাবে এবং কর্জ শোধ করতে সুবিধে হবে। স্ত্রী-যুক্তি শোনার মানসিকতা যেহেতু বিহারি পুরুষদের নেই তাই নাগেশ্বরের চলে আসতে কোনও অসুবিধে হয়নি।

পাণ্ডেজির এই বাড়িতে কোনও অবিবাহিত পুরুষের স্থান নেই। নাগেশ্বর যখন এবার একা ফিরে এল তখন তিনি চিন্তায় পড়লেন। যদিও নাগেশ্বর কোনওদিকে মুখ তুলে তাকায় না তবু স্ত্রীহীন। হয়ে অন্যান্য পরিবারের সঙ্গে থাকাটা শোভন হচ্ছে না। কিন্তু সে অবিবাহিত নয়, স্ত্রীও প্রয়োজনে দেশে যেতে পারে। একটা বিহিত করার জন্যে সুযোগ খুঁজছিলেন পাণ্ডেজি।

এই প্রথম স্ত্রীকে ছেড়ে কলকাতায় আছে নাগেশ্বর। প্রথম প্রথম তার খুব মন খারাপ হত। রোজ ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠে স্ত্রী তার পাদোদক পান করত। সে সময় চোখ বুজে থাকত নাগেশ্বর, নিজেকে খুব দামি বলে মনে হত। স্নান-খাওয়ার শেষে যখন অফিসে বেরুত তখন স্ত্রীর প্রণাম। নিতে হত। অনেক দিন তাড়াহুড়োয় বেরিয়ে এসে এই কারণে আবার ফিরে যেতে হয়েছে। সন্ধে হওয়ার আগেই বাড়ি ফিরে আসে নাগেশ্বর। রাত আটটার মধ্যেই স্ত্রীর পাশে না শুলে তার খুব মন খারাপ লাগে। শুয়ে-শুয়ে অফিসের বাঙালিদের গল্প বলে সে। মনেপ্রাণে বাঙালিদের অনেক কিছু সে অনুসরণ করতে চায়। ভাঙা বাংলা বলে। কিন্তু মেয়েদের স্বাধীনভাবে ঘোরাফেরা মানতে পারে না। স্ত্রীকে সে অফিসের মেয়েছেলেদের নানান কেচ্ছার কথা শোনায়। আর স্ত্রীর কাছে এ বাড়ির মেয়েদের গল্প শোনে। দু-একজন যাদের সে ভালো করে কখনও দ্যাখেনি, একটু-আধটু ফস্টিনস্টি করার বাতিক আছে। নাগেশ্বর বউকে সতর্ক করে দেয়, ভুলেও যেন তাদের সঙ্গে কথা না বলে।

এখন সেই ঘরে একা শুয়ে-শুয়ে নাগেশ্বরের বড় কষ্ট হল। সকালে ঘুম থেকে উঠে ভাতে-ভাত রান্না করে অফিসে যেতে হয়। হোটেলে খেলে খরচ বাড়বে বলে সন্ধেবেলায় আবার স্টোভ। ধরাতে হয়। এ বাড়ির লোকজনের সঙ্গে বেশি কথাবার্তা নেই তার। কিন্তু অফিসে সে নিশ্চিত। বাঙালিদের মন খুব উদার হয়। বউ থাকলেও বেশ্যাদের গল্প বেশ সহজেই করে ওরা।

সেদিন সকালে সে ভাত খেতে বসেছে এমন সময় একটা বাচ্চা হাতে বাটি নিয়ে এসে দাঁড়াল। বিস্মিত নাগেশ্বর শুধোল, কী চাই?

এমন সময় পেছন থেকে আর একটি গলা ভেসে এল, রোজ-রোজ হাত পুড়িয়ে খান, তাই একটু সবজি দিলাম।

নাগেশ্বর আঁতকে উঠল, না, না, আমার কিছু লাগবে না।

একি কথা! দিদি থাকলে কি এত কষ্ট করতে হত।

একথা শোনার পর না নিয়ে পারেনি নাগেশ্বর। খেয়ে দেখল তার স্ত্রীর চেয়ে অনেক ভালো রান্না। বাচ্চাটি দাঁড়িয়েছিল, এঁটো বাটি ধুয়ে তাতে কিছু বাতাসা দিয়ে ফেরত দিল নাগেশ্বর।

স্ত্রীলোকেরা কখনওই অন্য স্ত্রীলোককে সুখী দেখতে পারে না। নাগেশ্বরের স্ত্রী চলে যাওয়ার পর এই বাড়ির স্ত্রীলোকরা যেন স্বস্তি পেল। তাদের মনে হল নাগেশ্বরের এখন খুব কষ্ট হচ্ছে। শরীরের গড়ন হালকা হওয়ায় তাকে খুবই তরুণ দেখায়। অল্পবয়সি স্ত্রীহীন যুবকের প্রতি স্ত্রীলোকদের এক ধরনের মমতা জন্মায়। ক্রমশ অন্যান্য ঘর থেকে খাবার আসতে লাগল নাগেশ্বরের কাছে। নাগেশ্বর প্রথমে বিব্রত হলেও শেষ পর্যন্ত বেশ উপভোগ করতে লাগল। এত অন্তঃপুরবাসিনীদের সে চোখে দেখে না কিন্তু প্রতি মুহূর্তে তাদের নরম স্পর্শ অনুভব করে। উনুনে আগুন দিলে ধোঁয়া আকাশে ছড়াবেই। বাড়ির তিন-চারজন পুরুষ ওর সঙ্গে হেসে কথা বলতে শুরু করল। তারা নাগেশ্বরের ঘরে এসে বসতে লাগল। নাগেশ্বরের ট্রাঞ্জিস্টার রেডিও তাদের প্রধান আকর্ষণ। আড়ালে আবডালে তারা নাগেশ্বরের কাছে দু-পাঁচ টাকা কর্জ করা শুরু করে দিল। নাগেশ্বর ওই সামান্য অর্থ তাদের দিতে পেরে যেন বেঁচে গেল। বিনাপয়সায় প্রতিদিন খাবার খেতে তার মন স্বস্তি পেত না তাই ঋণ দিয়ে কখনওই তাগাদা করেনি সে। ফলে ভাড়াটাদের একাংশের মধ্যে তার খাতির বেড়ে গেল খুব।

স্নেহপ্রদর্শনের কালেও স্ত্রীলোকেরা কোনও প্রতিদ্বন্দ্বিতা সহ্য করতে পারে না। নাগেশ্বর প্রত্যেক রান্নাই ভালো বলে, কোনও রমণীর মুখের দিকে তাকায় না। এতে তাদের মন ভরে না। প্রত্যেকেই চায় তার ভূমিকা অধিকতর উজ্জ্বল হোক। ফলে দু-একজন একটু-একটু করে সাহসী হল। তারা অনেক সন্তানের জননী হলেও কঠিন পরদাপ্রথায় বিশ্বাসী। কিন্তু এখন নাগেশ্বরকে। অসহায় তরুণ বলে ভাবতে কারও কষ্ট হল না। কথাবার্তা এতকাল কোনও শিশুর মাধ্যমে চলত, এখন সেই দু-একজনের সঙ্গে সরাসরি হয়। তারা ভগ্নীস্নেহ প্রকাশ করে। এতে নাগেশ্বর কৃতার্থ হয় এবং সেই রমণীরা অন্যান্যদের চেয়ে নিজেদের অধিকতর মূল্যবান মনে করতে থাকে। বোঝা যায়, নাগেশ্বরের সঙ্গে এই মেলামেশার জন্যে তাদের স্বামীরা কোনওরকম বিরাগ পোষণ করে না।

সেদিন সন্ধের একটু আগে ঘরে ফিরেছিল নাগেশ্বর। বাইরের ঘরে পাণ্ডেজিদের আসর জমজমাট। আগামীকাল মোহনবাগানের খেলা, কথাবার্তার বিষয় সেটাই। নাগেশ্বরকে দেখে পাণ্ডেজি বললেন, আইয়ে মাহাতোজি, আপনি তো এ ঘরে আসেনইনা। কি যে অপরাধ করেছি আমরা!

নাগেশ্বর দু-হাত জোড় করে বলল, নমস্তে। ছি ছি, একথা বলছেন কেন! আসলে আপনাদের বিব্রত করতে চাই না।

পাণ্ডেজি বললেন, একি কথা! আপনার মতো শরিফ আদমি এলে আমরা বিব্রত হব? এ বাড়ির সব মেয়েপুরুষ যখন আপনাকে আত্মীয় করে নিয়েছে। কথাটা শেষ না করে হাসলেন পাণ্ডেজি। নাগেশ্বর দেখল উপস্থিত অন্যান্যদের মুখ বেশ গম্ভীর। ওইসব পুরুষরা তার ঘরে যাতায়াত করে না। নাগেশ্বর বসল।

পাণ্ডেজি বললেন, আমি খুব প্রবলেমে পড়েছি, আপনাদের সাহায্য দরকার। কর্পোরেশন বাড়ির ট্যাক্স বাড়িয়েছে, ইলেকট্রিক কোম্পানিও চার্জ ডাবল করেছে। এই অবস্থায় আমার খুব অসুবিধা। হচ্ছে। আমি নিজে আপনাদের বাড়িভাড়া বাড়াতে পারতাম কিন্তু তা করব না। কারণ আমি ডেমোক্রেসিতে বিশ্বাস করি। আপনারাই নিজেরা ঠিক করে দিন কত ভাড়া বেশি দিতে পারবেন যাতে আমার ওপর চাপ না পড়ে। আপনি বি. এ. পাশ শিক্ষিত লোক, এখানে আছেন, আমাদের গর্ব, আপনি সবার সঙ্গে কথা বলুন।

নাগেশ্বর বলল, আপনি খুব সহৃদয় মানুষ। কিন্তু এ ব্যাপারে আমি আর কি বলব। আমি কী পাশ করেছি তা এক্ষেত্রে বড় কথা নয়, আমি এনাদের মতো একজন ভাড়াটে মাত্র, এটাই আমার পরিচয়। তাই সবাই যা ঠিক করবে তাই আমি মানব।

পাণ্ডেজি মাথা নাড়লেন, খুব ভালো, খুব ভালো। তা স্ত্রী না থাকায় আপনার কোনও অসুবিধে হচ্ছে না তো?

নাগেশ্বর মাথা নাড়ল, একা লোকের আর অসুবিধে কি! তারপর সে উঠে বেরিয়ে আসতে গিয়ে ঘুরে দাঁড়াল, আপনারা কি কালকের খেলা দেখতে চান?

পাণ্ডেজি বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, জরুর! কিন্তু–?

নাগেশ্বর সেদিন অফিসে উপরি হিসেবে পাওনা একটা টিকিট পকেট থেকে বের করে পাণ্ডেজির সামনে রেখে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। এরকম মহার্ঘ্য টিকিট যে এককথায় কেউ বের করে দিতে পারে এটা কল্পনার বাইরে। এ বাড়ির অনেকে টিকিটটাই প্রথমে চোখে দেখল। পাণ্ডেজি হাসলেন। চাপ দিলে পাথর থেকেও জল বের হয়, তা নাগেশ্বর তো ছেলেমানুষ!

ইদানীংকলঘরে যাওয়ার সময় দু-একটি রমণীর সঙ্গে চোখাচোখি হয়। তারা ঠোঁট টিপে হাসে। এই হাসি দেখে নাগেশ্বর রোমাঞ্চিত হয়। কিন্তু ঘরে ফিরে এসেই সে সতর্ক করে নিজেকে। যে রমণী পরপুরুষের দিকে অমন ভঙ্গিতে হাসতে পারে সে চরিত্রহীনা–তার প্রতি কোনওরকম আকর্ষণ বোধ করা মানে নিজের স্ত্রীকে অপমান করা। একথা ভাবতেই নিজের স্ত্রীর জন্যে তার। খুব মন কেমন করতে লাগল। এই ভরযৌবনে স্ত্রীহীন হয়ে রাত কাটানো বড়ই কষ্টকর। যদিও মেয়ের বিয়ে দেওয়ার পর তার ছাব্বিশ বছরের স্ত্রী আবেদন করেছে যাতে কোনও কারণেই সে যেন পুনরায় গর্ভবতী না হয় সে দায়িত্ব নাগেশ্বরকে নিতে হবে। তাহলে একুশ বছরের জামাই এর সামনে মুখ দেখাতে পারবে না সে। নাগেশ্বর ভেবেছিল বলবে, তাদের সংসারে শাশুড়ি কখনই জামাই-এর সামনে দাঁড়ায় না, অতএব মুখ দেখানোর সমস্যাই নেই। কিন্তু লজ্জাবোধ হওয়ায় সেকথা বলেনি সে।

ঘরে মৃদু শব্দ হল। নাগেশ্বর খাটে শুয়ে ছিল, চোখ মেলে দেখল খাবারের বাটি নিয়ে একজন। ঢুকছে। সে দ্রুত উঠে বসতেই রমণীটি ঘোমটা সরিয়ে হাসল। একে আগেও দেখেছে নাগেশ্বর। অন্তত চল্লিশ বছর বয়স এবং সন্তানহীনা। বোধহয় সেই কারণেই শরীর অটুট। রমণীটি ঠোঁটে আঙুল দিয়ে তাকে নীরব থাকতে বলল। তারপর ঘরের দরজা ছেড়ে কয়েক পা এগিয়ে এসে অত্যন্ত নিম্নস্বরে বলল, কাল রাত্রে আমার স্বামী থাকবে না। আমার যাতে ছেলে হয় সেইজন্য তারকেশ্বরে জল দিতে যাবে। ওসবে কিছু হয় না আমি জানি। কিন্তু সে জানুক ওতেই কাজ হল।

নাগেশ্বর অত্যন্ত সঙ্কুচিত হয়ে বলল, কিন্তু আমি কী করব?

রমণী চোখে বিদ্যুতের চমক এনে বলল, ঢং, জানেন না যেন! নাকি আমাকে পছন্দ হচ্ছে না? আপনার বউ চলে যাওয়ার পর থেকেই এই ফন্দিটা আমি এঁটেছি। কাল রাত্রে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে আমি আসব। দরজাটা খোলা রাখবেন। যেমন এসেছিল তেমন নিঃশব্দে চলে গেল সে।

বজ্রাহতের মতো বসে থাকল নাগেশ্বর। একি কথা শুনল সে! এই রমণীকে এই কদিন সে অত্যন্ত স্নেহপ্রবণা বয়স্কা দিদির মতো দেখেছে। এত কঠোর পদাপ্রথার মধ্যে বাস করেও এইরকম কামনা কেউ পোষণ করে বিন্দুমাত্র না জানতে দিয়ে! সে তো বয়সে অনেক ছোট। মহাভারতে নাকি এমন ঘটনার কথা আছে। শ্রীকৃষ্ণ বলেছিলেন রমণীরা শক্ত খোলের আড়ালে নিজেকে। চিরকাল ঢেকে রাখতে পারে, কিন্তু একমুহূর্তেই সেই আড়াল খুলে দিতে দ্বিধা করে না। তবে মুশকিল হল, সেই মুহূর্ত কখন আসবে তা তারা নিজেরাও জানে না। এই ঘটনাই তার চিরসত্যতা প্রমাণ করে। এই ব্রাহ্মণপত্নী তাকে কী পাপে নিয়ে যাচ্ছে! নাগেশ্বরের মাথা খারাপ হয়ে গেল। এই ঘটনার কথা যদি কেউ জানতে পারে তাহলে আর দেখতে হবে না। কিন্তু অধিক রাতে ওই নিঃসন্তান রমণীর কথা চিন্তা করতে-করতে একটি গোপন ঢেউ তাকে প্লাবিত করল। একটি সুঠাম শরীর চোখের সামনে থেকে সমস্ত পৃথিবীকে আড়াল করে দিচ্ছিল।

পরের দিন অফিসে কোনও কাজে মন দিতে পারছিল না নাগেশ্বর। বিকেল হতে না হতেই তাকে চুম্বকের মতো বাড়িটা টানছিল। সে অবশশরীরে যখন ঘরে ফিরল তখন পাণ্ডেজির মজলিশ সরগরম। হয়তো খেলার জন্যই এই অবস্থা। কিন্তু তাকে দেখামাত্রই সমস্ত কথাবার্তা নিঃশব্দ হয়ে গেল। নাগেশ্বর দেখল সবকটি চোখ তার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছে এবং মুখের অভিব্যক্তি অত্যন্ত কঠোর। ধক করে উঠল বুক। আজকের খবর কি এরা কোনওভাবে জেনে গেছে! হিমবুক নিয়ে সে দেঁতো হাসল, নমস্তে পাণ্ডেজি। আপনি খেলা দেখতে যাননি?

পাণ্ডেজি মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। কেউ কথা বলছেনা। এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে নাগেশ্বর ভেতরে যাওয়ার জন্য বারোয়ারি পাপপাসে পা মুছতে যেতেই একজন চিৎকার করে উঠল, খবরদার, ওতে তুমি পা দেবে না।

এবার আর একটা শীতল স্রোত নাগেশ্বরের দিকে ধেয়ে এল। সে লোকটির দিকে তাকাতে পাণ্ডেজি উঠে ওর সামনে এল। নাগেশ্বর কোনওমতে জিজ্ঞাসা করল, কী ব্যাপার?

পাণ্ডেজি বললেন, তোমার জামাই-এর বাপ এসেছিল দুপুরে।

নাগেশ্বর থতমত হল, বেয়াই আসবে সে তো জানে না!

পাণ্ডেজি আবার বললেন, তাঁর কাছে তোমাদের সব খবর পেলাম!

নাগেশ্বর বলল, কী খবর?

পাণ্ডেজি বললেন, তোমরা নিচু জাত।

সে গম্ভীর গলায় জিজ্ঞাসা করল, আপনি আমাকে কী বলতে চাইছেন?

পাণ্ডেজি বললেন, আমি ডেমোক্রেসিতে বিশ্বাস করি। সবাই যা বলবে আমি তাই করব। আগামীকাল সকালে মিটিং আছে, তুমি উপস্থিত থাকবে। এ বিষয়ে সবাই আলোচনা করবে।

নাগেশ্বর বলল, ওসব আপনার ব্যাপার। আমি নিয়মিত ভাড়া দিই, কারও সাতেপাঁচে থাকি না। আমি যেমন আছি তেমনি থাকব।

পাপোস না ছুঁয়ে নিজের ঘরে চলে এল। আসবার সময় সে লক্ষ করল পথের পাশে কেউ নেই। এমনকী বাচ্চাগুলোও সামনে আসছে না। মুখহাত ধুতে কলঘরে যেতে দেখল সবাই আড়ালে। সরে যাচ্ছে। এই সময় একটা বুড়ি কাকস্বরে চিৎকার জুড়ে দিল, এই জল আমি খাব কী করে!

কেউ একজন বলল, আস্তে বলল, ও শুনতে পাবে।

শুনুক। বুড়ির গলা তীব্রতম হল, খুব নেচেছিলি তোেরা। খুব সবজি খাওয়াতিস। হায়-হায়!

কোনওরকমে ঘরে ফিরে এসে ঝিম মেরে গেল নাগেশ্বর। একদিনের মধ্যেই সে এদের কাছে অন্ত্যজ হয়ে গেল। কী করবে ভেবে পাচ্ছিল না সে। অফিসের বাঙালিরা এ কথা শুনলে কিছুতেই বিশ্বাস করবে না। কিন্তু ক্রমশ ভয় করতে লাগল তার। আজ কেউ সবজির বাটি দিয়ে গেল না। বাইরে পুরুষরা উত্তেজিত গলায় তর্ক করছে। বিষয়টা যে সে-ই তা বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না। মেয়েমহল একদম নিঃসাড়। সমস্তিপুরে এরকম অভিজ্ঞতা হয়নি নাগেশ্বরের। ছাপরার দিকে এ ব্যাপারটা খুব জোরাল তবে উত্তরপ্রদেশের মতোনয়। খাওয়ার ইচ্ছাটাই চলে গেল, স্টোভ ধরাল না নাগেশ্বর। বিছানায় শুয়ে-শুয়ে ভাবতে লাগল ওরা কী করতে পারে। নিশ্চয়ই তাকে মারধোর করার সাহস পাবে না ওরা। তা না হলে সে এই বাড়ি কিছুতেই ছাড়বে না। ওর প্রতি এমনিতেই সবাই ঈর্ষান্বিত ভালো চাকরি করে বলেই, এটি অতিরিক্ত। সে ভাড়া দিচ্ছে মাথা উঁচু করে থাকবে। এখন কলকাতা শহরে এত অল্প পয়সায় বাড়িভাড়া মাথা খুঁড়লেও পাওয়া যাবে না। তাই ছেড়ে যাওয়ার কথাই ওঠে না।

আজকের রাতটার কথা মন থেকে উধাও হয়ে গিয়েছিল পাণ্ডেজির সঙ্গে কথা বলার পর থেকেই। এখন খেয়াল হতে সে নিশ্চিত হল। ভেজানো দরজার দিকে তাকিয়ে সে নিজেকে বলল, না, কোনও চান্স নেই। কেউ এ ঘরে আসবে না।

কিন্তু অনেক রাত্রে যখন দরজাটা খুলেই চট করে বন্ধ হয়ে গেল তখন চমকে উঠল সে। রমণীটি ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে। আলো নেভা থাকলেও জানলা দিয়ে ঈষৎ ঔজ্জ্বল্য ঘরে আসায় সে। রমণীটিকে অস্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। খুব মৃদুস্বরে রমণীটি বলল, জেগে আছেন আপনি?

নাগেশ্বরের গলা শুকিয়ে কাঠ। সে ঘাড় নাড়ল।

রমণীটি বলল, সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। আমাকে তাড়াতাড়ি ফিরে যেতে হবে। বলে হাসল।

নাগেশ্বর কোনওরকমে বলল, আপনি চলে যান।

কেন?

আমি পারব না।

কেন?

আমি, আমি নিচু জাতের লোক, শোনেননি?

শুনেছি। কিন্তু আপনি পুরুষমানুষ। আপনার সন্তান আছে।

আমাকে ঘেন্না হচ্ছে না? আপনি ব্রাহ্মণের বউ!

ভগবান তো এইজন্যে রাত দিয়েছেন। রাতে সব ঢেকে রাখা যায়।

আপনি ক্ষমা করুন।

না, আমি যখন একবার লজ্জা বিসর্জন দিয়েছি তখন ফললাভ করবই। তবে আপনি এখান থেকে কালই চলে যান। ওরা আপনার ক্ষতি করবেই। সেটা আমার লাভ। দিনের বেলায়। আপনাকে দেখতে হবে না।

রমণীটি তার খাটের দিকে এগিয়ে আসতেই নাগেশ্বর বলে উঠল, আপনি চলে যান। আপনি ভ্ৰষ্টা, দ্বিচারিণী।

রমণীটি যেন বেত্রাঘাত পেল। তার ঠোঁট স্ফীত হয়ে বেঁকে উঠল একবার, চোখ জ্বলছে। দ্রুত নিশ্বাসের তালে বুকের উত্থান-পতন সমুদ্রকে হার মানায়। কিন্তু সেটা কয়েক পলক মাত্র। নাগেশ্বর দেখল সে যেমন এসেছিল তেমনি চলে গেল নিঃশব্দে।

তারপর সব চুপচাপ। নাগেশ্বরের রক্তচলাচল ঈষৎ শান্ত হলে সে দরজায় খিল দিয়ে বিছানায় ফিরে এল। রমণীটির দু:সাহস এবং স্পর্ধায় সে স্তম্ভিত হয়ে পড়েছিল। তার জাতের কথা জানার

পরও প্রস্তাবের কোনও হেরফের হল না কেন? এ অবস্থায় ধরা পড়লে রমণীটির তো মারাত্মক ক্ষতি হত তবু এত বড় ঝুঁকি নিতে সাহসী হল? নাগেশ্বর নিজের দিকটা ভাবতে লাগল। কেন সে দরজাটা ভালো করে বন্ধ রাখেনি? এত ঘটনার পরেও কি সে গোপনে রমণীটির জন্যে অপেক্ষা করছিল? তাহলে এখন গ্রহণ করতে পারল না কেন? এই রকম হাজার চিন্তা মাথায় পাক খেলে কারও ঘুম আসে না। ওরা নাগেশ্বরের ক্ষতি করবে। কী ক্ষতি!

ঠিক এইসময় বাড়ি কেঁপে উঠল তীক্ষ্ণ চিৎকারে। যারা নিদ্রিত ছিল তাদের অনুভূতি সেই শব্দের প্রতিঘাতে ছিন্ন হল। সতেরো ঘরের বাসিন্দারা চিল্কারের কারণ সন্ধানে সশব্দে দরজা খুলতে। লাগল। চমকে উঠেছিল নাগেশ্বরও। সে দ্রুত দরজা খুলতে যেতেই রমণী-কণ্ঠস্বর ডুকরে উঠল, হায় ভগবান, এ কিয়া হো গয়া।

নাগেশ্বরের কণ্ঠস্বরটি পরিচিত বোধ হওয়াতে কানখাড়া করে ঘরের মধ্যেই দাঁড়িয়ে থাকল। সতেরো বাসিন্দা একসঙ্গে প্রশ্ন করছে, কী হয়েছে? চিৎকার এবং কান্নার কারণ কী? রমণীটি প্রথমে নিজের স্বামীকে দায়ী করল তার ভাগ্যের জন্যে। কি দরকার ছিল এই বয়সে সন্তানের আশায় তারকেশ্বরে যাওয়ার? সে যদি ঘরে থাকত তাহলে কি ওই লোকটা এই সাহস পেত?

এতক্ষণে দিনের মতো পরিষ্কার হয়ে গেছে নাগেশ্বরের কাছে। তার সমস্ত শরীর কাঁপতে লাগল। মহাভারতে আছে, প্রত্যাখ্যাতা স্ত্রীলোক সাপের চেয়ে হিংস্র হয়। এখন কী হবে!

পুতিগন্ধের ইঙ্গিত পাওয়ামাত্র যেমন শকুনেরা ডানায় জোর পায় তেমনি সতেরো বাসিন্দারা নানাবিধ প্রশ্নে সত্য জেনে নিল। এই একটু আগে রমণীটি কলঘরে যাওয়ার জন্যে বেরিয়েছিল, এমন সময় কেউ তার হাত ধরে টানে। ভয় পেয়ে চিৎকার করতেই লোকটি যখন তাকে ছেড়ে। ছুটে যায় তখন সে চিনতে পারে। এতদিন সে যাকে নিজের ভাই-এর মতো দেখে এসেছে সেই লোকটা তার ইজ্জত নেওয়ার জন্যে হাত বাড়িয়েছিল। এখন মনে হচ্ছে গঙ্গা মাইয়ার বুকে গিয়ে শুয়ে থাকলে তবেই এ অপমানের জ্বালা দূর হবে। পাগলের মতো করছিল রমণীটি। অন্যান্য রমণীরা তাকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিচ্ছিল। উত্তেজিত পুরুষকণ্ঠ তখন পাণ্ডেজিকে খুঁজছে।

একটু পরেই পাণ্ডেজির গলা পাওয়া গেল। তাঁকে অনেকে মিলে ব্যাপারটা বোঝাবার চেষ্টা করতেই তিনি বললেন, কে সে নরাধম, এই বাড়ির কেউ কি যে পরস্ত্রীর শরীরে হাত দেওয়ার হিম্মত রাখে?

পুরুষরা আবার রমণীটির শরণাপন্ন হল। সে তখনও ডুকরে-ডুকরে কাঁদছে। সেই অবস্থাতে জানাল, ওর চোখের নজর আমার খারাপ লাগত। কিন্তু ভাবতাম আমার ভাইয়ের মতন। অন্য। সবাই যেমন সবজি তৈরি করে ওকে দিত আমিও দিতাম। ওর বউটা তো ভারি সুন্দর ছিল। কিন্তু আজ দুপুরে যখন শুনলাম–তখন থেকে বুক জ্বলে যাচ্ছিল। মাঝরাতেও মনে হচ্ছিল আমি ভাই। বলছি আর সে নিজের পরিচয় লুকিয়ে আমাদের ঠকিয়েছে? অমনি তাই মনে হল স্নান করলে পবিত্র হব। তা যেই ঘর থেকে বেরিয়েছি অমনি যে সে খপ করে হাত ধরবে তা কে জানত!

সমুদ্রগর্জনকেও এই শব্দ হার মানায়। মারো শালাকে, কেটে ফেলো, ঘর জ্বালিয়ে দাও–ইত্যাদি বাক্য বাঁশ ফাটার মতো বাজতে আরম্ভ করল। পাথর হয়ে দাঁড়িয়েছিল নাগেশ্বর। হে ভগবান, একী করলে! মেয়েছেলেটা এতবড় মিথ্যে বলছে? সে দ্রুত দরজার ছিটকিনিটাও বন্ধ করে। জানালার পাল্লাও আটকে দিল। ওরা কি দরজা ভেঙে ঢুকবে? না, সেটা সহজ নয়। তার চেয়ে সে যদি এখনই বেরিয়ে চ্যালেঞ্জ করে মেয়েটিকে? সব কথা ফাঁস করে দেয়? তবে? সঙ্গে-সঙ্গে ওর। মন বলল, কেউ বিশ্বাস করবে না। ওরা বিশ্বাস না করার জন্যে মুখিয়ে আছে। তাহলে?

দ্রুত পায়ের আওয়াজ তার বারান্দায় উঠে আসা মাত্র পাণ্ডেজির গলা শুনতে পাওয়া গেল, এ্যাই হুঁশিয়ার, কেউ দরজায় হাত দেবে না। ওটা আমার দরজা।

লোকগুলো বলল একসঙ্গে, কিন্তু ও শালাকে এখনই ছিঁড়ে ফেলতে হবে, শাস্তি দিতে হবে।

পাণ্ডেজি বললেন, এটা তো আমারও লজ্জা। কিন্তু আমি ডেমোক্রেসিতে বিশ্বাস করি। হুট করে কিছু করলে পরে আপশোস হয়। প্রথমে ঠিক হোক, নাগেশ্বর শিউশরণের জেনানার গায়ে হাত দিয়েছিল কিনা। কোনও প্রমাণ আছে।

ঘরের মধ্যে ইঁদুরের বুক নিয়ে দাঁড়ানো নাগেশ্বরের মনে হল পাণ্ডেজির মতো মানুষকে চেনা যায় না প্রথমে। সে মনে-মনে পাণ্ডেজির পায়ে লুটিয়ে পড়ল। একজন বলল, এতরাত্রে কে দেখবে? শিউশরণের বউ যখন বলছে তখন সত্যিকথাই বলছে। কোনও মেয়েছেলে ফালতু নিজের বদনাম দেবে না!

পাণ্ডেজি বললেন, জরুর। তবে কিনা একটু প্রমাণ চাই। আমি বলি কি, শিউশরণের বউ যদি তার স্বামী-অ, স্বামী তো এখন তারকেশ্বরে, তাহলে স্বামীর জামা ছুঁয়ে হলফ করে বলুক যে সে। যা বলছে সত্য। স্ত্রীলোকের সব চেয়ে বড় হল স্বামী, এ কথা মনে রেখে সে যেন কথা বলে।

হই-চই পড়ে গেল শিউশরণের জামা আনবার জন্য। সবাই এখন চুপচাপ। তারপরেই কান্নাজড়ানো গলা শোনা গেল, যা বলেছি সব সত্যি।

সঙ্গে-সঙ্গে গর্জনটা দ্বিগুণ হল। তারপরেই পাণ্ডেজির গলা সবাইকে ছাপিয়ে উঠল, আপনারা কী চান? এই লোকটা এখানে থাকুক না চলে যাক!

ওর খুন চাই ওকে মেরে ফেলো, ইত্যাদি চিৎকার উঠল।

পাণ্ডেজি বললেন, না, তা হয় না। আমার বাড়িতে খুন হোক এটা আমি চাই না। পুলিশ তোমাদের ছেড়ে দেবে না। তার চেয়ে ওকে চলে যেতে বলাই ভালো।

নাগেশ্বর দরজায় প্রথম আঘাত শুনল, নাগেশ্বরজি, দরজা খোল। গলা শুকিয়ে গিয়েছিল নাগেশ্বরের। বাইরে উত্তেজিত সংলাপ চলছে। পাণ্ডেজির প্রস্তাব কেউ মানতে পারছে না। সাড়া দিল নানাগেশ্বর। কয়েকবার ডাকাডাকির পর পাণ্ডেজি উত্তেজিত হলেন, আরে নাগেশ্বরজি, তুমি সাড়া দিচ্ছ না কেন? আমরা তো সবাই জানি তুমি ঘরেই আছ!

এবার প্রাণপণে চিৎকার করল নাগেশ্বর, ও যা বলছে সব মিথ্যে কথা। আমি সন্ধে থেকে ঘরের বাইরেই যাইনি।

পাণ্ডেজি বললেন, তাহলে তুমি এত ভয় পাচ্ছ কেন? বাইরে বেরিয়ে এসো।

ঠিক সেই সময় একটা লাঠি জানালার খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকে আসতেই নাগেশ্বর তড়াক করে লাফিয়ে সরে গেল। অবিরাম দরজায় শব্দ হচ্ছে, মচমচ করছে পাল্লা। যে কোনও মুহূর্তেই ভেঙে পড়তে পারে সেটা। তার ঘরের চারপাশে উত্তেজিত শব্দ পাক খাচ্ছে।

নাগেশ্বরের সমস্ত শরীর এখন ঘামে জবজবে। ফাঁদে পড়া জন্তুর মতো তার শরীর কুঁকড়ে ঘরের মধ্যে আশ্রয় খুঁজছে। কিন্তু সে অনুভব করছিল এই দরজা বা জানলা মোটেই নিরাপদ নয়।

বাড়ির বাইরে যে কলকাতা শহর সেটা একদম আলাদা। সেখানে কেউ জাত নিয়ে মাথা ঘামায় না। যদি একবার সেখানে পৌঁছে যাওয়া যায়, তাহলে

নাগেশ্বর উঠে দাঁড়াল। পা টিপেটিপে দরজার কাছে গিয়ে কান পাতল। নানারকম শলাপরামর্শ চলছে বাইরে। সে নিঃশব্দে ছিটকিনি এবং খিল সরাল। তারপর আচমকা দরজা খুলে তিরের মতো বেরিয়ে এল ঘর থেকে।

সবাই কিছু বুঝে ওঠার আগেই নাগেশ্বর সদর দরজার কাছে পৌঁছে গেছে। সঙ্গে-সঙ্গে হই-চই উঠল, ভাগতা হ্যায়, ভাগতা হ্যায়!সেই গভীর রাতে একদল মানুষ অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে লাঠিসোটা হাতে কলকাতার রাজপথে ছুটে যাচ্ছিল শিকারে। যে শিকার সে তখন উন্মত্তের মতো দৌড়ে যাচ্ছে সম্মুখে। ওদের মধ্যে দূরত্ব ক্রমশ কমে আসছিল। যেহেতু কলকাতা সারারাত জাগ্রত থাকে তাই পথের বাসিন্দারাও এই উত্তেজনায় অংশ নিল। এই মানুষ-শিকার পর্ব শেষ পর্যন্ত কারণ পালটাতে-পালটাতে একটা সাদাসাপটা চেহারা নিয়ে ফেলল। নাগেশ্বর জানত না উত্তরপ্রদেশ কিংবা ভারতবর্ষের যে কোনও জায়গার সঙ্গে কলকাতার তফাত এখানেই। নগ্নতা ঢেকে একটা মানানসই পোশাক চাপালে লোকে অন্ধ হয়ে থাকতে ভালোবাসে এখানে, যুক্তির প্রয়োজন হয় না। পাণ্ডেজি সেকথা। জানতেন। সমস্যাটাকে ঘরের বাইরে দিয়ে তাই তিনি নিশ্চিন্ত।

<

Samaresh Majumdar ।। সমরেশ মজুমদার