রাজার মতো যাওয়া

আজকাল রাত না ফুরোতেই ঘুম ভেঙে যায়। আসলে ঘুম বলা ঠিক উচিত নয়, ঘুমের একটা ঘোর গোছের ব্যাপার শুরু হয় একটা নাগাদ। তারই চটকা ভেঙে যায় অন্ধকার কাটতে-না কাটতেই। তারপর বিছানায় শুয়ে ছটফট করা আর জানলা দিয়ে আকাশ দেখা। ভোরের আকাশ দেখা একটা দারুণ ব্যাপার। এটা এক ধরনের নেশা হয়ে গেছে অবনীর। নীল বেনারসি শাড়ির মতো আকাশটা, জমজমে আকাশটা ক্রমশ উদাস-উদাস হয়ে যায়। জ্বলে যাওয়া শাড়ির রঙের মতো নেতিয়ে থাকে। যে তারাগুলো এতক্ষণ মাত করে রেখেছিল দাপটে, সেগুলোকে চোরের মতন মনে হয়। তারপর একসময় ফুটো বেলুনের মতন রাতটা চুপসে যায়। ভোরের টাটকা বাতাস আর মেয়েদের, অল্পবয়সি কোনও মেয়ের, হাতের ছোঁয়ার মতো ভোরের রোদ্দুর পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। অবনী চুপচাপ দ্যাখে। এপাশের জানলায় আকাশ আর পাশ ফিরলেই। সুনীপা, একদম ঘুমে কাদা হয়ে সাত বছরের বাচ্চার মতো গুটিসুটি মেরে শুয়ে থাকা সুনীপা।

বিছানার ওপর উঠে বসে অবনীভূষণ ঘরের চারপাশে চোখ বোলাল। সারারাত একটা জিরো পাওয়ারের নীলচে আলো জ্বেলে রাখে সুনীপা। অন্ধকারে থাকতে খুব ভয় ওর। যদিও এখন রাত নেই তবু এই আলোটা সারা ঘরে দুধের সরের মতো জড়িয়ে আছে। অবনীভূষণ মাথার কাছে রাখা মাঝারি টেবিল ভরতি ওষুধগুলো দেখল। এগুলো কি হবে? সব তো শেষ হবে না। এত দামি-দামি ওষুধ সব!

ভোরবেলায় এ সময়টায় ওর রোজই সুনীপার জন্যে কষ্ট হয়। এই সময় দেওয়ালে আলোর নিচে টাঙানো তার আর সুনীপার ছবিটাকে বড্ড ঝকঝকে দেখায়। তিন বছর আগের তোলা ছবি। ম্যারেজ রেজিস্ট্রারের অফিস থেকে বেরিয়ে এক দোকানে ছবিটা তুলেছিল ওরা। বিয়াল্লিশ। বছরের অবনীভূষণ আর তার দুবছরের ছোট সুনীপা। একটু বেশি বয়স, তবু হয়ে গেল। না, প্রেম-ট্রেম করে নয়, কাগজে বিজ্ঞাপন দেখে যোগাযোগ। মন্ত্র পড়ে বিয়েতে দেখা গেল দুজনেরই আপত্তি। ছবিটার দিকে তাকাল অবনীভূষণ। কেমন ছিমছাম দেখাচ্ছে তাকে। সুনীপাকে অবশ্য একদম যুবতী-যুবতী দেখাচ্ছে। অবশ্যি শরীরটা ওর এখনও ভাঙেনি। কিন্তু অবনীর মুখ, চিবুক, গলা? অজান্তে হাত বোলাল ও, চটচট করল আঙুলের ডগা। রোজই হয়, কিন্তু তবু এই আঙুলের ডগার শিরশিরানিটা জানান দেয়, না হে, তোমার হয়ে আসছে। রোজই সকালে গলার, চিবুকের ব্যান্ডেজ পালটাও। কেমন গন্ধ বের হয় আজকাল ব্যান্ডেজ থেকে।

সুনীপার ঘুম ভাঙবার আগেই ও বাথরুমে চলে আসে। দরজা বন্ধ করে আলোটা জ্বেলে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। মুখ চোখ ফোলা-ফোলা। চিবুক ঢেকে যে ব্যান্ডেজটা মাথার ওপরে গিয়ে গিট খেয়েছে সেটার ওপর নজর রাখে অবনীভূষণ। চিবুকের তলায় গলার ওপরটা ভিজে গেছে। কালচে-কালচে দাগ। রক্ত বেরিয়েছে। ঠোঁট দুটো ব্যান্ডেজের চাপে বেঁকে ফুলে গিয়েছে। এবার হসপিটাল থেকে ফিরে যন্ত্রণাটা আর বাড়েনি। প্রথমবার রে নেওয়ার আগে ভুগিয়েছিল খুব। রে নেওয়ার পর মাসকয়েক মোটামুটি ভালোই ছিল সে। তারপর আবার যেতে হল। এবার। অপারেশন। কিন্তু এ অপারেশন আর শুকোল না। ডাক্তার রায় প্রায় স্পষ্ট গলায় বলেছিলেন, দেখুন, এখন শুধু বরাতের ব্যাপার।

অথচ এখন কাগজে মাঝে-মাঝেই বের হয়–পৃথিবীর এপাশে-ওপাশে কেউ-কেউ ক্যান্সার সারাচ্ছে। সুনীপার আগ্রহেদু-এক জায়গায় চিঠি দিয়েছিল; না, কোনও জবাব আসেনি। ডা: রায় ভালোই বলেন, বরাতের ব্যাপার। লটারির টাকা পাওয়ার মতন। কেউ-কেউ তো পেয়েও থাকে।

প্রথম-প্রথম অস্বস্তি হত, আজকাল হাত রপ্ত হয়ে গেছে। ব্যান্ডেজটা খুলে ফেলে নতুন ব্যান্ডেজ করে নিল অবনীভূষণ। পুরোনোটায় আজ যেন বেশি রক্তের দাগ। সপ্তাহে একদিন ড্রেসিং করার কথা। রোববারের সকালে।

চোখে জল দিয়ে বাইরে এল অবনীভূষণ। আজকাল আর দাঁত মাজার ব্যাপারই নেই। সে পাট চুকে গেছে অনেকদিন।

এখন বেশ রোদ উঠেছে। ছিমছাম পরিষ্কার রোদ। এরকম রোদের সকালে মনটা বেশ প্রফুল্ল থাকে। এমনিতে শরীরে আর কোনও অসুবিধে নেই। হাত-পা বেশ সচল। তবে কদিন থেকে শরীরটা কেমন ঝিমঝিম লাগছে, ডা:রায় যাকে উইকনেস বলেন। বেশিদূর হাঁটাচলা করতে একটু কষ্ট হয়। বাইরের ঘরে এল অবনীভূষণ। আসার সময় দেখল, সুনীপা উঠে পড়েছে।

খবরের কাগজটা হাতে নেওয়ার একটা উত্তেজনা আছে। নতুন ছাপার কালির গন্ধ বেশ লাগে। কত খবর হচ্ছে রোজ পৃথিবীতে; কালকের খবর আজ বাতিল; এইভাবেই চলতে থাকে।

অবনীভূষণ যখন থাকবে না, তখনও খবরের কাগজ ছাপা হবে, টাটকা-টাটকা খবর, কিন্তু অবনীভূষণ সেগুলো পড়তে পারবে না। অতদূর কি, কলকাতাটাই ভালো করে দেখা হল না। মধুসূদনের সমাধিটা দেখা হয়নি–সেই দাঁড়াও পথিকবর কবিতাটাই পড়েছে ছোটবেলা থেকে। বিড়লা প্লানেটোরিয়াম, ভিক্টোরিয়ার ভেতরটা–এসব দেখার সময়ই পাওয়া গেল না। না, একদিন সব দেখে নিতে হবে। নইলে কখন কি ফাঁকি হয়ে যায়–বুকের ভেতরটা কেমন করে।

সুনীপা এল চা নিয়ে। তেপায়া টেবিলে চা রেখে বলল, আজ কেমন আছ?

মাথা নাড়ল অবনী। যার মানে, এই আর কী! রোজ সকালে সূর্য ওঠার মতো নিয়ম করে এই প্রশ্ন জিগ্যেস করে সুনীপা। খারাপ নেই জানলে একটু নিশ্চিন্ত হয়। বোধহয় আর একটা দিন কেটে। যাওয়ার আশ্বাস পায়। তাই আজকাল শরীরের সামান্য কষ্ট হলে বলে না অবনীভূষণ। কেমন আছ কথাটা শুনতেও কেমন অস্বস্তি হয়।

বাজারের থলি নিয়ে দরজায় আসতেই রিকশা পেয়ে গেল সে। প্রথম-প্রথম সবাই আপত্তি করেছিল। সবাই বলতে বাবা আর ছোট ভাই সুনীপার সঙ্গে গলা মিলিয়েছিল। বাজার সে কোনওকালেই করত না, কিন্তু অপারেশনের পর একটা কেমন নেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে। শেষপর্যন্ত ওরা হাল ছেড়েছে, লোকটা একটা কিছু নিয়ে থাকুক–এইরকম ভাব আর কী।

রিকশাওয়ালা ওকে চেনে। ব্যান্ডেজবাঁধা বাবুকে বাজারে নেওয়ার ব্যাপারে ওর কিছু অভিজ্ঞতা আছে। বাবু এখন যাবে গলির শেষ বাড়িটায়। গিয়ে অবনীভূষণ হাঁকবে, গুপ্ত আছ নাকি?

গুপ্তগিন্নি দরজা খুলবেন, আসুন, ও দুধ আনতে গিয়েছে। অবনী জানে গুপ্ত এখন থাকবে না।

না, এখন যাব না, কই বাজারের ব্যাগটা দাও।

মুখ-চোখে কেমন একটা লজ্জার ব্যাপার দেখল অবনী। গুপ্তগিন্নিকে এবার ধমক দিল, ও, কী হল, দাঁড়িয়ে কেন? ব্যাগটা আনো?

ও বলছিল, রোজ-রোজ–। গুপ্তগিন্নি মিনমিনি গলায় বলতে চাইলেন।

তুমি কি চাও তার সঙ্গে কথা বন্ধ করব! আরে কদিনই বা আছি, একটু–। আর কথা শুনতে। দাঁড়িয়ে নেই গুপ্তগিন্নি। বাজারের ব্যাগটা এনে দিলেন তাড়াতাড়ি। হাত বাড়িয়ে সেটা নিয়ে বলল অবনী, কী মাছ আনব?

যা খুশি।

আঃ, তোমরা মনের কথা মুখে বলতে পারো না কেন? অফিসের সময় কুচো মাছ আনলে হাড়ে হাড়ে টের পাবে।

রিকশা ঘোরাতে বলল ও। তারপর আরও দুটো বাড়ির ব্যাগ আদায় করে বাজারে চলল অবনী। এই তিনটে সংসারের মোটামুটি খরচ জানা আছে তার। বিশেষ করে গুপ্ত লোকটাকে দেখে ওর অবাক লাগে। সব সময় হাসিখুশি, রাত এগারটায় যখন বাড়ি ফেরে তখনও রাস্তায় দাঁড়িয়ে। দোতলার জানলায় দাঁড়ানো অবনীর সঙ্গে বকবক করে যায় কিন্তু এত এনার্জি লোকটা পায়। কোত্থেকে? গুপ্ত মাইনে কত পায় অবনী জানে। মোটামুটি এই তিনটে পরিবারের অবস্থা ওর জানা। এই টাকায় ওরা কীভাবে বেঁচে থাকে–সবরকম হাসিখুশি নিয়ে, এটাই বুঝতে পারে না ও। দ্বিতীয়বার হাসপাতাল থেকে ফিরে এসে এইসব চিন্তা মাথায় জমছে ওর।

মোড়ের মাথায় গুপ্তর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। দুহাতে দুটো বোতল ঝুলিয়ে মুখে একটা চারমিনার চেপে আসছে গুপ্ত। বেঁটেখাটো কদমছাঁট চেহারা। এই শালা, এই তোমার সকাল হল! কেন, আর একটু আগে গতর তুলতে কি হয়? রিকশা দাঁড় করিয়ে খিঁচিয়ে উঠল অবনী।

দুটো বোতল এক করে মাথায় ঠেকাল গুপ্ত। চারমিনারটা ঠোঁটের কোণে সরিয়ে ফিক-ফিক করে হাসল। তারপর দুলে-দুলে বলল, সকাল কোনওদিন দেখিনি সাহেব, ওকে বলে ব্রাহ্মমুহূর্ত,পূণ্যাত্মাদের জন্য সংরক্ষিত।

অবনী আর দাঁড়াল না। গুপ্তর সঙ্গে কথা বলা যায় না। এত কথা ও পায় কোথায় কে জানে। সেল। ট্যাক্সের অফিসার অবনী, গুপ্ত ওকে সাহেব বলবেই। হোক না কেন রোববারের তাসের পার্টনার।

রিকশাওয়ালার সঙ্গে কথা বলে ওকে নিয়ে বাজারে ঢুকল ও। মোটামুটি একই জিনিস চারটে থলেতে কিনবে ও। এই সময়টা অদ্ভুত একটা উত্তেজনা মনে। এই দর করে বাজার করা।

কত? আলুর দোকানে দাঁড়াল অবনী।

বিশ বাবু।

বিশ? ইয়ার্কি? কাল এক দশে নিলাম। তোমরা পেয়েছটা কী বলো তো? এখনই এই অবস্থা, কয়েক মাস পরে দু-টাকা বলবে! টনটন করল ঠোঁটের কোণাটা। কথা বলতে অসুবিধে হয় ব্যান্ডেজের জন্য, কিন্তু এরকম হল কেন?

তা কি করব বাবু, বাজারের যা অবস্থা, দেখুন না সামনের বছর কী হয়। দোকানি পাল্লায় আলু চড়াল।

সামনের বছর কি হয়! অবনী একটু খতিয়ে গেল। সামনের বছর যদি আলুর দর পাঁচ টাকা হয় অবনী জানবে না। কিন্তু গুপ্তদের কী হবে? সর্বত্র এক অবস্থা। পটল বেগুন কি আদার দর দেখে মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। পটল বিক্রি করে যে ছোঁকরাটা তার কাছে এল ও। এর সঙ্গে কদিন আগে প্রায় হাতাহাতি হয়ে গিয়েছিল অবনীর। ব্যাটা পাকামো করে বলেছিল, দর করবেন না বাবু। যে কদিন আছেন খেয়ে যান। আজকে ইচ্ছে করেই দর জিজ্ঞাসা করল না সে। ছোঁকরা অবাক হল। যেতে বলল, একই দর বাবু, আপনার কাছে কম দাম নিলাম। বাজারে দেখুন দেড় টাকা কিলো। অবনী আজকাল হাসতে পারে না। ঘাড় নাড়ল শুধু। না, দর বাড়াওনি, কিন্তু ওজনে মারছ। ভিজে পটলে লাভ অনেক। কিন্তু অবনী কিছু বলল না। আজকাল কাউকে কিছু বলতে ইচ্ছে করে না।

সুনীপা একটু সাজতে ভালোবাসে। স্কুলে যাওয়ার সময়ও চুল বাঁধা আর স্নো-পাউডারে ওর বেশ সময় খরচ হয়। খদ্দরের পাঞ্জাবি আর ধুতি পরে বসেছিল অবনী, সুনীপা আসতেই উঠে দাঁড়াল। সুনীপার স্কুল সেই পার্ক সার্কাসে। এখান থেকে যাওয়া-আসা করা মুশকিল। কিন্তু তবু চাকরিটা ছাড়তে চায় না। হেডমিসট্রেস হওয়ার সুযোগ আছে। মাইনে খারাপ দেয় না স্কুলটা। গলির ভেতর একটা ট্যাক্সি ঢুকেছিল, দরজায় দাঁড়িয়ে ধরে ফেলল সুনীপা। অবনী ভাবল আজ কপালটা ভালোই যাবে। অন্যদিন রিকশা করে মোড়ের মাথায় গিয়ে ট্যাক্সির জন্যে হা-পিত্যেশ করতে হয়। গলির মুখে আসতেই ট্যাক্সি থামাতে বলল অবনী। সুনীপা ভ্রু কুঁচকে একপাশে সরে যেতে যেতে বলল, আদিখ্যেতা। অবনী হাসল। সুনীপা এসব ভালো চোখে দেখছে না। এই বাজার। করা, ধার দিয়ে তাগাদা না করা, অফিসে যাওয়ার সময় ট্যাক্সিতে লিফট দেওয়া। ছোট ভাইয়েরও ধারণা অসুখের পর দাদার মাথাটা গোলমেলে হয়েছে। আর এই লোকগুলো তার সুযোগ নিচ্ছে। ঝগড়া করতে ইচ্ছে করে না অবনীর। টাকা সে অনেক রোজগার করেছে। মাইনের চেয়ে বাঁ হাতে এসেছে বেশি। যে চাকরির যা দস্তুর। সুনীপার ভবিষ্যতের কোনও আশঙ্কা নেই। তার ওপর জি পি এফে আছে মোটা টাকা। তবু যে কেন ওরা এরকম করে!

ডালহৌসি ঘুরে গেল ট্যাক্সিটা। তিনজনকে সেখানে নামিয়ে ও গেল পার্কন্সার্কাসে। সুনীপাকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে অফিস। তেতলায় ওর ঘর। আগে সিঁড়ি ভাঙত, এখন লিফটে ওঠে। এইটুকুনিতেই আজ কেমন ক্লান্তি লাগছে।

নিজের ঘরে বসে অবনীর কেমন অসহায় বোধ হল। অসুখের পর থেকে ওর আর অ্যাসেসমেন্ট নেই। কাজের চাপ আর সহ্য হয় না। অথচ যতক্ষণ না নিজে চাকরিটা ছাড়ছে ততক্ষণ কেউ ওকে চলে যেতে বলবে না। সবাই জানে, গাঙ্গুলিসাহেব যে কোনওদিন মারা যাবেন। ক্যান্সার বলে কথা। দু-দুবার হাসপাতাল থেকে ফিরে এসেছেন ভাগ্যের জোরে।

ছোটখাটো কয়েকটা ফাইল দেখল অবনী। তারপর টেবিলে রাখা গেলাসটার জল আকণ্ঠ খেয়ে চেয়ারে গা এলিয়ে দিল। কদিন বাদে এই চেয়ারে অন্য কেউ বসবে। লোকটা নিশ্চয়ই অবনীর কথা জানবে। কেমন মনে হবে ওর! ওই জানলা, জানলা দিয়ে দেখা গির্জার চূড়া এসব ওর কেমন লাগবে! আচ্ছা, লোকটা যখন এই চেয়ারে বসে কোনও পার্টির কাছ থেকে ঘুষ নেবে তখন নিশ্চয়ই ভাববে অবনীও নিত। অবনী অনেক ঘুষ নিত, শেষপর্যন্ত অবনীর ক্যান্সার হল! ঘুষ নিত অবনী তাই ক্যান্সার হল এরকমটাও ভেবে নিতে পারে লোকটা। লোকটা নিশ্চয়ই ভয় পাবে। কারণ ক্যান্সার থেকে মুক্তি নেই লোকটা জানে। মনে-মনে একটা ভীত অথচ লোভী মুখের ছবি আঁকল অবনী। কিন্তু কী আশ্চর্য, ছবিটা বার-বার পরিষ্কার ছিমছাম দাড়ি কামানো অবনী হয়ে। যাচ্ছে। গালে হাত দিল অবনী। আজকাল ব্যান্ডেজ বাঁচিয়ে দাড়ি কামাতে হয় ওকে।

আজ শনিবার। একটা নাগাদ উঠি-উঠি করছে অবনী, এমন সময় সেই ভদ্রলোক এলেন। কদিন থেকেই ইনি আসছেন। অবনী অনেকবার ঘুরিয়ে বলেছে এ ব্যাপারে তার কিছুই করার নেই। ভদ্রলোক নাছোড়বান্দা। ঘরে ঢুকে ভদ্রলোক হাসলেন, কী করলেন স্যার?

মুখটা দেখল অবনী। তেল-চকচকে মুখ। সুখী-সুখী চেহারা।

আমার এখন কিছুই করার নেই, আপনি তো জানেন। অবনী রিক্ত গলায় বলল।

সামনের চেয়ারে বসে ভদ্রলোক ঝুঁকে পড়লেন টেবিলের ওপর, এ ব্যাপারে আপনার একটা দায়িত্ব আছে তো। কাজটা আপনার শেষ করার কথা ছিল। বলুন ছিল কিনা?

হ্যাঁ ছিল, কিন্তু আপনি জানেন আমি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। আপনার অ্যাসেসমেন্ট আমি আর করছি না। আর আপনাকে আমি বলেছি ওটা আপনি ফেরত নিয়ে যান। আমার এসব ভালো। লাগছেনা। একটু হাঁপ ধরে কথা বলতে, গলার কাছটাতে টনটন করছে।

জিভ বের করল লোকটা, টাকাটা স্যার ফেরত নেব বলে দিইনি। আপনি শুধু ফাইলটা আনিয়ে ব্যাকডেটে অর্ডারটা করে দিন। তারপর বাকি কাজ আমি করে নেব।

না, হবে না। আমি আর ওসব পারব না। বরং সোমবার এসে টাকাটা নিয়ে যাবেন। বলা যায় না তো, একদিন হঠাৎ দেখবেন আমি নেই। তখন টাকাটাও যাবে। উঠে দাঁড়াল অবনী।

যন্ত্রণা হয় স্যার?

তা হয়।

কোনওদিন সারবে না?

না।

ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেলল লোকটা, আমাদের সবাইকে একদিন চলে যেতে হবে, ভাবতেই কেমন লাগে। চললেন স্যার?

হ্যাঁ, আসুন আপনি। অবনী বাথরুমের দিকে এগোল।

বাড়ি যাবেন, তাহলে আমি লিফট দিতে।

লোকটাকে থামিয়ে দিল অবনী একটা হাত তুলে। তারপর বলল, আপনি যান, আমি বাড়ি যাব না। আজ শনিবার, আমি রেসের মাঠে যাব।

বলে দরজা ভেজিয়ে দিল। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকল লোকটা, তারপর নিজের গলায় হাত বুলিয়ে বলল, শা-লা!

গেট থেকে একটা বই কিনে নিল অবনী। তারপর দশটাকা দিয়ে টিকিট কেটে ভেতরে পা দিল। এখানে পা দিলেই শরীরে কেমন একটা উত্তেজনা হয়। গ্র্যান্ড এনক্লোজারে যারা আসে তাদের বেশবাস মুখ-চোখে একটা ভদ্র ছাপ থাকে। কিন্তু উত্তেজনায় সবাই টইটম্বুর। বাঁ-দিকে প্যাডকে এল অবনী। ঘোড়াগুলো ঘুরছে। প্রত্যেকের গায়ে নম্বর আঁটা। জকিগুলো মাঝখানে দাঁড়িয়ে ট্রেনারদের সঙ্গে প্ল্যান আঁটছে। একগাদা লোক হুমড়ি খেয়ে রেলিং ধরে ঘোড়াগুলো দেখছে। কোন ঘোড়াটা কীরকম ফিট জরিপ করছে সবাই। অবনী সরে এল। কেউ তার দিকে তাকাচ্ছে। ব্যান্ডেজ বাঁধা মুখ রেসের মাঠে দেখে বোধহয় একটু অবাক হচ্ছে। অপারেশনের পর আজ প্রথম এল অবনী। আগে আসত। এখানে এলে বুকের ভেতরটা টগবগ করত। কিন্তু আজ কিছুই হচ্ছে না। মানে সে ধরনের কোনও একসাইটমেন্ট নেই। শুধু চেয়ে-চেয়ে দ্যাখা।

প্যাডক থেকে সরে এল অবনী। বুকিদের কাউন্টারে খুব হইচই। প্রথম রেসটা বি-ক্লাসের। টালিগঞ্জের ঘোড়াগুলো দৌড়বে। মোটামুটি ফেবারিট ঘোড়াটার দর ইভন মানি। বোর্ডের দিকে তাকাল অবনী। ফেবারিট ঘোড়াটার কাঁটা ডগা ছুঁয়েছে। ঘোড়াটা জিতবে না, অবনী মনে-মনে বলল। অবনী বইটা খুলল। টাকটা গন্ধ। প্রথম রেসের ঘোড়ার তলায় ফেবারিটটাই টিপ। জিতবে না, জিততে পারে না। পাতা ওলটাল অবনী। থার্ড রেস থেকে জ্যাকপটের লেগ। আটটা ঘোড়া আছে। নামগুলো পড়ে গেল অবনী। বাপ-মায়ের ঠিকানা, অতীতের ফলাফল এসব নিয়ে মাথা ঘামাল না। পর-পর পাঁচটা এক নম্বর ঘোড়া নিয়ে দশটাকার জ্যাকপট কাটল ও। কেটে সোজা দোতলার ব্যালকনির কোনায় চুপচাপ বসে পড়ল অবনী। কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছে, ঝিমঝিম ভাবটা বেড়েছে।

প্রথম রেস শুরু হয়ে গেছে। অবনী দেখল ফেবারিট ঘোড়াটা বাকিগুলোকে কুকুরের মতো পেছনে রেখে জিতে গেল। মাঠে বেশ খুশি-খুশি ভাব। অবনীর ভালো লাগল। লোকগুলো টাকা পেল।

ডান দিক বাঁ-দিক নিচে শুধু মানুষের মাথা। এত লোক–সবাই বড়লোক হতে চায়। প্রত্যেকের মনের মধ্যে বাসনার পোকা কুটকুট করছে। অবনী দেখল, তার পাশের লোকটা একটা ব্যাগ। নিয়ে এসেছে, টাকা নিয়ে যাবে বলে। অবনী হাসল, এখান থেকে কেউ জিতে যেতে পারে না, কেউ নয়। তবু সবাই আসে, জিতে যেতে আসে। লড়ে যাও ভাই, লড়ে যাও! অবনী গালে হাত বোলাল।

জ্যাকপটের চারটে লেগ শেষ হতে অবনীনড়েচড়ে বসল। সমস্ত মাঠ ঠান্ডা। পর-পর চারটে এক নম্বর ঘোড়া জিতে গেল। অবিশ্বাস্য ব্যাপার। একটু আগে মাইকে অ্যানাউন্সমেন্ট হল, হ্যালো, হ্যালো! ইন দি জ্যাকপট পুল দেয়ার আর টু টিকেটস অ্যালাইভ আফটার দি এন্ড অফ ফোর্থ লেগ।

দুটো টিকিট আছে। বাঃ। বাঃ। টোটাল পুল কত? দু লাখ হবে। একনম্বর ঘোড়া যদি শেষ রেসে জেতে তাহলে এক লাখ করে ভাগে। বাপস! অবনী বুঝল কপালে ঘাম হচ্ছে। আজ সকাল। বেলায় ট্যাক্সি পাওয়া থেকেই মনে হচ্ছে সব যেন কীরকম ভালো। ডা:রায় বলেছেন বরাতের ব্যাপার। রেস খেলেনি অবনী। এর আগে অনেকদিন এসে চুপচাপ দৌড় দেখে গেছে। পকেট থেকে কোনও রিস্ক নেই। আজ লাক ট্রাই। পরপর পাঁচটা জিতে গেলে মিনিমাম এক লাখ। ক্যান্সার সারা নিশ্চয়ই এর চেয়ে বেশিবরাতের নয়। চন্দননগরে নাকি কে এক তান্ত্রিক আছে, যেতে হবে। জলপড়া না কি খেতে দেয়। বরাতের ব্যাপার। পাশের লোকটা মুখ চুপসে বসেছিল, হঠাৎ জিজ্ঞাসা করল, আপনার কি হয়েছে?

কিছু না তো! অবনী হাসল, একটা জ্যাকপট কেটেছি। দেখছি খুব মিলে যাচ্ছে। টিকিটটা বের করে দেখাল অবনী।

ঝুঁকে পড়ে দেখল লোকটা। তারপর লাফিয়ে উঠল, আপনার হয়ে গেছে, লাইনে দাঁড়ান গিয়ে। লাস্ট রেসে এক নম্বর জিতবে আমার খবর। আমি পাঁচ হাজার হেরেছি, বাকি পাঁচ হাজার এবার এক নম্বরে লাগাব। এ ঘোড়ার মার নেই। মিনিমাম তিনের দর। থ্রি টু ওয়ান। যাঃ শালা! এত টাকা নিয়ে কি করব? সুনীপার কথা ভাবল অবনী। সব শালা বউয়ের ভাগ্যে। ক্যান্সার বউয়ের ভাগ্যে জ্যাকপটও বউয়ের ভাগ্যে।

অল দি হর্সেস হ্যাভ অ্যারাইভড ইন দি স্টার্টিং পয়েন্ট। মাইকে ঘোষণা হল। অবনী দেখল মাঠের ওপাশে টাটা বিল্ডিংটার দিকে ঘোড়াগুলো জড় হয়েছে। বোর্ডের দিকে তাকাল ও। দু নম্বর ফেবারিট। বই খুলে নাম দেখল, লাকি স্টার। এক নম্বরটার নাম ফুল অফ লাইফ। ঘোড়াটা যখন যায় অবনী লক্ষ করেছে দারুণ ফিট। পাশের লোকটা নেই। বোধহয় টাকা লাগাতে গেছে।

রেস শুরু হল। বারোশো মিটারের দৌড়। এখান থেকে ঠিক বোঝা যাচ্ছেনা কে প্রথমে আসছে। মাইকে লাকি স্টারের নাম শুনতে পেল অবনী। লোকগুলো চেঁচাচ্ছে। যেযার নিজের পছন্দের। ঘোড়ার নাম বলছে। বেন্ট ঘুরে এল ঘোড়াগুলো। এবার সোজা পথ। মাইকে ফুল অফ লাইফ শুনতে পেল অবনী। উত্তেজনায় সবাই দাঁড়িয়ে পড়েছে। অবনী উঠে দাঁড়াল। বুকের মধ্যে দড়াম-দড়াম করছে। ফুল অফ লাইফ রেলিং ধরে ছুটে আসছ। তার তিন লেংথ পেছনে লাকি স্টার। হুইপ করছে জকিটা। না, ধরতে পারবে না। বুলেটের মতো যাচ্ছে ঘোড়াটা। আর পঞ্চাশ গজ বাকি–চল্লিশতিরিশ। হঠাৎ সারা মাঠে চিৎকার উঠল। পায়ে-পায়ে লেগে পড়ে গেল ফুল অফ লাইফ। উইনিং পোস্টের দশ গজ এপাশে পড়ে ছটফট করতে লাগল। লাফ দিয়ে ছিটকে পড়ল জকিটা। ততক্ষণে লাকি স্টার জিতে গেছে। দু-নম্বর জিতে গেল। ফুল অফ লাইফ ছটফট করছে। ওঠার চেষ্টা করছে, পারছে না। পা-ভেঙে গেছে, কে যেন চেঁচাল। অবনী দেখল, স্বাস্থ্যবান চকচকে একটা সাদা ঘোড়া মাঠের ধুলোয় ছটফট করছে। মুখ তুলে তাকাচ্ছে আকাশের দিকে। টার্ফ ক্লাবের দুটো গাড়ি এসে দাঁড়াল সেই সময়। কয়েকটা লোক এসে ঘোড়াটার পা দেখল। একজন হাত নেড়ে ইশারা করতেই অবনী দেখল একটা অ্যাম্বুলেন্স আসছে। ছ-সাত জন কুলি। গোছের লোক অ্যাম্বুলেন্স থেকে নেমে ত্রিপল দিয়ে ফুল অফ লাইফকে ঘিরে ফেলল।

কে যেন বলল, এবার ঘোড়াটাকে মেরে ফেলবে।

মেরে ফেলবে? অবনী ভীষণ ধাক্কা খেল।

লোকটা বলল, হ্যাঁ, তাই নিয়ম। রেস চলার সময় কোনও ঘোড়া অকেজো হয়ে গেলে গুলি করে মেরে ফেলা হয়।

অবনী বলল, ফ্যাসফেসে গলায় বলল, কেন ঘোড়াটার পা সারিয়ে গাড়ি-ফাড়ি টানাতে পারে তো!

না, তা হবে না। রেস রাজার খেলা, রাজার মতো যেতে হবে। অকেজো বাতিল হয়ে কেউ বেঁচে থাকবে না।

অবনী দেখল মাঠে পূর্ণ নীরবতা। সবাই উঠে দাঁড়িয়েছে। ওপরে থাকার দরুন অবনীরা ফুল অফ লাইফকে দেখতে পাচ্ছে। একটা টুপি পরা লোক রিভলভার বের করে ঘোড়াটার মাথা ছুঁয়ে নমস্কার করল। আর একটা লোককে বিড়বিড় করে কিছু বলতে দেখল অবনী। তারপরই গুলির শব্দ। খানিক ছটফট করে মরে গেল ঘোড়াটা। মাঠে একটু শব্দ নেই। পরিপূর্ণ জীবনের জন্যে শেষ সম্মান।

নেমে এল অবনী। নামতে গিয়ে দেখল হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে। মুখ-চোখে কেমন একটা তাপ। এখন লোকজন কথা বলছে, ঘোড়াটার কথা বলছে। অবনী কোনওরকমে বেরিয়ে এল।

বাড়ি ফিরল অবনী অনেক রাত্রে। গুপ্ত দাঁড়িয়েছিল গলির মোড়ে। দেখে এগিয়ে এল, দাদা কোথায় ছিলেন? একি, শরীর খারাপ নাকি আপনার?

ট্যাক্সির ভাড়া মিটিয়ে গুপ্তর কাঁধে হাত রাখল অবনী, তুমি কি আমার জন্যে দাঁড়িয়ে আছ?

হ্যাঁ। বউদি খবর পাঠিয়েছিলেন। আপনাকে নাকি অফিসে ফোন করে পাওয়া যায়নি। গুপ্ত অবনীকে ধরে নিয়ে চলল।

গুপ্ত, আমার ব্যান্ডেজটা কি ভিজে গেছে? অবনী আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল।

একটু একটু, সে তো হয়ই। গুপ্ত ওকে নিয়ে দরজায় দাঁড়াল।

গুপ্ত, আমার গলা থেকে কোনও গন্ধ পাচ্ছ?

দাদা! চাপা গলায় বলল গুপ্ত। বলে কলিং বেল টিপল।

হাসল অবনী, আজ সাহেব বলছ না কেন, গুপ্ত? সাহেব শুনতে ভালো লাগে। গন্ধ পাচ্ছ গুপ্ত?

হুঁ।

গলাটা পচছে হে। এরপর শরীর পচবে। হাঁপাতে লাগল অবনী।

ভেতরে শব্দ হচ্ছে। দরজা খুলতে আসছে কেউ।

গুপ্ত, কেউ যদি আমাকে গুলি করে মারত আমি তাকে এক লাখ টাকা দিতাম।

দরজা খুলল সুনীপা। অবনীকে দেখেই চিৎকার করে কেঁদে উঠল, কোথায় ছিলে এতক্ষণ, আমি ভেবে-ভেবে মরি–তুমি আমার কথা–।

হেসে ফেলল অবনী। তারপর গুপ্তর দিকে ঘুরে বলল, এই জন্যেই শুয়ে-শুয়ে দুঃখ সইয়ে দিয়ে যেতে হবে গুপ্ত। এটাও তো একটা দায়িত্ব, কি বলো।

<

Samaresh Majumdar ।। সমরেশ মজুমদার