রঙিন জামা এবং সাদা গেঞ্জি

সুধা বলেছিল, পুরুষজাতটাকে বাপু কোনওদিন বিশ্বাস করতে পারব না। সুধাময় জানে, তবু শুধিয়েছিল, কেন? তোমাকে তো দেখছি। সুধার মুখে কিছু আটকায় না।

সুধার সব ভালো, শুধু মাঝে-মাঝে এই কথাগুলো বেলকাঁটার মতো ফোঁটে। টেনে বের করলেও দপদপানি কমে না। খুব অন্তরঙ্গ মুহূর্তেও সুধা একই স্বভাবের। বুকে মুখ রেখে বলে, আমি জানি এটা ঠিক করছি না আবার না করেও যে পারি না।

মেঘ ঘনানো মুখে বলে তুমি আমাকে নষ্ট করেছ। কিন্তু তার দু-হাতের বেড় একটুও শিথিল হয় না।

প্রথম গ্রহণের পর সুধা অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলেছিল, কেন কবছর আগে আমাদের দেখা হল না গো।

বুকের ভেতর তখন রক্ত ঝরে সুধাময়ের। পৃথিবীটাকে লাথি মেরে সরিয়ে শুধু সুধার সঙ্গে যদি বাকিটা জীবন কাটিয়ে দেওয়া যেত। মুখে বলেছিল, কি জানি, হয়তো এতদিনে সম্পর্কটা বিশ্রী হয়েও যেতে পারত।

যেমন অঞ্জলির সঙ্গে তোমার হয়েছে?

সুধা এই কথাটা না বললেও পারত। যা সত্যি তা সবসময় দেখতে ইচ্ছে করে না যদি তাতে দীর্ঘশ্বাস মিশে থাকে। সুধা তাই করবে। যখনই দুজনের নিভৃতে কথা হয় তখনই ওর শব্দগুলো ভাঙা  কাঁচ হয়ে যায়। কিন্তু সুধাময় জানে, সুধা তাকে যতখানি ভালোবাসে ঠিক ততখানি ঘৃণা করে কিংবা যতখানি ঘৃণা করে সেই পরিমাণেই ভালোবাসে।

মাঝে-মাঝে সুধাময়ের উদ্দাম হতে ইচ্ছে করে। অঞ্জলি কিংবা সন্তানদের নস্যাৎ করে দিতে ইচ্ছে হয়। সুধার এই সন্দেহ সহ্য হয় না তার। প্রমাণ দিয়ে দেবে সুধাই তার সব, সব শেষ কথা।

কিন্তু যে সুধা তাকে নিবিড় করে চায়, পায় না বলে জ্বলে এবং জ্বালায়, সে নিজে অছিলা বের করে অঞ্জলির সঙ্গে আলাপ জমিয়ে নিল। এসে বলল, এত সাদামাটা গ্রাম্য টাইপের মেয়েকে বিয়ে করলে কী করে?

সুধাময় পুরনো কথাটা বলেছিল, যাচাই করিনি, জুড়ে দেওয়া হয়েছিল।

অথচ তাই নিয়ে তো বেশ রয়েছ। আমার দিন কাটে কি করে ভেবেছ?

ভেবেছি।

আমি বিশ্বাস করি না।

তাহলে আমাকে ভালোবাসলে কেন?

ফাঁদ পেতেছিলে তাই। নিজের ঘর ঠিকঠাক রেখে আমার সঙ্গে খেলা করে যাচ্ছ, ছি! ঘেন্নাটা যেন ছিটকে উঠল।

সুধাময় মুখ ভার করেছিল, আমি তো ডিভোর্স চেয়েছিলাম, তুমি আপত্তি করেছ একথা ভুলে যেও না।

সুধা মাথা নেড়েছিল, না, কক্ষনো না।

তাহলে? তোমার কথাবার্তা শুনলে নিজেকে লম্পট বলে মনে হয়।

তা বাবা তুমি একটু তাই আছ। সুধা এবার হেসেছিল।

আর পাঁচটা পুরুষেরা যেরকম মানিয়ে নিতে পারে সুধাময় তাই পারত, যদি সুধা ওর জীবনে না আসত। অঞ্জলির সঙ্গে মনের ফারাক সামান্য ব্যবধানেই ধরা পড়েছিল। বাড়ি থেকে বের করতে জোর খাটাতে হয়, সাহিত্য-সংস্কৃতির কথা দূরের ব্যাপার, সুধাময়ের বন্ধুদের সামনে দু-দণ্ডের বেশি দাঁড়ায় না। অঞ্জলির কাশীবৃন্দাবন হল তিন কামরার ফ্ল্যাটটা। তাকে ঘষেমেজে সাজানো, প্রয়োজনের সবকটা হাঁ-মুখদু-হাতে ভরাট করে যায় সারাদিন। সুধাময় অনেক বোঝাতে। চেয়েছিল প্রথম-প্রথম। পুরুষের শরীরে গেঞ্জিটাই সব নয়, একটা জামাও দরকার বাইরে বের হতে গেলে। অঞ্জলি বলত, তুমি তোমার বাইরের জগৎ নিয়ে থাকো না, আমি তো বাধা দিচ্ছি না।

একবার টোল খেয়ে গেলে পাত্র মাটিতে সমানভাবে বসে না। প্রায়ই ঝগড়া বাধত সামান্য সূত্র ধরে। আক্ষেপ প্রকাশে কোনও দ্বিধা থাকত না। জৈবিক নিয়মে যে সন্তানেরা পৃথিবীতে এসেছে তারা এখনও অবোধ। সুধাময় ভাবে, এইরকম শিকলের বোঝা সারা জীবন বয়ে যেতে হবে। প্রচণ্ড বৃষ্টিতে ভিজে সর্দি হব-হব অবস্থায় যখন গরম তোয়ালে দরকার তখন অঞ্জলি ভেজা। গামছার মতো শীতল। এই সময় সুধা এল। আচম্বিতে। এসে ঝড়ের দোলায় কুটোকাটার বাঁধ উড়িয়ে দিল।

অথচ অঞ্জলির সঙ্গে আলাপ জমে গেল সুধার। ওয়াকিং গার্লসদের হোস্টেল থেকে প্রায়ই আসে সে। অঞ্জলি তার কথা শোনে বড়-বড় চোখে, বাচ্চা সামলায় আর রকমারি রান্না করে খাওয়ায়। সুধাময়ের সঙ্গে সুধার কী সম্পর্ক তা হয়তো বোঝে না অঞ্জলি কিংবা বোঝে বলেই বোঝায় না।

সুধাময় যখন একটা কিনারায় ফিরতে উৎসুক তখন বাধা দিল সুধা। বলল, না, একটা ঘর ভেঙে আর একটা ঘর গড়বে, সেটাও যদি না টেকে?

সুধাময় বলেছিল, তোমার ওপর আমার ভরসা আছে।

সুধা বলেছিল, আমার নেই। যদি আমি তোমাকে সুখী না করতে পারি, যদি আমার অঞ্জলির মতো অবস্থা হয়!

চমকে উঠেছিল সুধাময়। সুধা তাকে সন্দেহ করছে? নিজেকে দুই চাকার মধ্যে দেখল সে। অথচ সুধাকে না দেখলে, সুধার কথা না শুনলে বুকের ভেতরটা টনটন করে। সুধা যেন সেই অভিধান। যা কোনওকালেই মুখস্থ করা যায় না আর অঞ্জলি সহজপাঠের মতো, চোখ বোলালেই দুবার ছুঁতে হয় না।

আজ দুপুরে সুধা এসেছিল বাড়িতে। বড় মেয়ে ঝুমা বায়না ধরেছিল কিছুদিন থেকেই, চিড়িয়াখানায় যাবে। তিন বছর বয়সে সে একবারই গিয়েছিল সেখানে বাবার সঙ্গে। পাঁচে পড়ে শখ হয়েছে আবার। তিন বছরের ভাইটাও তাল মিলিয়েছে ওর সঙ্গে। সুধা বলল, চলুন বউদি, সবাই ঘুরে আসি।

অঞ্জলি আপত্তি করেছিল কাজের অছিলায় কিন্তু সুধা শোনেনি। সুধাময়কে বলেছিল, ট্যাক্সি ডাকুন মশাই, আজ আপনার খরচ করিয়ে ছাড়ব। একান্ত না হলে সুধা তুমি বলে না সুধাময়কে। দু-সময় দু-রকম সম্বোধন খুব সহজেই বের হয় জিভ থেকে। ভিন্ন স্বাদ আনে।

আপত্তি ছিল মনে-মনে, অঞ্জলিকে নিয়ে যাওয়ার কী দরকার। কিন্তু সুধার চাপে মেনে নিতে হল। অঞ্জলি সঙ্গে আছে থাক, সুধার সঙ্গে ছেলেমেয়েকে নিয়ে বেড়ানো যাবে তো!

ওরা পেছনে বসল, সুধাময় ড্রাইভারের পাশে! সারাটা পথ বাচ্চা দুটো সুধার সঙ্গে বকবক করে গেল। সুধাময় দেখছিল মেয়েটারও অসীম প্রাণশক্তি! ওদিকে অঞ্জলি চুপচাপ জানলা দিয়ে শহর দেখছে। যেন আসতে হয় তাই আসা।

চিড়িয়াখানায় সামান্য ঘুরে অঞ্জলি বলল, আর পারি না ঘুরতে। আমি বরং এখানটায় বসি, তোমরা ঘোরাঘুরি করো।

এইটে চাইছিল সুধাময়। সুধা সামান্য আপত্তি করে মেনে নিল। বাচ্চা দুটোকে নিয়ে ওরা নানান খাঁচা ঘুরে-ঘুরে দেখল। ভীষণ ভালো লাগছিল সুধাময়ের। যেন সুধাই ওদের মা বলে মনে হচ্ছিল তার। ছোটটাকে কোলে নিয়ে সুধার হাঁটা দেখে বুক ভরে যাচ্ছিল যেন। সেই সময় অফিসের সামান্য আলাপী এক সহকর্মীর সঙ্গে দেখা। সুধাময় তাকে দেখেও দেখল না। আলাপ হলে সুধার পরিচয় দিতে কী সঙ্কোচ হত! ব্যাপারটা বুঝতে দিল না সে। বাচ্চা দুটো সুধার সঙ্গে বেশ সেঁটে গেছে। ঘুরতে-ঘুরতে ওরা বাঘ সিংহের খাঁচার কাছে এল। বাঘ দেখে ছোটটা ভয়ে কাঁটা। বড় ঝুমা কিন্তু খুঁটিয়ে দ্যাখে, কি সুন্দর, না বাবা?

সুধা বলে, তোমার তো খুব সাহস, বাঘকে সুন্দর বলছ!

সিংহের খাঁচার সামনে এসে ঝুমা বলল, কেমন রাজার মতো হাঁটছেনা বাবা।

সুধা মুখ টিপে হাসল। সুধাময় খুশি হল মেয়ের চোখ আছে বলে। পরের খাঁচার সামনে এসে ঝুমা জিজ্ঞাসা করল, এটা কী বাঘ?

সুধাময় হেসে বলল, না একে বলে টাইগন। ওর বাবা বাঘ মা সিংহ।

নাক কোঁচকাল ঝুমা ইস কি বিচ্ছিরি।

সুধা বলল, বিশ্রী কেন?

ঝুমা জবাব দিল, দ্যাখোনা, বাঘের মতন না, আবার সিংহের মতনও না।

সুধার চোখ চকিতে সুধাময়কে ছুঁয়ে গেল। এবং তারপর থেকেই ওর মুখ অন্ধকার। চাপা গলায় বলেছিল, দোঁ আশলারা এইরকমই হয়।

এরপর পথটা যেন আচমকাই ফুরিয়ে গেল। ওরা ফিরে এল অঞ্জলি যেখানে বসেছিল সেখানে। সুধাময় সুধার পরিবর্তনটা ধরতে চাইছিল বলে একটু অন্যমনস্ক, মেয়ের কথা শুনতে পায়নি। ঝুমা ওর হাত ধরল, খিদে পেয়েছে বাবা। সুধার যেন ইচ্ছে ছিল না, বড় চুপচাপ হয়ে গেছে সে। তবু যেতে হয় তাই যেন রেস্তোরাঁতে ঢুকল। ছোট্ট কেবিনে পরদার আড়ালে। সুধা চা ছাড়া কিছু খাবে না, অঞ্জলিও তাই। অর্ডার দিয়ে মুখ ফেরাতেই জানলার পরদার তলা দিয়ে বাইরেটা নজরে এল সুধাময়ের। সেখানে একটি রঙিন শাড়ির আভাস। বেশ দুরে বলেই রহস্যময়। পুরোটা দেখার আগ্রহে পরদা সরাতে হাসি এল। রঙিন লুঙ্গি পরনে উদোম গায়ে কেউ ঢং করে হাঁটছে।

ঝুমা জিজ্ঞাসা করল, কী দেখছ বাবা, হাসছ কেন?

সুধাময় সরল গলায় বলল, ওই লোকটাকে আমি মেয়ে ভেবেছিলাম।

হঠাৎ সুধার তীক্ষ্ম গলা বাজল, ছি। লজ্জা করে না!

প্রতিটি কথায় একটা হিসহিস শব্দ জড়ানো ছিল। এমন করে পৃথিবীতে কেউ কখনও ঘৃণা প্রকাশ করেনি। সুধাময় অবাক হয়ে তার দিকে ফিরে তাকাতেই শুনতে পেল অঞ্জলি নরম গলায় বলছে, তুমি কিছু মনে করো না ভাই, মুখেই ওর যত, আসলে কিন্তু ঠিক উলটোটা।

<

Samaresh Majumdar ।। সমরেশ মজুমদার