পরম ও দীপালি

ইস্কুল থেকে ফিরে, সদর দরজা দিয়ে ঢুকতে পরম দেখতে পেল, তাদের বসবার ঘরের দরজার বাইরে অনেকগুলো জুতো।

পরম অবাক হল না। সে বুঝতে পারল, কারা এসেছে। জুতোগুলো গুনে দেখল, মোট পাঁচ জোড়া, তার মধ্যে তিনজোড়া মেয়েদের চটি। প্রত্যেকবার ঠিক পাঁচজনই আসে কেন?

এখন পরমের ও-ঘরে ঢোকা নিষেধ।

বসবার ঘরটা ঠিক আলাদাভাবে বৈঠকখানা নয়, ওটা অনেক রকমভাবে কাজে লাগানো হয়। সন্ধেবেলা পরমের মাস্টারমশাই এলে ওই ঘরে বসেন, এক পাশে ডাঁই করা আছে অনেকগুলো বড়-বড় কাগজের বাক্স, তাতে ছোটকাকার ব্যাবসার কী সব জিনিসপত্র আছে, শান্তি পিসি রাত্তিরে ওই ঘরেই শোয়। তবে, বাইরের কোনও বিশিষ্ট লোক এলে ঘরটা সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা হয়, এমনকি মেঝেতে পাতা হয় জুট কার্পেট।

পরম সোজা চলে যায় দিদির ঘরে। সে আর দিদি দুজনেই এ-ঘরে থাকে, কিন্তু দিদির অধিকারটাই বেশি।

রান্নাঘরে রুটি-তরকারি রাখা আছে। পরম ইচ্ছে করলে খেয়ে নিয়ে চলে যেতে পারে তাপসদের বাড়িতে। সে-বাড়ির ঠাকুর দালানের সামনে বড় উঠোনে সবুজ সংঘের ছেলেমেয়েরা খেলাধুলো করে। কিন্তু ইস্কুল থেকে এসে কারুর সঙ্গে একটাও কথা না বলে কি আবার বেরিয়ে যেতে ভালো লাগে?

মা, বাবা, দিদি সবাই এখন বাইরের ঘরে। এমনকি শান্তি পিসি পর্যন্ত। কাকা এখন এখানে থাকে। শান্তি পিসি কিন্তু পরমের নিজের পিসি নয়, তকে আনানো হয়েছে শক্তিগড় থেকে। রান্নাবান্না করাই কাজ, কিন্তু বাবার দূরসম্পর্কের জ্যাঠতুতো বোন বলে ঠিক কাজের লোকের মতন ব্যবহার করা হয় না।

শান্তি পিসির এখন ওখানে থাকার কী দরকার? পরম চিনির কৌটোটা খুঁজে পাচ্ছে না। তাহলে সে দুধ খাবে না, থাক পড়ে!

হঠাৎ বাবা ডেকে উঠলেন, পরম, পরম, এদিকে একবার আয় তো! পরম গিয়ে দাঁড়াল ও-ঘরের দরজার কাছে।

পড়ার টেবিলটা সরিয়ে রাখা হয়েছে একপাশে, মেঝের কার্পেটে বসেছে সবাই, শুধু একজন। বুড়ো মতন ভদ্রলোক বসেছেন চেয়ারে। মাঝখানে অনেকগুলো প্লেটে রয়েছে দু-তিন রকমের সন্দেশ আর সিঙাড়া আর চায়ের কাপ।

বাবা বললেন, এই আমার ছোট ছেলে পরম।

তারপর পরমকে বললেন, প্রণাম কর, প্রণাম কর!

একদম যাদের চেনে না, তাদের প্রণাম করতে পরমের একটুও ভালো লাগে না। রাগ হয়। কিন্তু পরম জানে, এই লোকদের সামনে একদম রাগ দেখানো চলবে না, বরং এদের খুশি করার চেষ্টা করতে হবে।

একে-একে অতিথিদের প্রণাম করার পর পরম বাবা, মা, দিদি, শান্তি পিসিকেও প্রণাম করল পায়ে হাত দিয়ে। কেউ বাদ পড়ে কি না তা তীক্ষ্ণ চোখে লক্ষ করছিলেন মা।

বৃদ্ধটি জিগ্যেস করলেন, তুমি কোন ক্লাসে পড়ো?

পরম বলল, ক্লাস ফাইভ।

বৃদ্ধ বললেন, বাঃ, বেশ ভালো ছেলে। মুখে একটা লক্ষ্মীশ্রী আছে। তুমি কি দিদির সঙ্গে কখনও ঝগড়া-টগড়া করো নাকি?

পরম অবাক হয়ে মুখ তুলল। দিদির সঙ্গে তার ঝগড়া হয় কি না সে কথা সে একজন বাইরের লোককে বলতে যাবে কেন?

পরম কিছু বলার আগেই বাবা গদগদ ভাবে বললেন, না, না, ঝগড়া করবে কেন, দিদির সঙ্গে ওর খুব ভাব!

কথাটা মোটেই সত্যি নয়। দিদির সঙ্গে এক ঘরে থাকে পরম, মাঝে-মাঝে তো ঝগড়া হবেই। রাস্তার দিকের জানলাটা দিদি কিছুতেই খুলতে দেয় না, আর জানলা বন্ধ থাকলে পরমের কেমন দমবন্ধ লাগে।

পরম দিদির দিকে তাকাল।

দিদি মুখ নীচু করে ঊরুর ওপর শাড়িটা সমান করছে।

বৃদ্ধটি আবার বললেন, খোকা, তুমি পড়ার বই ছাড়া গল্পেই বই-টই পড়ো?

এবারেও পরম কিছু বলার আগেই বাবা বললেন, ও তো এবারে পরীক্ষায় সেকেন্ড হয়েছে!

পরম বলল, হ্যাঁ, আমি গল্পের বই পড়ি।

বৃদ্ধটি বলল, বেশ, একটা কবিতা মুখস্থ বলতে পারো? শোনাও না।

পরম দেখল, বাবা আর মায়ের মুখ কেমন যেন শুকিয়ে এসেছে। এরা পছন্দ করতে এসেছে। দিদিকে, কিন্তু পরমকে এত প্রশ্ন করছে কেন?

একটুপরেই পরম চলে গেল খেলতে।

যেতে-যেতে পরম ভাবল, প্লেটের সিঙাড়া-সন্দেশগুলোর বেশ কয়েকটা বেঁচে যাবে। প্রত্যেকবারই বেশি-বেশি আনানো হয়, সব খরচ হয় না। ফিরে এসে পরম সিঙাড়া খাবে। অন্যদিন তাদের বাড়িতে সিঙাড়া আসে না। মায়ের ধারণা ওগুলো খেলে বদহজম হয়।

বাড়ি থেকে বেরুলে একটা গলি, সেটা ডানদিকে বেঁকে গেলে বড় রাস্তা। গলির মোড়ের একদিকে মিষ্টির দোকান, আর-একদিকে কাঠের ফার্নিচারের দোকান।

গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকে পাড়ার বড় বয়েসি ছেলেরা।

তাদের মধ্যে একজন পরমকে ডেকে জিগ্যেস করল, তোর দিদিকে আজ আবার দেখতে এসেছে, না রে?

পরম মাথা নাড়ল।

সেই ছেলেটি বলল, এই নিয়ে কটা পার্টি এলো রে? বারো-চোদ্দোটা তো হবেই? তাই না?

পরম মনে-মনে গুনে দেখবার চেষ্টা করল। বেশিও হতে পারে।

সেই ছেলেটির নাম বাপি। সুন্দর চেহারা। চাকরি-বাকরি করে না, একটা ক্লাবে শনি-রবিবার বাচ্চা ছেলেদের ক্রিকেট খেলা শেখায়।

বাপি বলল, শোন, পরম, আজকের পার্টিটা কিন্তু সুবিধের নয়।

ছেলেটার নাম তো শেখর, তাই না? সঙ্গে ওর একটা মাসি এসেছে, সেই মাসিটাকে আমি চিনি। জয়শ্রী। জয়শ্রী দাস, ঠিক তো?

যারা এসেছে, তাদের মধ্যে কে মাসি আর কে পিসি, তাই-ই জানে না পরম, নাম জানবে কী করে? তিনজন মহিলা ছিল।

বাপি বলল, এখান থেকে যখন গেল, তখন আমি দেখেই স্পষ্ট করেছি। শ্যাম পার্কে আমরা ক্রিকেট খেলতে যেতাম, তার পাশেই একটা বাড়িতে থাকে। ওই জয়শ্রীর দুবার বিয়ে। প্রথম বিয়েটার পরেও ওর একটা বয়ফ্রেন্ড ছিল। তারপর সেই বয়ফ্রেন্ড আর জয়শ্রী মিলে স্বামীটিকে খুন করেছে। পুলিশ ধরেছিল, দুজনকেই ধরেছিল। মজার ব্যাপার কী জানিস, জয়শ্রীটা কীভাবে। ম্যানেজ করে কেটে বেরিয়ে এল, যাবজ্জীবন জেল হল সেই বয়ফ্রেন্ডটার, তার নাম নিখিল। কিন্তু ও-পাড়ার সবাই জানে, খুনের ব্যাপারে জয়শ্রীই ছিল আসল। ওর এখনকার হাজব্যান্ড অন্য একজন লোক। কী তালেবর মেয়ে!

নিপু নামে আর-একটি ছেলে বলল, অ্যাই বাপি, তুই ওইটুকু ছেলেকে এসব কথা শোনাচ্ছিস

কেন? ও কী বুঝবে?

বাপি বলল, ওইটুকু ছেলে মানে? পরম মোটেই আর ছোট নেই। কী রে পরম, তুই ছোট? এখনকার বাচ্চারাও অনেক ম্যাচিওরড।

পরম চুপ করে রইল।

নিপু বলল, ওসব নিয়ে আমাদের মাথা ঘামাবার কী দরকার! তুই যা রে পরম!

বাপি বলল, বাঃ, সাবধান করে দিতে হবে না? আমাদের পাড়ার মেয়ে। যদি একটা বাজে ফ্যামিলিতে গিয়ে পড়ে। শোন পরম, তোর বাবাকে বলিস, এই পার্টি যদি রাজিও হয়, তাহলেও পাত্তা দেওয়ার দরকার নেই।

সন্ধের পর পরম বাড়িতে ফিরে দেখল, তখনও আজকের অতিথিদের নিয়ে আলোচনা চলছে।

পাত্র কাজ করে খিদিরপুর ডকে, ভালো মাইনে পায়। সে নিজে এসেছিল, আর তার বাবা, মা এবং দিদি আর মাসি। সত্যিই সেই মাসির নাম জয়শ্রী। মা আর বাবা সেই মাসিরই প্রশংসা করছে বেশি। মা উচ্ছ্বসিত হয়ে বলতে লাগলেন, ছেলের মাসির ব্যবহার কী চমৎকার! মা একটু চুপচাপ। আমার তো মনে হল, জয়শ্রী পছন্দ করে ফেলেছে আমাদের দীপালিকে। আজেবাজে প্রশ্ন করেনি, বরং যাওয়ার সময় থুতনি ধরে আদর করল। ওই মাসির পছন্দ হলেই ওরা মেনে নেবে।

মা যার এত প্রশংসা করছে, সেই জয়শ্রী যে একজন খুনি, তা কি পরম বলে দেবে?

নিজে নিজেই পরম বুঝেছে, সবকথা বলে দিতে নেই। কিছু কিছু কথা চেপে রাখতে হয়।

তা ছাড়া, কোনও ছেলের মাসি যদি খুনিও হয়, তাতে ছেলেটার কী দোষ? এরপর শুরু হয় দিন গোনা। কবে চিঠি আসবে। কিংবা বাবা-মাকে ডাকবে ওদের বাড়িতে।

আসে না। কোনও খবরই আসে না।

রাত্তিরে আয়নায় চুল আঁচড়াতে-আঁচড়াতে দীপালি বলল, পরম, সেদিন ওই বুড়োটা আমায় কিছু জিগ্যেস করেনি, কিন্তু তোকে অত কথা জিগ্যেস করছিল কেন বল তো?

বিছানায় শুয়ে পরম বলল, আমি তার কী জানি?

দীপালি বলল, আমায় প্রথম থেকেই ওদের পছন্দ হয়নি। আমি যে বেঁটে। কিন্তু ওই বুড়োটার একটা ছোট মেয়ে আছে বলল। তোকে ওদের এত ভালো লেগেছে যে তোর সঙ্গেই বোধহয় সেই মেয়েটার বিয়ে দিতে চাইবে!

পরম লজ্জা পেয়ে বলল, যাঃ! আমি মোটেই বিয়েই করব না। দীপালি হাসতে-হাসতে বলল, তুই বিয়ে করবি না? কেন রে?

পরম দু-দিকে মাথা ঝাঁকাতে-ঝাঁকাতে বলল, না, আমি বিয়ে-ফিয়ে করব না। পরম অনেক কিছুই বোঝে, কিন্তু একটা ব্যাপার তার কাছে এখনও পরিষ্কার নয়। বিয়ে ব্যাপারটা ঠিক কী? ছেলে মেয়েতেই শুধু বিয়ে হয় কেন?

বড়দের কথা শুনে-শুনে তার একটা অস্পষ্ট ধারণা হয়েছে যে, বিয়ের সঙ্গে ছেলেমেয়ে জন্মানোর একটা সম্পর্ক আছে। মেয়েদের পেটেই তো বাচ্চা হয়, বিয়ে না হলে মেয়েরা মা হতে পারে না কেন? কী সেই রহস্য?

খবরের কাগজের পাত্র-পাত্রী সংবাদ দেখে বাবা চিঠি লেখেন। দলে-দলে নারী-পুরুষ দিদিকে দেখতে আসে। শেষপর্যন্ত কেউ পছন্দ করে না, শুধু সন্দেশ-টন্দেশ খেয়ে মিষ্টি-মিষ্টি কথা বলে চলে যায়। কিন্তু আগের দুই দিদির বিয়ে হয়ে গেছে সহজেই। বড়দি একটা ফাংশানে নাচতে গিয়েছিল, সেখানেই তাকে দেখে পছন্দ করেছি বড় জামাইবাবু। আর মেজদি নিজেই তার। কলেজের বন্ধু অপূর্বদাকে বিয়ে করল, প্রথমে বাড়িতে জানায়নি, কী যেন জাত-টাতের গণ্ডগোল ছিল, এখন মা-বাবা দুজনেই অপূর্বদাকে খুব ভালোবাসে।

দুই দিদিই থাকে কলকাতার বাইরে। মেজদি তবু বছরে একবার-দু-বার আসে কানপুর থেকে। বড়দির আসাই হয় না। সে থাকে আরও দূরে চণ্ডীগড়ে।

ছোড়দি এই দীপালির নিজের কোনও ছেলে বন্ধু নেই। কোনও পাত্রপক্ষই তাকে পছন্দ করে না। কারণ দীপালি বেশ বেঁটে। পৃথিবীতে কি বেঁটে ছেলে নেই? তাদের বিয়ে হয় না?

এই পাড়াতেই তো কত ছেলে আছে, তাদের কারুর সঙ্গে ছোড়দির বিয়ে হতে পারে না?

আড়াল থেকে মা-বাবার টুকরো-টুকরো কথা শুনে পরম বুঝতে পারে, ছোড়দির বিয়ে হওয়াটা খুব দরকার। ওঁরা ছোড়দিকে এ-বাড়িতে বেশিদিন রাখতে চান না। কেন? ছেলেরা বাড়িতে থাকে, আর মেয়েদের কেন অন্য বাড়িতে পাঠিয়ে দিতে হয়? আগের দুই মেয়ের বিয়ে নিয়ে কোনও ঝামেলা হয়নি, ছোড়দির কিছুতেই বিয়ের ব্যবস্থা করা যাচ্ছে না বলে মা-বাবা দুজনেই বিরক্ত হয়ে উঠছেন। মাঝে-মাঝে তুচ্ছ কারণে ছোড়দিকে ওঁরা বকুনি দেন।

ছোড়দি যে বেঁটে হয়েছে, সেটা কি ছোড়দির দোষ? ভগবানই তো এজন্য দায়ী।

পাড়ার ছেলেরা বড় হচ্ছে আর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে টপাটপ। বাপিদার সঙ্গে ছোড়দির বিয়ে হলে বেশ হত। কারা কখন ছোড়দিকে দেখতে আসছে, বাপিদা তার ঠিক খবর রাখে।

বাপিদাকে নিয়েও মা-বাবার মধ্যে আলোচনা হয়।

মা একদিন বলেছিলেন, আমি মরে গেলেও ওই বাপি ছেলেটার সঙ্গে দিপুর বিয়ে দেব না। তার চেয়ে ও যদি আইবুড়ো হয়েও থাকে—

বাপিদার কী দোষ? বাপিদার বাবা খুব মাতাল, প্রায় দিনই ও-বাড়িতে খুব চ্যাঁচামেচি আর ঝগড়া হয়। কিন্তু বাপিদা তো মদ খায় না। বাপিদা গালাগালিও করে না। কিন্তু বাপিদা কোনও চাকরি। করে না, শুধু ক্রিকেট খেলে। তাও তো খেলার চান্স পায়নি, পাড়ার ক্লাবের খেলোয়াড়।

এবারের পাত্রপক্ষ বাড়িতে আসবে না, সেকেলে ধরনের মেয়ে দেখা তাদের পছন্দ নয়। বাবা-মা ছোড়দিকে নিয়ে গেলেন গঙ্গার ধারের রেস্তোরাঁয়, পাত্রপক্ষ সেখানে আসবে, আলাপ পরিচয় হবে।

পরম একা রইল বাড়িতে। শান্তি পিসির জ্বর হয়েছে, শুয়ে-শুয়ে ঘুমোচ্ছে সারাদিন।

পরমের বেশ অভিমান হয়েছে। গঙ্গার ধারের রেস্টুরেন্টে বুঝি তাকে নিয়ে যাওয়া যেত না?

ওঁরা ফিরলেন রাত সাড়ে আটটার পর।

ছোড়দি প্রায় ছুটে গিয়ে বিছানায় উপুড় ঝাঁপিয়ে পড়ে কাঁদতে লাগল ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে।

নিজের ঘরে গিয়ে বাবা প্রায় গর্জন করে উঠলেন, জোচ্চোর! চশমখোর!

পরম জানে, কী হয়েছে জানতে চাইলে সে কোনও উত্তর পাবে না। সে যে ছোট!

কিন্তু কিছু একটা অপমানজনক ঘটনা যে ঘটেছে তা বোঝার মতন বয়েস তার হয়েছে।

অনেক ডাকাডাকি সত্বেও দীপালি আর বিছানা ছেড়ে উঠল না, কিছু খেতেও রাজি হল না।

একসময় আলো নিবিয়ে দিল পরম।

পাশাপাশি দুটো খাট। অন্যদিন শোওয়া মাত্র পরম ঘুমিয়ে পড়ে, আজ তার ঘুম আসছেনা।

নিশ্বাসের শব্দ শুনেই বোঝা যায়, দীপালি এখনও ঘুমোয়নি। মাঝে-মাঝে ফুঁপিয়ে উঠছে।

একসময় কৌতূহল চাপতে না পেরে পাশের খাটে উঠে সে জিগ্যেস করল, এই ছোড়দি, ছোড়দি, আজ কী হয়েছে রে?

ফোঁপানি থেমে গেল দীপালির। পরমের প্রশ্নের কোনও উত্তরও দিল না।

তার পরই ধড়মড় করে উঠে বসে বলল, ছোটু, তুই খানিকটা পেট্রল জোগাড় করে আনতে পারবি?

পরম বলল, পেট্রেল? পেট্রল কী হবে? আমাদের তো গাড়ি নেই! দীপালি বলল, আমার গায়ে পেট্রল ঢেলে আগুনে পুড়ে মরব।

মৃত্যু সম্পর্কে এখনও কোনও অভিজ্ঞতা হয়নি পরমের। কোনও নিকটজনের মৃত্যু দেখেনি।

তবু মরার কথা শুনলেই ভয়-ভয় করে। সে ছোড়দির মাথায় হাত রেখে বলল না, না।

দীপালি সেই হাতটা ঠেলে সরিয়ে দিয়ে ঝাঁঝের সঙ্গে বলল, তুই কেন ফরসা হলি? তোর তো কোনও দরকার ছিল না। তোর বদলে আমি ফরসা হলে কাজে লাগত!

ফরসা-কালোর তফাতটাও পরম ঠিক বোঝে না। তবে, নানান টুকরো-টুকরো কথা শুনে তার ধারণা হয়েছে, ছেলেদের ফরসা হওয়ার তেমন কোনও দরকার নেই, কিন্তু মেয়েদের ফরসা। হওয়াটা খুব জরুরি। নইলে তাদের বিয়ে হয় না।

ছেলে আর মেয়েদের মধ্যে এই তফাত কেন? কালীঠাকুরের গায়ের রংও তো কুচকুচে কালো, সেই কালীঠাকুরের কত ধুমধাম করে পুজো হয়, অথচ কালো মেয়েদের বিয়ে হবে না কেন?

পরম কি ইচ্ছে করলে তার গায়ের রংটা ছোড়দিকে দিয়ে দিতে পারে?

মাঝে-মাঝেই সে প্রশ্নটা মাথায় ঘোরে, এবার সেটা বলে ফেলল পরম।

আবার দীপালির মাথায় হাত রেখে সে জিগ্যেস করল, বিয়ে না হলে কী হয় রে ছোড়দি?

 দীপালি চোখ মুছে, খানিকটা শান্ত হয়ে বলল, যা, শুয়ে পড় ছোটু, অনেক রাত হয়েছে। কাল ইস্কুল আছে না?

পরম তবু জিগ্যেস করল, বল না! মেয়েদের কেন বিয়ে করতে হবেই? কাকু তো বিয়ে করেনি। দীপালি এবার বলল, ছেলেদের কথা আলাদা। মেয়েদের অবস্থা হয় শান্তি পিসির মতন। ঝি-গিরি করতে হয় পরের বাড়িতে।

পরম আর কোনও অবিবাহিতা রমণীর কথা মনে করতে পারল না। কিন্তু একটা যুক্তি তার মাথায় এল।

সে বলল, শান্তি পিসির তো মা-বাবা কেউ নেই।

দীপালি বলল, মা, বাবা কারুর চিরকাল থাকে না। বুড়ো বয়েসে আমি কোথায় যাব? আমি কোনও ভালো চাকরিও পাব না!

দীপালি পাড়ার একটা স্কুলে বাচ্চাদের আঁকা শেখায়। মাইনে পায় অতি সামান্য।

দীপালি পার্ট-টু পরীক্ষায় পাশ করতে পারেনি। প্রথমবার টাইফয়েড হল, পরীক্ষা দিতেই পারল না। দ্বিতীয়বার দিতে বসে সে কেঁদেছিল, তার কিছু মনে পড়েনি।

ছেলেবেলা থেকেই তার আঁকার হাত ভালো। কিন্তু আঁকা শেখানোর কথা কেউ ভাবেনি, এখন নিজে নিজে বড়জোর ফুল পাখি আঁকতে পারে।

পরম বলল, আমি তো বড় হয়ে চাকরি করব। তুই আর আমি থাকব একসঙ্গে।

দীপালি বলল, মিত্তিরবাড়ির অর্চনাদিকে দেখিস না? আমার অবস্থা হবে সেই রকম। অর্চনাদি বিধবা হওয়ার পর দাদার সংসারে থাকে। বউদি কীসব বিচ্ছিরি গালাগালি দেয়। ভালো করে খেতেও দেয় না। তপনদাও কিছু বলে না। ওরকম ভাবে বেঁচে থাকার বদলে মরে যাওয়াও। ভালো!

পরম বলল, তপনদাটা বাজে লোক। সক্কলের সঙ্গে ঝগড়া করে।

দীপালি বলল, আমি তো দেখেছি, ছোটবেলায় তপনদা ঘুড়ি ওড়াত, আর লাটাই ধরত অর্চনাদি। এখন সারাদিনে তপনদা একটাও কথা বলে না অর্চনাদির সঙ্গে। বিয়ের পর মানুষ বদলে যায়।

কেন বদলে যায়?

বউ এলে তখন সেটা হয় বউয়ের সংসার। বউয়ের কথা মতনই সব কিছু চলে। যারা আশ্রিত হয়ে থাকে, তাদের লাথি-ঝাঁটা খেতেই হয়।

বউরা কেন এরকম করে?

তুই বড় হবি, একসময় বিয়ে করবি, তখন এসব বুঝবি।

আমি বিয়েই করব না।

আহা-হা, তোকে আর পাকামি করতে হবে না। ঘুমো বলছি না?

সত্যি বলছি, আমি বিয়ে করব না। কিছুতেই করব না!

কেন করবি না? তুই আমাদের বাড়ির একমাত্র ছেলে, তুই বড় হবি, বিয়ে করবি, বাবা-মায়ের নাতি-নাতনি হবে, তাদের কত আনন্দ হবে। ততদিনে শান্তি পিসি মরে গেলে, তার জায়গাটা নিতে হবে আমাকে। আর বাবা-মাও যদি মরে যায়, তাহলে আমি হব সেই সংসারের বোঝা।

আমি বিয়ে করব না, করব না, করব না!

আবার পাকামি? এই বয়সে তোকে বিয়ের চিন্তা করতে কে বলেছে? শুতে যা বলছি!

ছোড়দি, তুমি শুনে রাখখা! আমি প্রতিজ্ঞা করেছি, বিয়েটা একটা বিচ্ছিরি ব্যাপার, আমি কোনওদিনই বিয়ে করব না।

প্রতিজ্ঞা করেছিস? ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা নাকি?

পরম মহাভারত পড়েছে। তাই জোর দিয়ে হ্যাঁ, ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা। তুমি দেখো! তুমি আর আমি একসঙ্গে থাকব।

সে রাত্রি প্রায় কেটে গিয়েছিল বিনা ঘুমে।

সেই প্রতিজ্ঞার কথা ভোলেনি পরম।

স্কুল ছেড়ে প্রেসিডেন্সি কলেজে ভরতি হয়েও সে মেয়েদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মেশেনি। তার জেদ ছিল পড়াশুনোয়।

সে সুদর্শন তরুণ, নামকরা ছাত্র, তার দিকে সহপাঠিনী তো আকৃষ্ট হবেই। কিন্তু সে তাদের কারুর সঙ্গেই নিরিবিলিতে দেখা করতে চায়নি। অনেক জনের দলের মধ্যে সে হাসিঠাট্টাতেও যোগ দেয়, কিন্তু কেউ তাকে একা পায় না।

কেমিস্ট্রিতে এম. এস সি পাশ করার পর রিসার্চ করতে-করতেই সে একটা ভালো চাকরি পেয়ে গেল বড় একটা ওষুধ কোম্পানিতে। তখন তার মা-বাবা তার বিয়ের জন্য তো চিন্তা করবেনই।

সে প্রসঙ্গ উঠলেই পরম হাত নেড়ে উড়িয়ে দেয়।

কেন যে পরম মেয়েদের ব্যাপারে নির্লিপ্ত, তা মা-বাবা জানবেন কী করে? শুধু ছোড়দি জানে।

দীপালিও মাঝে-মাঝে বলে, পরম, তুই এখনও সেই প্রতিজ্ঞার কথা ধরে বসে আছিস? ওসব প্রতিজ্ঞার কোনও মূল্য আছে নাকি? তখন তোর কম বয়েস ছিল, তখন মাথায় কত কী আসে। আমার জন্য তুই তোর জীবনটা নষ্ট করবি কেন? আমি বলছি, তুই বিয়ে কর। লক্ষ্মী ভাইটি আমার।

পরম শুধু হাসে। কম বয়েসে সে আবেগের মাথায় একটা প্রতিজ্ঞা করে বসেছিল, সেজন্য সে মোটেই আপশোশ করে না। এখন বুদ্ধি-বিবেচনা দিয়ে বোঝার পর বিয়ে জিনিসটারই প্রতি তার ঘেন্না ধরে গেছে। বিয়ে একটা কৃত্রিম সামাজিক বন্ধন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে মেয়েদের প্রতিই বন্ধন আর অবিচার হয় বেশি। পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্যা, নানারকম মোলায়েম প্রলেপ দিয়েও এই নীতিটাই তো চালু আছে এখনও।

বারো বছর বয়সে এক অন্ধকার রাতে ছোড়দির পাশে দাঁড়িয়ে একটা কঠিন প্রতিজ্ঞা করেছিল পরম। তারপর কেটে গেছে উনিশ বছর।

এরমধ্যে বদলে গেলে অনেক কিছু।

ক্যানসার ধরা পড়ার পর মাত্র পাঁচ মাসের মধ্যে চলে গেলেন মা। বাবা আর কলকাতায় থাকতেই চাইলেন না, জোর করেই চলে গেলেন হরিদ্বারের এক আশ্রমে।

সেই ভাড়াবাড়ি ছেড়ে দিয়েছে পরম, এখন সে কোম্পানির ফ্ল্যাট পেয়েছে যোধপুর পার্কে। দীপালির শেষপর্যন্ত বিয়ে হয়নি, সে-ই এখন সংসারের কত্রী। কোনদিন কী বাজার হবে, এমনকি পরম কোনদিন কী শার্ট পরবে, তাও ঠিক করে দেয় দীপালি। অবসর সময়ে সে ছবি আঁকে। অনেকটা উন্নতি করেছে।

সেই শান্তি পিসি রয়ে গেছে এখনও। শান্তি পিসির মেজাজ খুব চড়া, মাঝে-মাঝেই ছোড়দির সঙ্গে টক্কর লাগে, কিন্তু তাতে মাথা গলায় না পরম। মেয়েরা এরকম ঝগড়া আসলে উপভোগই করে, এই তার ধারণা।

দিদির নামে পরম আলাদা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলে দিয়েছে, প্রতিমাসে সেখানে দেড় হাজার টাকা জমা হয়। সে টাকা দীপালি ইচ্ছে মতন খরচ করতে পারবে। পরমের কাছে হাত পাততে হবে না কখনও।

শান্তি পিসিই প্রথম দেখতে পেল দীপালির মৃতদেহ।

শীতকালের দুপুরে একবার ঘুমোলে শরীর এত ভারী হয়ে যায় যে চোখ আর খুলতেই চায় না। অনেকক্ষণ ধরেই শান্তি পিসি একটা পোড়ো গন্ধ পাচ্ছিল, একসময় বাধ্য হয়ে উঠে সারা বাড়ি খুঁজতে লাগল।

একতলার উঠোনে পড়ে আছে দীপালি। তখনও তার গায়ের আগুন জ্বলছে, প্রাণ বেরিয়ে গেছে আগেই।

অফিস থেকে ছুটে এসেছে পরম। পুলিশকে ফোন করা হয়েছে, পুলিশ না এলে লাশ সরানো যাবে না।

সেই লাশের পাশে একটা চেয়ারে নিথর হয়ে বসে আছে পরম, তার হাতে দীপালির শেষ চিঠি। অতি সংক্ষিপ্ত, আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়। পরম, তুই আমাকে ক্ষমা করিস। অশেষ পুণ্য করলে মানুষ তোর মতন ভাই পায় না।

পরম ভাবতে লাগল, ভুলটা হল কোথায়? সে নিজে বিয়ে করতে না চেয়ে দিদির জন্য বিরাট স্বার্থত্যাগ করেছে, তাও তো নয়। বিয়ে ব্যাপারটাই তার ঘোর অপছন্দ, সেকথা ছোড়দিকে। বুঝিয়েছে অনেকবার। বংশরক্ষার ব্যাপারেও তার কোনও মোহ নেই। এ-দেশের যা জনসংখ্যা, তাতে আর দু-চারটি যোগ না করলেও চলবে।

গার্গীকে দেখেই কি দিদির ভাবান্তর হল?

গার্গীর সঙ্গে পরমের পরিচয় হয়েছে বছরখানেক, অফিসে কাজের সূত্রে। সে একজন ডাক্তার। দুজনের রুচির মিল আছে, মনের তরঙ্গেরও যোগ হতে দেরি হয়নি। কিন্তু বিয়ের প্রশ্ন ওঠেনি একবারও। এ ব্যাপারে গার্গী যেন পরমের চেয়েও উগ্র, বিয়ে শব্দটাই সে সহ্য করতে পারে না। এবং সে মনে করে, আজ থেকে আগামী দশবছর প্রত্যেক শিক্ষিত নারীর সন্তান জন্ম দেওয়া নিষিদ্ধ করা উচিত। তার বদলে দত্তক নেওয়া উচিত অনাথ শিশুদের।

মনের মিল হলে ভালোবাসা হবে না কেন? পরস্পরের শরীরের প্রতি আকর্ষণও অস্বাভাবিক নয়। আর দুজনেই যখন বিয়ে করতে চায় না, তখন এর মধ্যে অন্যায় কিংবা দুর্নীতির প্রশ্নই বা আসবে কেন? অনেক সভ্য দেশে এরকম সম্পর্ক অনেকদিন চালু হয়ে গেছে।

এমনকি পরমের সঙ্গে এক বাড়িতেও থাকতে চায় না গার্গী। তার বাড়িতে রয়েছেন একমাত্র বিধবা মা। আর একটি পালিত শিশু। মাঝে-মাঝে পরমের সঙ্গে দেখা হবে, সেই তো ভালো।

সামনের সপ্তাহের ছুটিতে গার্গীর সঙ্গে পরম দার্জিলিং-এ কয়েকটা দিন কাটিয়ে আসবে ঠিক করেছিল। এর মধ্যে গার্গীর মায়ের সঙ্গে তার আলাপ হয়েছে, তিনি সব জানেন। গার্গীও এসেছিল ছোড়দির সঙ্গে দেখা করতে। গার্গীর এমনই প্রাণোচ্ছ্বল ব্যবহার, তাকে অপছন্দ করা কারুর পক্ষেই সম্ভব নয়। ছোড়দির আঁকা ছবি দেখেও সে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছে।

গার্গী চলে যাওয়ার পর ছোড়দিও বলেছিল, ভারি চমৎকার মেয়ে। এতদিনে তোর ঠিক যোগ্য

একটা মেয়েকে দেখলাম রে ছোটু। দেরি করিস না, ওকে বিয়ে করে ফ্যাল। পরম হাসতে-হাসতে বলেছিল, বিয়ে? বিয়ের কোনও প্রশ্নই নেই। ছোড়দি বলেছিল, কেন? ছোটবেলায় ওইসব বাজে প্রতিজ্ঞা-ট্ৰতিজ্ঞা ভুলে যা। আমি তো তোকে বলেছি, ওর সঙ্গে আমি ঠিক মানিয়ে নেতে পারব।

পরম বলেছিল, ছোড়দি, ও নিজেই বিয়ে-টিয়ের ঝঞ্চাট চায় না। আমরা মাঝে-মাঝে একসঙ্গে থাকব–

দীপালির মুখখানা ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছিল। আস্তে-আস্তে বলেছিল, বিয়ে না করেও একসঙ্গে থাকবি, ছিছি—

তারপর থেকেই দীপালি যেন আর স্বাভাবিক হতে পারেনি।

চিঠিখানা হাতে নিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পরম ভাবল, কেন গার্গীর সঙ্গে এই সম্পর্কটা ছোড়দি মানতে পারল না? একজন নারী হিসেবে অন্য নারীর প্রতি ঈর্ষা? কিংবা দিদি কি তাকে

প্রতিজ্ঞা থেকে মুক্তি দিতে চাইল? অথচ সেই প্রতিজ্ঞাটাই তো এখন অবান্তর হয়ে গেছে।

দীপালির বীভৎস, পোড়া শরীরটার দিকে একপলক চেয়েই মুখ ফিরিয়ে নিল পরম। দিদি বলেছিল, ছি, ছি!

নিজে সারাজীবন বিয়ের জন্য কত লাঞ্ছনা, কত অপমান সহ্য করেছে ছোড়দি। তবু বিয়ে ব্যাপারটার ওপর তার এত ভক্তিশ্রদ্ধা! অন্য সম্পর্ক মেনে নিতে পারল না।

<

Sunil Gangapadhyay।। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়