নিম্নগামী

স্নেহের বাবাজীবন অমিয়,

আমায় তুমি চিনিবা না। তোমার পিতাঠাকুর অকালে স্বর্গগত হইয়াছেন জানিয়া মর্মাহত হইলাম। এতদিন তোমাদের কোনও সন্ধানাদি জানিতাম না। সংবাদপত্রে তোমার পিতা শ্রীমান। ভক্তিপদর মৃত্যুসংবাদ দেখিয়া তোমাদের ঠিকানা জানিলাম। তোমাদের আদি নিবাস ফরিদপুর জেলার পুব মাইজপাড়া গ্রামে, এমনই আমি মনে করিতেছি, আশা করি ইহাতে কোনও ভুল নাই। ভক্তিপদ ও শক্তিপদকে আমি অতি বাল্যকাল হইতেই স্নেহ করি। যাহা হউক, এখন। কাজের কথা বলি। পুব মাইজপাড়া গ্রামে আমার দশকর্ম ভাণ্ডার দোকান ছিল, নিশ্চয় তোমার বাবা-কাকার নিকট সে দোকানের কথা শুনিয়াছ। তোমাদের পরিবার আমার খাতক ছিল। হিসাবপত্রে দেখিতেছি তাং তেরো শত ছাপ্পান্ন, তেইশে আষাঢ় পর্যন্ত আমার দোকান হইতে দুই শত বত্রিশ টাকার তৈজস ও একখানি লেপ বাবদ আরও একান্ন টাকা তোমরা ধারে লইয়াছ। আজও তাহা পরিশোধ করা হয় নাই। তুমি কৃতী হইয়াছ, আশা করি বংশের এই ঋণ তুমি জানিবা মাত্র শোধ করিয়া দিবে। আমি এই শনিবার অর্থাৎ ৪ঠা শ্রাবণ সকাল নয়টায় তোমার গৃহে যাইব। টাকার জোগাড় রাখিও।

ইতি
আং তোমার জ্যেঠা হরিনাথ পাইন

চিঠিখানা পড়ে দলা-মোচা করে ফেলে দিতে গিয়েও অমিয় থেমে গেল। তার মনটা বিস্বাদ হয়ে গেছে। এইরকম সময় কারুর সঙ্গে কথা বলতে হয়, নইলে শুধু নিজের ভেতরে-ভেতরে গজরে গেলে একটা বিষবাষ্প মনকে আরও দুর্বল করে দেয়।

সে জোরে ডাকল, বুলা, বুলা।

সাড়া পাওয়া গেল না। দুটি ঘরের ছোট ফ্ল্যাট। অর্থাৎ বুলা এখন বাথরুমে। সন্ধে থেকেই অন্ধকার। অফিস থেকে ফিরে খাবার টেবিলেই চুপ করে বসেছিল অমিয়, সামনে একটা। কেরোসিন ল্যাম্প জ্বলছে। বুলা চা তৈরি করে দিয়ে এই একটু আগেও তো এখানে বসে কথা। বলছিল। গরম লাগলেই বুলা বাথরুমে গিয়ে শাওয়ার খুলে তার নীচে দাঁড়ায়। অথচ বেরিয়ে এলেই তো আবার ঘাম হবে।

অমিয়র মনের মধ্যে রাগ জমছে। সে টেবিলের ওপর থেকে খবরের কাগজটা টেনে নিল। এটা বাংলা কত সাল? বাড়িতে একটি মোটে ইংরেজি কাগজ রাখা হয়, তাতে বাংলা তারিখ নেই। ক্যালেন্ডারও একটি মাত্র, বিদেশি কোম্পানির। তখন অমিয় মনে-মনে হিসেব করতে লাগল। বাংলা সালের সঙ্গে পাঁচশো তিরানব্বই যোগ করলে ইংরেজি বছর। তাহলে…তাহলে…উনিশ শো উনপঞ্চাশ।

অমিয় দাঁতে দাঁত চেপে কিছু চেপে কিছু একটা অস্ফুট খারাপ কথা বলল।

আধঘণ্টা বাদে বুলা যখন বাথরুম থেকে বেরুল, তখন অমিয় বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছে। সামনে রাস্তা ঘাট মিশমিশে অন্ধকার, দেখবার কিছু নেই।

বুলা পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলল, আজ যদি রান্না না করি…বাইরে কোথাও গিয়ে খেয়ে নিলে হয় না? সস্তা কোনও জায়গায়…

মাসের তিন তারিখ মাত্র, এখন দু-একদিন এরকম বিলাসিতা করা যায়। অমিয় বলল, চলো, কটার সময় যাবে, সাড়ে আটটা? এখন তুমি মিনিটদশেক সময় দিতে পারবে, তোমার সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই।

বুলা একটু আড়ষ্ট হয়ে বলল, কী ব্যাপার, হঠাৎ গলার আওয়াজ এমন গম্ভীর হয়ে গেল যে!

—শোনো একটা ব্যাপারে আমার মেজাজটা খিচড়ে গেছে। তোমার সঙ্গে আলোচনা করলে আমার মনটা একটু হালকা হতে পারে। কিন্তু সেটা এক হিসেবে স্বার্থপরতাও হবে। আমার খারাপ-লাগাটা তোমার মনের মধ্যেও ছড়িয়ে যাবে খানিকটা।

–কী হয়েছে বলো তো?

—এই চিঠিটা পড়ো।

বুলাকে খাবারের টেবিলের আলোর কাছে গিয়ে পড়তে হল। ফিরে এসে বলল, এটা কি অদ্ভুত চিঠি?

—মনে হচ্ছে, এই শনিবার এক দ্বিতীয় শাইলক আসতে চাইছে আমাদের বাড়িতে।

—টাকা চাইছে তোমার কাছে। কী ব্যাপার কিছু বুঝতে পারলুম না। তোমার জ্যাঠামশাই হন?

—আমার কোনও জ্যাঠামশাই নেই। এই লোকটা কীরকম পাজি ভেবে দ্যাখো, বাবা মারা যাওয়ার খবর কাগজে দেখে লোকটা আমাকে লিখেছে, আসল উদ্দেশ্য টাকা চাওয়া।

—কীসের টাকা? তৈজস, লেপ এসব তোমার বাবা কিনেছিলেন ওই ভদ্রলোকের কাছ থেকে?

—কী করে আমি জানব? কবেকার কথা বলছে জানো? নাইনটিন ফর্টি নাইন, তখন আমি জন্মাইনি। আমার জন্মের আগে বাবা কারুর কাছ থেকে কিছু ধার করেছিলেন কি করেননি, সেই টাকা ওই লোকটা আমার চাইছে হাইট অব অডার্সিটি!

—এতদিন চায়নি কেন?

…তার মানে বাবা ধার করেননি ওর কাছ থেকে। এসব মিথ্যে কথা। কাকা আগেই মারা গেছেন, বাবাও গেলেন, তাই ও এখন আমার সেন্টিমেন্টে সুড়সুড়ি দিয়ে টাকাটা বাগিয়ে নিতে চাইছে। ওঁরা বেঁচে থাকলে জোচ্চুরিটা ধরে ফেলতেন।

—এরকমভাবে টাকা চায়, আমি আগে কখনও শুনিনি।

—লোকটা অতি নীচ। মানুষের এমন নীচতা আমি সহ্য করতে পারি না। যারা অন্যকে ঠকিয়ে নিজের সুখ চায়, তারা নরকের কীট।

—তুমি বেশ রেগে যাচ্ছ।

—রাগব না? ও আমাকে এমন বোকা ভেবেছে।

—তোমার মাকে জিগ্যেস করো ব্যাপারটা।

–কাগজে খবরটা দেখেই লোকটা মনে-মনে এই মতবল ভেঁজেছে। কিন্তু আমার ঠিকানা পেল কী করে?

–কাগজের রিপোর্টেই তো ছিল।

–কাগজে আমাদের বাড়ির ঠিকানা ছিল? না তো।

—ছিল না?

অমিয়র বাবা বিখ্যাত লোক ছিলেন না। তবু তাঁর মৃত্যু সংবাদ ও ছবি ছাপা হয়েছিল প্রায় সব খবরের কাগজের প্রথম পাতায়। স্কুল মাস্টারি থেকে রিটায়ার করেছিলেন, সাতষট্টি বছর বয়েসে, তাঁর স্বভাব ছিল রাস্তায়-রাস্তায় টো-টো করে ঘুরে বেড়ানো। কেন যে তিনি ভোরবেলা রাজভবনের সামনে গিয়েছিলেন তা কেউ জানে না। ওই সময় রাস্তা ফাঁকা থাকে তবু তিনি গাড়ি চাপা পড়লেন। কলকাতায় প্রত্যেক দিনই দু-তিনজন গাড়ি চাপা পড়ে মরে, খবরের কাগজে তারা এক লাইন দু-লাইন স্থান পায়, কিন্তু ভক্তিপদবাবু চাপা পড়েছিলেন, স্বয়ং রাজ্যপালের গাড়ির নীচে। সে গাড়িতে রাজ্যপাল তখন ছিলেন, না ছিলেন না, সে সম্পর্কে মতভেদ আছে, কিন্তু মুমূর্ষু ভক্তিপদবাবুকে রাজভবনের মধ্যে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানেই তিনি শেষ নিশ্বাস ফেলেন। সেইজন্যই রিপোর্টারদের হুড়োহুড়ি। কয়েকজন রিপোর্টার এসেছিল অমিয়র কাছে। তার রি-অ্যাকশান জানতে।

ভক্তিপদ মৃত্যুর আগে বড় ছেলের নাম উচ্চারণ করেছিলেন, কিন্তু এ-বাড়িতে তিনি থাকতেন না। অমিয়র ছোট ভাই থাকে বেহালায়, মা-বাবা সেখানেই থাকতেন। বুলার সঙ্গে বিয়েটা মা ঠিক মেনে নিতে পারেননি।

বাবা নিজেই অমিয়কে বলেছিলেন, বেহালার বাড়িতে জায়গা এত কম, এখানে তুই নতুন বউকে নিয়ে কী করে থাকবি। একটা ফ্ল্যাট দেখে নে—যাওয়া আসা তো থাকবেই।

মৃত্যুর আগে ছ-মাস বাবার সঙ্গে দেখাই হয়নি অমিয়র। শ্রাদ্ধের পর একুশদিন কেটে গেছে, আজ সেজন্য একটু অনুতপ্ত বোধ করল অমিয়।

বুলা বলল, শনিবার লোকটা আসবে, তুমি কী বলবে?

অমিয় রুক্ষ গলায় বলল, দরজা থেকে ভাগিয়ে দেব। কিংবা আমি দেখা করব না, তুমি মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিয়ো। এইরকম লোভী লোকদের দেখলেই আমার মাথা গরম হয়ে যায়, হয়তো একটা থাপ্পড়ই মেরে বসব।

একটু বাদে, বাইরে বেরুবার জন্য যখন তৈরি হচ্ছে বুলা, অমিয় আবার উত্তেজিতভাবে বলল, আর একটা কথা মনে পড়েছে। আমার বাবা আমাদের দেশের বাড়িতে লাস্ট গিয়েছিলেন, নাইনটিন ফর্টি এইটে, তাহলে ফর্টি নাইনে কী করে বাবা ধার করে লেপ কিনবেন? লোকটা তাহলে কীরকম জোচ্চোর বুঝে দ্যাখো!

বুলা স্থিরভাবে তাকিয়ে রইল অমিয়র দিকে। তারপর বলল, তুমি বরং একটা চিঠি লিখে লোকটিকে আসতে বারণ করে দাও। তোমার যা মেজাজ দেখছি।

—শোনো, আমার বাবার জন্য আমি দু-তিনশো টাকা নিশ্চয়ই খরচ করতে পারি, কিন্তু কেউ একজন ঠেকিয়ে নেবে…

—চিঠি লেখ!

—অন্ধকারের মধ্যে কী করে চিঠি লিখব? সন্ধের পর কি বাড়িতে ফিরে কোনও কাজ করার উপায় আছে?

—আমাকে এমন ধমকাচ্ছ কেন, অন্ধকারের জন্য কি আমি দায়ী?

রাত্তিরবেলা বাইরে থেকে ওরা যখন ফিরল, তখন রাত সোয়া এগারোটা, বিদ্যুৎও তখনই এসেছে।

জুতো-টুতো না খুলেই চিঠি লিখতে বসে গেল অমিয়।

সবিনয় নিবেদন,

আমার বাবার কোনও বড় ভাই ছিল না। অচেনা কোনও লোক আমার কাছে নিজেকে যদি জ্যাঠা বলে জাহির করে, তাও আমি মোটেই পছন্দ করি না। পূর্ববঙ্গের একটি গ্রামে আমাদের একটি। পৈতৃক বাড়ি ছিল বটে কিন্তু সে বাড়ি বা সে গ্রাম আমি চোখে দেখিনি। সেই গ্রাম সম্পর্কে আমার কোনও দুর্বলতা থাকার কারণ নেই। আমার বাবা শেষবার দেশে গিয়েছিলেন, উনিশশো আটচল্লিশ সালে, তার পরের বছরেও তিনি আপনাদের দোকান থেকে কীভাবে ধারে জিনিসপত্র কিনলেন তা আমার বুদ্ধির অতীত। আমার জন্মের আগেকার সময়ের ধার শোধ করতে আপনি

আমায় কেন বলছেন, তাও বুঝতে পারলুম না। আমার বাড়িতে আপনার আসবার কোনও প্রয়োজন নেই।

নমস্কারান্তে
অমিয় মজুমদার

শেষ করার পর চিঠিটা দুবার পড়ল অমিয়। যথেষ্ট কড়া হল না। কিন্তু মুখের কথায় যত রাগ আসে, লিখতে গেলে তা অন্যরকম হয়ে যায়। দুটো ভাষা যে আলাদা।

আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ার পর বুলা বলল, এবারে কয়েকদিন তোমার মাকে নিয়ে এসে এখানে রাখো। বেহালার বাড়িতে সবসময় ওই স্মৃতির মধ্যে…

—মাকে তো অনেকবার বলেছি। মা আসতে চায় না। বেহালার বাড়িতে কতগুলো গাছ পুঁতেছে। তো, যদি অন্য কেউ জল না দেয়…মা এখন মানুষের চেয়ে গাছপালাদের বেশি পছন্দ করে—

কদিন না হয় আমি বাপের বাড়ি গিয়ে থাকতে পারি।

অমিয় কনুইতে ভর দিয়ে উঁচু হয়ে উঠে বলল, তার মানে?

বুলা স্বাভাবিক গলাতেই উত্তর দিল, আমি না থাকলে তখন উনি আসতে পারেন। তুমি তো। বেহালায় যাওয়ার সময় পাও না, উনি এখানে এসে থাকলে তবু তোমার সঙ্গে কথাটথা বলতে পারবেন। সেটা এ সময়ে খুব দরকার।

—তুমি থাকলে আসবেন না, তুমি না থাকলে আসবেন, এর মানে কী?

—আমি না থাকলে তোমার দেখাশোনার জন্যও তো উনি আসতে পারেন।

—আমার মা তোমার সঙ্গে কোনওদিন খারাপ ব্যবহার করেছেন?

—না, খারাপ ব্যবহার কখনও করেননি। বরং দু-একসময় এত বেশি ভালো ব্যবহার করেন যে আমার লজ্জা করে।

—তাহলে, তুমি কী বলতে চাও?

—উনি আমাকে পছন্দ করেননি, এখনও করেন না। সে তো হতেই পারে। সবার সবাইকে ভালো লাগবে তার কোনও মানে নেই। আমি তোমার মাকে খুব একটা পছন্দ করি না, কিন্তু কোনওদিন কি খারাপ ব্যবহার করেছি?

অমিয় হঠাৎ চুপ করে গেল। তার মনে পড়ল বাবার মুখ। বাবা বুদ্ধিমান ছিলেন, মা আর বুলার মাঝখানের এই ফাটলটা বাবা বুঝতেন, কিন্তু তিনি নিরপেক্ষ থাকতেন। এখন প্রায়ই ছেলেবেলার কথা মনে পড়ছে। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার, এর মধ্যে একদিনও অমিয় বাবাকে স্বপ্নে দেখেনি।

কয়েকদিন পরেই চিঠিটার উত্তর এল।

স্নেহের বাবাজীবন অমিয়,

এই শনিবার আমি তোমার বাটিতে যাইতে পারি নাই তাহার কারণ পূর্বরাত্রে, অর্থাৎ শুক্রবারে আমার জ্বর আসিল। টেম্পারেচার তেমন বেশি নহে, এক শতের মধ্যেই, কিন্তু সর্বাঙ্গে বেদনা। তবু যাইতে পারিতাম কিন্তু বড় ঝড় বৃষ্টি হইল। সোদপুরের এ বাটি হইতে সাইকেলরিক্সা যোগে স্টেশনে যাইতে হয়। রাস্তা ভালো নহে, ঝড় বৃষ্টিতে খুবই অসুবিধা। ট্রেনেরও কী যেন গোলযোগ ছিল। এইসব কারণে যাওয়া হইল না।

তোমার পত্র পাইয়াছি। তুমি আমার পত্রের মর্ম ভুল বুঝিয়াছ। পিতৃঋণ কখনও রাখিতে নাই। পিতার যাবতীয় ঋণ যে পুত্র শোধ করিয়া দিয়া যায়, সে পুত্র মহাপুণ্যবান হয়। আমার দোকান হইলে তোমার বাবা-কাকারা ধারে যাহা খরিদ করিয়াছিলেন, তা তোমারই বংশের ঋণ। সংবাদপত্রে দেখিলাম তুমি চাকুরি ভালোই করিতেছ। সুতরাং পিতার এই সামান্য ঋণের বোঝা তুমি সানন্দে মস্তকে পাতিয়া নিবে, তাহাই তোমাকে স্মরণ করাইয়া দিয়াছি। লক্ষ্য করিয়াছ নিশ্চয়, তিরিশ বৎসরের অধিক সময় পার হইলেও আমি সেই অর্থের কোনও সুদ চাহিনাই। চক্রবৃদ্ধি হারে ধরিলে কত টাকা হইতে পারিত, তারা তুমি ভালোই বুঝিবে। কিন্তু সেরূপ আমি চাহিতে পারি না, তোমরা আমার স্নেহের ধন। যাহা হউক, আমি আগামী রবিবার, ইং ১৪ তারিখে অবশ্যই তোমার বাসায় যাইব। তুমি টাকার জোগাড় রাখিও। দুই শত বত্রিশ ও একান্ন, একুনে দুইশত তিরাশি দিলেই তুমি দায়মুক্ত হইবে।

তোমার পিতা আমাকে দাদা বলিয়া ডাকিত, সেই সূত্রে আমি তোমার জ্যেঠা। বউমা ও নাতি নাতনীদের আমার স্নেহাশীর্বাদ দিও।

ইতি
হরিনাথ পাইন

আজও অফিস থেকে ফিরে অন্ধকারের মধ্যে বসে লণ্ঠনের আলোয় অমিয় পড়ল চিঠিটা, সঙ্গে সঙ্গে তিরিক্ষি হয়ে গেল তার মেজাজ।

বুলা চিঠিটা আগেই পড়েছে। আজ কোনও কারণে তার মনটা বেশ ফুরফুরে আছে। অফিস থেকে ফিরেই সে নতুন ধরনের কিছু একটা রান্নার জোগাড়-যন্তর করছে।

বুলা বলল, তোমার এই বুড়ো কিন্তু মহা ঘুঘু। কী কায়দায় চিঠিটা লিখেছে দেখেছ?

অমিয় চেঁচিয়ে বলল, ওলড সোয়াইন। শনিবার আসতে পারেনি বলে লম্বা ফিরিস্তি দিয়েছে, অথচ আমি ওকে আসতে বারণ করেছি।

–তোমাকে পুণ্যের লোভ দেখিয়েছে। তুমি এতবড় একটা পুণ্য করার সুযোগ পাচ্ছ, উনি তো তোমার উপকারই করছেন!

—কত বড় শয়তান! যারা এইরকম ধর্মের দোহাই দেয়, তারা নিজেরা যে কত পাপ করে।

—যাই বলল, ভদ্রলোকের হাতের লেখাঁটি সুন্দর, আগেকার দিনের মতন টানা-টানা, বেশ গুছিয়ে লিখতে পারেন। একটা কথা ঠিকই লিখেছে, গ্রাম সম্পর্কে সবাই সবাইকে কাকা-জ্যাঠা বলে। তোমার বাবা ওঁকে দাদা বলে ডাকতেন সেই সূত্রে উনি তো আমার জ্যাঠা হতেই পারেন।

—তুমি কী করে জানলে? তুমি তো কখনও গ্রামে থাকনি!

—এটা সবাই জানে।

—ব্যাটা মুদি আবার আমাকে চক্রবৃদ্ধি হারে সুদের ভয় দেখিয়েছে! আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি, পুরো ব্যাপারটাই ভাঁওতা। কোনও রকমে ব্যাটা আমাদের গ্রামের নাম আর বাবা-কাকার নাম জেনেছে।

—তোমার মাকে জিগ্যেস করো, উনি নিশ্চয়ই বলতে পারবেন।

—হ্যাঁ, মায়ের সঙ্গে দেখা করতে হবে। আজ অফিসে খোকন এসেছিল, ওকে বলতে ভুলে গেলুম।

—খোকন এসেছিল? কী বলল?

—এমনিই…বিশেষ কিছুনা…না এখন কান্নাকাটি কম করছে, অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে গেছে।

—খোকনকে বলোনি, মাকে কিছুদিনের জন্য এ-বাড়িতে পাঠিয়ে দিতে?

—না বলিনি।

অমিয় উঠে চলে গেল জামাকাপড় ছাড়তে। রান্নাঘরের গ্যাস স্টোভের সামনে গিয়ে দাঁড়াল বুলা। তার মুখে মৃদুমৃদু হাসি। স্বামী-স্ত্রী দুজনের সংসার। দু-জনেই চাকরি করে। বাসন মাজা, কাপড় কাচার একজন ঠিকে লোক আছে শুধু, সর্বক্ষণের লোক পাওয়া যায়নি। অফিস থেকে ফিরে এক একদিন বুলার রান্না করতে ইচ্ছে করে না। আবার এক-একদিন বেশ রান্না নিয়ে মেতে থাকে। অমিয় তাকে পেঁয়াজ কুঁচিয়ে আলু কেটে সাহায্য করে।

অমিয় আবার রান্নাঘরে এসে বলল, আর একখানা কড়া চিঠি লিখে দিই, কী বলো? রবিবার যদি

সত্যিই লোকটা আসে, মেজাজ সামলাতে পারব না।

বুলা বলল, আসুক না, লোকটাকে আমার দেখতে ইচ্ছে করছে।

—কুটিল, নীচ টাইপের লোকদের কাছাকাছি দাঁড়ালেই আমার গা ঘিনঘিন করে।

—আমার কিন্তু বুদ্ধিমান বদমাসদের দেখতে বেশ লাগে। আসুক না লোকটা। সেদিন আমাদের দরজার কাছটায় সাবান জল ছড়িয়ে রাখব, যাতে এসেই ও আছাড় খেয়ে পড়ে।

বুলা বেশ শব্দ করে হেসে উঠল। অমিয় বলল, তুমি হাসছ, কিন্তু আমি ব্যাপারটা একেবারে সহ্য করতে পারছিনা!

বুলা আরও জোরে হেসে বলল, নাতি-নাতনীদের আশীর্বাদ…হো-হো-হো। বিয়ের আগেই ওরা ঠিক করেছিল, প্রথমে তিন বছর ওরা কোনও বাচ্চা-কাচ্চা চায় না। তারপর একটু গুছিয়ে নিলে সে সম্পর্কে ভাবা যাবে। দু-মাস আগে ওদের তৃতীয় বিবাহবার্ষিকী উদযাপিত হয়ে গেছে।

অমিয় বুলার পিঠে হাত রাখল।

বুলা মুখ ফিরিয়ে বলল, আজ তোমায় একটা ভালো খবর দেব।

বুকটা কেঁপে উঠল অমিয়র। অনেক গল্প-উপন্যাসে এইরকম সিচুয়েশান এইরকম সংলাপ পড়েছে সে। সিনেমাতে দেখেছে। এই কথার একটাই অর্থ হতে পারে।

গল্পের চরিত্রের মতনই কণ্ঠস্বরে খানিকটা অতিরিক্ত আবেগ এনে, বুলাকে দু-হাতে ধরে, নিজের দিকে টেনে এনে বলল, সত্যি? বুলা সত্যি?

বুলা হাসতে-হাসতে বলল, তুমি কী ভাবলে বলো? না, না, তা নয়।

—তবে? কী ভালো খবর?

—আজ একটা ইনভার্টারের অর্ডার দিয়েছি। ব্যাটারি সমেত সবসুষ্ঠু পড়বে চব্বিশ শো টাকা। বেশ সস্তা নয়? তাও ইনস্টলমেন্টে দেওয়া যাবে। আমাদের অফিসের এক কলিগ এজেন্সি নিয়েছে। অনেক কমিশন পাওয়া গেল। দু-দিনের মধ্যেই এসে যাবে।

কোথায় যেন বিরাট শব্দে একটা বজ্রপাত হল। কেউ যেন সজোরে এক থাপ্পড় কষিয়েছে অমিয়র মুখে।

বুলাকে ছেড়ে দিয়ে সে নিষ্প্রাণ, বিবর্ণ গলায় বলল, তুমি অর্ডার দিয়েছ? ও!

–হ্যাঁ, দেখেছ তো অবস্থা। প্রত্যেকদিন দশ-বারো ঘণ্টা লোডশেডিং। সারাদিন খাটাখাটনির পর বাড়িতে এসে…অন্ধকার…পাখা নেই, কোনও কাজ করা যায় না। তোমার মেজাজ খারাপ হয়ে থাকে…তাই দেখলুম যখন অনেকটা কনসেশানে পাওয়া যাচ্ছে।

–দ্যাখো, চায়ের জল ফুটে গেছে।

—এতে তিনটে আলো-পাখা চলবে। বুঝলে আমাদের তো তার বেশি দরকার নেই…পাখা ছাড়া আমি একদম ঘুমোতে পারি না, কদিন ধরে এমন গুমোট চলছে…কালকে জানো তো, ভোর চারটেয় কারেন্ট চলে গেল, অমনি আমার ঘুম ভেঙে গেল, তুমি তো কিছু টেরও পাওনি!

—তাই বুঝি?

—তুমিও অফিস থেকে ফিরে লেখাপড়ার কাজ করতে পারবে। হঠাৎ থেমে গিয়ে বুলা তার স্বামীর দিকে তীক্ষ্ণভাবে চেয়ে রইল। অমিয় তখন রান্নাঘর ছেড়ে যেতে উদ্যত।

বুলা বলল, শোনো! কী ব্যাপার বলোতো? তুমি হঠাৎ এমন ঠান্ডা হয়ে গেলে? খবরটা শুনে তুমি

খুশি হওনি মনে হচ্ছে? বউয়ের টাকায় ইনভার্টার কেনা হচ্ছে তোমার মনে লেগেছে নাকি।

—আরে না, না।

—আমার টাকা আর তোমার টাকা আলাদা?

—কি ছেলেমানুষি কথা বলছ! ওরকম বোকা-বোকা চিন্তা আমার মাথায় কখনও আসে না। সত্যি বেশ সস্তায় পেয়েছ। আমার ধারণা ছিল তিন হাজার টাকার কমে হয় না। সেইজন্যই তো আমি কিনতে ভয় পাচ্ছিলাম, তা ছাড়া শ্রাদ্ধের জন্য বেশ কিছু টাকা খরচ হয়ে গেল।

—এটা ইনস্টলমেন্টে পাচ্ছি, এটুকু বিলাসিতা আমরা করতে পারি।

—মোটেই বিলাসিতা নয়…সন্ধে হলেই অন্ধকার—এইভাবে আধুনিককালের সভ্য মানুষ বাঁচতে পারে?

কথা বলতে-বলতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল অমিয়। তারপর খাটে গিয়ে চিত হয়ে শুয়ে রইল।

তার মনের মধ্যে একটা প্রবল যাতনা হচ্ছে। এখন বুলার সঙ্গে গল্প করলেও এই কষ্টটা দূর করা যাবে না। অথচ একলা শুয়ে থাকলে কষ্টটা বাড়বে। ট্রানজিসটার নিয়ে সে কাঁটা ঘোরাতে লাগল।

এক সময় তার ইচ্ছে হল আছাড় মেরে রেডিওটা ভেঙে ফেলতে। সে ইচ্ছে দমন করে সে নিজেই শিস দিয়ে একটা গান বাজাতে লাগল।

স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের একটা সূক্ষ্ম বোঝাপড়া থাকে। আবার এমন কিছু কথাও থাকে, যা এত কাছের দুজন মানুষও পরস্পরকে বলতে পারে না।

পরদিন সকালবেলা বাথরুম থেকে বেরিয়েই বুলা বলল, তোমাকে একটা কথা জিগ্যেস করতে চাই। কাল ইনভার্টারের কথা শুনেই তুমি কীরকম যেন অন্যমনস্ক হয়ে গেলে। কী হয়েছে বলো তো? ব্যাপারটা তোমার পছন্দ হয়নি? এখনও অর্ডারটা ক্যানসেল করে দিতে পারি।

—আরে না, না, পছন্দ হবে না কেন? রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে গরমে ঘামছিলুম, একটা ইনভার্টার তো আমাদের সত্যি এক্ষুনি দরকার, এত সস্তায় পাওয়া যাচ্ছে যখন।

–বাজে কথা বলো না। তোমার কী হয়েছে সত্যি করে বলো তো।

একটুক্ষণ চুপ করে থেকে অমিয় বলল, একটা কথা হঠাৎ মনে পড়ে গেল, তাই একটু খারাপ লাগছিস।

—কী কথা আমাকে বলা যায় না?

—হ্যাঁ, বলা যাবে না কেন?

—তবে কেন কালকে বললে না তক্ষুনি।

—তুমি তখন খুব খুশি মুডে ছিলে।

—এখন জানতে পারি?

ব্যাপারটা হয়েছে কী, বছরখানেক আগে খোকনের ছেলের মুখে ভাতে বেহালার বাড়িতে গিয়েছিলুম মনে আছে?

—আমার অফিসে অডিট ছিল বলে আমি সকালবেলা ঘুরে এসেছিলুম। তুমি দুপুরে খেতে গিয়েছিলে।

—হ্যাঁ, তাই হবে। অসহ্য গরম ছিল সেদিন। আমাদের বেহালার বাড়িটা জানো তো, একতলা, তিনদিক চাপা, একদম হাওয়া ঢুকতে চায় না। যেদিন গুমোট থাকে, সেদিন আর ঘরের মধ্যে বসে থাকা যায় না। বাবার একটু হাঁপানির টান ছিল। সেই গরমে একেবারে দম বন্ধ হয়ে। যাওয়ার মতন অবস্থা…সেদিন একটা ইনভার্টার কেনার কথা উঠেছিল…তা হলে বাবা-মা রাত্তিরে অন্তত একটু ঘুমোতে পারতেন।

—কিনে দাওনি কেন?

—খোকন বলেছিল ইনভার্টার মেশিনটা জোগাড় করবে, আমি ব্যাটারিটা পাঠিয়ে দেব…তারপর খোকন আর আমায় মনে করিয়ে দেয়নি।

—একথা তো তুমি আমাকে বলেনি। তাহলে আমি মনে করিয়ে দিতুম।

—বলিনি, তাই না? ভুলেই গিয়েছিলুম…সেদিন মা বলেছিলেন, তোর বাবা গরমের চোটে মাঝরাত্রে উঠে বসে থাকে। ভোর হতে-না-হতেই উঠে বাইরে যায়। হাঁপানি রুগির গরমে বড়। কষ্ট…আমার কি মনে হয় জানো বুলা, ওই যে সেদিন বাবা অত ভোরবেলা হাঁটতে বেরিয়েছিলেন, তাও ওই গরমের জন্য বোধহয়।

—শুধু ব্যাটারি কেন, পুরো ইনভার্টারটাই তোমার কিনে দেওয়া উচিত ছিল। আমরা ধার করেও কিনে দিতে পারতুম।

—উচিত তো অনেক কিছুই থাকে, আবার অনেক কিছুই করা হয়ে ওঠে না। এইসব ভুলের জন্য আমাদের আত্মগ্লানি হয়, কিন্তু স্ত্রীর কাছ থেকে কোনটা উচিত কোনটা উচিত নয়, তা শুনতে ভালো লাগে না।

—এই ব্যাপারটা যদি তুমি সেই এক বছর আগেই আমায় বলতে তাহলে একটা কিছু ব্যবস্থা হয়ে যেত নিশ্চয়ই।

—তা ঠিক। তুমি আমার চেয়ে অনেক বেশি এফিসিয়েন্ট।

—তাহলে কি আমাদেরটা এখন কেনা উচিত নয়?

—না, না, না, এসব ন্যাকামির কোনও মানে হয় না। যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে। মানুষ বর্তমান নিয়ে বাঁচে।

—তোমার মা-কে কিছুদিন এখানে এনে রাখো। এই গরমে উনি তবু একটু আরাম করতে পারবেন।

হঠাৎ বুলার ওপর চটে গেল অমিয়। বুলা কেন যে এই কথাটা বারবার বলে!

*

রবিবার সকালে চা খাওয়ার পর বুলা বলল, আজ কিন্তু সেই ঘোড়েল বুড়োটি আসবে। তোমার মার কাছে গিয়ে একদিন জিগ্যেস করে এলে না?

অমিয় চমকে উঠল। এই কদিন নানান কাজে সে ওই চিঠির প্রসঙ্গ ভুলেই গিয়েছিল, মায়ের সঙ্গেও দেখা করা হয়ে ওঠেনি। বেহালায় যাতায়াত করাও কম ঝামেলা নয়।

অমিয় বলল, আমি এক্ষুনি কেটে পড়ছি বাড়ি থেকে। তুমি ম্যানেজ করো।

বুলা বলল, আমি কী কথা বলব? আমি তোমাদের গ্রামের কথা কিছুই জানি না।

—আমিই বা কী জানি। কোনওদিন দেখিনি, শুধু গল্প শুনেছি। তবে আই অ্যাম শিওর, ও লোকটা মিথ্যেবাদী। বাবা তো কোনওদিন আমায় কোনও পুরোনো ধারের কথা বলেননি। এইরকম একটা স্বার্থপর লোককে দেখলে আমি যদি বেশি মেজাজ খারাপ করে ফেলি, সেটা কী ভালো হবে?

—কিন্তু আমি ওকে কী করে ট্যাকল করব বলো তো?

—তুমি বলে দিও, সামনের রবিবার আসতে, এর মধ্যে আমি সব খবর নিয়ে নিচ্ছি।

কিন্তু অমিয় বেরুবার আগেই দরজায় বেল বাজল। দরজা খুলল বুলা। এবং সে কিছু বোঝবার আগেই এক বৃদ্ধ এই যে বউমা, নাও বলেই তার হাতে তুলে দিলেন একটা মিষ্টির হাঁড়ি।

ফর্সা, ছোটখাটো চেহারা বৃদ্ধটির। বয়েস অন্তত আশি তো হবেই। পরিষ্কার সাদা পাঞ্জাবি ও ধুতি পরা, হাতে একটি রুপো বাঁধানো লাঠি। দেখলে গ্রাম্য মুদি বলে মনে হওয়ার কোনও উপায় নেই। সঙ্গে একটা তেরো-চোদ্দো বছরের কিশোরী মেয়ে। তার হাতে একটি পাকা কাঁঠাল।

ভেতরে ঢুকেই বদ্ধ বললেন, এইটি আমার নাতনী, সঙ্গে আনলাম, আইজ কাল তো একা-একা চলাফিরা করতে পারি না। ওরে পুষ্প, কাঁঠালটা নামাইয়া রাখ, প্রণাম কর, প্রণাম কর, কই বাবাজীবন কোথায়?

অমিয় শোওয়ার ঘরে পালাবার উদ্যোগ করছিল, কিন্তু তার আগেই বৃদ্ধ ঘরে ঢুকে পড়ায় সেন যযৌ ন তন্থৌ অবস্থায় কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। লাঠি ঠুকতে-ঠুকতে সেদিকে এগিয়ে এসে বৃদ্ধ বললেন, আমার দ্বিতীয় চিঠিখান পাইছিলা নিশ্চয়? দ্যাখো, ঠিক আইলাম।

বুলা ভুরু কুঁচকে বলল, এসব এনেছেন কেন?

বৃদ্ধ একগাল হেসে বললেন, গ্রামের মানুষের বাড়িতে আইলাম, মিষ্টি হাতে ছাড়া কি আসা যায়? আর কাঁঠালটা আমাগো বাড়িতে হইছে। সোদপুরে বাড়ি করছি। তেরো কাঠা জমি, দুইখান আম গাছ, দুইখান কাঁঠাল গাছ, একখান জম্বুরা গাছও আছে–। তোমাগো দ্যাশের বাড়িতে খুব ভালো বাগান ছিল…

কিশোরী মেয়েটি এসে অমিয়কে প্রণাম করল। বৃদ্ধটি দু-পা জোড়া করে অমিয়র দিকে এমনভাবে তাকিয়ে রইলেন, যেন তিনিও প্রণাম প্রত্যাশী। কিন্তু বুলা কিংবা অমিয় ওসবের ধার ধারে না।

বুলা মেয়েটিকে জিগ্যেস করল, তোমার নাম কী? তুমি কোন ক্লাসে পড়ো?

বদ্ধ এগিয়ে এসে অমিয়র কাঁধে হাত দিয়ে গাঢ় গলায় বললেন, তোমার বাবার মৃত্যু সংবাদ দেইখ্যা দুঃখ পাইছি ঠিকই, আবার আনন্দও হইছে। মরতে তো হবেই সকলেরে, তবু এমন মৃত্যু কয়জনের হয়? কোথা থিকা যাত্রা আর কোথায় শেষ। পূর্ব বাংলার গ্রামের মাটির উঠোনে জন্ম আর মৃত্যু হইল কইলকাতার লাটসাহেবের বাড়িতে। কাগজে-কাগজে ছবি!

এইধরনের কথায় নাক কুঁচকে যায় অমিয়র। লাটসাহেব? এরা কোন যুগে আছে—

কিন্তু অমিয় একজন ভদ্রলোক। একজন বুড়ো লোক বাড়িতে মিষ্টি-ফিষ্টি নিয়ে এসেছে, সঙ্গে আবার একটা বাচ্চা মেয়ে, এখন কড়া কথায় অপমান করা যায় না। সে গম্ভীরভাবে বলল, আপনি বসুন, আগে কাজের কথাটা সেরে নেওয়া যাক।

বৃদ্ধ উদারভাবে বললেন, না, না, কাজের কথা কিছু নাই। অ্যামনই দেখা করতে আইছি। আমার মেজো ছেলে তোমার চিঠিখান পড়ছে। সে আমারে কইল, বাবা, আপনে…

মাঝপথে বাধা দিয়ে অমিয় বলল, খাতাপত্র কিছু এনেছেন?

—কীসের খাতাপত্তর?

—আপনাদের দোকানের হিসেবের খাতা? আমার বাবার কোনও সই আছে। উপযুক্ত প্রমাণ না পেলে আমি আপনাকে বিশ্বাস করব কী করে? যে-কেউ এসেই তো টাকা চাইতে পারে। বৃদ্ধ চোখ বুজে, মুখে চুক-চুক করে বললেন, আমি কি তোমারে মিথ্যা কমু? আমাগো সে সম্পর্ক না।

—দেখুন আপনাকে আমি চিনি না। আমাদের গ্রাম আমি কখনও চোখে দেখিনি। বাবার কাছে কোনও ঋণের কথাও আমি শুনিনি। আমার মা হয়তো কিছু জানতে পারেন, তাঁর কাছে খোঁজ খবর নেওয়া হয়নি এখনও

—তোমার মায় কোথায়? কেমন আছেন তিনি?

—মা অন্য জায়গায় থাকেন, ভালো আছেন। কিন্তু কোনও নির্দিষ্ট প্রমাণ না পেলে আমি আপনার দাবি মেনে নিতে পারব না।

—শোনো, তাহলে তোমারে বুঝাইয়া কই।

এরপর বৃদ্ধ অনেকখানি কথা বলে গেলেন। তার মর্ম হচ্ছে এই যে, শুধু এক গ্রামে নয়, প্রায়। কাছাকাছি বাড়ি ছিল অমিয়র পূর্বপুরুষদের এবং এই বৃদ্ধদের। এদের বেশ বড় মুদিখানা ছিল, তিন-চারখানা গ্রামের মধ্যে একমাত্র দোকান। অমিয়র বাবা কলকাতায় চাকরি করতে আসেন, সেইসময় দেশে তাঁদের পরিবারের অবস্থা বেশ খারাপ হয়ে পড়ে। যুদ্ধের সময় জিনিসপত্রের দামও খুব বেড়ে যায়, দেশের বাড়িতে সেই সময় অমিয়র ঠাকুরদা, ঠাকুমা আর বিধবা পিসিমা থাকতেন। ধারে জিনিসপত্র না কিনে তাঁদের বেঁচে থাকার কোনও উপায় ছিল না। তারপর তো দেশ ভাগ হয়ে গেল, অনেক ডামাডোল শুরু হল।

অমিয় বলল, আমার বাবা সেই ধার এতদিন শোধ করেননি!

—শোনো, বাবা, আমার দুই পরিবার ছিলাম অনেকখানি আপনা-আপনির মইধ্যে। সেই বাজারে আড়াইশো তিনশো টাকা মানে অনেক টাকা। এখনকার দুই তিন হাজার তো হবেই। অত টাকার মাল কেউ কি বাকিতে দেয়? আমি পনেরো-কুড়ি টাকার বেশি হাওলাৎ দিতাম না কারুরে। তোমার বাবারে আমি ছুট ভাইয়ের মতন দ্যাখতাম। যুদ্ধের শ্যাষ দিকে সে বেতন পায় নাই, বড় কষ্টের মধ্যে আছিল, তবু আমি জানতাম, সে সৎ মানুষ, ভগবানে বিশ্বাস করে, সে আমাকে। কোনওদিন ঠকাইতে পারবে না। তার সাথে আর দেখা হইল না, সবই তো দূরদৃষ্ট! ওই ল্যাপের কথা আমি লেখছি, তুমি সেই ল্যাপর কথা জানো?

বুলা কিশোরী মেয়েটিকে জলখাবার দিয়ে আর-একটা প্লেট নিয়ে ওদের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে।

সে জিগ্যেস করল, ল্যাপ মানে?

অমিয় বলল, লেপ। শীতকালে গায়ে দেবার।

বৃদ্ধ বললেন, তোমার ঠাকুর্দারে আমরা সকলডিই বড় খুড়া কইতাম! তুমি দ্যাখছো তোমার ঠাকুর্দারে? ও, না, তোমার জন্মের আগেই তো তিনি গত হইছেন। খুব উঁচাদরের মানুষ আছিলেন বড় খুড়া। যেমন সইত্যবাদী আর তেমন রাগী। তেনার কথা কইতে গেলে অনেক কইতে হয়। যাহা হউক, তোমার বাবা যখন শ্যাষবার দ্যাশে গ্যালেন…

—নাইনটিন ফট্টি এইট।

—সেই সময়ে তোমার ঠাকুর্দার একেবারে যায়-যায় অবস্থা। নিউমোনিয়া হইছিল। খবর পাইয়া তোমার বাবায় তারে দ্যাখতে গেল। কবিরাজ জবাব দিয়া দিছে, চিকিৎসার কিছু নাই, তোমার বাপে তবু চেষ্টার তুরুটি করে নাই। তার নিজেরও তখন চাকরি নাই, অনেক কষ্ট কইরা দ্যাশে আইছে। মরার দুইদিন আগে তোমার ঠাকুরদার সে সকি কাঁপুনি! থরথর কইরা কাঁপে আর চিখায়, শীত, মলাম রে, বড় শীত। উঃ-উঃ বড় শীত! বাড়িতে কাঁথা-কম্বল যত ছিল সব চাপা দিল, তবু শীত যায় না। একসময় বড় খুড়ো কইল, ভক্তি আমারে নতুন ল্যাপ আইন্যা দে। লাল। রঙের ল্যাপ। আমার শীত করে, আমারে বাঁচা, আমারে লাল ল্যাপ দে। তখন ভক্তিপদ দৌড়াইয়া আইল আমার দোকানে, কইল কি, হরিদাদা, য্যামন কইরা পারো আমারে একটা লাল ল্যাপ দাও। আমার বাবার শেষ সাধ, এ না মিটাইলে আমি নরকে যামু। আমার কাছে টাকা নাই, হরিদাদা, তুমি একখান লাল ল্যাপ দাও। আমি যেমন কইরা পারি তোমারে এই টাকা শোধ দিমু। আমি কইলাম, ওরে ভক্তি, তোর বাপে শীতে কষ্ট পায়, তিনি আমাগো বড় খুড়া, তার জন্য ল্যাপ দিমু না, নিশ্চয় দিমু। লাল ল্যাপ তো এস্টকে ছিল না, তয় লাল কাপড় আছিল, এক ঘণ্টায় ল্যাপ বানাইয়া দিলাম। সে ল্যাপ তোমার ঠাকুরদা গায় দিছে, গায় দিয়া কইছে, আঃ বড় আরাম, তারপর মরছে।

একটুক্ষণ সবাই চুপ করে রইল। এমনিই নিস্তব্ধতা যে পাখা ঘোরার আওয়াজ পর্যন্ত শোনা যায়।

গলা পরিষ্কার করে অমিয় বলল, বহুদিন আগেকার কথা, এর মধ্যে বাবা সেই ধার শোধ করার চেষ্টা করেননি? আপনাদের তো আর যোগাযোগ হয়নি?

বৃদ্ধ বললেন, তার দোষ নাই, এর পরের সনেই পাকিস্তানে বড় রকম গোলমাল শুরু হইল, আমার দোকানে আগুন লাগাইয়া দিল, আমার বড় ছেলে মারা গেল, আমরা দ্যাশ ছাইড়া পালাইলাম। কে কোথায় গেল তার ঠিক নাই। আমরা গিয়া ঠ্যাকলাম ফুলিয়ায়। তোমার বাবা কোথায় থাকেন তাও জানি না, সে-ও জানে না আমরা কোথায়।

বুলা চোখ দিয়ে ইঙ্গিত করল অমিয়কে। অমিয় উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমি আপনাকে ক্যাশ দিতে পারছিনা, চেক দিয়ে দিচ্ছি।

খপ করে অমিয়র হাত ধরে বৃদ্ধ বললেন, আরে না, না, সেই কথাই তোকইতে আইছি। আমার মেজো ছেলে এখন পাটের কম্পানিতে ভালো চাকরি করে, ছোট ছেলেটিও ব্যবসায় নামছে। সোদপুরে বাড়ি করছি। ভগবানের আশীর্বাদে এখন আর আমাগো অভাব নাই! তোমার চিঠিখানা আমার মেজো ছেলে দ্যাখছে। সে আমারে খুব বকল। কইল কি, বাবা, আপনে এতদিন পরেও। ওই সামান্য টাকার জন্য মানুষরে বিরক্ত করতে আছেন? ছি ছি! আপনি ক্ষমা চাইয়া চিঠি। লেখেন। আমি যত কই যে আমি শুধু টাকার জন্যই চিঠি লিখি নাই, তা সে শোনে না। পুতের বউ সেই কথাই কয়। তাই তোমার কাছে আজ আইছি।

অমিয় বলল, না, না, আপনি তো ঠিক কাজই করেছেন, টাকা নেবেন না কেন? বিপদের সময় আমাদের পরিবারকে সাহায্য করেছেন, এখন সেই ধার শোধ করা তো আমাদের কর্তব্য নিশ্চয়ই।

বৃদ্ধ বলল, না, না, না, সে টাকা আমি কিছুতেই নিতে পারব না। তাইলে আমার পোলারা আমার মুখ দ্যাখবে না। তুমি ও টাকা আমারে নিতে কইয়ো না।

—আপনি আমাদের ঋণী করে রাখবেন?

—আমি দুইদিন পরে মইরা যামু, আমার কাছে আর ঋণ কি! ও টাকা আমি দাদুভাই আর দিদিভাইদের আশীর্বাদ হিসাবে দিয়া গ্যালাম। কই, নাতি-নাতনীরা কোথায়, তাদের দেখছি না যে?

<

Sunil Gangapadhyay।। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়