চমৎকুমারী

বক্রেশ্বর দাস সরকারী গুণ্ডা দমন বিভাগের একজন বড় কর্মচারী। শীতের মাঝামাঝি এক মাসের ছুটি নিয়ে নববিবাহিত পত্নী মনোলোভার সঙ্গে সাঁওতাল পরগনায় বেড়াতে এসেছেন। সঙ্গে বুড়ো চাকর বৈকুণ্ঠ আছে। এঁরা গণেশমুণ্ডায় লালকুঠি নামক একটি ছোট বাড়িতে উঠেছেন। জায়গাটি নির্জন, প্রাকৃতিক দৃশ্য মনোহর।

বক্রেশ্বরের বয়স চল্লিশ পেরিয়েছে, মনোলোভার পচিশের নীচে। বক্রেশ্বর বোঝেন যে তিনি সুদর্শন নন, শরীরে প্রচুর শক্তি থাকলেও তাঁর যৌবন শেষ হয়েছে। কিন্তু মনোলোভার রূপের খুব খ্যাতি আছে, বয়সও কম। এই কারণে বক্রেশ্বরের কিঞ্চিৎ হীনতাভাব অর্থাৎ ইনফিরিয়রিটি কমপ্লেক্স আছে।

প্রভাত মুখুজ্যে মহাশয় একটি গল্পে একজন জবরদস্ত ডেপুটির কথা লিখেছেন। একদিন তিনি যখন বাড়িতে ছিলেন না তখন তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে এক পূর্বপরিচিত ভদ্রলোক দেখা করেন। ডেপুটিবাবু তা জানতে পেরে স্ত্রীকে যথোচিত ধমক দেন এবং আগন্তুক লোকটিকে আদালতী ভাষায় একটি কড়া নোটিস লিখে পাঠান। তার শেষ লাইনটি (ঠিক মনে নেই) এইরকম। বারদিগর এমত করিলে তোমাকে ফৌজদারি সোপর্দ করা হইবে। সেই ডেপুটির সঙ্গে বক্রেশ্বরের স্বভাবের কিছু মিল আছে। দরিদ্রের কন্যা অল্পশিক্ষিতা ভালমানুষ মনোলোভা তাঁর স্বামীকে চেনেন এবং সাবধানে চলেন।

জিনিসপত্র সব গোছানো হয়ে গেছে। বিকেল বেলা মনোলোভ বললেন, চল চম্পীদিদির সঙ্গে দেখা করে আসি। তিনি ওই তির সিংগা পাহাড়ের কাছে লছমনপুরায় আছেন, চিঠিতে লিখেছিলেন আমাদের এই বাসা থেকে বড় জোর সওয়া মাইল।

বক্রেশ্বর বললেন, আমার ফুরসত নেই। একটা স্কীম মাথায় এসেছে, গভরমেন্ট যদি সেটা নেয় তবে দেশের সমস্ত বদমাশ শায়েস্তা হয়ে যাবে। এই দুটির মধ্যেই স্কীমটা লিখে ফেলব। তুমি যেতে চাও যাও, কিন্তু বৈকুণ্ঠকে সঙ্গে নিও।

—বৈকুণ্ঠর ঢের কাজ। বাজার করবে, দুধের ব্যবস্খা করবে, রান্নার যোগাড় করবে। আর ও তে অথর্ব বুড়ো, ওকে সঙ্গে নেওয়া মিথ্যে। আমি একাই যেতে পারব, ওই তো তিরসিংগা পাহাড় সোজা দেখা যাচ্ছে।

–ফিরতে দেরি করো না, সন্ধ্যের আগেই আসা চাই।

 

লছমনপুরায় পৌঁছে মনোলোভা তাঁর চম্পীদিদির সঙ্গে অফুরন্ত গল্প করলেন। বেলা পড়ে এলে চম্পীদিদি ব্যস্ত হয়ে বললেন, যা যা শিগগির ফিরে যা, নয়তো অন্ধকার হয়ে যাবে, তোর বর ভেবে সারা হবে। আমাদের দুটো চাকরই বেরিয়েছে, নইলে একটাকে তোর সঙ্গে দিতুম। কাল সকালে আমরা তোর কাছে যাব।

মনোলোভ তাড়াতাড়ি চলতে লাগলেন। মাঝপথে একটা সর, নদী পড়ে, তার খাত গভীর, কিন্তু এখন জল কম। মাঝে মাঝে বড় বড় পাথর আছে, তাতে পা ফেলে অনায়াসে পার হওয়া যায়। নদীর কাছাকাছি এসে মনোলোভা দেখতে পেলেন, বাঁ দিকে কিছু দূরে চার-পাঁচটা মোষ চরছে, তার মধ্যে একটা প্রকাণ্ড শিংওয়ালা জানোয়ার কুটিল ভঙ্গীতে তাঁর দিকে তাকাচ্ছে। মোষের রাখাল একটি ন-দশ বছরের ছেলে। সে হাত নেড়ে চেঁচিয়ে কি বলল বোঝা গেল না। মনোলোভা ভয় পেয়ে দৌড়ে নদীর ধারে এলেন এবং কোনও রকমে পার হলেন, কিন্তু ওপারে উঠেই একটা পাথরে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলেন। উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করলেন, পারলেন না, পায়ের চেটোয় অত্যন্ত বেদনা।

চারিদিক জনশূন্য, সেই রাখাল ছেলেটাও অদশ্য হয়েছে। অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। আতঙ্কে মনোলোভার বুদ্ধিলোপ হল। হঠাৎ তাঁর কানে এল।

–একি, পড়ে গেলেন নাকি?

লম্বা লম্বা পা ফেলে যিনি এগিয়ে এলেন তিনি একজন ব্যুঢ়োরস্ক বৃষস্কন্ধ পুরুষ, পরনে ইজার, হাঁটু পর্যন্ত আচকান, তার উপর একটা নকশাদার শালের ফতুয়া, মাথায় লোমশ ভেড়ার চামড়ার আাকান টুপি।

মনোলোভার দুই হাত ধরে টানতে টানতে আগন্তুক বললেন, হেইও, উঠে পড়ুন। পারছেন না। খুব লেগেছে? দেখি কোথায় লাগল।

হাত পা গুটিয়ে নিয়ে মনোলোভা বললেন, ও আর দেখবেন কি, পা মচকে গেছে, দাঁড়াবার শক্তি নেই। আপনি দয়া করে যদি একটা পালকি টালকি যোগাড় করে দেন তো বড়ই উপকার হয়।

–খেপেছেন, এখানে পালকি তাঞ্জাম চতুর্দোলা কিছুই মিলবে না, স্ট্রেচারও নয়। আপনি কোথায় থাকেন? গণেশমুণ্ডায় লাল কুঠিতে? আপনারাই বুঝি আজ সকালে পৌঁছেছেন? আমি আপনার পায়ে একটু মাসাজ করে দিচ্ছি, তাতে ব্যথা কমবে। তার পর আমার হাতে ভর দিয়ে আস্তে আস্তে হেঁটে বাড়ি ফিরতে পারবেন। যদি মচকে গিয়ে থাকে, চুনে-হলদে লাগালেই চট করে সেরে যাবে।

বিব্রত হয়ে মনোলোভা বললেন, না না আপনাকে মাসাজ করতে হবে না। হেঁটে যাবার শক্তি আমার নেই। আপনি দয়া করে আমাদের বাসায় গিয়ে মিস্টার বি দাসকে খবর দিন তিনি নিয়ে যাবার যা হয় ব্যবস্থা করবেন।

—পাগল হয়েছেন? এখান থেকে গিয়ে খবর দেব, তার পর দাস মশাই চেয়ারে বাঁশ বেধে লোকজন নিয়ে আসবেন, তার মানে অন্তত পঁয়তাল্লিশ মিনিট। ততক্ষণ আপনি অন্ধকারে এই শীতে একা পড়ে থাকবেন তা হতেই পারে না। বিপদের সময় সংকোচ করবেন না, আপনাকে আমি পাঁজাকোলা করে নিয়ে যাচ্ছি।

-কি যা তা বলছেন!

–কেন, আমি পারব না ভেবেছেন? আমি কে তা জানেন? গগনচাঁদ চক্কর, গ্রেট মরাঠা সার্কসের স্ট্রং ম্যান। না না, আমি মরাঠী নই, বাঙালী বরেন্দ্র ব্রাহ্মণ, চক্রবর্তী পদবীটা ছেঁটে চক্কর করেছি। সম্প্রতি টাকার অভাবে সাকস বন্ধ ছিল, তাই এখানে আসবার ফরসত পেয়েছি। আজ সকালে আমাদের ম্যানেজার সাপুরজীর চিঠি পেয়েছি—সব ঠিক হয়ে গেছে, দু হপ্তার মধ্যে তোমরা পনায় চলে এস। জানেন, আমার বুকের ওপর দিয়ে হাতি চলে যায়, দু হন্দর বারবেল আমি বনবন করে ঘোরাতে পারি। আপনার এই শিঙি মাছের মতন একরত্তি শরীর আমি বইতে পারব না?

–খবরদার, ও সব হবে না।

—কেন বলুন তো? আপনি কি ভেবেছেন আমি রাবণ আর আপনি সীতা, আপনাকে হরণ করতে এসেছি। আপনাকে আমি বয়ে নিয়ে গেলে আপনার কলঙ্ক হবে, লোকে ছিছি করবে?

–আমার স্বামী পছন্দ করবেন না।

–কি অদ্ভুত কথা! অমন রামচন্দ্র স্বামী জোটালেন কোথা থেকে? বিপদের সময় নাচার হয়ে আপনাকে যদি বয়ে নিয়ে যাই তাতে আপত্তির কি আছে? আপনার কত বুঝি মনে করবেন আমার ওপর আপনার অনুরাগ জন্মেছে, আমার পশে আপনি পুলকিত হয়েছেন, এই তো? একবার ভাল করে আমার মুখখানা দেখুন তো, আকর্ষণের কিছু আছে কি?

পকেট থেকে একটা প্রকাণ্ড টর্চ বার করে গগনচাঁদ নিজের শ্রীহীন মুখের ওপর আলো ফেললেন, তার পর বললেন, দেখুন, লোকে আমার মুখ দেখতে সার্কসে আসে না, শুধু গায়ের জোরই দেখে। আমার এই চাঁদবদন দেখলে আপনার স্বামীর মনে কোনও সন্দেহই হবে না।

মনোলোভা বললেন, কেন কি করে সময় নষ্ট করছেন। আপনার চেহারা সুশ্রী না হলেও লোকে দোষ ধরতে পারে।

–ও, বুঝেছি। আপনার চিত্তবিকার না হলেও আমার তো আপনার ওপর লোভ হতে পারে—এই না? নিশ্চয় আপনি নিজেকে খুব সুন্দরী মনে করেন। একদম ভুল ধারণা, মিস চমৎকুমারী ঘাপার্দের কাছে আপনি দাঁড়াতেই পারেন না।

—তিনি আবার কে?

গগনচাঁদ চক্কর তাঁর ফতুয়ার বোতাম খুললেন, আচকানেরও খুললেন, তার নীচে যে জামা ছিল, তারও খুললেন। তার পর মুখে একটি বিহ্বল ভাব এনে নিজের উন্মুক্ত লোমশ বুকে তিনবার চাপড় মারলেন।

মনোলোভা প্রশ্ন করলেন, আপনার প্রণয়িনী নাকি?

—শুধু প্রণয়িনী নয় মশাই, দস্তুরমত সহধর্মিণী। তিন মাস হল দুজনে বিবাহবন্ধনে জড়িত হয়ে দম্পতি হয়ে গেছি।

–তবে মিস চমৎকুমারী বললেন কেন? এখন তো তিনি শ্রীমতী

-আঃ, আপনি কিছুই বোঝেন না। মিস চমৎকুমারী ঘাপার্দে হল তাঁর স্টেজ নেম, আমেরিকান ফিল্ম অ্যাকট্রেসরা যেমন পঞ্চাশবার বিয়ে করেও নিজের কুমারী নামটাই বজায় রাখে, সেইরকম আর কি। চমৎকুমারী হচ্ছেন গ্রেট মরাঠা সার্কসের লীডিং লেড়ি, বলবতী ললনা। যেমন রুপ, তেমনি বাহবল, তেমনি গলার জোর। একটা প্রমাণ সাইজ গর, কিংবা গাধাকে উপ করে কাঁধে তুলে নিয়ে ছুটতে পারেন। আবার ছুটন্ত ঘোড়ার পিঠে এক পায়ে দাঁড়িয়ে একটা হাত কানে চেপে অন্য হাতে তারা নিয়ে ধুপদ খেয়াল গাইতে পারেন। মহারাষ্ট্রী মহিলা, কিন্তু অনেক কাল কলকাতায় ছিলেন, চমৎকার বাঙলা বলেন। আপনার স্বামীর সঙ্গে তাঁর মোলাকাত করিয়ে দেব। চমৎকুমারীকে দেখলেই তিনি বুঝতে পারবেন যে আমার হদয় শক্ত খুটিতে বাঁধা আছে, তার আর নড়ন চড়ন নেই।

–আপনি আর দেরি করবেন না, দয়া করে মিস্টার দাসকে খবর দিন।

–কি কথাই বললেন! আমি চলে যাই, আপনি একলা পড়ে থাকুন, আর বাঘ কি হড়ার কি লক্কড় এসে আপনাকে ভক্ষণ করকে। শুনতে পাচ্ছেন? ওই শেয়াল ডাকছে। আপনার হিতাহিত জ্ঞান এখন লোপ পেয়েছে, কোনও আপত্তিই আমি শুনবো না। চুপ, আর কথাটি নয়।

নিমেষের মধ্যে মনোলোভাকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে গগন চাঁদ সবেগে চললেন। মনোলোভা ছটফট করতে লাগলেন। গগনচাঁদ বললেন, খবরদার হাত পা ছুড়বেন না, তা হলে পড়ে যাবেন, কোমর ভাঙবে, পাঁজরা ভাঙবে। এত আপত্তি কিসের? আমাকে কি অচ্ছুত হরিজন ভেবেছেন না সেকেলে বঠঠাকুর ঠাউরেছেন যে ছুঁলেই আপনার ধর্মনাশ হবে? মনে মনে ধ্যান করুন—আপনি একটা দুরন্ত খুকী, রাস্তায় খেলতে খেলতে আছাড় খেয়েছেন, আর আমি আপনার

স্নেহময়ী দিদিমা, কোলে করে তুলে নিয়ে যাচ্ছি।

আপত্তি নিষ্ফল জেনে মনোলোভা চুপ করে আড়ষ্ট হয়ে রইলেন। গগনচাঁদ হাতের মুঠোয় টর্চ টিপে পথে আলো ফেলতে ফেলতে চললেন।

 

বক্রেশ্বর দাস দুজনকে দেখে আশ্চর্য হয়ে বললেন, একি ব্যাপার?

গগনচাঁদ বললেন, শোবার ঘর কোথায়? আগে আপনার স্ত্রীকে বিছানায় শুইয়ে দিই, তার পর সব বলছি। এই বুঝি আপনার চাকর? ওহে বাপ, শিগগির মালসা করে আগুন নিয়ে এস, তোমার মায়ের পায়ে সেক দিতে হবে।

মনোলোভাকে শুইয়ে গগনচাঁদ বললেন, মিস্টার দাস, আপনার স্ত্রী পড়ে গিয়েছিলেন, ডান পায়ের চেটো মচকে গেছে। চলবার শক্তি নেই, অথচ কিছুতেই আমার কথা শুনবেন না, কেবলই বলেন, লে আও পালকি, বোলাও দাস সাহেবকো। আমি জোর করে একে তুলে নিয়ে এসেছি। অতি অবুঝ বদরাগী মহিলা, সমস্ত পথটা আমাকে যাচ্ছেতাই গালাগাল দিতে দিতে এসেছেন।

মনোলোভ অস্ফুট স্বরে বললেন, বাঃ, কই আবার দিলুম!

বক্রেশ্বর একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলেন। এখন গরম হয়ে বললেন, তুমি লোকটা কে হে? ভদ্রনারীর ওপর জলম কর এতদূর আস্পর্ধা?

-অবাক করলেন মশাই। কোথায় একটু চা খেতে বলবেন, অন্তত কিঞ্চিৎ থ্যাংকস দেবেন, তা নয়, শুধুই ধমক!

-হু আর ইউ? কেন তুমি ওঁর গায়ে হাত দিতে গেলে?

-আরে মশাই, ওঁকে যদি নিয়ে না আসতুম তা হলে যে এতক্ষণ বাঘের পেটে হজম হয়ে যেতেন, আপনাকে যে আবার একটা গিন্নীর যোগাড় দেখতে হত।

—চোপরও বদমাশ কোথাকার। জান, আমি হচ্ছি বক্রেশ্বর দাস আই.এ, এস, গণ্ডা কন্ট্রোল অফিসার, এখনি তোমাকে পুলিসে হ্যাণ্ড ওভার করতে পারি?

–তা করবেন বইকি। স্ত্রী যন্ত্রণায় ছটফট করছেন সেদিকে হুঁশ নেই, শুধু আমার ওপর তশি। মুখ সামলে কথা কইবেন মশাই, নইলে আমিও রেগে উঠব। এখন চললুম, নির্মল মুখুজ্যে ডাক্তারকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।

বক্রেশ্বর তেড়ে এসে গগনচাঁদের পিঠে হাত দিয়ে ঠেলতে ঠেলতে বললেন, অভি নিকালো।

গগনচাঁদ বেগে চলতে লাগলেন, বক্রেশ্বের পিছু পিছ গেলেন। কিছুদূর গিয়ে গগনচাঁদ বললেন, লড়তে চান? আপনার স্ত্রী একটু সুস্থ হয়ে উঠুন তার পর লড়বেন। যদি সবর করতে না পারেন তো কাল সকালে আসতে পারি।

বক্রেশ্বর বললেন, কাল কেন, এখনই তোকে শায়েস্তা করে দিচ্ছি। জানিস, আমি একজন মিডলওয়েট চ্যাম্পিয়ন? এই নে, দেখি কেমন সামলাতে পারিস।

গগনচাঁদ ক্ষিপ্রগতিতে সরে গিয়ে ঘুষি থেকে আত্মরক্ষা করলেন এবং বক্রেশ্বরের পায়ের গুলিতে ছোট একটি লাথি মারলেন। সঙ্গে সঙ্গে বক্রেশ্বর ধরাশায়ী হলেন।

গগনচাঁদ বললেন, কি হল দাস মশাই, উঠতে পারছেন না? পা মচকে গেছে। বেশ যা হক, কাগিন্নীর এক হাল। ভাববেন না, আপনাকে তুলে নিয়ে গিন্নীর পাশে শুইয়ে দিচ্ছি, তার পর ডাক্তার এসে চিকিৎসার ব্যবস্থা করবে।

বক্রেশ্বর বললেন, ড্যাম ইউ, গেট আউট ইহাঁ সে।

-ও, আমার কোলে উঠবেন না? আচ্ছা চললম, আর কাউকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।

 

বক্রেশ্বর বেশ শক্তিমান পুরুষ, ভাবতেই পারেন নি যে ওই বদমাশ গুণ্ডাটা তাঁর প্রচণ্ড ঘুষি এড়িয়ে তাঁকেই কাবু করে দেবে। শুধু ডান পায়ের চেটো মচকায় নি, তাঁর কাঁধও একটু থেঁতলে গেছে। তিনি ক্ষীণ কণ্ঠে ডাকতে লাগলেন, বৈকুণ্ঠ, ও বৈকুণ্ঠ।

প্রায় পনরো মিনিট বক্রেশ্বর অসহায় হয়ে পড়ে রইলেন। তার পর নারীকণ্ঠ কানে এল—অগ্‌গ বাঈ! হে কায়? কায় ঝালা তুমহালা?–ওমা, এ কি? কি হয়েছে আপনার?

বক্রেশ্বর দেখলেন, কাছা দেওয়া লাল শাড়ি পরা মহিষমর্দিনী তুল্য একটি বিরাট মহিলা টর্চ হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। বক্রেশ্বর বললেন, উঃ বড় লেগেছে, ওঠবার শক্তি নেই। আপনি-আপনি কে?

—চিনবেন না। আমি হচ্ছি চমৎকুমারী ঘাপার্দে, গ্রেট মরাঠা সার্কসের বলবতী ললনা।

-আপনি যদি দয়া করে ওই লালকুঠিতে গিয়ে আমার চাকর বৈকুণ্ঠকে পাঠিয়ে দেন–

–আপনার চাকর তো রোগা পটকা বড়ো, আপনার এই দু-মনী লাশ সে বইতে পারবে কেন? ভাববেন না, আমিই আপনাকে পাঁজা কোলা করে তুলে নিয়ে যাচ্ছি।

-সেকি, আপনি?

-কেন, তাতে দোষ কি, বিপদের সময় সবই করতে হয়। ভাবছেন আমি অবলা নারী, পারব না? জানেন, আমি একটা পরষ্ট গাধাকে কাঁধে তুলে নিয়ে দৌড়াতে পারি?

কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বক্রেশ্বর ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন। চমৎকুমারী খপ করে তাঁকে তুলে নিয়ে বললেন, ওকি, অমন কুকড়ে গেলেন কেন, লজ্জা কিসের? মনে করুন আমি আপনার মেলোমশাই, আপনি একটা পাজী ছোট ছেলে, আপনার চাইতেও পাজী আর একটা ছেলে লাথি মেরে আপনাকে ফেলে দিয়েছে, মেসোমশাই দেখতে পেয়ে কোলে তুলে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছেন।

চমৎকুমারী তাঁর বোঝা নিয়ে হনহন করে হেঁটে তিন মিনিটের মধ্যে লালকুঠিতে পৌঁছলেন এবং বিছানায় মনোলোভার পাশে ধপাস করে ফেলে বক্রেশ্বরকে শুইয়ে দিলেন। বক্রেশ্বর করণে স্বরে বললেন, উহহ, বড় ব্যথা। জান মনু, আমি হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়েছিলাম, ইনিই আমাকে বাঁচিয়েছেন, গ্রেট মরাঠা সার্কসের স্ট্রং লেডি মিস চমৎকুমারী ঘাপার্দে।

মনোলোভা অবাক হয়ে দু হাত তুলে নমস্কার করলেন।

নির্মল ডাক্তার তাঁর কম্পাউণ্ডারকে নিয়ে এসে পড়লেন। স্বামী শ্রীকে পরীক্ষা করে ডাক্তার বললেন, ও কিছু নয়, দুজনেরই পায়ে একটু স্পেন হয়েছে। একটা লোশন দিচ্ছি, তাতেই সেরে যাবে। তিন-চার দিন চলাফেরা করবেন না, মাঝে মাঝে ননের পুটলির সেক দেবেন। মিস্টার দাসের কাঁধে একটা ওষুধ লাগিয়ে ড্রেস করে দিচ্ছি।

যথাকর্তব্য করে ডাক্তার আর কম্পাউণ্ডার চলে গেলেন। চমৎকুমারী বললেন, আপনাদের চাকর একা সামলাতে পারবে না, আমি আপনাদের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করে তার পর যাব।

বক্রেশ্বর করজোড়ে বললেন, আপনি করুণাময়ী, যে উপকার করলেন তা জীবনে ভুলব না।

মনোলোভা মনে মনে বললেন, তা ভুলবে কেন, ওই গোদা হাতের জাপটানি যে প্রাণে সুড়সুড়ি দিয়েছে। যত দোষ বেচারা গগনচাঁদের।

বক্রেশ্বর বললেন, ডাক্তারবাবুর কাছে শুনলাম, আপনার স্বামী মিস্টার চক্করও এখানে আছেন। কাল বিকেলে আপনারা দুজনে দয়া করে এখানে যদি চা খান তো কৃতার্থ হব। আমার এক শালী কাছেই থাকেন, তাঁকে কাল আনাব, তিনিই সব ব্যবস্থা করবেন। আমার তো চলবার শক্তি নেই, নয়তো নিজে গিয়ে আপনাদের আসবার জন্যে বলতুম।

চমৎকুমারী বললেন, কাল যে আমরা তিন দিনের জন্যে রাঁচি যাচ্ছি। শনিবারে ফিরব। রবিবার বিকেলে আমাদের বাসায় একটা সামান্য টি-পার্টির ব্যবস্থা করেছি। চক্করের বন্ধু হোম মিনিস্টার শ্ৰীমহাবীর প্রসাদ, দমকার ম্যাজিস্ট্রেট খাস্তগির সাহেব, গিরিডির মার্চেই সর্দার গুরমুখ সিং এরা সবাই আসবেন। আপনারা দুজনে দয়া করে এলে খুব খুশী হব। কোনও কষ্ট হবে না, একটা গাড়ি পাঠিবে দেব। আসবেন তো?

বক্রেশ্বের বললেন, নিশ্চয় নিশ্চয়।

মনোলোভা মনে মনে বললেন, হেই মা কালী, রক্ষা কর।

<

Rajshekhar Basu।। রাজশেখর বসু