হারানো কাকাতুয়া – অদ্ভুতুড়ে সিরিজ – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

ঐ গবা পাগলা বেরিয়েছে। গায়ে একটা সবুজ রঙের আলপাকার কোট আর ভোলা কালো রঙের পাতলুন। বড়-বড় কটাশে চুল রোগাটে মাঝারি চেহারা। এক গাল দাড়ি, বিশাল মোচ। পায়ে খয়েরি রঙের ক্যামবিসের জুতো। হেঁকে বলছিল, “কেয়াসমাস! কেয়াসমাস! বর্বর ছেলেরা দৌড়িয়া ফেরে। সরল রেখা কাকে বলে? দুটি বিন্দুর মধ্যে ন্যূনতম দূরত্বই হচ্ছে সরলরেখা। এন এ সি এল ইজ সোডিয়াম ক্লোরাইড অ্যাণ্ড ইট ইজ কমন সলট। ভাস্কো ডা গামা ভারতবর্ষে আসে চোদ্দ শো আটানবৃই সালে………হেঁ হেঁ জানি বাবা, সব জানি।”

সকালবেলা হরিহরবাবু আর গদাধরবাবু বাজার করে ফিরছিলেন। গবা পাগলাকে দেখে হরিহরবাবু বিরক্ত হয়ে বললেন, “এঃ, আবার দেখি গবাটা উদয় হয়েছে! ছেলেপেলেগুলোর মাথা খাবে আবার!”

গদাধরবাবু একটু গম্ভীর হয়ে বললেন, “আপনার কথাটা মানতে পারছি না হরিহরবাবু। গবা পাগলা যে একজন ছদ্মবেশী বৈজ্ঞানিক এ কথা সবাই জানে।”

হরিহরবাবু তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললেন, “হ্যাঁ, বৈজ্ঞানিকরা তো আজকাল গাছে ফলে কিনা! পেরেছে গবা পাগলা আপনার দেয়ালঘড়িটা সারাতে?”

গদাধরবাবু একটু গরম হয়ে বললেন, “পেরেছে বই কী! আলবাত পেরেছে।”

হরিহরবাবু হোহো করে হেসে বলেন, “তাই বুঝি আপনার দেয়ালঘড়ির কাটা উল্টোদিকে ঘোরে?”

“সেইটেই তো বিস্ময়! আর কার ঘড়ির কাঁটা উল্টোদিকে ঘোরে বলুন তো? বৈজ্ঞানিক ছাড়া পারে কেউ ঘড়ির কাটাকে বিপরীতগামী করতে?”

এইভাবে হরিহরবাবু আর গদাধরবাবুর মধ্যে একটা তর্কবিতর্ক পাকিয়ে উঠছিল।

আগের দিন দুধের মধ্যে একটা কুঁচো চিংড়ি পেয়েছিলেন হালদারবাড়ির বুড়ি। তাই গয়লাকে বকছিলেন। গবা পাগলার সাড়া পেয়ে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এসে একগাল হেসে বলেন, “বাব্বাঃ! কতদিন পরে গবাসাধু আবার এ পোড়া শহরে ফিরেছে! এবার আমার কাকালের ব্যথাটার একটা হিল্লে হবে।”

গুণধরবাবু তাঁর বাগানে নেতিয়ে পড়া একটা লাউডগাকে মাচানে তুলছিলেন। চশমার ফাঁক দিয়ে গবা পাগলাকে দেখে গিন্নিকে ডাক দিয়ে বললেন, “গবা চোরটা আবার এসেছে জিনিসপত্র সব সামলে রেখো। সেবার ও হাওয়া হওয়ার পর থেকেই আমাদের দু দুটো কাসার বাটি গায়েব হল।”

দুই ভাই–আন্দামান আর নিকোবর জানালার ধারে বসে অ্যানুয়্যাল পরীক্ষার পড়া তৈরী করছিল। আন্দামান অঙ্কে কঁচা, নিকোবর কঁচা ইংরেজীতে।

আন্দামান গবা পাগলাকে জানালা দিয়ে দেখেই চাপা গলায় বলল, “আগের বারের মতো এবারেও গবাদা ঠিক পরীক্ষার সময় বাইরে থেকে চেঁচিয়ে অঙ্ক বলে দেবে। বাঁচা গেল বাবা, অঙ্ক নিয়ে যা ভাবনা ছিল!”

নিকোবরও চাপা গলায় বলল, “আমার কুড়ি নম্বরের ট্রানস্লেশনের ব্যবস্থাও হয়ে গেল।”

বোধনের সকালের পড়া হয়ে গেছে। এবার নেয়ে-খেয়ে স্কুলে যাবে। হাতে খানিকটা সময় আছে দেখে সে তার মহাকাশযানে কিছু যন্ত্রপাতি লাগাচ্ছিল। তার মহাকাশটানটা দেখলে যে-কেউ অবশ্য নাক সিঁটকাবে। কারণ সেটা আসলে একটা ফুলঝাটা। ঝাটার হাতলের সঙ্গে গোটা চারেক হাউই দড়ি দিয়ে শক্ত করে বাঁধা। ঝাটার সঙ্গে একটা কৌটোও বাঁধা আছে। তার ইচ্ছে ঐ কৌটোয় কয়েকটা পিঁপড়ে ছেড়ে দেবে। আজ সে মহাকাশযানের সঙ্গে মেজোকাকার সাধের পকেট-ট্রানজিসটার রেডিওটা চুপি-চুপি লাগিয়ে দিচ্ছিল। এমন সময় রাস্তায় গবা পাগলার হাঁকডাক শোনা গেল : “দেখবি যদি ভুতের নাচ, ধর বাগিয়ে বঁটাগাছ, ডিং মেরে ওঠ গাধার পিঠে।নখুড়োর ঘর পেরিয়ে ঈশানকোণে যা হারিয়ে, লাগবে হাওয়া মিঠে। দেখতে পাবি তিনঠেঙে গাছ, তাহার ডালে ঝুলতেছে মাছ নীচে গহিন ছায়া। সেই ছায়ারই কায়া ধরে ভুত-ভুতুড়ে অদ্ভুতুড়ে নাচতেছে সব মায়া……..”

বোধন দৌড়ে রাস্তার ধারে গিয়ে চেঁচিয়ে বলে, “ও গবাদা! মঙ্গলগ্রহ থেকে জ্যান্ত পাথর এনে দেবে বলেছিলে যে! সেইসব পাথর নাকি আপনা থেকেই গড়িয়ে-গড়িয়ে চলে ছোট থেকে বড় হয়, রেগে গেলে একটা গিয়ে আর-একটাকে ছুঁ মারে!”

হেঃ হেঃ করে হেসে গবা পাগলা বলে, “চার দুগুনে আট এ তো সবাই জানে। কিন্তু বলো তো বাছাধন, হ্যারিকেনকে পেনসিল দিয়ে গুণ করলে কত হয়?”

থানার দারোগা কুকুসুমের নামটা যত নরম, মানুষটা ততই শক্ত। ছ ফুট লম্বা দশাসই চেহারা। গলার স্বরে স্পষ্ট বাঘের ডাক। রোজ আড়াইশো করে বুকডন আর বৈঠক মারেন। রাগলে ভিসুভিয়াস। বাস্তবিকই নাকি রাগন্ত অবস্থায় তার মাথার চারপাশে একটা লালচে মতো আভা অনেকে দেখেছে। কুকুসুমের ভয়ে এই অঞ্চলের গুণ্ডা বদমাস চোর বাটপাড় সব রোগা হয়ে যাচ্ছে, ভাল করে খেতে পারে না, ঘুমোতে পায় না, ঘুমোলেও দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে যায়। সকালবেলায় কুন্দকুসুম সবে থানায় এস কোমরের বেল্টটা খুলে রেখে গায়ে একটু হাওয়া লাগাচ্ছেন, এমন সময় রাস্তায় গবার চেঁচানি শোনা গেল, “সবাই জানে চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে। কিন্তু বুদ্ধি পালালে কী বাড়ে? অ্যাঁ?”

কুলকুসুম সিধে হয়ে বসে বললেন, “স্পাইটা আবার এসেছে। ওরে, নজর রাখিস। নজর রাখিস!”

কিন্তু গবা কোথাকার স্পাই কার স্পাই তা কুন্দকুসুম ঠিক জানেন না। এর আগেও তিনি গবাকে ধরে এনে বিস্তর জেরা করেছেন, খোঁজ-খবর নিয়েছেন, কোনো তথ্য আবিষ্কার করতে পারেননি। তার্তে তাঁর সন্দেহটা আরো ঘোরতর হয়েছে।

“এই যে গবাঠাকুর”–বলে একপাল পেঁয়ো মেয়ে-পুরুষ রাস্তার মাঝখানেই ঢিবঢিব করে গবা পাগলাকে প্রণাম করল। তারা সব হাটবারে আনাজপাতি, ধামাকুলো, গোরু ছাগল, মুর্গি ডিম, ধান চাল, দড়িদড়া নিয়ে বেচতে যাচ্ছে শহরে। তাদের ধারণা, গবাঠাকুর আকাশে উড়তে পারে, অদৃশ্য হতে পারে, জলের উপর দিয়ে হেঁটে যেতে পারে, যে-কোন রোগ হাতের ছোঁয়ায় সারিয়ে দিতে পারে।

গবা তাদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল, “হবে হবে, সব হবে, একবার যদি ছুঁচে সুতোটা পরাতে পারি। দেখিস খন, সব অকাল চলে যাবে, ক্ষেতে-ক্ষেতে ধান আর ধরবে না, পুকুরে নদীতে মাছের গাদি লেগে যাবে। দাঁড়া একবার, ছুঁচে সুতোটা পুরাই………”

বাঘা ওস্তাদা গাইয়ে রাঘব ঘোষ সকালের দিকেটায় গলা সাধছিলেন। রোজই সাধেন। ভারী দাপুটে গলা। সাতটা সুর একেবারে রামধনুর মতো তার গলায় লেগে থাকে।

ঘণ্টা তিনেক গলার কসরত করায় এই শীতকালেও বেশ ঘেমে গেছেন রাঘব ঘোষ। একটু জিরিয়ে জর্দাপান মুখে দিয়ে তানপুরাটা সবে তারায় জড়িয়ে ধরে পিড়িং করেছেন মাত্র, অমনি মূর্তিমান গবা ঘরে ঢুকে বলল, “আরে সা লাগাও! সা লাগাও। একবার যদি ঠিকমতো ‘সা’-টা লাগাতে পারো, তাহলেই হয়ে গেল, সুরে জগৎ ভেসে যাবে। ‘সা’ লাগালে ‘রে’ আসবে মা রে বাবা রে বলে তেড়ে। রে এলে কি আর ‘গা’ দূরে থাকবে গা? এসে যাবে গা দোলাতে-দোলাতে। ‘গা’ যদি এল তবে ‘মা’-এর জন্য আর ভাবনা কী গো? মা তো মায়ের মতো কোল পেতেই আছে। আর মা এর পা ধরেই সেধে আসবে ‘পা’! পা-এর পিছু পিছু ধেয়ে আসবে ‘ধা’। ধাঁ ধাঁ করেই আসবে হে। আর কী বাকি থাকে? ‘নি’? নির্ঝঞ্ঝাটে আসবে, নির্ঝঞ্ঝাটে আসবে। নিত্যি নিত্যি আসবে, নৃত্য করতে করতে আসবে। এইভাবেই পৌঁছে যাবে তার গ্রাম। ধরো ফের চড়ায় গিয়ে ‘সা’-এর চুলের মুঠি। বুঝলে? সা লাগাও হে, ঠিকমতো সা লাগাও।”

রাঘব ঘোষ বুঝলেন না। তবে মাথা নেড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। গবা এল, জীবনে আর শান্তি রইল না।

তবে গবা আসায় শহরে যে একটা শোরগোল পড়েছে, তাতে সন্দেহ নেই।

উদ্ধববাবু ভারী রাসভারী লোক। তার সারা জীবনটাই রুটিনে বাঁধা।

তেমনি রুটিনে বাঁধা তার তিন ছেলে আর তিনমেয়ের চলা-ফেরা, লেখাপড়া, খেলাধূলো। তার গিন্নিও রুটিন মেনে চলেন। চাকরবাকর ঝি তো বটেই, তার বাড়ির গোরু ছাগল কুকুর বেড়াল পর্যন্ত কেউই রুটিনের বাইরে পা দেয় না। উদ্ধববাবু বলেন, ডিসিপ্লিন ইজ দি এসেন্স অব সাকসেস।

মুসকিল হল মাসখানেক আগে তিনি একটা ভালজাতের কাকাতুয়া কিনেছেন। তার ইচ্ছে ছিল, তাকাতুয়াটাকে শিখিয়ে পড়িয়ে এমন তৈরি করবেন যাতে সেটা তাঁর গবেট ছোট ছেলে রামুটাকে উঠতে-বসতে ডিসিপ্লিনের কথা মনে করিয়ে দেয়। উদ্ধববাবুর ছোট ছেলেটাই হয়েছে সবেচেয়ে সৃষ্টিছাড়া। শাসনে থাকে, দুষ্টুমিও বেশি করতে পারে না বটে, কিন্তু সে এই বাড়ির আবহাওয়া ঠিক মেনেও চলে না। আকাশে রামধনু উঠলে রামু হয়তো বাইরে গিয়ে দুহাত তুলে খানিক নেচে আসে। ঘুড়ি কাটা গেল দৌড়ে যায় ধরতে। অঙ্কের খাতায় একদিন লিখে রেখেছিল, “কে যায় রে ভোগাড়িতে উড়িয়ে ধূলো? যা না ব্যাটা……. দেখে শিউরে উঠেছিলেন উদ্ধববাবু। ঐটুকু ছেলে কবিতা লিখবে কী? কিন্তু কতই বা আর একটা ছেলের পিছনে লেগে থাকবেন তিনি? তার তো কাজকর্ম আছে! মস্ত উকিল, দারুণ নামডাক, ব্যস্ত মানুষ। তাই ঠিক করেছিলেন, কাকাতুয়াটাকে রামুর পিছনে লাগিয়ে দেবেন। সে বলবে, “রামু পড়তে বোসো। রামু এবার স্নান করতে যাও। রামু, আজ আধ ঘন্টা বেশী খেলেছ।রামুরামধনু দেখতে যেওনা।রামু, কাটাঘুড়ি ধরতে নেই…….ইত্যাদি।

কিন্তু মুশকিল হল, কাকাতুয়াটা প্রথম দিনই নিজে থেকে বলে উঠল, “আমার ভীষণ ঘুম পাচ্ছে। বিশু বাতিটা নিভিয়ে দাও। ওঃ, কী মশা! কী মশা!”

ধৈর্য ধরে উদ্ধববাবু পরদিন তাকে আবার রামু-শাসন শেখাতে বসলেন। কাকাতুয়াটা গম্ভীরভাবে শুনল। তারপর বলল, “বিশু, আমার খাবারে খুব ঝাল দিও।” উদ্ধববাবু কটমট করে পাখির দিকে চেয়ে বললেন, “ইয়ার্কি হচ্ছে?” কাকাতুয়াটা এ-কথায় খক-খক করে হেসে বলল, “আমার ভীষণ হাসি পাচ্ছে। খকখক।”

উদ্ধববাবু পরদিন আবার পাখিকে পড়াতে বসালেন। পাখি তাকে ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে অনেকক্ষণ লক্ষ্য করে বলল, “বালিশের তলায় কী খুঁজছ বিশু? আলমারির চাবি?”

উদ্ধববাবু বললেন, “আহা, বলো, রামু এখন ঘুম থেকে ওঠো।”

পাখি বলল, “বিশু, আমার ঘুম পাচ্ছে। আলমারিতে টাকা নেই। অন্য জায়গায় আছে।”

উদ্ধববাবু বললেন, “হোপলেস।”

.

০২.

কাকাতুয়াকে শেখাতে গিয়ে উদ্ধববাবু ঘেমে ওঠেন। রেগে গিয়ে চেঁচাতে থাকেন, “ইয়ার্কি হচ্ছে? অ্যাঁ! ইয়ার্কি?” কাকাতুয়াটা একথাটা খুব টক করে শিখে নেয়। ঘাড় কাত

করে উদ্ধববাবুর দিকে চেয়ে গম্ভীর গলায় বলে, “ইয়ার্কি হচ্ছে? অ্যাঁ! ইয়ার্কি?”

“নাঃ তোকে নিয়ে আর পারা গেল না। টাকাটাই জলে গেল দেখছি।” উদ্ধববাবু হতাশভাবে এই কথা বলে উঠে পড়লেন। নেয়ে খেয়ে আদালতে যেতে হবে।

কাকাতুয়াটা পিছন থেকে বলল, “টাকাটাই জলে গেল দেখছি।”

আড়াল থেকে কাকাতুয়া ভারসাস উদ্ধববাবুর লড়াইটা ছেলেমেয়েরা রোজই লক্ষ্য করে।

সেদিন কোর্টে উদ্ধববাবু যখন মামলার কাজে ব্যস্ত, সে-সময় একজন পেয়াদা এসে তাকে একটা হাতচিঠি দিয়ে বলল, “বাইরে একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে। জবাব নিয়ে যাবে।”

উদ্ধববাবু ভ্রূকুটি করে বললেন, “এখন সময় নেই। পরে আসতে বল।”

পরে ভেবে দেখলেন, মোকদ্দমার ব্যাপারে কোনো মক্কেল কোনো পয়েন্ট দিয়ে থাকতে পারে। তাই পেয়াদাকে বারণ করে চিঠিটা খুলে পড়তে লাগলেন?

মাননীয় মহাশয়,

কিছুকাল পূর্বে আমার পোষা কাকাতুয়াটি বাড়ির লোকের অসতর্কতার সুযোগে উড়িয়া যায়। পাখিটি আমার অত্যন্ত আদরের। বহু জায়গায় অনুসন্ধান করিয়া এতকাল তাহার কোনো খবর পাই নাই। সম্প্রতি জানিতে পারিলাম, ঐ কাকাতুয়াটিকে আপনি কোনো পাখিওলার কাছ হইতে কিনিয়াছেন। এখন আপনার নিকট সনির্বন্ধ অনুরোধ, দয়া করিয়া কাকাতুয়াটি আমার হাতে প্রত্যর্পণ করুন। আপনি টাকা খরচ করিয়া কিনিয়াছেন, তাই আপনার অর্থক্ষতি হউক ইহা আমার অভিপ্রেত নহে। পত্রবাহকের সঙ্গে টাকা আছে। ন্যায্য দাম লইয়া আপনি পাখিটি তাহার হস্তে দিলেই হইবে। পত্রবাহকটি জন্ম হইতেই মূক ও বধির। তাহার সহিত বাক্যালাপ করা নিষ্প্রয়োজন। কিছু জানিবার থাকিলে আপনি তাহার হাতে পত্রও দিতে পারেন। আমার প্রীতি ও নমস্কার জানিবেন। ইতি ভবদীয়-শ্রীশচীলাল শরমা।

চিঠি পড়ার পরও উদ্ধববাবু ভূকুচকেই ছিলেন। তিনি উকিল মানুষ, সুতরাং একটা সন্দেহবাতিক আছে। কোনো ঘটনাকেই সরলভাবে বিশ্বাস করেন না, যুক্তি দিয়ে সম্ভাব্যতা দিয়ে বিচার করে দেখেন। তিনি একটি চিরকুটে লিখলেন?

মাননীয় শচীলালবাবু,

আপনার পত্র পাইয়া প্রীত হইলাম। আমার ক্রীত কাকাতুয়াটি সাতিশয় অবাধ্য ও জেদি। আজ পর্যন্ত তাহাকে মনোমত বুলি শিখাইতে পারি নাই।

পাখিটি যদি আপনার হয় তবে ফেরত দিতেও বিন্দুমাত্র বিলম্ব করিব না, তবে দুনিয়ায় লক্ষ-লক্ষ কাকাতুয়া আছে। এই অঞ্চলেই কয়েকশো লোকের পোযা কাকাতুয়া আছে বলিয়া জানি। এখন আমার ক্রীত কাকাতুয়াটিই যে আপনার নিরুদ্দিষ্ট কাকাতুয়া, তাহার প্রমাণ কী? যদি অকাট্য প্রমাণ দেন তাহা হইলেই বুঝিব যে, আপনার নিরুদ্দিষ্ট এবং আমার ক্রীত কাকাতুয়াটি এক ও অভিন্ন। পাখিটি কিনিতে আমার দুইশত টাকা খরচ পড়িয়াছে। মাসখানেক তাহার খোরাকিবাবদ খরচ হইয়াছে প্রায় পঞ্চাশ টাকা। কাকাতুয়াটি বেশ ভালমন্দ খাইতে পছন্দ করে। প্রীতি ও নমস্কার জানিবেন।

ইতি ভবদীয়–উদ্ধবচন্দ্র ভট্টাচার্য।

পেয়াদার হাত দিয়ে চিরকুটটা পাঠিয়ে উদ্ধববাবু আবার মোকদ্দমার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। ঘটনাটা আর মনেই রইল না।

উদ্ধববাবুর বাড়ির সব কাজের কাজি হল নয়নকাজল। ছেলেবেলা থেকেই এ বাড়িতে আছে। ঘরের সব কাজ জানে। এমনকী, মোকদ্দমার ব্যাপারে উদ্ধববাবুকেও নাকি কখনো-সখনো পারমর্শ দেয়। বয়স বেশি নয়, চল্লিশের নীচেই। তবে তার চালচলন বুড়ো মানুষের মতো ভারিক্কি হওয়ার জন্য সে চোখে একটা চশমা পরে।

দুপুরে কাকাতুয়াটাকে ঝাঁঝরি দিয়ে ভাল করে স্নান করাল নয়ন। বাইরের বারান্দায় শীতের রোদে দাঁড়টা ঝুলিয়ে দিল। তারপর চোখে চশমা এঁটে খবরের কাগজ খুলে পড়তে বসল। ঠিক এমন সময় বিশাল এক সাধু এসে হাজির। পরনে বাঘছাল, হাতে ত্রিশূল, ডমরু, কপালে ত্রিপুণ্ডক, মাথায় জটা, বিশাল ভূঁড়ি, পেল্লায় দাড়ি গোঁফ, হুহুংকার দিল–হর হর ব্যোম ব্যেম….। হর হর ব্যোম ব্যোম….হর হর ব্যোম ব্যোম…..”

সেই হুংকারে আতকে উঠল নয়ন। এ শহরটা ছোটো বলে সাধু ভিখিরি সবই সকলের চেনা। কিন্তু এই বিকট সাধুকে আগে কখনো দেখা যায়নি।

চশমার ভিতর দিয়ে (যদিও চশমার কাঁচে কোনো পাওয়ার নেই) খুব গম্ভীর ভাবে সাধুকে লক্ষ করে নয়ন বলল, “কোত্থেকে আসা হচ্ছে?”

সাধু কাঁধের ঝোলাটা নামিয়ে বারান্দার সিঁড়িতে জমিয়ে বসে বলে, “সোজা হিমালয় থেকে। দেড় হাজার মাইল হাঁটাপথ। ওফ, একটু জল খাওয়াও তো বাপু মায়াবদ্ধ জীব।”

‘মায়াবদ্ধ জীব’ বলে এ পর্যন্ত কেউ সম্বোধন করেনি নয়নকে। সে খানিকটা থতমত খেয়ে বলে, “শুধু জল?”

সাধু হা-হা করে আকাশ ফাটিয়ে হেসে ওঠে হঠাৎ। বলে, “আরে জলই তো হাতের গুণে অমৃত হয়ে যাবে। আনো দেখি ঘটিভর।”

সেই হাসি শুনে নয়নের খুব ভক্তি হল। তাড়াতাড়ি এক ঘটি জল নিয়ে এল সে।

সাধু দু’হাতে ঘটি ধরে উঁচু থেকে গড়গড় করে জল ঢালল গলায়। ঘাবুত-ঘুবুত করে খানিক গিলে ঘটিটা ফেরত দিয়ে বলল “নে, পেসাদ খা।”

নয়ন ঘটিটা মাথায় ঠেকিয়ে সেটা আলগা রেখে গলায় জল ঢেলেই চমকে ওঠে। জল কোথায়? এ যে খাঁটি কমলালেবুর রস!

ঘটি রেখে নয়ন উপুড় হয়ে সাধুকে প্রণাম করে বলল, “আমাকে দয়া করতে হবে, বাবা।”

সাধু তার মাথায় প্রকাণ্ড হাতের একটা থাবড়া মেরে বলে, “হবে হবে। এই যে সিকি ঘটি অমৃত খেলি, এর ঠেলাটাই আগে সামলা।”

নয়নকাজল অবাক হয়ে বলল, “এই কি অমৃত, বাবা?”

“তাহলে কী?” সাধু কটমট করে তাকিয়ে বলে।

আমতা-আমতা করে নয়ন বলে, “না, অমৃতই হবে। খাওয়ার পর থেকে গায়ে একটু জোরও পাচ্ছি যেন। তবে কিনা খেতে একেবারে কমলালেবুর রসের মতো।”

“দূর বেটা খণ্ডিত সত্তা, তোরা হলি সংসার-পুকুরের মাছ। অমৃতের স্বাদ কি একেবারে পাবি? তবু তো তোর কমলালেবুর রস বলে মনে হয়েছে, অনেকের আবার ডাবের জল বা এমনি জল বলে মনে হয়েছে। তারা ঘোর পাপী, ঘোর পাপী, ব্যোম ব্যোম হর হর…”

নয়ন আর একবার সাধুকে প্রণাম করে।

সাধু কাকাতুয়ার দাঁড়টার দিকে তাকিয়ে ফেঁত করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে “নিজেরা হাজারো মায়ায় আটকে ছটফট করছিস তার ওপর ঐ অবোলা জীবটার পায়ে শিকল দিয়ে বেঁধে রেখেছিস! ঘোর নরকে যাবি।

“আমি নই বাবা! ও হল কর্তাবাবুর পাখি। আমি সামান্য চাকর।

“যে বেটা নিজেকে চাকর ভাবে, সে তো আগাপাশতলা চাকরই। নিজেকে চাকর ভাবিস কেন? তুই তো মুক্ত আত্মা। এ-বাড়ি এ-সংসার এ-দুনিয়ার সব কিছুর মালিক। যা বেটা ছেড়ে দে পাখিটাকে যা যা, ওঠ, দেরি করিসনি।”

নয়ন ভয়ে-ভয়ে উঠে পড়ে বলে, “কিন্তু বাবা, কর্তাবাবু রাগী লোক। ফিরে এসে পাখি না দেখলে এমন কুরুক্ষেত্র করবে!”

চোখ পাকিয়ে সাধু হুহুংকার দিয়ে ওঠে। “হর হর ব্যোম ব্যোম….কে  তোর কেশাগ্র স্পর্শ করবে রে বেটা? এইমাত্র অমৃত খেলি যে! যা বেটা, ছেড়ে দে, একটা মুক্ত আকাশের জীবকে আর কষ্ট দিসনে। ছেড়ে দে, উড়ে যাক।”

নয়নকাজল সাধুর হুংকারে মনস্থির করতে না-পেরে দোনোমোনো হয়ে উঠে পড়ল। দাঁড়ের কাছে গিয়ে শিকলিটা খুলতে সবে হাত বাড়িয়েছে এমন সময় আর-একটা লোক বারান্দায় উঠে বিকট গলায় বলে উঠল, “কাকাতুয়ার

মাথায় ঝুঁটি, খ্যাকশিয়ালি পালায় ছুটি……।

নয়নকাজল এই দু নম্বর চেঁচানিতে ঘাবড়ে গেল। শিকল আর খোলা হল না। তাকিয়ে দেখল, মূর্তিমান গবা পাগলা।

গবা খুব সরু চোখ করে আপাদমস্তক সাধুকে দেখে নিচ্ছিল। ভাল করে দেখে-টেখে বলল, “সব ঠিক আছে। তবে বাবু, তোমার একটা ভুল হয়েছে। গায়ে ছাই মাখোনি।”

সাধু একটু হতভম্ব। কথা সরছে না। তবু একবার রণহুংকার দিল, “হর হর ব্যোম ব্যোম……”

গবা সেই হুংকারে একটুও না ঘাবড়ে বলে, “পায়ে বাটা কোম্পানির চটি জোড়াও মানায়নি একদম। একজোড়া কাঠের খরম যোগাড় করতে পারোনি হে?”

সাধু এবার একটু ক্ষীণ কণ্ঠে বলে, “হর হর……”

গবা সাধুর বাঁ হাতটা তুলে কবজিটা দেখে নিয়ে বলে, “এ যে ঘড়ি পরার স্পষ্ট দাগ গো! রোজ ঘড়ি পরো বুঝি হাতে? সাধুরা আজকাল ঘড়িও পরেছ তাহলে? তা সেটা রেখে এলে কোথায়?”

সাধু ত্রিশূলটা শক্ত করে চেপে ধরে ধমক দেয়, “ব্যোম ব্যোম…”

গবা ফিক করে হেসে বলে, “বোমা কেন? পিস্তল নেই? বোমার চেয়ে পিস্তল ভাল। বোমা অনেক সময় ঝোলার মধ্যে ফেটে টেটে যেতে পারে।”

সাধু এক ঝটকা মেরে উঠে দাঁড়িয়ে বলে, “ঘোর পাপী, ঘোর পাপী। অন্ধকারে ডুবে আছিস।”

পাখিটা অনেকক্ষণ ধরে সাধুকে ঘাড় কাত করে করে দেখছিল আর দাঁড়ে এধার-ওধার করছিল। এখন একটা ডিগবাজি খেয়ে বলল, বিশু, বিশু, আমারা কেন ঘুম পাচ্ছে! ঘুম পাচ্ছে! আলমারিতে টাকা নেই। টাকা আছে……”

সাধু হঠাৎ একটা লাফ মেরে বারান্দায় উঠে দাঁড়টাকে একটা ঝাঁকুনি মেরে বলে, “বল বেটা কোথায় আছে! বল নইলে গলা টিপে খুন করে ফেলব।”

পাখিটা হঠাৎ কঁকনি খেয়ে বুলি ভুলে ডানা ঝাঁপটে ভয়ে চিৎকার করতে লাগল।

.

০৩.

সাধুর কাণ্ড দেখে নয়নকাজলের বাকি সরে না, হাত-পা নড়ে, শরীরে সাড়া নেই। বড় বড় চোখে চেয়ে আছে। মুখোনা হাঁ। পাখিটা বুলি ভুলে গাঁ গাঁ করে প্রাণভয়ে চেঁচাচ্ছে আরদাঁড়ে বনবন করে ডিগবাজি খাচ্ছে। বিটকেল গলায় সাধু বলছে, “বল বেটা বল কোথায় টাকা! বল!”

অবস্থা যখন এইরকম গুরুচরণ, তখন হঠাৎ–জলের চৌবাচ্চায় নেমে বৈজ্ঞানিক আর্কিমিডিস আপেক্ষিক গুরুত্ব আবিষ্কার করার পর যেমন ইউরেকা ইউরেকা’ বলে আওয়াজ ছেড়েছিলেন–তেমনি গবা পাগলা লাফিয়ে উঠে দু’হাত তুলে নাচতে নাচতে চেঁচাতে লাগল’ চিনেছি! চিনেছি! সাধুকে চিনেছি!”

যেই না চেঁচানো সেই না সাধু চোখের পলকে লাফ দিয়ে বারান্দা থেকে নেমে হাওয়ার বেগে দৌড়ে পালিয়ে গেল।

নয়নকাজল ধাতস্থ হয়ে গবাকে জিজ্ঞেস করে, “বিটকেল সাধুটাকে চেনো হলে! কে বলো তো?

গবা বসে-বসে ঘাম মুখের ধুলো-ময়লা মুছছিল। বিজ্ঞের মতো হেসে বলল, “বলব কেন? ডবল লেন্স লাগিয়ে নতুন ধরনের একটা টর্চবাতি বানাব বলে তোমার কাছে যে গতকাল বাবুর মায়ের পুরনো চশমাজোড়া চাইলাম, দিয়েছিলে?”

নয়ন একটু তেড়িয়া হয়ে বলে, “আর চোর বলে যদি আমার বদনাম রটত? তখন তুমি কোথায় থাকতে?”

“চোর!” বলে হোঃ হোঃ করে হাসে গবা, “চোর বুঝি এখন নও? কুন্দ দারোগাকে যদি তোমার আসল নামটা জানাই তাহলে তুমি এরকম সুখে আর থাকবে না হে!”

একথা শুনে নয়ন কেমন একধারা হয়ে গেল। মুখোনা ছাইবর্ণ, চোখে জুলজুলে চাউনি।

গবা অবশ্য আর ঘাটাল না। বলল, “নাও, মেলা বেলা হয়েছে, পাঁচক ঠাকুরকে আমার খাবারটা বাড়তে বলো গে।”

নয়নকাজল মিনমিনে গলায় বলল, “যাচ্ছি। কিন্তু কথাটা হল–”

গবা হাত তুলে বলে, “বলতে হবে না। কথাটা আপাতত চাপা থাকবে। এখন নিশ্চিন্ত মনে যাও। আর শোনো, পাখিটাকে ভিতরের দরদালানে ঝুলিয়ে রেখো, যখন-তখন বের কোরো না, এটার ওপর কিছু লোকের চোখ আছে।”

নয়নকাজল দাঁড়টা নিয়ে ভিতরবাড়িতে চলে গেল।

এ-বাড়িতে গবা পাগলার আস্তানা বহুদিনের। মাঝেমধ্যে সে দু-চার ছ মাসের জন্য হাওয়া হয়ে যায় বটে, কিন্তু ফিরে এসে বাইরের পাকা চণ্ডীমন্ডপের পাশে রসুইখানার ঘরটায় বরাবরের মতো থানা গাড়ে। তাকে কেউ কিছু বলে না। শোনা যায় উদ্ধববাবু গবাকে একটা বিচ্ছিরি মামলা থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন। বহুকাল আগেকার কথা। সত্যি-মিথ্যে কেউ বলতে পারেনা।

গবা পিছনের পুকুর থেকে স্নান করে এসে এক পেট খেয়ে ঘুম লাগাল।

বিকেল হতে না হতেই রামু এসে ঠেলে তুলল, “ও গবাদা! বাবাকে বলে বিষ্ঠুপুরের সারকাসে নিয়ে যাবে বলেছিলে যে! আজই চলো।”

গবা হাই তুলে বলে, দূর! ও একটা সারকাস নাকি? মরকুটে বাঘ,

রোগা হাতি, পালোয়ানের নেই বুকের ছাতি। কাল সকালে গিয়ে দেখি, সরকাসের ম্যানেজার গুণঘঁচে পাটের ফেঁসে ভরে ছেঁড়া তবু সেলাই করছে। তার চেয়ে হবিগঞ্জের সারকাস অনেক ভাল।”

“কী আছে তাতে?”

“ওঃ, সে মেলা জিনিস। বাঘ হাতি সিন্ধুঘোটকের কথা ছেড়েই দিলাম। একটা বেঁটে লোক আছে, সে ভারী হাসায়। বেঁটেটার বন্ধু হচ্ছে একটা তালগাছের মতো লম্বা লোক। তা বন্ধুর সঙ্গে কথা বলার সময় বেঁটেটা একটা মই লাগিয়ে বন্ধুর কাধ-বরাবর উঠে যায়। মজা না?”

“খুব মজা। কিন্তু কবে নিয়ে যাবে?”

“ব্যস্ত হয়ো না বাবুমশাইকে বলে আগে অনুমতি নিই। তারপর একদিন যাব’খন। পয়সা-টয়সাও লাগবে না। হাবিবগঞ্জের সারকাসের সেই বেঁটে লোকটা আমার খুব বন্ধু। দুজনে একসময়ে একই দলে ছিলাম কিনা।”

রামু চোখ কপালে তুলে বলে, “তুমি সারকাসের দলে ছিলে গবাদা? বলোনি তো?”

গবা মৃদু-মৃদু হেসে বলে, “সারকাসে ছিলাম, বেদের দলে ছিলাম। সে অনেক ঘটনা।”

“সারকাসে কী কী খেলা দেখাতে?”

“সবরকম। ট্রাপিজ, দড়ির ওপর হাঁটা, একচাকার সাইকেলে উঠে রকম রকম কসরত, ক্লাউন সেজে রগড়ও করতে হয়েছে।

‘আমাকে খেলা শিখিয়ে দেবে?”

“তা আর শক্ত কী? তবে কঠিন ডিসিপ্লিন চাই, মনোযোগ চাই অধ্যবসায়। চাই।”

“আমি পারব।”

উদ্ধববাবু আজ একটু তাড়াতাড়িই কাছারি থেকে ফিরে এসেছেন। এসেই হাঁক মারলেন, “নয়ন, ওরে নয়ন!”

নয়নকাজল ছুটে এসে বলে, “আজ্ঞে বাবুমশাই।”

“পাখিটা কোথায়?”

“দরদালানে ঝোলানো আছে।”

“হুঁ” বলে উদ্ধববাবু পকেট থেকে শচীলাল শর্মার চিঠিটা বের করে আর একবার পড়লেন। তারপর ক্রু কুঁচকে বললেন “পাখিটাকে খুব সাবধানে রাখা দরকার। আজ থেকে ওটাকে এ-ঘরে রাখবি। আমি না থাকলে দরজায় সবসময় তালা দেওয়া থাকবে বুঝেছিস?”

“আজ্ঞে।” নয়নকাজল খুব বিনীতভাবে বলল, তবে এসময় উদ্ধববাবু লক্ষ করলে দেখতে পেতেন যে, নয়নকাজলের চোখ দুটো চকচক করছে। জিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁট দুটো চেটে নয়ন বলল, “আজ এক বিটকেল সাধু এসে পাখিটার ওপর খুব হামলা করে গেছে। নিয়েই যেত, আমি গিয়ে সময়মতো আটকালাম বলে।”

“সাধু!” বলে উদ্ধববাবু হাঁ করে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলেন, “সাধুর সঙ্গে পাখির কী সম্পর্ক?”

মাথা চুলকে নয়ন বলে, “আজ্ঞে সে তো জানি না”।

উদ্ধববাবু রেগে গিয়ে বলেন, “এবাড়িটা কি হাট নাকি? যে-কেউ এসে ঢুকে পড়বে, হামলা করবে, তোরা সব করিস কী? সাধু পাখিটা নিয়ে যাচ্ছিল নাকি?”

“তাই মতলব ছিল। বিশাল চেহারা দেখলেই ভয় হয়।”

“ধরতে পারলি না?”

“ও বাবা, ধরবে কে? হাতে যা একখানা ধারালো শূল ছিল!”

উদ্ধববাবু একটু চিন্তিত মুখে বললেন, “ঠিক আছে, এখন থেকে সাবধান থাকবি।”

বাইরের কাছারি ঘরে মক্কেলরা জড়ো হতে শুরু হয়েছে। কাজেই পাখি নিয়ে ভাববার সময় উদ্ধববাবুর নেই। তিনি তৈরি হয়ে কাছারিঘরে গিয়ে বসলেন এবং মামলামকদ্দমার মধ্যে ডুবে গেলেন।

সন্ধের সময় যখন সবাই পড়তে বসে তখনই রামুর ভীষণ ঘুম পায়। এত ঘুম যে কোথায় থাকে? কেবল হাইয়ের পর হাই উঠতে থাকে, চোখের দুটো পাতায় যেন আঠা-মাখানো চুম্বক লাগিয়ে দেয় কে। শ্রীধর মাস্টারমশাই পড়াতে এসে ভীষণ রাগারাগি করেন রোজ। মারধরও প্রায় রোজই খেতে হয় রামুকে। কিন্তু পড়তে তার একদমই ভাল লাগে না।

আজও তিন ভাই পড়তে বসেছে। রামু ঘন ঘন দেওয়ালঘড়িটার দিকে চাইছে। ঠিক ছটায় শ্রীধরবাবু আসবেন। ততক্ষণ যতটা পারে ঢুলে নেওয়ার জন্য সে মুখে অ্যাটলাসটা চাপা দিয়ে চোখ বুজে রইল।

কিন্তু কে জানে কেন আজ রামুর ঘুম আসছিল না। বারবারই তার চোখে একটা সারকাসের দৃশ্য ভেসে উঠছে, সে দেখছে, একটা ছেলে ট্রাপিজ থেকে আর একটায় ঝাঁপ দিয়ে চলে যাচ্ছে, দড়ির ওপর হাঁটছে। একচাকার সাইকেল কসরৎ দেখাচ্ছে। ছেলেটা অবশ্য সে নিজেই। আজ তার মনে হল, সারকাসের খেলোয়াড় হতে না পারলে জীবনের কোনো মানেই নেই।

এদিকে ছটা বেজে গেল। ক্রমে সাড়ে ছটাও বাজে। কিন্তু শ্রীধরবাবু এলেন না। এরকম অঘটন কখনোই ঘটে না, শ্রীধরবাবুর মতো নিয়মনিষ্ঠ লোক কমই আছে। কামাই তো নেইই, এ মিনিট দেরিও করতে নারাজ। আজ তবে হল কী?

সন্ধে সাতট নাগাদ কাছারিঘরে উদ্ধববাবুর কাছে একটা লোক এসে বলল, “শ্রীধরবাবু সাইকেল থেকে পড়ে গিয়ে পা মচকেছেন। ক’দিন আসতে পারবেন না।”

মামলা-মকদ্দমায় ডুবে-থাকা উদ্ধববাবু অবাক হয়ে বললেন, “কে শ্রীধরবাবু? কিসের মামলা?”

“মামলা নয়। শ্রীধরবাবু আপনার ছেলেদের পড়ান।”

“অ, তা কী করে পড়লেন?”

“সাইকেলে টিউশানি করে আসছিলেন এমন সময় একটা মোটর সাইকেল এসে তাকে ধাক্কা মেরে পালিয়ে যায়। খুব চোট হয়েছে। ডান পায়ের হাড় সরে গেছে।”

“তাই তো! খুব দুঃখের কথা।”

পরদিন সকালেই অবশ্য শ্রীধরবাবু চিঠি দিয়ে একটি লোককে পাঠালেন। চিঠিতে লেখা, “আমার বদলে এই ভ ভদ্রলোক ছেলেদের ক’দিন পড়াবেন। ইনি তিনটি বিষয়ে এম. এ. পাস।”

উদ্ধববাবুর আপত্তির কারণ ছিল না। শ্রীধরবাবু যাকে পাঠিয়েছেন তার যোগ্যতা সম্পর্কে প্রশ্নই ওঠে না। লোকটির চেহারাও বেশ ভালমানুষের মতো। নাম যুধিষ্ঠির রায়। আগে এঁকে কখনো দেখেন নি উদ্ধববাবু। জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনি কি এই অঞ্চলের লোক?”

“এই অঞ্চলেরই। তবে পড়াশুনো করতে অনেকদিন বাইরে ছিলাম।”

“ঠিক আছে। আজ থেকেই শুরু করুন।”

রাত্রিবেলা চুপিসারে নয়নকাজল একটা লুচি খাওয়াল কাকাতুয়াটাকে। তারপর বেশ মিষ্টি করে পাখিটার গায়ে হাত বুলিয়ে মিষ্টি গলায় বলল, হ্যাঁ, কী যেন বলছিলি! সেই টাকাটার কথা, না? কোথায় যেন আছে সেই টাকাটা? বল বাবা।”

পাখিটা ঘাড় বেঁকিয়ে নয়নকাজলকে ভাল করে দেখে নিয়ে বলল, “টাকা নয়, মোহর। মোহরগুলো….মোহরগুলো…..।”

নয়নকাজল সাপর মতো চোখ করে চেয়ে ছিল পাখিটার দিকে। সাপের মতো গলাতেই বলল, “হ্যাঁ, হ্যাঁ মোহর। তা সে মোহরগুলো কোথায় রে বাপ?”

“মোহর আছে…মোহর আছে….মাটির তলায়…..কিন্তু বিশু, তুমি অমন করে তাকিও না…..আমি ভয় পাই…..ভয় পাই।”

চাপা গলায় নয়নকাজল বলে, “ভয় নেই রে! মাটির তলায় তো বুঝলুম, কিন্তু জায়গাটি কোথায়? |||||||||| পাখিটা দাঁড়ে দোল খেতে লাগল। তারপর হঠাৎ হাঃ হাঃ হাসির শব্দ তুলে বলল “জানি, কিন্তু বলব না।”

“বলবি না? বলবি না?” বলতে বলতে নয়নকাজল দুটো হাত সাঁড়াশির মতো করে পাখিটার দিকে এক পা এগিয়ে গেল। পেছনে কখন নিঃশব্দে রামু এসে দাঁড়িয়েছে। দৃশ্যটা দেখে সে অবাক! কিন্তু বিপদ বুঝে সে হঠাৎ বলে উঠল, “নয়নদা। কী হচ্ছে?”

নয়নকাজল চট করে নিজেকে সামলে নিয়ে একগাল হেসে বলল, “পাখিটাকে বড়বাবুর ঘরে রেখে আসার হুকুম হয়েছে কিনা। তাই দাঁড়টা নিয়ে যাচ্ছিলাম।”

কথাটা রামুর বিশ্বাস হল না। কিন্তু আর কিছু বলল না সে। তবে পাখিটা যে মোহরের কথা বলছিল, তা সে স্পষ্ট শুনেছে।

রামু যে খুবই দুষ্টু ছেলে সে, নিজেও জানে। একবার স্কুলের অঙ্ক স্যার হেরম্ববাবু রেগে গিয়ে তাকে বলেছিলেন “তুই এত পাজি কেন বল তো?”

“আজ্ঞে স্যার, আমার শরীরের মধ্যে সবসময় কে যেন কাতুকুতু দেয়। যখন খুব কাতুকুতুর মতো লাগে, তখন আমার কিছু একটা না করলে চলে না।”

“বটে!” বলে হেরম্ববাবু খুব রেগে গেলেন। রামু ইয়ার্কি করছে ভেবে শপাং শপাং কয়েক ঘা বেতও বসালেন তার গায়ে। তারপর বললেন, “এবার কাতুকুতু টের পাচ্ছিস?”

কিন্তু ইয়ার্কি রামু করেনি। বাস্তবিকই তার শরীরের মধ্যে সবসময় একটু কাতুকুতুর ভাব। কখনো বাড়ে, কখনো কমে। যখন বাড়ে তখন বেহদ্দ কোনো দুষ্টুমি না করলেই নয়। খাঁ-খাঁ দুপুরে সে তখন এলোপাথাড়ি ঢিল ছোঁড়ে, গাছের মগডালে ওঠে, ক্লাসে অন্য ছেলেদের বই খাতা গোপনে ছিঁড়ে রাখে, ক্লাসঘরে ছাগল ঢুকিয়ে দেয়, বাড়িতে রান্নাঘরে গিয়ে রান্না তরকারির মধ্যে নুন ছিটিয়ে দিয়ে আসে। প্রতিবেশীরা তার উৎপাতে অস্থির। রামুর মেজদাদুর সত্তর বছর বয়সেও সটান চেহারা সবকটা দাঁত অটুট, মাথায় কালো কুচকুচে চুল। সেবার মেজদাদু রামুদের বাড়ি বেড়াতে এসে বললেন, “আমার মাথা থেকে পাকা চুল বের করতে পারবি? পার পাকাচুল চার আনা করে পয়সা দেব।”

.

০৪.

দুপুরে খাওয়ার পর মেজদাদু যখন শুয়েছেন তখন রামু চুল বাছতে গেল এবং ঘন্টাখানেকের মধ্যে প্রায় শ’খানেক পাকা চুল বের করে ফেলল। দেখে মেজদাদু তে মূৰ্ছা যান আর।

কী! বাড়ি মাথায় করে চেঁচাতে থাকেন, “ভৌতিক কাণ্ড! ভোতক কাণ্ড! আমি কি রাতারাতি বুড়ো হয়ে গেলুম! ওরে উদ্ধব, শিগগির ডাক্তার ডাক। আমার বুকটা কেমন করেছে, মাথা ঘুরছে, হাত পা কাঁপছে!”

ঠিক সেই সময়ে প্রতিবেশী জামাল সাহেব তার সাদা ধবধবে বিলিতি কুকুরটাকে চেন দিয়ে বেঁধে এনে বাড়িতে ঢুকলেন। দুঃখ করে বললেন, “রেমোর কাণ্ড দেখুন একটু আগে আমার বাসায় গিয়েছিল, হাতে একটা কাচি। কুকুরটাকে খুব আদর করছিল তখন কি ছাই টের পেয়েছি! এখন দেখি পিঠের লম্বা চুলগুলো কেটে একেবারে টাক ফেলে দিয়ে এসেছে।”

বাস্তবিকই তাই। সুন্দর, বড় বড় লোমওয়ালা কুকুরটার পিঠ প্রায় ফাঁকা। উদ্ধববাবু হান্টার বের করলেন, মেজদাদু তখন গিয়ে তাকে আটকে দিয়ে বললেন, “যাই হোক বাবা, মাপ করে দাও। ছেলেমানুষ।”

মেজদাদু যে বাস্তবিকই বুড়ো হননি সেটা জেনেই তিনি তখন খুশি। তবে তার পরেও দিন-দুই তার চুল থেকে কুকুরের সাদা লোম ঝরে পড়ত।

শরীরের এই কাতুকুতুটা নিয়ে রামু মাঝেমাঝে ভাবে। কে যে তাকে কাতুকুতু দেয়! ব্যাটাকে ধরতে না পারলে কিছুতেই আর ভাল ছেলে হওয়া যাবে না।

অবশ্য ভাল ছেলে হওয়ার তেমন কোনো ইচ্ছেও তার হয় না। আর ইচ্ছে করে সারকাসের রিং-মাষ্টার বা ম্যাজিসিয়ান বা প্রেসিদ্ধ তান্ত্রিক বা নামকরা ফুটবল খেলোয়াড় বা রেলের গার্ড বা মহাকাশচারী বা বহুরূপী বা বিশ্বভ্রমণকারী বা ট্রাক ড্রাইভার বা পাইলট বা ডুবুরি হতে। শুধু লেখাপড়া করে আর নিয়মমতো চলে এর কোনোটাই হওয়া যাবে না। সুতরাং সে ঠিক করেছে, একদিন বাড়ি থেকে পালিয়ে যাবে। কুমোরপাড়ার গারও পালানোর হচ্ছে। দুজনে প্রায়ই শলাপরামর্শ করে। গান্টুর ইচ্ছে পালিয়ে প্রথমেই উত্তরমেরুতে যাবে। রামুর ইচ্ছে, আফরিকা। দুজনে এখনো একমত হতে পারেনি। হলেই গলা-জড়াজড়ি করে একদিন বেরিয়ে পড়বে।

তবে রামু দুষ্টু হলেও সে গাছপালা আর পশুপাখি খুব ভালবাসে। এমন কী, নিজেদের বাগানের সব কটা গাছের সঙ্গেই তার আলাদা আলাদা রকমের সম্পর্ক আছে। বুড়ো তেঁতুলগাছটার সঙ্গে তার সম্পর্ক দিদিমা আর নাতির। তেঁতুলগাছটাকে সে তিন্তিড়ি দিদিমা বলে ডাকেও। গাছটা যে তাতে সাড়া দেয়, তাও সে টের পায়।

কমেলর আমগাছটা ভাল-ছেলে ধরনের। প্রতি বছর আঁকা ঝকা আম ফলে তাতে,। কাজের লোক, কিছু গম্ভীরও। তাকে রামু গোপালদা বলে ডাকে। রামুর ক্লাসের ফাওঁবয়ের নামও গোপাল, আর গাছটাও গোলাপ-খাস আমের। তবে ফার্স্ট বয়ের সঙ্গে রামুর ভাব নেই, গাছটার সঙ্গে আছে। একটু বর্ণ বিপর্যয় করে নিয়ে গোলাপখাসকে গোপালদা বানিয়ে নিতে রামুর অসুবিধে হয়নি।

এছাড়া কাক, শালিখ, চড়াই, বেড়াল, কুকুর, ইঁদুর, এমনকী কাঠবেড়ালিদের সঙ্গেও রামুরর কোনো শত্রুতা নেই। তারা রামুকে পছন্দই করে। বাড়ির পোষা পায়রাগুলো রামুর মাথায়, কাঁধে নির্ভয়ে এসে বসে। কাঠবেড়ালি তার থেকেই চিনে-বাদাম খেয়ে যায়। গোট চারেক চেনা শালিখ রোজ সকালে পড়ার ঘরে ঢুকে কিচির-মিচির করে তাদের পড়া ভণ্ডুল করে রামুকে সাহায্য করার চেষ্টা করে।

নয়ন পাখির দাঁড়টা বাবার ঘরে দিয়ে আসতে চলে যাওয়ার পর রামুর মনে হল, এই কাকাতুয়াটাকে হাত করা দরকার। বাবা এটাকে কিনেছে রামুকে ঢিট করবার জন্যই। পাখিটাকে হাত না করলে ব্যাটা তাকে বিস্তর জালাবে।

উদ্ধববাবু মক্কেলদের বিদায় করে খাওয়া দাওয়া সেরে যখন ঘরে এলেন তখন অনেক রাত। পাখির দাঁড়টা সিলিং ফ্যান থেকে ঝোলানো একটা দড়িতে বাঁধা। কাকাতুয়া ঘাড় গুঁজে ঘুমোচ্ছে। উদ্ধববাবু নিশ্চিন্তে শুয়ে পড়লেন।

কিন্তু মাঝরাতে একটা দুঃস্বপ্ন দেখে তার ঘুম ভেঙ্গে গেল। না, দুঃস্বপ্নটা ঠিক দেখেননি তিনি। বরং বলা যায় একটা দুঃস্বপ্ন তিনি শুনলেন। কে যেন বলছে, “ওরে বাবা! কী ভয়ংকর! কী সাংঘাতিক রক্ত! রক্ত!”

এইসব বিদঘুঁটে কথা-শুনে ঘুম ভেঙে গেল। উদ্ধববাবু উঠে বসলেন। তার শ্বাসকষ্ট হতে লাগল। তবু চেঁচিয়ে বললেন, “কী হয়েছে রে? ডাকাত পড়ল নাকি?”

না, ডাকাত পড়েনি। হতচ্ছাড়া সেই পাখিটা। চালের এধারে-ওধারে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে। পায়ের সরু শিকলের শব্দ হচ্ছে। কিন্তু আশ্চর্য এই, ঘোর শীতকালেও সিলিং ফ্যানটা বাই বাই করে ঘুরছে। সেই সঙ্গে পাখির দাঁড়টাও।

কে পাখা খুলল? কেন খুলল? পাখিটাই বা ওরকম চেঁচাল কেন? এসব প্রশ্নের জবাব পাওয়া গেল না।

উদ্ধববাবু উঠে পাখাটা বন্ধ করলেন। পাখিটা খুব কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে তাকে একবার দেখল। তারপর মৃদু স্বরে বলল, “সাবধান!”

উদ্ধববাবু আর বাকি রাতটা ঘুমোতে পারলেন না। ঠিক করলেন, পাখিটাকে শচীলাল শরমার কাছে বেচেই দেবেন। না হয় তো অন্য কাউকে। বড্ড ঝামেলা।

.

০৫.

দুপুরবেলা বহু দূর থেকে একটা লোক পশ্চিমের চষা খেতের মত্ত মাঠটা পেরিয়ে শহরের উপকণ্ঠে শালবনটার ভিতরে ঢুকল। ঝরা পাতার বনটায় আলোছায়ার চিকরি-মিকরি। গোঁ-গোঁ করে

উত্তরে শীতের হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। ভোকাট্টা ঘুড়ির মতো শুকনো পাতা খসে পড়ছে। লোকটা কাধ থেকে তার খাকি রঙের ব্যাগটা নামিয়ে গাছতলায় রাখল।

তার ব্যাগটা দেখেই বোঝা যায়, লোকটা পর্যটক। তার গালে বেশ ঘন দাড়ি আর গোঁফ। খুব লম্বা নয়, কিন্তু শক্ত মজবুত চেহারা, পরনে মালকোচা মারা ধুতি, গায়ে একটা ফতুয়া আর মোটা সুতির চাঁদর। কাঁধে একটা ভাঁজ করা কুটকুটে কম্বলও আছে। পায়ে খুব পুরু সোলের নাগরা জুতে। হাতে বেতের একটা লাঠি। বয়স বাইশ-তেইশ বা বড়জোর পঁচিশ পর্যন্ত হতে পারে। চোখ দুখানায় তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। রোদে-জলে ঘুরে-ঘুরে গায়ের রং তামাটে হয়ে গেছে বটে, তবে একসময় সে খুব ফর্সা ছিল তা বোঝা যায়।

লোকটা খানিকক্ষণ জিরিয়ে নিল। তার পর ব্যাগ থেকে চিড়ে আর গুড় বের করে কয়েকটা শালপাতা বিছিয়ে তার ওপর ঢাকল। সামনেই মটর খেত। উঠে গিয়ে খেত থেকে তাজা মটরশুটি তুলে আনল এক কোঁচড়। জলও জুটে গেল কাছেই এক চাষীবাড়ির কুয়ো থেকে। কোথায় কী জোটে তা লোকটা ভালই জানে।

খাওয়ার পর গাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে লোকটা অঘোরে ঘুমোতে লাগল। জঙ্গলে সাপখোপ, পাগলা শেয়াল থাকতে পারে। শীতকালে এই অঞ্চলে চিতাবাঘও হানা দেয়। লোকটা সবই জানে, কিন্তু সূক্ষেপ নেই।

শীতের বেলা তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে পশ্চিমের মাঠে সূর্য টুক করে মেঘলা মতো একটা কুয়াশার স্তরের মধ্যে ডুবে গেল। শালবনের মধ্যে ঘনিয়ে উঠল অন্ধকার। আর হাড়-কাঁপানো হিম একটা হাওয়া হুঁ-হুঁ করে বইতে লাগল।

লোকটা চোখ মেলে তাকায়। সে দিনের বেলায় বড় একটা লোকালয়ে ঢুকতে চায় না। চারদিকটা বেশ আঁধারমতো হয়ে এসেছে দেখে লোকটা তার ব্যাগ-ঠ্যাগ গুছিয়ে নিয়ে উঠে পড়ল।

বন পার হয়ে লোকটা কিন্তু শহরে ঢুকল না। শহরের বাইরে মস্ত সার্কাসের তবু পড়েছে। ডিম-ডিম করে বাজনা বাজছে। বাঘ সিংহের হুংকার শোনা যাচ্ছে। ভিড়ে ভিড়াক্কার। চারিদিকে আলো ঝলমল দোকানপাট, বেলুনওয়ালা, ভেঁপুওয়ালা বাঁশিওয়ালা মিলে এক মেলা বসে গেছে।

লোকটা মোটা চাঁদরে নাক পর্যন্ত ঢেকে আর মাথায় একটা কপাল ঢাকা বাঁদুরে টুপি চাপিয়ে একটু সন্তর্পণে তাবুর পিছন দিকে এগোতে লাগল।

এ-পাশটা অন্ধকার। বাঘ সিংহের খাঁচা, রসুইখানা, খেলোয়াড়দের তাবু আর মেলা, দড়ি-দড়া, বাঁশ-কাঠ, প্যাকিং বাক্সের গাদা। লোকটার কোনো অসুবিধে হল না অন্ধকারে সাবধানে পা ফেলে এগিয়ে গেল।

খেলোয়াড়দের ঢুকবার দরজায় কড়া পাহারা, খুব কম করেও পাঁচ-সাতজন মুশকো লোক দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছে। খেলা শুরু হতে আর দেরি নেই। দরজার কাছে একটি আলোর চৌখুপি। মুখটকা লোকটা এগিয়ে যেতেই পাহারাদাররা পথ আটকাল, “এই এধারে যাওয়া বারণ। হঠো, হঠো।”

লোকটা তার বাঁদুরে টুপিটা খুলে চাঁদর-ঢাকার মুখটা একটু ফাঁক করে আলোয় তুলে ধরে বলে, “আমি রে আমি। গোবিন্দ ওস্তাদ।”

লোকগুলো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে হাঁ করে আছে। লোকটা বলে কী? গোবিন্দ ওস্তাদ! তার তো আজ বাদে কাল ফাঁসি হওয়ার কথা।

গোবিন্দ আবার টপ করে টুপিটা কপালে টেনে, চাঁদরে মুখ ঢেকে ফেলল।

একজন তোতলাতে তোতলাতে বলল, “গোবিন্দদা। তোমার না ফাঁসি হওয়ার কথা ছিল! ভুত হয়ে আসনি তো?”

আর একজন রামনাম করতে করতে কঁপা গলায় বলে, “সব ভুলে গেলে নাকি গোবিন্দদা?”

গোবিন্দ জবাব দিচ্ছিল না। খোলা দরজা দিয়ে তাবুর ভিতরে গোল জায়গাটা দেখছিল এক মনে। এই সার্কাসে সে বহু খেলা দেখিয়েছে। আপনা থেকেই তার একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে গেল।

জোয়ান-জোয়ান লোকগুলো তার দিকে তাকিয়ে আছে, কী করবে বুঝতে পারছে না। জেলে যাওয়ার আগে গোবিন্দ যখন সার্কাসে খেলা দেখাত তখনও সবাই তাকে ভয় খেত। মাথায় গোবিন্দ লম্বা নয় বটে, তবে তার গায়ে প্রচণ্ড জোরের কথা সবাই জানে। তার ওপর গোবিন্দর হাত-পা চলত বিদ্যুৎ গতিতে। তেমনি ছিল তার প্রচণ্ড রাগ। অমন খুনে রাগও দেখা যায় না। বড়-একটা। গোবিন্দকে তাই কেউ কখনো চটাতে সাহস করত না। আজও তাকে দেখে লোকগুলো ভয়ে ভাবনায় সিঁটিয়ে আছে।

গোবিন্দ মৃদুস্বরে একটা লোককে ডেকে আড়ালে নিয়ে বসল, “সামন্ত মশাইয়ের তবুটা কোন দিকে রে?”

“দেখা করবে গোবিন্দদা?”

“করেই যাই।”

“চলো তাহলে।” লোকটা খুশি হয়ে বলে, “সামন্তমশাই তোমার কথা খুব বলে। বলে, গোবিন্দটা খুন করল বটে, কিন্তু ওরকম খেলোয়াড় হয় না।”

গোবিন্দ একথার জবাব দিল না। বারো-তেরো বছর বয়সে সে সামন্ত মশাইয়ের সার্কাসে চলে এসেছিল। এই সার্কাসের সঙ্গে ঘুরে-ঘুরেই ছোটো থেকে বড় হয়েছে। সে আর-একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

সামন্তমশায়ের তাবুটা একটু পিছনের দিকে, আলাদা জায়গায়। তাঁবুর এমনিতে কোনো চাকচিক্য নেই, তবে ভিতরটা বেশ বৈঠকি ঢঙে সাজানো। সেজবাতি জ্বলছে। নিচু একটা তক্তপোষে পুরু গদির বিছানা। তার ওপর বেশ কয়েকটা পুরুষ্টু তাকিয়া। বুড়ো সামন্তমশাই বসে ভাল গন্ধওলা তামাক খাচ্ছে গড়গড়ায়। সামার চেহারা রোগার দিকেই, তবে রুগণ নয়। মাথার চুল কাঁচাপাকায় মেশানো। মত পাকানো গোঁফ। চোখের দিকে চাইলে বুক গুড়গুড় করে। ভয়ডর বলতে কিছু নেই সেই চোখে। তবে লোকে তাকে ভয় খায়, আবার ভালও বাসে। চিরকুমার সামন্তমশাই সারা জীবন তিলে তিলে এই সার্কাসখানা তৈরি করেছে। সার্কাসটাই তার ধ্যান-জ্ঞান। এটা থেকে তার বেশ মোটা লাভও হয়। কিন্তু সেই টাকা কে খাবে তার ঠিক নেই। সামন্ত তাই ইদানীং একটু চিন্তিত।

দুজনে ঘরে ঢুকতেই সামন্ত মুখ থেকে তামাকের নলটা সরিয়ে অল্প আলোয় ঠাহর করে দেখতে-দেখতে বলে, “কে রে? কী চায়?”

গোবিন্দ এগিয়ে গিয়ে ভঁয়ে মাথা ঠেকিয়ে দাঁড়াল। মুখের ঢাকা সরিয়ে বলে “আমি গোবিন্দ, সামন্তমশাই।”

সামন্ত যেন ছ্যাকা খেয়ে সোজা হয়ে বসে। বলে “কে বললি?”

“গোবিন্দ। মনে পড়ছে না?”

“গোবিন্দ।” বলে সামন্ত হতবুদ্ধি হয়ে চেয়ে থাকে। তারপর বলে “তোর না ফাঁসি হয়ে গেছে?”

“হলে আর আসতাম কী করে? “আয় তে, এগিয়ে আয়, আলোতে ভাল করে দেখি।”

গোবিন্দ হাসিমুখে এগিয়ে গেল। দাড়িগোঁফওয়ালা মুখে সেজবাতির আলো পড়ল।

******

রামু ট্রাপিজের খেলা দেখে তাজ্জব। কী সাহস। অন্য সব সার্কাসের মতো এরা নীচে কোনো জালও খাটায়নি। পড়ে গেলে মাথা ফেটে ঘিলু বেরিয়ে যাবে। হাত-পা ভেঙে “দ” হয়ে যাওয়ার কথা।

“উঃ, কী খেলা গবাদা। আমি ট্রাপিজ শিখব।”

গবা হেসে বলে, “আরো আছে। দেখই না”

ট্রাপিজ শেষ হতেনা-হতেই সাহেবি পোশাক পরা সার্কাসের ম্যানেজার এসে ঘোষণা করল, “আজ আপনাদের আমরা একটা নতুন। খেলা দেখাব। লখিন্দর আর কালনাগিনীর খেলা। জীবন ও মৃত্যুর খেলা। এই খেলায় একদিকে থাকবে আমাদের নতুন এক ওস্তাদ মাস্টার লখিন্দর অন্যদিকে থাকবে একটি বিষাক্ত রাজ-গোখরো। সাপটার বিষদাঁত আমরা কামাইনি। যে-কেউ পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। সদ্য জঙ্গল থেকে ধরা বুনো সাপ। এ খেলা সবার শেষে।”

রামু রোমাঞ্চিত হল। আজ নতুন খেলা বাঃ, কপালটা ভাল।

এরপর সাইকেল, দড়ি, বাঘ, সিংহ, চোখ বেঁধে ছোরা নিক্ষেপ–একের পর এক হয়ে যেতে লাগল। রামুর আর পলক পড়ে না। বাঘ-সিংহের খেলা দেখে গায়ে রোঁয়া দাঁড়িয়ে গেল তার। লম্বা আর বেটে জোকার দুটোও খুব হাসাল।

সবার শেষে নতুন খেলা।

সব আলো জ্বেলে গোল এরেনাটাকে একেবারে ফাঁকা করে দেওয়া হল। বাজনা বাজতে লাগল অত্যন্ত মৃদু শব্দে। একটা সুরেলা বাঁশির সুর কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল।

কয়েকজন তোক একটা মস্ত খাঁচা টেনে আনল মাঝখানে। স্পষ্টই দেখা যাচ্ছিল, খাঁচার মধ্যে একটা বিশাল ভয়ঙ্কর সাপ বিড়ে পাকিয়ে আছে।

খাঁচার মাথায় একটা লোক বসে আছে।

ম্যানেজার একটা পাটাতনের ওপর দাঁড়িয়ে ঘোষণা করল, “এবার আসছেন মাস্টার লখিন্দর। কিন্তু আগেই আপনাদের জানিয়ে রাখি, মাস্টার লখিন্দরের মুখ আপনারা দেখতে পাবেন না। কয়েক বছর আগে এক দুর্ঘটনায় ওর মুখটি পুড়ে বীভৎস হয়ে যায়। তার ফলে উনি সব সময়েই মুখোশ পরে প্রকাশ্যে আসেন।”

ঘোষণা শেষ হল। বাজনা মৃদু তরঙ্গে বাজতে লাগল। খাঁচার ওপরের লোকটা ছাড়া বাকি সবাই সরে গেল এরেনা থেকে।

আগাগোড়া কালো পোশাক এবং কালো মুখোশ পরা মাস্টার লখিন্দর এসে ঢুকল। ভারী চটপটে তার হাঁটার ভঙ্গি। চওড়া কাধ, সরু কোমর, আঁট পোশাকের ভিতর দিয়ে শরীরের শক্ত বাঁধুনি দেখা যাচ্ছে।

খাঁচার ওপরের লোকটা দরজাটা ওপর দিকে টেনে তুলতে না-ভুলতে বিশাল সাপটা বিদ্যুৎগতিতে বেরিয়ে এল বাইরে। লখিন্দর তখনো দর্শকদের অভিবাদন শেষ করেনি। ঠিক এই অপ্রস্তুত মূহুর্তে বিশাল গোখরো লখিন্দরের পিঠ সমান উঁচু ফণা তুলে সাঁই করে চাবুকের মতো ছোবল দিল।

সেই দৃশ্য দেখে আর সকলের মত চোখ বুজে ফেলল রামু। একটা মৃদু “গেল গেল এই রে, সব শেষ” গোছের আওয়াজও বেজে গেল চারদিকে।

<

Shirshendu Mukhopadhyay ।। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়