রামরাহা আংটির পিঠে তার সবল হাতখানা রেখে বলল, “তোমাদের তেমন যন্ত্রপাতি বা অস্ত্রশস্ত্র নেই বটে, কিন্তু দারুণ সাহস আছে। তোমাদের মতো আমাদের মা, বাবা, ভাইবোন নেই, কাকা মামার তো প্রশ্ন ওঠে না। আমাদের গ্রহমণ্ডলে ওসব সম্পর্কই নেই। জন্মের পর থেকেই আমরা স্বাধীন। তাই কারও জন্য কোনও পরোয়াও নেই। যাদের জন্য তুমি নিজে মরতে চাইছ, আমি হলে তাদের জন্য এক সেকেন্ডও চিন্তা করতাম না। সন্দেহ নেই তোমরা খুব সেকেলে, খুব আদিযুগে পড়ে আছ এখনও। তবু এইজন্যই তোমাদের ভাল লাগে আমার।”

আংটি ছলোছলে চোখে বলল, “মা, বাবা, দাদা, কাকাঁদের ভীষণ ভালবাসি যে।”

রামরাহা মাথা নেড়ে বলল, “আমরা ভালবাসা কাকে বলে জানিই না। আমরা শুধু কাজ করতে জানি, যুদ্ধ করতে জানি, ফসল ফলাতে জানি, যন্ত্রবিদ্যা জানি। আমাদের সঙ্গে যন্ত্রের খুব একটা তফাত যে নেই, তা এই পৃথিবীতে এবং বিশেষ করে তোমাদের এই পুবদিকের দেশে এসে বুঝেছি। তোমাদের কাছে এসে মনে হচ্ছে আমরা কী বিশ্রী জীবনই না যাপন করি।” বলতে বলতে রামরাহা একটা দূরবীনের মতো জিনিস চোখে এঁটে জলার দিকে তাকালেন। তারপর সামান্য উত্তেজিত গলায় বললেন, “আরে এরা যে একটা লোককে ওদের যানে তুলে নিয়েছে।”

আংটি বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে রামরাহার হাত থেকে যন্ত্রটা নিয়ে চোখে লাগাল। এবং বায়োস্কোপের ছবির মতো দেখতে পেল, একটা বিকট দানব জলা থেকে একজন মানুষকে ধরে নিয়ে ভিতরে চলে যাচ্ছে। সবচেয়ে ভয়ংকর কথা, মানুষটা তার বাবা।

আংটি কোনও আর্তনাদ করল না। যন্ত্রটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে সে হরিণের মতো টগবগে পায়ে জলার জলে নেমে ছুটতে লাগল। রাগে আর আতঙ্কে সে দিশেহারা। বুদ্ধি স্থির নেই।

বিশাল পটলের মতো মহাকাশযানটার কাছাকাছি পৌঁছতেই পথ আটকাল তার চেয়ে দশগুণ বড় দশাসই একটা দানব। আংটি বিন্দুমাত্র না ভেবে লাফিয়ে গিয়ে জোড়া পায়ে দানবটার পেটে লাথি কষাল, তারপর এলোপাথাড়ি কিল চড় ঘুসি ক্যারাটের মার কিছু বাদ রাখল না।

আশ্চর্যের বিষয় তার মতো খুদে মানুষের ওই তীব্র আক্রমণে দানবটা আধ মিনিট যেন হতভম্ব হয়ে গেল। একবার গোঙানির মতো যন্ত্রণার শব্দও করল একটা। কিন্তু সেটা আর কতক্ষণ? আংটির লড়াই করার ক্ষমতা আর কতটুকুই বা। দানবটা তার বিশাল হাতে আংটির ঘাড়টা ধরে শূন্যে ভাসিয়ে নিয়ে ঠিক তার বাবার মতোই মহাকাশযানের ভিতরে চৌকো ঘরটায় ফেলে দিল। আংটির তেমন লাগল না। লাফঝাঁপ তার অভ্যাস আছে। সে ঘরের চারদিকে তার বাবাকে খুঁজতে লাগল।

“বাবা!”

হরিবাবু খুবই অবাক হয়ে গেলেন আংটিকে দেখে। তারপর হাত বাড়িয়ে ছেলেকে কাছে টেনে নিয়ে বললেন, “তুই কোত্থেকে এলি?”

“বাবা! আমাদের ভীষণ বিপদ।” হরিবাবু মাথা নেড়ে বললেন, “সে তো বুঝতেই পারছি। যখন জাহাজের সঙ্গে মিল দেওয়ার মতো একটাও শব্দ খুঁজে পেলাম না, তখনই বুঝলাম আমাদের খুব বিপদ ঘটেছে নিশ্চয়ই, তা আর কী করা যাবে, তোদর দুই ভাইয়ের জন্য একটা ক্রিকেট বল রেখেছি। এই নে। বাবার ল্যাবরেটরিতে পেলাম। ভাবলাম তোরা খুব খেলা-টেলা ভালবাসিস, তোদের কাজে লাগবে হয়তো।”

আংটি গোল বস্তুটা হাতে নিয়ে বলল, “কিন্তু বাবা, এ তো ক্রিকেট-বল নয়।”

“তবে এটা কী?”

জিনিসটা হাতে তুলে নিয়ে দেখল আংটি। বেশ ভারী কোনও ধাতু দিয়ে তৈরি। গায়ে খুদে-খুদে বোতামের মতো কী সব রয়েছে। আংটির বুকটা গুড়গুড় করে উঠল। রামরাহা যে জিনিসটার কথা বলেছে, এটা সেটা নয় তো! দাদুর ল্যাবরেটরিতে যখন পাওয়া গেছে, তখন সেটাই হতে পারে। কিন্তু এই বস্তু দিয়ে কী করা যায় তা তো আংটি জানে না। সে জিনিসটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগল। দেখতে-দেখতে হঠাৎ চোখ পড়ল একটা বোতামের ওপর।

আংটি বোতামটায় হালকা আঙুলে একটা চাপ দিল। কিছুই ঘটল না। আংটি আর একটু জোরে চাপ দিল। কিছুই ঘটল না এবারও।

আংটি একটু ভেবে নিল। তারপর তার শরীরের সমস্ত শক্তি আঙুলে জড়ো করে প্রাণপণে বোতামটা চেপে ধরল।

.

ঘড়ি আর পঞ্চানন্দ সবই দেখছিল। তবে আবছাভাবে।

ঘড়ি মুখ চুন করে বলল, “ওরা বাবাকে ধরেছে, আংটিকেও ধরল, এবার কী করা যায় বলুন তো!”

পঞ্চানন্দ ভয়-খাওয়া মুখে বলল, “আমার মাথায় কিছু খেলছে না। তবে আংটি বড্ড বোকার মতো তেড়েফুঁড়ে গিয়ে বিপাকে পড়ে গেল। একটু বুদ্ধি খাটালে কাজ দিত।”

ঘড়ি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “কিন্তু বুদ্ধি তো মাথায় খেলছে না।”

পঞ্চানন্দ ঘড়ির দেখাদেখি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “আমার মাথাটা পেটের সঙ্গে বাঁধা। পেট ফাঁকা থাকলে মাথাটাও ফাঁকা হয়ে যায়। আর পেট ভরা থাকলে মাথাটাও নানারকম বুদ্ধি আর ফিকিরে ভরে উঠে। অনেকক্ষণ কিছু খাইনি তো।”

পঞ্চানন্দ কথাটা ভাল করে শেষ করার আগেই তার ঘাড়ে কঁত করে একটা শ্বাস এসে পড়ল। শ্বাস তো নয়, যেন ঘূর্ণিঝড়। পঞ্চানন্দ একটু শিউরে উঠে ঘাড় ঘুরিয়ে যা দেখল তাতে তার বাক্য সরল না। সে হাঁ করে রইল।

ঘড়ি নিবিষ্টমনে জলার মধ্যে দানবদের চলাফেরা লক্ষ্য করছিল। এক্ষুনি একটা কিছু করা দরকার। কিন্তু এই প্রবল প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে দুর্বল মানুষের কীই বা করার আছে। আচমকা সেও পিছন দিকে একটা কিছুর অস্তিত্ব টের পেল। বিদ্যুৎবেগে ঘাড় ঘুরিয়ে সেও যা দেখল তাতে আঁতকে ওঠারই কথা।

পিছনে বিকট এক চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে গজ-পালোয়ান। দু’খানা চোখ জুলজুল করে জ্বলছে। ফুলে-ওঠা শরীরটা যেন খুনখারাপির জন্য উদ্যত হয়ে আছে। হাতের আঙুলগুলো আঁকশির মতো বাঁকা।

ঘড়ি ঘুষি তুলেছিল, কিন্তু সেটা চালাল না। চাপা স্বরে বলল, “গজদা!”

গজ তার দিকে তাকাল। তারপর একটু ভাঙা-গলায় বলল, “তোরা এখানে কী করছিস?”

গজ যে মাতৃভাষায় স্বাভাবিকভাবে কথা বলবে, এটা ঘড়ি আশা করেনি। সে মনে-মনে ধরে নিয়েছিল, গজ-পালোয়ানও ওই বর্বর দানবদের একজন হয়ে গেছে। কিন্তু তা হয়নি দেখে সে স্বস্তির শ্বাস ছেড়ে বলল, “ওই দ্যাখো গজদা, জলার মধ্যে কী সব কাণ্ড হচ্ছে।”

গজ গম্ভীর মুখে বলল, “দেখেছি, আমাকে ওরাই আটকে রেখেছিল ওই গুহায়।”

ঘড়ি আকুল মুখে বলল, “এখন আমরা কী করব গজদা?”

“তোদের কিছু করতে হবে না। আমিই যা করার করছি।” এই বলে গজ-পালোয়ান নিঃশব্দে জলে নেমে গেল। ওই বিশাল দেহ দিয়ে যে কেউ এত সাবলীল চলাফেরা করতে পারে তা না দেখলে বিশ্বাস হয় না।

ঘড়িও টপ করে উঠে পড়ল। কিছু একটা করতে হবে। নইলে সাঙ্ঘাতিক একটা বিপদ ঘটবে। আর একটা কিছু করার এই সুযোগ। সে গজর পিছনে পিছনে এগোতে গিয়ে টের পেল, পঞ্চানন্দ জলে নেমে পড়েছে।

গজর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অবশ্য তারা পেরে উঠছিল না। গজ এগিয়ে যাচ্ছে মোটর-লঞ্চের মতো তীব্রবেগে। ঘড়ি আর পঞ্চানন্দ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জল ভেঙে এগোতে লাগল।

.

রামরাহা আংটির আকস্মিক প্রস্থানে একটু থমকে গিয়েছিল। তারপর সে আপনমনে একটু হাসল। স্মিত হাসি। যে জগৎ থেকে সে এসেছে সেখানে কেউ আবেগ বা ভালবাসা দিয়ে চালিত হয় না। তারা চলে হিসেব কষে। প্রতি পদক্ষেপই তাদের মাপা। কিন্তু এ পুরনো আমলের গ্রহটিতে মানুষজনের আচার ব্যবহার সে যত দেখছে তত ভাল লাগছে। তত এরা আকর্ষণ করছে তাকে।

রামরাহা নিজের মহাকাশযানে ফিরে যাবে বলে ঠিক করেছিল। কিন্তু এখন তার মনে হল, পৃথিবীর অসহায় এইসব মানুষজনকে বাঁচানোর একটা শেষ চেষ্টা করলে মন্দ হয় না।

রামরাহা ঘাড় ঘুরিয়ে অন্ধকারের দিকে চেয়ে চাপা গলায় বলল, “মাথুস, আমার বি মিটারটা নিয়ে এসো।”

সেই সিঁড়ি লোকটা অন্ধকার কুঁড়ে এগিয়ে এল। হাতে একটা খুব ছোট্ট থার্মোমিটারের মতো জিনিস।

রামরাহা কোমর থেকে বেল্টটা খুলে তার একটা সকেটে মিটারটা ঢুকিয়ে দিল। তারপর বেল্টটা কোমরে পরে নিয়ে সে জলের দিকে পা বাড়াল।

আশ্চর্যের বিষয় জলের দু’ইঞ্চি ওপরে যেন একটা অদৃশ্য কুশলে তার পার পড়ল। তারপর অনায়াসে জলের ওপর দিয়ে সে হাঁটতে লাগল।

হাতের মিটারটার দিকে বারবার চাইছিল রামরাহা। নানারকম আলোর সঙ্কেত ভেসে উঠছে। একটা আলোর রেখা বারবার ঢেউ খেলে যাচ্ছে।

আচমকা আলোর রেখাটা একটা পাক খেয়ে বৃত্ত রচনা করল। রামরাহা থমকে দাঁড়াল! এরকম হওয়ার কথা নয়। অজানা এক শক্তির উৎস কেউ ব্যবহার করছে। যদি যন্ত্রটা সক্রিয় হয়ে ওঠে, তবে পৃথিবীর সর্বত্র সবরকম শক্তির উৎস কিছুক্ষণের জন্য অকেজো হয়ে যাবে। বিজলি উৎপন্ন হবে না। পারমাণবিক সংঘাত একরত্তি তাপ দেবে না, থেমে যাবে বেশিরভাগ রি অ্যাকটর।

রামরাহা ভাবতে লাগল, বর্বররা যদি যন্ত্রটার সন্ধান পেয়েই থাকে তবে তারা। এত বোকা নয় যে, এই মোক্ষম সময়ে সেটা ব্যবহার করবে।

তবে? তা হলে?

যন্ত্রটা কে ব্যবহার করছে?

৩২.

দানবের মতো লোকগুলো তাদের দ্রুত ও অতিশয় শক্তিশালী খনক দিয়ে মাটির নীচে যে-সব গর্ত করে ফেলল, সেগুলো বহু মাইল গভীর। খনকগুলোর সঙ্গেই লাগানো রয়েছে চার্জ। বহু দূর থেকে বেতার-তরঙ্গের সঙ্কেতে সেগুলোকে সক্রিয় করা যায়। বিপুল এই উথাল-পাথাল শক্তিতে আলোড়িত হয়ে পৃথিবীর অভ্যন্তরে উথলে উঠবে। তারপর ভারসাম্য নষ্ট করে কক্ষচ্যুত টালমাটাল করে দেওয়া হবে পৃথিবীকে। সূর্যের বিপুল আকর্ষণ থেকে তার কোনও গ্রহকেই বাইরে টেনে নিয়ে যাওয়া সহজ নয়। মানুষের বিজ্ঞানে তা একরকম অসম্ভব। কিন্তু পৃথিবী নিজেই যদি মহাকাশযানে পরিণত হয়ে ছুটতে থাকে, তবে তাও সম্ভব। দানবেরা পৃথিবীর গভীরে চার্জ ঢুকিয়ে সেই ব্যবস্থাই করে রাখল। পৃথিবী যখন ছুটতে থাকবে সৌরলোকের বাইরে, তখন এক অদৃশ্য রশ্মি দিয়ে দূর থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হবে তাকে। কক্ষচ্যুত হলে প্রথম ধাক্কাতেই সমুদ্রে উঠবে বিপুল জলোচ্ছ্বাস, দেখা দেবে প্রবলতম ভূমিকম্প, অগ্ন্যুৎপাত। জীবজগৎ একরকম শেষ হয়ে যাবে তখনই। সৌরলোকের বাইরে পৌঁছলে উবে যাবে পৃথিবীর আবহমণ্ডল, কঠিন বরফের মৃত্যুহিম মোড়কে ঢেকে যাবে চরাচর। গ্রহটি পরে ফের নিজেদের বাসযোগ্য করে নেবে দানবেরা। তবে তখন আর সেটা এই পৃথিবী থাকবে না। এইসব গাছপালা, পাখি, জীবজন্তু, মানুষ, কিছুই না।

রামরাহা হাতের মিটারটার দিকে চেয়ে ভ্রূ কুঁচকে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। ছোট্ট কিন্তু বিপুল শক্তির আধার একটি রহস্যময় যন্ত্র এই অদ্ভুত কাণ্ডটি ঘটাচ্ছে। কিংবা যন্ত্রটাকে বলা যায় প্রতিশক্তির আধার। কাছাকাছি যত শক্তির উৎস আছে যন্ত্রটা ঠিক তার বিপরীত ধর্মে কাজ করে যায়। শক্তি ও প্রতিশক্তির সংঘাতে সৃষ্টি হয় একটা নিউট্রাল শূন্যতা। এরকম যন্ত্র রামরাহার অগ্রজ বিজ্ঞানীও আবিষ্কার করতে পারেনি। এই পুরনো আমলের গ্রহে একজন মানুষ কী করে বানাল এরকম জিনিস? তার চেয়েও বড় কথা, এ-যন্ত্র ব্যবহার করাও বড় সহজ নয়। বোধহয় কেউ সত্যিই সেটাকে কাজে লাগাচ্ছে। হয়তো আনাড়ির মতো। কিন্তু ঠিকমতো কাজে লাগাতে পারলে যন্ত্রটা অনেক অসম্ভব সম্ভব করবে।

রামরাহার অত্যন্ত হিসেবি মন জীবনে এই প্রথম একটু দ্বিধাগ্রস্ত হল। ইচ্ছে করলে সে এখনই বিপন্ন পৃথিবী থেকে নিজের প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে যেতে পারে। পৃথিবীর এক মহাসাগরের তলায় তার মহাকাশযান তৈরি আছে। মাত্র আধঘণ্টার মধ্যেই সেখানে পৌঁছে মহাকাশযানে করে পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ ছেড়ে মহাকাশে পাড়ি দেওয়া সহজ। আর যদি পৃথিবীকে বাঁচাতে চেষ্টা করে, তবে সেই কাজে বিপন্ন হবে তার প্রাণ। শেষ অবধি হয়তো পৃথিবীও বাঁচবে না, সেও নয়। তবে সে যদি ওই যন্ত্রটা হাতে পায়, তা হলে কোনও কথাই নেই।

রামরাহার দ্বিধাটা রইল কয়েক সেকেন্ড। তারপর সে স্থির মস্তিষ্কে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। তাকে একটা কাজই করতে হবে। ওই ছোট্ট ছেলেটিকে তার প্রিয়জনসহ কিছুতেই সে মরতে দেবে না। সুতরাং রামরাহাকে ওই দানবদের

আকাশযানে উঠতে হবে। দানবদের হাতে ধরা দিতে হবে।

“জানুস!”

সেই লম্বা লোকটা অবিকল রামরাহার মতোই জলের ওপর দিয়ে ভেসে এগিয়ে এল। রামরাহা তার সব বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি গা থেকে খুলে লোকটার হাতে দিয়ে বলল, “সেন্টারে গিয়ে অপেক্ষা করো।“

যন্ত্র না থাকায় রামরাহাকে জলে নামতে হবে। সঙ্গে কোনও অস্ত্র নেই। থাকলেও লাভ ছিল না। দানবদের ট্রেসারে তা ধরা পড়ত, এবং ওরা তা কেড়ে নিত।

রামরাহা খুব বোকা মানুষের মতো এগিয়ে গেল।

একজন দানব তাকে দেখে ক্রুদ্ধ এক শব্দ করল। বাকিরা বিদ্যুত-গতিতে ধেয়ে এল তার দিকে।

স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে রামরাহার পক্ষে এই আক্রমণ ঠেকানো মোটেই শক্ত কাজ ছিল না। কিন্তু এখন সে একটুও গায়ের জোর দেখাবে না, তবে সামান্য একটু বাধা দেবে। নইলে ওরা সন্দেহ করতে পারে।

প্রথম যে দানবটা তার দিকে তেড়ে এল, তাকে এড়াতে রামরাহা একটু দৌড়ে পালানোর ভান করল। লোকটা লম্বা হাত বাড়িয়ে খামচে ধরল তার কাঁধ। আর একজন তার দু পা ধরে সটান শূন্যে তুলে ফেলল। তারপর একটা আছাড়।

রামরাহা হাসছিল। দশতলা বাড়ি থেকে সে তো কতদিন স্রেফ লাফ দিয়ে। নেমেছে। তবু সে একটু যন্ত্রণার শব্দ করল। তিন-চারজন দানব এসে চ্যাংদোলা করে তুলে নিল তাকে। এরা একটা অদ্ভুত ভাষায় নিজেদের মধ্যে কথা বলছে।

রামরাহা চুপ করে কথাগুলো শুনতে লাগল। তার সঙ্গে অনুবাদ্যন্ত্র নেই। কিন্তু বিপুল বিশ্বের অনেক গ্রহে সে ঘুরেছে, ভাষাও শুনেছে হাজার রকম। শব্দ সম্পর্কে তার অভিজ্ঞতা বিপুল। তাই সে শব্দ ধরে ধরে অর্থে পৌঁছানোর চেষ্টা করতে লাগল মনে-মনে। তার মাথা টেপরেকর্ডারের মতোই নির্ভুল স্মৃতিশক্তির অধিকারী। যা শেনে বা দ্যাখে, সব হুবহু মনে থাকে।

খানিকক্ষণ শুনে রামরাহা বুঝতে পারল, এরা পৃথিবী থেকে কিছু মানুষকে জ্যান্ত অবস্থায় নিজেদের গ্রহে নিয়ে যাচ্ছে নমুনা হিসেবে। এইসব মানুষের হৃৎপিণ্ড, রক্ত, ফুসফুস সব তারা পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষা করবে। দেখবে এদের বেঁচে থাকার পদ্ধতি। এর জন্য কয়েকজন মানুষকে মেরে ফেলতে হবে। বাকিদের জিইয়ে রেখে দেওয়া হবে চিড়িয়াখানার জন্তু হিসেবে।

চ্যাংদোলা করে এনে যে-ঘরটায় দানবেরা তাকে ফেলে দিল, সেটাতে রামরাহা বেশ কয়েকজন মানুষকে দেখতে পেল। যাকে দেখে সে সবচেয়ে খুশি হল, সে আংটি।

আংটি তাকে দেখেই চেঁচিয়ে উঠল, “রামরাহা!”

রামরাহা হাত বাড়িয়ে বলল, “যন্ত্রটা দাও।”

“যন্ত্র!” বলেই কেমন বিবর্ণ হয়ে গেল আংটি। তারপর মাথা নেড়ে বলল, “নেই। কেড়ে নিয়ে গেছে।”

“কী করে কাড়ল?”

“আমি যন্ত্রটায় একটা রঙিন বোম দেখে চেপে দিয়েছিলাম। খুব জোরে। তাতে কিছু হয়নি। কিন্তু হঠাৎ একটা দানব এসে হাজির। আমাকে একটা ধাক্কা দিয়ে ফেলে যন্ত্রটা কেড়ে নিয়ে গেল এই একটু আগে।”

রামরাহা ঠোঁট কামড়াল।

“কী হবে রামরাহা?”

“দেখা যাক। কাজটা আর সহজ রইল না, এই যা।”

হঠাৎ একজন লোক এগিয়ে এসে রামরাহার মুখের দিকে চেয়ে করুণ স্বরে বলল, “আচ্ছা মশাই, জাহাজের সঙ্গে মেলানো যায়, এমন একটা শব্দ বলতে পারেন?”

রামরাহা অবাক হয়ে বলল, “জাহাজ!”

আংটি বলল, “ইনি আমার বাবা। আমার বাবা একজন কবি।”

“কবি! কবি কাকে বলে?”

“যারা কবিতা লেখে।” রামরাহা মাথা চুলকে বলল, “কবিতা! কিন্তু আমাদের দেশে তো এরকম কোনও জিনিস নেই। কবিতা! কবিতা! কীরকম জিনিস বলো তো!”

হরিবাবু খুব দুঃখের সঙ্গে বললেন, “তা হলে আপনার দেশেরই দুর্ভাগ্য রাহাবাবু। বাঙালি হয়ে কবিতা কাকে বলে জিজ্ঞেস করছেন! আপনার লজ্জা হওয়া উচিত।”

যে-সময়ে এই নাটক ভিতরে চলছিল, ঠিক সেই সময়ে গজ-পালোয়ান তার অতিকায় চেহারাটা নিয়ে শ্বাপদের মতো এসে পৌঁছল মহাকাশযানের কাছে। একজন দানব মাত্র পাহারায়। বাকিরা রামরাহাকে ভিতরে নিয়ে গেছে, এখনও ফেরেনি।

গজ-পালোয়ান একবার চারদিকটা দেখে নিয়ে নিঃশব্দে কয়েক পা এগিয়ে দাবনটার ঘাড়ে লাফিয়ে পড়ল।

দানবটা চকিত পায়ে একটু সরে গিয়েছিল শেষ মুহূর্তে নিজের বিপদ টের পেয়ে। তবে গজকে সম্পূর্ণ এড়াতে পারেনি সে। গজ’র কাঁধের ধাক্কায় সে ছিটকে গেল খানিকটা। তারপর উঠে এসে গজকে দুহাতে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করল।

কিন্তু পারবে কেন! গজ’র শক্তি এবং মত্ততা দুই-ই দশ-বিশ গুণ বেড়েছে। উপরন্তু সে তার প্যাঁচ-পয়জারও ভোলেনি। সে দু’হাতে বিপুল দু’খানা ঘুষি চালাল দাবনটার মুখে। দাবনটা টাল খেয়ে পড়ে যাচ্ছিল। গজ তার পা দুখানা ধরে পেল্লায় দুটো পাক মারল মাথার ওপর তুলে। তারপর একটি আছাড়।

কিন্তু আছাড় মারতে গিয়েই দানবটার কেঁচড় থেকে কী একটা ভারী আর শক্ত জিনিস ঠক্ করে গজ’র মাথায় পড়ল।

‘উঃ,” বলে বসে পড়ল গজ।

দানবটা উপুড় হয়ে পড়ে রইল। নড়ল না।

ঘড়ি আর পঞ্চানন্দ এসে গজকে ধরল।

“তোমার কী হল গজদা! দানোটাকে তো আউট করে দিয়েছ।”

পঞ্চানন্দ হাতে টর্চটা জেলে গজ’র মাথাটা দেখে বলল, “এঃ,খুব লেগেছে এখানটায়। কালসিটে দেখা যাচ্ছে। …আরে, ওটা কী?” এই বলে পঞ্চানন্দ মাটি থেকে একটা গোলাকার বস্তু তুলে নিয়ে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখতে লাগল।

ঘড়ি হাত বাড়িয়ে বলল, “দেখি।“

পঞ্চানন্দ হঠাৎ “বাপ রে” বলে আঁতকে উঠে চেঁচাল, “দৌড়ও! আসছে!” কিন্তু সামান্য বে-খেয়ালে যে-ভূল তারা করে ফেলেছিল, তা আর শোধরানো গেল না। চার-পাঁচজন দানো চোখের পলকে ঘিরে ফেলল তাদের।

শেষ চেষ্টা হিসেবে হাতের ভারী বলের মতো বস্তুটা পঞ্চানন্দ প্রাণপণে ছুঁড়ে মারল একজন দানোর মাথা লক্ষ্য করে। কিন্তু দানোটা স্লিপের দক্ষ ফিল্ডারের মতো সেটা লুফে নিল।

কয়েক মিনিটের মধ্যেই তারা একে-একে নিক্ষিপ্ত হল দানোদের মহাকাশ যানের গুপ্ত ঘরে। আংটি চেঁচিয়ে উঠল, “দাদা!”

বড়ছেলে ঘড়িকে দেখে হরিবাবু খুশি হলেন। তবে পঞ্চানন্দকে দেখে তাঁর প্রাণে যেন জল এল। হরিবাবু ভারি খুশি হয়ে বললেন, “পঞ্চানন্দ যে!”

“আজ্ঞে আমিই। যেই শুনলুম আপনাকে এই গাধাগুলো ধরে এনেছে, অমনি আর থাকতে পারলুম না, ছুটে এলুম। তা ভাল তো কর্তাবাবু?”

“ভাল আর কী করে থাকব বলল। জাহাজের সঙ্গে মিল দিয়ে একটা শব্দও যে মাথায় আসছে না। নাগাড়ে ঘণ্টা-দুই ধরে ভাবছি।”

পঞ্চানন্দ একগাল হেসে বলল, “জাহাজ যখন পেয়েছেন, তখন মিলটা আর এমন কী শক্ত জিনিস। হয়ে যাবে’খন।”

“আচ্ছা, মমতাজ শব্দটা কি চলবে হে পঞ্চানন্দ?”

পঞ্চানন্দ মাথা নেড়ে বলল, “চলবে, খুব চলবে।”

“কিন্তু একটা অক্ষর যে বেশি হয়ে যাচ্ছে হে।”

“তা হোক। অধিকন্তু ন দোষায়।”

“না হে না, কবিতায় অধিকন্তু চলে না ননও চলে না। দেখি আর একটু ভেবে। সময়টাও কাটাতে হবে।“

এসব কথা যখন চলছে, তখন হঠাৎই একটা শিহরন টের পেল সবাই। তারপর তীব্র একটা বাতাস কাটার শব্দ। একটা ভারহীনতার অনুভূতি।

সবাই কেমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বাক্যহারা হয়ে গেল। রামরাহা আংটির কানে কানে বলল, “আমরা পৃথিবী ছেড়ে চলেছি। আতঙ্কিত আংটি বলল, “কোথায়?”

“মহাকাশে।” আংটি বোবা হয়ে গেল।

যে গর্ত দিয়ে তাদের ঘরের মধ্যে ফেলা হয়েছে, সেটার দিকে চোখ রেখেছিল রামরাহা। গর্তটার কোনও পাল্লা বা ঢাকনা নেই। একজন দানব ওপরে দাঁড়িয়ে তাদের নজরে রাখছে। তার হাতে একটা খুদে যন্ত্র, অনেকটা। ইনজেকশনের সিরিঞ্জের মতো। যন্ত্রটা চেনে রামরাহা। ছুঁচের মুখ দিয়ে তরলের পরিবর্তে একটা আলোর রেখা বেরিয়ে আসে। যাকে লক্ষ্য করে ছোঁড়া হয়, সে কয়েক ঘণ্টার জন্য ঘুমিয়ে পড়ে।

রামরাহা আংটিকে বলল,” শোনো আংটি, এখান থেকে গর্তটার মুখ দশ ফুটের বেশি উঁচু হবে না। আমার পক্ষে এই দশ ফুট লাফিয়ে ওঠা খুব শক্ত কাজ নয়। এমনকী, ওই দানবটাকে কজা করাও কঠিন হবে না। কিন্তু তারপরেই গণ্ডগোল দেখা দেবে। আমরা সবাই মিলে লড়াই করে ওদের হারিয়ে দিলেও পৃথিবী বাঁচবে না। কারণ ওরা একা নয়। পৃথিবীর আরও কয়েক জায়গা থেকে ঠিক এই সময়ে একই রকম মহাকাশযানে আরও কতগুলো দানব মহাকাশে উড়ে যাচ্ছে। ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই ওরা দূর-নিয়ন্ত্রণে পৃথিবীকে ভারসাম্যহীন করে। দেবে। তারপর চার্জগুলো চালু করবে। যা করবার করতে হবে এক ঘণ্টার মধ্যেই।”

“কী করব রামরাহা?”

“আমার ওই গোলকটা চাই। ওটা হাতে পেলে সবই সম্ভব। নইলে…..”

“নইলে কী হবে সে তো জানি।”

“তা হলে তৈরি হও। আমি যখন লাফ মারব, তখন তুমি আমার কোমর ধরে ঝুলে থাকবে। খুব শক্ত করে ধরবে। পড়ে যেও না। আমি উপরে উঠেই দানবটার সঙ্গে লড়াই করব। সেই ফাঁকে তুমি সরে পড়বে। যেমন করেই হোক, গোলকটা তোমাকে উদ্ধার করতে হবে। আমাদের বাঁচার এবং পৃথিবীকে বাঁচানোর ওইটেই একমাত্র এবং শেষ অবলম্বন। পারবে?”

আংটি দাঁতে ঠোঁট টিপে বলল, “এমনিতেও তো মরতেই হবে। পারব।”

“তবে এসো। গেট রেডি।”

দশ ফুট হাইজাম্প দেওয়া যে সম্ভব, এটা বিশ্বাস করাই শক্ত। বিশেষ করে একটুও না দৌড়ে শুধু দাঁড়ানো অবস্থা থেকে এতটা উঁচুতে লাফানো এক অলৌকিক ব্যাপার। আংটির বিশ্বাস হচ্ছিল না। তবু রামরাহার কোমর ধরে দাঁড়াল। মহাকাশযানটা কাঁপছে আর কেমন যেন একটা শিহরন খেলে যাচ্ছে। বাতাসে। কানে একটা অদ্ভুত শব্দ বা তরঙ্গ এসে লাগছে। মহাকাশের অভিজ্ঞতা তো নেই আংটির। তার হাত-পা অবশ হয়ে আসছিল। তবু সে প্রাণপণে ধরে রইল রামরাহাকে।

রামরাহা ওপরের দিকে চেয়ে একটু হিসেব কষে নিল। মহাকাশে যদিও ভারহীন অবস্থায় তারা পৌঁছে গেছে, তবু এই মহাকাশযানে সেটা টের পাওয়া যাচ্ছে না। কৃত্রিম উপায়ে এরা এই ঘরে পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণের মতোই অবস্থা সৃষ্টি করে রেখেছে। সেইটে হিসেব কষে নিয়ে রামরাহা আচমকা শূন্যে একটা রকেটের মতো মসৃণ লাফ দিল। আংটির মনে হল, সে যেন লিফটে করে ওপরে উঠে যাচ্ছে।

চমৎকার লাফ। গর্তটার ভিতর দিয়ে সোজা উঠে দু’পাশে ছড়ানো পায়ে দাঁড়িয়েই দানবটাকে রামরাহা দুই হাতে ধরেই শূন্যে তুলে ফেলল। তারপর চাপা গলায় বলল, “আংটি পালাও। কাজ সেরে আসা চাই।”

৩৩.

কোন দিকে যেতে হবে, কোথায় খুঁজতে হবে, তার কিছুই জানে না আংটি। তবু অন্ধের মতো সে ছুটতে চেষ্টা করল। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল, রামরাহা দৈত্যটাকে স্রেফ দু’হাতে ধরে ওয়েটলিফটার যেমন মাথার ওপর ভার তুলে দাঁড়ায় তেমনি তুলে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। দৈত্যটা অসহায়ের মতো হাত-পা ছুঁড়ছে।

দানবদের মহাকাশযান তাদের আকারেই তৈরী। মস্ত মই, মস্ত বড় সব যন্ত্রপাতি, বিশাল সব কুঠুরি। তার মধ্যে মেলা অলিগলিও আছে। কোন্ দিকে যাবে তা আংটি বুঝতে পারছিল না। সামনে যে পথ বা সিঁড়ি পাচ্ছে, তাই দিয়ে এগোচ্ছে বা উঠছে। এক জায়গায় ভারী কাঁচ লাগানো গোল একটা জানালা দেখতে পেয়ে কৌতূহল চাপতে পারল না আংটি। উঁকি দিয়ে সে এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখতে পেল। কুচকুচে কালো আকাশে এক অতিশয় উজ্জ্বল সূর্য জুলজুল করছে। একটু দূরে এক নীলাভ সবুজ বিশাল গ্রহ। গ্রহটাকে চিনতে অসুবিধে হল না আংটির। তাদের আদরের পৃথিবী। পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে আফ্রিকা, দক্ষিণ ভারত, এশিয়া, আরব সাগর, ঠিক যেমন মানচিত্রে দেখেছে। পৃথিবী যে কত সুন্দর তা প্রাণ ভরে আজ উপলব্ধি করল আংটি। চাঁদকে দেখতে পেল সে। আবহমণ্ডলহীন আকাশে গ্রহনক্ষত্র চৌগুণ উজ্জ্বল হয়ে ফুটে আছে। মহাকাশে যেসব শারীরিক অসুবিধে বোধ করার কথা, তার বিশেষ কিছুই টের পাচ্ছিল না আংটি। তবে মাঝে-মাঝে গা গুলোচ্ছে আর কানে তালা লাগছে।

সুন্দর পৃথিবীর দিকে চেয়ে আংটি চোখের জল মুছল। এমন সুন্দর গ্রহকে ধ্বংস হতে দেয়া যায়? রামরাহা অপেক্ষা করছে। তাকে গোলকটা উদ্ধার করতেই হবে।

আংটি সামনেই একটা লোহার মই পেয়ে উঠতে লাগল। ওপরে একটা গলি পথ। আংটি গলি ধরে খানিক দূর এগিয়ে একটা ধাতুর তৈরি বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়াল। দরজায় হাতল নেই, নব নেই। একেবারে লেপাপোছা।

আংটি দরজায় কান পেতে শোনার চেষ্টা করল। ভিতর থেকে মৃদু সব যান্ত্রিক শব্দ আসছে। দু-একটা দুর্বোধ্য কথাবার্তা। আংটির কাছে সবটাই দুর্বোধ্য। আংটি কী করবে তা বুঝতে না পেরে দাঁড়িয়ে রইল। দানবেরা যে খুবই উন্নতমানের বিজ্ঞানী সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। নইলে পৃথিবীর মতো বিশাল একটি গ্রহকে সূর্যের পরিমণ্ডল থেকে ছিঁড়ে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনাও যে অসম্ভব। কিন্তু মস্ত বিজ্ঞানী হলেও তারা মানুষের মতো নয়। কোথাও যেন বাস্তববোধ এবং সাধারণ বুদ্ধির একটু খামতি আছে।

এতক্ষণ নিশ্চয়ই রামরাহাও চুপ করে বসে নেই। সেও একটা কিছু করছে। কিন্তু যে যাই করুক গোলকটা হাতে না পেলে সবই পণ্ডশ্রম। একটু বাদেই দানবদের মহাকাশযান থেকে পৃথিবীর অভ্যন্তরে ভয়ংকর সব চার্জ-এ বিস্ফোরণ ঘটানো হবে। তারপর আলোর চেয়েও বহু-বহুগুণ গতিবেগে দানবেরা ছুটতে থাকবে তাদের নিজস্ব গ্রহমণ্ডলের দিকে।

আংটি দরজাটার গায়ে হাত বুলিয়ে দেখল। মসৃণ। খুবই মসৃণ এক ধাতু দিয়ে তৈরি। অনেকটা সোনার মত রঙ। তবে বেশি উজ্জ্বল নয়।

“এখানে কী করছিস?”

চাপা গলায় একথা শুনে আংটি চমকে উঠল। অবাক হয়ে চেয়ে দেখল, তার পেছনে ঘড়ি দাঁড়িয়ে আছে। আংটি মস্ত বড় একটা শ্বাস ফেলে বলল, “দাদা! তুই কী করে উঠে এলি?”

“গজদার কাঁধে ভর দিয়ে উঠে। রামরাহা তুলে নিল।”

“রামরাহা কোথায়?”

“ধারেকাছেই কোথাও আছে। এই ঘরটার মধ্যে কী হচ্ছে?”

“বুঝতে পারছি না। তবে কথাবার্তার শব্দ শুনছি। তোর হাতে ওটা কী?”

ঘড়ি নিজের হাতের রুমালের পুঁটুলির দিকে চেয়ে বলল, “একটা কঁকড়া বিছে।”

“কাঁকড়াবিছে! কোথায় পেলি?”

“সে অনেক কথা। তবে এটা খুব সহজ জিনিস নয়। দেখবি?” ঘড়ি রুমালটা মেঝেয় রেখে রুমালের গিট খুলে দিল। সবুজ রঙের বিছেটা ঝিম মেরে রয়েছে। একটা সুগন্ধে চারদিক ভরে যেতে লাগল। এত সুন্দর গন্ধ যে ঘুমিয়ে পড়তে ইচ্ছে করে।

দুই ভাই হঠাৎ অবাক হয়ে দেখল, কঁকড়াবিছেটা একটা ডিগবাজি খেয়ে আস্তে-আস্তে দরজাটার দিকে এগোতে লাগল। দরজার তলার দিকে সামান্য একটু ফঁক রয়েছে। আধ সেন্টিমিটারেরও কম। বিছেটা কিন্তু ধীরে ধীরে গিয়ে সেই ছোট্ট ফাঁকের মধ্যে নিজের শরীরটা ঢুকিয়ে দিল। তারপর সুট করে ঢুকে গেল ভিতরে। ঘড়ি ওটাকে আটকানোর চেষ্টা করল না দেখে আংটি বলল, “যেতে দিলি কেন?”

“দেখা যাক না, কী করে।”

দুই ভাই দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে চারদিকটা খুব ভাল করে লক্ষ্য করল। দেখার মতো কিছুই নেই। মেঝে দেওয়াল ছাদ সবই মসৃণ ধাতুর তৈরি। ওপরে সারি সারি পাথরের স্নিগ্ধ আলো জ্বলছে।

দরজাটা যে খুব ধীরে-ধীরে খুলে যাচ্ছে, এটা প্রথম লক্ষ্য করল আংটি। সে শিউরে ঘড়ির হাত চেপে ধরল। দরজাটা খুলছে খুব অদ্ভুতভাবে। নীচে থেকে ওপরে উঠে যাচ্ছে থিয়েটারের ডুপস্ক্রিনের মতো।

খোলা দরজার ওপাশে মস্ত একখানা ঘর। তীব্র আলো জ্বলছে। হাজার রকমের কনসোল, যন্ত্রপাতি, শব্দ। খোলা দরজা দিয়ে টলতে টলতে একজন দানব বেরিয়ে এল। তার মুখের করুণ ভাব দেখেই বোঝা যায় যে, সে সুস্থ নয়। জিভ বেরিয়ে ঝুলে আছে। গলা থেকে একটা গোঙানির শব্দ আসছে।

আংটি শিউরে উঠে বলল, “দাদা!”

ঘড়ি হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, “ভয় পাসনি। এটা ঐ কাঁকড়াবিছের কাজ।”

দানবটা তাদের দেখতে পেয়ে একটু থমকাল। কোমরের দিকে হাত বাড়াল। কিন্তু যে জিনিসের জন্য হাত বাড়িয়েছিল তা ছোঁওয়ার আগেই ঘড়ি লাফিয়ে পড়ল তার ওপর। দুর্বল দানবটা ঘড়ির দুটো ঘুষিও সহ্য করতে পারল না। গদাম করে পড়ে গেল মেঝের ওপর। ঘড়ি তার কোমরের বেল্ট থেকে একটা ছোট্ট লাইটের মতো যন্ত্র খুলে নিল।

আংটি বলল, “ওটা কী করে?”

“জানি না। তবে কাজে লাগতে পারে। আমরা না পারি, রামরাহা কাজে লাগাবে। এখন আয়, ভিতরটা দেখি। হামাগুড়ি দিয়ে আসবি কিন্তু।”

দুই ভাই হামাগুড়ি দিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়ল। চারদিকে যা তারা দেখছে তার কিছুই তারা কস্মিনকালেও দ্যাখেনি। চারদিকটায় এক যান্ত্রিক বিভীষিকা। তারই ফাঁকে ফাঁকে এক-আধজন দানবকে মনোযোগ দিয়ে কাজ করতে দেখা যাচ্ছে। কোনওদিকে দৃকপাত নেই।

আংটি কাঁকড়াবিছেটাকে আবিষ্কার করল একটা টেবিলের নীচে। ঝিম মেরে পড়ে আছে। সে ঘড়িকে একটা খোঁচা দিয়ে বিছেটাকে দেখাল।

ঘড়ি টপ করে বিছেটার হুলের নীচে দু’আঙুল দিয়ে ধরে সেটাকে তুলে নিল হাতের তেলোয়। তারপর চাপা গলায় বলল, “এটা মাঝে-মাঝে নেতিয়ে পড়ে কেন ভেবে পাচ্ছি না।”

বলে সে চিত করে বিছেটার বুকের কাছটা দেখল। ছোট-ছোট সব বোতামের মতো জিনিস রয়েছে। একটার রং লাল। ঘড়ি সেটা একটু চাপ দিতেই ক্লিক করে একটা শব্দ। তারপরই বিছেটা চাঙ্গা হয়ে উঠল। ঘড়ি কাছাকাছি যে দানবটার পা দেখতে পাচ্ছিল সেটার দিকে মুখ করে মেঝেয় ছেড়ে দিল বিছেটাকে। অমনি বিছেটা একটা দম-দেওয়া খেলনাগাড়ির মত বেশ দ্রুত বেগে সেই পা লক্ষ্য করে এগিয়ে গেল।

যন্ত্রপাতির প্রবল শব্দের মধ্যেও দানবটার চাপা আর্তনাদ শুনতে পেল তারা। দানবটা উঠে দাঁড়াল, তারপর থরথর করে কেঁপে পড়ে গেল মেঝেয়। তারপর উঠে টলতে টলতে দরজার দিকে রওনা হল।

ঘড়ি সময় নষ্ট করল না। হঠাৎ লাফিয়ে উঠে দানবটাকে টেনে মেঝেয় ফেলে তার মুখে দুখানা ঘুষি বসিয়ে দিল দ্রুত পর পর। এই দানবের কোমরে পাওয়া গেল ডটপেনের মতো একটা বস্তু। ঘড়ি সেটাও খুলে নিল।

আংটি দানবটার শরীর হাতড়ে বলল, “গোলকটা এর কাছে নেই।” ঘড়ি কাঁকড়াবিছেটাকে আবার তুলে চালু করে ছেড়ে দিল। একটু বাদেই আবার এক দানব একইভাবে আর্তনাদ করে উঠল। কিন্তু এবার ঘড়ির কাজটা আর সহজ হল না। হঠাৎ অন্য তিন-চারজন দানব একসঙ্গে ফিরে তাকাল ভূপতিত দানবটার দিকে। তারপর ছুটে এল সকলে।

প্রথমেই ধরা পড়ে গেল ঘড়ি। একজন দানব একটা থাবা মেরে তাকে তুলে নিল বেড়ালছানার মতো।

আংটি একটু আড়াল পেয়ে গিয়েছিল। তার সামনে একটা বাক্সের মতো জিনিস। বাক্সের একটা ডালাও আছে। আংটি চিন্তাভাবনা না করে ডালাটা তুলে ভিতরে ঢুকে পড়ল। তারপর ডালাটা আস্তে জোরে নামাল। ঘড়ির কী হল তা সে বুঝতে পারল না।

বাক্সের মধ্যে ঘোর অন্ধকার। হাত বুলিয়ে-বুলিয়ে চারদিকটা দেখল আংটি। আংটির হিসেবমতো দানবেরা ছ-সাতজনের বেশি নেই। একজনকে রামরাহা জব্দ করেছে। বাকি তিনজন বিছের কামড়ে কাহিল। খুব বেশি হলে দু-তিনজন দানবের মহড়া নিতে হবে। ভেবে বুকে একটু বল এল আংটির। খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে সে খুব সন্তর্পণে ডালাটা ঠেলে তুলল।

ঘরের ছাদের কাছে ক্যাটওয়াকের মতো একটা জায়গায় একজন দানব দাঁড়িয়ে চারদিকে দেখছে। আংটির সঙ্গে তার চোখাচোখি হয়ে গেল। কিন্তু দানবটা তাকে দেখতে পেয়েছে বলে মনে হল না। বাক্সের সামনে মেঝের ওপর লাইটারের মতো জিনিসটা পড়ে আছে। ওটা দিয়ে কী হয় তা জানে না আংটি। কিন্তু মনে হল, কোনও অস্ত্রই হবে। সে যন্ত্রটার দিকে হাত বাড়াল। খুব ধীরে ধীরে। তার চোখ ওপরে দানবটার দিকে।

শেষ মুহূর্তে একটু নার্ভাস হয়ে গিয়েছিল আংটি। যন্ত্রটা তুলতে গিয়ে একটু দ্রুত হাত বাড়িয়েছিল। সেই নড়াটুকু চোখে পড়ে গেল দানবটার। ওই ওপর থেকে দানবটা এক লাফে নীচে নামল।

আংটি যন্ত্রটা তুলে নিয়ে কিছু না বুঝেই দানবটার দিকে সেটা তাক করে ট্রিগার বা ওই জাতীয় কিছু খুঁজতে লাগল। বুড়ো আঙুলের তলায় আলপিনের

মাথার মতো কিছু একটা অনুভব করে সেটায় প্রাণপণে চাপ দিল সে।

চিড়িক করে একটা শব্দ। বুলেট নয়, অন্য কিছু একটা জিনিস ছুটে গেল দানবটার দিকে। দানব কাটা কলাগাছের মতো লুটিয়ে পড়ল মেঝের ওপর।

অন্য সব দানবেরা চিৎকার করে ছুটে এল।

আংটি বুঝল, লুকিয়ে থাকা বৃথা। সে বাক্সের ডালাটা খুলে বেরিয়ে এসে যন্ত্রটা আর-একজনের দিকে তাক করল। কিন্তু তার হাত উত্তেজনায় ভয়ে এত কাপছিল যে, লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে গেল সে। অমনি দানবটা একটা হুঙ্কার দিয়ে ঝাঁপ খেল তার ওপর।

দানবের শরীরের চাপে চিড়েচ্যাপ্টাই হয়ে যেত সে। কিন্তু হঠাৎ বিদ্যুতের বেগে আর-একটা লোক যেন শূন্য দিয়ে ভেসে এল। আর তার দুই লোহার হাতে দানবটাকে তুলে অন্য দিকে ছুঁড়ে দিল।

“রামরাহা!” চেঁচিয়ে উঠল আংটি। শেষতম দানবটি দৃশ্যটা দেখে চকিতে তার বেল্ট থেকে একটা জিনিস খুলে আনল। সেটা তাক করল রামরাহার দিকে।

এবার আংটির পালা। এক বানরের লাফে সে দানবের হাত ধরে ঝুলে পড়ল। ঝুল খেয়েই দানবের হাঁটুটায় সে পেল্লায় এক কিক জমিয়ে দিল।

মনঃসংযোগে এই সামান্য ব্যাঘাতই চাইছিল রামরাহা। উড়ন্ত এক বল্লমের মতো সে দানবটার বুকে এসে পড়ল। তারপর দানবটাকে অনায়াসে দু’হাতে তুলে আছড়ে ফেলল সে।

রামরাহা সব ক’জন দানবের শরীর তল্লাশ করে বলল, “কিন্তু গোলকটা কোথায়? সেটা না পেলে তো সব চেষ্টা বৃথা যাবে।”

আংটি আর্তনাদ করে উঠল, “নেই”?

কোথা থেকে ক্ষীণ একটা গলা বলে উঠল, “আছে। এখানে!”

রামরাহা দৌড়ে গেল দেয়ালের কাছে। দেয়ালে কম্বিনেশন লকের মতো গোল চাকতি আর নানা সংকেত! রামরাহা কয়েক সেকেন্ড চিন্তা করে নিয়ে ডিস্কটা ঘোরাতে লাগল। একসময়ে চড়াক করে দেয়ালের গায়ে একটা কুলুঙ্গির ঢাকনা খুলে গেল। তার মধ্যে ঘড়ি। ঘড়ির হাতে গোলক। মুখে হাসি।

রামরাহা গভীর একটা শ্বাস ফেলে পরম নিশ্চিন্তে বলল, “আর ভয় নেই।”

বলাই বাহুল্য, মানুষের মস্ত এক বিপদ ঘটতে-ঘটতেও শেষ অবধি ঘটতে পারেনি। অল্পের জন্য ফঁড়াটা কেটেছে। কিন্তু এ-গল্পের শেষ অবধি কী ঘটল সেটা জানার ইচ্ছে আমাদের হতেই পারে।

রামরাহা খুবই দক্ষতার সঙ্গে সেই গোলকটি ব্যবহার করে দানবদের পুঁতে রাখা চার্জ অকেজো করে দেয়। তার আগেই সে অবশ্য মহাকাশযানটিকে নামিয়ে এনেছিল। নইলে প্রতিশক্তি উৎপাদক গোলকটির প্রভাবে মহাকাশযানের কলকজা অকেজো হয়ে যেত এবং তারা ঝুলে থাকত মহাশূন্যে। দানবদের অন্য চারটি মহাকাশযান, যেগুলি পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গা থেকে যাত্রা করেছিল সেগুলির ভাগ্যে এরকমই ঘটেছিল।

যে কয়েকজন দানব তাদের হাতে ধরা পড়েছিল তাদের দিয়ে রামরাহা মাটির তলা থেকে সমস্ত চার্জ তুলে আনে। তারপর মহাকাশযানে সেগুলি দানবদের সঙ্গেই তুলে দেওয়া হয়। দানবদের জন্য রামরাহা বা আর কেউ কোনও শাস্তির ব্যবস্থা করেনি। কারণ, তা হলে তাদের খুন করতে হয়। দানবরা অবশ্য রামরাহাকে কথা দিয়ে যায় যে, ভবিষ্যতে তারা আর পৃথিবীতে হানা দেবে না।

বিপদমুক্ত পৃথিবীতে প্রথম শ্বাস নিয়েই আংটি পাঁচটি ডিগবাজি খেয়েছিল আনন্দে। ঘড়ি খেল ছয়টি। দেখাদেখি পঞ্চানন্দ দশটি ডিগবাজি খেয়ে ফেলল। হরিবাবুর মনে হল, ডিগবাজি খেলে মস্তিষ্কে একটা নাড়াচাড়ার ফলে জাহাজের সঙ্গে মিল খায় এমন একটা শব্দ মাথায় এসেও যেতে পারে, তিনি পনেরোটা ডিগবাজি খেয়ে গায়ের ব্যথায় সপ্তাহখানেক বিছানায় পড়ে রইলেন।

রামরাহা চক-সাহেবের বাড়িতে আরও কয়েকদিন রইল। আংটি আর ঘড়ি কিছুতেই তাকে সমুদ্রগর্ভে ফিরে যেতে দেবে না। রামরাহা তখন কথা দিল যে, সে আরও কিছুকাল পৃথিবীতে থাকবে। এই গ্রহটা তার খুবই ভাল লাগছে। মাঝে-মাঝে সে ঘড়ি আর আংটির কাছে বেড়াতে আসবে। গোলকটা রামরাহার কাছেই রইল। সে ছাড়া এর মর্ম আর কে বুঝবে?

পঞ্চানন্দ একদিন ঘাড় চুলকোতে চুলকোতে হরিবাবুকে বলল, “কর্তাবাবু, এবার তো আমাকে ছেড়ে দিতে হয়।”

হরিবাবু আঁতকে উঠে বললেন, “বলো কী হে, তোমাকে ছাড়লে আমার চলবে কেন?”

“আজ্ঞে, আমি লোক বিশেষ সুবিধের নই। আগেই বলেছিলুম আপনাকে। আমি হলুম গে আসলে গোয়েন্দা।”

হরিবাবু ফের চমকে উঠলেন, “গোয়েন্দা, সর্বনাশ!”

“ঘাবড়াবেন না। গোয়েন্দা শুনলে লোকে ভয় খায় বটে, কিন্তু ভাল লোকদের ভয়ের কিছু নেই। অনেকদিন ধরেই সরকার-বাহাদুর এ-জায়গায় একটা গণ্ডগোলের আঁচ পাচ্ছিলেন। তাই আমাকে পাঠানো হয়েছিল।”

সুতরাং পঞ্চানন্দকেও বিদায় দেওয়া হল। রয়ে গেল গজ-পালোয়ান। ধীরে ধীরে তার শরীর শুকিয়ে আবার আগের মতো হয়ে গেল। অবশ্য পঞ্চানন্দ তার সম্পর্কেসব কথাই জানত। একদল খারাপ লোক তাকে লাগিয়েছিল গোলকটা চুরি করতে। গজ-পালোয়ানের অতীত ইতিহাসও খুব ভাল নয়। কিন্তু সে দানবের সঙ্গে প্রাণ তুচ্ছ করে লড়াই করেছিল বলে শেষ অবধি তার সম্পর্কেও লোকের রাগ রইল না। গজ ফের কুস্তি শেখাতে শুরু করল।

কিন্তু মুশকিল হল, হরিবাবু জাহাজের সঙ্গে মেলানো শব্দটা খুঁজে পাচ্ছেন। রোজ দিস্তা দিস্তা কাগজ নষ্ট হচ্ছে।

<

Shirshendu Mukhopadhyay ।। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়