দুই ভাই মোটরসাইকেল দাবড়ে যখন বাড়ি ফিরল তখন বেশ একটু রাত হয়ে গেছে। বাড়ির লোক চিন্তা করতে শুরু করেছে। হরিবাবু বাইরের বারান্দায় পায়চারি করতে করতে স্বগতোক্তি করছেন, “মরবে…..মরবে, দুটোই একদিন বেঘোরে মরবে। ওসব বর্বর খেলার পরিণতি ভাল হওয়ার কথা নয়। ফাঁইনার সেন্স নষ্ট হয়ে যায়, বুদ্ধি লোপ পায়, হিংস্রতা আসে, মানুষ পশু হয়ে যায়…”

খেলাধুলো জিনিসটা যে এত খারাপ তা পঞ্চানন্দ জানত না। সে খুব গম্ভীর মুখে হরিবাবুর পিছু পিছু পায়চারি করছিল। আর মাঝে-মাঝে “খুব ঠিক কথা, “বেড়ে বলেছেন, সে আর বলতে”–এইসব বলে যাচ্ছিল।

হরিবাবু তার দিকে চেয়ে হঠাৎ বললেন, “তুমি তো অনেক ফিকির জানো। ছেলে দুটোর কী হল একটু দেখবে?”

পঞ্চানন্দ বিগলিত হয়ে বলল, “আজ্ঞে বৃথা ভেবে মরছেন। আপনার ছেলে দুটো তো আর দুধের খোকা নয়। ঠিক ফিরে আসবে?”

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হরিবাবু বললেন, “দুধের খোকা যে নয় তা আমি বিলক্ষণ জানি। দুটোই ভয়ংকর রকমের ডাকাবুকো গুন্ডা। প্রায়ই মারপিট করে আসে। ওদের শত্রুর অভাব নেই। তার কেউ যদি গুম-খুন করে বসে, তা হলে কী হবে?”

পঞ্চানন্দ মাথা চুলকে বলল, “তা হলে তো খুবই মুশকিল।”

হরিবাবু একটু কঠিন চোখে পঞ্চানন্দের দিকে চেয়ে বললেন, “ওবেলা তো দিব্যি ঘাট চালালে।”

পঞ্চানন্দ বিগলিত হয়ে বলল, “আজ্ঞে সে আর বলতে। মাংসটা কিন্তু মশাই খুব জমে গিয়েছিল। আর-একটু ঝাল হলে কথাই ছিল না। তারপর ধরুন পোলাওয়ের কথা! তারটা খুব উঠেছিল বটে, তবে কিনা জাফরান না পড়লে পোলাও ঠিক যেন পোলাও-পোলাও লাগে না। তবে ফুলকপির রোস্ট গিন্নিমা একেবারে সোনার ফ্রেমে বাঁধিয়ে দিয়েছিলেন বটে…..”হরিবাবু কঠিন গলায় বললেন, “ঘাট ফের এ-বেলাও তো চালাবে।”

পঞ্চানন্দ মাথা চুলকে বলল, “আজ্ঞে হিমালয়ে গিয়ে যখন থাকি, তখন দিনান্তে একটা পাকা হতুকি ছাড়া কিছুই জোটে না। এই আপনাদের কাছে যখন আসি-টাসি, তখনই যা আজ্ঞে, একটু ভালমন্দ জোটে। বলতে নেই আজ্ঞে শ্রীভগবানের আশীর্বাদে এ-বেলাও একটু ঘ্যাঁট চালানোর ইচ্ছে আছে।”

“তা চালাবে চালাও, কিন্তু বসে-বসে খাওয়া আমি অপছন্দ করি। যাও গিয়ে ছেলে দুটোর একটা হদিস করে এসো।”

পঞ্চানন্দ মাথা চুলকে বলল, “প্রস্তাবটা মন্দ নয়। হাঁটাহাটি দাপাদাপি করলে খিদেটাও চাগাড় দিয়ে উঠত। কিন্তু মুশকিল কী জানেন। আপনার ছেলেদের তো আমি চিনি না। আপনাদেরই সব ছোট-ছোট দেখেছি। সেই আপনারা বড় হলেন, ছেলের বাপ হলেন, ভাবতেও অবাক লাগে। ভাবি দুনিয়াটা হল কী!”

হবিবাবু যথেষ্ট রেগে গলা রীতিমত তুলে বললেন, “ওসব বাজে কথা ছাড়ো। তুমি না চিনলেও ঘড়ি আর আংটিকে তল্লাটের সবাই চেনে। জিজ্ঞেস করে করে খোঁজ নাও। শুনেছি, কোনও রাজা নাকি তাদের নিয়ে গেছে।”

পঞ্চানন্দ অবাক হয়ে বলে, “রাজা! এ তল্লাটে আবার রাজা-গজা কে আছে বলুন তো?”

“সে কে জানে। হাতরাশগড়ে একসময়ে রাজা ছিল একজন। সে কবে মরে হেজে গেছে। তা সে জমিদারি রাজত্বও কিছুই তো আর নেই। সব জঙ্গল হয়ে আছে। তাই ভাবছি হাতরাশের রাজা আবার কে এল ঘড়ি আর আংটিকে নিয়ে যেতে! কোনও বদমাশের পাল্লায় পড়ল না তো!”

পঞ্চানন্দ মাথা নেড়ে বলল, “আজকাল গুন্ডা-বদমাশের অভাব কী! চার দিকেই তো তারা—“

হরিবাবু খেঁকিয়ে উঠে বললেন, “সেইজন্যই তো খোঁজ নিতে বলছি।”

“যাচ্ছি আজ্ঞে”। ‘ তবে পঞ্চানন্দকে যেতে হল না। বারান্দা থেকে সে সবে সিঁড়িতে পা বাড়িয়েছে, এমন সময় বিকট শব্দে হুড়মুড় করে একটা বিশাল মোটরসাইকেল এসে গা ঘেঁষে ব্রেক কষল। পঞ্চানন্দ সড়াত করে পা-টেনে নিয়ে বলল, “বাপ রে!”

হরিবাবু কটমট করে ঘড়ি আর আংটির দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন। তারপর বিকট হুঙ্কার দিয়ে বললেন, “কোথায় ছিলি?”

ঘড়ি আর আংটি খুবই দামাল আর দুরন্ত বটে, কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় তারা তাদের নিরীহ কবি-বাবাকে ভীষণ ভয় পায়। হরিবাবু তাদের কখনও মারধর করেননি, এমনকী বকাঝকাও বিশেষ করেন না। বলতে কী, ছেলেদের খোঁজ খবরই, তিনি কম রাখেন। তবু ঘড়ি আর আংটি বাপের সামনে পড়লে কেমন যেন নেংটি ইঁদুরের মতো হয়ে যায়।

দুই ভাই মোটর সাইকেল থেকে নেমে কাঁচুমাচু হয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়াল। “কোথায় গিয়েছিলি? মোটরবাইকই বা কোথায় পেলি? কতবার বলেছি না মোটরবাইক, সাইকেল, এসব হল শয়তানের চাকা? দু চাকায় যে গাড়ি চলে তাকে কোনও বিশ্বাস আছে?”

ঘড়ি গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, “আমরা একটু এই এক বাড়িতে নেমন্তন্ন খেতে গিয়েছিলাম।”

কথাটা মিথ্যে, তবে ঘড়ি জানে তাদের বাবা খুব ভিতু মানুষ। তারা যে বিপদে পড়েছিল, সে কথা বললে বাবার সারা রাত আর ঘুম হবে না।

হরিবাবু অত্যন্ত সন্দিহান চোখে মোটরবাইকটার দিকে চেয়ে বললেন, “ওটা কার?”

“আমাদের এক বন্ধুর। রাস্তায় বাস খারাপ হয়ে যাওয়ায় চেয়ে এনেছি।”

হরিবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তারপর বললেন, “ওটা ফেরত দেওয়ার সময় ঠেলে নিয়ে যাবে। খবর্দার চাপবে না। মনে থাকবে?

ঘড়ি ঘাড় কাত করে বলল, “থাকবে।”

“এখন যাও। তোমাদের মা খুব দুশ্চিন্তায় আছেন। জরি, ন্যাড়া সব খুঁজতে বেরিয়েছে তোমাদের!”

হরিবাবুর পিছন থেকে পঞ্চানন্দ দুই ভাইকে দেখে নিচ্ছিল ভাল করে। মুখে বিগলিত হাসি। ঘড়ি আর আংটি ঘরে চলে যাওয়ার পর সে বলল, “বেশ দুষ্টু দুষ্টু আর মিষ্টি-মিষ্টি দেখতে হয়েছে খোকা দুটি।”

হাত-মুখ ধুয়ে জামাকাপড় পাল্টে দুই ভাই নিজেদের ঘরে যখন মুখোমুখি বসল, তখন দু’জনেরই মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ।

আংটি বলল, “দাদা,এখনও আমি ঘটনাটির কিছু বুঝতে পারছি না।”

ঘড়ি প্রথমে উত্তর দিল না। ভ্রূ কুঁচকে ভাবল কিছুক্ষণ। তারপর বলল, “আমিও না।”

“ সেক্রেটারিকে কে মারল, কেন মারল, তা আন্দাজ করতে পারিস?”

‘দূর! কী করে আন্দাজ করব? শুধু মনে হচ্ছে, পিছন থেকে কেউ গুলি করেছে।”

“সেক্রেটারি বাসে করে যাচ্ছিল কোথায়? আমাদের খোঁজ নিতে নয় তো!”

ঘড়ি হাত উল্টে বলল, “ কে জানে! নরনারায়ণই বা আমাদের পাকড়াও করেছিল কেন তাও তো বুঝতে পারছি না।

সমস্যার কোনও সমাধান সহজে হওয়ার নয় বুঝে ঘড়ি আর আংটি সোজা দাবার ছক পেতে বসে পড়ল।

দাবা খেলায় দুজনেই ওস্তাদ। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা, কোনও সমস্যায় বা বিপদে পড়লে ঘড়ি সবসময়ে এক বা দুই পাট্টি দাবা খেলে নেয়। তাতে তার মনের ভাবটা সহজ হয়ে যায়।

হরিবাবু দাবা খেলা পছন্দ করেন না, তাস খেলা দু’চোখে দেখতে পারেন না। তাই দুই ভাই গোপনে বসে দাবা খেলে।

***

ওদিকে ছেলেরা বাড়ি ফিরে আসায় হরিবাবু নিশ্চিন্ত হয়ে পঞ্চানন্দকে বললেন, “ওহে পঞ্চানন্দ, ইয়ে, আমার ঘরে চলে গিয়ে একটু বসি।”

“তা চলুন। বসতে আর আপত্তি কী?”

“ইয়ে বলছিলাম, আজ সন্ধেবেলায় ইয়ে একটা ওই লিখেছিলাম আর কি।”

“জিনিসটা একটু ভেঙে বলুন। কথা সবসময়ে খোলসা করে বলবেন, তাতে মনটা পরিষ্কার থাকে।”

‘ইয়ে একটা কবিতা আর কি।”

“কবিতা? তা সে কথা বলতে অত কিন্তু কিন্তু করছেন কেন বলুন তো। কবিতা তো ভাল জিনিস। কবিতা ঝুড়ি ঝুড়ি লিখে ফেলবেন। যত লিখবেন ততই ভাল।”

হরিবাবু খুব লাজুক মুখে বললেন, “না ইয়ে বলছিলাম কী, তোমাকে গোটাকয় শোনাব। হয়েছে কী জানো, এ বাড়িতে কবিতার ঠিক সমঝদার নেই। আমার স্ত্রী তো কবিতার খাতা পারলে উনুনে দেন। জরিটার নাকি কবিতা শুনলেই তেড়ে জ্বর আসে। ন্যাড়াটা তো গাধা। আর আমার পিসি তো কানে শোনেন না।”

পঞ্চানন্দ একটু গম্ভীর হয়ে বলল, “কবিতা শুনব সে তো ভাল কথা। কিন্তু মশাই, আমার আবার একটু বিড়ি-টিড়ি না হলে এসব দিকে মেজাজটা আসে না। দুটো টাকা দিন, ঝট করে মোড়ের মাথা থেকে এক বান্ডিল বিড়ি আর একটা ম্যাচিস নিয়ে আসি।”

হরিবাবু দিলেন, এবং বললেন, “তুমি খুব ঘড়েল।”

১২.

গজ পালোয়ান নামটা শুনলে মনে হয় লোকটা বুঝি হাতির মতোই বিরাট আকারের। কিন্তু আসলে গজ পালোয়ানের চেহারা মোটেই সেরকম নয়, জামাকাপড় পরা অবস্থায় তাকে পালোয়ান বলে মনেই হয় না। ছিপছিপে গড়ন, লম্বাটে চেহারা, মুখচোখ নিরীহ, একটু সাধু সাধু উদাস-উদাস ভাব। ল্যাঙট পরে খালি গায়ে যখন সে কুস্তি শেখাতে দঙ্গলে নামে, তখন তার বিদ্যুতের মতো গতি আর বাঘের মতো শক্তির খানিকটা আঁচ পাওয়া যায়। ঘুসি মেরে সে পাথর ভাঙতে পারে, দু’প্যাকেট তাস একসঙ্গে ধরে ছিঁড়ে ফেলতে পারে, তিন আঙুলের চাপে বেঁকিয়ে দিতে পারে একটা কাঁচা টাকা।

গজ খুব সাদাসিধে মানুষ। চকসাহেবের ভাঙা পোড়োবাড়ির একখানা ঘর। নিয়ে সে থাকে। আসবাব বলতে একটা দড়ির খাঁটিয়া, একখানা উনুন আর কয়েকটা বাসনপত্র। জামাকাপড় তার বিশেষ নেই। যা আছে তা একটা দড়িতে ঝোলে। থাকার মধ্যে আর আছে একখানা পাকা বাঁশের তেল চুকচুকে পাঁচ হাত লাঠি। পুরনো বাড়ি বলে মাঝে-মাঝে বিষাক্ত সাপ বেরিয়ে আসে। গজ সাপখোপ মারে না, লাঠি মেঝেয় ঠুকে শব্দ করে তাড়িয়ে দেয়। এ ছাড়া লাঠিটা আর কোনও কাজে লাগে বলে কেউ জানে না। তবে মানুষের সবচেয়ে বড় অস্ত্র যেটা, তা লাঠি-বন্দুক এসব নয়। সেটা হল দুর্জয় সাহস। গজ পালোয়ানের সেইটে আছে।

চকসাহেবের বাড়ি নিয়ে অনেক কিংবদন্তী আছে। চক নামে কোনও নীলকর বা অন্য কোনও সাহেব এই বাহারি বাড়িখানা বানিয়েছিল। তারা মরে-হেজে যাওয়ার পর এ-বাড়ি ছিল ডাকাতের আস্তানা। তারপর ভূতের বাড়ি হিসেবেও রটনা হয়েছিল একসময়। আস্তে-আস্তে বাড়িটা ভেঙে পড়ছে, জঙ্গলে ঢেকে যাচ্ছে। বসবাসের যোগ্য আর নেই। এই পড়ো-পড়ো বাড়িতে থাকতে যে কারও ভয় পাওয়ার কথা। তার ওপর ভূতপ্রেত এবং সাপখোপ। গজ এই ভগ্নপ্রায় বাড়িটার জঙ্গল কেটে কুস্তির আখড়া বানিয়েছে, একটা ঘর কোনওরকমে বাসোপযোগী করে নিয়েছে। বিকেলে গুটি দশবারো ছেলে তার কাছে কুস্তি শিখতে আসে। বাকি দিনরাত সে একা থাকে। কেউ তাকে বড় একটা ঘাঁটায় না। সে কোথাকার লোক, কেন তাকে জখম অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল, তার কে আছে, এসব খবর কেউ জানে না।

আজ রাত্রে প্রচন্ড শীত পড়েছে। গজ খিচুড়ি রাঁধবে বলে চালে-ডালে মিশিয়ে উনুন চাপিয়ে খাঁটিয়ায় বসে একটা বই পড়ছিল। চারদিকটা খুব নিঝুম। তবে পুরনো বাড়ির নানারকম শব্দ থাকেই। যেমন, একটা তক্ষক বা প্যাচা ডেকে উঠল, একটা নড়বড়ে কপাট ফটাস করে বাতাসে বন্ধ হয়ে গেল, একটা বেড়াল ডেকে উঠল, মিয়াও। তা ছাড়া ঝিঝির শব্দ আছে, মশার পনপন আছে, ইঁদুরের চিকচিক আছে। এসব সত্ত্বেও চকসাহেবের বাড়ি খুবই নিস্তব্ধ।

গজর গরম জামা বলতে প্রায় কিছুই নেই। একটা মোটা খদ্দরের চাঁদর আর একখানা কুটকুটে কালো কম্বল। কম্বলখানা সে শোয়ার সময়ে গায়ে দেয়। এখন শুধু চাঁদরখানা জড়িয়ে বসে ছিল সে। বই পড়তে-পড়তে হঠাৎ সে উত্তর্ণ হয়ে মুখ তুলল। তার মনে হল, সে একটা অচেনা শব্দ শুনেছে। কীরকম শব্দ তা বলা মুশকিল। তবে পুরনো বাড়ির যে-সব শব্দ হয়, সবই তার চেনা। এ-শব্দ সেরকম নয়।

কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল গজ। আজ কৃষ্ণপক্ষের নিকষ অন্ধকার রাত্রি। তার। ওপর গাঢ় কুয়াশা পড়েছে। এইরকম রাত্রে চকসাহেবের বাড়িতে খুব সাধারণ কেউ আসবে না। কিন্তু গজর মনে হল, সে কারও একটা পায়ের শব্দ শুনতে পেয়েছে।

টেমিটা এক ছুঁয়ে নিবিয়ে দিয়ে গজ উঠল। অভ্যস্ত জায়গা থেকে লাঠিটা হাতে তুলে নিয়ে ছায়ার মতো নিঃশব্দে সে বাইরে বেরিয়ে এল। ঘরের সামনেই একটা বারান্দা। ছাদটা অনেকদিন আগেই ভেঙে পড়ে গেছে, আছে শুধু একটু বাঁধানো চাতাল আর তিনটে থাম।

গজ একটা থামের পাশে দাঁড়িয়ে অন্ধকারেই একটা কিছু অনুভব করার চেষ্টা করল। চারদিকে নিস্তব্ধ।

তবে কি গজ ভুল শুনেছে? না, সেটা সম্ভব নয়। গজকে যে অবস্থায় বেঁচে থাকতে হয়, তা সাধারণ গেরস্থ মানুষের জীবনের মতো নয়। তার কান সজাগ, চোখের দৃষ্টি অত্যন্ত তীক্ষ্ম, অনুভূতি প্রবল। সুতরাং তার ভুল সহজে হয় না।

যারা চোখে দেখে না, তাদের শ্রবণশক্তি এবং অনুভূতি ধীরে ধীরে তীক্ষ্ম হয়ে ওঠে। এটা লক্ষ করে গজ একসময়ে দিনের পর দিন চোখে ফেট্টি বেঁধে রেখে নিজের অনুভূতি ও শ্রবণশক্তি বাড়িয়ে তুলবার চেষ্টা করেছে। যারা কানে শোনে না, তাদের দৃষ্টি থাকে সবদিকে। সুতরাং গজ কিছুদিন কানে তুলো খুঁজে রেখে শব্দ না শুনেও শব্দকে অনুভব করার চেষ্টা করেছে এবং ঘ্রাণ ও দৃষ্টিশক্তিকে করে তুলেছে চৌখস। গজ জানে, একটু ভুল হলেই তার প্রাণসংশয়। রাতে সে যখন ঘুমোয় তখনও তার কান এবং অনুভূতি জেগে থাকে। সামান্য একটু

অস্বাভাবিক শব্দ হলেই সে তড়াক তরে উঠে পড়ে। সাধারণ যে-কোনও মানুষের চেয়ে তার ঘ্রাণ, শ্রবণ এবং দৃষ্টিশক্তি বহুগুণ বেশি। সুতরাং আজও তার ভুল হয়নি।

বাগানে খোয়া-বিছানো রাস্তায় বোগেনভেলিয়ার ঝোঁপটার আড়ালে সরে গেল। তার শরীরের পেশিগুলো শক্ত হয়ে গেল, ঘ্রাণ-শ্রবণ-দৃষ্টিশক্তি হয়ে উঠল ক্ষুরধার। কে আসছে? কী চায়?

ঝোঁপের আড়ালে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল গজ। কিন্তু আর কোনও শব্দ নেই, কোনও নড়াচড়া নেই, কোনও গন্ধ নেই। কিন্তু তবু গজর মনে হতে লাগল সে এ-বাড়িতে আর একা নয়। কোনও একজন আগন্তুক এ-বাড়ির কোথাও নিঃশব্দে অপেক্ষা করছে।

খিচুড়ির পোড়া গন্ধ পেল গজ! কিন্তু তবু অনেকক্ষণ নড়ল না। সে বুঝল, যে-ই থাক, সে খুব তুখোড় তোক। গজর চোখ কান-নাককে ফাঁকি দেওয়া বড় সহজ কাজ নয়।

অন্ধকারে আর একবার চারদিকে চোখ চালিয়ে গজ ধীরে ধীরে বারান্দায় উঠল এবং ঘরে ঢুকে টেমি জ্বালাল।

খিচুড়িটা একদম পুড়ে ঝামা হয়ে গেছে। হাঁড়িটা নামিয়ে রাখল সে। তারপর টেমিটা তুলে নিয়ে এ-ঘর সে-ঘর ঘুরে দেখল। কোথাও কেউ নেই। গজ খুবই অস্বস্তি বোধ করতে লাগল। জীবনে বহুরকম বিপদে পড়েছে এবং বেঁচেও গেছে। সুতরাং বিপদকে তার ভয় নেই। তার অস্বস্তিটা অন্য কারণে। তার কেবলই মনে হচ্ছে, তার চোখ-কান-নাককে ফাঁকি দিয়ে যদি কেউ এ-বাড়িতে ঢুকেই থাকে, তবে সে সাধারণ মানুষ নয়। হয়তো সে মানুষই নয়।

তবে কি অশরীরী? গজ খুব চিন্তিতভাবে বইখানা আবার খুলে বসল। কিন্তু মন দিতে পারল না।

একটা হুলো বেড়াল ভীষণ ডাকছে কোথায় যেন। কিছু দেখতে পেয়েছে কি? খুব ভয় পেয়েছে যেন!

হঠাৎ দুটো চামচিকে অন্ধের মতো চক্কর মারতে লাগল ঘরের মধ্যে। একটা ভাঙ্গা দরজায় শব্দ হল, কাঁচ।

গজ স্থির হয়ে বসে রইল। মাঠে ময়দানে, শ্মশানে, কারখানায় সে বহু রাত কাটিয়েছে। কখনও ভয় পায়নি। লাঠিটা মুঠোয় নিয়ে সে বসে রইল চুপ করে। কী করবে তা ঠিক করতে পারছিল না। বিদ্যুতের মতো যার গতি, বাঘের মতো যার শক্তি, দুর্জয় যার সাহস, সেই গজ পালোয়ান কি আজ ভয় পাচ্ছে?

হঠাৎ একা ঘরেই হাঃ হাঃ করে হেসে উঠল গজ। সেই হাসির দমকে তার ভয় ভীতি উড়ে গেল। হঠাৎ শরীরে এক মত্ত হাতির ক্ষমতা। গজ পালোয়ান তার লাঠিটা নিয়ে এক ঝটকায় উঠে দাঁড়িয়ে বিকট হুঙ্কার ছেড়ে বলল, “কে রে, চোরের মতো ঢুকেছিস বাড়িতে? বাপের ব্যাটা হয়ে থাকিস তো সামনে আয়!”

কেউ এই হুঙ্কারের জবাব দিল না। চারদিক নিস্তব্ধ। গজ পালোয়ান আবার হুঙ্কার দিল, “শুনতে পেয়েছিস? সামনে আসার মতো বুকের পাটা নেই তোর?”

গজ পালোয়ান কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করল। হঠাৎ বারান্দায় খুব মৃদু একটা পায়ের শব্দ শোনা গেল। খুব ধীর পদক্ষেপে কে যেন আসছে।

গজ শক্ত হাতে লাঠিটা ধরে অপলক চোখে দরজার দিকে চেয়ে রইল।

প্রথমে একটা ছায়া বারান্দায় গাঢ় অন্ধকারে একবার যেন নড়ে উঠল। তারপর হঠাৎ দরজায় এসে দাঁড়াল দীর্ঘ রোগা একটা লোক। এত লম্বা আর শুটকে চেহারার লোক গজ কখনও দেখেনি। পরণে গাঢ় রঙের একটা স্যুট। বুক থেকে সর্বাঙ্গে রক্ত ঝরে পড়ছে।

সাদা ফ্যাকাসে মুখে লোকটা গজর দিকে একটু চেয়ে রইল। তারপর ধীরে ধীরে ওই লম্বা শরীরটা কাটা গাছের মতো পড়ে যেতে লাগল মেঝেয়।

গজ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে চেয়ে রইল। এক পা নড়ার ক্ষমতাও তার ছিল না।

লোকটা মেঝের ওপর দড়াম করে পড়ে একটু ছটফট করল। তারপর নিথর হয়ে গেল।

সম্বিত ফিরে পেতে অনেকক্ষণ সময় লাগল গজর। ঘটনাটা কী ঘটল তা সে বুঝতে পারছে না। কে খুন করল লোকটাকে? কেন?

গজ পালোয়ানের অবশ হাত থেকে টেমিটা পড়ে নিবে গেল। লাঠিটাও খসে গেল মুঠো থেকে।

গজ এবার সত্যিকারের ভয় পেল। এ-ভয়ের কারণ অন্য। এ-ভয়ের সূত্র লুকিয়ে আছে তার অতীত জীবনে। সে বুঝল, যে-লোকটা তার দরজায় মরে পড়ে আছে, তার লাশ রাতারাতি পাচার করার উপায় নেই। পুলিশ আসবে, তাকে জেরা করবে। অনেক জল ঘোলা হবে তাতে।

গজ অন্ধকারে একবার চারদিকে চোখ বুলিয়ে নিল। না,তাকে পালাতে হবে। সঙ্গে বিশেষ কিছু নেওয়ার নেই।

দড়ি থেকে জামাকাপড়গুলো টেনে আর বিছানা থেকে কম্বলখানা তুলে সে বিছানার চাঁদর দিয়ে একটা পুঁটুলি বানাল দ্রুত হাতে। বাসনকোসনগুলো পড়ে রইল। থাকগে, গজকে এখনই পালাতে হবে। সময় নেই।

পোটলা ঘাড়ে নিয়ে গজ পিছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে এল। তারপর হন হন করে হাঁটতে লাগল ফটকের দিকে।

১৩.

কবিতা শুনতে শুনতে পঞ্চানন্দ খুব বিকট একটা শব্দ করে প্রকান্ড প্রকান্ড হাই তুলছিল। হরিবাবু বিরক্ত হয়ে বললেন, “আহা,অত শব্দ করলে কি চলে? কবিতা হল স্বর্গীয় জিনিস।”

বিনীতভাবে পঞ্চানন্দ বলল, “আজ্ঞে সে তো ঠিকই। কবিতার মতো জিনিস হয় না। এত মোলায়েম জিনিস যে কান দিয়ে ভিতরবাগে ঢুকে একেবারে বুকখানা জুড়িয়ে দিচ্ছে। ওই যে লিখেছেন লাইনটা ঘুম ঘুম ঘুম, ভূতের ঠ্যাং,বাদুড়ের ডানা, চাঁদের চুম’ ওইটে শুনে এমন হাই উঠতে লেগেছে। ভাল জিনিসের মজাই এই। একবার রাজশাহির রাঘবসাই খেতে খেতে-খেয়েছেন তো? উরেব্বাস, কী যে সারস জিনিস–হ্যাঁ তা খেতে খেতে এমন আরাম লেগেছিল যে খাওয়ার মাঝপথেই ঘুমিয়ে পড়লাম। নাক ডাকতে লাগল। শেষে একটা ইঁদুর এসে হাত থেকে বাকি আধখানা খেয়ে নেয়। তাই বলছিলাম আজ্ঞে, ভাল জিনিস পেলেই আমার বড্ড হাই ওঠে।”

হরিবাবু করুণ চোখে পঞ্চানন্দের দিকে চেয়ে বললেন, “কিন্তু ইয়ে, তুমি ঘুমিয়ে পড়লে যে আমার আর কবিতা পড়ার উৎসাহ থাকবে না।”

পঞ্চানন্দ খুব বিগলিত হয়ে দাঁত বের করে বলল, “তাহলে বরং গিন্নীমাকে বলে পাঠান, দু’কাপ বেশ জবর করে চা পাঠিয়ে দিতে। শীতটাও জাঁকিয়ে পড়েছে। জমবে ভাল। সঙ্গে এক-আধখানা নোনতা বিস্কুট-টিস্ফুট হলে তো চমৎকার। চা আবার খালিপেটে খেতেও নেই। পেটে গরম চা গেলে আপনার কবিতার সাধ্যি নেই যে, পঞ্চানন্দকে হাই ভোলাবে।”

অগত্যা হরিবাবু উঠে গিয়ে চায়ের কথা বলে এলেন।

নোনতা বিস্কুট দিয়ে চা খাওয়ার পর মিনিট দশেক জেগে রইল পঞ্চানন্দ। হরিবাবু নাগাড়ে কবিতা পড়ে চলেছেন। পঞ্চানন্দ দেয়ালে ঠেস দিয়ে ঘুম। তবে ঘুমের মধ্যেই পঞ্চানন্দ মাঝে মাঝে বলে যেতে লাগল, “আহা…..বেড়ে লিখেছেন…চালিয়ে যান……”। তারপর হঠাৎ ঘুম ভেঙে সোজা হয়ে বসে বলল,

“দাঁড়ান,দাঁড়ান, একতলা থেকে কে যেন ডেকে উঠল!”

হরিবাবু পড়া থামিয়ে অবাক হয়ে বললেন, “কই আমি শুনিনি তো!”

পঞ্চানন্দ মাথা নেড়ে বলল, নির্ঘাত ডেকেছে। ওই যে শুনুন।”

বাস্তবিকই শোনা গেল, নীচে থেকে বাচ্চা-চাকরটা হাঁক মারছে “বাবুরা, সব খেতে চলে আসুন।–ঠাকরোন ডাকছেন।”

পঞ্চানন্দ একগাল হেসে বলল, “শুনলেন তো! এ হল পঞ্চানন্দর কান। সেবার তো কৈলাশ থেকে ভূতেশ্বরবাবা ডাক দিলেন আর আমি সে-ডাক গঙ্গোত্রীতে বসে শুনে ফেললুম। শিবুবাবুও বলতেন, “ওরে পঞ্চা, তোর কান তো কান নয়, যেন টেলিফোন।” তা আজ্ঞে গিন্নিমা যখন ডাকছেন তখন আর দেরি করা ঠিক নয়। খবর নিয়েছি আজ খাসির তেলের বড়া হয়েছে এবেলা। গরম খেলে অমৃত, ঠাণ্ডা হলে গোবর। দেরি করাটা আর একদমই উচিত হবে। না।”

হরিবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কবিতার খাতা বন্ধ করে বললেন, “তোমার কান সত্যিই খুব সজাগ।”

যাই হোক, খাওয়াদাওয়া মিটতে একটু রাতই হয়ে গেল। পঞ্চানন্দ যা খেল তা আর কহতব্য নয়। তবে কিনা গিন্নিমা অর্থাৎ হরিবাবুর স্ত্রী তাকে খুব অপছন্দ করছিলেন না।

পঞ্চানন্দ এগারোটা খাসির তেলের বড়া শেষ করে যখন মাংসের ঝোল দিয়ে একপাহাড় ভাত মাখছে তখন গিন্নিমা সামনে এসে দাঁড়িয়ে কোমরে হাত দিয়ে তার খাওয়া দেখতে দেখতে বললেন, “এই খিদেটা পেটে নিয়ে এতকাল কোথায় ছিলে?”

পঞ্চানন্দ লজ্জা-লজ্জা ভাব করে বলল, “আজ্ঞে পাহাড়ে কন্দরেই কাটছিল আর কি! টানা বছর-দুই নিরম্বু উপোস। পাহাড়িবাবার হুকুমে দেড় বছর একটানা এক ঠ্যাঙে দাঁড়িয়ে সাধনা করতে হল। তারপর…”

গিন্নিমা চোখ পাকিয়ে বললেন, “আমি তো কর্তাবাবুর মতো কবি নই, পাগলও নই যে, যা-খুশি বুঝিয়ে দেবে। তোমার মতো হাড়হাভাতেদের আমি খুব চিনি। মিথ্যে কথা বললে দূর করে তাড়িয়ে দেব। বলি হাতটানের অভ্যেস নেই তো?”

পঞ্চানন্দ একটু মিইয়ে গিয়ে মিনমিন করে বলল,”খুব অভাবে পড়ে ওই একটু-আধটু। বেশি কিছু নয়, এই ঘটিটা বাটিটা। সত্যি বলছি।”

“থাক, আর কিরে কাটতে হবে না। শোনো, এই বলে রাখছি, এ বাড়িতে থাকতে চাও থাকবে, দুবেলা দুটি করে খেতেও পাবে। তবে তার বদলে শক্ত কাজ করতে হবে। বসে খেলে চলবে না।”

পঞ্চানন্দ কাজের কথায় খুব নরম হয়ে গিয়ে বলল, “আজ্ঞে আমার হল ননির শরীর। বেশি কাজটাজ আমার আসে না।”

“তা বললে তো হবে না। কাজ না করলে সোজা বাড়ি থেকে বের করে দেব। তবে এও বলি বাছা, কাজ শক্ত হলেও বেশি পরিশ্রমের নয়। এ বাড়ির কর্তাবাবুর বড় কবিতা লেখার বাতিক। কেউ শুনতে চায় না বলে ভারি মনমরা হয়ে থাকেন। খবরের কাগজের লোকগুলোও কানা, কেউ ছাপতে চায় না। তা এবার থেকে বাবুর কাছে কাছে থাকবে। আর কবিতা শুনবে। পারবে তো।”

পঞ্চানন্দ একটা বিষম খেল। তারপর ঘটি আলগা করে খানিক জল গিলে নিয়ে বলল, “তা……তা পারব’খন। তবে কিনা মা-ঠাকরোন, এই বিড়িটা আশটা কিংবা একটু গরম চা, মাঝে-মাঝে চুল ছাঁটা আর দাঁড়ি কামানোর পয়সা….”

‘ইঃ, আম্বা দ্যাখো, আচ্ছা সে অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করা যাবে। কর্তাবাবুর তোমাকে বেশ ভাল লেগেছে বলেই তোমাকে রাখছি। নইলে…….”

পঞ্চানন্দ সপাসপ ঝোলমাখা ভাত খেতে খেতে বলল, “নইলে কী তা আর বলতে হবে না মা-ঠাকরোন। পঞ্চানন্দকে আজ অবধি কেউ ভাল চোখে দেখেনি। অবিশ্যি তাদের দোষও নেই।”

“আর শোনো, মিথ্যে কথাটথাগুলো একটু কম করে বোলো। তুমি নাকি আমার শ্বশুরমশাইয়ের বন্ধু ছিলে বলে বলেছ?”

জিব কেটে পঞ্চানন্দ বলে, ছিঃ ছিঃ, বন্ধু বললে আমার জিব খসে পড়বে যে। তবে কিনা শিবুবাবু আমাকে খুব স্নেহ করতেন। বাপে-তাড়ানো মায়ে খেদানো বাউন্ডুলে তো আমি, তাই তার জাদুই-ঘরের বারান্দায় থাকতে দিয়েছিলেন। ওরকম মানুষ হয় না।”

“আর তুমি নাকি একটা চাবি দিয়েছ কর্তাবাবুকে, সে-চাবি কিসের চাবি?”

পঞ্চানন্দ বাঁ হাতে মাথা চুলকে বলল, “আজ্ঞে মা-ঠাকরোন, আপনার কাছে মিথ্যে কথা বলে কোন্ আহাম্মক? চাবিটা কিসের তা আমিও জানি না। তবে শিবুবাবু……”

গিন্নিমা চোখ পাকিয়ে বললেন, “দ্যাখো পঞ্চানন্দ, আমাকে তোমার কর্তাবাবুর মতো গোলা লোক পাওনি। আমার শ্বশুরমশাইয়ের সঙ্গে তোমার ভাব থাকলে এখন তোমার কত বয়শ হওয়ার কথা জানো?”

পঞ্চানন্দ খুব ভাবনায় পড়ে গিয়ে বলে, “আজ্ঞে বয়সটাও আমার নেহাত ফেলনা নয়। তা বলতে নেই বয়স তো গিয়ে সেই……”

“থাক, থাক, তোমার ওজর আমার জানা আছে। এখন খাও, খেয়ে নিজের বাসন মেজে জায়গা পুঁছে ল্যাবরেটারির বারান্দায় গিয়ে শুয়ে থাকো।”

গিন্নিমা চলে যাওয়ার পর পঞ্চানন্দ রাঁধুনিকে ডেকে গম্ভীরভাবে বলল, “লেখাপড়া জানার ঝক্কি অনেক, বুঝলে? লেখাপড়া না শিখে খুব ভাল কাজ। করেছ। আমি একটু বেড়াতে এসে কেমন ফেঁসে গেলুম দ্যাখো, বাবুর হয়ে এখন নানারকম লেখা-টেখার মুসাবিদা করতে হবে। মাথার খাটুনিটাও কিছু কম হবে না। কাল সকাল থেকে আমাকে এক গেলাস করে গরম দুধ দিও তো। আর একটা কথা, আমার কাছে একটা পোঁটলা আছে। বেশি কিছু নেই তাতে। পড়তি জমিদার বংশ তো, বেশি কিছু ছিলও না। ভরি পাঁচ সাত সোনার গয়না, কয়েকটা মোহর আর বোধহয় দশ বারোখানা হিরে, তিন চারটে মুক্তো এই সব আর কি? পোঁটলাটা তোমার কাছে গচ্ছিত রাখব। একটু লুকিয়ে রেখো। কেমন?”

রাঁধুনি একটু বোকাসোকা লোক। সহজেই বিশ্বাস করে বলল, “ যে আজ্ঞে। তা আপনি কদিন আছেন এখানে?”

“দেখি রে ভাই। যতদিন হিমালয় আবার না টানে ততদিন তো থাকতেই হচ্ছে। আর এরাও ছাড়তে চাইছে না। কেন বলো তো?”

রাধুনি মাথা চুলকে বলল, “ না, ভাবছি কাল থেকে দু’বেলাই কয়েক খুঁচি চাল বেশি করে নিতে হবে। আজ রাতে আমাদের ভাতে টান পড়েছে। আপনি বেশ খান”।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পঞ্চানন্দ বলল, “ সেই খাওয়া আর কোথায় রে ভাই। আর খাবই বা কী দিয়ে! কাল যদি একটু ভালোমন্দ রাঁধো তো খাওয়া দেখাব, দেখলে ট্যারা হয়ে যাবে।”

“আজ্ঞে ভালমন্দ তো আজ কিছু কম হয়নি।”

“দূর পাগলা, মাংস, খাসির তেলের বড়া, ভাজা মুগের ডাল, মাছের মাথা দিয়ে ফুলকপির পোড়র ভাজা, পটলের দোড়মা এ আর এমন কী? এর সঙ্গে চিতল মাছের পেটি, ইলিশ ভাপা, কুচো মাছের টক, মুরগির কালিয়া, পায়েস আর কাঁচাগোল্লা হত তো দেখতে ভোজবাজি কাকে বলে।”

পঞ্চানন্দ আঁচিয়ে এসে বাড়ির কাজের লোকটিকে ডেকে বলল, “থালাটা ভালো করে মেজো। নোংরা কাজ একদম পছন্দ করি না।”

এই বলে সে সোজা গিয়ে জরিবাবুর ঘরে হানা দিল।

“এই যে জরিবাবু, হবে নাকি একখানা দরবারি কানাড়া? রাতটা বেশ হয়েছে। এই বেলা ধরে ফেলুন।”

জরিবাবু করুণ স্বরে বললেন, “ধরব, আবার যদি কেউ তারা চলে আসে গান শুনতে?”

“ভয় কী? আমি তো আছি। নাঃ, আজ বড় চাপনো খাওয়া হয়েছে। আজ বরং থাক। কাল হবে। তা আমার বিছানাটা কোন দিকে হবে?”

জরিবাবু তাড়াতাড়ি উঠে কম্বল চাঁদর আর বালিশ দিয়ে বললেন, “ মেঝেয় শুতে কি আপনার খুব কষ্ট হবে?”

“নাঃ, হিমালয়ে তো বরফের ওপরেই শোওয়া- টোওয়া চলত। কষ্ট কিসের?”

পঞ্চানন্দ বেশ ভাল করে বিছানা পেতে শুয়ে বলল, “বাতিটা নিবিয়ে আপনিও শুয়ে পড়ুন। সকালে আবার গলাটলা সাধতে হবে।”

জরিবাবু বাধ্য ছেলের মতো শয্যা নিলেন। আস্তে-আস্তে দু’জনেই ঘুমিয়ে পড়ল। রাত্রি নিঝুম হয়ে গেল। কিন্তু মাঝরাতে আচমকাই ঘুম ভেঙে চোখ চাইল পঞ্চানন্দ।

১৪.

অন্ধকারে পঞ্চানন্দ ঘুম ভেঙে কিছুক্ষণ চুপচাপ শুয়ে রইল। তার ঘুম খুবই পাতলা। কিন্তু ঘুমটা ভাঙল কেন তা চট করে বুঝতে পারছিল না সে। কিছুক্ষণ কান খাড়া করে থাকার পর সে শুনতে পেল, কে যেন বাইরে থেকে খুব চাপা গলায় ডাকল, “ন্যাড়া! এই ন্যাড়া!” ব্যাপারটা একটু দেখতে হচ্ছে। রাত-বিরেতে চাপা গলার ডাক মোটেই সুবিধের ব্যাপার নয়। কিছু গোলমাল আছে। আর যেখানে গোলমাল এবং গন্ডগোল সেখানেই পঞ্চানন্দ জুত পায়।

কালো কম্বলটা মুড়ে নিয়ে উঠে পঞ্চানন্দ নিঃশব্দে দরজা খুলে ফেলল। তারপর বারান্দা ডিঙিয়ে উঠোন পেরিয়ে বাইরের বাগানে এসে ন্যাড়ার ঘরের জানালার দিকে গুঁড়ি মেরে এগোল।

বেশিদূর এগোতে হল না। কুয়াশামাখা অন্ধকারে সে একজন লম্বামতো লোককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে টপ করে কামিনীঝোঁপের আড়ালে গা ঢাকা দিল।

লোকটা ডাকছে, “ন্যাড়া! এই ন্যাড়া!” ন্যাড়া কুস্তিগির বলেই বোধহয় ঘুমটা খুব গাঢ়। সাড়া দিচ্ছিল না। লোকটা খানিকক্ষণ ডাকাডাকির পর বন্ধ জানালার কপাটে টোকা দিতে লাগল।

ভিতর থেকে ন্যাড়ার ভয়জড়ানো গলা পাওয়া গেল, “কে? কে?”

লোকটা চাপা গলায় ধমক মারল, “চিৎকার কোরো না। আমি গজ পালোয়ান। জানালাটা খোলো, জরুরি কথা আছে।”

সঙ্গে সঙ্গে জানালা খুলে গেল। ন্যাড়া শিকের ফাঁকে উঁকি মেরে অবাক হয়ে বলল, “গজদা! এত রাতে! কী ব্যাপার?”

গজ চাপা গলায় কী বলতে শুরু করল। পঞ্চানন্দ শুনতে না পেয়ে আরও একটু এগোল। বলতে গেলে গজ পালোয়ানের কোমরের হাতখানেকের মধ্যেই তার মাথা। মাঝখানে একটু শুধু কলাবতীর ঝোঁপ।

গজ বলল, “আমার বাড়িতে একটু আগে একটা লোক খুন হয়েছে।”

ন্যাড়া আঁতকে উঠে বলল, “সর্বনাশ!”

গজ বলল, “চেঁচিয়ো না, খুন হওয়ার ঘটনা আমি স্বচক্ষে দেখিনি। লোকটা রক্তমাখা শরীরে আমার ঘরে ঢুকেই পড়ে যায়। ঘাবড়ে গিয়ে আমি পালিয়ে আসি। কিন্তু কিছু দূর আসার পর আমার মনে হল, আগুপিছু ভাল করে না দেখে পালানোটা ঠিক হচ্ছে না। তখন আমি আবার ফিরে গেলাম। আশ্চর্যের ব্যাপার কী জানো? গিয়ে দেখলাম খুন-হওয়া লোকটার চিহ্নমাত্র কোথাও নেই। আরও দেখলাম, আমার জিনিসপত্র বলতে যা কিছু ছিল সব কে হাঁটকে আটকে রেখে গেছে। তখন সন্দেহ হল, খুনটা হয়তো আসল খুন নয়। সাজানো ঘটনা। তাই বেরিয়ে যখন থানায় খবর দিতে যাচ্ছি তখন পানুর সঙ্গে দেখা। পানুকে চেনো তো? তোমাদের সঙ্গেই কুস্তি শেখে! তার মুখে আর এক আশ্চর্য ঘটনা শুনলাম। আজ একটা বাস-এ নাকি একটা লোক খুন হয়েছিল। লম্বা সুড়ঙ্গে চেহারা। অবিকল আমার বাসার লোকটার মতো। খুন হওয়ার পর তাকে ধরাধরি করে সকলে হাসপাতালে নিয়ে দিয়ে আসে। হাসপাতালে তাকে ইমার্জেন্সিতে ফেলে রেখে ডাক্তাররা পুলিশে খবর দেয়। কিন্তু পুলিশ এসে দেখে ইমার্জেন্সির বেড খালি, লাশ নেই।”

“বলেন কী গজদা? এ তো ভূতুড়ে কান্ড?”

“হ্যাঁ। খুবই রহস্যময় ঘটনা। আমার মনে হচ্ছে দুটি ঘটনাই এক লোকের কাজ। দুবারই সে খুনের অভিনয় করেছে। কিন্তু তার কারণ কী সেটা জানা দরকার। তাই আমি ভাবছি কয়েকটা দিন তোমার এখানে একটু গা-ঢাকা দিয়ে থাকব। তোমার বাড়ির লোক জানলে ক্ষতি নেই, কিন্তু বাইরের লোক না যেন জানতে পারে।”

ন্যাড়া বলল, “কোনও চিন্তা নেই গজদা। আমার বাবার ল্যাবরেটরি তো পড়েই আছে। কেউ থাকে না, চলুন, এখনই ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।”

গজ খুশি হয়ে বলল, “বাঃ, চমৎকার ব্যবস্থা।”

এই পর্যন্ত শুনে পঞ্চানন্দ সুট করে সরে এল। তারপর আড়ে-আড়ে থেকে নজর রাখল।

ন্যাড়া দরজা খুলে বেরিয়ে গজ-পালোয়ানকে খাতির করে নিয়ে গিয়ে ল্যাবরেটরিতে ঢোকাল। ল্যাবরেটরির চাবি যে ন্যাড়ার কাছেই থাকে এটাও জেনে নিল পঞ্চানন্দ।

ল্যাবরেটরিতে শিবু হালদারের যা সব যন্ত্রপাতি ছিল তা আজও অক্ষত এবং যথাস্থানে সাজিয়ে রাখা আছে। কেউ নাড়াচাড়া করেনি। ল্যাবরেটরির একধারে একটা সিংগল খাটে বিছানা পাতা আছে আজও। কাজ করতে করতে রাত গম্ভীর হয়ে গেলে শিবুবাবু এখানে শুয়ে থাকতেন।

ন্যাড়া বিছানাটা ঝেড়েঝুড়ে দিয়ে বলল, “গজদা, একটা কিন্তু সমস্যা আছে।

“কী বলো তো?”

ন্যাড়া মাথা চুলকে বলল, “বাবার ল্যাবরেটরিতে ভূত আছে।”

গজ চমকে উঠে বলল, “ভূত! তোমরা দেখেছ?”

ন্যাড়া মাথা নেড়ে বলল, “আমি নিজে দেখিনি। তবে অনেকে দেখেছে।”

“ভূতটার চেহারা কেমন?”

“সেইটেই তো গোলমাল। একটা ভূত হলে একই রকম চেহারা হওয়ার কথা। কিন্তু এখানে নানা সময়ে নানাজনে নানারকম ভূতকে দেখে। বেঁটে ভূত, লম্বা ভূত, সাহেব ভূত, কাফ্রি ভূত। ভয়ে রাত-বিরেতে এদিকে কেউ আসে না।”

গজ একটু চিন্তিত হয়ে বলল, “ভূতের ভয় আমার নেই। তবে অনেকে যখন দেখেছে, তখন কিছু একটা আছেই। যাই হোক, আমি সাবধান থাকব।”

“দরজাটা ভাল করে এঁটে শোবেন।”

কাঁচের শার্শি দিয়ে পঞ্চানন্দ সবই মন দিয়ে দেখছিল আর শুনছিল। ভূতের কথাতে তার গায়ে একটু কাটা দিল।

ল্যাবরেটরির ভিতরে আলো থাকায় গজ-পালোয়ানকে খুব ভাল করে দেখে নিল পঞ্চানন্দ। চেহারাটা একই রকম আছে। গায়ের জোরও কি আর কমেছে?

ওই হাতের রদ্দা যে কী ভীষণ তা পঞ্চানন্দের মতো আর কে জানে?

ন্যাড়া বিদেয় হলে গজ ঘরে দরজা বন্ধ করে কিছুক্ষণ বাঘের মতো পায়চারি করল। মাঝে-মাঝে কটমট করে চারদিকে চাইছে। একবার যেন পঞ্চানন্দের দিকে চাইল।

বাইরে ঘুটঘুট্টি অন্ধকার। পঞ্চানন্দ জানে তাকে গজ পালোয়ান দেখতে পায়নি। তবু সে একটু পিছনে সরে একটা লেবুগাছের আড়ালে দাঁড়াল, চারদিকটায় একটু চোখ বুলিয়ে দেখে নিল। নাঃ, কোথাও কেউ নেই।

গজ পালোয়ান আরও কিছুক্ষণ পায়চারি করে থমকে দাঁড়িয়ে গেল হঠাৎ। তারপর এগিয়ে এসে ঘরের জানালাগুলোর পর্দা ভাল করে টেনে দিতে লাগল।

পর্দাগুলো ভীষণ মোটা কাপড়ের। তার ভিতর দিয়ে কিছুই দেখা যায় না। পঞ্চানন্দ জানালার ধারে গিয়ে অনেক উঁকিঝুঁকি দিল, কিন্তু সুবিধে হল না। তবে এটা সে বুঝল যে,ঘরে আলো জ্বেলে গজ কিছু একটা করছে। একটা দেরাজ খোলার শব্দ হল। কিছুক্ষণ পর একটা লোহার আলমারির পাল্লার শব্দও পাওয়া গেল।

গজ বন্ধ ঘরে কী করছে তা জানার অদম্য কৌতূহল সত্তেও কিছু করার নেই। জেনে পঞ্চানন্দ দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘরের দিকে রওনা দেওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়াল।

আর তার পরেই তার মাথার চুলগুলো দাঁড়িয়ে পড়ার উপক্রম। কেয়াঝোঁপটার নীচে ঘুটঘুট্টি ছায়ায় হঠাৎ একটু নড়াচড়া পড়ে গেল যেন। পঞ্চানন্দের চোখে অন্ধকার সয়ে যাওয়ায় একটু ঠাহর করে চাইতেই সে দেখতে পেল, তিনটে মানুষের চেহারার প্রেতমূর্তি কেয়াঝোঁপের অন্ধকার থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসছে।

পঞ্চানন্দ এমন হা হয়ে গেল যে, নড়াচড়ার সাধ্য নেই। পা দুটো যেন পাথর। শরীরটা হিম। দাঁতে দাঁতে আপনা থেকেই ঠকঠক শব্দ হচ্ছে।

কিন্তু বহু ঘাটের জল খেয়ে পঞ্চানন্দ ঠেকে শিখেছে অনেক। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে সম্বিৎ ফিরে পেয়ে টক করে ঘাসের ওপর উপুড় হয়ে পড়ে গেল। কম্বলের তলায় হাত-পা সব টেনে নিয়ে একেবারে মরা হয়ে রইল সে। শুধু মুখের কাছটা একটু ফাঁক করে চোখ দুটো সজাগ রাখল।

আশ্চর্যের কথা কেয়াঝোঁপের নীচে তিনটে সাহেবের লাশ পোতা আছে বলে সে নিজেই বলে বেড়িয়েছে। সেই তিনজন যে এমন জলজ্যান্ত হয়ে উঠবে তা জানত কোন আহাম্মক!

খুব আস্তে-আস্তে তিনটি মূর্তি ল্যাবরেটরির দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। তিনজনেরই কালো রং। বেশ ঢ্যাঙা। শরীরও তাগড়াই। অন্ধকারে আর ভাল দেখা গেল না কিছু।

পঞ্চানন্দের বেশ কাছ ঘেঁষেই তিনটে মূর্তি ল্যাবরেটরির দিকে চলে গেল। পঞ্চানন্দ শ্বাস বন্ধ করে রইল কিছুক্ষণ। তারপর হামাগুড়ি দিয়ে কুয়োর পাড় আর কলার ঝোঁপ পেরিয়ে সোজা জরিবাবুর ঘরে ঢুকে দরজা এঁটে দিল।

জরিবাবু অন্ধকারে কাতর গলায় বলে উঠলেন “বাপ রে! গেছি!”

পঞ্চানন্দ ভড়কে গিয়ে আঁ আঁ করে উঠল। তারপর সামলে নিয়ে একটা শ্বাস ফেলে বলল, “জেগে আছেন নাকি আজ্ঞে?”

জরিবাবু কাঁপা গলায় বললেন, “আপনি কে আজ্ঞে?”

“আজ্ঞে পঞ্চানন্দ।”

“এতক্ষণ কোথায় ছিলেন?” পঞ্চানন্দ সশব্দে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “আর বলবেন না জরিবাবু, পাজিগুলোর সঙ্গে কি আর পারা যায়? আবার জ্বালাতে এসেছিল। তাড়া করে গিয়ে একেবারে গোয়ালঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে এসেছি।”

জরিবাবু উঠে বসে আলো জ্বালালেন। তারপর কতকটা নিশ্চিন্ত হয়ে বললেন, “গোয়ালঘর থেকে তারা ফের বেরিয়ে পড়বে না তো? এতক্ষণ বড় জ্বালাতন করে গেছে।”

পঞ্চানন্দ আঁতকে উঠে বলল, “কে জ্বালাতন করে গেছে?”

জরিবাবু পানের বাটা টেনে কোলের ওপর নিয়ে মাথা নেড়ে বললেন, “সে তো আপনি ভালই জানেন। ওই যে যাঁদের চোখে দেখা যায় না, অথচ আছেন, তারাই আর কি? তাও একজন নয়, দুজন নয়, তিন-তিনজন।”

“বলেন কী জরিবাবু! অ্যাঁ?”

“কেন, আপনার সঙ্গে তাদের দেখা হয়নি?”

পঞ্চানন্দ কাষ্ঠহাসি হেসে বলল, হ্যাঁ, তা,–তা হয়েছে বইকী। তবে কিনা …..ইয়ে…….।”

“আর বলবেন না। হঠাৎ ঘুম ভেঙে শুনি ঘরে খুটখাট শব্দ। আমার ঘরে বাদ্যযন্ত্রের অভাব নেই। শুনি, পিড়িং করে তানপুরা বেজে ওঠে, টুস করে তবলায় শব্দ হয়, জঁ করে হারমোনিয়ামের আওয়াজ ছাড়ে। ওফ, কতক্ষণ দম চেপে শুয়ে ছিলাম।”

পঞ্চানন্দ তার বিছানাটা জরিবাবুর চৌকির ধারে টেনে এনে বলল, “আর ভয় নেই। আমি কাছাকাছি রইলাম। একটা জব্বর পান সাজুন তো।”

১৫.

জরিবাবু উঠে পান সাজতে বসলেন। কম্বল মুড়ি দিয়ে পঞ্চানন্দ হিহি করে কঁপছিল। জরিবাবু বললেন, “আপনার কি খুব শীত লেগেছে পঞ্চানন্দবাবু?”

“আজ্ঞে হ্যাঁ। বেজায় শীত।”

“কিন্তু কই ঘরের মধ্যে তো তেমন ঠান্ডা নেই?”

পঞ্চানন্দ বিরক্ত হয়ে বলল, “আমার ম্যালেরিয়ার ধাত। যখন-তখন শীত করে।”

“হিমালয়ে করত না?”

পঞ্চানন্দ কম্বল দিয়ে ভাল করে মাথাটা ঢেকে বলল, “করত। আবার যোগবলে শীত তাড়িয়েও দিতাম। তা ইয়ে, ঘরে কারা ঢুকেছিল বলছিলেন যে?”

“আজ্ঞে হ্যাঁ। তাদের তো আপনিও দেখেছেন।”

“তবু শুনি বৃত্তান্তটা।”

জরিবাবু একটা পানের খিলি পঞ্চানন্দকে এগিয়ে দিয়ে নিজেও একটা মুখে পুরলেন। তারপর নিমীলিতচক্ষু হয়ে কিছুক্ষণ চিবিয়ে বললেন, “প্রথমটায় ভেবেছিলাম আপনি বোধহয় কিছু খুঁজছেন।”

পঞ্চানন্দ মাথা নেড়ে বলল, “এ ঘরে খোঁজার আছেটাই বা কী বলুন। যত সব অকাজের বাদ্যযন্ত্র, নীচের দেরাজের টানায় বাহান্নটা টাকা, তোশকের তলায় তিন টাকার খুচরো আর আলমারিতে উঁচু তাকে ধুতি-পাঞ্জাবির ভঁজের মধ্যে লুকোনো একটা সোনার বোম আর গুটিকয় আংটি। আরও কিছু আছে বটে, তবে কিনা ছুঁচো মেরে হাত গন্ধ করতে কে চায় বলুন।

জরিবাবু চোখদুটোকে একেবারে রসগোল্লা বানিয়ে বাক্যহারা হয়ে চেয়ে থাকলেন পঞ্চানন্দের দিকে। তারপর অতিকষ্টে গলার স্বর খুঁজে পেয়ে বললেন “দেরাজের টাকা, তোশকের তলা এ না হয় বুঝলুম খুঁজে পাওয়া শক্ত নয়, কিন্তু আলমারির ভিতরের জিনিসের সন্ধান পেলেন কী করে? ওটা যে চব্বিশ ঘন্টা চাবি দেওয়া থাকে। আর চাবি বাঁধা থাকে আমার কোমরের ঘুনসিতে!”

পঞ্চানন্দ উঠে জানালা সাবধানে ফঁক করে পানের পিক ফেলে আবার পাল্লা দুটো এঁটে ফিরে এসে হেঁ হেঁ করে লাজুক একটু হাসি হাসল, তারপর দরজার ওপরকার তাকে সরস্বতী মূর্তিটার দিকে উদাস নয়নে চেয়ে থেকে বলল, “শিবুবাবুও বলতেন, ‘ওরে পঞ্চানন্দ, তোর চোখ যে দেয়াল ছুঁড়ে দেখতে পায়।’ একবার হল কী জানেন, শিবুবাবুর সঙ্গে সকালে বেড়াতে বেরিয়েছি, গুইদের বাড়ির পিছনে একটা মস্ত পোড়ো মাঠ ছিল তখন। সেখানে বেড়াতে বেড়াতে হঠাৎ শিবুবাবুর পা আটকে গেল এক জায়গায়। কিছুতেই নড়তে পারেন না, ভয় খেয়ে চেঁচাতে লাগলেন, ‘ওরে পঞ্চানন্দ, এ কী অলক্ষুনে কান্ড দ্যাখ। পা দুটো যে একেবারে খাটের পায়া হয়ে গেল, নট নড়ন চড়ন, এ কী কান্ড রে বাবা!’ আমি গিয়ে কান্ড দেখে খুব হাসলুম, তারপর বললুম, ‘আজ্ঞে পায়ের দোষ নেই, দোষ জুতোর, বিহারি নাগরা পরে বেরিয়েছেন, নাগরার নীচে বুলাকি আর নাল লাগান! লোহার জিনিস চুম্বকে তো আটকাবেই।’ উনি তো আকাশ থেকে পড়লেন। ‘চুম্বক! চুম্বক কোথায়?’ আমি খুব হেসে-টেসে বললাম, “আজ্ঞে মাটির সাত হাত নীচে। পরে লোক ডেকে মাটি খুঁড়িয়ে সাত হাত নীচের থেকে সাত মন ওজনের এক চুম্বক ভোলা হল। তাই বলছিলাম–”

জরিবাবু এত অবাক হয়ে গেছেন যে, ভুলে জর্দার রস সমেত পানের পিক গিলে ফেলে হেঁচকি তুলতে লাগলেন। শুধু স্বলিত কণ্ঠে বললেন, “আপনি লোহার আলমারির ভিতরটা দেখতে পান?”

“দিনের মতো। ওই তো দেখা যাচ্ছে, নীচের তাকে আপনার মুগার পাঞ্জাবি আর আলিগড় পায়জামা, দ্বিতীয় তাকের কোণের দিকে সেন্টের শিশির গোলাপজলের ঝারি, পমেটম। ওপরের তাকে–”

“থাক থাক। ওতেই হবে।”

পঞ্চানন্দ খুব আরামে পান চিবোতে-চিবোতে বলল, “শেষ দিকটায় তো এমন হয়েছিল যে, গ্রহ নক্ষত্রের কোথায় কী হচ্ছে তা আর শিবুবাবুকে আঁক কষে বা দূরবিন দিয়ে দেখতে হত না। আমিই বলে দিতাম। সব ঠিকঠাক লেগেও যেত। সাধনায় কী না হয় বলুন। আপনার গলাতেও তো সাধনাতেই গান ফুটল!”

জরিবাবু গম্ভীর হয়ে বললেন, “তা বটে।”

“অথচ শিবুবাবু প্রায়ই বলতেন, “ওরে পঞ্চানন্দ, আমার জরিটার গলা শুনছিস? ঠিক যেন ব্যাঙ ডাকছে।”

“বাবা বলতেন ওকথা?”

পঞ্চানন্দ মিটিমিটি হেসে বলল, “তা সত্যি বলতে কী জরিবাবু, আপনাকে এই এত্তটুকু দেখেছি। তখন আপনার গলা দিয়ে সাতরকম স্বর বেরোত একসঙ্গে। ওফ, ও-রকম বিকট আওয়াজ আর শুনিনি। তা সে-কথা যাক। এখন আপনার গলার অনেক চেকনাই এসে গেছে। ধরবেন নাকি একখানা দরবারি কানাড়া? মেজাজ না থাকলে মালকোশই হোক। তবে তার আগে কথাটা শেষ করুন।”

জরিবাবু কিছুক্ষণ দম ধরে থেকে বললেন, “হাঁ,প্রথমটায় ভেবেছিলাম আপনি কিছু খুঁজছেন। তাই বিশেষ গা করলাম না। পরে ভাবলাম, আপনি হয়তো অন্ধকারে পানের বাটাটাই খুঁজে মরছেন। তাই বললাম, “পঞ্চানন্দবাবু, পানের বাটা খাটের তলায়। যেইনা বলা অমনি দেখি একটা কালো মূর্তি শাঁ করে খোলা দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল। পিছনে আরও দুটো।”

পঞ্চানন্দ জরিবাবুর খাটের সঙ্গে আরও ঘেঁষে বসে অমায়িক হাসি হেসে বলল, “পঞ্চানন্দর নাম করলেই কেন যে আজও এরা এত ভয় পায়! আমি সন্ন্যাসী বৈরাগী মানুষ, কারও কোন ক্ষতি করি না, তবু নামটি করে দেখুন চোর-ডাকাত ভূত-প্রেত গুন্ডা-বদমাস সব পড়ি-কি-মরি করে পালাচ্ছে।”

জরিবাবু ঘনঘন হিক্কা তুলতে তুলতে বললেন, “আপনি আছেন বলেই আমার ভরসা আছে। কিন্তু সেই সময়টায় আপনি যে কোথায় গিয়েছিলেন!”

পঞ্চানন্দ গম্ভীর হয়ে বলল, “একজনকে নিয়ে থাকলে তো আমার চলবে না জরিবাবু। এখন গোটা বাড়িটারই দেখাশোনার ভার আমার ওপর। শুধু কি তাই? কর্তাবাবু আর গিন্নিমা আজ আমার কাঁধে আরও এক গন্ধমাদন চাপিয়ে দিলেন। কাল থেকে আমি হব কর্তাবাবুর সেক্রেটারিকে সেক্রেটারি, আবার ম্যানেজারকে ম্যানজার। পাগল-ছাগল নিয়েই জীবনটা কেটে গেল।”

জরিবাবুর চোখ আবার রসগোল্লা। বললেন, “আপনি দাদার সেক্রেটারি? দাদার আবার সেক্রেটারির কী দরকার?”

পঞ্চানন্দ মাথা নেড়ে রহস্যময় একটু হেসে বলল, “আছে আছে। চিরদিন কি আর হবিবাবুর একই রকম যাবে? তাঁর কপাল ফিরল বলে। তখন লাখে লাখে টাকা, তাল-তাল সোনা আর হাজার রকমের বিষয়-সম্পত্তি সামলাবে কে?”

জরিবাবুর মুখ এমন হাঁ হয়ে রইল যে, একটা মশা তার মধ্যে সাতবার। সিঁধিয়ে সাতবার বেরিয়ে এল। জরিবাবু ভুল করে ফের জর্দাসুদ্ধ পানের পিক গিলে বিকট হেঁচকি তুলে বললেন, “বলেন কী! দাদা এসব পাবে কোত্থেকে?”

পঞ্চানন্দ বিজ্ঞের মতো মুখের ভাব করে বলল, “আকাশ থেকে নয় জরিবাবু। কেন, আপনাকে সেই চাবি আর তার সঙ্কেতের কথা বলিনি নাকি?”

জরিবাবু মাথা চুলকে বললেন, “বললেও মনে পড়ছে না। সারাদিন আপনি এত হরেকরকম বলেছেন যে, তার মধ্যে কোন্টা রাখব কোনটা ছাড়ব তা ঠিক করতে পারিনি।”

পঞ্চানন্দ হেসে বলল, “তা বটে। আমি একটু বেশি কথা বলি ঠিকই। তবে বিশ বছর টানা মৌন থাকার পর কথা তো একটু বেরোবেই।”

“চাবির কথা কী যেন বলছিলেন!”

“হ্যাঁ। চাবিটা শিবুবাবুই দিয়েছিলেন। বেশ ভারি চাবি। শিবুবাবুর অবস্থা তখন বেশ বিপজ্জনক। কারা যেন সব আসে যায়। কী সব মতলব নিয়ে কারা যেন ঘোরা ফেরা করে। শিবুবাবু সব কথা আমার কাছে ভাঙতেন না। তবে এক সন্ধেবেলায় আমাকে ডেকে চুপিচুপি বললেন, “পঞ্চানন্দ, গতিক সুবিধের নয় রে। এবার বুঝি মারা পড়ি। কী কুক্ষণে বিজ্ঞান নিয়ে কাজে নেমেছিলাম, তার ফল এখন ভোগ করতে হচ্ছে।”

জরিবাবু সোৎসাহে বললেন, “বাবা বোধহয় নতুন কিছু আবিষ্কার করেছিলেন? আর তার ফরমূলা বাগাতেই……,

পঞ্চানন্দ কথা ফুঁ দিয়ে কথাটা উড়িয়ে বলল, “আবিষ্কার! সে তো উনি আকছার করতেন। এই যে ব্যাটারা চাঁদে মানুষ নামিয়ে খুব হাঁকডাক ফেলে দিয়ে বাহবা কুড়োচ্ছ, কেউ কি জানে যে, ওই রকেটের ন্যাজের কাছে তিনটে খুব ঘঘাড়েল এই আমাদের শিবুবাবুর তৈরি? ওই তিনটে স্কু না পেলে চাঁদে যাওয়া বেরিয়ে যেত। তিনহাত উঠতে না উঠতেই ধপাস করে পড়ে যেত রকেট। তারপর ধরুন না, ওই যে অ্যাটম বোমা, সেটার মশলার কথা কজন জানে? ব্যাটারা বোমা বানিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু সেটা শত চেষ্টা করেও আর ফাটাতে পারে না। শিবুবাবু গিয়ে কি করলেন জানেন? স্রেফ এক চিমটি হলুদের গুড়ো মিশিয়ে দিয়ে এলেন তাতে। আর অমনি সেই বোমা একেবারে ফটফাটং ফট।”

“বটে?”

“তবে আর বলছি কী? জাপানিরা দিব্যি ট্রানজিস্টর ছেড়েছে বাজারে। স্বীকার করবে না, তবু বলি, একদিন বিকেলে কুচো-নিমকি খেতে খেতে হঠাৎ করে ট্রানজিস্টর তৈরির ফিকিরটা মাথায় খেলে গেল শিবুবাবুর। সেইটে নিয়ে আজ জাপানের কত রম-রমা।”

“এসব তো আমরা জানতামও না।”

“আমিই কি সব জানি? তবে রোজই দু’চারটে করে জিনিস তিনি আবিষ্কার করে ফেলতেন। আর তাই নিয়েই তো গন্ডগোল।”

জরিবাবু পানের পিক আবার ভুল করে গিলে ফেললেন। বললেন, “তারপর?”

“শিবুবাবু চাবিটা আমার হাতে দিয়ে বললেন, “কবে খুন হয়ে যাই তার তো ঠিক নেই। এই চাবিটা রাখ। আমার ছেলেগুলো এখনও নাবালক। তুই চাবি নিয়ে হিমালয়ে পালিয়ে যা। কেউ যেন তোর খোঁজ না পায়। আমার ছেলেরা বড় হলে ফিরে এসে চাবিটা দিস, আর বলিস, ঈশান কোণ, তিন ক্রোশ।”

জরিবাবুর মুখের মধ্যে ঢুকে মশাটা বার কয়েক চক্কর দিয়ে ফিরে এল। বোধহয় জর্দার কড়া গন্ধ সইতে পারল না। জরিবাবু বললেন, “কথাটার মানে কী?”

“আজ্ঞে তা কে জানে? তার মানে একটা আছে এটা ঠিক। আর চাবিটা বড় আজেবাজে জিনিস নয়।”

“ঈশান কোণ তিন ক্রোশ তো? তা হলে জায়গাটা খুঁজতে কোনও অসুবিধেই তো হবে না।”

“হওয়ার কথা নয়।” বলে পঞ্চানন্দ হাসল।

<

Shirshendu Mukhopadhyay ।। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়