আমবাগানে দুজন দরোয়ান আছে। এক মারোয়াড়ি বাগান ইজারা নিয়ে দরোয়ান দুজনকে আনিয়ে পাহারা বসিয়েছে। ভোজপুরী দুই দবোয়ানেরই বেশ দশাসই চেহারা। পেতলে বাঁধানো লাঠি হাতে তারা পালা করে বাগান পাহারা দেয়। একজন ঘুমোলে অন্যজন জেগে থাকে। একজন খানা পাকায় তো অন্যজন ডন-বৈঠক দেয়। আমবাগানের মধ্যেই তারা ছোট্ট একখানা ঝোঁপড়ি বানিয়ে নিয়েছে। উনুন জ্বেলে সেখানেই তারা রুটি আর ভাজি তৈরি করে। কখনও মনের আনন্দে চেঁচিয়ে গানও গায়। তুলসীদাসের রামায়ণও পড়ে মাঝে-মাঝে।

আজ সন্ধের মুখে জটাজুটধারী একজোড়া সাধু এসে ঝোঁপড়ির সামনে দাঁড়িয়ে গাল বাজিয়ে বিকট চিৎকারে ‘জয় শিব স্বয়ম্ভু, জয় সীতারাম, জয় বজরঙ্গবলী’ বলে হাঁক মারতে দুজন দরোয়ানই ভড়কে গিয়ে একেবারে সাধুদের পায়ের গোড়ায় গিয়ে পড়ল। “গোর লাগি সাধুবাবা।”

দুই সাধুরই বয়স সাংঘাতিক। দেখলেই মনে হয় একশো বছর পার করে দিয়েছে। কিন্তু মেদহীন রুক্ষ শরীরে ব্রহ্মতেজ যেন ফেটে বেরোতে চাইছে।

সাধুরা ঝোঁপড়ির বাইরে দুটো খাঁটিয়ায় বসে খানিক জিরোল। ততক্ষণ দু’জন দরোয়ান রামরিখ আর রামভরোসা খুব যত্ন করে হাওয়া করল তাদের। জলটল খাওয়াল মিছরি আর লেবু দিয়ে।

সাধুরা দুজনকেই বিস্তর আশীবাদ করে বলল, “তোদের সেবায় আমরা খুব খুশি হয়েছি রে বেটা। আজ রাতটাও তোদের ঝোঁপড়িতেই থেকে যাব। যা, ভাল করে রুটি পাকা। সঙ্গে অড়হর ডাল, ঘি আর আলু-পটলের ডালনা যেন থাকে।”

রামরিখ আর রামভরোসা এই আদেশে বিগলিত হয়ে গেল। ভাল করে আটা মেখে ভিজে ন্যায় জড়িয়ে রাখল রামরিখ। রামভরোসা ছুটল বাজারে, আলু আর পটল আনতে।

দুই সাধু সন্ধে থেকে রাত দশটা পর্যন্ত দুই খাঁটিয়ায় শুয়ে টানা ঘুম দিল। ততক্ষণ পালা করে রামরিখ আর রামভরোসা তাদের পা টিপে দিল।

রান্না হওয়ার পর ডেকে তুলে যখন সাধুদের খাওয়াতে বসাল দু’জন, তখনই বুঝতে পারল, বাস্তবিক সাধুদের ক্ষমতার শেষ নেই। দু’জনকে দশখানা করে পুরু এবং বিশাল সাইজের রুটি দেওয়া হয়েছিল প্রথমে। সাধুরা স্রেফ ডাল দিয়ে উড়িয়ে দিল তা। আরও দশখানা করে ওড়াল ডালনা দিয়ে। শেষে চাটনি দিয়ে আরও পাঁচখানা করে।

ফলে রামরিখ আর রামভরোসাকে ফের আটা মেখে নিজেদের রুটি পাকিয়ে নিতে হল।

খাওয়া-দাওয়া হয়ে গেলে পর দুই সাধু মিলে সিদ্ধি খুঁটতে বসে গেল। ঘুটতে ছুঁটতেই তারা নানারকম তত্ত্বতালাশ নিতে লাগল। কতদিন রামরিখ আর রামভরোসা এখানে আছে? জায়গাটা কেমন? দক্ষিণ দিকে ওই বাড়িটা কার? ওখানে কে কে থাকে? কোনও নতুন লোক এদিক দিয়ে যায় কি না, ও বাড়িতে আজ কেউ এসেছে কি না, এইসব।

সাধুদের এসব কথা জিজ্ঞেস করাটা তেমন স্বাভাবিক ঘটনা নয়। তবে রামরিখ আর রামভরোসা নিতান্তই সহজ সরল এবং ভক্তিমান বলে কোনও সন্দেহ করল না। নানা কথার ফাঁকে তারা এও জানিয়ে দিল, ওই বাড়িতে আজ এক নতুন মেহেমান এসেছে। তার বয়স নিতান্তই কম। চেহারা গরিব দুঃখীর মতো।

সাধু দু’জন গম্ভীর ভাবে সব শুনে সিদ্ধি ঘোঁটা শেষ করে রামরিখ আর রামভরোসার লোটায় অর্ধেকটা সিদ্ধি ঢেলে দিয়ে নিজেরাও নিয়ে বসল।

এটা ওটা গল্প হতে-হতেই হঠাৎ রামরিখ আর রামভরোসার ভীষণ হাই উঠতে লাগল। চোখ বুজে আসতে লাগল ঘুমে। এবং কয়েক মিনিটের মধ্যেই কোনওরকমে মাটিতে গামছা পেতে শুয়ে দু’জনেই নাক ডাকাতে লাগল।

দুই সাধু লণ্ঠনের ম্লান আলোয় পরস্পরের দিকে চেয়ে একটু হাসল। তারপর ঝোলা থেকে টর্চ বের করে চারদিকটা ঘুরে-ঘুরে একটু দেখল।

আমবাগানের শেষে পুকুরধারে একটা মরা গাছ আছে। দুজনে সেই গাছটার তলায় এসে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগল।

রাত্রি ক্রমে গভীর থেকে গভীরতর হতে লাগল। কিন্তু দুই সাধু পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে।

হঠাৎ তীব্র দুটো শিসের শব্দ হল পর-পর। একটা লম্বা, একটা খাটো। সাধু দুজন ধীরে ধীরে গাছতলা ছেড়ে বেরিয়ে এল।

<

Shirshendu Mukhopadhyay ।। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়