ছিন্নমস্তার সভ্যতা

পাহাড়ের নিচেও জঙ্গলের আভাস। স্পেসশিপটা চকচক করছে পড়ন্ত আলোয়। তাড়াতাড়ি পাহাড়ের উপর উঠে এল চমক আর পরি।

চলো, চলো, আরও আরও দূরে। ওই দূরের পাহাড় পেরিয়ে আকাশগঙ্গা ঘিরে গভীর জঙ্গলের মধ্যে… হাঁপাতে হাঁপাতে বলল চমক।

আকাশগঙ্গাতেও যদি হানা দেয় ওরা? তাহলে? হতাশায় আচ্ছন্ন পরির কণ্ঠস্বর।

থমকে ঘুরে দাঁড়াল চমক। দপদপিয়ে উঠল ওর ক্লান্ত চোখদুটো। কেমন যেন ডানা ভাঙা পাখির মতো পরির চেহারা। ফেলে আসা ঘরের খোঁজে কাতর দৃষ্টি ওর নীড়ের আশায় ব্যাকুল।

আবার যেন নতুন করে চিনল চমক পরিকে। ঘর-বাড়ি নগর-শহর-সভ্যতা ছেড়ে পালাচ্ছে ওরা। সুদূর মহাকাশের ভয়ংকর এক অভিশাপে ধ্বংস হয়ে গেছে ওদের সব। একদা উন্নত ওদের সভ্যতা জুড়ে তাল তাল ধোঁয়ার কুণ্ডলী উঠছে আকাশ পানে। ধোঁয়ার বুক চিরে একে একে নেমে এসেছে অসংখ্য আততায়ী স্পেসশিপ।

কী? বললে না, আকাশ গঙ্গায়ও যদি আসে ওরা? আবার প্রশ্ন করে পরি।

আরও… আরও দূরে যাব তোমাকে নিয়ে। চেষ্টা করব ওদের হাত এড়িয়ে সুদূর কোনও এক প্রান্তে পৌঁছোতে। না না, ধরা দেব না আমরা কিছুতেই ওদের হাতে।

দপদপ করে জ্বলে উঠল তীব্র এক আলোক পিণ্ড। পাহাড়ের পাদদেশে জঙ্গলের এখানে সেখানেও ফুটে উঠছে আলোক বিন্দু। কালো কালো দেহ যেন মূর্তিমান দুঃস্বপ্ন! বুঝতে দেরি হয় না ওদেরই অনুসরণে ব্যস্ত শত্রুরা। বিচিত্র মারণাস্ত্র নিয়ে এগিয়ে আসছে ওদের দিকে। অগ্নিবর্ষণে অধীর।

চলো, চলো। পা চালাও তাড়াতাড়ি।

 যাচ্ছি তো, পা আর চলছে না আমার। একটু হাত ধরো আমার।

 দ্রুত পায়ে উদভ্রান্তের মতো পাহাড়ের গা বেয়ে সমতল ভূমিতে নেমে এল ওরা। সামনেই একঠেঙে দৈত্যের মতো দাঁড়িয়ে আছে অকেজো এক রেডিয়ো অ্যান্টেনা। কয়েকদিন আগেও মুহুর্মুহু খবর শুনিয়েছে রেডিয়োগুলো। আর আজ, ছায়ায় ছায়ায় গাছের আড়ালে পথ বেয়ে চলল ওরা দূর আকাশগঙ্গার দিকে। দূর পাহাড় পেরিয়ে গভীর বন। তারই বুক চিরে খরস্রোতা আকাশগঙ্গা ছুটেছে বাধা-নিষেধের গণ্ডী পেরিয়ে অজানার সন্ধানে।

হাপরের মতো উঠছে আর নামছে ওদের বুক দুটো। আর মাত্র মাইল খানেক। কট… কট… কটু গুলির আওয়াজ। সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত থেকে দ্রুততর হল ক্ষত বিক্ষত রক্তাক্ত চরণগুলো। হিংস্র জানোয়ারের মতো ধেয়ে আসছে শত্রুদল।

সামনে এবার শুকনো নদীর বালির চড়া। এলোমেলো শুকনো আগাছা আর ছোট ছোট কাঁটা ঝোপে ভরা। হঠাৎ হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল পরি। হাত ধরে তোলার চেষ্টা করল চমক।

উঃ মাগো, আর পারি না। উঠতে পারছি না আর… ক্লান্ত স্বরে ভেঙে পড়ল পরি।

পরি… পরি… ওঠো। উঠতে যে হবেই তোমাকে। দেখো, আর একটু… একটুখানি মাত্র। একটু চেষ্টা করো লক্ষ্মীটি, পালাতে যে হবেই আমাদের।

জানি, জানি চমক।

কোনওরকমে উঠে দাঁড়াল সে৷ দু-হাতে পরিকে জড়িয়ে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করল চমক। পায়ের যন্ত্রণায় কাতর পরি। থেকে থেকে কেঁপে উঠছে ওর সর্বাঙ্গ। না না, প্রাণ থাকতে ধরা দেওয়া নয়। পা টানতে টানতে সামনের দিকে এগিয়ে চলল ওরা। অনেক কথাই ভীড় করে আসছে মনে… সুখের দিনগুলো ছিল ওদের… আকাশযানের মিস্ট্রি চমক… হঠাৎ শুরু হয়ে কী অভাবনীয় আক্রমণ… ঝাঁপিয়ে পড়ল শিকারীর দল… বিচিত্র তাদের ভাষা, বিচিত্র তাদের চিন্তাধারা। না না, এমনিতে হার মানেনি চমকরা। স্বাধীনতা রক্ষার জন্য শুরু হয়েছিল যুদ্ধ, শিকারীদের স্পেসশিপ ধ্বংসও হয়েছিল বেশ কিছু, কিন্তু শিকারীদের সঙ্গে পারবে কেন ওরা? শান্তি আর উন্নত সভ্যতার ধারক-বাহক বলেই তো যুদ্ধ আর মারাত্মক অস্ত্র-শস্ত্রকে মনপ্রাণ দিয়ে ঘৃণা করত চমকদের পৃথিবী। আর সেই জন্যেই আক্রমণের মুখে টিকতে পারেনি ওরা। নির্মম হত্যালীলায় মেতে উঠল শিকারীদল। রক্তের স্রোত প্রমাণ করল মিথ্যে… মিথ্যেই শুধু শান্তি আর সভ্যতার বড়াই।

না, হালকা পরির দেহ যেন লোহার মতো ভারী। থেকে থেকেই দাঁড়াতে হচ্ছে। আর কত দূর… দেহ চলে না আর। বিশ্রাম, একটু বিশ্রাম চাই। ঘন ঝোপের আড়ালে পরিকে পাশে নিয়ে ক্লান্ত দেহ এলিয়ে দিল চমক। আরও.. আরও কাছে টেনে নিল পরিকে। সাংঘাতিক ফুলে উঠেছে ওর পা। রক্তাক্ত ভাবলেশহীন দৃষ্টি মেলে ওর দিকে তাকাল পরি।

আর কী হবে চেষ্টা করে…

না। হেরে গেলাম, পারলাম না পরি।

এই তো ভালো হল চমক। সব যখন শেষ তখন কী হবে আর বাঁচার চেষ্টা করে। যা হবার একসঙ্গেই হোক আমাদের। চমক… চমক, আর একটু কাছে এসে বস আমার।

থেকে থেকে পাহাড়ের বুকে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত উঠেছে ভিনগ্রহী শিকারীদের গুলির আওয়াজ। এসে পড়েছে ওরা… চমকের বুকে মাথা দিয়ে গভীর শান্তিতে চোখ বুজল পরি।

আরও… আরও নিকটে শব্দ এবার। বিজাতীয় ভাষায় টুকরো-টুকরো কথা ভেসে আসছে। কী অদ্ভুত ভাষা ওদের। হঠাৎ যেন ক্ষেপে উঠল চমক। চিৎকার করে উঠল, শয়তান দূর হয়ে যা! দূর হয়ে যা আমাদের পৃথিবী থেকে! কী অন্যায় করেছিলাম আমরা জানোয়ারের দল?

হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরল পরি। কোনও উত্তেজনা নেই আর ওর শরীরে।

ছিঃ, চমক! কী লাভ উত্তেজিত হয়ে? মনে করে দেখো আমাদের পূর্বপুরুষের কথা, অধিকার আর জয়ের নেশায় আমরাও তো ধ্বংস করেছিলাম গ্রহের পর গ্রহ। কিন্তু কী পেয়েছিলাম আমরা? ধ্বংসের হাতে বিকিয়ে দিয়েছিলাম নিজেদের শান্তিকে।

ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল বিচিত্র সব ভিনগ্রহী শিকারীরা। হাতে ওদের চকচকে অস্ত্র। পরিকে জড়িয়ে ধরে উঠে দাঁড়াল চমক। একে একে শিকারীরা ঘিরে ফেলল ওদের। চোখে মুখে কী সে নারকীয় উল্লাস, বিজয়গর্বে উদ্ধত, ওদের তাক করে উত্তেজনায় অধীর অস্ত্রগুলো।

পরি আর চমক নির্ভীকভাবে তাকাল শত্রুদের দিকে। এত কাছ থেকে শিকারীদের দেখার সৌভাগ্য হয়নি ওদের। লম্বা লম্বা দুটো হাত, দুটো পা, ড্যাবডেবে চোখদুটো সামনে। এরাই তো সুদূর মহাকাশের সূর্যের তৃতীয় গ্রহের বাসিন্দা, পৃথিবী যার নাম। এক চাঁদ পাক দিয়ে ফেরে গ্রহকে। হ্যাঁ হ্যাঁ, এরা… এরাই তো জয়ের নেশায় বুদ। ছিন্নমস্তা সভ্যতার এরাই তো ধ্বজাধারী–মা… নু… ষ…!

[প্রথম প্রকাশ: ফ্যানট্যাসটিক, বার্ষিকী ১৯৮৩]

Ranen Ghosh ।। রণেন ঘোষের