অসুর (নভেলেট)

শীতের দুপুরে কোনও এক শহরতলিতে তিনতলা বাড়িটা ছিল একা-একা দাঁড়িয়ে। সামনে একফালি বাগান, আর দু-পাশে খোলা মাঠের নির্জনতা। পিছন দিকটায় কিছু জংলা ঝোঁপ। বাড়ির বাসিন্দা ছজন মানুষ। কিন্তু ছজনের একজন গরহাজির ছিল সেই নির্জন দুপুরে। এবং ঠিক সেই সময়েই এসে হাজির হল সপ্তম ব্যক্তি…।

পরনে ফুল হাতার কালো জামা, কালো কর্ড-এর প্যান্ট। চোখে মুখে কেমন একটা উদাসীন দৃষ্টি। চেহারা তার রোগার দিকেই। কিন্তু চোয়ালের কঠিন রেখা ভেতরের শক্তির একটা আভাস দিচ্ছে। পা ফেলায় বিন্দুমাত্র চাঞ্চল্য নেই। অলসভাবে মেঠো পথ ধরে সে এগিয়ে আসছিল। আধা-গ্রাম আধা-শহর মিশিয়ে তৈরি এই শহরতলিতে তার আসা এই প্রথম। এবং বোধহয় এই শেষ।

রাস্তার দুপাশে ঘাসের ছোঁওয়া এখনও আছে। চোখ তুলে তাকালে দূরে দেখা যায় ওভারহেড লাইন। সেই তারে বসে আছে কয়েকটা ফিঙে। লেজ নাড়িয়ে দোল খাচ্ছে।

এ-অঞ্চলের বাড়িগুলোকে কেউ যেন সযত্ন পরিকল্পনায় হিসেবি দূরত্বে বসিয়ে দিয়েছে। কোনওটা একতলা, কোনওটা দোতলা, আর কোনওটা-বা তিনতলা। শীতের দুপুর। সব বাড়ির জানলা, দরজা বন্ধ। হয়তো বাসিন্দারা বিশ্রাম নিচ্ছে।

তিনতলা হলদে বাড়িটা তাকে টানল কোন অদ্ভুত কারণে, তা সে নিজেই জানে না। হয়তো বাড়ির সামনের এই একফালি বাগানটা।

নির্জন মাঠের এদিক-ওদিক একবার চোখ বুলিয়ে সে বাড়িটার দিকে তাকাল। বাউন্ডারি গেটের হুড়কো খুলে ঢুকে পড়ল ভেতরে।

আধুনিক পরিকল্পনায় ছোঁয়াচ বাড়িটার সর্ব অঙ্গে।

ভারী কাঠের দরজার ওপরে নেমপ্লেট। তাতে লেখাঃ

সুশান্ত মল্লিক, অ্যাডভোকেট

আর একটু ওপরে, ডান পাশে কলিংবেলের সুইচ। বাগান চিরে যে-পথ দরজা পর্যন্ত পৌঁছেছে, তার দু-ধারে গেঁথে দেওয়া ইটে সাদা রং করা; খাটো বাঁশের বেড়াও রয়েছে একটা।

শ্লথ পায়ে দরজার কাছে পৌঁছে কী যেন চিন্তা করল সে। চোখ তুলে তাকাল দোতলার বারান্দার দিকে। সাদা রঙের গ্রিলে ঘেরা বারান্দা জনশূন্য। এবং যে-হলদে দরজাটা বাড়ি এবং বারান্দার যোগসূত্র, সেটা বন্ধ।

চিন্তার ইতি ঘটিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কলিংবেলের বোতামে হাত রাখল সে। ভেতরে ঝনঝনিয়ে ওঠা চাপা আওয়াজটা কানে আসতেই হাসল; বাঁ-হাতটা অভ্যস্ত ভঙ্গিতে পকেটে ঢুকিয়ে অনুভব করল ভাঁজ করা স্টিলের ছুরিটা।

আর একবার হাসল সে।

*

একটা হালকা লেপ গায়ে দিয়ে বারান্দার লাগোয়া ঘরটাতে শুয়েছিলেন সুশান্ত মল্লিক।

শারীরিক অসুস্থতার জন্য দিনকয়েক ওকালতিকে ছুটি দিয়েছেন। পঞ্চাশ পার হওয়ার পর থেকে তার হৃৎপিণ্ড যেন শরীরের সঙ্গে লাগাতার বিরোধিতা শুরু করে দিয়েছে। সুতরাং খাওয়াদাওয়া সেরে একটু দিবানিদ্রার আয়োজন করছিলেন। ঘরের জানলা-দরজা সব বন্ধ। সবাই জানে, এ সময়ে তাকে বিরক্ত করা বারণ। সাধারণত গল্পের বই পাশে নিয়ে শোন। মাথার কাছে রিডিং-ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে কিছুক্ষণ পড়েন, তারপর একসময় আলো নিভিয়ে পাশ ফিরে ঘুমোনোর চেষ্টা করেন।

সুশান্ত মল্লিকের একটু তন্দ্রা মতো এসেছিল। আধো-ঘুম আধো-জাগরণের মধ্যেই তিনি শুনতে পেলেন কলিংবেলের শব্দ। অর্থাৎ, দরজায় কোনও অতিথি অপেক্ষা করছে। কিন্তু তিনি ব্যস্ত হলেন না। কারণ, বেলা এখন সবে দুটো। তার স্ত্রী, মেয়ে, বিধবা বোন এবং বাড়ির কাজের লোক– সকলেই এখন জেগে। কলিংবেলের শব্দ ওরা কেউ-না-কেউ নিশ্চয়ই শুনতে পেয়ে থাকবে। তারপর ওদের কেউ যাবে দরজা খুলে দিতে।

প্রমাণিত হল, সুশান্ত মল্লিকের অনুমান নির্ভুল। তাঁর স্ত্রী, রমলা মল্লিক, দোতলার রান্নাঘরে এঁটো বাসন নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। কলের জলের শব্দে কলিংবেলের শব্দটা তার কানে যায়নি। রান্নাঘরের পাশেই একটা মাঝারি ঘর। সে-ঘরে সিনেমার পত্রিকার পাতায় চোখ বোলাতে ব্যস্ত ছিল সুমনা– সুশান্ত মল্লিকের মেয়ে। ইতিহাসে অনার্স নিয়ে বি. এ. পাশ করার পর সুযোগ্য পাত্রের অপেক্ষায় দিন গুনছে। ঘণ্টার শব্দটা ওর কানে গেলেও বিছানা ছেড়ে ওঠার চেষ্টা সুমনা করল না। কারণ ও জানে, আর কেউ-না-কেউ শব্দটা নিশ্চয়ই শুনতে পেয়ে থাকবে। তাই পত্রিকার পাতায় চোখ রাখলেও ওর কান পড়ে রইল সদর দরজার দিকে ও কখন শুনতে পাবে দরজা খোলার শব্দ। তারপর না হয় জানলা দিয়ে একবার উঁকি মেরে দেখবে, কে এল।

সুমনার বিধবা পিসি প্রভা রায়গুপ্ত পুজো-আচ্চা সেরে খাওয়ার ব্যবস্থা করছিলেন, কানে এল ঘণ্টার শব্দ। এ-বয়েসে মানুষ হয়তো একটু অধৈর্য এবং খুঁতখুঁতে হয়। তাই খাওয়ার ব্যবস্থা ছেড়ে তিনি বাইরের করিডরে বেরিয়ে এসে ডেকে উঠলেন, সুমু, দেখ তো কে এল!

সুমনা দোতলায় নির্বিকার থাকলেও প্রভাদেবীর চিৎকারটা রমলাদেবীর কানে গেল। তিনি বাসন মাজা থামিয়ে চাকর অবিনাশকে উদ্দেশ করে চেঁচিয়ে বললেন, অবিনাশ, দরজা খুলে দে। কে এল দেখ– কথা শেষ করে আবার হাতের কাজে মন দিলেন তিনি।

অবিনাশের বয়স বাইশ-তেইশ। কালো স্বাস্থ্যবান চেহারা। এ-বাড়িতে সে আছে প্রায় চার বছর। রোজকার মতো একতলায় বসে সে নিজের জামাকাপড় কাচছিল। কাপড় কাঁচা হলে স্নান সেরে দোতলার গিয়ে ঢেকে রাখা খাবার খাবে। তারপর একটু গড়ানোর ব্যবস্থা করবে।

কাপড় কাচার শব্দে ঘণ্টির শব্দ চাপা পড়ে যাওয়ায় সে এতক্ষণ খেয়াল করেনি। কিন্তু মায়ের গলার আওয়াজে হাতের কাজ থামাল সে। শুনতে পেল ঘণ্টার অধৈর্য শব্দ।

একটু বিরক্ত হয়ে অবিনাশ উঠল। ভিজে হাত থেকে সাবান-জল ঝাড়তে ঝাড়তে দরজার কাছে এগিয়ে গেল।

.

নীরবে অপেক্ষা করতে করতেই তার নজর পড়ল টেলিফোনের তারটায়। দরজার বাঁ-পাশ দিয়ে দেওয়ালের গা বেয়ে সাপের মতো নেমে গেছে।

মনে-মনে হাসল সে।

বিজ্ঞানের লম্বা হাত এত দুরেও এসে পৌঁছেছে! এই ভাবনার সঙ্গে-সঙ্গে তার মনের হাসি কালো ঠোঁটজোড়ায় ছায়া ফেলল। বাঁ-হাতে ছুরিটা বের করে বুড়ো আঙুলে চাবি টিপতেই ঝলসে উঠল স্টিলের ফলা। এবং পরমুহূর্তেই নিখুঁত হাতে বিচ্ছিন্ন হল টেলিফোনের তার।

রোদ-ঝকমকে নীল আকাশে হঠাৎই যেন ছায়া ফেলল একটুকরো ঘন কালো মেঘ।

এমন সময় সশব্দে খুলে গেল সদর দরজা।

দরজায় দাঁড়িয়ে বাইশ-তেইশ বছরের এক যুবক। খালি গা। পরনে চেক লুঙ্গি। খাটো করে পরা। কোথাও কোথাও সামান্য ভিজে।

তার মুখের দিকে তাকিয়ে ভিজে হাত দুটো লুঙ্গিতে মুছতে লাগল ছেলেটি। প্রশ্ন করল, কাকে চাই?

উত্তরে মৃদু স্বরে সে বলল, সুশান্ত মল্লিক, অ্যাডভোকেট।

উনি অসুস্থ। এখন বিশ্রাম করছেন।

নীরবে খোলা দরজার চৌকাঠ পেরোল সে। ছেলেটির বিস্ফারিত চোখের সামনে পিঠ দিয়ে বন্ধ করে দিল সদর দরজা। তারপর বাঁ-হাতটা উঁচিয়ে ধরল ছেলেটার চোখের সামনে। হাতে ধরা বস্তুর চরিত্র এই আধো-অন্ধকারেও স্পষ্ট বুঝল ছেলেটা। হয়তো আসন্ন বিপর্যয়ের কথা অনুমান করেই এক বুক ফাটা চিৎকারের জন্য ভোকাল কর্ডকে তৈরি করে হাঁ করল। এবং ঠিক সেই মুহূর্তেই অভ্যাসলব্ধ পেশাদারি ভঙ্গিতে সাপের মতো ক্ষিপ্রতায় আগন্তুকের বাঁ-হাত ছোবল মারল ছেলেটির গলায়। স্টিলের ফলাটা একইসঙ্গে তার চিৎকার এবং শ্বাসনালিকে মাঝপথেই বিচ্ছিন্ন করল।

অদ্ভুতভাবে ছেলেটার শরীরটা সামনে মাথা ঝুলিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কিন্তু সে কয়েকমুহূর্তের জন্য। তারপরই সিমেন্টের মেঝেতে আছড়ে পড়ল। মেঝে তখন রক্তে ভিজে উঠেছে।

ছটফট করা শরীরটার দিকে একপলক দেখল সে। দেখল বাঁ-হাতের রক্তাক্ত ছুরিটার দিকে। তাকাল কালো জামায় ছিটকে আসা রক্তের রেখার দিকে। তারপর নির্বিকারভাবে ছুরিটা ঘষে-ঘষে মুছে নিল জামার কাপড়ে। দরজার ছিটকিনি তুলে দিয়ে ছেলেটার দেহ ডিঙিয়ে এগিয়ে গেল সিঁড়ির কাছে। পা থেকে চটিজোড়া এককোণে খুলে রেখে নিঃশব্দ পায়ে উঠতে লাগল সিঁড়ি বেয়ে…।

.

সুমনা শুয়ে-শুয়েই শুনতে পেল সদর দরজা খোলা এবং বন্ধ করার শব্দ। সুতরাং অতিথির সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসার শব্দের প্রতীক্ষায় ও সময় গুনতে লাগল। কিন্তু মিনিটপাঁচেক পরেও যখন কারও পায়ের শব্দ ওর কানে এল না, তখন একটু অবাক হল ও। অনিচ্ছা সত্ত্বেও সিনেমা-পত্রিকাটা বালিশের পাশে রেখে বেশবাস গুছিয়ে বিছানা ছেড়ে নেমে দাঁড়াল।

ভেজানো দরজা খুলে বাইরের অলিন্দে এল সুমনা। ডান পাশেই রান্নাঘর, এখান থেকে মায়ের বাসন মাজার শব্দ বেশ স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে। মা-কে আর ব্যস্ত না করে বাঁ-দিকে এগোল। সুমনা। একপলক দেখল তিনতলায় ওঠার সিঁড়ির দিকে, তারপর তাকাল বাবার ঘরের দরজার দিকে। দরজা রোজকার মতোই ভেজানোযাতে কোনও অবাঞ্ছিত অতিথি সুশান্ত মল্লিকের ঘুমের ব্যাঘাত না ঘটায়।

এবার নীচে নামার সিঁড়ি বেয়ে নামতে শুরু করে সুমনা। যতই নামে ততই ও অবাক হয়। কারণ, একতলার বাথরুম থেকে অবিনাশের কাপড় কাঁচার একটানা শব্দ মোটেও শোনা যাচ্ছে না। এটা রোজকার নিয়মের ব্যতিক্রম। সুতরাং অস্বাভাবিক।

সিঁড়ির শেষ ধাপ থেকে নেমে কলতলার দিকে এগিয়ে চলল সুমনা।

কলতলা এবং বাথরুমের একটাই দরজা, এবং সেটা হাট করে খোলা।

ভেতরে উঁকি মারতেই কোনও শব্দ না শোনার কারণটা বোঝা গেল। কলতলার অবিনাশ নেই। বালতি, সাবান, কাপড়চোপড় সব ছড়ানো। বোঝাই যাচ্ছে, কাপড় কাচতে কাচতে হাতের কাজ ফেলে অবিনাশ উঠে গেছে সদর দরজা খুলতে।

বাথরুম দেখা শেষ করে সদর দরজার দিকে চলল সুমনা।

সদর দরজার হাতপাঁচেকের মধ্যে পৌঁছোতেই মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে থাকা জিনিসটা যে অবিনাশ সেটা ও বুঝতে পারল।

কিন্ত সদর দরজা বন্ধ!

আর রক্তে ভেসে যাওয়া সিমেন্টের মেঝেতে বিস্তভাবে পড়ে আছে অবিনাশ। দু-চোখে ঘোলাটে দৃষ্টি। ঠোঁট দুটো ফাঁক করা। এবং গলার নলিটা কে যেন সযত্নে দু-টুকরো করে দিয়েছে।

ঘটনার আকস্মিকতায় সুমনা কয়েক মুহূর্তের জন্য দিশেহারা হয়ে পড়ল। আপ্রাণ চেষ্টাতেও ওর মুখ থেকে সঙ্গে-সঙ্গে কোনও চিৎকার বেরিয়ে এল না। বুকে জমাট বাঁধা নিশ্বাসটা যখন বাইরে বেরিয়ে এল, তখনই শোনা গেল ওর উন্মাদ চিৎকার। যেন কসাইখানায় খতম হওয়ার সময়ে কোনও শুয়োর ভাঙা, মর্মন্তুদ, কর্কশ স্বরে আর্তচিৎকার করছে।

.

দোতলার ওঠার সিঁড়ির শেষ ধাপে পৌঁছে একমুহূর্ত থমকে দাঁড়াল সে। দেখল, বাঁ-দিকে একটা ভেজানো দরজা। দ্বিধা কাটিয়ে দরজার হাতের চাপ দিল। ধীরে-ধীরে সেটা খুলে গেল। এবং নিঃশব্দ পায়ে আগন্তুক ভেতরে ঢুকল। আবার ভেজিয়ে দিল দরজাটা।

যে ঘরটায় সে পা রাখল সেটা অতিথি-অভ্যাগতদের আপ্যায়ন করার জন্য আধা ড্রইংরুমগোছের একটা ঘর। দরজার বাঁ-পাশে রেফ্রিজারেটর। সামনে সাজানো সোফাসেট এবং একটা ছোট টেবিল হলদে কাপড় দিয়ে ঢাকা। বাঁ-দিকের শেষ প্রান্তে একটা কাঠের তাকে বসানো রেডিয়ো। এখন বন্ধ।

ঘরের আসবাবপত্রের ওপর একপলক চোখ বুলিয়ে সে এগিয়ে চলল।

সামনেই আর-একটা দরজা। আলতো করে ভেজানো।

দ্বিতীয় দরজা অতিক্রম করেই সে পৌঁছোল দোতলায় বারান্দার লাগোয়া বড় ঘরটায়। ঘরে আবছা অন্ধকার। ডানদিকে এবং বাঁ-দিকে দুটো বড় খাট। ডান পাশে দাঁড় করানো একটা বিশাল কাঠের আলমারি। ঘরের মাঝামাঝি জায়গায় একটা চেয়ার ও টেবিল।

পরমুহূর্তেই তার চোখ পড়ল বাঁ-দিকের খাটে দেওয়ালের দিকে মুখ করে লেপ গায়ে ঘুমিয়ে রয়েছে একজন মানুষ। শুধুমাত্র তার মাথার পিছনটুকু অস্পষ্টভাবে নজরে পড়ছে। খাটের বাঁ-দিকে সাজানো একটা স্টিলের আলমারি, চেয়ার, ড্রেসিং টেবিল। টেবিলে কয়েকটা জিনিস রাখা আছে। বোঝা গেলেও আবছা আঁধারে ঠিকমতো নজরে এল না। স্টিলের আলমারির গায়ে লাগানো এক বিশাল আয়না। সেই আয়নায় নিজেকে একপলক দেখে বাঁ-দিকের খাটটার কাছে নিঃশব্দে এগিয়ে গেল।

খাটের খুব কাছে দাঁড়িয়ে সে লেপের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা মাথাটা খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। জানলায় লাগানো কাচের শার্সির দৌলতে সামান্য আলো ঠিকরে পড়েছে শুয়ে থাকা মানুষটির গায়ে। তার নজরে পড়ল কাঁচা-পাকা চুলের হালকা আস্তরণ মাথার পিছনটা ঢেকে রেখেছে। মনে মনে কী ভাবল সে। তারপর পকেট থেকে ইস্পাতের ছুরিটা বের করে বাঁ-হাতে উঁচিয়ে ধরল। চাবির ওপর বুড়ো আঙুলের চাপ দিতেই একটা খ করে শব্দের সঙ্গে-সঙ্গে বাইরে ছিটকে এল ঝকঝকে ফলাটা। শুয়ে-থাকা লোকটা সে-শব্দ শুনতে পেল কি না ঠিক বোঝা গেল না।

সুতরাং নিশ্চিত ভঙ্গিতে সে খাটের ওপর ঝুঁকে পড়ল, দু-চোখের কালো তারা কেন যেন ধকধক করে জ্বলছে…।

*

চিৎকারটা প্রথমে শুনতে পাননি রমলাদেবী। কারণ ধাতব বাসনে ছিটকে পড়া জলের শব্দ আর-সব শব্দ ঢেকে দিয়েছিল। আচমকা কলটা বন্ধ করতেই কারও গলা চিরে বেরিয়ে আসা তীব্র চিৎকারটা পাগলের মতো তার কানের পরদায় এসে আঘাত করল। একবার-দুবার-তিনবার…।

সম্পূর্ণ হতভম্ব রমলাদেবীর হাত থেকে অ্যালুমিনিয়ামের হাতাটা খসে পড়ে গেল। দিশেহারাভাবে কয়েকমুহূর্ত তিনি উবু হয়ে বসে রইলেন। তারপর বয়েসের তুলনায় ক্ষিপ্র চেষ্টায় উঠে দাঁড়ালেন। ভিজে হাত দুটো পরনের শাড়িতে মুছতে মুছতে বেরিয়ে এলেন বাইরের অলিন্দে। স্বভাবমতো ডেকে উঠলেন, কী হল? চেঁচাচ্ছে কে কী ব্যাপার?

অলিন্দ ধরে কয়েক পা এগিয়েই তিনি বুঝলেন, চিৎকারের শব্দটা আসছে একতলা থেকেই। সুতরাং নীচে নামার সিঁড়ির কাছে এগিয়ে গেলেন তিনি। কিন্তু হঠাৎ সুমনার কথা মনে হতেই আবার ফিরে এলেন রান্নাঘরের পাশের ঘরটায়। হ্যাঁ, চোখের কোণ দিয়ে যেটুকু তার নজরে পড়ছিল তা সত্যি ।

ঘরে সুমনা নেই।

 সিনেমার পত্রিকাটা বালিশের পাশে নামানো। ঘরের দরজা হাট করে খোলা।

এবার রমলা মল্লিক ভয় পেলেন। সুমু-সুমু বলে চিৎকার করতে করতে তিনি টলোমলো পায়ে সিঁড়ি ভেঙে একতলায় নামতে শুরু করলেন।

সিঁড়ির মাঝামাঝি নামার পরই বিপরীত দিক থেকে উদ্ভ্রান্ত ভঙ্গিতে ছুটে আসা সুমনার সঙ্গে তাঁর ধাক্কা লাগল।

সুমনার দু-চোখ আতঙ্ক-বিস্ফারিত। ঠোঁট দুটো সামান্য ফাঁক করা। ঘন নিশ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে-সঙ্গে ওর ভারী বুক দুটো উঠছে-নামছে।

মা-কে সামনে পেয়ে জাপটে ধরল সুমনা। মুখ দিয়ে কোনও শব্দ বেরোল না। রুদ্ধ আবেগে ওর শরীরটা রমলাদেবীর দুহাতের মাঝে কেঁপে-কেঁপে উঠতে লাগল।

সেকেন্ডকয়েক পর সুমনার কাঁপা স্বর–অবিনাশ–মরে গেছে– এই শব্দ তিনটে উচ্চারণ করল এবং করেই চলল।

পাঁচবারের পর রমলাদেবী ওর কথার অর্থ স্পষ্টভাবে বুঝতে পারলেন। তখন আরও জোরে আঁকড়ে ধরলেন মেয়েকে। চাপা স্বরে বললেন, অবিনাশ মরে গেছে? কী করে?

সুমনা নীরবে সদর দরজার দিকে আঙুল দেখাল। ওর শরীরের কাপুনি তখনও থামেনি।

রমলাদেবীর অভিজ্ঞতা নেহাত কম নয়। প্রথম কয়েকমিনিট তিনি দিশেহারা হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। অবশেষে সিদ্ধান্তে এলেন, সুমনা মিথ্যে কথা বলছে না। কিন্তু ওর দেখা ও শোনার মধ্যে কোথাও হয়তো কোনও গলদ রয়েছে, তাই এরকম অসংলগ্ন আচরণ করছে। সুতরাং তিনি মেয়েকে সাহস দেখিয়ে বললেন, চল তো, দেখি কী ব্যাপার।

সুমনা শূন্য চোখে মায়ের চোখের দিকে দু-পলক চেয়ে রইল, তারপর নীরবে তাঁর কথা মেনে নিল। মায়ের হাত ধরে ও সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগল। ওর শূন্য দৃষ্টি সামনে–যেন অবিনাশের মৃতদেহটা ওর চোখের তারায় ভাসছে।

সিঁড়ির শেষ ধাপে নামতেই রমলা মল্লিকের সন্ধানী নজর পড়ল এককোণে রাখা মামুলি একজোড়া চটির ওপর। কিছু একটা বলতে গিয়েও তিনি থমকে গেলেন। ক্লান্ত সুমনার দিকে মনোযোগ দিলেনঃ চল, আস্তে-আস্তে চল। কোনও ভয় নেই, আমি তো আছি।

সুমনা মা-কে নিয়ে মৃত অবিনাশের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। শুধু রক্তের কালচে রং, আর কিছু কালো মাছি ছাড়া দৃশ্যপটের আর কোনও পরিবর্তন হয়নি।

রমলাদেবীর মুখ দিয়ে একটা অদ্ভুত শব্দ বেরিয়ে এল। সুমনা ভাব-অনুভূতিহীন, নির্বিকার।

সংবিৎ ফিরে পেতে রমলাদেবীর যেটুকু দেরি হল সেটা তিনি পুষিয়ে নিলেন আচমকা ছুট দিয়ে। মেয়েকে ফেলে রেখে তিনি পাগলের মতো দৌড়োলেন সিঁড়ির দিকে। মেয়ের কথা তার মনেও রইল না।

মা-কে উধাও হতে দেখে সুমনাও চুপ করে থাকল না। অস্বাভাবিক ভঙ্গিতে মাকে অনুসরণ করল। সিঁড়ির কাছে পৌঁছে যে-দৃশ্য ও দেখল তাতে অবাক হওয়ারই কথা। এবং সেইসঙ্গে ভয়ের পরশও বুঝি দোলা দিয়ে যায়…।

.

সুশান্ত মল্লিকের শোওয়ার ঘরে দাঁড়িয়েই নীচের তলার শোরগোলটা তার কানে গেল। একটু যেন বিচলিত হয়েই তার বাঁ-হাত পকেট ছুঁয়ে দেখল, অনুভব করল ইস্পাতের ভরসা। তারপর বেড়ালের পায়ে বেরিয়ে এল বসবার ঘরে। সিঁড়ির লাগোয়া দরজায় কান পেতে শুনতে পেল একাধিক নারীকণ্ঠ। ওরা কথা বলছে সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে। একটু পরেই কথা মিলিয়ে আসতে লাগল– ওরা সিঁড়ি বেয়ে নামছে।

সুতরাং সে বেরিয়ে এল দরজার বাইরে, চোরা পায়ে নামতে শুরু করল সিঁড়ি বেয়ে– পলকের জন্য রেলিঙের পাশ দিয়ে তার চোখে পড়ল রঙিন শাড়ির আভাস। নির্লিপ্তভাবে ওদের অনুসরণ করল সে।

যখন সে সিঁড়ির শেষ ধাপে, নজরে পড়ল তার রেখে যাওয়া চটিজোড়া, এবং কানে এল একটা অদ্ভুত চাপা চিৎকার–যদি তাকে চিৎকার বলা যায়। পরক্ষণেই যে কারও ফিরে আসার শব্দ শোনা যাচ্ছে, সেটা বুঝতে পেরেই চট করে চটিজোড়া হাতে তুলে নিল সে, শ্বাপদের মতো ক্ষিপ্র পায়ে সিঁড়ি বেয়ে আবার উঠতে শুরু করল। পিছনে ভেসে আসছে পায়ের শব্দ।

সিঁড়ির শেষ ধাপে পৌঁছে লুকোনোর চেষ্টায় আবার বসবার ঘরেই ঢুকে পড়ল সে। চঞ্চল চোখে জরিপ করে ডানদিকের দেওয়ালের গায়ে, সোফাসেটের ঠিক বিপরীত দিকে, সে আবিষ্কার করল একটা ছোট দরজা। ঝটিতি সেই দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল সে। হাতের চাপ দিতেই দরজা খুলে গেল। ভেতরে ঢুকে আবার দরজা ভেজিয়ে দিল। তারপর ভালো করে দেখতে লাগল ঘরটা।

আটফুট বাই চারফুট ছোট্ট ভঁড়ার ঘর। টুকিটাকি জিনিসে–হাঁড়ি, কড়াই, টিনের কৌটো, বালতি আর একটা বিশাল আলমারিতে ঠাসা। কোনওরকমে জনাতিনেক পাশাপাশি দাঁড়ানো যায়।

আলমারির পাশে একটা সবুজ কাঠের মই। মাথার ওপরে কাঠের সিলিং। তার এক জায়গায় একটা চৌকো ফোকর–অর্থাৎ, ওপরে কুঠরি-ঘরে যাওয়ার দরজা। সেই চৌকো তক্তাটা একটা আংটা দিয়ে বাইরের কাঠের সঙ্গে আটকানো। এবার কাঠের মইটার অর্থ বুঝতে পারল সে। এই মই বেয়ে উঠে কাঠের চৌকো তক্তাটা খুলে একজনের পক্ষে ওপরের কুঠরি-ঘরে যাওয়া সম্ভব। মই বেয়ে ওপরে ওঠার ইচ্ছেটা একবার তার মনে চাড়া দিয়ে উঠল, কিন্তু প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই প্রচণ্ড শব্দে খুলে গেল বসবার ঘরের দরজা। হাঁফাতে-হাঁফাতে কেউ ঢুকল ঘরে। তারপর দুদ্দাড় করে সিঁড়ি ভেঙে ছুটতে শুরু করল।

কান খাড়া করে নির্লিপ্তভাবে দাঁড়িয়েছিল সে। চোখ ভঁড়ার ঘরের ছোট্ট জানলা দিয়ে দুরের রোদে-ধোওয়া নীল আকাশে। মনে-মনে পরিস্থিতির ওজন মাপতে চাইল সে। পারল না। সব চিন্তা কেমন জট পাকিয়ে যাচ্ছে। ভেসে আসছে মশার গুনগুন একটানা কান্না…।

*

জমাট পাথরের মতো নিশ্চল দাঁড়িয়ে আছেন রমলা মল্লিক। তেমনি নিশ্চল তার বিস্ফারিত দু-চোখ। তাকিয়ে আছেন সিঁড়ির শেষ ধাপের কাছে দেওয়ালের পাশে একটি বিশেষ জায়গার দিকে। মায়ের হতবাক হওয়ার কারণ সুমনা প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই বুঝতে পারল। মায়ের পিছন থেকে উঁকি দিয়ে ও সেইদিকে তাকিয়ে রইল, কিন্তু কোনও কিছুই ওর নজরে পড়ল না।

সুমনা ভয় পেয়ে দু-হাতে আঁকুনি দিল মাকে : কী হয়েছে মা? দাঁড়িয়ে পড়লে কেন?

ক্লান্ত আচ্ছন্ন স্বরে রমলা মল্লিক বললেন, সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় একজোড়া চটি দেখেছিলাম, এখন দেখছি না।

কথার অর্থটা মনের গভীরে কেটে বসতে সুমনার যেটুকু সময় লাগল। তারপরই ও ক্ষিপ্র পায়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে শুরু করল। পিছন থেকে ভেসে আসা কী হল, সুমু?-র উত্তরে ও কোনওরকমে বলল, দাঁড়াও মা, অফিস-ঘরের চাবিটা নিয়ে আসি।

রমলা মল্লিক মেয়েকে চোখের আড়াল করতে চাইলেন না। ওকে অনুসরণ করলেন। সুমনা তখন একধাক্কায় বসবার ঘরের দরজা খুলে ফ্রিজের ওপরে রাখা অফিস-ঘরের চাবিটা তুলে নিয়ে বেরিয়ে এসেছে। দ্রুতপায়ে পাশ কাটিয়ে নেমে যেতে-যেতে মা-কে ও বলল, তুমি শিগগির বাবাকে ডাকো! আমি পুলিশে ফোন করছি।

মা-কে বিহ্বল অবস্থায় সিঁড়িতে রেখে সুমনা ছুটে গেল একতলার অফিস-ঘরে। অ্যাডভোকেট সুশান্ত মল্লিকের অফিসে।

মানসিক অস্থিরতায় তালার গায়ে চাবিটা ঢোকাতে কিছুক্ষণ সময় লাগল ওর। তারপর এক ঝটকায় দরজা খুলে সেক্রেটারিয়েট টেবিলের বাঁ-প্রান্তে বসানো টেলিফোনের কাছে পৌঁছে গেল সুমনা। কাঁপা হাতে রিসিভার তুলে নিয়ে ডায়াল ঘোরাতে যেতেই বুঝল, রিসিভার নিস্তব্ধ। তাতে ডায়াল টোনের সুপরিচিত কড়কড় শব্দ শোনা যাচ্ছে না। শত চেষ্টাতেও যখন কিছু হল না, তখন রূঢ় বাস্তবটা সুমনা বুঝতে পারল।

ওদের বাড়ির টেলিফোনের লাইন কেউ কেটে দিয়েছে…।

.

সাময়িক স্থবিরতা কাটিয়ে রমলা মল্লিক যখন সচল হলেন, তখন বেশ কয়েক সেকেন্ড কেটে গেছে। স্বামীকে অবিশ্বাস্য ঘটনা কীভাবে বিশ্বাস করাবেন সেই কথা ভাবতে-ভাবতে তিনি উঠে এলেন সিঁড়ি বেয়ে। খোলা দরজায় দাঁড়িয়ে গভীর মনোযোগে দেখতে চাইলেন নীচের চটিজোড়ার মতো এই বসবার ঘরে কোনওরকম গরমিল চোখে পড়ছে কি না। পড়ল না। সুতরাং ধীরে ধীরে তিনি এগোলেন সুশান্ত মল্লিকের শোওয়ার ঘরের দিকে।

ঘরের ভেজানো দরজায় হাত রাখতেই অস্পষ্টভাবে কারও নড়াচড়ার শব্দ তার কানে এল– বোধহয় ভঁড়ার ঘরের দিক থেকে। থমকে দাঁড়ালেন রমলাদেবী। চোখ এবং পা যথাক্রমে ফেরালেন ভঁড়ার ঘরের ভেজানো দরজার দিকে। তারপর ধীরে ধীরে পা বাড়ালেন।

ভেজানো দরজায় হাত ছোঁয়াতেই বুক কেঁপে উঠল অজানা আশঙ্কায়। তবু সাহসে ভর করে দরজায় চাপ দিলেন। ক্ষীণ প্রতিবাদে কাচক্যাচ সুরে খুলতে শুরু করল দরজা। খানিকটা খুলতেই দরজায় ফাঁক দিয়ে দেখতে চাইলেন, কিন্তু বিশেষ কিছুই তার নজরে পড়ল না। অতএব মনকে বোঝালেন শব্দটা অবাধ্য হঁদুরের। তারপর ফিরে এলেন শোওয়ার ঘরের দরজায় কাছে।

ঘরে ঢুকে প্রথমে যে অস্বাভাবিক ব্যাপারটা রমলা মল্লিকের নজরে পড়ল, অথবা বলা যায়, কানে এল–সেটা সুশান্ত মল্লিকের ভারী শ্বাস-প্রশ্বাসের অনুপস্থিতি। ঘরের প্রতিটি জিনিসই নিজের নিজের জায়গায় স্বাভাবিকভাবে দাঁড়িয়ে। এমনকী দেওয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে কান পর্যন্ত লেপ মুড়ি দিয়ে সুশান্ত মল্লিকও স্বাভাবিকভাবে শুয়ে আছেন।

হঠাৎ যেন গতি এবং সংবিৎ ফিরে পেলেন রমলাদেবী। দ্রুতপায়ে পৌঁছে গেলেন স্বামীর বিছানায় কাছে। ঝুঁকে পড়লেন খাটের ওপর। স্বামীর গায়ে হাত রেখে ধাক্কা দিলেন, ডাকলেন, ওগো, শুনছ? শিগগির ওঠো! সর্বনাশ হয়েছে।

কিন্তু বারবার ডেকেও কোনও সাড়া না পেয়ে রমলা মল্লিক অবাক হলেন। আর তখনই তার চোখ পড়ল স্বামীর মাথার দিকে। এবং অসঙ্গতিটা নজরে পড়ল।

তার হাতের ধাক্কায় স্বামীর শরীরটা নড়ছে ঠিকই, কিন্তু সেই অনুপাতে মাথাটা প্রায় নড়ছে না বললেই চলে।

বুকভরা আশঙ্কা নিয়ে এক ঝটকায় লেপটা তুলে নিলেন রমলাদেবী। এবং বুঝলেন, মাথাটা কেন ঠিকঠাক নড়ছিল না।

সুশান্ত মল্লিকের মাথা এবং শরীরের মাঝে প্রায় চার আঙুল পরিমাণ ফাঁক যেন হাঁ করে রমলা মল্লিককে গ্রাস করতে আসছে।

রক্তাক্ত বিছানা-বালিশের রং হঠাৎ যেন হলুদ ফুলে বদলে গেল রমলাদেবীর চোখের সামনে। তিনি টলে পড়লেন মেঝেতে।

হয়তো সেই কারণেই, সুশান্ত মল্লিকের খাটের নীচে রাখা ফল-কাটার ধারালো রক্তাক্ত বঁটিটা তাঁর নজরে পড়ল না।

.

রমলাদেবীর পড়ে যাওয়ার ভারী শব্দটাও তার কানে গেল। এর আগের ছোটখাটো শব্দগুলো তার কানে গেলেও মাথায় ঢোকেনি। শেষ শব্দটায় সে চমকে উঠল। সন্তর্পণে খুলে ফেলল ভাড়ার ঘরের দরজা। ডাইনে-বাঁয়ে একপলক করে তাকিয়ে কাউকে দেখতে না-পেয়ে এগিয়ে চলল সিঁড়ির দিকে।

ওপরে যাওয়ার এবং নীচে নামার সিঁড়ির মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে সে একটু যেন দ্বিধায় পড়ল। তারপর দ্বিধা কাটিয়ে সিদ্ধান্ত নিল এবং নীচে যাওয়ার সিঁড়ি বেয়ে নামতে শুরু করল।

নিঃশব্দ শব্দটা যেন তার পায়ের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। সুতরাং অবিচলিত ধীর পায়ে সে নেমে এল অফিস-ঘরের দরজার সামনে। চটিজোড়া আবার খুলে রাখল সিঁড়ির গোড়ায়। সামনেই বাথরুম। তার ভোলা দরজা দিয়ে চোখে পড়ছে ছড়িয়ে রাখা ভেজা কাপড়চোপড়, সাবান-জল ভরা বালতি, সব মিলিয়ে অসমাপ্ত কাজের ইশারা।

এবার তার মনোযোগ পড়ল অফিস-ঘরের দিকে।

 কিছুটা কৌতূহল কিছুটা আগ্রহ নিয়ে সে ভেতরে উঁকি মারল।

দেওয়ালের দিকে মুখ করে, তার দিকে পিছন ফিরে, টেলিফোন নিয়ে ধস্তাধস্তি করছে একটি মেয়ে-যুবতী।

হাসল সে। ফোনের তার তো সে আগেই কেটে দিয়েছে, তা হলে?

নীরবে মেয়েটির পিছনে গিয়ে থামল সে। চুপটি করে দাঁড়িয়ে ওর কাণ্ডকারখানা লক্ষ করতে লাগল। এবং নিঃশব্দে হাসতে লাগল।

ফোন রেখে ঘুরে দাঁড়াতেই মেয়েটি তার মুখোমুখি হল।

মুহূর্তের নীরবতা।

তার কালো পোশাক এবং সাদা হাসির পরস্পরবিরোধী চেহারায় মেয়েটির চোখজোড়া অবাক হল, বিস্ফারিত হল।

এবং কোনও শব্দ তৈরির আশায় নরম ঠোঁটজোড়া স্ফুরিত হতেই বিদ্যুতের মতো তার থাবা আছড়ে পড়ল মেয়েটির মুখে…।

রমলাদেবীর জ্ঞান ফিরলেও আচ্ছন্ন ভাবটা কাটতে বেশ সময় লাগল। তিনি কোথায়, কী করে, কেন? এইসব প্রশ্নের উত্তরগুলো ধীরে-ধীরে তার মনকে ভারী করে তুলল। মাথাটা দু-হাতে চেপে ধরে তিনি উঠে দাঁড়ালেন। নীরবে তাকালেন স্বামীর শরীরের দিকে। স্বামীর লেপে-ঢাকা দেহটা জড়িয়ে ধরে পাগলের মতো হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলেন। দু-চোখ জলে ঝাপসা হয়ে গেল, জ্বালা করতে লাগল।

কিছুক্ষণ পর নিজেকে সামলে নিয়ে কোনওরকমে উঠে দাঁড়ালেন। ইতস্তত তাকিয়ে ঝুঁকে পড়লেন খাটের নীচে, ফল-কাটার বঁটিটা টেনে নিতে গিয়ে থামলেন। কারণ, বঁটি রক্তে মাখামাখি। কিন্তু মনের দ্বিধা কাটিয়ে আস্থা-ভরা ডানহাতে তুলে নিলেন বঁটিটা। ঘরের চারপাশে চোখ বুলিয়ে চলে এলেন বসবার ঘরে। ভাঁড়ার ঘরের খোলা দরজা দেখে সচকিত হলেন। ঢুকে পড়লেন ভেতরে।

কেউ নেই।

বসবার ঘর ছেড়ে বেরোনোর সময় ফ্রিজের ওপর থেকে তালা এবং চাবিটা তুলে নিলেন। বঁটিটা মেঝেতে নামিয়ে রেখে দরজায় তালা দিলেন রমলাদেবী। চাবিটা কোমরে গুঁজে দোতলার বাকি দুটো ঘর, রান্নাঘর, বাথরুম, প্রতিটির দরজার কড়া সরু পাটের দড়ি দিয়ে বাঁধলেন। পাটের দড়ির বাকিটা ফেলে দিলেন বারান্দার একপাশে। তারপর মেঝে থেকে রক্তাক্ত বঁটিটা তুলে নিয়ে সিঁড়ির কাছে এসে দাঁড়ালেন।

দরজার কড়ায় দড়ি বাঁধার উদ্দেশ্য নিয়ে রমলাদেবীর মনে কোনওরকম ভুল ধারণা ছিল না। তিনি একমুহূর্তের জন্যও ভাবেননি, ওই হালকা দড়ি দিয়ে অদৃশ্য খুনিকে তিনি আটকে রাখতে পারবেন। তার উদ্দেশ্য ছিল, তার অজান্তে কেউ কোনও ঘরে ঢুকলে সেটা যেন তিনি বুঝতে পারেন। আর বসবার ঘরের দরজায় তালা দেওয়ার কারণ, সুশান্ত মল্লিকের শোওয়ার ঘরেই তাদের টাকা-পয়সা, গয়না-সম্পত্তি ইত্যাদি থাকে। অনুপ্রবেশকারী যদি কোনও চোর-ডাকাত হয় তা হলে সেগুলো যাতে তার হাতে না পড়ে সেইজন্যই এই সাবধান হওয়া।

সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে রমলাদেবী মনস্থির করতে কয়েক মুহূর্ত খরচ করলেন। তারপর গলা তুলে ডাকলেন, সুমু সুমুউউ!

বদ্ধ বাড়িতে তার ডাক কেঁপে-কেঁপে উঠতে লাগল।

দু-মিনিট অপেক্ষার পরও কোনও উত্তর পেলেন না। শুধুই নিস্তব্ধতা।

সুতরাং, এইবার সাততাড়াতাড়ি সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করলেন তিনি। লক্ষ্য অফিস ঘর। বাইরের পৃথিবী তখন তার কাছে লুপ্ত হয়ে গেছে। তা নইলে রমলাদেবী হয়তো শুনতে পেতেন প্রভা রায়গুপ্তের উৎকণ্ঠিত স্বর। তিনি তখন একনাগাড়ে রমলা মল্লিক এবং সুমনা মল্লিকের কুশল সম্পর্কে প্রশ্ন করে চলেছেন।

অফিস-ঘরে পৌঁছে ঘরের যা অবস্থা রমলাদেবীর নজরে পড়ল, তাতে ঘরটাকে অফিস ঘর ছাড়া আর সব কিছু বলা চলতে পারে। কাচের টেবিলের কাচ শতটুকরো, টেলিফোনটা পড়ে আছে মেঝেতে, খাতাপত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে এখানে-সেখানে পড়ে রয়েছে। একটা চেয়ার কাত হয়ে পড়ে আছে, আর সুমনা পড়ে রয়েছে উপুড় হয়ে। ওর বাঁকানের পাশে পড়ে আছে কালো টেলিফোন রিসিভারটা।

রমলাদেবী হাতের বঁটিটা একপাশে নামিয়ে রাখলেন। এগিয়ে গিয়ে সুমনার দেহের পাশে হাঁটুগেড়ে বসলেন। হাতের ধাক্কায় একমাত্র মেয়ের দেহটা চিত করে ফেললেন। বুঝলেন, ও আর বেঁচে নেই।

সুশান্ত মল্লিকের বেলায় রক্তপাতের যেমন ছড়াছড়ি ছিল এখানে তা নেই। টেলিফোনের কালো কর্ডটা সুমনার নরম গলায় আষ্টেপৃষ্টে জড়ানো। তার চাপে সুমনার চোখ দুটো ঠেলে বেরিয়ে এসেছে বাইরে, মুখের ভেতরে জিভের আর জায়গা হয়নি।

চাপা রাগে, আক্রোশে রমলাদেবীর বুকের ভেতরটা প্রচণ্ড এক বিস্ফোরণে যেন টুকরো টুকরো হয়ে গেল। সম্ভবত দোতলায় যে কয়েক মিনিট তিনি আচ্ছন্ন ছিলেন, সেই সময়ের মধ্যেই ঘটে গেছে অফিস-ঘরের তাণ্ডব। উঠে দাঁড়াতে গিয়েই নিজের ভুলটা বুঝতে পারলেন রমলাদেবী। তাই হাত বাড়ালেন বঁটিটার দিকে।

এবং দেখলেন বঁটিটা তার জায়গায় নেই!

সুতরাং ভুল শোধরানোর সময়টুকু তিনি পেলেন না।

পরমূহুর্তেই তার শরীরের ওঠার চেষ্টাকে থামিয়ে দিল ধারালো কোনও কিছুর অমানুষিক আঘাত…।

.

প্রভা রায়গুপ্ত এবার অধৈর্য হয়ে পড়লেন। অফিস-ঘরের সশব্দ-তাণ্ডব তাঁর শুনতে না পাওয়ার কারণ তিনি বাড়ির পিছন দিকের ছাদে নিজের এঁটো বাসনগুলো ধুয়ে রাখছিলেন। এবং প্রথমবার সুমনার চিৎকার তিনি যে শুনতে পাননি তার কারণ, তখন তিনি নিত্যকার নিয়মমাফিক খাওয়ার আগে সেই ছাদে দাঁড়িয়েই পাখিদের খাওয়াচ্ছিলেন। পাখিদের খাওয়ানো হলে তবে তিনি নিজে খেতে বসেন।

কিন্তু রমলাদেবীর শেষবারের চিল্কারে তিনি বিচলিত হয়েছেন, এবং বারবার ভ্রাতৃবধূ ও তার কন্যার নাম ধরে ডেকে উঠেছেন কিন্তু কোনও কাজ হয়নি। মানুষের বয়েস হলে স্বভাব একটু খুঁতখুঁতে হয়, এবং অল্পেতেই ভয় পেয়ে যায়। হয়তো সেই কারণেই, রমলাদেবী অথবা সুমনার কাছ থেকে কোনও উত্তর না পেয়ে তিনি বিরক্ত হয়ে বিছানা ছেড়ে উঠলেন।

শীতের দুপুরে জানলা-দরজা ভেজিয়ে কাঁথামুড়ি দিয়ে শোয়াটা প্রভাদেবীর পুরোনো অভ্যেস। প্রথমত, সেই অভ্যেস ভেঙে তাঁকে ঘরের বাইরে আসতে হল। তারপর নিরুপায় হয়েই তিনতলা থেকে তিনি নেমে আসতে লাগলেন দোতলায়।

দোতলায় এসে দাঁড়াতেই দুটো জিনিস তাকে ভীষণ অবাক করল।

এক, বসবার ঘরের দরজায় তালা দেওয়া, অন্যান্য ঘরগুলোর দরজার কড়া দড়ি দিয়ে বাঁধা।

দুই, অদ্ভুত অপার্থিব নীরবতা।

কিন্তু একটা আবিষ্কার তাঁর অবাক হওয়ার প্রথম কারণকে একটু কমজোরি করে দিল। বাথরুমের লাগোয়া ঘরের দরজার কড়ায় দড়ি বাঁধা নেই। কিন্তু ভোলা দড়িটা একটা কড়া থেকে ঝুলছে বলে সিঁড়ির কাছ থেকে তার মনে হয়েছিল দরজা বুঝি বন্ধ।

আরও অবাক হলেন প্রভাদেবী। রমলাদেবী এবং সুমনার নাম ধরে আরও দু-চারবার ডাকলেন। তার গলা ক্রমশ খাদে নেমে আসতে লাগল। একবার ভাবলেন, নীচটা দেখে আসি। সুতরাং বাথরুম, রান্নাঘর এবং সুমনার ঘরে দড়ি-বাঁধা দরজাগুলোর দিকে একপলক তাকিয়ে তিনি একতলার সিঁড়ি ভেঙে নামতে শুরু করলেন। তার হৃৎপিণ্ডের ধুকপুক শব্দটা কি ক্রমশ বেড়ে ওঠায় বুকের শব্দটা জোরালো ঠেকছে?

সিঁড়ির শেষ ধাপে পৌঁছে প্রায় একইসঙ্গে তিনটে জিনিসের ওপর প্রভাদেবীর নজর পড়ল।

 বাথরুমের খোলা দরজা।

অফিস-ঘরের খোলা দরজা।

 এবং একজোড়া চটি…।

চটচটে বঁটিটা নামিয়ে সে ক্লান্ত দেহ নিয়ে বসল মাটিতে। দেখল একপলক নিজের তৈরি ধ্বংসস্তূপের দিকে।

এখন শীতকাল সুতরাং শীত করার কথা। কিন্তু তার শরীরে যেন অসহ্য জ্বালা। সেই জ্বালা মাকড়সা-হুল ছড়িয়ে দিয়েছে তার ওলটপালট মগজে।

জটপাকানো অন্ধ মস্তিষ্কে সুষম চিন্তা করতে চেষ্টা করল সে। ভাবতে চেষ্টা করল, সে কোথায়। এখানে এল কী করে? মেঝেতে শুয়ে আছে এরাই-বা কারা? কই, এদের কখনও দেখেছে বলে তো মনে পড়ছে না!

বেশ কিছুক্ষণ চিন্তাভাবনার পর সে সিদ্ধান্তে এল, না, এদের কাউকেই সে চেনে না, এই বাড়িটাও তার অচেনা, এমনকী এই পৃথিবীটাও তার অচেনা। একমাত্র চেনা-পরিচিত যে ছিল, ও আজ কোথায়! সে খুঁজে বেড়াচ্ছিল ওকে। আর তখনই এই পৃথিবী তাকে বাধা দিয়েছে। গলা টিপে শেষ করেছে তার ইচ্ছে-কে। আর, এক ইচ্ছে-কে শেষ করতে গিয়ে দম বন্ধ হয়ে মারা গেছে ওদের দ্বিতীয় ইচ্ছে–যে ইচ্ছে ওদের মনের মাঝে ছিল। ওরা যখন তার সব ইচ্ছে শেষ করে দিচ্ছিল, তখন ওদের বাধা দিতে গিয়ে রুখতে গিয়ে মাথার ভেতরে ঘটে গেছে ভিসুভিয়াসের বিস্ফোরণ। তারপর?…তার পরের ইতিহাসে আছে সাদা ধবধবে চার দেওয়াল, দৈহিক অত্যাচার, ইলেকট্রিক শক, কালো ফ্রেমের চশমা, সাদা পোশাক, আর স্টেথোস্কোপ। অবশেষে খুঁজে পাওয়া গেছে মুক্ত খোলা আকাশ, নীরব সুন্দর চাঁদ, আর মুখর তারা।

সুদীর্ঘ পথ চলার ক্লান্তি সে কাটিয়ে উঠেছে। তারপর এসে পৌঁছেছে এইখানে, একশো দুশমনের মাঝখানে। এখন এই শত্রুহীন মুহূর্তে নিজেকে আর-একবার ক্লান্ত বলে মনে হল। অবসাদ যেন বরফ-ঠান্ডা আস্তরে তার মনকে জড়িয়ে রেখেছে। দু-চোখ যেন চাইছে বুজে আসতে। আ–! বড় হাঁ করে শ্বাস নিল সে।

তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বেরিয়ে এল ঘর ছেড়ে। ঢিলে পায়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে শুরু করল দোতলায়। দোতলায় এসে অবাক হয়ে লক্ষ করল, সামনের দরজাটায় তালা দেওয়া। সুতরাং ডানদিকে এগোল সে। কী খেয়ালবশে থামল গিয়ে শেষপ্রান্তে, খাওয়ার ঘরের দরজায়। কড়ায় বাঁধা দড়িটা খুলে ঢুকে পড়ল ঘরের ভেতরে। দরজা ভেজিয়ে দিল। সামনের টেবিলে রাখা জলের গেলাস দেখে তেষ্টা পেল তার। সুতরাং জল ভরতি গেলাসটা তুলে ঠোঁটে ঠেকাল–।

এবং সেই মুহূর্তে এক হৃদয়বিদারী তীক্ষ্ণ চিৎকারে তার হৃৎপিণ্ড যেন হোঁচট খেল।

থামল না সেই চিৎকার। বিভিন্ন লয়ে বিভিন্ন পরদায় কাটা রেকর্ডের মতো বেজেই চলল।

একরাশ বিরক্তি আর ঘৃণা নিয়ে পিছন ফিরে ঘরের দরজার দিকে তাকাল সে। দেখল চিৎকারের উৎস।

.

অফিস-ঘরের দরজায় চৌকাঠে দাঁড়িয়ে ভেতরের দৃশ্যটা সম্পূর্ণ দেখতে বিন্দুমাত্র অসুবিধে হয়নি প্রভাদেবীর। বরং ঘরের দুজন যে মৃত সেটা বুঝতেই তাঁর সময় লাগল।

হতভম্ব প্রভাদেবীর সমস্ত মন যেন জমাট বেঁধে গেল সেই মুহূর্তে। অবস্থাটা ভালো করে যাচাই করার জন্য আলো জ্বাললেন তিনি। এবারে আরও স্পষ্টভাবে সবকিছু তার নজরে পড়ল।

সুমনা, রক্তমাখা বঁটি–যেটা এখন অচেনা লাগছে, এবং রমলার ধ্বংসাবশেষ।

পাকস্থলীর বিপরীত প্রতিক্রিয়ায় প্রভাদেবীর শরীরটা কেঁপে উঠল। গা গুলিয়ে উঠল। পেট চেপে ধরে উপুড় হয়ে বমি করতে লাগলেন তিনি। শরীরের প্রচণ্ড কাঁপুনি যেন কিছুতেই আর থামতে চাইছে না।

কিছুক্ষণ পর জল-ভরা লাল চোখে কাঁদতে কাঁদতে অফিস-ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলেন তিনি। দরজাটা ভেজিয়ে দিলেন।

এবং তখনই নজরে পড়ল অচেনা চটিজোড়া।

সুতরাং এবারে কৌতূহল হয়ে উঠল প্রবল। প্রভাদেবী আবার ফিরে চললেন। দোতলায়।

প্রথমে দেখতে চাইলেন সুশান্তর শোওয়ার ঘর। বসবার ঘরের ভেতর দিয়ে সুশান্তর শোওয়ার ঘরে যেতে হয়। দেখলেন, সেই দরজায় তালা। তা হলে কি সুশান্ত বাড়িতে নেই? কিন্তু না, এই তো ওর চটি, জুতো–দু-জোড়াই এখানে রয়েছে।

দোতলায় উঠেই সামনের অংশটুকু জুতো রাখার জায়গা হিসেবে ব্যবহার হয়। সেখানে শুধু সুশান্ত মল্লিক কেন, বাড়ির সকলের চটি এবং জুতোই রয়েছে।

আচ্ছন্ন প্রভাদেবী এগিয়ে চললেন খাওয়ার ঘরের দরজার দিকে। কারণ, একমাত্র ওটার দরজাই বাইরে থেকে ভোলা। সাধারণত আমিষাশীদের খাওয়ার ঘরে তিনি কখনওই পা দেন না, কিন্তু এই সংকট-মুহূর্তে সব নিয়মই ভাঙা যায়।

ভেজানো দরজার সামনে দাঁড়িয়ে একমুহূর্ত ঠাকুরের নাম বিড়বিড় করে উচ্চারণ করলেন প্রভাদেবী। তারপর হাতের চাপে খুলে ফেললেন খাওয়ার ঘরের ভেজানো দরজা।

সঙ্গে-সঙ্গেই সমস্ত ঘটনার কার্যকারণ তার বোধগম্য হল। বুঝলেন, তাঁর সামনে দাঁড়ানো এই একজনের উপস্থিতির ফলে, তার সমস্ত আত্মীয় এখন অনুপস্থিত। মরতে ভয় পান না প্রভাদেবী। কিন্তু তবুও কেন জানি না তার গলা চিরে বেরিয়ে এল এক অদ্ভুত চিৎকার। থামল না–বিভিন্ন লয়ে, বিভিন্ন পরদায় বেজেই চলল–

আর সেই মুহূর্তেই তার দিকে ঘুরে দাঁড়াল কালো পোশাক পরা লোকটা…।

.

যে তার ঘৃণাভরা চোখে, তেষ্টাভরা বুক নিয়ে, তাকাল তিন কাল গিয়ে এক কালে ঠেকা বিধবা মেয়েছেলেটার দিকে। হঠাৎই জমাট আক্রোশ ফেটে পড়ল তার দু-চোখে। জলের গ্লাসটা ঠোঁটের কাছ থেকে নামিয়ে রেখে ঘুরে দাঁড়াল সে। কালো হাতায় ঢাকা দুটো হাত সামনে বাড়িয়ে দরজা লক্ষ্য করে তিরবেগে ছুটল। বিধবা বুড়িটার চিৎকার তখনও তার কানে দামামা বাজিয়ে চলেছে।

মুহূর্তের মধ্যে কী ঘটে গেল, শূন্যে উঠল সাদা থান পরা শরীরটা। কালো দুটো হাতের এক ঝটকায় বারান্দার রেলিঙের আওতা ছাড়িয়ে একেবারে যেন উড়ে গেল বাইরে বাড়ির বাইরে। তার অন্তিম আর্তনাদটুকুর সাক্ষী রইল বাইরের ঘন নীল আকাশ, সোনালি রোদ্দুর, আর ধূসর প্রান্তর।

হতভম্বের মতো কয়েকমুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইল সে। বারকয়েক আক্ষেপে মাথা নাড়ল। তারপর পা বাড়াল বসবার ঘরের দিকে।

তালাবন্ধ দরজায় পৌঁছে চিন্তা করল কিছুক্ষণ। তারপর ফিরে চলল অফিস-ঘরের দিকে।

সেখানে পড়ে থাকা বিধ্বস্ত, রক্তাক্ত মহিলার শরীর হাতড়ে চাবিটা একসময় পেল সে। সুতরাং আবার উঠতে শুরু করল সিঁড়ি বেয়ে।

তালা খুলে বসবার ঘরে ঢুকে সোফায় কিছুক্ষণ সে বসল। নতুন করে ক্লান্তি অনুভব করল। তাই সোফায় গা এগিয়ে দিল।

ঘুমে যখন তার চোখ দুটো বুজে এসেছে তখন বসবার ঘরের দেওয়াল-ঘড়িতে তিনটের সঙ্কেত বাজল, ঢং-ঢং-ঢং…।

এবার আমরা সেই অনুপস্থিত, এ পর্যন্ত অপাংক্তেয়, মানুষটির প্রসঙ্গে আসব। বয়েস তার তেরো। ক্লাস এইটের মেধাবী ছাত্র। বাড়ির ছনম্বর বাসিন্দা। সুশান্ত মল্লিকের একমাত্র ছেলে সুকান্ত মল্লিক। রোজকার মতো স্কুলেই গিয়েছিল ও। ফিরছে এখন, পাঁচটার সময়। শীতের বেলা, তাই আঁধার নেমে এসেছে। কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ নিয়ে রোজকার মতো দুলকি চালে মেঠো পথ ধরে হেঁটে বাড়ির দিকে আসছে। ও ওই দেখুন, বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে কলিংবেল টিপছে ছেলেটা, হা, রোজকার মতো। কিন্তু ও জানে না, রোজকার মতো নয় এমন কিছু একটা জিনিস এখন ওদের বাড়িতে রয়েছে।

সময়ের ঘড়িতে এখন পাঁচটা। স্কুলের ছুটি হয় সাড়ে চারটেয়। কিন্তু বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে গল্পগুজব করে দশ-পনেরো মিনিটের পায়ে-হাঁটা পথ পেরিয়ে আসতে কিছুক্ষণ সময় লাগে বইকি!

বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে পরপর দুবার অবাক হল সুকান্ত, এবং একবার আশ্বস্ত হল। প্রথম অবাক : দোতলার বাবার ঘরের আলো, যা রোজই জ্বলে, আজ জ্বলছে না।

দ্বিতীয় অবাকঃ বাড়ির সদর দরজা বন্ধ, অন্যদিন যা ভেজানো থাকে। এ ছাড়া দরজার মাথায় বসানো আলোটা আজ নেভাননা রয়েছে সুতরাং ব্যতিক্রম।

আশ্বস্ত হওয়ার কারণ, রোজকার মতো একতলায় অফিস-ঘরের আলো জ্বলছে।

কলিংবেলে আঙুলের চাপ দিল সুকান্ত। পরিচিত বাজার এর কড়কড় শব্দ জোরালোভাবেই ওর কানে এল। কিন্তু কোনও উত্তর নেই।

কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আবার বেল বাজাল ও। কিন্তু কেউই কলিংবেলের ডাকে সাড়া দিল না।

ভয় পেল সুকান্ত। দু-হাতে পাগলের মতো পিটতে শুরু করল সদর দরজা। কিন্তু কোনও ফল হল না।

তখন ও চেঁচিয়ে ডাকতে শুরু করল, মামা! দিদি দিদি!

উত্তর নেই। তা হলে কি বাড়িতে কেউ নেই? উঁহু, তা সম্ভব নয়। কারণ, সদর দরজা ভেতর থেকে ছিটকিনি দেওয়া। সুতরাং দ্বিতীয় পথের সন্ধানে অন্ধকারের মধ্যে বাড়ির ডানদিকের দেওয়াল ঘেঁষে এগিয়ে চলল সুকান্ত। ফুলবাগানের নরম মাটিতে পা ফেলে এক জায়গায় এসে থামল। কাধ থেকে নামিয়ে রাখল বইয়ের ঝোলানো ব্যাগটা। তারপর বহুবছরের অভ্যাসে পাঁচিলের গায়ে পা দিয়ে বেয়ে উঠতে চেষ্টা করল। এই পাঁচিল ডিঙিয়ে বাড়ির ভেতরে আগেও অনেকবার ঢুকেছে ও। এখন এ ছাড়া দ্বিতীয় কোনও পথ ওর কাছে ভোলা নেই।

পাঁচিল ডিঙিয়ে একলাফে ভেতরের ছোট্ট উঠোনে পড়ল। জায়গাটা ভীষণ অন্ধকার। শুধু সামনে অফিস-ঘরের ভেজানো দরজার ফাঁক দিয়ে ভেসে আসছে একটুকরো আলোর রেশ।

সেদিকে না গিয়ে প্রথমে সদর দরজার দিকে এগোল সুকান্ত। উদ্দেশ্য দরজার ছিটকিনি খোলা।

কিন্তু ওর ইচ্ছেয় বাদ সাধল অবিনাশের মৃতদেহ। অবিনাশের দেহের ওপরে হোঁচট খেয়ে পড়ল ও। অন্ধকারে কিছু নজরে আসে না। তাই হাতড়ে হাতড়ে দেওয়ালের গায়ে বসানো আলোর সুইচ টিপল।

আলো জ্বালতেই গোটা দৃশ্যের বীভৎসতা ওর মুখে-চোখে আছড়ে পড়ল। ঘাড় মুচড়ে পড়ে আছে অবিনাশ। কালচে রক্তের ছোপ সর্বাঙ্গে, মেঝেতে, এমনকী সাদা দেওয়ালের গায়েও ছিটেফোঁটা নজরে পড়ছে।

অস্ফুট এক শব্দ করে ডুকরে কেঁদে উঠল সুকান্ত। ওর ছোট্ট বুকটা নিঃশব্দে ফুলে-ফুলে উঠতে লাগল। স্বপ্নাচ্ছন্নের মতো ও হাঁটতে শুরু করল অফিস-ঘরের দিকে। ও যেন বোবা হয়ে গেছে। শুধু ভেতরের প্রচণ্ড আবেগে ওর শরীরটা কেঁপে-কেঁপে উঠছে।

অফিস-ঘরে পৌঁছে ভেজানো দরজায় হাতের চাপ দিল। ধীরে-ধীরে খুলে গেল নরকের দরজা।

পরের পাঁচমিনিট ও পাথর হয়ে গেল। আর সেই অবস্থাতেই তাকিয়ে দেখল সবকিছু।

সে-দৃশ্যের অভিঘাত বুঝি বৃদ্ধ, যুবক, শিশু বিচার করে না। সুতরাং নির্বাক, স্তম্ভিত সুকান্ত টলোমলো পায়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে শুরু করল।

মা-কে এবং দিদিকে ও পরনের শাড়ি দেখেই চিনতে পেরেছে, চিনতে পেরেছে ফল কাটার বঁটিটাও। তবে অন্যমনস্ক থাকায় সিঁড়ির গোড়ায় রাখা চটিজোড়া ওর নজরে পড়ল না।

দোতলায় পৌঁছে শুধুমাত্র বসবার ঘরেই যে আলো জ্বলছে সেটা ওর চোখে পড়ল। এবং পুরোপুরি অবাক হয়ে ওঠার আগেই দপ করে জ্বলে উঠল ডান প্রান্তে খাওয়ার ঘরের আলোটা।

সুকান্ত প্রথমে উঁকি মারল বসবার ঘরে। কেউ নেই।

 চাপা স্বরে ডেকে উঠল, বাবা– বাবা!

 উত্তর নেই।

তখন স্কুলের জামা-জুতো পরেই ও এগিয়ে চলল খাওয়ার ঘরের দিকে।

ঘরে ঢুকেই দেখল, কালো পোশাক পরা একজন অপরিচিত লোক ওর দিকে পিছন ফিরে বসে কী যেন খাচ্ছে। গলার স্বর ভারিক্কি করে ও বলে উঠল, তুমি কে?

তড়িৎস্পৃষ্টের মতো চমকে উঠল লোকটা। বিদ্যুৎগতিতে চেয়ার ঠেলে ঘুরে দাঁড়াল।

তুমি এখানে কী করছ? আমার মা-কে, দিদিকে, অবিনাশদাকে মারল কে? তুমি?

অত্যন্ত সরল প্রশ্ন। এবং তার উত্তর ঠিক ততটাই জটিল ঠেকল লোকটার কাছে। কিছুক্ষণ নীরব থেকে হাসল সে। পকেটে হাত ঢুকিয়ে বের করে নিল ইস্পাতের ছুরিটা।

ইতিহাসের পুনরাবৃত্তির নিয়ম অনুযায়ী এই মুহূর্তে সুকান্তর আতঙ্কে নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার কথা, কিন্তু বাস্তবে ঠিক বিপরীতটাই ঘটল। ঘুরে দাঁড়িয়ে বসবার ঘর লক্ষ্য করে তিরবেগে ছুটতে শুরু করল ও।

একলাথিতে চেয়ারটা মেঝেতে ছিটকে ফেলে লোকটা ওকে তাড়া করল। অনেকক্ষণ বাদে তার মুখে-চোখে জিঘাংসার পুরোনো রেখাগুলো স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠল।

অন্ধকার বারান্দার দৈর্ঘ্য পেরিয়ে দড়াম করে বসবার ঘরের আধ-ভেজানো দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে পড়ল সুকান্ত। চকিতে দরজা বন্ধ করে ভেতর থেকে খিল এঁটে দিল। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই দরজার ওপাশে লোকটার শরীর এসে আছড়ে পড়ল প্রচণ্ড শব্দে। গোটা বাড়িটা যেন সন্ত্রস্তভাবে কেঁপে উঠল।

পরের কয়েক সেকেন্ডে সুকান্ত ওর ভাবনা-চিন্তার কাজ শেষ করল। ও জানে, এই নির্জন লোকালয়ে, এই শীতের সন্ধ্যায়, সাহায্য আশা করা উদ্ভট কল্পনা। সুতরাং ওর এখন দরকার একটা নিখুঁত লুকোনোর জায়গা, কারণ, দরজার ওপিঠে রাগী চিতাবাঘের মতো প্রচণ্ড শক্তিতে দরজায় ধাক্কা দিয়ে চলেছে লোকটা। কাঠের খিল কতক্ষণ এ-অত্যাচার সইতে পারবে কে জানে!

কী ভেবে বসবার ঘরে ছেড়ে শোওয়ার ঘরে ঢুকল সুকান্ত।

ঘর অন্ধকার।

কিন্তু বহুবছরের চেনা ম্যাপে অন্ধকার কোনও বাধা নয়। তা ছাড়া এখন আলো জ্বালারও সময় নেই। দরজা পেটানোর দুদ্দাড় শব্দ কামানের বিস্ফোরণের মতো কানে এসে ঠেকছে। সুতরাং তড়িৎগতিতে ডানদিকের দেওয়ালে গাঁথা তাকের কাছে গেল সুকান্ত। তাকে রাখা টর্চলাইটের ধাতব শরীর অন্ধকারেও ঝিলিক মারছিল। সেটা হাতে করে বসবার ঘরে ফিরে এল ও। রেফ্রিজারেটরের মাথায় কয়েকটা চুলের কাটা ছিল–এখানে মা-দিদি যে এগুলো রাখে তা ওর বহুদিনের জানা। সেখান থেকে একটা কাটা নিয়ে সুইচবোর্ডের প্লাগ পয়েন্টে দুটো মাথা গুঁজে দিল। তারপর প্লাগ পয়েন্টের সুইন অন করে দিল।

একটা চাপা শব্দের সঙ্গে-সঙ্গে গোটা বাড়িটার সমস্ত আলো নিভে গেল। আর সুকান্তের হাতে টর্চের আলো জ্বলে উঠল। ও জানে কীভাবে বাড়ির সমস্ত আলো ফিউজ করতে হয়। আগেও একদিন করেছিল।

এবার ও ঢুকল ভাঁড়ার ঘরে। আলমারির পাশে রাখা কাঠের মইটা বেয়ে ওপরে উঠল। কাঠের সিলিংয়ের চৌকো অংশটায় জোর চাপ দিতেই ডালাটা ভেতরে ঢুকে গেল, আর ওপরের কুঠরি-ঘরে ঢুকে পড়ল সুকান্ত।

এই ছোট্ট কাঠের কার-এ ওদের চাল-গম-সরষের বস্তা থাকে। থাকে মুড়ি-চিঁড়ের সঞ্চয়। সুতরাং ইঁদুর-আরশোলার উপদ্রবও আছে। জ্বলন্ত টর্চটাকে একপাশে নামিয়ে রেখে, ছোট্ট দুহাতে মইটাকে টেনে ওপরে তুলতে লাগল ওযাতে আর কেউ এই মই বেয়ে ওপরে উঠতে না পারে।

অতি কষ্টে, একরাশ ধুলো মেখে, মিনিটপাঁচেক পর ও সফল হল। মইটা অদ্ভুতভাবে কিছুটা ভেতরে কিছুটা বাইরে অবস্থায় আটকে রইল।

সুকান্তের সামনে-পিছনে ধুলোমাখা বস্তা আর থলে। টর্চের আলোর চোখে পড়ছে হলুদ আর শুকনো লঙ্কার ঠোঙা। এবং ওর সাধের হামানদিস্তে। প্রতি বছর বিশ্বকর্মা পুজোর সময় সে হামানদিস্তে দিয়ে কাচ গুঁড়ো করে সুতোয় মাঞ্জা দেয়।

নিজের শরীরটাকে যতটা সম্ভব ভেতরে ঢুকিয়ে ও চুপটি করে বসল। নিভিয়ে দিল টর্চের আলো।

চারদিক নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে ডুবে যেতেই দরজা ধাক্কানোর শব্দটা বিকটভাবে কানে এসে বাজল। সুকান্ত শুনল, প্রতিবাদে-প্রতিবাদে ক্লান্ত কাঠের খিলের ক্ষীণ মচমচ শব্দ। ও বুঝল, বসবার ঘরের দরজা ভাঙতে আর দেরি নেই। কিন্তু বাবা, পিসিমণি–ওরা কি এ-শব্দ শুনতে পাচ্ছে না? শুনতে যদি পেয়ে থাকে তা হলে ছুটে আসছে না কেন?..তা হলে কি ওদের অবস্থাও মা-দিদি অবিনাশদার মতো?

হঠাৎ সুকান্তর মনে পড়ল, টর্চটা নিতে শোওয়ার ঘরে ঢুকবার সময় একটা বিশ্রী আঁশটে দুর্গন্ধ নাকে এসে ঝাপটা মেরেছিল। ও ফিশফিশ করে ডেকে উঠল, বাবা বাবা।

.

এক সময়, এক চূড়ান্ত মুহূর্তে, ভেঙে পড়ল শেষ প্রতিরোধ, বসবার ঘরের দরজা।

লাথি মেরে কাত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা পাল্লাটা মেঝেতে শুইয়ে দিয়ে ঘরে ঢুকল সে।

সামনে অন্ধকার, পিছনেও অন্ধকার। আর সেই অন্ধকারে মাঝে-মাঝে ঝলসে উঠছে তার হাতের ইস্পাতের ছুরিটা। অন্ধকারে তার কালো পোশাক মিশে গেছে।

প্রথম কয়েক সেকেন্ড সে নিঃসাড়ে দাঁড়িয়ে রইল। শুনতে চেষ্টা করল কারও শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ। তারপর ধীর পায়ে এগোল শোওয়ার ঘরের দিকে।

এখানেও যথারীতি অন্ধকার। নজর চলে না। সুতরাং পকেট হাতড়ে একটা সস্তার লাইটার বের করল সে। চাবি টিপতেই একটা নীলচে আলোর শিখা লাফিয়ে উঠল। ডানহাতে লাইটার উঁচিয়ে ধরল সে। ক্ষীণ আলোর বিছানায় লেপমুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকা মৃতদেহটা আবছাভাবে চোখে পড়ল। নীচু হয়ে খাটের তলাটা দেখল সে। না, কেউই সেখানে লুকিয়ে নেই। এবং তার পরই শুরু হল তার তন্নতন্ন অনুসন্ধান পর্ব।

শোওয়ার ঘর পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে খুঁজে দেখার পর সে ফিরে এল বসবার ঘরে। ইস্পাতের ছুরিটা পকেটে রেখে শোওয়ার ঘর এবং বসবার ঘরের মাঝের দরজাটা বন্ধ করল। বসবার ঘর থেকে এক গাছা দড়ি বের করে শক্ত হাতে বাঁধল দরজায় কড়া দুটো। পকেট থেকে লাইটার বের করে জ্বালল আবার। কী এক অজানা প্রতিজ্ঞায় তার চোয়াল আরও কঠিন হয়ে উঠেছে। এবার ছুরিটা বের করে বাঁ-হাতে উঁচিয়ে ধরল সে।

শোওয়ার ঘর শেষ করে এবার বসবার ঘরের পালা।

প্রথমে সোফাসেটগুলোকে টেনে এনে ভাঙা দরজার মুখে স্তূপাকারে রাখল সে। উদ্দেশ্য জলের মতোই সরল : যাতে কেউ আচমকা দরজা ডিঙিয়ে পালাতে না পারে।

বসবার ঘরে আঁতিপাঁতি করে খুঁজেও কাউকে পাওয়া গেল না। সুতরাং সে নিশ্চিত হল, বাচ্চাটা ভঁড়ার ঘরে ঢুকেছে।

বুকভরা ভারী শ্বাস নিয়ে জ্বলন্ত লাইটার হাতে ভঁড়ার ঘরে ঢুকল সে। ডানদিকে বাঁ-দিকে তাকাল। তাকাতেই ওই ছোট ঘরটায় যে-বিশাল পরিবর্তনটা তার নজরে পড়ল তা হল সবুজ কাঠের মইটা। ওটার ওপরের দিকটা ঢুকে গেছে কুঠরি-ঘরের ভেতরে। আর বাকি অংশটা বেরিয়ে আছে। বাইরে। নির্ঘাত কুঠরি-ঘরে ঢুকেছে ছেলেটা। ছুরি উঁচিয়ে ওপরে তাকাতেই একইসঙ্গে মইয়ের শেষটুকু আর বাচ্চাটার জ্বলন্ত চোখে তার চোখ পড়ল। একমুহূর্ত দুই প্রতিদ্বন্দ্বী স্থির হয়ে রইল। তারপর…।

.

সুকান্ত চারপাশের শব্দ শোনার জন্য কান খাড়া করে রেখেছিল। শুধুমাত্র শব্দ শুনেই পাশের ঘরের কাজকর্মের হদিস পাচ্ছিল ও। অবশেষে, যখন লাইটারের আলোটা ভঁড়ার ঘরের দরজায় এসে থামল, তখন ও ভয় পেল। শরীরটাকে আরও ভিতরে গুটিয়ে নিল।

কিছুক্ষণ নিস্তব্ধতার পর কৌতূহলে নীচের দিকে একবার উঁকি মারল।

এবং সঙ্গে সঙ্গেই কালো জামা পরা লোকটার সঙ্গে ওর চোখাচোখি হল। ত্রাসে পিছিয়ে আসার আগেই ও শুনতে পেল এক অদ্ভুত জান্তব চিৎকার। সে-চিৎকারে ফেটে পড়ল জয়ের উল্লাস। পরমুহূর্তেই নীচের কালো চেহারাটা শূন্যে লাফিয়ে উঠল। ইস্পাতের বিদ্যুৎ খেলে গেল সুকান্তর চোখের সামনে। ঝটিতি মুখ সরিয়ে নিল ও। লোকটার ছুরির ফলা হাওয়ায় শিস কেটে ফিরে গেল নীচে।

এবার অবাক হয়ে সুকান্ত লক্ষ করল, লোকটা ছুরিটার গায়ে চাপ দিয়ে ভাঁজ করে ওটা পকেটে ঢুকিয়ে রাখছে। তারপর খানিকটা বেরিয়ে থাকা মইটা লক্ষ্য করে আচমকা লাফ দিল সে। ভয়ে চমকে পেছোতে যেতেই হামানদিস্তের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল সুকান্ত। অন্ধকারে অনুভব করল ভিজের ডগায় নোনতা স্বাদ। একটা ঘড়ঘড় শব্দ করে ওর গায়ে গা ঘষে কাঠের মইটা অদৃশ্য হয়ে গেল। সেই শব্দে সুকান্তর সংঘর্ষের শব্দটা চাপা পড়ে গেল।

একমিনিট…দু-মিনিট…।

সুকান্ত বুঝল, দেওয়ালের গায়ে মই লাগিয়ে, নিজেকে তৈরি করে, ওপরে উঠতে শুরু করেছে লোকটা। একটু পরেই চৌকো কাঠের ফোকরের ভেতরে জেগে উঠল কালো মাথাটা। জুলজুলে চোখজোড়া নিচ্ছিদ্র অন্ধকারের মাঝে ওকে খুঁজে বেড়াচ্ছে।

লোকটা জ্বলন্ত লাইটার ধরা হাতটা ওপরে তুলে ধরতে গেল। আর সেইমুহূর্তেই এক অমানুষিক শক্তি সুকান্তর শরীরে ভর করল। হামানদিস্তের মোটা লোহার রডটা দিয়ে দু-হাতে সর্বশক্তি দিয়ে ও লোকটার মাথায় আঘাত করল। একবার, দুবার…।

ধীরে-ধীরে মইয়ের গা থেকে ঢলে পড়তে লাগল লোকটা। মইটা কাত হয়ে গিয়ে ঠেকল দেওয়ালের কোণে, আর লোকটার শরীর শানবাঁধানো মেঝেতে সশব্দে আছড়ে পড়ল। জ্বলন্ত লাইটারটা নিভে গিয়ে কোথায় যেন ঠিকরে পড়ল।

কুঠরি-ঘরের ফোকর দিয়ে টর্চের আলোর সুকান্ত দেখল, ঠিক নীচেই শ্লথ ভঙ্গিতে পড়ে রয়েছে লোকটা।

টর্চটাকে জ্বলন্ত অবস্থায় পাশে নামিয়ে রেখে দু-হাতে গোটা হামানদিস্তেটা তুলে ধরল ও। তারপর, গুলি খেলায় যেরকম নান্ধু করে, সেরকম ভঙ্গিতে লোকটার মাথা লক্ষ করে ছুঁড়ে দিল হামানদিস্তেটা।

লোকটার মাথার সঙ্গে পাঁচ কেজি ওজনের লোহার সংঘর্ষের শব্দটা তেমন জোরদার হল না। ফট করে একটা শব্দ হল শুধু।

জ্বলন্ত টর্চটা হাতে নিয়ে একটা পা আলমারির গায়ে দিয়ে, অন্য পা-টা হেলে যাওয়া মইয়ের গায়ে রেখে অতি কষ্টে মেঝেতে নেমে এল সুকান্ত। টর্চের আলোয় দেখল, লোকটার কালো পোশাকের সঙ্গে রক্তাক্ত মুখটা নিতান্তই বেমানান লাগছে। আর হামানদিস্তের দুটো অংশ পড়ে রয়েছে দু পাশে।

অত্যন্ত গম্ভীরভাবে সুকান্ত লোকটার শরীর ডিঙিয়ে হামানদিস্তের রডটা তুলে নিল। তারপর কী ভেবে নিভিয়ে দিল টর্চটা। এবং লোকটার মাথা আন্দাজ করে রড দিয়ে পাগলের মতো আঘাত করে চলল–একবার, দুবার…।

জ্ঞানশূন্য মিনিট পাঁচেকের পর থামল সুকান্ত। রডটা নামিয়ে রেখে টর্চটা জ্বালল। তারপর জ্বলন্ত টর্চটা মেঝেতে নামিয়ে রেখে লোকটার পা দুটো দু-হাতে চেপে ধরল। অনেক কসরৎ করে পা দুটোকে টেনে নিয়ে এল ভঁড়ার ঘরের দরজার বাইরে। আর শরীরের সমস্ত ক্ষমতা একজোট করে লোকটাকে টেনে নিয়ে এল বসবার ঘরে। সেখানে তাকে শুইয়ে রেখে ও আবার ভাড়ার ঘরে ঢুকল। পড়ে থাকা টর্চের আলোয় দেখতে পেল লাইটারটা। লাইটার আর টর্চটা তুলে নিয়ে ফিরে এল বসবার ঘরে। লাইটারটা পকেটে রেখে শোওয়ার ঘরের দরজায় বাঁধা রেশমি দড়িটা খুলতে চেষ্টা করল। কিছুক্ষণের চেষ্টায় নিরাশ হয়ে ও লোকটার শুয়ে থাকা শরীরের পকেট হাতড়ে ছুরিটা বের করল। চাবি টিপতেই ফাটা লাফ দিয়ে বেরিয়ে এল বাইরে। এরপর শোওয়ার ঘরের দরজা খোলা কয়েক সেকেন্ডের কাজ। সুতরাং…।

বাবার শরীর এবং মাথাকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় আবিষ্কার করেও বিচলিত হল না সুকান্ত। কারণ, ইতিমধ্যেই ও সবরকম ভাব এবং আবেগ নিঃশেষে খরচ করে বসে আছে। শুধু শ্লথ পায়ে ও ফিরে এল বসবার ঘরে। আধঘণ্টার চেষ্টায় অনেক টানাটানি করে ও সরিয়ে ফেলল সোফাসেটগুলো। তারপর ভাঙা দরজা পেরিয়ে টর্চ জ্বেলে রওনা হল তিনতলার দিকে। এখন ও খুঁজতে চলেছে পিসিকে।

তিনতলা, দোতলা, একতলায় খোঁজ করেও পিসিকে পেল না ও। তাই ফিরে এল বসবার ঘরে। কালো-পোশাকি লোকটার গায়ে টর্চের আলো ফেলে কী চিন্তা করল। তার পর ফিরে চলল খাওয়ার ঘরের দিকে।

বারান্দার বাঁ-কোণে খাওয়ার ঘরের দরজার ঠিক মুখেই থাকে কেরোসিন তেলের টিনটা। সেটাকে একহাতে নিয়ে অন্য হাতে টর্চ জ্বেলে বসবার ঘরে ফিরে এল। টর্চটাকে জুলন্ত অবস্থায় একটা সোফার ওপরে রেখে কেরোসিন তেলের টিনটা লোকটার গায়ে উপুড় করে দিল।

একটু পরে খালি টিনটা একপাশে ছুঁড়ে ফেলল। পকেট থেকে লাইটারটা বের করে জ্বালল। আগুন ধরিয়ে দিল কালো পোশাকে। তারপর লাইটার ফেলে দিয়ে বেরিয়ে এল বসবার ঘর থেকে। আগুনের শিখা তখন লোকটার শরীরটাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছে।

অন্ধকারেই সিঁড়ি বেয়ে নামতে শুরু করল সুকান্ত।

সিঁড়ির শেষ ধাপে পৌঁছে অন্ধকার অফিস-ঘরের সামনে একমুহূর্ত দাঁড়াল ও। তারপর এগিয়ে চলল সদর দরজায় দিকে। অন্ধকার থাকলেও এবারে অবিনাশের মৃতদেহে হোঁচট খেল না ও। পা যথাসম্ভব উঁচু করে দরজায় ছিটকিনিটা খুলে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এল।

তারপর মেঠো পথ ধরে দিগ্ভ্রান্তের মতো হাঁটতে শুরু করল।

<

Anish Deb ।। অনীশ দেব