যদি ‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’-এর অনলাইন সংস্করণে আমার লেখা সম্পর্কে পাঠকের মন্তব্যের অংশটি খোলা থাকত, আমি নিশ্চিত ওখানে হেন কুৎসিত ভাষা নেই যা ব্যবহার না হতো আমার বিরুদ্ধে। দেশের একটা বিশাল সংখ্যার মানুষ যে কতটা অশিক্ষিত, কতটা মূর্খ, কতটা অসহিষ্ণু, কতটা অচেতন, কতটা নারীবিদ্বেষী, কতটা বর্বর তা আমার জানা হতো না, যদি না আমার সম্পর্কে ওদের মন্তব্য অন্যান্য পত্রিকার অনলাইন সংস্করণে আমি না পড়তাম। আমাকে নিয়ে কুৎসা রটনা আর মিথা্যচারে মজা হলো, কেউ বাধা দেয় না। নেটে আরও বাধা নেই। নানা ব্লগে, নিউজে আমাকে ঠিক একই ভাষায় অবমাননা করছে এখনকার যুবসমাজ অর্থাৎ দেশের ভবিষ্যৎ, যে ভাষায় কুড়ি বছর আগে তাদের ঘৃণ্য নারীবিরোধী বাপ-দাদারা অবমাননা করত আমাকে। এই দুঃসহ খরায় হঠাৎ এক পশলা বৃষ্টির স্বাদ পেলাম। মেঘকন্যা ঝরাল সেই বৃষ্টি। জানি না কে এই মেঘকন্যা। যেখানেই থাকুন আপনি মেঘকন্যা, আমার ভালোবাসা নিন। মেঘকন্যার এই ব্লগ পুরোটাই আমি আজ তুলে দিচ্ছি পাঠকদের পড়ার জন্য। ব্লগ তো পাঠকদের জন্যই, নিশ্চয়ই অনধিকার চর্চা করছি না।

মনের গুরু ‘তনা’_ আমার তসলিমা নাসরিন

লিখেছেন : মেঘকন্যা। আগস্ট ১০, ২০১৩- ১:৩৪ অপরাহ্ন

‘সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি সারাদিন আমি যেন ভালো হয়ে চলি’_ এভাবেই তো চলতাম। যে যা বলত শুনতাম, জানতাম একমাত্র লেখাপড়াতেই এ মেয়ে জীবনের মুক্তি ঘটতে পারে। পাড়ার সবাই ভালো মেয়ে ভালো ছাত্রী হিসেবে আমার উদাহরণ টানত। আমিও তাতে কম আহ্লাদিত হতাম না। মাটির দিকে তাকিয়ে স্কুলে যাই, মাটির দিকে তাকিয়েই ফিরে আসি, যাতায়াতের পথে কেউ ভালো বললেও রা কাড়ি না, মন্দ বললে তো একদমই কাড়ি না। বাসে যদি কেউ গায়ে হাত দেয় কিশোরী আমি লজ্জায় দুঃখে মনে মনে কাঁদি, বাসায় ফিরে কেউ না দেখে মতো করে কাঁদি, কখনো স্কুলে টিফিন পিরিয়ডে কাঁদি। এই ছিলাম ৯২ সাল পর্যন্ত, ক্লাস নাইন পর্যন্ত আমার জানা আমি। মা-বাবার ভালো ছাত্রী, ভালো মেয়ে, পাড়া-প্রতিবেশীর লক্ষ্মী মেয়ের রোলমডেল হঠাৎ করে রং বদলানো পৃথিবীকে অন্য চোখে অন্য ধ্যানে একটু একটু বুঝতে শুরু করলাম। কচি মনে মালুম হতে থাকল। সারাদেশ যে লেখকের লেখা নিয়ে ছিঃ ছিঃ করছে তার লেখা পড়ে আমার বদল হচ্ছে, আর আমি ভালো মেয়ে সার্টিফিকেট হারাচ্ছি প্রতিনিয়ত অল্প অল্প করে।

বাসে প্রাপ্য অশোভন আচরণের বিরুদ্ধে হায় আমি রুখেও দাঁড়ালাম। ‘একতাই বল’ এ নীতির প্রয়োগে আমরা বান্ধবীরা এ সব বিকৃত লোকজনকে হরহামেশাই জটিল মারা মেরেছি, এমনও হয়েছে বাসের সবাই একযোগে আমাদেরকে বলছে, অপরাধী লোকটাকে ছেড়ে দিতে, আমরা দিইনি। আমি জানলাম যে অপরাধ করেছে তাকে কাঁদতে হবে, অপরাধের শিকার আমার কান্নার কোনো কারণ ঘটেনি। তনা আমাদের মনোজগৎ এভাবে পাল্টে দিচ্ছিলেন নিজের লেখনী দিয়ে। ৯৪ এর বইমেলা, ৮-৯ জন বান্ধবী গিয়েছি, মাঝখান দিয়ে এক ফ্রেন্ড এর বুকে খামচি দিল চরম ভিড়ের মধ্যে একটি হাত, আমার বান্ধবী ধরে ফেলল সেই হাত, সেই লোক এবার আমার বান্ধবীর হাতে খামচাল ছাড়া পাওয়ার জন্য, আমরা ধরে ফেললাম, আমাদের ব্যাগ ভর্তি তসলিমার বই, মন ভরা তার দেওয়া সাহস, আমরা একমেলা মানুষের সামনে সেই লোককে গালে থাপ্পড় একের পর এক দিলাম, তারপর কান ধরে উঠ-বস করালাম। আমরা সবাই সেই সময় কাজেও তসলিমা হতে চাচ্ছিলাম। এভাবে গুডগার্ল ইমেজ একবারেই তিরোহিত হয়ে গেল, যা নিয়ে আজও আমি গর্বিত।

‘যায় যায় দিন’ সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন তখন না পাক্ষিক?? স্মৃতি বলছে সাপ্তাহিক। হায় হায় কি সাংঘাতিক সব কলাম_ ‘মৌচাকে ঢিল’ নামক কলামে। ধ্যানের নিভৃতিতে, চরম হলাহলে আমরা একপাল কিশোরী ক্ষুরধার এক লিখনের মুখোমুখি। যে লিখন ল্যাটপেটে প্রেমের কথা বলছে না, বরং আমাদের প্রতিদিনের বঞ্চনাগুলোকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। মর্নিং শিফটে পড়া মেয়েরা নাকি ছেলেদের মতো জধম ডে যারা ডে শিফটে পড়ে করতে পারবে না। সবসময় আমাদের মেয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য আলাদা নিয়ম। টিচারদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে আমরা এসএসসি পরীক্ষার্থী মেয়েরা ছেলেদের মতোই জধম ডে করলাম।

বাসায়, বাইরে সর্বত্র রক্তচক্ষু তার লেখা পড়া নাজায়েজ এ মর্মে। আরো পড়ছি, একজন কিনলে আরেকজনকে দিচ্ছি, টিফিনের ফাঁকে গোল হয়ে পড়ছি, বোরিং কোনো ক্লাসের মধ্যে মলাট দিয়ে পড়ছি, আমাদের বাসস্থান মীরপুরে এ লেখকের বই সহজলভ্য নয়, আমরা খোঁজ নিয়ে জানলাম নিউমার্কেট এবং বেইলি রোডে সব বই পাওয়া যায়। কী কষ্ট করে যে আমরা বেইলি রোড গেলাম সাগর পাবলিশার্সে, ‘তবুও বই পড়ুন’ দোকানে। পরনে স্কুলের ইউনিফর্ম, সবাই আমাদের ঘুরে ঘুরে দেখছে। আমরা ফিরলাম ‘নষ্ট মেয়ের নষ্ট গদ্য’ নিয়ে।

‘লজ্জা’ বা ‘ভ্রমর কইও গিয়া’ সাহিত্য বলতে যা বোঝায় তা আমাদের কাছে মনে হতো না। তারচেয়ে আমরা গোগ্রাসে গিললাম ‘যাব না কেন যাব’, ‘নষ্ট মেয়ের নষ্ট গদ্য’, ‘নির্বাচিত কলাম’, ‘বেহুলা একা ভাসিয়েছিলো ভেলা’, রুদ্রর বন্ধু রুদ্রর মতো না হলেও কবিতা ভালো লিখে আমরা একমত হলাম।

সারাদেশে আন্দোলনের জেরবার, সিলেটের কোনো এক হুজুর তসলিমাকে তওবা পড়তে বলেছে, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লেগেছে, তসলিমার ফাঁসি চাওয়া হচ্ছে। যে কোনোদিন কোনো লেখা তার পড়েনি সে-ও তসলিমাকে গালি দিচ্ছে। আমাদের সরকার ডুগডুগি বাজাচ্ছে। আমাদের বুদ্ধিজীবীরা আত্দতোষণে ব্যস্ত। একজন তসলিমাকে মুরতাদ ডাকলে কী হয়! একজন নষ্ট নারী দেশান্তরী হলে কী হয়! কিছু হয় না। প্রথম প্রথম খুব মন খারাপ করতাম। দিন যেতে যেতে বন্ধুরা তাকে ভুলে গেল। একজন তসলিমা গোটা দেশ অচল করে দিল, বহু বছর ধরে চলা সমাজ যেন থমকে দাঁড়াল একজন তসলিমার আশঙ্কায়। তসলিমা তখন আরও বেপরোয়া, তসলিমা তোমাদের আমি থোড়াই কেয়ার করি এ ভঙ্গি বোঝাতেই যেন টিভিতে সিগারেট পোড়ালেন। আমার মাথার ভেতর তিনি রয়ে গেলেন। সিগারেট হাতে তসলিমা, শার্ট পরা তসলিমা, ডোন্ট কেয়ার তসলিমা, কবিতার তসলিমা, দুঃখী তসলিমা, বেস্ট সেলার তসলিমা। নোংরা রাজনীতি আর মৌলবাদের হাতে হাত ধরে চলা সিম্ফনীর সরল শিকার তসলিমা আমার মস্তিষ্কের ধূসর কোষে রয়ে গেলেন। বন্ধুরা তাকে জীবনের অনেক ঘটে যাওয়া ঘটনার মতোই ভুলে গেল। আমি বইমেলা, বইয়ের দোকান, ইন্টারনেট সব খুঁজে আজো তাকে পাঠ করি। আউট অব দ্য বঙ্ কিছু করলেই আজো শুনি ‘তসলিমা নাসরিন’ হইছ! যারা আমাকে এ কথা বলে তাদের মুখের ওপর আমি মনে মনে হাসি এ ভেবে, তোমরা তো জান না এ আমার জন্য কত বড় কমপ্লিমেন্ট!

এমন এক দেশে তোমার জন্ম মেয়ে যেখানে বেগম রোকেয়াকে চাওয়া হয় না, চাওয়া হয় মানুষ নামক ছায়া, যারা কোনো কিছুতেই না বলবে না। তুমি ডাক্তার না লেখক, তুমি গুণী না নির্গুণ, তুমি ভাবুক না সংসারী এ সবের কোনো মূল্য এখানে নেই। তুমি দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক, তুমি লেখক বা শিল্পী নও মহিলা কবি, নারী লেখক, লেডি ডাক্তার_ এখানে কমন জেন্ডার বলে কিছু নেই। স্বাধীনতার চলি্লশ বছর, আর অধীনতার শত বছর ধরে এখানে কোনো নারী আন্দোলন, মানুষের অধিকার আদায়ের অধিকার দানা বাঁধেনি। তুমি সেখানে কলম দিয়ে বিপ্লব চেয়েছ। আর কিছু সুবিধাবাদীর মুনাফা করার জন্য পণ্য করেছে নিজেকে নিজের অজান্তেই। তোমার ছবি দিয়ে বইয়ের মলাট দিয়ে এখনো ব্যবসা করছে এদেশের প্রকাশকরা। এখানে মনোবিজ্ঞানের নামে বই লিখে কাঁচা যৌনতা যখন কিশোর-কিশোরীর হাতে তুলে দেওয়া হয়, প্রকাশকরা তা বাজারজাত করেন, তখন কেউ এর বিরুদ্ধে কথা বলে না, কারণ সে পুরুষ লেখক, নারী কোনো যৌনতার কথা বললেই তা শ্লীল কি অশ্লীল_ বলা ঠিক হয়েছে কি-না তার জন্য পাল্লা মাপা শুরু হয়। এখানে চাঁদকে ফালি ফালি করে কাটার কথা বলতে গিয়ে বারবার সঙ্গমের কথা বললে সেই বইয়ের কাটতি হয়, সেই লেখক জাতে উঠেন, তারা নিষিদ্ধ হন না_ কারণ তারা একে তো পুরুষ লেখক, তার ওপর বুদ্ধিজীবীর তক্মা অাঁটা এবং আমাদের বুদ্ধিজীবীরা নিজেদের পুরুষতান্ত্রিক আহ্লাদীপনা চালু রাখতে ভীষণ রকম সংঘবদ্ধ। এ নারী যেহেতু প্রচলিত সব ট্যাবু ভেঙে চুরমার করেছে তাকে সমর্থন দেওয়ার প্রশ্নই উঠে না, এ নারীর লেখা কেউ ভালোবেসে পড়ছে, কেউ ঘৃণা থেকে পড়ছে, কেউ নিতান্ত কৌতূহলে পড়ছে, মেলায় তখন পুরুষ লেখকদের বই কোণঠাসা, তসলিমার বই উঠে এলো তিন নম্বর বেস্ট সেলার হিসেবে, একে আটকাও, আমাদের বুদ্ধিজীবী আহমদ ছফা, হুমায়ুন আজাদসহ আরও অনেকে নিজেদের প্রথম পরিচয় লেখক ভুলে ভীষণ পুরুষ হয়ে উঠলেন_ তসলিমার সেই সংকটে তাকে রক্তাক্ত করতে আরও ভয়ঙ্কর সব কথা বলা শুরু করলেন পত্রিকায়। আমাদের তসলিমার বই বিক্রি তাতে কমল না, বরং আরও বাড়ল। দেশে দেশে আজো আমাদের তসলিমা পঠিত_ একজন ছফা কিংবা একজন আজাদ বিশ্বের অর্ধশত ভাষায় অনূদিতও হলো না, তাদের নামও শুধু ছাপান্ন হাজার বর্গমাইলে ছাপান্ন হাজার মানুষের ভেতরই সীমাবদ্ধ থাকল।

তসলিমাকে নিয়ে ভাবনা শেষ হয় না। এখনো কলম ধরলে তার কথা মনে পড়ে, কলাম লিখেছি যখন মনে পড়েছে তার কথা, ২০০৫-এ প্রথম ছোটগল্পের বই তাকেই উৎসর্গ করেছি, লিখেছি ‘মনের গুরু তনা’কে’।

কড়া কথা, সুগার কোটিং দিয়ে বলা শেখেনি মেয়ে, তাই তার এবেলা ওবেলা জাত গেল, উনিশ বছর দেশান্তরী, মাকে দেখতে পারেনি মরণকালে। আমার দেশ গোলাম আযমকে নাগরিকত্ব দেয়, মাকে দেখার উসিলায় একাত্তরের পর জিয়ার আমলে গোলম আযম বাংলাদেশে এসে স্থান পেয়ে যায়, আর আমার খালেদা তাকে আদালত থেকে নাগরিকত্ব এনে দেন। আমার হাসিনা নির্বাচনের আগে গোলাম আযমের দোয়া নিতে যান, শুধু আমার তসলিমার এদেশে জায়গা হয় না।

আমাদের চুরচুর ধর্মানুভূতি। ধর্ষণ হলে আমাদের ধর্মবেত্তারা ফতোয়া দেন না, বালকের বলাৎকার হলে আমাদের ধর্মজীবীদের মাতম হয় না, এসিড মারা হলে আমরা সেই সন্ত্রাসীর ফাঁসি চাই না, ‘লজ্জা’ লিখিত হলে আমাদের লজ্জা লাগে, ‘লজ্জা’ যে কারণে লিখিত হয় তাতে আমাদের লজ্জা লাগে না। তুমি যা ইচ্ছা তাই করতে পার, শুধু ধরা পড়া যাবে না_ এই হচ্ছে আমার দেশের নাগরিক সমাজের ঔচিত্যবোধ।

খুব মনে পড়ে তসলিমার সেই কথাটা “যুদ্ধের সকল ভাঙন, বুট ও বেয়নেটের নৃশংস অত্যাচার এবং মৃত্যুর মতো বীভৎসতা সবাই গ্রহণ করলেও ধর্ষণ দুর্ঘটনাটি গ্রহণ করেনি। বাইরে যখন মা-বোনের সম্মান নিয়ে চিৎকার করছে রাজনৈতিক নেতারা, তখন অসম্মান থেকে নিজেকে বাঁচাবার একমাত্র উপায় হিসেবে ঘরের কড়িকাঠে আমার খালা যে মাসে ফাঁসি নিয়েছে সে মাস ডিসেম্বর মাস।” (নির্বাচিত কলম, তসলিমা নাসরিন, পৃষ্ঠা-২২)।

বীরাঙ্গনা শুধু মুখে মুখে, বীরাঙ্গনা নয় আসলে আমার দেশ বলতে চায় বারাঙ্গনা, বীর শব্দটি শুধুই আদমের গোষ্ঠীর জন্য বরাদ্দ।

তসলিমা আজো আমার একার সম্পদ, আমি তাকে পাঠ করি সময়ে অসময়ে, মনে মনে কখনো মায়াবোধ করি, একজন নিঃসঙ্গ গ্রহচারীর জন্য, একজন দেশান্তরী মানুষের জন্য। লেখক হিসেবে তার সঙ্গে একাত্দতা বোধ করি, তার পক্ষে কথা বলে কটু কথা শুনি। এ শোনার কোনো শেষ নেই। আমাদের মাতৃত্বকালীন ছুটি লাগে, আমরা অফিস আওয়ার শেষ হলেই বাসায় দৌড়াই, লেট সিটিং করতে চাই না_ এমন অভিযোগগুলো শুনে চুপ করে থাকি। আমরা নারীরা সমঅধিকার চাই, সমান সমান বেতন চাই কর্মস্থলে, নিজেদের পুরুষের সমকক্ষ মনে করি কিন্তু বাসে আমাদের জন্য আলাদা আসন লাগে, সংসদে আমাদের কোটা লাগে_ অভিযোগগুলো শুনতে শুনতে বিরক্ত হয়ে সেদিন বলে ফেললাম, বাসে কেন আলাদা আসন লাগে বলেন তো!_ কোনো উত্তর নেই চুপ। আমি বললাম, কারণ আমাদের দেশের পুরুষরা জানে না নারী বা পুরুষ কোনো মানুষের শরীরেই নিজের শরীর ছোঁয়ানোর অধিকার কারও নেই অনুমতি ছাড়া। আমাদের পুং রা এখনো অশোভন আচরণের বেড়াজাল থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারেনি বলেই নারীদের জন্য এখনো অনেক কিছুই আলাদা রাখতে হয়, সে বাসের আসনই হোক আর সংসদের আসনই হোক। প্রতিউত্তরে শুনলাম আমি তসলিমা নাসরিনের মতো কথা বলছি। তারপরও পুরুষের মুখে, নারীর মুখে যখন মেয়ে তোমার নাম উচ্চারিত হয় বিরক্তিতে ক্রোধে অথবা গালি হিসেবে তখন আমি খুশি হই_ তুমি ফেলে দেওয়ার বিষয় নয়, তুমি এখনো মানুষকে ভাবাচ্ছ, তুমি থাকবে, ছিলে আছ, এ প্রমাণ এভাবে দৈনন্দিনতায় উঠে আসে আজো। তাকে দেশে ফিরতে বলতে মন চায়, মন চায় বলি অনেক আগুন হলো, এবার উপশমের কথা বল মেয়ে; তারপর ভাবি দেশে এলেইবা কি, না এলেইবা কি_ তোমার কলম যেন না থামে। তোমার কলম তোমাকে একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছে, তোমাকে নিয়ে গবেষণা হবে এদেশেই একদিন আমি জানি নিশ্চয় করে। সত্যি তা কুৎসিত হোক বা সুন্দর সত্যকে সত্য হিসেবে বলার শক্তি তোমার আছে, তোমার শক্তি আছে নষ্ট কথা বলার অবলীলায়, তাই তুমি তসলিমা, এটাই তসলিমা, এ ই-ই তুমি আমাদের তসলিমা। আমাদের কৈশোরের আইডল, প্রাত্যহিকতার সঙ্গী।

তসলিমাকে মনে পড়ে ‘আমার মেয়েবেলা’তে দ্বিখণ্ডিত ক, ফরাসি প্রেমিক, শোধ, খালি খালি লাগে, উতাল হাওয়া সব পঠনে। অনেক নাম হয়েছে, অনেক খ্যাতি শুধু এদেশে তসলিমার কোনো স্থান নেই_ খুনি, যুদ্ধাপরাধী, দুর্নীতিবাজ, সন্ত্রাসী, নষ্ট রাজনীতিক সবার এদেশে থাকার অধিকার আছে। যে নারী প্রথা ভাঙবে এদেশ তার নয়, সরকার তার নয়, রাষ্ট্র তার নয়। রাষ্ট্রীয় প্রশাসনযন্ত্র অনায়াসে তার বিরুদ্ধে কোমর বেঁধে দাঁড়িয়ে যাবে, তথাকথিত নারী আন্দোলনের পুরোধারা একটি শব্দও উচ্চারণ করবে না।

আমাদের ১৫-২০ বছর বয়সী অনেকেই জানে না তসলিমা জমানার কথা, উত্তাল বইমেলার কথা, আমাদের লেখক সমাজের অনৈক্যের কথা। সব মনে পড়ে, আজ বিজন ঘরে তসলিমাকে খুব বেশি মনে পড়ে… মনে পড়তে পড়তে তসলিমার কবিতায় বিষণ্ন হই :

আমার জন্য অপেক্ষা করো মধুপুর নেত্রকোনা
অপেক্ষা করো জয়দেবপুরের চৌরাস্তা
আমি ফিরব। ফিরব ভীড় হট্টগোলে, খরায় বন্যায়
অপেক্ষা করো চৌচালা ঘর, উঠোন, লেবুতলা, গোল্লাছুটের মাঠ
আমি ফিরব। পূর্ণিমায় গান গাইতে, দোলনায় দুলতে, ছিপ ফেলতে বাঁশবনের পুুকুরে_
অপেক্ষা করো আফজাল হোসেন, খায়রুন্নেসা, অপেক্ষা করো ঈদুল আরা,
আমি ফিরব। ফিরব ভালোবাসতে, হাসতে জীবনের সুতোয় আবার স্বপ্ন গাঁথতে_
অপেক্ষা করো মতিঝিল, শান্তিনগর, অপেক্ষা করো ফেব্রুয়ারি বইমেলা
আমি ফিরব।
মেঘ উড়ে যাচ্ছে পশ্চিম থেকে পুবে, তাকে কফোঁটা জল দিয়ে দিচ্ছি চোখের,
যেন গোলপুকুর পাড়ের বাড়ির টিনের চালের বৃষ্টি হয়ে ঝরে।
শীতের পাখিরা যাচ্ছে পশ্চিম থেকে পুবে, ওরা একটি করে পালক ফেলে আসবে
শাপলা পুকুরে, শীতলক্ষ্যায়, বঙ্গোপসাগরে।
ব্রহ্মপুত্র শোনো, আমি ফিরব।
শোনো শালবন বিহার, মহাস্থানগড়, সীতাকুণ্ড পাহাড়_ আমি ফিরব।
যদি মানুষ হয়ে না পারি, পাখি হয়েও ফিরব একদিন।
(আমি ভালো নেই তুমি ভালো থেক প্রিয় দেশ, তসলিমা নাসরিন, পৃ:-২৮৮)
আমি তোমার মানুষ হিসেবে ফেরার অপেক্ষা করি আজো…’।

সূত্রঃ দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪

Taslima Nasrin ।। তসলিমা নাসরিন