“জন চীনেম্যানের চিঠি’ বলিয়া একখানি চটি বই ইংরাজিতে বাহির হইয়াছে। চিঠিগুলি ইংরাজকে সম্বোধন করিয়া লেখা হইয়াছে। লেখক নিজের বিষয়ে বলেন–

“দীর্ঘকাল ইংলণ্ডে বাস করার দরুন তোমাদের (ইংরাজদের) আচার অনুষ্ঠান–সম্বন্ধে কথা কহিবার কিছু অধিকার আমার জন্মিয়াছে। অপর পক্ষে, স্বদেশ হইতে দূরে আছি বলিয়া আমাদের সম্বন্ধেও আলোচনা করিবার ক্ষমতা খোওয়াইয়া বসি নাই। চীনেম্যান সবত্রই সর্বদাই চীনেম্যানই থাকে; এবং কোনো কোনো বিশেষ দিক হইতে বিলাতি সভ্যতাকে আমি যতই পছন্দ করি-না কেন, এখনো ইহার মধ্যে এমন কিছু দেখি নাই যাহাতে পূর্বদেশের মানুষ হইয়া জন্মিয়াছি বলিয়া আমার মনে কোনোপ্রকার ক্ষোভ হইতে পারে।’

ইংরাজি ভাষায় লেখকের অসামান্য দখল দেখিলেই বুঝা যায় যে, ইংরাজি শিক্ষায় ইনি পাকা হইয়াছেন–এইজন্য বিলাত সম্বন্ধে ইনি যাহা বলিয়াছেন তাহাকে নিতান্ত অনভিজ্ঞ লোকের অত্যুক্তি বলিয়া গণ্য করা যায় না।

এই ছোটো বইখানি পড়িয়া আমরা বিশেষ আনন্দ ও বল পাইয়াছি। ইহা হইতে দেখিয়াছি, এশিয়ার ভিন্ন ভিন্ন জাতির মধ্যে একটি গভীর ও বৃহৎ ঐক্য আছে। চীনের সঙ্গে ভারতবর্ষের প্রাণের মিল দেখিয়া আমাদের প্রাণ যেন বাড়িয়া যায়। শুধু তাহাই নহে; এশিয়া যে চিরকাল য়ুরোপের আদালতেই আসামী হইয়া দাঁড়াইয়া তাহার বিচারকেই বেদবাক্য বলিয়া শিরোধার্য করিবে, স্বীকার করিবে যে আমাদের সমাজের বারো-আনা অংশকেই একেবারে ভিতসুদ্ধ নির্মুল করিয়া বিলাতি এঞ্জিনিয়ারের প্ল্যান-অনুসারে বিলাতি ইঁটকাঠ দিয়া গড়াই আমাদের পক্ষে একমাত্র শ্রেয়, এই কথাটা ঠিক নহে–আমাদের বিচারালয়ে য়ুরোপকে দাঁড় করাইয়া তাহারও মারাত্মক অনেকগুলি গলদ আলোচনা করিয়া দেখিবার আছে, এই বইখানি হইতে সেই ধরণা আমাদের মনে একটু বিশেষ জোর পায়। প্রথমত ভারতবর্ষের সভ্যতা এশিয়ার সভ্যতার মধ্যে ঐক্য পাইয়াছে ইহাতেও আমাদের বল; দ্বিতীয়ত এশিয়ার সভ্যতার এমন একটি গৌরব আছে যাহা সত্য বলিয়াই প্রাচীন হইয়াছে, যাহা সত্য বলিয়াই চিরন্তন হইবার অধিকারী, ইহাতেও আমাদের বল।

সম্প্রতি আমাদের মধ্যে একটা চঞ্চলতা জন্মিয়াছে; আমাদের স্বাধীন শক্তি–আমাদের চিরকালের শক্তি কোন্‌খানে প্রচ্ছন্ন হইয়া আছে তাহাই সন্ধান করিয়া সেইখানে আশ্রয় লইবার জন্য আমাদের মধ্যে একটা চেষ্টা জাগিয়াছে। বিদেশীর সহিত আমাদের সংঘাত ক্রমশ যতই কঠিন হইয়া উঠিতেছে স্বদেশকে ততই বিশেষভাবে জানিবার ও পাইবার জন্য আমাদের একটা ব্যাকুলতা বাড়িয়া উঠিতেছে। দেখিতেছি, ইহা কেবল আমাদের মধ্যে নহে। য়ুরোপের সংঘাত সমস্ত সভ্য এশিয়াকে সজাগ করিতেছে। এশিয়া আজ আপনাকে সচেতনভাবে, সুতরাং সবলভাবে উপলব্ধি করিতে বসিয়াছে। বুঝিয়াছে, আত্মানং বিদ্ধি, আপনাকে জানো–ইহাই মুক্তির উপায়। পরধর্মো ভয়াবহঃ, পরের অনুকরণেই বিনাশ।

বস্তুপ্রধান শক্তিপ্রধান সভ্যতার সম্পদ আমাদের ইন্দ্রিয়মনকে অভিভূত করিয়া দেয়। তাহার কল দ্রুত চলে, তাহার প্রাসাদ আকাশ স্পর্শ করে, তাহার কামান শতঘ্নী, তাহার বাণিজ্যজাল জগদ্‌ব্যাপী–ইহা আমাদের দৃষ্টিকে আচ্ছন্ন ও বুদ্ধিকে স্তম্ভিত না করিয়া থাকিতে পারে না। কিছু না হউক, বিপুলতার একটা গায়ের জোর আছে, সেই জোরকে ঠেলিয়া উঠিয়া মনকে মোহমুক্ত করা আমাদের মতো দুর্বলের পক্ষে বড়ো কঠিন। যদি বিপুলতাগ্রস্ত এই সভ্যতার দিকেই একমাত্র আমাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ করি তবে তাহাতে আমাদের মানসিক দুর্বলতা কেবল বাড়িতেই থাকে, এই সভ্যতাকেই একমাত্র আদর্শ বলিয়া বোধ হয় এবং নিজের সামর্থ্যকে ও সম্পদকে একেবারে নগন্য বলিয়া জ্ঞান হয়। ইহাতে স্বচেষ্টা পরাস্ত হয়, আত্মগৌরব দূর হয়, ভবিষ্যতের জন্য কোনো আশা থাকে না, এবং জড়ত্বের মধ্যে অনায়াসেই আত্মসমর্পণ করিয়া নিরাপত্তির আরামে নিদ্রার অচেতনতায় সমস্ত ভুলিয়া থাকিতে ইচ্ছা হয়।

বিশেষত আমাদের বর্তমান অবস্থা ধর্মে কর্মে বিদ্যাবুদ্ধিতে অত্যন্ত দীন। য়ুরোপীয় সভ্যতাকে কেবল নিজের সেই দীনতার সহিত তুলনা করিয়া নিজেরে সম্বন্ধে হতাশ্বাস হইয়া পড়ি।

এ অবস্থায় প্রথমে আমাদের বুঝিতে হইবে, বস্তুপ্রধান শক্তিপ্রধান সভ্যতাই একমাত্র সভ্যতা নহে, ধর্মপ্রধান মঙ্গলপ্রধান সভ্যতা তাহা অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। তাহার পরে, এই শেষোক্ত সভ্যতাই আমাদের ছিল, সুতরাং শেষোক্ত সভ্যতার শক্তি আমাদের প্রকৃতির মধ্যে নিহিত হইয়া আছে ইহাই জানিয়া আমাদিগকে মাথা তুলিতে হইবে, আমাদিগকে আশা ও আনন্দ লাভ করিতে হইবে। আমরা বর্তমান দুর্গতির মধ্যে নিজেদের বিচ্ছিন্ন ক্ষুদ্র করিয়া রাখিলে, য়ুরোপীয় ব্যাপারের বৃহত্ত্ব আমাদের বুদ্ধিকে দলন-পেষণ করিয়া তাহাকে আপনার চিরদাস করিয়া রাখিবে। সেই বুদ্ধির দাসত্ব, রুচির দাসত্ব আমরা প্রত্যহ অনুভব করিতেছি। প্রাচীন ভারতের সহিত নিজেকে সংযুক্ত করিয়া নিজেকে বড়ো করিয়া তুলিতে হইবে।

জড়পদার্থের অপেক্ষা মানুষ জটিল জিনিস, জড়শক্তি অপেক্ষা মানুষের ইচ্ছাশক্তি দুর্ধর্ষতর, এবং বাহ্যসম্পদের অপেক্ষা সুখ অনেক বেশি দুর্লভ। সেই মানুষকে আকর্ষণ করিয়া, তাহার প্রবৃত্তিকে সংযত করিয়া, তাহার ইচ্ছাশক্তিকে নিয়ন্ত্রিত করিয়া, যে সভ্যতা সুখ দিয়াছে, সন্তোষ দিয়াছে, আনন্দ ও মুক্তির অধিকারী করিয়াছে, সেই সভ্যতার মাহাত্ম্য আমাদিগকে যথার্থভাবে উপলব্ধি করিতে হইবে।

উপলব্ধি করা কঠিন, কারণ তাহা বস্তুপুঞ্জে এবং বাহ্যশক্তির প্রাবল্যে আমাদের ইন্দ্রিয়মনকে অতিমাত্র অধিকার করে না। সমস্ত শ্রেষ্ঠ পদার্থের ন্যায় তাহার মধ্যে একটা নিগূঢ়তা আছে, গভীরতা আছে–তাহা বাহির হইতে গায়ে পড়িয়া অভিভূত করিয়া দেয় না, নিজের চেষ্টায় তাহার মধ্যে প্রবেশ করিতে হয়–সংবাদপত্রে তাহার কোনো বিজ্ঞাপন নাই।

এইজন্য ভারতবর্ষের প্রাচীন সভ্যতাকে বস্তুর তালিকা-দ্বারা স্ফীত করিয়া তুলিতে পারি না বলিয়া তাহাকে নিজের কাছে প্রত্যক্ষগোচর করিতে পারি না বলিয়া, আমরা পুষ্পকরথকে রেলগাড়ি বলিতে চেষ্টা করি এবং ধর্মকে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা-দ্বারা কুটিল করিয়া ফ্যারাডে-ডারুইনের প্রতিভাকে আমাদের শাস্ত্রের বিবর হইতে টানিয়া বাহির করিবার প্রয়াস পাই। এই-সকল চাতুরী-দ্বারাতেই বুঝা যায়, ভারতবর্ষের সভ্যতাকে আমরা ঠিক বুঝিতেছি না এবং তাহা আমাদের বুদ্ধিকে সম্পূর্ণ তৃপ্ত করিতেছে না। ভারতবর্ষকে কৌশলে য়ুরোপ বলিয়া প্রমাণ না করিলে আমরা স্থির হইতে পারিতেছি না।

ইহার একটা কারণ, য়ুরোপীয় সভ্যতাকে যেমন আমরা অত্যন্ত ব্যাপ্ত করিয়া দেখিতেছি, প্রাচ্য সভ্যতাকে তেমন ব্যাপ্ত করিয়া দেখিতেছি না। ভারতবর্ষীয় সভ্যতাকে অন্যান্য সভ্যতার সহিত মিলাইয়া মানবপ্রকৃতির মধ্যে তাহার একটা বৃহত্ত্ব, একটা ধ্রুবত্ব উপলব্ধি করিতেছি না। ভারতবর্ষকে কেবল ভারতবর্ষের মধ্যে দেখিলেই তাহার সভ্যতা, তাহার স্থায়িত্বযোগ্যতা আমাদের কাছে যথার্থরূপে প্রমাণিত হয় না। এক দিকে প্রত্যক্ষ য়ুরোপ, আর-এক দিকে শাস্ত্রের কথা, পুঁথির প্রমাণ–এক দিকে প্রবল শক্তি, আর-এক দিকে আমাদের দোদুল্যমান বিশ্বাসমাত্র–এ-অবস্থায় অসহায় ভক্তিকে ভারতবর্ষের অভিমুখে স্থির করিয়া রাখাই কঠিন।

এমন সময় আমাদের সেই পুরাতন সভ্যতাকে যদি চীনে ও জাপানে প্রসারিত দেখি তবে বুঝিতে পারি, মানবপ্রকৃতির মধ্যে তাহার একটা বৃহৎ স্থান আছে, তাহা কেবল পুঁথির বচনমাত্র নহে। যদি দেখি চীন ও জাপান সেই সভ্যতার মধ্যে সার্থকতা অনুভব করিতেছে, তবে আমাদের দীনতার অগৌরব দূর হয়, আমাদের ধনভাণ্ডার কোন্‌খানে তাহা বুঝিতে পারি।

য়ু্‌রোপের বন্যা জগৎ প্লাবিত করিতে ছুটিয়াছে, তাই আজ সভ্য এশিয়া আপনার পুরাতন বাঁধগুলিকে সন্ধান ও তাহাদিগকে দৃঢ় করিবার জন্য উদ্যত। প্রাচ্যসভ্যতা আত্মরক্ষা করিবে। যেখানে তাহার বল সেইখানে তাহাকে দাঁড়াইতে হইবে। তাহার বল ধর্মে, তাহার বল সমাজে। তাহার ধর্ম ও তাহার সমাজ যদি আপনাকে ঠেকাইতে না পারে, তবে সে মরিল। য়ুরোপের প্রাণ বাণিজ্যে পলিটিক্‌সে, আমাদের প্রাণ অন্যত্র। সেই প্রাণ রক্ষা করিবার জন্য এশিয়া উত্তরোত্তর ব্যগ্র হইয়া উঠিতেছে। এইখানে আমরা একাকী নহি; সমস্ত এশিয়ার সহিত আমাদের যোগ রহিয়াছে। চীনেম্যানের চিঠিগুলি তাহাই প্রমাণ করিতেছে।

লেখক তাঁহার প্রথম পত্রে লিখিতেছেন–

“আমাদের সভ্যতা জগতের মধ্যে সব চেয়ে প্রাচীন। অবশ্য, ইহা হইতে প্রমাণ হয় না যে, তাহা সব চেয়ে ভালো; তেমনি আবার ইহাও প্রমাণ হয় না যে, তাহা সব চেয়ে মন্দ। এই প্রাচীনত্বের খাতিরে অন্তত এটুকুও স্বীকার করিতে হইবে যে, আমাদের আচার অনুষ্ঠান আমাদিগকে যে একটা স্থায়িত্বের আশ্বাস দিয়াছে য়ুরোপের কোনো জাতির মধ্যে তাহা খুঁজিয়া পাওয়া ভার। আমাদের সভ্যতা কেবল যে ধ্রুব তাহা নহে, ইহার মধ্যে একটা ধর্মনীতির শৃঙ্খলা আছে; কিন্তু তোমাদের মধ্যে কেবল একটা অর্থনৈতিক উচ্ছৃঙ্খলতা দেখিতে পাই। তোমাদের ধর্ম আমাদের ধর্মের চেয়ে ভালো কি না, এ জায়গায় আমি সে তর্ক তুলিতে চাই না–কিন্তু এটা নিশ্চয়, তোমাদের সমাজের উপর তোমাদের ধর্মের কোনো প্রভাব নাই। তোমরা খ্রীস্টানধর্ম স্বীকার কর, কিন্তু তোমাদের সভ্যতা কোনোকালেই খ্রীস্টান হয় নাই। অপর পক্ষে আমাদের সভ্যতা একেবারে অন্তরে অন্তরে কন্‌ফ্যুশিয়ান। কন্‌ফ্যুশিয়ান বলাও যা আর ধর্মনৈতিক বলাও তা। অর্থাৎ, ধর্মবন্ধনগুলিকেই ইহা প্রধানভাবে গণ্য করে। অপরপক্ষে অর্থনৈতিক বন্ধনকেই তোমরা প্রথম স্থান দাও, তাহার পরে যতটা পারো তাহার সঙ্গে ধর্মনীতি বাহির হইতে জুড়িয়া দিতে চেষ্টা কর।

“তোমাদের পরিবার এবং আমাদের পরিবারের তুলনা করিলেই আমার কথাটা স্পষ্ট হইবে। সন্তান যতদিন পর্যন্ত না বয়ঃপ্রাপ্ত হইয়া নিজের ভার লইতে পারে, তোমাদের পরিবার ততদিন পর্যন্ত তাহাকে আহার দিবার ও রক্ষা করিবার একটা উপায়স্বরূপ মাত্র। যত সকাল-সকাল পারো ছেলেগুলিকে পাব্লিক স্কুলে পাঠাইয়া দাও, সেখানে তাহারা যত শীঘ্র পারে গৃহের প্রভাব হইতে নিজেদের মুক্তিদান করিয়া বসে। যেমনি তাহারা বয়ঃপ্রাপ্ত হয় অমনি তাহাদিগকে রোজগার করিতে ছাড়িয়া দাও–এবং তাহার পরে অধিকাংশ স্থলেই বাপ-মার প্রতি নির্ভর যখনই ফুরাইল, বাপ-মার প্রতি কর্তব্যস্বীকারও অমনি শেষ হইল। তাহার পরে ছেলেরা যেখানে খুশি যাক,যাহা খুশি করুক, যত খুশি পাক এবং যেমন খুশি ছড়াক, তাহাতে কাহারো কথা কহিবার নাই– পরিবারবন্ধন রক্ষা করিবে কি না-করিবে তাহা সম্পূর্ণ তাহাদের ইচ্ছা। তোমাদের সমাজে এক-একটি ব্যক্তি একজন এবং সেই একজনেরা ছাড়া ছাড়া; কেহ কাহারো সহিত বদ্ধ নহে, তেমনি কোথাও কাহারো শিকড় নাই। তোমাদের সমাজকে তোমরা গতিশীল বলিয়া থাক– সর্বদাই তোমরা চলিতেছ। প্রত্যেকেই নিজের জন্য একটা নূতন রাস্তা বাহির করা কর্তব্য জ্ঞান করে। যে অবস্থার মধ্যে জন্মিয়াছ সেই অবস্থার মধ্যে স্থির থাকাকে তোমরা অগৌরব মনে কর। পুরুষ যদি পুরুষ হইতে চায় তবে সে সাহস করিবে,চেষ্টা করিবে, লড়াই করিবে এবং জয়ী হইবে। এই ভাব হইতেই তোমাদের সমাজে অপরিসীম উদ্যমের সৃষ্টি হইয়াছে, এবং বস্তুগত শিল্পাদির তোমরা উন্নতি করিতে পারিয়াছ। কিন্তু ইহা হইতেই তোমাদের সমাজে এত অস্থিরতা, উচ্ছৃঙ্খলতা, এবং এইজন্যই আমাদের মতে ইহার মধ্যে ধর্মভাবের এই অভাব। চীনেম্যানের চোখে এইটেই বিশেষ করিয়া ঠেকে। তোমাদের মধ্যে কেহই সন্তুষ্ট নও–জীবনযাত্রার আয়োজনবৃদ্ধি করিতে সকলেই এত ব্যগ্র যে, কাহারো জীবনযাত্রার অবকাশ জোটে না। মানুষের মধ্যে অর্থের সম্বন্ধকেই তোমরা স্বীকার কর।

“পূর্বদেশীয় আমাদের কাছে ইহা বর্বরসমাজের লক্ষণ বলিয়া বোধ হয়। জীবন-যাত্রার উপকরণবৃদ্ধির মাপে আমরা সভ্যতাকে মাপি না; কিন্তু সেই জীবনযাত্রার প্রকৃতি ও মূল্য-দ্বারাই আমরা সভ্যতার বিচার করি। যেখানে কোনো সহৃদয় ও ধ্রূব বন্ধন নাই, পুরাতনের প্রতি ভক্তি নাই, বর্তমানের প্রতিও যথার্থ শ্রদ্ধা নাই, কেবল ভবিষ্যৎকেই লুব্ধভাবে লুন্ঠন করিবার চেষ্টা আছে, সেখানে আমাদের মতে যথার্থ সমাজই নাই। যদি তোমাদের আচার-অনুষ্ঠানের নকল না করিলে ধনে বিজ্ঞানে ও শিল্পে তোমাদের সঙ্গে টক্কর দেওয়া না যায়, তবে আমরা টক্কর না দেওয়াই ভালো মনে করি।

“এ-সকল ব্যাপারে আমাদের পদ্ধতি তোমাদের ঠিক উল্‌টা। আমাদের কাছে সমাজ প্রথম, ব্যক্তিবিশেষ তাহার পরে। আমাদের মধ্যে নিয়ম এই যে, মানুষ যে-সকল সম্বন্ধের মধ্যে জন্মলাভ করে চিরজীবন তাহারই মধ্যে সে আপনাকে রক্ষা করিবে। সে তাহার পরিবারতন্ত্রের অঙ্গ হইয়া জীবন আরম্ভ করে, সেইভাবে জীবন শেষ করে, এবং তাহার জীবননির্বাহের সমস্ত তত্ত্ব এবং অনুষ্ঠান এই অবস্থারই অনুযায়ী। সে তাহার পূর্বপুরুষদিগকে পূজা করিতে শিখিয়াছে, তাহার পিতামাতাকে ভক্তি ও মান্য করিতে শিখিয়াছে, এবং অল্প বয়স হইতেই পতি ও পিতার কর্তব্যসাধনের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করিয়াছে। বিবাহের দ্বারা পরিবারবন্ধন ছিঁড়িয়া যায় না, স্বামী পরিবারেই থাকে এবং স্ত্রী আত্মীয়কুটুম্ববর্গের অঙ্গীভূত হয়। এইরূপ এক-একটি কুটুম্বশ্রেণীই সমাজের এক-একটি অংশ। ইহার ভূমিখণ্ড, ইহার দেবপীঠ ও পূজাপদ্ধতি, আত্মীয়দের মধ্যে বিবাদমীমাংসার বিচারব্যবস্থা, এ-সমস্তই পরিবারের মধ্যে সরকারি। চীনদেশে নিজের দোষে ছাড়া কোনো লোক একলা পড়ে না। চীনে কোনো একজন ব্যক্তির পক্ষে তোমাদের মতো ধনী হইয়া উঠা সহজ নহে, তেমনি তাহার পক্ষে অনাহারে মরাও শক্ত; যেমন রোজগারের জন্য অত্যন্ত ঠেলাঠেলি করিবার উত্তেজনা তাহার নাই, তেমনি প্রবঞ্চনা এবং পীড়ন করিবার প্রলোভনও তাহার অল্প। অত্যাকাঙ্খার তাড়না এবং অভাবের আশঙ্কা হইতে মুক্ত হইয়া, জীবনযাত্রার উপকরণ-উপার্জনের অবিশ্রাম চেষ্টা ছাড়িয়া, জীবনযাত্রার জন্যই সে অবসর লাভ করে। প্রকৃতির দানসকল উপভোগ করিতে,শিষ্টতার চর্চা করিতে এবং মানুষের সঙ্গে সহৃদয় নিঃস্বার্থ সম্বন্ধ পাতাইয়া বসিতে তাহার ভিতরের স্বভাব এবং বাহিরের সুযোগ দুই’ই অনুকূল। ইহার ফল হইয়াছে এই যে, ধর্মের দিকেই বল, আর মাধুর্যের দিকেই বল, তোমাদের য়ুরোপের অধিকাংশ অধিবাসীর চেয়ে আমাদের লোকেরা শ্রেষ্ঠতা লাভ করিয়াছে। তোমাদের কার্যকরী এবং বৈজ্ঞানিক সফলতার মহত্ত্ব আমরা স্বীকার করি; কিন্তু স্বীকার করিয়াও, তোমাদের যে সভ্যতা হইতে বড়ে বড়ো শহরে এমন রূঢ় আচার, এমন অবনত ধর্মনীতি এবং বাহ্যশোভনতার এমন বিকার উৎপন্ন হইয়াছে, সে সভ্যতাকে আমরা সমস্ত মন দিয়া প্রশংসা করা অসম্ভব দেখি। তোমরা যাহাকে উন্নতিশীল জাত বল আমরা তাহা নই এ কথা মানিতে রাজি আছি, কিন্তু ইহাও দেখিতেছি, উন্নতির মূল্য সর্বনেশে হইতে পারে। তোমাদের আর্থিক লাভের চেয়ে আমাদের ধর্মনৈতিক লাভকেই আমরা শিরোধার্য করি, এবং তোমাদের সেই সম্পদ হইতে যদি বঞ্চিত হইতে হয় সেও স্বীকার, তবু আমাদের যে-সকল আচার-অনুষ্ঠান আমাদের ধর্মলাভকে সুনিশ্চিত করিয়াছে তাহাকে আমরা শেষ পর্যন্ত আঁকড়িয়া ধরিবার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।’

এই গেল প্রথম পত্র। দ্বিতীয় পত্রে লেখক অর্থনৈতিক অবস্থা সম্বন্ধে আলোচনা করিয়াছেন। তিনি বলেন–

“আমাদের যাহা দরকার তাহাই আমরা উৎপন্ন করি, আমরা যাহা উৎপন্ন করি তাহা আমরাই খাই। অন্য জাতের উৎপন্ন দ্রব্য আমরা চাহি নাই, আমাদের দরকারও হয় নাই। আমাদের মতে সমাজের স্থিতি রক্ষা করিতে হইলে, তাহার আর্থিক স্বাধীনতা থাকা চাই। বৃহৎ বিদেশী বাণিজ্য সামাজিক ভ্রষ্টতার একটা নিশ্চিত কারণ।

“তোমরা যাহা খাইতে চাও তাহা তোমরা উৎপন্ন করিতে পার না, তোমাদিগকে যাহা উৎপন্ন করিতে হয় তাহা তোমরা ফুরাইতে পার না। প্রাণের দায়ে এমনতরো কেনাবেচার গঞ্জ তোমাদের দরকার যেখানে তোমাদের কারখানার মাল চালাইতে পার এবং খাদ্য এবং কৃষিজাত দ্রব্য কিনিতে পার। অতএব যেমন করিয়া হউক, চীনকে তোমাদের দরকার।

“তোমরা চাও আমরাও ব্যবসাদার হই এবং আমাদের রাষ্ট্রীয় ও আর্থিক যে স্বাধীনতা আছে তাহা বিসর্জন দিই; কেবল যে আমাদের সমস্ত কাজ কারবার উলট-পালট করিয়া দিই তাহা নহে, আমাদের আচারব্যবহার, ধর্ম, আমাদের সাবেক রীতিনীতি, সমস্তই বিপর্যস্ত করিয়া ফেলি। এমত অবস্থায় তোমাদের দশাটা কী হইয়াছে তাহা যদি বেশ করিয়া আলোচনা করিয়া দেখি, তবে আশা করি মাপ করিবে।

“যাহা দেখা যায় সেটা তো বড়ো উৎসাহজনক নহে। প্রতিযোগিতা-নামক একটা দৈত্যকে তোমরা ছাড়িয়া দিয়াছ, এখন আর সেটাকে কিছুতেই কায়দা করিতে পারিতেছ না। তোমাদের গত একশো বৎসরের বিধিবিধান কেবল এই আর্থিক বিশৃঙ্খলাকে সংযত করিবার জন্য অবিশ্রাম নিষ্ফল চেষ্টা মাত্র। তোমাদের গরিবেরা, মাতালেরা, অক্ষমেরা, তোমাদের পীড়া ও জরা-গ্রস্তগণ একটা বিভীষিকার মতো তোমাদের ঘাড়ে চাপিয়া আছে। মানুষের সহিত সমস্ত ব্যক্তিগত বন্ধন তোমরা ছেদন করিয়া বসিয়া আছ, এখন স্টেট অর্থাৎ সরকারের অব্যক্তিক উদ্যমের দ্বারা তোমরা ব্যক্তির সমস্ত কাজ সারিয়া লইবার বৃথা চেষ্টা করিতেছ। তোমাদের সভ্যতার প্রধান লক্ষণ দায়িত্ববিহীনতা। তোমাদের কারবারের সর্বত্রই তোমরা ব্যক্তির জায়গায় কোম্পানি এবং মজুরের জায়গায় কল বসাইতেছ। মুনফার চেষ্টাতেই সকলে ব্যস্ত–শ্রমজীবীর মঙ্গলের ভার কাহারোই নহে,সেটা সরকারের। সরকার সেটাকে সামলাইয়া উঠিতে পারে না। সহস্র ক্রোশ দূরে যদি দুর্ভিক্ষ হয়, যদি কোথাও মাশুলের কোনো পরিবর্তন হয়, তবে তোমাদের লক্ষ লোকের কারবার বিশ্লিষ্ট হইবার জো হয়–যাহার উপরে তোমাদের হাত নাই তাহার উপরে তোমাদিগকে নির্ভর করিতে হয়। তোমাদের মূলধন একটা সজীব পদার্থ, সেটা খোরাকের জন্য সর্বদাই চীৎকার করিতেছে; তাহাকে আহার না জোগাইলে সে তোমাদের গলা চাপিয়া ধরে। তোমরা যে উৎপন্ন কর সেটা ইচ্ছামত নহে, অগত্যা–এবং তোমরা যে কিনিয়া থাক সেটা যে চাও বলিয়া তাহা নহে, সেটা তোমাদের ঘাড়ের উপর আসিয়া পড়ে বলিয়া। এই-যে বাণিজ্যটাকে তোমরা মুক্ত বল, ইহার মতো বদ্ধ বাণিজ্য আর নাই। কিন্তু ইহা কোনো বিবেচনাসংগত ইচ্ছার দ্বারা বদ্ধ নহে, ইহা আকস্মিক খেয়ালের স্তূপাকার মূঢ়তার দ্বারা বন্দীকৃত।

“চীনেম্যানের চক্ষে তোমাদের দেশের ভিতরকার আর্থিক অবস্থা এইরকমই ঠেকে। পররাষ্ট্রের সহিত তোমাদের বাণিজ্যসম্বন্ধ, সেও অত্যন্ত উল্লাসজনক নয়। পঞ্চাশ বৎসর পূর্বে ধারণা হইয়াছিল যে, বিভিন্ন জাতির মধ্যে যখন বাণিজ্যসম্বন্ধ স্থাপিত হইবে তখন শান্তির সত্যযুগ আসিবে। কাজে দেখা গেল সমস্তই উল্‌টা। প্রাচীনকালের রাজাদের অত্যাকাঙক্ষা ও ধর্মযাজকদের গোঁড়ামির চেয়ে এই বাণিজ্যস্থান লইয়া পরস্পর টানাটানিতে যুদ্ধবিগ্রহের সম্ভাবনা আরো বেশি প্রবল হইয়া উঠিতেছে। পৃথিবীর যেখানেই একটুখানি অপরিচিত স্থান ছিল, সেইখানেই য়ুরোপের লোক একেবারে ক্ষুধিত হিংস্র জন্তুর মতো হুংকার দিয়া পড়িতেছে। এখন য়ুরোপের এলাকার সীমানার বাহিরে এই লুণ্ঠনব্যাপার চলিতেছে। কিন্তু যতক্ষণ ভাগাভাগি চলিতেছে ততক্ষণ পরস্পরের প্রতি পরস্পর কট্‌মট্‌ করিয়া তাকাইতেছে। আজ হউক বা কাল হউক, যখন আর বাঁটোয়ারা করিবার জন্য কিছুই বাকি থাকিবে না, তখন তাহারা পরস্পরের ঘাড়ের উপরে গিয়া পড়িবে। তোমাদের শস্ত্রসজ্জার এই আসল তাৎপর্য–হয় তোমরা অন্যকে গ্রাস করিবে, নয় অন্যে তোমাদিগকে গ্রাস করিবে। যে বাণিজ্যসম্পর্ককে তোমরা শান্তি বন্ধন মনে করিয়াছিলে তাহাই তোমাদিগকে পরস্পরের গলা কাটাকাটির প্রতিযোগী করিয়া তুলিয়াছে এবং তোমাদের সকলকে একটা বিরাট বিনাশব্যাপারের অনতিদূরে আনিয়া স্থাপন করিয়াছে।’

লেখক বলেন–

“পরিশ্রম বাঁচাইবার কল তৈরি করিতে তোমরা যে বুদ্ধি খাটাইতেছ তাহাতে সমাজের কল্যাণ হইতেছে না। তাহাতে ধনবৃদ্ধি হইতেছে সন্দেহ নাই, কিন্তু সেটা যে মঙ্গলই আমার মতে এমন কথা মনে করিবার হেতু নাই। ধন কিরূপে ভাগ হয় এবং সেই ধনে জাতির চরিত্রের উপরে কী ফল হয়, তাহাই চিন্তার বিষয়। সেইটে যখন চিন্তা করি তখন বিলাতি পদ্ধতি চীনে ঢুকাইবার প্রস্তাবে মন বিগড়াইয়া যায়।

“এই তোমরা যতদিন ধরিয়া যন্ত্রতন্ত্রের শ্রীবৃদ্ধিসাধনে লাগিয়াছ ততদিনে তোমাদের শ্রমজীবীদিগকে সংকটে ফেলিয়া তাহা হইতে উদ্ধারের কোনো একটা ভালো উপায় বাহির কর নাই। ইহা আশ্চর্যের বিষয় নহে; কারণ টাকা করা তোমাদের প্রধান লক্ষ্য, জীবনের আর-সমস্ত লক্ষ্য তাহার নীচে। চীনেম্যানের কাছে এটা কিছুতেই উৎসাহজনক ঠেকে না। বিলাতি কারবারের প্রণালী যদি চীনদেশে ফালাও করিয়া তোলা যায় তবে তাহার চল্লিশ কোটি অধিবাসীর মধ্যে যে নিশ্চিত বিশৃঙ্খলা জাগিয়া উঠিবে, অন্তত আমি তো তাহাকে অত্যন্ত আশঙ্কার চক্ষে দেখি। তোমরা বলিবে, সে বিশৃঙ্খলা সাময়িক। আমি তো দেখিতেছি, তোমাদের দেশে তাহা চিরস্থায়ী। আচ্ছা, সে কথাও যাক, তাহাতে আমাদের লাভটা কী? আমরা তো তোমাদেরই মতো হইয়া যাইব! সে সম্ভাবনা কি অবিচলিতচিত্তে কল্পনা করা যায়? তোমাদের লোকেরা নাহয় আমাদের চেয়ে আরামে খায় বেশি, পান করে বেশি, নিদ্রা যায় বেশি–কিন্তু তাহারা প্রফুল্ল নয়, সন্তুষ্ট নয়, শ্রমানুরাগী নয়, তাহারা আইন মানে না। তাহাদের কর্ম শরীরমনের পক্ষে অস্বাস্থ্যকর, তাহারা প্রকৃতি হইতে বিচ্যুত হইয়া, ভূমিখণ্ডের অধিকার হইতে বঞ্চিত হইয়া, শহরে এবং কারখানার মধ্যে ঠাসাঠাসি করিয়া থাকে।

“আমাদের কবিগণ–লেখকগণ–ধনের মধ্যে, ক্ষমতার মধ্যে, নানাপ্রকার উদ্‌যোগের মধ্যে, কল্যাণ অনুসন্ধান করিতে উপদেশ দেন নাই; কিন্তু মানবজীবনের অত্যন্ত সরল ও বিশ্বব্যাপী সম্বন্ধগুলির সংযত সুনির্বাচিত সুমার্জিত রসাস্বাদনের পথে আমাদের মনকে তাঁহারা প্রবর্তিত করিয়াছেন। এই জিনিসটা আমাদের আছে–এটা তোমরা আমাদিগকে দিতে পার না,কিন্তু এটা তোমরা অনায়াসে অপহরণ করিতে পার। তোমাদের কলের গর্জনের মধ্যে ইহার স্বর শোনা যায় না, তোমাদের কারখানার কালো ধোঁওয়ার মধ্যে ইহাকে দেখিতে পাওয়া যায় না, তোমাদের বিলাতী জীবনযাত্রার ঘূর্ণি এবং ঘর্ষণের মধ্যে ইহা মরিয়া যায়। যে কেজো লোকদিগকে তোমরা অত্যন্ত খাতির করিয়া থাক, যখন দেখি তাহারা ঘণ্টার পর ঘণ্টায়, দিনের পর দিনে, বৎসরের পর বৎসরে, তাহাদের জাঁতার মধ্যে আনন্দহীন অগত্যাপ্রেরিত খাটুনিতে নিযুক্ত–যখন দেখি তাহাদের দিনের উৎকণ্ঠাকে তাহারা স্বল্পাবশিষ্ট অবকাশের মধ্যে টানিয়া আনিতেছে, এবং পরিশ্রমের দ্বারা ততটা নহে যতটা শুষ্ক সংকীর্ণ দুশ্চিন্তা দ্বারা আপনাকে জীর্ণ করিয়া ফেলিতেছে–তখন এ কথা স্বীকার করিতেই হইবে যে, আমাদের দেশের প্রাচীন বৈশ্যবৃত্তির সরলতর পদ্ধতির কথা স্মরণ করিয়া আমি সন্তোষ লাভ করি, এবং আমাদের যে-সকল চিরব্যবহৃত পথগুলি আমাদের অভ্যস্ত চরণের কাছে এমন পরিচিত যে তাহা দিয়া চলিবার সময়েও অনন্ত নক্ষত্রমণ্ডলীর দিকে দৃষ্টিপাত করিবার জন্য আমাদের অবকাশের অভাব ঘটে না, তোমাদের সমুদয় নূতন ও ভয়সংকুল বর্ত্মের চেয়ে সেই পথগুলিকে আমি অধিক মূল্যবান বলিয়া গৌরব করি।’

ইহার পরে লেখক রাষ্ট্রতন্ত্রের কথা তুলিয়াছেন। তিনি বলেন–

“গবর্মেণ্ট্‌ তোমাদের কাছে এতই প্রধান এবং সর্বত্রই সে তোমাদের সঙ্গে এমনি লাগিয়াই আছে যে, যে জাতি গবর্মেণ্ট্‌কে প্রায় সম্পূর্ণই বাদ দিয়া চলিতে পারে, তাহার অবস্থা তোমরা কল্পনাই করিতে পার না। অথচ আমাদেরই সেই অবস্থা। আমাদের সভ্যতার সরল এবং অকৃত্রিম ভাব, আমাদের লোকদের শান্তিপ্রিয় প্রকৃতি, এবং সর্বোচ্চে আমাদের সেই পরিবারতন্ত্র যাহা পোলিটিক্যাল সামাজিক ও আর্থিক ব্যাপারে এক-একটি ক্ষুদ্র রাজ্যবিশেষ, তাহারা আমাদিগকে গবর্মেণ্ট-শাসন হইতে এতটা দূর মুক্তিদান করিয়াছে যে য়ুরোপের পক্ষে তা বিশ্বাস করাই কঠিন।

“আমাদের সমাজের গোড়াকার জিনিসগুলি কোনো রাজক্ষমতার স্বেচ্ছাকৃত সৃজন নহে। আমাদের জনসাধারণ নিজের জীবনকে এইরূপ শরীরতন্ত্রের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছে। কোনো গবর্মেণ্ট্‌ তাহাকে গড়ে নাই, কোনো গবর্মেণ্ট তাহার বদল করিতে পারে না। এক কথায় আইন জিনিসটা উপর হইতে আমাদের মাথায় চাপানো হয় নাই–তাহা আমাদের জাতিগত জীবনের মূলসূত্র, এবং যাহা শাস্ত্রে লিপিবদ্ধ আছে তাহাই ব্যবহারে প্রবর্তিত হইয়াছে। এইজন্য চীনে গবর্মেণ্ট যথেচ্ছাচারী নহে, অত্যাবশ্যকও নয়। রাজপুরুষদের শাসন তুলিয়া লও, তবু আমাদের জীবনযাত্রা প্রায় পূর্বের মতোই চলিয়া যাইবে। যে আইন আমরা মান্য করি সে আমাদের স্বভাবের আইন, বহু শতাব্দীর অভিজ্ঞতায় তাহা অভিব্যক্ত হইয়া উঠিয়াছে–বাহিরের শাসন তুলিয়া লইলেও ইহার কাছে আমরা বশ্যতা স্বীকার করি। যাহাই ঘটুক না, আমাদের পরিবার থাকে, পরিবারের সঙ্গে সঙ্গে মনের সেই গঠনটি থাকে,সেই শৃঙ্খলা কর্মনিষ্ঠতা ও মিতব্যয়িতার ভাবটি থাকিয়া যায়। ইহারাই চীনকে তৈরি করিয়াছে।

“তোমাদের পশ্চিমদেশে গবর্মেণ্ট্‌ ব্যাপারটা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। এখানে কোনো মূলবিধান নাই, কিন্তু ইচ্ছাকৃত অন্তহীন আইন পড়িয়া আছে। মাটি হইতে কিছুই গজাইয়া উঠে না, উপর হইতে সমস্ত পুঁতিয়া দিতে হয়। যাহাকে একবার পোঁতা হয় তাহাকে আবার পোঁতা দরকার হয়। গত শত বৎসরের মধ্যে তোমরা তোমাদের সমস্ত সমাজকে উল্‌টাইয়া দিয়াছ। সম্পত্তি, বিবাহ, ধর্ম, চরিত্র, শ্রেণীবিভাগ, পদবিভাগ, অর্থাৎ মানবসম্বন্ধগুলির মধ্যে যাহা-কিছু সব চেয়ে উদার ও গভীর, তাহাদিগকে একেবারে শিকড়ে ধরিয়া উপড়াইয়া কালের স্রোতে আবর্জনার মতো ভাসাইয়া দেওয়া হইয়াছে। এইজন্যই তোমাদের গবর্মেণ্ট্‌কে এত বেশি উদ্যম প্রকাশ করিতে হয়– কারণ,গবর্মেণ্ট্‌ নহিলে কে তোমাদের সমাজকে ধারণ করিয়া রাখিবে? তোমাদের পক্ষে গবর্মেণ্ট্‌ যত একান্ত আবশ্যক, সৌভাগ্যক্রমে আমাদের পূর্বদেশের পক্ষে তত নয়। আমার কাছে এটা একটা অমঙ্গল বলিয়াই বোধ হয়; কিন্তু দেখিতেছি, ইহা নহিলেও তোমাদের চলিবার উপায় নাই। তবু এত বড়ো কাজটা যাহাকে দিয়া আদায় করিতে চাও, সেই যন্ত্রটার অসামান্য অপটুতা দেখিয়া আমি আরো আশ্চর্য হই। যোগ্য লোক-নির্বাচনের সুনিশ্চিত উপায় আবিষ্কার বা উদ্ভাবন করা দুরূহ সে কথা স্বীকার করি, কিন্তু তবু এটা বড়োই অদ্ভুত যে যাহাদের উপরে এমন একটা মহৎ ভার দেওয়া হয় তাহাদের ধর্মনৈতিক ও বুদ্ধিগত সামর্থ্যের কোনোপ্রকার পরীক্ষার চেষ্টা হয় না।

“ইলেক্‌শন ব্যাপারটার অর্থ কী? তোমরা মুখে বল, তাহার অর্থ জনসাধারণের দ্বারা প্রতিনিধিনির্বাচন–কিন্তু তোমরা মনে মনে কি নিশ্চয় জান না তাহার অর্থ তাহা নহে? বস্তুত এক-একটি দলীয় স্বার্থেরই প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়। জমিদার, মদের কারখানার কর্তা, রেল-কোম্পানির অধ্যক্ষ–ইহারাই কি তোমাদিগক শাসন করিতেছে না? আমি জানি একদল আছে তাহারা “মাস’ অর্থাৎ জনসাধারণের প্রচণ্ড পশুশক্তিকেও এই কর্তৃপক্ষদের দলভুক্ত করিয়া সামঞ্জস্য সাধন করিতে চাহে। কিন্তু তোমাদের দেশে জনসাধারণও যে একটা স্বতন্ত্র বিশেষ দল, তাহাদেরও একটা দলগত সংকীর্ণ স্বার্থ আছে। তোমাদের এই যন্ত্রটার উদ্দেশ্য দেখিতেছি, একটা গর্তের মধ্যে কতকগুলা প্রাইভেট স্বার্থের আত্মম্ভরি শক্তিকে ছাড়িয়া দেওয়া–তাহারা শুদ্ধমাত্র পরস্পর লড়াইয়ের জোরেই সাধারণের কল্যাণে উপনীত হইবে। ধর্ম এবং সদ্‌বিবেচনার কর্তৃত্বের উপর চীনেম্যানের এমন একটা মজ্জাগত শ্রদ্ধা আছে যে, তোমাদের এই প্রণালীকে আমার ভালোই বোধ হয় না। তোমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং অন্যত্র আমি এমন-সকল লোক দেখিয়াছি যাঁহারা তোমাদের ব্যবস্থাযোগ্য সমস্ত বিষয়গুলিকে সুগভীরভাবে আলোচনা করিয়াছেন, যাঁহাদের বুদ্ধি পরিষ্কৃত, বিচার পক্ষপাতশূন্য, উৎসাহ নিঃস্বার্থ এবং নির্মল, কিন্তু তাঁহারা তাঁহাদের প্রাজ্ঞতাকে কোনো কাজে লাগাইবার আশাও করিতে পারেন না–কারণ, তাঁহাদের প্রকৃতি, তাঁহাদের শিক্ষা, তাঁহাদের অভ্যাস, জানপাদিক ইলেক্‌শনের উপদ্রব সহ্য করিবার পক্ষে তাঁহাদিগকে অপটু করিয়াছে। পার্লামেণ্টের সভ্য হওয়াও একটা ব্যবসা-বিশেষ– এবং ধর্মনৈতিক ও মানসিক যে-সকল গুণ সাধারণের মঙ্গলসাধনের জন্য আবশ্যক এই ব্যবসায়ে প্রবেশ করিবার গুণ তাহা হইতে স্বতন্ত্র বলিয়াই বোধ হয়।’

আমি সংক্ষেপে চীনেম্যানের পত্রের প্রধান অংশগুলি উপরে বিবৃত করিলাম। এই পত্রগুলি পড়িলে প্রাচ্যসমাজের সাধারণ ভিত্তি সম্বন্ধে আমাদের পরস্পরের যে ঐক্য,তাহা বেশ স্পষ্ট বোঝা যায়। কিন্তু ইহাও দেখিতে পাই,এই-যে শান্তি এবং শৃঙ্খলা, সন্তোষ এবং সংযমের উপরে সমস্ত সমাজকে গড়িয়া তোলা, তাহার চরম সার্থকতার কথা এই চিঠিগুলির মধ্যে পাওয়া যায় না। চীনদেশ সুখী, সন্তুষ্ট, কর্মনিষ্ঠ হইয়াছে, কিন্তু সেই সার্থকতা পায় নাই। অসুখে অসন্তোষে মানুষকে ব্যর্থ করিতে পারে, কিন্তু সুখে সন্তোষে মানুষকে ক্ষুদ্র করে। চীন বলিতেছে, আমি বাহিরের কিছুতেই দৃক্‌পাত করি নাই; নিজের এলাকার মধ্যে নিজের সমস্ত চেষ্টাকে বদ্ধ করিয়া সুখী হইয়াছি। কিন্তু এ কথা যথেষ্ট নহে। এই সংকীর্ণতাটুকুর মধ্যে সকল উৎকর্ষ লাভ করাকেই চরম মনে করিলে হতাশ হইতে হয়। জলধারা যদি সমুদ্রকে চায়, তবে নিজেকে দুই তটের মধ্যে সংহত সংযত করিয়া তাহাকে চলিতে হয়, কিন্তু তাই বলিয়া নিজেকে এক জায়গায় আনিয়া বদ্ধ করিলে চলে না। মুক্তির জন্যই তাহাকে সংযত হইতে হয়, কিন্তু নিজেকে বন্দী করিলে তাহার চরম উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়–তাহা হইলে নদীকে ঝিল হইতে হয় এবং স্রোতের অন্তহীন ধারাকে সমুদ্রের অন্তহীন তৃপ্তির মধ্যে লইয়া যাওয়া হয় না।

ভারতবর্ষ সমাজকে সংযত সরল করিয়া তুলিয়াছিল, তাহা সমাজের মধ্যেই আবদ্ধ হইবার জন্য নহে। নিজেকে শতধাবিভক্ত অন্ধ চেষ্টার মধ্যে বিক্ষিপ্ত না করিয়া, সে আপন সংহত শক্তিকে অনন্তের অভিমুখে একাগ্র করিবার জন্যই ইচ্ছাপূর্বক বাহ্যবিষয়ে সংকীর্ণতা আশ্রয় করিয়াছিল। নদীর তটবন্ধনের ন্যায় সমাজবন্ধন তাহাকে বেগদান করিবে, বন্দী করিবে না, এই তাহার উদ্দেশ্য ছিল। এইজন্য ভারতবর্ষের সমস্ত ক্রিয়াকর্মের মধ্যে, সুখশান্তিসন্তোষের মধ্যে মুক্তির আহ্বান আছে–আত্মাকে ভূমানন্দে ব্রহ্মের মধ্যে বিকশিত করিয়া তুলিবার জন্যই সে সমাজের মধ্যে আপন শিকড় বাঁধিয়াছিল। যদি সেই লক্ষ্য হইতে ভ্রষ্ট হই, জড়ত্ববশত সেই পরিণামকে উপেক্ষা করি, তবে বন্ধন কেবল বন্ধনই থাকিয়া যায়, তবে অতিক্ষুদ্র সন্তোষশান্তির কোনো অর্থই থাকে না। ভারতবর্ষের লক্ষ্য ক্ষুদ্র নহে, তাহা ভারতবর্ষ স্বীকার করিয়াছে– ভূমৈব সুখং নাল্পে সুখমস্তি। ভূমাই সুখ, অল্পে সুখ নাই। ভারতের ব্রহ্মবাদিনী বলিয়াছেন : যেনাহং নামৃতা স্যাং কিমহং তেন কুর্যাম্‌। যাহার দ্বারা অমর না হইব তাহা লইয়া আমি কি করিব? কেবলমাত্র পারিবারিক শৃঙ্খলা এবং সামাজিক সুব্যবস্থার দ্বারা আমি অমর হইব না, তাহাতে আমার আত্মার বিকাশ হইবে না। সমাজ যদি আমাকে সম্পূর্ণ সার্থকতা না দেয়, তবে সমাজ আমার কে? সমাজকে রাখিবার জন্য যে আমাকে বঞ্চিত হইতে হইবে, এ কথা স্বীকার করা যায় না। য়ুরোপও বলে, জ্ঞভশধভৎভধয়তরঞ্চকে যে সমাজ পঙ্গু ও প্রতিহত করে সে সমাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ না করিলে হীনতা স্বীকার করা হয়। ভারতবর্ষও অত্যন্ত অসংকোচে নির্ভয়ে বলিয়াছে, আত্মার্থে পৃথিবীং ত্যজেৎ। সমাজকে মুখ্য করিলে উপায়কে উদ্দেশ্য করা হয়। ভারতবর্ষ তাহা করিতে চাহে নাই, সেইজন্য তাহার বন্ধন যেমন দৃঢ় তাহার ত্যাগও সেইরূপ সম্পূর্ণ। সাংসারিক পরিপূর্ণতার মধ্যে ভারতবর্ষ আপনাকে বেষ্টিত বদ্ধ করিত না, তাহার বিপরীতই করিত। যখন সমস্ত সঞ্চিত হইয়াছে, ভাণ্ডার পূর্ণ হইয়াছে, পুত্র বয়ঃপ্রাপ্ত হইয়া বিবাহ করিয়াছে, যখন সেই পূর্ণপ্রতিষ্ঠিত সংসারের মধ্যে আরাম করিবার–ভোগ করিবার–অবসর উপস্থিত হইয়াছে, ঠিক সেই সময়েই সংসার পরিত্যাগের ব্যবস্থা; যতদিন খাটুনি ততদিন তুমি আছ, যখন খাটুনি বন্ধ তখন আরামে ফলভোগের দ্বারা জড়ত্বলাভ করিতে বসা নিষিদ্ধ। সংসারের কাজ হইলেই সংসার হইতে মুক্তি হইল, তাহার পরে আত্মার অবাধ অনন্ত গতি। তাহা নিশ্চেষ্টতা নহে। সংসারের হিসাবে তাহা জড়ত্বের ন্যায় দৃশ্যমান, কিন্তু চাকা অত্যন্ত ঘুরিলে যেমন তাহাকে দেখা যায় না তেমনি আত্মার অত্যন্ত বেগকে নিশ্চলতা বলিয়া প্রতীয়মান হয়। আত্মার সেই বেগকে চতুর্দিকে নানারূপে অপব্যয় না করিয়া সেই শক্তিকে উদ্‌বোধিত করিয়া তোলাই আমাদের সমাজের কাজ ছিল। আমাদের সমাজে প্রবৃত্তিকে খর্ব করিয়া প্রত্যহই নিঃস্বার্থ মঙ্গলসাধনের যে ব্যবস্থা আছে তাহা ব্রহ্মলাভের সোপান বলিয়াই আমরা তাহা লইয়া গৌরব করি। বাসনাকে ছোটো করিলে আত্মাকেই বড়ো করা হয়,এইজন্যই আমরা বাসনা খর্ব করি– সন্তোষ অনুভব করিবার জন্য নহে। য়ুরোপ মরিতে রাজি আছে, তবু বাসনাকে ছোটো করিতে চায় না। আমরাও মরিতে রাজি আছি, তবু আত্মাকে তাহার চরমগতি পরমসম্পদ হইতে বঞ্চিত করিয়া ছোটো করিতে চাই না। দুর্গতির দিনে ইহা আমরা বিস্মৃত হইয়াছি–সেই সমাজ আমাদের এখনো আছে, কিন্তু তাহার ভিতর দিয়া ব্রহ্মাভিমুখী মোক্ষাভিমুখী বেগবতী স্রোতোধারা “যেনাহং নামৃতা স্যাং কিমহং তেন কুর্যাম্‌’ এই গান করিয়া ধাবিত হইতেছে না–

মালা ছিল তার ফুলগুলি গেছে
রয়েছে ডোর।

সেইজন্য আমাদের এতদিনকার সমাজ আমাদিগকে বল দিতেছে না, গৌরব দিতেছে না, আধ্যাত্মিকতার দিকে আমাদিগকে অগ্রসর করিতেছে না; আমাদিগকে চতুর্দিকে প্রতিহত করিয়া রাখিয়াছে। এই সমাজের মহৎ উদ্দেশ্য যখন আমরা সচেতনভাবে বুঝিব, ইহাকে সম্পূর্ণ সফল করিবার জন্য যখন সচেষ্টভাবে উদ্যত হইব, তখনই মুহূর্তের মধ্যে বৃহৎ হইব, মুক্ত হইব, অমর হইব–জগতের মধ্যে আমাদের প্রতিষ্ঠা হইবে, প্রাচীন ভারতের তপোবনে ঋষিরা যে যজ্ঞ করিয়াছিলেন তাহা সফল হইবে এবং পিতামহগণ আমাদের মধ্যে কৃতার্থ হইয়া আমাদিগকে আশীর্বাদ করিবেন।

আষাঢ়, ১৩০৯

<

Rabindranath Tagore ।। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর