ভোরবেলা ঘুম ভাঙল আজান শুনে। নমাজ পড়ালেন বুখারার এক পুস্তিন সদাগর। উৎকৃষ্ট আরবী উচ্চারণ শুনে বিস্ময় মানলুম যে তুর্কীস্থানে এত ভালো উচ্চারণ টিকে রইল কি করে। বেতারওয়ালাকে জিজ্ঞাসা করাতে তিনি বললেন, আপনি নিজেই জিজ্ঞেস করুন না। আমি বললুম, কিছু যদি মনে করেন? আমার এই সঙ্কোচে তিনি এত আশ্চর্য হলেন যে বুঝতে পারলুম, খাস প্রাচ্য দেশে অচেনা অজানা লোককে যে কোনো প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে বাধা নেই। পরে জানলুম, যার সম্বন্ধে কৌতূহল দেখানো হয় সে তাতে বরঞ্চ খুশীই হয়।

মোটরে বসে তারি খেই তুলে নিয়ে আগের রাতের অভিজ্ঞতার জমাখরচা নিতে লাগলুম।

গ্রেট ইস্টার্ন পান্থশালা, আফগান সরাইও পান্থশালা। সরাইয়ের আরাম-ব্যারাম তো দেখা হল— গ্রেট ইস্টার্ন, গ্র্যাণ্ডেরও খবর কিছু কিছু জানা আছে।

মার্কস না পড়েও চোখে পড়ে যে সরাই গরীব, হোটেল ধনী। কিন্তু প্রশ্ন তাই দিয়ে কি সব পার্থক্যের অর্থ করা যায়? সরাইয়েও জন আষ্টেক এমন সদাগর ছিলেন যারা অনায়াসে গ্রেট ইস্টার্নের সুইট নিতে পারেন। তাঁদের সঙ্গে আলাপচারি হয়েছে। গ্রেট ইস্টার্নের বড়সায়েবদেরও কিছু কিছু চিনি।

কিন্তু আচারব্যবহারে কী ভয়ঙ্কর তফাত। এই আটজন ধনী সদাগর ইচ্ছে করলেই একত্র হয়ে উত্তম খানাপিনা করে জুয়োয় দু শ চার শ টাকা এদিক ওদিকে ছড়িয়ে দিয়ে রাত কাটাতে পারতেন। চাকরবাকর সন্ত্রস্ত হয়ে হুজুরদের হুকুম তামিল করত— সরাইয়ের ভিখিরি ফকিরদের তল ঠেকিয়ে রাখতই, সাধুসজ্জনদের সঙ্গেও এদের কোনো যোগাযোগ হত না।

পৃথক হয়ে আপন আপন দ্বিরদরদস্তম্ভে এরা তো বসে থাকলেনই না— আটজনে মিলে খানদানী গোঠও এরা পাকালেন না। নিজ নিজ পণ্যবাহিনীর ধনী গরীব আর পাঁচজনের সঙ্গে এদের দহরম-মহরম আগের থেকে তো ছিলই, তার উপরে সরাইয়ে আসন পেতে জিরিয়েজুরিয়ে নেওয়ার পর তারা আরো পাঁচজনের তত্ত্বতাবাশ করতে আরম্ভ করলেন। তার ফলে হরেক রকমের আজ্ঞা জমে উঠল; ধনী গরীবের পার্থক্য জামা কাপড়ে টিকে থাকল বটে কিন্তু কথাবার্তায় সে সব তফাত রইল না। দু-চারটে মোসাহেব ইয়েমেন ছিল সন্দেহ নেই, তা সে গরীব আড্ডা-সর্দারেরও থাকে। ব্যবসাবাণিজ্য, তত্ত্বকথা, দেশ-বিদেশের রাস্তাঘাট-গিরিসঙ্কট, ইংরেজ-রুশের মন-কষাকষি, পাগলা উট কামড়ালে তার দাওয়াই, সর্দারজীর মাথার ছিট, সব জিনিস নিয়েই আলোচনা হল। গরীব ধনী সকলেরই সকল রকম সমস্যা আর দয়ে মজে কখনো ডুবল কখনো ভাসল; কিন্তু বাকচতুর গরীবও ধনীর পোলাও-কালিয়ার আশায় বেশরম বাদরনাচ নাচল না।

ঝগড়া-কাজিয়াও আড়ার চোখের সামনের চাতালে হচ্ছে। কথাবার্তার খোঁচাখুচিতে যতক্ষণ উভয়পক্ষ সন্তুষ্ট ততক্ষণ আড্ডা সে সব দেখেও দেখে না, শুনেও শোনে না, কিন্তু মারামারির পূর্বাভাস দেখা দিলেই কেউ-না-কেউ মধ্যস্থ হয়ে বখেড়া ফৈালা করে দেয়। মনে পড়ল বায়স্কোপের ছবি : সেখানে দুই সায়েবে ঝগড়া লাগে, আর পাঁচজন হটে গিয়ে জায়গা করে দিয়ে গোল হয়ে দাঁড়ায়। দুই পায়েব তখন কোট খুলে ছুঁড়ে ফেলেন, আর সকলের দয়ার শরীর, কোটটাকে ধুলোয় গড়াতে দেন না, লুফে নেন। তারপর শুরু হয় ঘুষোঘুষি রক্তারক্তি। পাঁচজন বিনা টিকিটে তামাসা দেখে আর সমস্ত বর্বরতাটাকে অন্য লোকের নিতান্ত ঘরোয়া ব্যাপার নাম দিয়ে ক্ষীণ বিবেকদংশনে প্রলেপ লাগায়।

সরাইয়ে কারো কোনো নিতান্ত ঘরোয়া ব্যাপার নেই। তাই পার্সোনাল ইডিয়সিংক্রেসি বা খেয়াল খুশীর ছিট নিয়ে কেউ সরাইয়ে আশ্রয় নেয় না। অথবা বলতে পারেন, সকলেই যে যার খুশী মত কাজ করে যাচ্ছে, আপনি আপত্তি জানাতে পারবেন না, আর আপনিও আপনার পছন্দ মত যা খুশী করে যাবেন, কেউ বাধা দেবে না। হাতাহাতি না হলেই হল।

তাতে করে ভালো মন্দ দুই-ই হয়। একদিকে যেমন গরম, ধুলো, তৃষ্ণা সত্ত্বেও মানুষ একে অন্যকে প্রচুর বরদাস্ত করতে পারে, অন্যদিকে তেমনি সকলেই সরাইয়ের কুঠরি-চত্বর নির্মমভাবে নোংরা করে।

একদিকে নিবিড় সামাজিক জীবনযাত্রা, অন্যদিকে ব্যক্তিগত স্বাধীনতার চূড়ান্ত বিকাশ। অর্থাৎ কমুনিটি সেন্স আছে কিন্তু সিভিক সেন্স নেই।

ভাবতে ভাবতে দেখি সরাইয়ে এক রাত্রি বাস করেই আমি আফগান তুর্কোমান সম্বন্ধে নানারকম মতবাদ সৃষ্টি করতে আরম্ভ করেছি। হুশিয়ার হয়ে ভিতরের দিকে তাকানো বন্ধ করলুম। কিন্তু বাইরের দিকে তাকিয়েই দেখব আর কি? সেই আগের দিনকার জনপদ বা জনশূন্য শিলাপর্বত।

সর্দারজীকে বললুম, রাত্তিরে যখন গা বিড়োচ্ছিল তখন একটু সুপুরি পেলে বড় উপকার হত। কিন্তু সরাইয়ে পানের দোকান তো দেখলুম না।

সর্দারজী বললেন, পান কোথায় পাবেন, বাবুসায়েব। পেশাওয়ারেই শেষ পানের দোকান। তার পশ্চিমে আফগানিস্থান ইরান, ইরাকের কোথাও পান দেখিনি— পল্টনে ড্রাইভারি করার সময় এসব দেশ আমার ঘোরা হয়ে গিয়েছে। পাঠানও তো পান খায় না। পেশাওয়ারের পানের দোকানের গাহক সব পাঞ্জাবী।

তাই তো। মনে পড়ল, কলুটোলা জাকারিয়া স্ত্রীটে হোটেলের গাড়ি বারান্দার বেঞ্চে বসে কাবুলীরা শহর রাঙা করে না বটে। আরো মনে পড়ল, দক্ষিণ-ভারতে বর্মা মালয়ে এমন কি খাসিয়া পাহাড়েও প্রচুর পান খাওয়া হয় যদিও এদের কেউই কাশীলক্ষ্ণৌয়ের মত তরিবৎ করে জিনিসটার রস উপভোগ করতে জানে না। তবে কি পান অনার্য জিনিস? পান কথাটা তো আর্য–কর্ণ থেকে কান, পর্ণ থেকে পান। তবে সুপারি? উহু, কথাটা তো সংস্কৃত নয়। লক্ষৌয়ে বলে ডলি অথবা ছালিয়া–সেগুলোও তো সংস্কৃত থেকে আসেনি। কিন্তু পূর্ববঙ্গে গুয়া কথাটার গুবাক না গূবাক কি একটা সংস্কৃত রূপ আছে না? কিন্তু তাহলেও তো কোনো কিছুর সমাধান হয় না, কারণ পাঞ্জাব দোয়াব এসব উন্নাসিক আর্যভূমি ত্যাগ করে খাঁটি গুবাক হঠাৎ পূর্ববঙ্গে গিয়ে গাছের ডগায় আশ্রয় নেবেন কেন? আজকের দিনে হিন্দু-মুসলমানের সব মাঙ্গলিকেই সুপারির প্রয়োজন হয়, কিন্তু গৃহসূত্রের ফিরিস্তিতে গুবাক–গুবাক? নাঃ। মনে তো পড়ে না। তবে কি এ নিতান্তই অনার্যজনসুলভ সামগ্রী? পূর্বপ্রাচ্য থেকে উজিয়ে উজিয়ে পেশাওয়ার অবধি পৌঁচেছে? সাধে বলি, ভারতবর্ষ তাবৎ প্রাচ্য সভ্যতার মিলনভূমি।

ডিমোক্রসি ডিমোক্রসি জিগির তুলে বড় বেশী চেঁচামেচি করাতে দক্ষিণ-ভারতের এক সাধক বলেছিলেন, তাহলে সবাই ঘুমিয়ে পড়। ঘুমন্ত অবস্থায় মানুষে মানুষে ভেদ থাকে না, সবাই সমান। সেই গরমে বসে বসে তত্ত্বটি সম্পূর্ণ হৃদয়ঙ্গম করলুম। ঝাঁকুনি, ধুলো, কঠিন আসন, ক্ষুধাতৃষ্ণা সত্বেও বেতারকর্তা ও আমার দুজনেরই ঘুম পাচ্ছিল। মাঝে মাঝে তাঁর মাথা আমার কাঁধে ঢলে পড়ছিল, আমি তখন শক্ত হয়ে বসে তার ঘুমে তা দিচ্ছিলুম। তারপর হঠাৎ একটা জোর ঝাঁকুনি খেয়ে ধড়মড়িয়ে জেগে উঠে তিনি আমার কাছে মাফ চেয়ে শক্ত হয়ে বসছিলেন। তখন আমার পালা। শত চেষ্টা সত্ত্বেও ভদ্রতার বেড়া ভেঙে আমার মাথা তার কাধে জিরিয়ে নিচ্ছিল।

চোখ বন্ধ অবস্থায়ই ঠাণ্ডা হাওয়ার প্রথম পরশ পেলুম; খুলে দেখি সামনে সবুজ উপত্যকা রাস্তার দুদিকে ফসল ক্ষেত। সর্দারজী পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, জলালাবাদ।

দক্কার পাশের সেই কাবুল নদীর কৃপায় এই জলালাবাদ শস্যশস্পশ্যামল। এখানে জমি বোধ হয় দক্কার মত পাথরে ভর্তি নয় বলে উপত্যকা রীতিমত চওড়া একটু নিচু জমিতে বাস নামার পর আর তার প্রসারের আন্দাজ করা যায় না। তখন দুদিকেই সবুজ, আর লোকজনের ঘরবাড়ি। সামান্য একটি নদী ক্ষুদ্রতম সুযোগ পেলে যে কি মোহন সবুজের লীলাখেলা দেখাতে পারে জলালাবাদে তার অতি মধুর তসবির। এমনকি যে দুটো-চারটে পাঠান রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল তাদের চেহারাও যেন সীমান্তের পাঠানের চেয়ে মোলায়েম বলে মনে হল। লক্ষ্য করলুম, যে পাঠান শহরে গিয়ে সেখানকার মেয়েদের বেপর্দামির নিন্দা করে তারি বউ-ঝি ক্ষেতে কাজ করছে অন্য দেশের মেয়েদেরই মত। মুখ তুলে বাসের দিকে তাকাতেও তাদের আপত্তি নেই। বেতারকর্তাকে জিজ্ঞাসা করতে তিনি গভীরভাবে বললেন, আমার যতদূর জানা, কোনো দেশের গরীব মেয়েই পদ মানে না, অন্ততঃ আপন গাঁয়ে মানে না। শহরে গিয়ে মধ্যবিত্তের অনুকরণে কখনো পর্দা মেনে ভদ্রলোক হবার চেষ্টা করে, কখনো কাজ-কর্মের অসুবিধা হয় বলে গাঁয়ের রেওয়াজই বজায় রাখে।

আমি জিজ্ঞাসা করলুম, আরবের বেদুইন মেয়েরা?

তিনি বললেন, আমি ইরাকে তাদের বিনা পর্দায় ছাগল চরাতে দেখেছি।

থাকু উপস্থিত এ সব আলোচনা। গোটা দেশটা প্রথম দেখে নিই, তারপর রীতি-রেওয়াজ ভালো-মন্দের বিচার করা যাবে।

গাড়ি সদর রাস্তা ছেড়ে জলালাবাদ শহরে ঢুকল। কাবুলীরা সব বাসের পেট থেকে বেরিয়ে এক মিনিটের ভিতর অন্তর্ধান। কেউ একবার জিজ্ঞেস পর্যন্ত করল না, বাস ফের ছাড়বে কখন। আমার তো এই প্রথম যাত্রা, তাই সর্দারজীকে শুধালুম, বাস আবার ছাড়বে কখন? সর্দারজী বললেন, আবার যখন সবাই জড়ো হবে। জিজ্ঞেস করলুম, সে কবে? সর্দারজী যেন একটু বিরক্ত হয়ে বললেন, আমি তার কি জানি? সবাই খেয়েদেয়ে ফিরে আসবে যখন, তখন।

বেতারকর্তা বললেন, ঠায় দাঁড়িয়ে করছেন কি? আসুন আমার সঙ্গে।

আমি শুধালুম, আর সব গেল কোথায়? ফিরবেই বা কখন?

তিনি বললেন, ওদের জন্য আপনি এত উদ্বিগ্ন হচ্ছেন কেন? আপনি তো ওদের মালজানের জিম্মাদার নন।

আমি বললুম, তাতো নই-ই। কিন্তু যে রকমভাবে হুট করে সবাই নিরুদ্দেশ হল তাতে তো মনে হল না যে ওরা শিগগির ফিরবে আজ সন্ধ্যায় তা হলে কাবুল পৌঁছব কি করে?

বেতারকর্তা বললেন, সে আশা শিকেয় তুলে রাখুন। এদের তো কাবুল পৌঁছবার কোনো তাড়া নেই। বাস যখন ছিল না, তখন ওরা কাবুল পৌঁছত পনেরো দিনে, এখন চারদিন লাগলেও তাদের আপত্তি নেই। ওরা খুশী, ওদের হেঁটে যেতে হচ্ছে না, মালপত্র তদারক করে গাধা-খচ্চরের পিঠে চাপাতে-নামাতে হচ্ছে না, তাদের জন্য বিচুলির সন্ধান করতে হচ্ছে না। জলালাবাদে পোঁচেছে, এখানে সকলেরই কাকা-মামা-শালা, কেউ না কেউ আছে, তাদের তত্ত্বতাবাশ করবে, খাবেদাবে, তারপর ফিরে আসবে।

আমি চুপ করে গেলুম। দাঁতে অফিসারকে বলেছিলুম, আর পাঁচজনের যা গতি আমারও তাই হবে, এখন বুঝতে পারলুম সব মানুষই কিছু-না-কিছু ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে। তফাত শুধু এইটুকু কেউ করে জেনে, কেউ না জেনে।

আফগানিস্থানের বড় শহর পাঁচটি। কাবুল, হিরাত, গজনী, জালালাবাদ, কান্দাহার। জলালাবাদ আফগানিস্থানের শীতকালের রাজধানী। তাই এখানে রাজপ্রাসাদ আছে, সরকারী কর্মচারীদের জন্য খাস পান্থনিবাস আছে।

বেতারবাণী যখন বলছেন, তখন নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু উপস্থিত জালালাবাদের বাজার দেখে আফগানিস্থানের অন্যতম প্রধান নগর সম্বন্ধে উচ্ছ্বসিত হওয়ার কোনো কারণ খুঁজে পেলুম না। সেই নোংরা মাটির দেয়াল, অত্যন্ত গরীব দোকানপাট সস্তা জাপানী মালে ভর্তি বিস্তর চায়ের দোকান, আর অসংখ্য মাছি। হিমালয়ের চট্টিতে মানুষ যে রকম মাছি সম্বন্ধে নির্বিকার এখানেও ঠিক তাই।

হঠাৎ আখ দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল। চৌকো চৌকো করে কেটে দোকানের সামনে সাজিয়ে রেখেছে এবং তার উপরে দুনিয়ার সব মাছি বসাতে চেহারাটা চালে-তিলের মত হয়ে গিয়েছে। ঘিনপিত ঝেড়ে ফেলে কিনলুম এবং খেয়ে দেখলুম, দেশের আখের চেয়েও মিষ্টি। সাধে কি বাবুর বাদশা এই আখ খেয়ে খুশী হয়ে তার নমুনা বদখশানবুখারায় পাঠিয়েছিলেন। তারপর দেখি, নোনা ফুটি শশা তরমুজ। ঘন সবুজ আর সোনালী হলদেতে ফলের দোকানে রঙের অপূর্ব খোলতাই হয়েছে খুশবাই চতুর্দিক মাত করে রেখেছে। দরদস্তুর না করে কিনলেও ঠকবার ভয় নেই। রপ্তানি করার সুবিধে নেই বলে সব ফলই বেজায় সস্তা। বেতারবার্তা জ্ঞান বিতরণ করে বললেন, যারা সত্যিকার ফলের রসিক তারা এখানে সমস্ত গ্রীষ্মকালটা ফল খেয়েই কাটায় আর যারা পাঁড় মেওয়া-খোর তারা শীতকালেও কিসমিস আখরোট পেস্তা বাদামের উপর নির্ভর করে। মাঝে মাঝে রুটি-পনির আর কচিৎ কখনো এক টুকরো মাংস। এরাই

সব চাইতে দীর্ঘজীবী হয়।

আমি জিজ্ঞেস করলুম, এদের গায়ে বুলেট লাগে না বুঝি? জলালাবাদের ফল তা হলে মন্ত্রপূত বলতে হয়।

বেতারবার্তা বললেন, জলালাবাদের লোক গুলী খেতে যাবে কেন? তারা শহরে থাকে, আইনকানুন মানে, হানাহানির কিবা জানে?

কিন্তু জলালাবাদের যথার্থ মাহাত্ম্য শহরের বাইরে। আপনি যদি ভূবিদ্যার পাণ্ডিত্য প্রকাশ করতে চান তবে কিঞ্চিৎ খোঁড়াখুড়ি করলেই আপনার মনস্কামনা পূর্ণ হবে। আপনি যদি নৃতত্ত্বের অনুসন্ধান করতে চান তবে চারিদিকের নানাপ্রকারের অনুন্নত উপজাতি আপনাকে দেদার মালমশলা যোগাড় করে দেবে। যদি মার্কসবাদের প্রাচ্যদেশীয় পটভূমি তৈরী করতে চান তবে মাত্র এঙেল্‌সের অরিজিন অব দি ফ্যামিলি খানা সঙ্গে নিয়ে আসুন, বাদবাকি সব এখানে পাবেন–জলালাবাদের গ্রামাঞ্চলে পরিবারপত্তনের ভিৎ, আর এক শ মাইল দূরে কাবুলে রাষ্ট্রনির্মাণের গম্বুজশিখর বিরাজমান। যদি ঐতিহাসিক হন তবে গান্ধারী, সিকন্দর, বাবুর, নাদিরের বিজয় অভিযান বর্ণনার কতটা খাঁটী কতটা ঝুটা নিজের হাতে যাচাই করে নিতে পারবেন। যদি ভূগোল অর্থনীতির সময়ে প্রমাণ করতে চান যে, তিন ফোঁটা নদীর জল কি করে নব নব মন্বন্তরের কারণ হতে পারে তাহলে জলালাবাদে আস্তানা গেড়ে কাবুল নদীর উজান ভাটা করুন। আর যদি গ্রীক-ভারতীয় ভাস্কর্যের প্রয়াগভূমির অনুসন্ধান করেন তবে তার রঙ্গভূমি তো জালালাবাদের কয়েক মাইল দূরে হাদ্দা গ্রামে। ধ্যানী বুদ্ধ, কঙ্কালসার বুদ্ধ, অমিতাভ বুদ্ধ যত রকমের মূর্তি চান, গান্ধার-শৈলীর যত উদাহরণ চান সব উপস্থিত। মাটির উপরে কিঞ্চিৎ, ভিতরে প্রচুর। ঢিপিটাপা দেখামাত্র অজ্ঞ লোকেও বলতে পারে।

আর যদি আপনি পাণ্ডিত্যের বাজারে সত্যিকার দাও মারতে চান তবে দেখুন, সিন্ধুর পারে মোন্-জোড় বেরল, ইউফ্রেটিস টাইগ্রিসের পারে আসিরীয় বেবিলনীয় সভ্যতা বেরল, নীলের পারে মিশরীয় সভ্যতা বেরল এর সব কটাই পৃথিবীর প্রাকআর্য প্রাচীন সভ্যতা। শুনতে পাই, নর্মদার পারে ঐরকম একটা দাও মারার জন্য একপাল পণ্ডিত মাথায় গামছা বেঁধে শাবল নিয়ে লেগে গিয়েছেন। সেখানে গিয়ে বাজার কোণঠাসা করতে পারবেন না, উল্টে দেউলে হবার সম্ভাবনাই বেশী। আর যদি নিতান্তই বরাতজোরে কিছু একটা পেয়ে যান তবে হবেন না হয় রাখাল বাঁড় জ্যে। একপাল মার্শাল উড়োউড়ি করছে, ছোঁ মেরে আপনারি কাঁচামাল বিলেত নিয়ে গিয়ে তিন তলুম চামড়ায় বেঁধে আপনারি মাথায় ছুঁড়ে মারবে। শোনেননি, গুণী বলেছেন, একবার ঠকলে ঠকের দোষ, দুবার ঠকলে তোমার দোষ। তাই বলি, জালালাবাদ যান, মোন্-জোড়োর কনিষ্ঠ ভ্রাতার উদ্ধার করুন, তাতে ভারতের গর্ব বারো আনা, আফগানিস্থানের চার আনা। বিশেষতঃ যখন আফগানিস্থানে কাক চিল নেই আপনার মেহয়তের মাল নিয়ে তারা চুরিচামারি করবে না।

জানি, পণ্ডিত মাত্রই সন্দেহ-পিশাচ। আপনিও বলবেন, না হয় মানলুম, জলালাবাদের জমির শুধু উপরেই নয়, নিচেও বিস্তর সোনার ফসল ফলে আছে, কিন্তু প্রশ্ন, চতুর্দিক থেকে অ্যাদ্দিন ধরে ঝাঁকে ঝাঁকে বুলবুলির পাল সেখানে ঝামেলা লাগায়নি কেন?

তার কারণ তো বেতারবাণী বহু পূর্বেই বলে দিয়েছেন। ইংরেজ এবং অন্য হরেক রকম সাদা বুলবুলিকে আফগান পছন্দ করে না। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের পাণ্ডিত্যাম্বরে উপস্থিত যে কয়টি পক্ষী উডডীয়মান তাদের সর্বাঙ্গে শ্বেতকুষ্ঠ, এখানে তাদের প্রবেশ নিষেধ। কিন্তু আপনার রঙ দিব্য বাদামী, আপনি প্রতিবেশী, আফগান আপনাকে বহু শতাব্দী ধরে চেনে— আপনি না হয় তাকে ভুলে গিয়েছেন, আপনারি জাতভাই বহু ভারতীয় এখনো আফগানিস্থানে ছোটখাটো নানা ধান্দায় ঘোরাঘুরি এমন কি বসবাসও করে, আপনাকে আনাচে কানাচে ঘুরতে দেখলে কাবলীওয়ালা আর যা করে করুক, আঁৎকে উঠে কেঁৎকা খুজবে না।

তবু শুনবেন না? সাধে বলি, সব কিছু পণ্ড না হলে পণ্ডিত হয় না।

<

Syed Mujtaba Ali ।। সৈয়দ মুজতবা আলী