পুরাণে কথিত হইয়াছে যে, কংসবধের পর কৃষ্ণ বলরাম কাশীতে সান্দীপনি ঋষির নিকট শিক্ষার্থে গমন করিলেন, এবং চতুঃষষ্টিদিবসমধ্যে শস্ত্রবিদ্যায় সুশিক্ষিত হইয়া গুরুদক্ষিণা প্রদানান্তে মথুরায় প্রত্যাগমন করিলেন।
কৃষ্ণের শিক্ষা সম্বন্ধে ইহা ছাড়া আর কিছু পুরাণেতিহাসে পাওয়া যায় না। নন্দালয়ে তাঁহার কোন প্রকার শিক্ষা হওয়ার কোন প্রসঙ্গ কোন গ্রন্থে পাওয়া যায় না। অথচ নন্দ জাতিতে বৈশ্য ছিলেন, বৈশ্যদিগের বেদে অধিকার ছিল। বৈশ্যালয়ে তাঁহাদিগের কোনও প্রকার বিদ্যাশিক্ষা না হওয়া বিচিত্র বটে। বোধ হয়, শিক্ষার সময় উপস্থিত হইবার পূর্বেই তিনি নন্দালয় হইতে মথুরায় পুনরানীত হইয়াছিলেন। পূর্ব-পরিচ্ছেদে মহাভারত হইতে যে কৃষ্ণবাক্য উদ্ধৃত করা গিয়াছে, তাহা হইতে এরূপ অনুমানই সঙ্গত যে, কংসবধের অনেক পূর্ব হইতেই তিনি মথুরায় বাস করিতেছিলেন, এবং মহাভারতের সভাপর্বে শিশুপালকৃত কৃষ্ণনিন্দায় দেখা যায় যে, শিশুপাল তাহাকে কংসের অন্নভোজী বলিতেছে—
“যস্য চানেন ধর্মজ্ঞ ভুক্তমন্নং বলীয়সঃ।
স চানেন হতঃ কংস ইত্যেতন্ন মহাদ্ভুতং ||”
মহাভারতম্, সভাপর্ব, ৪০ অধ্যায়ঃ।
অতএব বোধ হয়, শিক্ষার সময় উপস্থিত হইতে না হইতেই কৃষ্ণ মথুরায় আনীত হইয়াছিলেন। বৃন্দাবনের গোপীদিগের সঙ্গে গ্রথিত কৈশোরলীলা যে উপন্যাস মাত্র, ইহা তাহার অন্যতর প্রমাণ।
মথুরাবাসকালেও তাঁহার কিরূপ শিক্ষা হইয়াছিল, তাহারও কোন বিশিষ্ট বিবরণ নাই। কেবল সান্দীপনি মুনির নিকট চতুঃষষ্টি দিবস অস্ত্রশিক্ষার কথাই আছে। যাঁহারা কৃষ্ণকে ঈশ্বর বলিয়া জানেন, তাঁহাদের মধ্যে কেহ কেহ বলিতে পারেন, সর্বজ্ঞ ঈশ্বরের আবার শিক্ষার প্রয়োজন কি? ফলতঃ কৃষ্ণ ঈশ্বরের অবতার হইলেও মানবধর্মাবলম্বী এবং মানুষী শক্তি দ্বারাই সকল কার্য সম্পন্ন করেন, এ কথা আমরা পূর্বে বলিয়াছি এবং এক্ষণেই তাহার ভূরি ভূরি প্রমাণ দেখাইব। মানুষী শক্তি দ্বারা কর্ম করিতে গেলে, শিক্ষার দ্বারা সেই মানুষী শক্তিকে অনুশীলিত এবং স্ফূরিত করিতে হয়। যদি মানুষী শক্তি সেই স্বতঃস্ফূরিত হইয়া সর্বকার্যসাধনক্ষম হয়, তাহা হইলে সে ঐশী শক্তি-মানুষী শক্তি নহে। কৃষ্ণের যে মানুষী শিক্ষা হইয়াছিল, তাহা এই সান্দীপনিবৃত্তান্ত ভিন্ন আরও প্রমাণ আছে। তিনি সমগ্র বেদ অধ্যয়ন করিয়াছিলেন। মহাভারতের সভাপর্বে অর্ঘাভিহরণ-পর্বাধ্যায়ে কৃষ্ণের পূজ্যতা বিষয়ে ভীষ্ম একটি হেতু এই নির্দেশ করিতেছেন যে, কৃষ্ণ নিখিল বেদবেদাঙ্গপারদর্শী। তাদৃশ বেদবেদাঙ্গজ্ঞানসম্পন্ন দ্বিতীয় ব্যক্তি দুর্লভ।
“বেদবেদাঙ্গবিজ্ঞানাং বলং চাপ্যধিকং তথা।
নৃণাং লোকে হি কোহন্যোহস্তি বিশিষ্টঃ কেশবাদৃতে ||
মহাভারতম্, সভাপর্ব, ৩৮ অধ্যায়ঃ।
মহাভারতে কৃষ্ণের বেদজ্ঞতা সম্বন্ধে এইরূপ আরও ভূরি ভূরি প্রমাণ পাওয়া যায়। এই বেদজ্ঞতা স্বতঃলব্ধও নহে। ছান্দোগ্য উপনিষদে প্রমাণ পাইয়াছি যে, তিনি আঙ্গিরস-বংশীয় ঘোর ঋষির নিকট অধ্যয়ন করিয়াছিলেন।
সে সময় শ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয়দিগের উচ্চশিক্ষার উচ্চাংশকে তপস্যা বলিত। শ্রেষ্ঠ রাজর্ষিগণ কোন সময়ে না কোন সময়ে তপস্যা করিয়াছিলেন, এইরূপ কথা প্রায় পাওয়া যায়। আমরা এক্ষণে তপস্যা অর্থে যাহা বুঝি, বেদের অনেক স্থানেই দেখা যায় যে, তপস্যার প্রকৃত অর্থ তাহা নহে। আমরা বুঝি, তপস্যা অর্থে বনে বসিয়া চক্ষু বুজিয়া নিশ্বাস রুদ্ধ করিয়া পানাহার ত্যাগ করিয়া ঈশ্বরের ধ্যান করা। কিন্তু দেবতাদিগের মধ্যে কেহ কেহ এবং মহাদেবও তপস্যা করিয়াছিলেন, ইহাও কোন কোন গ্রন্থে পাওয়া যায়। বিশেষতঃ শতপথব্রাহ্মণে আছে যে, স্বয়ং পরব্রহ্ম সিসৃক্ষু হইলে তপস্যার দ্বারাই সৃষ্টি করিলেন, যথা—
সোহকাময়ত। বহুঃ স্যাং প্রজায়েয়েতি। স তপোহতপ্যত। স তপস্তপ্ত্বা ইদং সর্বমসৃজত।[1] অর্থ,—“তিনি ইচ্ছা করিলেন, আমি প্রজাসৃষ্টির জন্য বহু হইব। তিনি তপস্যা করিলেন। তপস্যা করিয়া এই সকল সৃষ্টি করিয়াছিলেন।”
এ সকল স্থানে তপস্যা অর্থে এই রকমই বুঝিতে হয় যে, চিত্ত সমাহিত করিয়া আপনার শক্তি সকলের অনুশীলন ও স্ফুরণ করিয়াছিলেন। মহাভারতে কথিত আছে যে, কৃষ্ণ দশ বৎসর হিমালয় পর্বতে তপস্যা করিয়াছিলেন। মহাভারতের ঐশিক পর্বে লিখিত আছে যে, অশ্বত্থামাপ্রযুক্ত ব্রহ্মশিরা অস্ত্রের দ্বারা উত্তরার গর্ভপাতের সম্ভাবনা হইলে, কৃষ্ণ সেই মৃতশিশুকে পুনরুজ্জীবিত করিতে প্রতিজ্ঞারূঢ় হইয়াছিলেন, এবং তখন অশ্বত্থামাকে বলিয়াছিলেন যে, তুমি আমার তপোবল দেখিবে।
আদর্শ মনুষ্যের শিক্ষা আদর্শ শিক্ষাই হইবে। ফলও সেইরূপ দেখি। কিন্তু সেই প্রাচীন কালের আদর্শ শিক্ষা কিরূপ ছিল, তাহা কিছুই জানিতে পারা গেল না, ইহা বড় দুঃখের বিষয়।

—————————-
1 ২ বল্লী, অনুবাক।

<

Bankim Chandra Chattopadhyay ।। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়