তৃতীয় পরিচ্ছেদ—দ্বিতীয় স্তরের কবি

আমরা এত দূর পর্যন্ত সোজা পথে সুবিধামত চলিয়া আসিতেছিলাম; কিন্তু এখন হইতে ঘোরতর গোলযোগ। মহাভারত সমুদ্রবিশেষ, কিন্তু এতক্ষণ আমরা, তাহার স্থির বারিরাশিমধ্যে মধুর মৃদুগম্ভীর শব্দ শুনিতে শুনিতে সুখে নৌযাত্রা করিতেছিলাম। এক্ষণে সহসা আমরা ঘোর ব্যাত্যায় পড়িয়া, তরঙ্গাভিঘাতে পুনঃ পুনঃ উৎক্ষিপ্ত নিক্ষিপ্ত হইব। কেন না, এখন আমরা বিশেষ প্রকারে মহাভারতের দ্বিতীয় স্তরের কবির হাতে পড়িলাম। তাঁহার হস্তে কৃষ্ণচরিত্র সম্পূর্ণ পরিবর্তিত হইয়াছে। যাহা উদার ছিল, তাহা এক্ষণে ক্ষুদ্র ও সংকীর্ণ হইয়া পড়িতেছে; যাহা সরল, তাহা এক্ষণে কৌশলময়। যাহা সত্যময় ছিল, তাহা এক্ষণে অসত্য ও প্রবঞ্চনার আকর; যাহা ন্যায় ও ধর্মের অনুমোদিত ছিল, তাহা এক্ষণে অন্যায় ও অধর্মে কলুষিত। দ্বিতীয় স্তরের কবির হাতে কৃষ্ণচরিত্র এইরূপ বিকার প্রাপ্ত হইয়াছে।
কিন্তু কেন ইহা হইল? দ্বিতীয়স স্তরের কবি নিতান্ত ক্ষুদ্র কবি নহেন; তাঁহার সৃষ্টিকৌশল জাজ্বল্যমান। তিনি ধর্মাধর্মজ্ঞানশূন্য নহেন। তবে তিনি কৃষ্ণের এরূপ দশা ঘটাইয়াছেন কেন? তাহার অতি নিগূঢ় তাৎপর্য দেখা যায়।
প্রথমতঃ আমরা পুনঃ পুনঃ দেখিয়াছি ও দেখিব যে, কৃষ্ণ প্রথম স্তরের কবির হাতে ঈশ্বরাবতার বলিয়া পরিস্ফুট নহেন। তিনি নিজে ত সে কথা মুখেও আনেন না; পুনঃ পুনঃ আপনার মানবী প্রকৃতিই প্রবাদিত ও পরিচিত করেন; এবং মানুষী শক্তি অবলম্বন করিয়া কার্য করেন। কবিও প্রায় সেই ভাবেই তাঁহাকে স্থাপিত করিয়াছেন। প্রথম স্তরে এমন সন্দেহও হয় যে, যখন ইহা প্রণীত হইয়াছিল, তখন হয়ত ঈশ্বরাবতার বলিয়া সর্বজনস্বীকৃত নহেন। তাঁহার নিজের মনেও সে ভাব সকল সময়ে বিরাজমান নহে। স্থূল কথা, মহাভারতের প্রথম স্তর কতকগুলি প্রাচীন কিম্বদন্তীর সংগ্রহ মাত্র এবং কাব্যালঙ্কার কবিকর্তৃক রঞ্জিত; এক আখ্যায়িকার সূত্রে যথাযথ সন্নিবেশপ্রাপ্ত। কিন্তু যখন দ্বিতীয় স্তর মহাভারতে প্রবিষ্ট হইল, তখন বোধ হয়, শ্রীকৃষ্ণের ঈশ্বরত্ব সর্বত্র স্বীকৃত। অতএব দ্বিতীয় স্তরের কবি তাঁহাকে ঈশ্বরাবতারস্বরূপই স্থিত ও নিযুক্ত করিয়াছেন। তাঁহার রচনায় কৃষ্ণও অনেক বার আপনার ঈশ্বরত্বের পরিচয় দিয়া থাকেন, এবং ঐশী শক্তি দ্বারা কার্য নির্বাহ করেন। কিন্তু ঈশ্বর পুণ্যময়, কবি তাহাও জানেন। তবে একটা তত্ত্ব পরিস্ফুট করিবার জন্য তাঁহাকে বড় ব্যস্ত দেখি। ইউরোপীয়েরাও সেই তত্ত্ব লইয়া বড় ব্যস্ত। তাঁহারা বলেন, ভগবান্ দয়াময়, করুণাক্রমেই জীবসৃষ্টি করিয়াছেন; জীবের মঙ্গলই তাঁহার কামনা। তবে পৃথিবীতে দুঃখ কেন? তিনি পুণ্যময়, পুণ্যই তাঁহার অভিপ্রেত। তবে আবার পৃথিবীতে পাপ আসিল কোথা হইতে? খ্রীষ্টানের পক্ষে এ তত্ত্বের মীমাংসা বড় কষ্টকর, কিন্তু হিন্দুর পক্ষে তাহা সহজ। হিন্দুর মতে ঈশ্বরই জগৎ। তিনি নিজে সুখদুঃখ, পাপপুণ্যের অতীত। আমরা যাহাকে সুখদুঃখ বলি, তাহা তাঁহার কাছে সুখদুঃখ নহে, আমরা যাহাকে পাপপুণ্য বলি, তাহা তাঁহার কাছে পাপপুণ্য নহে। তিনি লীলার জন্য এই জগৎসৃষ্টি করিয়াছেন। জগৎ তাঁহা হইতে ভিন্ন নহে—তাঁহার অংশ। তিনি আপনার সত্তাকে অবিদ্যায় আবৃত করাতেই উহা সুখদুঃখ পাপপুণ্যের আধার হইয়াছে। অতএব সুখদুঃখ পাপপুণ্য তাঁহারই মায়াজনিত। তাঁহা হইতেই সুখদুঃখ ও পাপপুণ্য। দুঃখ যে পাই, তাঁহার মায়া; পাপ যে করি, তাঁহার মায়া। বিষ্ণুপুরাণে কবি কৃষ্ণপীড়িত কালিয় সর্পের মুখে এই কথা দিয়াছেন,—
যথাহং ভবতা সৃষ্টো জাত্যা রূপেণ চেশ্বর।
স্বভাবেন চ সংযুক্তস্তথেদং চেষ্টিতং মম ||
অর্থাৎ “তুমি আমাকে সর্পজাতীয় করিয়াছ, তাই আমি হিংসা করি।” প্রহ্লাদ বিষ্ণুর স্তব করিবার সময় বলিতেছেন,
বিদ্যাবিদ্যে ভবান্ সত্যমসত্যং ত্বং বিষামৃতে।*
“তুমি বিদ্যা, তুমিই অবিদ্যা, তুমি সত্য, তুমিই অসত্য, তুমি বিষ, তুমিই অমৃত।” তিনি ভিন্ন জগতে কিছুই নাই। ধর্ম, অধর্ম, জ্ঞান, অজ্ঞান, সত্য, অসত্য, ন্যায়, অন্যায়, বুদ্ধি, দুর্বুদ্ধি সব তাঁহা হইতে।
তিনি গীতায় স্বয়ং বলিতেছেন,
যে চৈব সাত্ত্বিকা ভাবা রাজসাস্তামসাশ্চ যে।
মত্ত এবেতি তান্ বিদ্ধি ন ত্বহং তেষু তে ময়ি || ৭। ১২
“যাহা সাত্ত্বিক ভাব বা রাজস বা তামস, সকলই আমা হইতে জানিবে। আমি তাহার বশ নহি, সে সকল আমার অধীন।” শান্তিপর্বে ভীষ্ম যেখানে কৃষ্ণকে “সত্যাত্মনে নমঃ” “ধর্মাত্মনে নমঃ” বলিয়া স্তব করিতেছেন, সেইখানেই “কামাত্মনে নমঃ” “ঘোরাত্মনে নমঃ,” “ক্রৌর্যাত্মনে নমঃ,” “দৃপ্তাত্মনে নমঃ,” ইত্যাদি শব্দে নমস্কার করিতেছেন; এবং উপসংহারে বলিতেছেন, “সর্বাত্মনে নমঃ।” প্রাচীন হিন্দুশাস্ত্র হইতে এরূপ বাক্য উদ্ধৃত করিয়া বহু শত পৃষ্ঠা পূরণ করা যাইতে পারে।
যদি তাই, তবে মানুষকে একটা গুরুতর কথা বুঝাইতে পারি। দুঃখ জগদীশ্বরপ্রেরিত, তিনি ভিন্ন ইহার অন্য কারণ নাই। যে পাপিষ্ঠ এজন্য নিন্দিত এবং দণ্ডনীয়, তাহার সম্বন্ধে লোককে বুঝাইতে পারি, ইহার পাপবুদ্ধি জগদীশ্বরপ্রবর্তিত, ইহার বিচারে তিনি কর্তা, তোমরা কে?
এই তত্ত্বের অবতারণায় দ্বিতীয় শ্রেণীর কবি, ভিতরে ভিতরে প্রবৃত্ত। শ্রেষ্ঠ কবিগণ, কখনই আধুনিক লেখকদিগের মত ভূমিকা করিয়া, ভূমিকায় সকল কথা বলিয়া দিয়া, কাব্যের অবতারণা করেন না। যত্নপূর্বক তাঁহাদিগের মর্মার্থ গ্রহণ করিতে চেষ্টা করিতে হয়। সেক্ষপীয়রের এক একখানি নাটকের মর্মার্থ গ্রহণ করিবার জন্য কত সহস্র কৃতবিদ্য প্রতিভাশালী ব্যক্তি কত ভাবিলেন, কত লিখিলেন, আমরা তাহা বুঝিবার জন্য কত মাথা ঘামাইলাম; কিন্তু আমাদের এই অপূ‍র্ব মহাভারত গ্রন্থের একটা অধ্যায়ের প্রকৃত মর্ম গ্রহণ করিবার জন্য আমরা কখনও এক দণ্ডের জন্য কোন চেষ্টা করিলাম না। যেমন হরিকীর্তনকালে এক দিকে বৈষ্ণবেরা খোলে ঘা পড়িতেই কাঁদিয়া পড়িয়া গড়াগড়ি দেন, আর এক দিকে নব্য শিক্ষিতেরা “Nuisance!” বলিয়া চীৎকার করিতে করিতে পশ্চাদ্ধাবিত হয়েন, তেমনই প্রাচীন হিন্দু গ্রন্থের নাম মাত্রে এক দল মাটিতে পড়িয়া গড়াগড়ি দেন—মকল কাবল ভুসি শুনিয়া ভক্তিরসে দেশ আপ্লুত করেন, আর এক দল সকলই মিথ্যা, উপধর্ম, অশ্রাব্য, পরিহার্য, উপহাসাস্পদ বিবেচনা করেন। বুঝিবার চেষ্টা কাহারও নাই। শব্দার্থবোধ হইলেই তাঁহারা যথেষ্ট বুঝিলেন মনে করেন। দুঃখের উপর দুঃখ এই, কেহ বুঝাইলেও বুঝিতে ইচ্ছা করেন না।
ঈশ্বরই সব— ঈশ্বর হইতেই সমস্ত। তাঁহা হইতে জ্ঞান, তাঁহা হইতে জ্ঞানের অভাব বা ভ্রান্তি, তাঁহা হইতে বুদ্ধি, তাঁহা হইতে দুর্বুদ্ধি। তাঁহা হইতে সত্য, আবার তাঁহা হইতে অসত্য। তাঁহা হইতে ন্যায়, এবং তাঁহা হইতেই অন্যায়। মনুষ্যজীবনের প্রধান উপাদান এই জ্ঞান ও বুদ্ধি, সত্য ও ন্যায় এবং তদভাবে ভ্রান্ত, দুর্বুদ্ধি অসত্য বা অন্যায় সবই ঈশ্বরপ্রেরিত। কিন্তু জ্ঞান, বুদ্ধি, সত্য, এবং ন্যায় তাঁহা হইতে, ইহা বুঝাইবার প্রয়োজন নাই; হিন্দুর কাছে তাহা স্বতঃসিদ্ধ। তবে ভ্রান্তি, দুর্বুদ্ধি প্রভৃতিও যে তাঁহা হইতে, তাহা মনুষ্যের হৃদয়ঙ্গম করিবার প্রয়োজন আছে। অন্ততঃ মহাভারতের দ্বিতীয় স্তরের কবি, এমন বিবেচনা করেন। আধুনিক জ্যোতির্বিদরা বলিয়া থাকেন, আমরা চন্দ্রের এক পিঠই চিরকাল দেখি, অপর পৃষ্ঠ কখন দেখিতে পাই না। এই কবি সেই অদৃষ্টপূর্ব জগৎরহস্যের অপর পৃষ্ঠ আমাদিগকে দেখাইতে চাহেন। তিনি জয়দ্রথবধে দেখাইতেছেন, ভ্রান্তি ঈশ্বরপ্রেরিত ঘটোৎকচবধে দেখাইবেন, দুর্বুদ্ধিও তাঁহার প্রেরিত, দ্রোণবধে দেখাইবেন, অসত্যও ঈশ্বর হইতে, দুর্যোধন বধে দেখাইবেন, অন্যায়ও তাঁহা হইতে। আরও একটা কথা বাকি আছে। জ্ঞানবল, বুদ্ধিবল, সত্যবল, ন্যায়বল, বাহুবলের কাছে কেহ নয়। বিশেষতঃ রাজনীতিতে বাহুবলের প্রাধান্য। মহাভারত বিশিষ্ট প্রকারে রাজনৈতিক কাব্য অর্থাৎ ঐতিহাসিক কাব্য; ইতিহাসের উপর নির্মিত কাব্য। অতএব এ কাব্যে বাহুবলের স্থান, জ্ঞান বুদ্ধ্যাদির উপরে। দ্বিতীয় স্তরের কবি দেখিতে পান যে, কেবল জ্ঞান ভ্রান্তি, বুদ্ধি দুর্বুদ্ধি, সত্যাসত্য, এবং ন্যায়ান্যায় ঐশিক নিয়োগাধীন, ইহা বলিলেই রাজনৈতিক তত্ত্বটা সম্পূর্ণ হইল না, বাহুবল ও বাহুবলের অভাবও তাই। তিনি ইহা স্পষ্টীকৃত কবিরার জন্য মৌসলপর্ব প্রণীত করিয়াছেন। তথায় কৃষ্ণের অভাবে স্বয়ং অর্জুন লগুড়ধারী কৃষকগণের নিকট পরাভূত হইলেন।
আমি যাহাকে ঐশিক নিয়োগ বলিতেছি, অথবা দ্বিতীয় স্তরের কবি যাহা ঈশ্বরপ্রেরণা বলিয়া বুঝেন, ইউরোপীয়েরা তাহার স্থানে “Law” সংস্থাপিত করিয়াছেন। এই মহাভারতীয় কবিগণের বুদ্ধিতে “Law” কোন স্থান পাইয়াছিল কি না, আমি বলিতে পারি না। তবে ইহা বলিতে পারি, যাহা “লর” উপরে, যাহা হইতে “Law” তাহা তাঁহারা ভালরূপে বুঝাইয়াছিলেন। তাঁহারা বুঝিয়াছিলেন, সকলই ঈশ্বরেচ্ছা। কৃষ্ণকে কর্মক্ষেত্রে অবতারিত করিয়া, এই কবি সেই ঈশ্বরেচ্ছা বুঝাইতে চেষ্টা করিলেন।

——————–
* বিষ্ণুপুরাণ। ১ অংশ, ১৯ অধ্যায়।

<

Bankim Chandra Chattopadhyay ।। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়