উদ্ভ্রান্ত রাজনীতিসহ ঘটমান বর্তমান
পারভেজ হোসেন

প্রাচীন কবি কাহ্নপা, লুইপার দেশ বাংলাদেশ। তাঁদেরই কাব্যে উল্লিখিত একজন গীতিকবি ঢেণ্ঢন পা। বদরুন নাহারের দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থের নাম ঢেণ্ঢনপা’র দেশে অর্থাৎ বাংলাদেশে। বদরুনের ৭২ পৃষ্ঠার এ গ্রন্থের আটটি গল্পের বিষয় সমকালের বাংলাদেশ। র‌্যাবের কার্যক্রম থেকে শুরু করে ড· ইউনূসের নোবেলপ্রাপ্তি-আমাদের উল্লাস এবং মুষড়ে পড়ার কাহিনী-আমাদের যাপিত জীবনের নানা ক্লেদ, ক্ষয়, বিবমিষা, জটপাকানো টুকরো টুকরো ঘটনা, উ??ান্ত রাজনীতিসহ ঘটমান বর্তমান বদরুনের গল্পের উপজীব্য; পরিপ্রেক্ষিত বা পটভূমি। ‘এনকাউন্টার’, ‘সুন্দরী এবং কিছু অসুন্দর সংলাপ’, ‘বার্ড ফ্লু অভিজ্ঞান কিংবা কুরহার সালুন’, ‘আঁরার ইউনুস’-গল্পের এসব শিরোনামই বলে দেয় বদরুন খুব ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে বলতে চান না; যা বলার তা প্রায় সরাসরিই বলেন সরল ভাষায়; সব রকম চটক এড়িয়ে, গল্পে গল্পে। তাঁর গল্পে কিন্তু গল্প বলার ঘোরও নেই, একমুখী তাড়নাও নেই; আছে সময় এবং সময়ের তোড়ে আবর্তিত মানুষের প্রাত্যহিক।
হারেজ আলী কিছুটা নির্বোধ প্রকৃতির মানুষ। পোস্টিং র‌্যাবে। ‘গত বছর যখন সে প্রমোশন পেয়ে কালো পোশাক পেল, সে-সময় তার বউ তৃতীয়বারের মতো কন্যাসন্তানের জ্ন দেয়। প্রমোশন পেয়ে দুঃসাহসিক কালো বাহিনীতে যোগদানের ফলেই সে পুত্র না-হওয়ার দুঃখ ভুলতে পারে।’ কিন্তু এই পোশাক সে মাত্র তিন দিন পরতে পারে। কারণ শাদা পোশাকের জটিল অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে তাকে দীর্ঘদিন যে লোকটির পিছু পিছু ঘুরে বেড়াতে হয়, ‘এনকাউন্টার’ গল্পের সে নায়ক। নাম-পরিচয় নেই। ধরা পড়া এ লোকটি ‘তখন পালাবার কোনো চেষ্টা না করে দরজা খুলে বেরিয়ে আসে। সেক্টর প্রধানের একবার মনে হচ্ছিল লোকটি বেকুব! ধরে আনা অবধি লোকটি কোনো কথা বলেনি, অস্বাভাবিক নীরবতায় তার চোখের দৃষ্টি ছিল অস্বস্তিকর।’ সেক্টর প্রধান হারেজের রিপোর্ট ওল্টাতে ওল্টাতে জানতে পারে, ‘শীর্ষ সন্ত্রাসী কালা মজিদের লাশ নিতে যখন তার মেয়ে মাজেদা থানা গেটে আসে তখন লোকটি সেখানে ছিল। তাকে মজিদের বাড়ি পর্যন্ত যেতে দেখা গেছে।’ আরও জানতে পারে, সে টোকাইদের সাথে বসে বাদাম খায়, বছরে সে এক হাজার পঁচানব্বইবার টয়লেটে গেছে। বিরক্ত হয়ে সেক্টর প্রধান ফাইল ফেলে লোকটির ঘর থেকে জব্দ করে আনা একটি ডায়েরি খুলে পড়তে থাকে। বদরুনের গল্পও মোড় ঘুরে দাঁড়ায়।

‘নদীতে পানি বেড়েছে, আজ সারা বিকাল নৌকায় ঘুরলাম। আজকাল মাঝিরা কেমন কঠিন মুখ করে নৌকা বায়। সবকিছু কেমন নিরেট শক্ত হয়ে যাচ্ছে।’
‘···আজ পল্টনে গিয়েছিলাম। অসংখ্য স্যান্ডেল, ছেঁড়া কাপড় এবং আরো কিছু টুকরোটাকরি পড়ে থাকতে দেখলাম। হয়তো মানুষের মাংসের ছেঁড়া অংশ হবে, বোঝা গেল না।’
পৃষ্ঠা এগিয়ে গেলে প্রশিক্ষিত অফিসারের মুখও কঠিন হয়ে আসে।

‘জানি না, কেন জানি না আমি কালা মজিদের বাড়ি চলে গিয়েছিলাম। তার বাড়িতে গোবর লেপা উঠান পেরিয়ে কোনো দালানকোঠা খুঁজে পাইনি। কেবল রূপার মতো চকচকে নতুন টিনের ঘরের সামনে ক্রন্দনরত পাঁচটি মানুষ। তারা জানে না, মজিদ কোন কৌশলে কালা মজিদ হলো বা কালো বাহিনীর বিচারের আইন-কানুন কী?’
এভাবে ডায়েরির পাতা ভরে নানা প্রশ্ন যেমন আছে, তেমনি করে আছে এক মোনতাজ আর তার ছেলে মোদ্দাসেরের করুণ কাহিনী। তাদের ঢাকা আগমন, পেটের দায়ে মিছিল-মিটিংয়ে গিয়ে পিতা মোনতাজের মৃত্যু। ছেলে মোদ্দাসেরের পা হারানো এবং পরিশেষে ভিক্ষাবৃত্তির কথা।
এভাবে এক গল্পের পেট ফুঁড়ে আরও অনেক গল্পের আখ্যান বুনতে বুনতে এনকাউন্টারে লোকটির মৃত্যু ঘটলে আমরা পাঠক বেকুব বনে যাই। অপরাধ এবং অপরাধী নিয়ে নানা প্রশ্ন দানা বাঁধে মনে। গল্পটি আর সমসময়ের মধ্যে আটকে থাকে না। সময়কে উতরে যেতে পারে।
সীমিত শব্দের এ আলোচনায় বদরুনের আর একটি গল্প আঁরার ইউনূস তুলে ধরতে চাই। মাত্র এক বেলার একটি কাহিনী। রনি আর সমীর বাল্যবন্ধু। বাম রাজনীতিতে দীক্ষিত। কিন্তু জীবনের জোয়ার সমীরকে একটি আমেরিকান প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক বানিয়েছে আর রনিকে গ্রামীণ ব্যাংকের ফিল্ড অফিসার। অনাহারী গরিব মানুষের প্রতি প্রবল মমতায় ঋণগ্রস্ত সাত নারীর কিস্তি পরিশোধের ব্যাপারে কঠোর হয়নি রনি। ফলত তারা অনেক ঋণখেলাপির মতো স্বাভাবিকভাবেই পলাতক। আর দায়িত্বে অবহেলার অজুহাতে রনির হয় জেলহাজত।
এদিকে সমীরের ঘরেও চাটগাঁ থেকে আগত গৃহকর্মী আছিয়া গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণখেলাপি। তার ভাষা নিয়ে প্রতিদিনই বিপুল বিপত্তিতে থাকে সমীর আর তার স্ত্রী রুনা। গল্পটি যেদিনের সেদিন সকালে পত্রিকার একটি হেডলাইনে চমকিত হয়ে সমীরের স্ত্রী রুনা সমীরকে ‘আঁরার ইউনূস নোবল পাঁইয়ে’ পড়ে শোনায়। এটা শুনে আছিয়া বিবি ভাবে তার মালিকেরা তো চাটগাঁর ভাষা বুঝেও না বোঝার ভান করে! সে প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হয় এবং বলে, কে তাঁকে বান্দি বানিয়েছে, নভেল-থিয়েটার সে বোঝে না। কিন্তু কণা হয়তো পরে আছিয়াকে ব্যাপারটা বোঝাতে পারে।
এদিকে সমীরও তার আমেরিকান ইউনিভার্সিটিতে এদিন কর্তৃপক্ষ ও ছাত্রছাত্রীদের উল্লাস-মাতামাতির সম্মুখীন হয়। আর বাড়ি ফিরতে ফিরতে মনে পড়ে বন্ধু রনির কথা-‘ওর মতো আসামিদের জেলে কতটুকু সুযোগ-সুবিধা আছে? রনি কি পেপার পড়ার সুযোগ পায় অথবা টিভি দেখার···? রনি কি দেখেছে, বাংলাদেশের বিশ্বজয়? গ্রামীণ নারীদের বিজয়? নিশ্চয়ই এ খবরে রনিও খুশি হবে।’
ক্লান্তি আর বিষাদ আক্রান্ত সমীর যখন বাড়ি ফিরে আসে, মনে মনে ভীত ছিল এই ভেবে যে, না জানি আর কোন রুদ্রমূর্তি সে দেখবে আছিয়ার। হয়তো রান্নাবান্নাই আজ হয়নি বাসায়। কিন্তু না, দরজা খুলে দিয়েই আছিয়া অতীতের সব ভুলে উল্লাসে ফেটে পড়ে, বলে, গরিব দেশের ছেলে নোবেল পেয়েছে, তার চেয়ে বড় কথা সে যে তাদের চট্টগ্রামেরই ছেলে। ‘ভাইজান আঁইস্যনে্‌-নেঁ, উইন্নন্নে···ইউনুস আঁরার ইউনুস···নোবেল পাঁইয়ে···বাপর্‌ বেডা···এঁত্‌তর নঁ পুরস্কার পাঁইয়ে, দেহন্‌ নঁ ফরিব নে হন্‌ দেশর্‌ পোঁয়া···আঁরার্‌···চাঁটগাইয়া পোঁয়া···’। ঋণগ্রস্ত মানুষের দুর্দশার চিত্র তুলে ধরার সাথে সাথে আত্মমর্যাদার ও আত্ম-অহংকারের এহেন বহিঃপ্রকাশ গল্পটিকে পরিণতি দিয়েছে।
‘সুন্দরী এবং কিছু অসুন্দর সংলাপ’ গল্পেও গ্রাম থেকে আসা পারলার-কর্মীদের ব্যক্তিগত আলাপচারিতা সুন্দরী কাস্টমারকে কীভাবে আতঙ্কিত করে, বিরক্তির মধ্যে ফেলে এবং পরিণতিতে চাকরি হারাবার মতো ঘটনাও ঘটে, তা তুলে আনতে পেরেছেন গল্পকার। কিন্তু গল্পটি আলাদা মর্যাদা নিয়ে উতরে ওঠে যখন দেখি সমগোত্রীয়র প্রতি মায়ায় চাকরিচ্যুত গর্ভবতী মেয়েটিকে তার এক সহকর্মী আরেকটি পারলারের ঠিকানা দেয়।
বদরুন নাহারের বাকি গল্পগুলোও এ ধাঁচের। অনেকটা নিরীক্ষার মধ্যে গল্প লেখার কলকব্জা আয়ত্ত করার চেষ্টা করছেন লেখক-বিষয় নির্বাচনে তাঁর সমাজমনস্কতার যে ছবি আমরা পাই তা আরও গভীরে যাবে, ভাষার গাঁথুনি বিষয় ও চরিত্র-সংলগ্ন হয়ে দৃঢ় ভিত্তি পাবে, তাঁর লেখায় সে প্রতিশ্রুতি আছে। সময়ের গল্প শুধু সময়ের সীমানায় আটকে না থেকে বহুমাত্রিক দ্যোতনায় উজ্জীবিত হবে বলে আশা রাখি।

সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো।

Super User