‘আমার বইয়ের লাইনগুলো জুড়ে রয়েছে সেই সব হাজার পথ/ যেখান দিয়ে আমি কখনও ভয়ে ভয়ে, কখনও দুর্বার গতিতে/ উঠেছি উঁচু থেকে উঁচুতে, যে শিখর নিয়েছে যাদু করে আমার মন,/ অথবা পাহাড়ের গা বেয়ে উল্টিয়ে পড়েছি একেবারে মাটিতে।’
কথাগুলো রাশান কবি রসুল গামজাতভের। কিন্তু এটা হতে পারত এই কবিতা-অনুবাদকেরই আত্মকথা। কেননা এই অনুবাদকের নাম আবুল হোসেন। কিন্তু তিনি অনুবাদক কবিমাত্র নন। অথচ তাঁর সঙ্গে পাঠক হিসেবে আমার পরিচয় ঘটে অন্য ক্ষেতের ফসল নামের বইটির মাধ্যমে। এ ছাড়া ‘বাংলার বাঘ’ কবিতাটি পড়েছিলাম স্কুল বয়সে, পাঠ্যবইয়ে। আজ বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করি, ৭০ বছরের অধিক কাল তিনি পার করে এসেছেন সাহিত্যের, বিশেষত কবিতাসৃষ্টির নির্জন পথ। নির্জন পথ বলছি, কেননা সৃষ্টি ও নির্মাণের, সাহিত্য বিচার ও পর্যালোচনার কল্লোলিত পথে, নদীতট দখলের মুখরিত আয়োজনে তাকে কেবলই ওপারের ঘাটে মিলিয়ে যাওয়া একটি ঢেউ বলে মনে হয়েছে।
অথচ তিনিই আমাদের প্রথম আধুনিক। বাঙালি মুসলমানের আধুনিকতায় প্রবেশ ঘটেছে, কবিতায়, মূলত চল্লিশের দশকে, আবুল হোসেনের হাত ধরে। একে প্রবেশ হিসেবে বিবেচনা করাই শ্রেয়, সিদ্ধি হিসেবে নয়। কেননা, এ দশক মূলত ভাবাদর্শ-পরিচালিত কবিদের উন্মেষপর্ব। পদাতিক ও সাত সাগরের মাঝি কাব্য দুটিই আমাদের সে কথা জানান দেয়। নতুন রাষ্ট্রগঠনের যে স্বপ্ন, তারই রঙের আড়ালে পায়চারী করে চলে আসে নতুন সমাজব্যবস্থারও প্রস্তাব, আকাঙ্ক্ষা। আশ্চর্যের বিষয় এই যে আবুল হোসেন সেই অর্থে ভাবাদর্শ-পরিচালিত নন, যদিও তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থের নাম নববসন্ত। সদ্য কৈশোর পেরোনো এই তরুণেরও আছে নতুনের পিপাসা, বসন্তবাসনা, আছে প্রাগাধুনিক রোমান্টিকেরই বেদনা, কেননা এক নিঃসঙ্গ নাবিকের মতো ‘মনের দূরবীন পেতে রয়েছে সে:/ সমুদ্রের জল ছাড়িয়ে, অজানা গাছের ছায়া ফেলে,/ কত বেলাভূমি পার হয়ে/ কোথায় কোনখানে পড়বে তার দৃষ্টি,/ কোন সমতল ভূমির খড়-ছাওয়া/ ঘরের কোণে গিয়ে সে হবে স্থির।’ কিন্তু এই রোমান্টিকতার খোলস ছেড়ে স্পষ্টতই তাঁকে বেরিয়ে আসতে দেখি ‘স্বপ্ন’ কবিতায়, যখন তিনি বলেন: ‘আমরা পাইনি তৃপ্তি উড়ন্ত ডানায়,/ আমরা পাইনি তৃপ্তি স্বপ্নসুষমায়।/ আমরাও স্বপ্ন দেখি। তারা পচে মরে/ শতাব্দীর শাহারায় বন্দরে বন্দরে।’
রবীন্দ্র-পরিশ্রুত রোমান্টিকতা ও ন্যারেটিভিটিকে আশ্রয় করে তাঁর কাব্যারম্ভ। পরবর্তী সময়জুড়ে নানা অভিঘাতে ঘটেছে নানা অভিক্ষেপ। দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ বিরস সংলাপেই সুর পাল্টে যাওয়া লক্ষ করি। প্রথম কবিতার শুরুটাই ভিন্ন অবলোকনে: ‘সারাদিন সূর্য ছুড়েছে নেপাম বোমা/ আর তারই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চীনে নববর্ষের হাওয়া/ গেসোলীনে ভিজিয়েছে সমস্ত ব্যাঙ্কক। শুঁটকির গন্ধে ভরে ঝলসানো নীল।’ একইভাবে ‘ব্যাঙ্ককে বৃষ্টি’ কবিতায় চলে আসে ‘আকাশের ব্যালেরীণারা’ যেন ‘কুয়াশার স্টোল গায়ে দিয়ে’, আসে সমুদ্রড্রাগন, বোমারু মেঘের জোট গুলিবর্ষণ করে চলে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বস্তিতে, সদর রাস্তায়, নদীর ঘাটে, ধানের খেতে।
তাঁর এই পাল্টে যাওয়াকে তিনি শনাক্ত করেছেন হাওয়ার দুঃসাহসিকতায়। ‘হাওয়া, তোমার কি দুঃসাহস’ কাব্যে তাই তাঁর স্পষ্টতই বলা: ‘…চাওনি ফিরে/ পিছন দিকে একটি বারও।/ উড়িয়ে দিয়ে সব ভীরুতা/ ধরিয়ে দিলে রক্তে নেশা।/ তোমার পথই পথ আমারও।’ প্রথম যৌবনে ভালোবাসার জৈবিকতায় তিনি প্রত্যক্ষ করেছিলেন ‘আমার মনের তলে সংখ্যাহীন আদিম নিষাদ’, এবার সেই তিনি সেই ভালোবাসারই রাক্ষসী-রূপ উন্মোচন করেন: ‘একটা তাজা হূদপিন্ড, সবটা গরম মগজ।/ তাতেও ক্ষিদে মিটল না তোর, হল না তোর ভোজ?/ খাবি আমায় আয় এবার খা।’ জীবন ও জীবিকার প্রাত্যহিকতায় নাগরিক মানুষের তুচ্ছতা, ঊনতা, ক্রমাগত হারিয়ে যাওয়ার বেদনাবার্তাও পেয়ে যাই তার কাছে : ‘অন্যেরা কি করে জানি না, আমি অন্তত/ নিজের মুখ খুব অল্পই দেখি। রোজ/ সকালে যখন দাড়ি কামাই অথবা/ হাত মুখ ধুয়ে এসে চুলে চিরুনি চালাই আয়নায় নিজের মুখ ফুটে উঠে ঠিকই, কিন্তু আমি তা কখনও ভাল করে দেখেছি/ হলফ করে বলতে পারব না…’। এখনও সময় আছে—এই আশাবাদের মর্মে ‘সারা জীবন তো কেটে গেল ভুল ভালবাসার পেছনে’—এই উপলব্ধির বয়ানই অন্তর্গত বাস্তবতা আবুল হোসেনের। একটা টানাপড়েন, যে কারণে রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে দেখি তাঁকে, কিন্তু গভীর প্রত্যয়ে সম্পৃক্ত হতে দেখি না। বরং ব্যক্তিবিশেষের প্রতি কাব্যস্তুতি একধরনের বিভ্রম সৃষ্টি করে। এই বিভ্রম অবশ্য তাঁর একলার নয়। হয়তো গোটা জাতির। আমাদের সিভিল সোসাইটির মনোহর প্রপাগান্ডায়। এবং এই সীমাবদ্ধতা পঞ্চাশ, ষাট ও সত্তরের দশকের বাংলা কবিতারও। আরও গভীরে নেমে বলতে হয়, এটা একটা প্রবণতা আমাদের ভূখণ্ডের মানসিকতার। এখানে সব সময়ই ব্যক্তির ভেতরে মুক্তি অন্বেষণ করা হয়। যার ফলে উচ্ছ্বাস, বিষাদ, স্তুতি, ঘৃণা। কিন্তু কোনো আদর্শ বা দৃষ্টিভঙ্গির বি-মানবিক পর্যালোচনা ও তার সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি আজও। তাই আমাদের রাজনৈতিক কবিতা প্রায়ই স্লোগানে পর্যবসিত হয়, নতুবা বিমূর্ত মানে নির্বস্তুক হাহাকারে হারিয়ে যায়।
ব্যঙ্গ কবিতার ভেতর বরং আবুল হোসেনকে বেশ তীর্যক দৃষ্টিভঙ্গিসহ আবিষ্কার করি আমরা। ‘অভ্যন্তরীণ ব্যাপার’ কবিতায় তিনি সরকারি বয়ানের প্রতিধ্বনি করছেন এভাবে: ‘কাকে ধরব কাকে মারব/ কার বাড়িঘর লুটব ভাঙব/ …সে তো আমার নিজের ব্যাপার।/ …আমরা না এক সার্বভৗম স্বাধীন সরকার।’ কিন্তু এখানেও প্রশ্ন থেকে যায়। সরকারের ভণ্ডামি আমরা টের পাই ঠিকই, কিন্তু, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের আন্তর্জাতিক রাজনীতি থেকে যায় আড়ালে, সংশয়াতীত। পক্ষান্তরে ‘শেষ কথা’ কবিতায় আমরা শুনতে পাই যথার্থ বাক্য: ‘মাফ করে দাও ছেলেমানুষী—/ অকালপক্ব বাহাদুরী।/ এত দিনে বুঝি যতই না কেন মাথা খুঁড়ি/ কিছুই হবে না, না হলে তোমার একটু খুশি।’ কিংবা, ‘জনগণের বাসর’ কবিতায়: ‘আপনি যাবেন কাটতে ফিতে/ মুহুর্মুহু হাততালিতে।/ আমরা দেখব দূর থেকে তা—/চিরকালের আমজনতা।’ ছোটদের জন্য লেখা ছড়াতেও এই উলট পুরাণের বাস্তবতার মুখোমুখি তিনি দাঁড় করিয়েছেন আমাদের: দেখছ না ভাই তারাই এখন/ নিয়েছে যে রাজার আসন।/ সুয়োরা সব টানছে ঘানি,/ দুয়োরাই তো আসল রানী।’ (গল্পের পচা লোক)।
পরিশেষে, আবুল হোসেনের দীর্ঘজীবনের কাব্য সম্পর্কে দু-তিনটি পর্যবেক্ষণ ও প্রত্যভীক্ষা হাজির করার চেষ্টা করা যেতে পারে। আমাদের জন্য পরম বিস্ময়ের ছিল যে মাত্র ১৮ বছর বয়সেই তিনি আধুনিকতায় অভিষিক্ত হতে পেরেছিলেন, বিশেষ কোনো মতাদর্শের সহায়তা ছাড়াই। আদর্শপ্রচার বা প্রতিষ্ঠা নয়, মননশীলতাই যে বাঙালি মুসলমানের, অন্তত কবিতায়, আত্ম-উদ্বোধনের একটি প্রধান শর্ত, যার অভাব নজরুল বা জসীমউদ্দীনের কবিতা পূরণ করতে এগিয়ে আসেনি, এসেছিলেন আরও পরে আহসান হাবীব প্রমুখ কবি, এই বার্তা, এই পূর্বাভাস স্পষ্টতই ধরা পড়েছিল আবুল হোসেনের কবিতায়। এবং তার পরিণতি সেই পরিমাণ গভীরে টেনে নেয়নি আমাদের যে পরিমাণ বৈচিত্র্য উপহার দিতে পেরেছে পরিবর্তীকালের কাব্যসৃষ্টি।
ফলে, এই ভূখণ্ডে আধুনিক বাঙালি মুসলমানের আত্মবিকাশের ইতিহাস, তার বিপর্যয় ও সীমাবদ্ধতার একটা রূপরেখা কবির দীর্ঘজীবনের পথপরিক্রমায় খুঁজে পাওয়া সম্ভব বলে মনে করি।

সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুলাই ০২, ২০১০

Super User