দি লস্ট সিম্বল—ড্যান ব্রাউন, ডাবলডে/ব্যান্টাম প্রেস, সেপ্টেম্বর ২০০৯

যেকোনো কারণেই হোক হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সংকেতবিশারদ অধ্যাপক রবার্ট ল্যাঙ্গডনকে লইয়া মার্কিন রহস্যোপন্যাস লেখক ড্যান ব্রাউনের টানাহ্যাঁচড়া যেন আর শেষ হইতেছে না। ২০০০ সালে এঞ্জেলস অ্যান্ড ডিমনস-এর ঘোল খাওয়াইয়া এই টানাহ্যাঁচড়ার শুরু; তাহার পরে ২০০৩-এর জগত্খ্যাত দি দ্য ভিঞ্চি কোড। ইহাতেও যেন যথেষ্ট হইল না। সর্বশেষ ফ্রিম্যাসন পিটার সলোমন ও তাঁহার পুত্র মালআখের সাতকাহনের মধ্যে রবার্ট ল্যাঙ্গডনকে জড়ানো হইল। সর্বশেষ গ্রন্থটিও একটি ‘থ্রিলার’, যাহার প্রচ্ছদনাম দি লস্ট সিম্বল। নামটি ভালো, রহস্যোপন্যাসের জন্য লাগসই; তবে রহস্যটি খুব সোজাসাপটা নহে।
প্রভাবশালী ‘ফ্রিম্যাসন’ পিটার সলোমন বক্তৃতা প্রদানের জন্য তাহার স্নেহধন্য অধ্যাপক ল্যাঙ্গডনকে ওয়াশিংটনে ডাকিয়া পাঠাইয়াছেন। প্লেন হইতে নামিয়া রীতিমতো দৌড়াইয়া অনুষ্ঠানস্থলে পৌঁছাইলেন ল্যাঙ্গডন। কোথায় অনুষ্ঠান? কোথায় দর্শক-শ্রোতা? সলোমনের কর্তিত দক্ষিণ হস্তটি পড়িয়া আছে। সলোমন কি তবে শেষ? সলোমনের খোঁজে নামিয়া পড়িলেন তিনি। অচিরেই ল্যাঙ্গডনকে গাপ করা হইল। কে এই সকল ঘটনার পশ্চাতে বসিয়া কলকাঠি নাড়িতেছে? সহসাই সিআইএ এই ঘটনায় জড়াইয়া পড়িল। সারা ওয়াশিংটন ডিসি জুড়িয়া ব্যাপক দৌড়-ঝাঁপ। নাটের গুরু ব্যক্তিটির নাম মালআখ। কে এই মালআখ? প্রকৃত ঘটনা হইল সে সলোমনপুত্র যাখারি। যৌবনে পরিবারের ওপর বীতশ্রদ্ধা হইয়া সে গৃহত্যাগ করিয়াছিল। পিতা খবর পাইয়াছিলেন তুরস্কের একটি কারাগারে তাঁহার নিখোঁজ পুত্রের জীবনাবসান হইয়াছে; কিন্তু ইহা সঠিক নহে, রটনা মাত্র। গৃহত্যাগের পর তাহার উপর ঐশ্বরিক ভূতের আছর হয়। যেই-সেই আছর নহে, ধর্মীয় গুপ্তবিদ্যা সাধনার ফলে সে নিজেকে ঈশ্বরপ্রতীম স্তরে উন্নীত করিবার বাসনায় উন্মাদ হইয়া উঠিল। তাহার বিশ্বাস, অধ্যাপক রবার্ট ল্যাঙ্গডন সাহায্য করিলে লুপ্ত সংকেত উদ্ধার করা সম্ভব হইবে, লুপ্ত গুপ্তবিদ্যার সন্ধান পাইলে সে সিদ্ধি লাভ করিতে সক্ষম হইবে।
হজরত ইব্রাহিম (আ.) তাঁহার পুত্রকে আল্লাহর নির্দেশে কোরবানির জন্য গলায় ছুরি চালাইয়াছিলেন। যাখারির প্রতীতি হয়, এইভাবে জীবন উত্সর্গ হইলে তাহার সিদ্ধি হইবে। কী এই সিদ্ধি? কেন যাখারির এই উন্মাদনা? এইখানে পাঠককে মধ্যযুগের রহস্যজনক সংগঠন ‘ফ্রিম্যাসন’ সম্পর্কে পরিষ্কার পূর্বজ্ঞান থাকিতে হইবে। যাঁহারা কদ্যপি মার্কিন মুল্লুকের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে যান নাই, ক্যাপিটল হিলে যাইয়া ঘুরিয়া-ফিরিয়া লাইব্রেরি অব কংগ্রেস, ন্যাশনাল ক্যাথিড্রাল, ম্যাসোনিক স্থাপনাসমূহ—এসব দর্শনের সৌভাগ্য যাঁহাদের হয় নাই, তাঁহাদের জন্য ড্যান ব্রাউনের দি লস্ট সিম্বল যথেষ্ট। নানা স্থাপনা, স্থাপত্য ও প্রতিষ্ঠানের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা এই গ্রন্থে রহিয়াছে। পাঠকের মনে হইতে পারে তিনি বিশ্বকোষ পাঠ করিতেছেন। তবে ‘ফ্রিম্যাসন’ সম্পর্কে মূল ধারণা অর্জন করিতে হইবে অন্যত্র।
গ্রন্থের প্রচ্ছদে ক্যাপিটল হিলের পটভূমিতে একটি চাবির চিত্র রহিয়াছে। চাবিতে ধরিবার প্রান্তে অগ্নিশিখা, অন্যপ্রান্তে ফ্রিম্যাসনারির প্রতীক সংযুক্ত। এই চাবির মাধ্যমে এক গুপ্ত রহস্য উদ্ঘাটন সম্পর্কে ইঙ্গিত করা হইয়াছে। কিসের এই লুপ্ত জগত্, কী এই অনাবৃত রহস্য, পাঠক সেই সম্পর্কে আগ্রহ বোধ করিতে পারেন বৈকি। প্রধানত ফ্রিম্যাসনারির বিভিন্ন গুপ্ত সংকেতের উপর এই গ্রন্থে আলোকপাত করা হইয়াছে।
আসমানি কিতাব যাঁহারা পড়িয়াছেন, তাঁহারা সোলায়মান নবী (আ.) সম্পর্কে অবহিত। বাইবেল ও কুরআনে তাহার কথা আছে। খ্রিষ্টজন্মের এক হাজার বত্সর আগে জেরুজালেমে এক পাহাড়ে সোলায়মান নবী (আ.) একটি উপাসনালয় নির্মাণ করিয়াছিলেন। ঠিক এই স্থানেই আল্লাহর নির্দেশে হজরত ইব্রাহিম (আ.) তাঁহার পুত্রকে কোরবানি করিতে উদ্যত হইয়াছিলেন। ফ্রিম্যাসনারিদের কাছে সোলায়মান নবীর (আ.) এই উপাসনালয় বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ। যে পদ্ধতিতে একটি নির্দিষ্ট ধারাক্রমে পাথরের পর পাথর বিন্যাস করিয়া ইহা নির্মাণ করা হইয়াছিল তাহা পরলোকবিশ্বাসী ফ্রিম্যাসনারিদের জন্য বিশেষ তাত্পর্যপূর্ণ। ফ্রিম্যাসনরা বিশ্বাস করে যে আত্মোন্নয়নের মাধ্যমে জগতের কল্যাণ সম্ভব; তবে কি না তজ্জন্য এক কঠোর ধারাবাহিক পদ্ধতিতে নিজেকে প্রস্তুত করিবার প্রয়োজন রহিয়াছে। তাহারা জীবনকে ওই উপাসনালয়ের পর্যায়ক্রমিক শিলান্যাসের মতোই কঠিন পদ্ধতিতে গড়িয়া তুলিবার সাধনা করে।
তাহাদের নানা গুপ্ত আচার ও রহস্যময় কার্যকলাপ লইয়া মানুষের কৌতূহল অপার। তাহাদের নানা গুপ্ত সংকেত সম্পর্কেও মানুষের মনে আগ্রহের শেষ নাই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ১৪ জন রাষ্ট্রপতি ‘ফ্রিম্যাসন’ ছিলেন। বিশ্বাস করা হয় যে মার্কিন রাজনীতি ও অর্থনীতিতে ফ্রিম্যাসনদের গোপন অথচ গভীর প্রভাব রহিয়াছে। ক্যাপিটল হিলে অবস্থিত জর্জ ওয়াশিংটন ম্যাসোনিক মেমোরিয়ালের ভিত্তিপ্রস্তরে রহিয়াছে একটি বাইবেল; স্মৃতিস্তম্ভটির শীর্ষমণ্ডপে খচিত রহিয়াছে ম্যাসোনিক পিরামিডের অন্তিম সংকেত: Laus Deo যাহার অর্থ ‘ঈশ্বরের প্রশংসা করো’। স্বাভাবিকভাবেই কাহিনির ঘটনাস্থল হিসেবে ড্যান ব্রাউন ক্যাপিটল হিল নির্বাচন করিয়াছেন।
মালআখ পিতা পিটার সলোমনকে কিডন্যাপ করিলেও প্রাণে বাঁচাইয়া রাখে। গুরুকে উদ্ধার করিতে ল্যাঙ্গডন ঝাঁপাইয়া পড়ে; সঙ্গে যোগ দেয় সলোমনের ভগিনী ক্যাথেরিন। সে উচ্চপর্যায়ের বিজ্ঞানী, স্মিথসোনিয়ান মিউজিয়াম সাপোর্ট সেন্টারে এক গোপন ল্যাবরেটরিতে সে গবেষণা করে। ল্যাঙ্গডন ও ক্যাথেরিন দুজনকেই ধরিয়া লইয়া যায় মালআখ। উদ্ধারে জড়িত হয় সিআইএ। ঘটনা দ্রুত পরিণতির দিকে আগাইয়া যায়। একপর্যায়ে সলোমনের হাতে ছুরি তুলিয়া দিয়া কোরবানি করিতে বলে মালআখ। এই সময় সিআইএর হেলিকপ্টার আসিয়া যায়, ইহার পাখার আঘাতে স্কাইলাইট ভাঙিয়া মালআখের গায়ে পড়িলে সে মারাত্মকভাবে আহত হয়; সকল পরিকল্পনা ভণ্ডুল হইয়া যায়, সলোমন প্রাণে বাঁচে। সে ল্যাঙ্গডনকে লইয়া যায় জর্জ ওয়াশিংটন ম্যাসোনিক মেমোরিয়ালের চূড়া পর্যবেক্ষণের জন্য। লুপ্ত সংকেত আর কিছুই নহে, তাহা কোনো গুপ্ত বিদ্যাও নহে, তাহা হইল পবিত্র বাইবেলের বাণী, যাহা মানুষ বিস্মৃত হইয়াছে। বাইবেলের এক কপি ৪ জুলাই ১৮৪৮ খ্রিষ্টাব্দে জর্জ ওয়াশিংটন ম্যাসোনিক মেমোরিয়ালের ভিত্তিকাঠামোতে গ্রথিত করা হইয়াছে। —এই হইল সংক্ষেপে কাহিনিচক্র। উল্লেখযোগ্য যে ইহা মাত্র ১২ ঘণ্টার একটি কাহিনিচক্র যাহা ড্যান ব্রাউন ৫২৮ পাতায় বর্ণনা করিয়াছেন।
বাঙালির সময়ের তেমন অভাব হয়তো নাই, তথাপি ৫২৮ পৃষ্ঠার এই স্থূলকায় গ্রন্থপাঠে কয়জন আগ্রহী হইবেন, তাহা লইয়া সন্দেহ হয়। মার্কিনিদের কথা আলাদা, তাহারা হুজুগে জাতি—গ্রন্থটি প্রকাশের আগেই লাখো লাখো মার্কিনি বইটি সংগ্রহের অভিপ্রায়ে অগ্রিম ক্রয়াদেশ দিয়া বসিয়াছেন। অগত্যা প্রকাশকের আর কী করিবার থাকে? ফলত প্রথম সংস্করণের (সেপ্টেম্বর ২০০৯) মুদ্রণ সংখ্যা ৬৫ লাখ। বিক্রি-বাটার বহর দৃশ্যে প্রথম সংস্করণের দুই সপ্তাহের মধ্যেই আরও ছয় লাখ মুদ্রিত হইয়াছে। তবে যাঁহারা দি দ্য ভিঞ্চি কোড পাঠে মুগ্ধ হইয়াছিলেন, তাঁহাদের জন্য কোনো আশার বাণী শুনাইতে পারিতেছি না। ঘটনার ঘনঘটায় চক্কর খাওয়া এক জিনিস আর সাহিত্যিক রসাস্বাদন আরেক। ফ্রেডরিক ফোরসাইথের দি ডে অব দি জ্যাকল এবং উমবার্তো একোর দি নেইম অব দ্য রোজ যাঁহারা পাঠ করিয়াছেন, তাঁহারা সুনিশ্চিত অনুভব হরিয়াছেন রহস্যকাহিনি কী গভীরভাবে মনোজ্ঞ হইতে পারে। দি লস্ট সিম্বল আর যা-ই হোক, সেইরূপ কোনো রসসঞ্চার করে না। ইহা যত না সাহিত্যিক প্রয়াস তাহার চাইতে বেশি গবেষণাকর্ম। প্রধানত ফ্রিম্যাসনারিদের সম্পর্কে রটনা, গুপ্ত বিষয়াদি এবং অকুস্থল হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসি সম্পর্কে নানা অজানা বিষয়ের বিশদ বয়ান এই গ্রন্থের কলেবর বৃদ্ধিতে উদারভাবে সহায়তা করিয়াছে। অসংকোচে বলিতে হয়: হাজারো স্বাভাবিক, অস্বাভাবিক, আপতিক, কষ্টকল্পিত ও কাকতালীয় ঘটনায় সমৃদ্ধ না হইয়া ইহা রীতিমতো ভারাক্রান্ত; ছবি না হইয়া হইয়াছে দুষ্পাঠ্য কোলাজ। রহস্যময় সংগঠন ফ্রিম্যাসনারি, তাহাদের গুপ্তসংকেত ও অজানা আচারাদি বা ক্যাপিটল হিলের বিভিন্ন স্থাপনা সম্পর্কে যাহাদের আগ্রহ নাই, এই গ্রন্থ পাঠে তাহাদের রীতিমতো কসরত করিতে হইবে বলিয়া ভয় হয়।

সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ফেব্রুয়ারী ০৫, ২০১০

Super User