১৫ ভাদ্র।

এই কয়েক দিনের মধ্যে কত কাণ্ডই না হয়ে গেল। বাবাঃ, যেন কালবোশেখীর ঝড়। শুধু আমার জীবনে নয়, শুক্লার জীবনেও। আজ রবিবার। গত বুধবারে ডাক্তার মন্মথ করের ফোন এল। গলার আওয়াজ আগের মতই মোলায়েম, কিন্তু মনে হয় মখমলের খাপের মধ্যে ধারালো ছুরি ঢাকা আছে। বললেন, মিস ভৌমিক, ভাল আছেন তো? খবর পেলাম শঙ্খনাথবাবুর অসুখ হয়েছিল, আপনি সেবা করতে গিয়েছিলেন। দেখছি শঙ্খনাথবাবুর সঙ্গে আপনার বেশ ভাব হয়ে গিয়েছে। আমাকে ডাকবার আগেই তিনি আপনাকে ডাকেন।

।আমার গলা বুজে এল। এ কথার কী উত্তর দেব? তিনি আবার বললেন, আরও শুনলাম ডক্টর নিরঞ্জন দাসকে কল দেওয়া হয়েছিল। আমি শঙ্খনাথবাবুর ফ্যামিলি ডক্টর অথচ তাঁর অসুখে আমাকে না-ডেকে ডাকা হয়েছিল নিরঞ্জন দাসকে। কে ডেকেছিল? আপনি?

হ্যাঁ।

মিস ভৌমিক, শঙ্খনাথবাবুর মেয়ের যখন অসুখ হয় তখন আমিই আপনাকে ডেকে কাজ দিয়েছিলুম। সে কথা এখন আপনার মনে নেই, কারণ শঙ্খনাথবাবুর সঙ্গে এখন আপনার ঘনিষ্ঠতা হয়েছে—তাছাড়া নিরঞ্জন দাসও আপনার ঘনিষ্ঠ বন্ধু—

আমি মরিয়া হয়ে বললুম, আপনি ভুল করছেন ডক্টর কর। শঙ্খনাথবাবুর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা নেই, তিনি আমাকে কল দিয়েছিলেন তাই গিয়েছিলুম। অবশ্য ডক্টর দাস আমার বন্ধু; কিন্তু তিনি। ডাক্তার হিসেবে শঙ্খনাথবাবুকে দেখতে যাননি, ফী নেননি। তাঁকে আমি ডেকেছিলুম, কারণ তাঁর। কথাই আমার আগে মনে পড়েছিল–

তা তো পড়বেই! বাঁকা হাসির সঙ্গে কথাগুলো আমার কানে বিধল—আপনি খাসা আছেন। একদিকে বড়মানুষ শঙ্খনাথ ঘোষ, যিনি গাড়িতে করে আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দেন; অন্যদিকে বড় ডাক্তার নিরঞ্জন দাস, যিনি রাত দুপুরে আপনাদের বাসায় যাতায়াত করেন। অথচ আমি চায়ের নেমন্তন্ন করলে আপনি সময় পান না!

আমার মুখচোখ গরম হয়ে উঠেছিল, বললুম, আর কিছু বলবার আছে?

তিনি বললেন, বলবার আছে অনেক কিছুই। কিন্তু আপনাকে নয়। যেখানে বললে কাজ হবে সেখানে বলব। আমি আপনার উপকার করেছিলাম আপনি তার চমৎকার প্রতিদান দিয়েছেন, আমাকে সরিয়ে নিরঞ্জন দাসকে ডেকে এনেছেন। একথা আমার মনে থাকবে। আচ্ছা নমস্কার।

টেলিফোন রেখে সেইখানেই বসে রইলুম। কী হবে এখন! হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল। তারপর শুক্লা এল, তাকে বললুম। তার মুখখানিও সিটিয়ে শুকিয়ে নীল হয়ে গেল।

পরদিন সকাল আটটার সময় আবার টেলিফোন। আমি আর শুক্লা দুজনেই ঘরে ছিলুম, আড়ষ্ট হয়ে টেলিফোনের দিকে চেয়ে রইলুম; যেন টেলিফোন নয়, একটা সাপ কুণ্ডলি পাকিয়ে রয়েছে, এখনই ফণা তুলে ছোবল মারবে। শুক্লা শেষে বলল, তুই ফোন ধর প্রিয়া, আমার হাত-পা কাঁপছে।

ফোন তুলে কানের কাছে ধরলুম, চিঠি সুরে বললুম, হ্যালো!

জামাইবাবুর গলা-প্রিয়ংবদা! শোন, তুমি এখনই একবার আমার বাড়িতে আসতে পারবে? একজনকে নার্স করতে হবে। তাঁর কণ্ঠস্বর দৃঢ়, কঠিন; ডাক্তারের কণ্ঠস্বর।

ভয় কেটে গেল, ব্যগ্র হয়ে বললুম, কী হয়েছে? কাকে নার্স করতে হবে?

তিনি একটু থেমে বললেন, আমার স্ত্রীকে। হঠাৎ তাঁর স্ট্রোক হয়েছে, প্যারালিটিক স্ট্রোক। তুমি ফ্রী আছ? আসতে পারবে?

কিছুক্ষণ কথা কইতে পারলুম না, তারপর বললুম, পারব। আধ ঘণ্টার মধ্যে গিয়ে পৌঁছব।

বেশ। বাড়ির ঠিকানা জানা আছে, চলে এস। তিনি ফোন রেখে দিলেন।

শুক্লা দাঁড়িয়ে একতরফা কথা শুনছিল। সে বুঝতে পেরেছিল জামাইবাবু ফোন করেছেন এবং একটা গুরুতর কিছু ঘটেছে। সে আমার আঁচল খামচে ধরে শীর্ণ গলায় বলল, প্রিয়া–কী—কী–?

আমার ঘরে আয়, বলছি। হয়তো হয়তো ভগবান তোর পানে মুখ তুলে চেয়েছেন।

শোবার ঘরে কাপড় বদলাতে বদলাতে শুক্লাকে বললুম। সে আমার বিছানায় বসে শুনছিল, আস্তে আস্তে চোখ বুজে শুয়ে পড়ল। তার মুখখানা মড়ার মত ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। আশা! যে-মানুষ আশা ছেড়ে দিয়েছে সে যদি হঠাৎ আশার আলো দেখতে পায় তাহলে আমচকা ধাক্কা সামলাতে পারে না। আমিও আশা করছি, সমস্ত মন-প্রাণ দিয়ে আশা করছি, জামাইবাবু যেন মুক্তি পান। শুক্লার জীবন যেন ফুলে ফুলে ভরে ওঠে।

কিন্তু তবু, ভেবে দেখতে গেলে, কিসের জন্যে আশা? একটা মানুষ সাংঘাতিক পীড়িত, সে যেন বেঁচে না-ওঠে এই আশা? খুব উচ্চাঙ্গের আশা নয়। তবু স্বার্থপর মন ওই আশাকেই আঁকড়ে ধরেছে। ভাবছি, জামাইবাবুর মনেও কি এই আশা উঁকিঝুঁকি মারছে?

বললুম, যদি সুবিধে পাই ফোন করব। ব্যাগ নিয়ে আমি বেরিয়ে পড়লুম। জামাইবাবুর বাড়িতে কখনও যাইনি, কিন্তু খুঁজে নিতে পারব।

জামাইবাবুর বাড়ি কলকাতার উত্তরাংশে। দোতলা বাড়ি; নীচের তলায় একটা সাধারণ বসবার ঘর, চাকরদের ঘর, রান্নাঘর, ভাঁড়ার। একজন চাকর সদরে দাঁড়িয়ে ছিল, আমাকে দেখে বলল, আপনি কি মিস ভৌমিক? এই সিঁড়ি দিয়ে উঠে যান, ডাক্তারবাবু ওপরে আছেন।

দোতলায় সিঁড়ির মুখেই একটা ঘর, ড্রয়িং রুমের মত সাজানো। সোফা-সেট আছে, সাজসরঞ্জাম আছে; কিন্তু কিছুরই ছিরিছাঁদ নেই। সব এলোমেলো অপরিচ্ছন্ন।

জামাইবাবু সোফায় বসে একজন বৃদ্ধ ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলছিলেন। ডক্টর বর্ধন কলকাতার ডাক্তার-সমাজের মাথার মণি; প্রায় সব ডাক্তারই তাঁর শিষ্য। তিনি আমাকে চেনেন না, কিন্তু আমি তাঁকে চিনি। আমি যখন ঘরে ঢুকলুম তখন তিনি শান্ত গম্ভীর গলায় বলছেন,…তুমি নিজের হাতে রেখো না আমাকে দেখে থেমে গেলেন।

জামাইবাবু বললেন, না স্যার। এস প্রিয়ংবদা।

ডক্টর বর্ধন বললেন, আমি উঠি। দরকার হলে জানিও।

জানাব স্যার।

ডক্টর বর্ধন চলে গেলেন। জামাইবাবু তাঁকে গাড়িতে তুলে দিয়ে ফিরে এলেন, আমাকে বললেন, বোস সখি। আমি সোফার একপাশে বসলুম। তিনিও সোফায় বসে কিছুক্ষণ গালে হাত দিয়ে কী ভাবলেন, তারপর আমার দিকে ফিরে একটু ফিকে হেসে বললেন, তোমাকে ডেকে ভুল করেছি সখি। যাহোক, এসেছ যখন দেখে যাও।

কখন কী হল আগে বলুন।

তিনি হেলান দিয়ে বসে উস্কখুস্ক চুলে হাত বুলিয়ে বললেন, কাল রাত্রি দশটার সময় কেউ একজন ফোন করেছিল…আমি বাড়ি ছিলাম না…ফোন পাবার পর আমার স্ত্রী ভীষণ চেঁচামেচি শুরু করেন, তারপর রাত্রি সাড়ে এগারোটার সময় অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান। আমি এসে দেখি—স্ট্রোক হয়েছে, বাঁ অঙ্গটা পড়ে গেছে।

বললুম, কে ফোন করেছিল জানা গেছে কি?

তিনি চকিত হয়ে চাইলেন, না। তুমি জান?

জানি। মন্মথ কর। বলে কাল বিকেলের ঘটনা বললুম।

তিনি একটা নিশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালেন, হুঁ। আমারও তাই সন্দেহ হয়েছিল। মন্মথ করের উদ্দেশ্য কিন্তু সিদ্ধ হল না, সে যা চেয়েছিল তার উল্টো ফল হল।—এস।

তিনি আমাকে শোবার ঘরে নিয়ে গেলেন। খাটের পায়ের কাছে একজন ঝি দাঁড়িয়ে আছে, আর খাটে শুয়ে আছেন একটি মহিলা। আগে তাঁকে দেখিনি, এই প্রথম দেখলুম। লম্বা হাড়ে-মাসে শরীর, মুখে বেশী মাংস নেই, রঙ লালচে সাদা, ঘন জোড়া-ভুরু, নাকটা মুখের ওপর খাঁড়ার মত উঁচু হয়ে আছে। মুখের বাঁ দিকটা রোগের আক্রমণে বেঁকে গেছে। তুব যৌবনকালে ইনি উগ্র ধরনের সুন্দরী ছিলেন তা এখনও বোঝা যায়। ইনিই ডক্টর নিরঞ্জন দাসের স্ত্রী।

আমরা খাটের পাশে গিয়ে দাঁড়ালুম। রোগিণী আমাদের দিকে মাথা ঘোরাতে পারলেন না, কেবল চোখ ফিরিয়ে তাকালেন। মানুষের চোখে এমন বিষাক্ত আক্রোশ আর বোধহয় কখনও দেখিনি। চমকে উঠতে হয়। তারপর তাঁর গলা দিয়ে আওয়াজ বেরুল; বিকল স্বরযন্ত্রের আওয়াজ, কিছু বোঝা গেল না। জামাইবাবু তাঁর মুখের কাছে ঝুঁকে জিজ্ঞেস করলেন, কিছু বলবে?

আবার তাঁর মুখ দিয়ে গোঙানির মত শব্দ বেরুল, যার মানে বোঝা না-গেলেও মনের ভাব বুঝতে কষ্ট হয় না। জামাইবাবু আমার দিকে ফিরে বললেন, চল, আমাদের দেখে উনি উত্যক্ত হচ্ছেন।

বাইরের ঘরে ফিরে গিয়ে জামাইবাবুর মুখের পানে চাইলুম। তিনি বললেন, ভেবেছিলাম নিজেই চিকিৎসা করব, তোমরা দেখাশোনা করবে। কিন্তু মাস্টারমশাই যা বলে গেলেন তারপর আর তা সম্ভব নয়। স্ত্রীর সঙ্গে আমার বনিবনাও নেই একথা জানাজানি হয়ে গেছে, এমনকী মাস্টামশায়ের কানে পর্যন্ত উঠেছে। আমার চিকিৎসায় যদি কিছু মন্দ ফল হয় বুঝতে পারছ? তার চেয়ে হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া ভাল। সেখানে অন্য ডাক্তার চিকিৎসা করবেন, আমার কোনও দায়। থাকবে না। আমি কেবল বাইরে থেকে দেখাশোনা করব।

জিগ্যেস করলুম, রোগের প্রগনসিস্ কী রকম?

মাথা নেড়ে বললেন, কিছু বলতে পারি না। অবশ্য আরাম হবার কোনও আশাই নেই, কিন্তু এই অবস্থায় পাঁচ বছর বিছানায় শুয়ে থাকাও সম্ভব।

বুক দমে গেল। তিনি আমার মনের অবস্থা বুঝে একটু হেসে বললেন, সখি, দুনিয়ার কাছে কিছু আশা কোরো না, তাহলেই ধাক্কা খাবে। সংসার নিজের নিয়মে চলে, আমাদের আশা-আকাঙক্ষার তোয়াক্কা রাখে না। চল, গাড়িতে তোমায় বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসি।

প্রায় আঁতকে উঠলুম, আপনি ওখানে যাবেন?

তাঁর মুখে কেমন একরকম হাসি ফুটে উঠল; তার কতকটা ব্যঙ্গ কতকটা আত্মগ্লানি। বললেন, এখন আর ভয় কিসের? লজ্জাই বা কিসের? আমি অবশ্য কোনওদিনই লজ্জা করিনি, কিন্তু কেচ্ছা-কেলেঙ্কারি দাঙ্গা-হাঙ্গামার ভয় ছিল; এখন আর তাও নেই।–চল, তোমাকে পৌঁছে দিয়ে হাসপাতালে যাব। সেখানে একটা প্রাইভেট ক্যাবিনের ব্যবস্থা করে আজই রুগীকে রিমুভ করতে চাই।

বাসার সামনে আমাকে নামিয়ে দিয়ে বললেন, শুক্লাকে বলল যেন বেশী বিচলিত না হয়। আমি যদি পারি রাত্তিরে আসব।

শুক্লা বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল, আমি আসতেই আমাকে খামচে ধরল,—ফিরে এলি যে?

যা দেখেছি যা শুনেছি সব তাকে বললুম, সে আমাকে খামচে ধরে বসে রইল। শেষে ভয়-জড়ানো সুরে বলল, কী হবে প্রিয়া?

বললুম, জামাইবাবু বলেছেন, দুনিয়ার কাছে কিছু আশা কোরো না, তাহলেই ধাক্কা খাবে। তোকে বেশী বিচলিত হতে মানা করেছেন। আজ রাত্তিরে হয়তো আসতে পারেন।

শুক্লা কিছুক্ষণ বুকে ঘাড় গুঁজে বসে রইল, তারপর উঠে স্নান করতে চলে গেল। স্নান করে যখন ফিরে এল তখন তার মুখ দেখে বুঝলুম, সে মন শক্ত করেছে। উঃ, আশা মানুষের মনকে কী দুর্বলই করে দিতে পারে।

জামাইবাবু কিন্তু রাত্তিরে এলেন না, বাড়ি থেকে ফোন করলেন,—আজ হাসপাতালে ক্যাবিন পাওয়া গেল না। কাল একটা খালি হবে। আজ তোমাদের বাসায় যেতে পারব না, রোগীর কাছে থাকতে হবে।

আমি যাব?

না, তাতে বিপরীত ফল হতে পারে। শুক্লাকে ফোন দাও, তার সঙ্গে দুটো কথা বলি।

শুক্লার হাতে ফোন দিয়ে আমি সরে গেলুম—

পরদিন শুক্রবার। সন্ধ্যের পর জামাইবাবু এলেন। আমি নিজের ঘরে ছিলুম, বেরিয়ে এসে শুক্লার ঘরে গলার আওয়াজ পেয়ে সেই দিকে গেলুম। দোরের কাছে দাঁড়িয়ে দেখি, জামাইবাবু ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছেন, আর শুক্লা তাঁর বুকে মাথা রেখে অঝোরে কাঁদছে।

পা টিপে টিপে সরে আসছিলুম, জামাইবাবু হাত নেড়ে বললেন, সখি, এদিকে এস। তুমি। শুক্লাকে বোঝাও যে এবার বিয়ে করলে কেউ নিন্দে করবে না।

আমি সসংকোচে ঘরে ঢুকলুম; ওরা যেমন ছিল তেমনই দাঁড়িয়ে রইল। লজ্জা করতেও ভুলে গেছে। জামাইবাবু বললেন, এত বোঝাচ্ছি কিছুতেই বুঝছে না।

শুক্লা মাথা নেড়ে কান্না-ভরা গলায় বলল, না, আমি বুঝব না। তুমি আমাকে লোভ দেখিও। এখন বিয়ে করলে সবাই তোমায় ছি ছি করবে, শহরে কান পাতা যাবে না। তুমি শ্রদ্ধা হারাবে, সম্মান হারাবে, পসার হারাবে। সে আমি কিছুতেই হতে দেব না।

জামাইবাবু বললেন, এখন ছি-ছির কিছু বাকী আছে? তোমার-আমার কথা সবাই জানতে পেরেছে।

তা জানুক। তাতে আমার নিন্দে, তুমি পুরুষমানুষ, তোমার নিন্দে নেই। কিন্তু যদি বিয়ে কর, সবাই জো পেয়ে যাবে। তুমি গাইনকোলজিস্ট, কেউ তোমাকে মেয়েদের চিকিৎসা করতে ডাকবে না।

জামাইবাবু গাঢ়স্বরে বলে উঠলেন, কিন্তু শুক্লা, আমি যে সংসার চাই, ছেলেমেয়ে চাই—

আর আমি কি চাই না? শুক্লা ভিজে চোখ তুলে তাঁর মুখের পানে তাকাল।

হঠাৎ যেন আমার চোখ খুলে গেল। ওদের মনের এই দিকটা এতদিন দেখতে পাইনি। সন্তানের জন্যে কী তীব্র কামনা ওদের মনে। সাধারণ পাঁচজনের মত সংসারের সাধ, সন্তানের সাধ। অথচ বর্তমান অবস্থায় তা তো হবার নয়। তাই জামাইবাবু শুক্লাকে বিয়ে করবার জন্যে এমন ক্ষেপে উঠেছেন। কিন্তু শুক্লা তা হতে দেবে না; বুক ফেটে গেলেও সে জামাইবাবুর এতটুকু অনিষ্ট হতে দেবে না।

শেষ পর্যন্ত জামাইবাবু রাগ করে চলে যাচ্ছিলেন, আমি হাত ধরে ফিরিয়ে আনলুম,—না-খেয়ে যেতে পাবেন না।

তাঁর রাগ কিন্তু বেশীক্ষণ রইল না। খানিক পরেই হেসে বললেন, বিয়ে না করলে তো বয়ে গেল, গোঁফজোড়াতে দিলে চাড়া তোমার মত অনেক মেয়ে পাব। কিন্তু একটা কাজ তো করতে পার; আমার বাড়িটা গরুর গোয়াল হয়ে আছে, সেটাকে ঝেড়েঝুড়ে পরিষ্কার করে দিতে পার। করবে?

আমি বলে উঠলুম, নিশ্চয় পারব। আমরা দুজনে মিলে আপনার বাড়ি তকতকে ঝকঝকে করে দেব। কি বলিস শুক্লা?

শুক্লার কান্না-বোয়া চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, সে ঘাড় নেড়ে সায় দিল।

আমি বললুম, কাল সকালেই আমরা যাব। একদিনে যদি কাজ শেষ না হয় পরশুও যাব। আপনার বাড়ির পঙ্কোদ্ধার করে ছেড়ে দেব। অনেক খরচ কিন্তু। দরজা-জানলার পর্দা ফেলে দিতে হবে, সোফা-সেটের স্প্রিং গদি সব বদলাতে হবে। পাঁচশো টাকার কমে হবে না। দেবেন তো?

জামাইবাবু ভীষণ খুশি হলেন। খাওয়া-দাওয়ার পর কিন্তু তিনি রইলেন না। হাসপাতালে গিয়ে স্ত্রীর রিপোর্ট নেবেন, তারপর বাড়ি যাবেন।

পরদিন, অর্থাৎ কাল সকালবেলা, চা খেয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লুম। শুক্লার একটু ভয়-ভয় ভাব, কিন্তু মুখে কিছু প্রকাশ করছে না। বাড়িতে পৌঁছে দেখলুম, জামাইবাবু কাজে বেরিয়ে গেছেন; চাকর বলল, আমার নাম সুবোধ। বাবু হুকুম দিয়ে গেছেন আপনাদের যা চাই সব জোগাড় করে দিতে। আমি দুটো জন-মজুর ডেকে এনেছি। আর কী কী চাই হুকুম করুন।

আমি বললাম, আমরা আগে বাড়িটা আগাগোড়া দেখতে চাই।

আজ্ঞে আসুন, বলে সুবোধ আমাদের ভিতরে নিয়ে গেল। আড়চোখে লক্ষ্য করলুম, শুক্লার চোখে জল এসেছে। আমি আর তার পানে তাকালুম না।

বাড়িতে একটা চাকর একটা ঝি, সুবোধ আর শশী। তাছাড়া রান্নার জন্য বামুন-মেয়ে আছে। মোটর-ড্রাইভার পঞ্চও বাড়িতেই থাকে। নীচের তলাটা অত্যন্ত অপরিষ্কার; রান্নাঘর জলে কাদায় একটু হয়ে আছে; ছাতলাধরা কলতলাতে পা দিতে ভয় করে। জামাইবাবুর অর্ধাঙ্গিনী শুধু চেঁচাতে পারতেন, সুগৃহিণী ছিলেন না।

সুবোধকে ডেকে বললুম, খানিকটা চুন আর বালি আনিয়ে নাও; আর নারকেল ছোবড়া। মজুর দুটোকে লাগিয়ে দাও, তারা ঘষে-মেজে কলতলা পরিষ্কার করুক।

সুবোধ আজ্ঞে বলে চলে গেল।

বামুন-মেয়ে ধোঁয়া-ভরা রান্নাঘর থেকে উঁকি মেরে আমাদের দেখছিল। বেঁটে মোটা আধবয়সী মেয়েমানুষ, চোখ-ভরা কৌতূহল। তাকে ডেকে বললুম, আজ দুপুরবেলা আমরা দুজনে এখানে খাব। ডাক্তারবাবুও খাবেন। সে থানের আঁচলটা মাথায় তুলে দিতে দিতে ঘাড় নাড়ল। আমাদের কী ভাবল কে জানে!

নীচেরতলার মোটামুটি ব্যবস্থা করে আমরা ওপরে গেলুম। ওপরতলার অবস্থা ওরই মধ্যে ভাল, কিন্তু তবু দেখলে গা কিচকিচ করে। জানলার কাছে এত ময়লা জমেছে যে আলো ঢোকে না, মেঝে এত নোংরা যে মোজেইকের কাজ প্রায় দেখা যায় না। তাছাড়া জানলা-দরজার পর্দা খাট বিছানা চেয়ার টেবিল টেনে ফেলে দিলেই হয়। শশী-ঝি ওপরে ছিল, আমাদের দেখে কাছে এসে দাঁড়াল। তাকে বললাম, তুমি বাড়ির ঝি? এ কী অবস্থা করে রেখেছ বাড়ির? বাড়িতে কি ঝটপাটও পড়ে না?

শশী-ঝি বুঝেছিল আমরা হেঁজিপেঁজি নই, তাই নাকি সুরে আরম্ভ করল, আমি একা মানুষ, কোন্ দিক দেখব মা। নীচে বাসন মাজা, কাপড় কাচা, কুটনো কোটা, বাটনা বাটা; ওপরে গিন্নী-ঠাকরুনের ফাইফরমাস, পান সাজা। তার ওপর মুখঝামটা। সারাদিন ওপর আর নীচে, ওপর আর নীচে। একটা গতরে কত সামলাব?

বললুম, আচ্ছা, হয়েছে। বাড়িতে গুঁড়ো সাবান আছে?

শশী বলল, আছে মা, কাপড় কাচার গুঁড়ো সাবান আছে।

বেশ। নীচে গিয়ে এক বালতি জল গরম করে তাতে গুঁড়ো সাবান দিয়ে নিয়ে এস। ঘরদোর সব ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করতে হবে।

হ্যাঁ মা, বলে শশী চলে গেল।

আমি আঁচল দিয়ে গাছ-কোমর বাঁধতে বাঁধতে শুক্লাকে বললুম, নে কোমরে আঁচল জড়া। তোকেও কাজ করতে হবে। তোর ঘর-দোর আমি একা পরিষ্কার করতে পারব না।

শুক্লা লাল হয়ে উঠল, তারপর কোমরে আঁচল জড়াতে লাগল।

দুপুর পেরিয়ে জামাইবাবু এলেন। সঙ্গে অনেক খাবার এনেছেন; মধুক্ষরার নিখুঁতি, দই সন্দেশ। বাড়ি দেখে বললেন, আরে বাঃ! বাড়ির চেহারা ফিরে গেছে। তোমাদের খাবার কী ব্যবস্থা হয়েছে জানি না, তাই বাজার থেকে খাবার এনেছি।

বামুন-মেয়ে অবশ্য রান্নাবান্না করে রেখেছিল। ওপরে খাবার দিয়ে গেল, আমরা তিনজনে একসঙ্গে বসে খেলুম। তারপর খানিকক্ষণ গল্পসল্প করে আমাদের হাতে পাঁচশো টাকা দিয়ে জামাইবাবু চলে গেলেন।

আমরাও বাজার করতে বেরলুম। পদা, বিছানার চাদর, মশারি, বালিশ, কত কী যে কিনতে হবে ঠিক নেই।

সন্ধ্যের পর ক্লান্ত শরীর নিয়ে বাসায় ফিরে এলাম। এ আমার ভালই হয়েছে, নিজের কথা ভাববার সময় পাচ্ছি না। মাঝে মাঝে যখন মনে পড়ে যাচ্ছে তখন বুকের মধ্যে খচ খচ করে উঠছে।

স্নান করে তাড়াতাড়ি রাত্রির খাওয়া খেয়ে নিলুম। তারপর শুয়ে পড়লুম। সারারাত্রি খুব ঘুমিয়েছি, একবারও ঘুম ভাঙেনি। রাত্রে জামাইবাবু এসেছিলেন কি না তাও জানতে পারিনি।

আজ সকালে ঘুম ভেঙে দেখি, আকাশে মেঘ জমেছে, ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে।

কাল জামাইবাবুর বাড়ির কাজ শেষ হয়নি; আমরা দুজনে চা খেয়ে বেরুতে যাচ্ছি, টেলিফোন বেজে উঠল। হয়তো জামাইবাবু, তাঁর স্ত্রীর কোনও খবর আছে।

তাড়াতাড়ি গিয়ে ফোন ধরলুম। কিন্তু জামাইবাবু নয়, শঙ্খনাথবাবু। গলার আওয়াজ ভারী-ভারী। বললেন, তুমি আছ? আমি এখনি যাচ্ছি।

কী হয়েছে?

মুখেই বলব।

আচ্ছা, আসুন।

ফোন রেখে শুক্লাকে বললুম, শঙ্খনাথবাবু আসছেন। কী দরকার বললেন না। তুই বরং এগিয়ে যা, আমি পরে যাব।

শুক্লা বলল, না, দুজনে একসঙ্গে যাব।

পনেরো মিনিট পরে খট্ খট্‌ করে দোরের কড়া নড়ে উঠল। গাড়ি কখন এসেছে জানতে পারিনি; দোর খুলে দেখি, সামনে শঙ্খনাথবাবু, তাঁর পিছনে পিউকে কোলে নিয়ে কলাবতী।

ইটের পাঁজায় আগুন দিলে বাইরে থেকে আগুন দেখা যায় না, কিন্তু কাছে গেলে গায়ে আঁচ লাগে। উনি যখন আমার কাছে এসে দাঁড়ালেন তখন আমার গায়ে যেন আঁচ লাগল। কী হয়েছে? ভয়ঙ্কর একটা কিছু হয়েছে। পিউকে নিয়ে উনি এসেছেন কেন?

আমার মুখ দিয়ে একটা কথাও বেরুল না, নির্বাক হয়ে চেয়ে রইলাম। উনি তখন কথা বললেন। যেন অতি কষ্টে নিজেকে সংযত করে রেখেছেন এমনইভাবে বললেন, প্রিয়দম্বা, পিউকে নিয়ে এসেছি, সে দিনকতক তোমার কাছে থাকবে।

এই কথা শুনে আমার অবস্থা কী হল তা আমি বোঝাতে পারব না, শুধু মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল,—পিউ আমার কাছে থাকবে!

হ্যাঁ। আমি–

শুক্লা আমার পিছনে এসে দাঁড়িয়ে ছিল, সে বলল, আগে ঘরে এসে বসুন। এই বুঝি পিউ? ওমা, এ তো মেয়ে নয়, এ যে চাঁদের কণা। এই বলে পিউকে কলাবতীর কোল থেকে কেড়ে নিল।

শঙ্খনাথবাবু ঘরে এসে বসলেন,—আমি কিছুদিনের জন্যে বাইরে যাচ্ছি। পিউকে তোমার কাছে রেখে যাব। তুমি ছাড়া আর কাউকে বিশ্বাস করতে পারি না।

আমরা দেয়ালে-আঁকা ছবির মত দাঁড়িয়ে রইলুম। শেষে বললুম, কিন্তু–কিন্তু–হঠাৎ–

তিনি পকেট থেকে একতাড়া নোট বার করে টেবিলের উপরে রাখলেন, বললেন, এই টাকা রইল, যা দরকার হয় খরচ কোরো। কলাবতীকে এখানে রাখলে ভাল হত; কিন্তু ওর নিজের বাচ্চা আছে, তাকে ছেড়ে এখানে থাকতে পারবে না। ও দুবেলা এসে পিউকে খাইয়ে যাবে।

আপনি কোথায় যাচ্ছেন? কতদিনের জন্যে যাচ্ছেন?

কিছু ঠিক নেই। দশ-পনরো দিনের মধ্যেই ফিরব বোধহয়।

তিনি আমার প্রশ্ন এড়িয়ে যাচ্ছেন দেখে আমার আশঙ্কা আরও বেড়ে গেল। বললুম, কী হয়েছে আমি জানতে চাই।

এতক্ষণ তিনি সংযতভাবে কথা বলছিলেন, এবার একেবারে হুঙ্কার ছেড়ে চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠলেন। শুক্লা তাই দেখে পিউকে নিয়ে ঘর ছেড়ে পালাল, কলাবতী তার পিছু পিছু গেল। শঙ্খনাথবাবু বললেন, কী হয়েছে। যা হবার তাই হয়েছে। সলিলা পালিয়েছে। ওই শালা লটপট সিংয়ের সঙ্গে পালিয়েছে। আমাকে মিছে কথা বলেছিল, বাপ আসেনি, কেউ আসেনি। সেই রাত্রেই পালিয়েছে।

মনটা যেন অসাড় হয়ে গেল। সেই রাত্রেই সলিলা আমার চোখের সামনে স্বামীকে ছেড়ে আর-একজনের সঙ্গে চলে গেছে। কিন্তু–

প্রশ্ন করলুম, আপনি কী করে জানলেন যে ওই লোকটার সঙ্গেই পালিয়েছে?

বললেন, আমি জানতে পেরেছি। ডাক্তার মন্মথ কর কাল রাত্রে টেলিফোন করেছিল—সে দেখেছে হাওড়া স্টেশনে সলিলা আর লেফটেনেন্ট লট্‌পট্ সিং একসঙ্গে ট্রেনে উঠছে।

এখানেও মন্মথ কর। পরের জীবনের গুপ্ত রহস্য খুঁজে বেড়ানই বোধ হয় ওর কাজ।

আমি ভেবেছিলাম সলিলা ঝগড়াঝাঁটি করে বাপের কাছে চলে গেছে। ইচ্ছে করেই খোঁজ নিইনি, আসবার হয় আপনি আসবে। এখন দেখছি বাপ নয়, নাগরের সঙ্গে পালিয়েছে। শুধুহাতে যায়নি, নিজের গয়নাগাঁটি যা ছিল সব নিয়ে গেছে। যাকগে, চুলোয় যাক গয়না। আমি চললুম। পিউকে দেখো।

তিনি দোরের দিকে চললেন। আমার মাথার মধ্যে সব ওলটপালট হয়ে গেল, ছুটে গিয়ে তাঁর সামনে দাঁড়ালুম,—সলিলা পালিয়েছে কিন্তু তুমি যাচ্ছ কোথায়? সলিলাকে ফিরিয়ে আনতে? অকে ফিরিয়ে এনে আবার ঘরকন্না করবে?

তিনি গর্জে উঠলেন, না, ফিরিয়ে আনতে যাচ্ছি না। সে আমার মুখে চুনকালি দিয়েছে, তারই জবাব দিতে যাচ্ছি।

জবাব! কী জবাব দেবে তুমি?

এই যে জবাব। এই বলে পকেট থেকে একটা পিস্তল বার করে দেখালেন। পিস্তল আগে কখনও দেখিনি, সিনেমায় দেখে তার চেহারা জানা ছিল। কাঁপতে কাঁপতে বললুম, খুন করবে?

দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, কুকুরের মত গুলি করে মারব জানোয়ার দুটোকে।

কিন্তু–কিন্তু যদি ধরা পড়?

ধরা পড়ি, ফাঁসি যাব।

না না, আমি তোমাকে যেতে দেব না–

তারপর মুহূর্তের জন্যে বোধ হয় জ্ঞান ছিল না, যখন জ্ঞান হল দেখি সিঁড়ির দরজা ধরে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি, উনি চলে গেছেন।

<

Sharadindu Bandyopadhyay ।। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়