তীর্থনাথ ও কিশোরের মধ্যে সম্বন্ধটা ঠিক যে বন্ধুত্ব ছিল, তাহা বলা চলে না। তবে কলেজ-হস্টেলের একই ঘরে থাকিয়া এবং একসঙ্গে সর্বদা ওঠাবসা করিয়া দুইজন সম্পূর্ণ বিভিন্ন প্রকৃতির লোকের মধ্যে যতদূর ঘনিষ্ঠতা হওয়া সম্ভব, তাহা হইয়াছিল।

তীর্থনাথ কিশোর অপেক্ষা বয়সে বছর চারেকের বড় ছিল। তাহার স্বভাবটা ছিল অত্যন্ত মৃদু নির্বিরোধ। কলেজে কয়েক ঘণ্টা ছাড়া সে কোথাও বাহির হইত না, নিজের ঘরটিতে শান্তভাবে বসিয়া বই পড়িত এবং চুরুট টানিত। কিশোরের চরিত্র ছিল ঠিক তাহার বিপরীত। সারা বছর পড়াশুনা করিত না, কিন্তু পরীক্ষা ঘাড়ের উপর আসিয়া পড়িলে ঘরে খিল দিয়া কয়েক দিন এমন পড়াই পড়িত যে বেশ ভাল করিয়া পাস করিয়া যাইত। অপর দিকে ফুটবল-হকি-ক্রিকেটের হুজুগে সে সর্বদাই মাতিয়া থাকিত, সভা-সমিতির হৈ-চৈ ব্যাপারেও সে ছিল একজন বড় পাণ্ডা। থিয়েটার জিনিসটা সে সহ্য করিতে পারিত না,সমস্ত রাত জাগিয়া বসিয়া থাকা তাহার পোষাইত না, কিন্তু বায়োস্কাপ দেখিয়া সে খেদ মিটাইয়া লইত।

দুজনের চেহারাও ভগবান বিপরীত করিয়া গড়িয়াছিলেন। তীর্থনাথ বেঁটে ও কৃশ, মস্ত বড় মাথাটি বহন করিয়া ঘাড়টি যেন অত্যন্ত শীর্ণ হইয়া পড়িয়াছে, চোখে মোটা কাচের চশমা। আর কিশোর ছ ফুট লম্বা, দোহারা, অসাধারণ বলবান, গৌরবর্ণ এবং সুশ্রী, কাচের চশমা পরিয়া তাহার চোখের সহজ তীক্ষ্ণ-দৃষ্টিকে কোনদিনই তীক্ষ্ণতর করিবার প্রয়োজন হয় নাই। আবার অর্থের দিক দিয়াও তীর্থনাথের ছিল অদ্য ভক্ষ্য ধনুগুণ, বাপ-মা ভাই-বোন কেহই ছিল না, জলপানির টাকায়। কোনও মতে পড়ার খরচ চালাইত। কিশোরের ধনী বাপ জীবিত ছিলেন; কিশোরের মাতার মৃত্যুর পর প্রৌঢ়বয়সে দ্বিতীয়বার বিবাহ করিয়া নতুন সংসার পাতিয়াছিলেন বটে এবং প্রথম পক্ষের একমাত্র সন্তানের প্রতি স্নেহের বন্ধন কিছু আলগা হইয়া পড়িয়াছিল তাহাতেও সন্দেহ নাই; কিন্তু কিশোরের প্রয়োজনমত টাকা পাঠাইতে তিনি কোনও দিন কৃপণতা করেন নাই। কলেজের ছুটি হইলে কিশোর বাক্স-বিছানা বাঁধিয়া বাড়ি যাইত, কিন্তু সেখানে ছোট বৈমাত্র ভাই-বোন ও প্রায়। সমবয়স্কা বিমাতার সংসর্গে তাহার মন টিকিত না। ছুটি ফুরাইবার পূর্বেই একটা ছুতা করিয়া সে কলিকাতায় ফিরিয়া আসিত। তীর্থনাথের দেশ একটা ছিল বটে, কিন্তু বাড়ি বলিতে কিছুই ছিল না, কাজেই সে ছুটির সময়েও হস্টেলে পড়িয়া থাকিত।

সন্ধ্যার পর কিশোর যখন অন্যান্য বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে ফুটবল ম্যাচ কিংবা শরবাবুর আধুনিকতম উপন্যাস সম্বন্ধে সতেজ তর্ক করিত, তীর্থনাথ তখন নিজের কোণটিতে বসিয়া নিবিষ্ট মনে বই পড়িত। এবং খেলো সিগারেটের ধোঁয়ায় ঘরের বাতাস ভারী করিয়া তুলিত। গল্প শেষ হইলে কিশোর তাহাকে বলিত, তীর্থদা, ধন্য বটে তুমি! আমাদের এত গল্প হয়ে গেল, একটা কথাও কি তোমার কানে গেল না? কখনও যদি তোমার নিমতলা প্রাপ্তি হয় তো সে ঐ পচা সিগারেট আর রাতদিন বই পড়ার গুণে! তীর্থনাথ মুখ তুলিয়া অন্যমনস্কভাবে একটু হাসিয়া আবার পাঠ্যপুস্তকে ড়ুবিয়া যাইত।

তারপর একদিন তীর্থনাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সব পরীক্ষা শেষ করিয়া একটা স্কুলের মাস্টারি পাইয়া দেশে চলিয়া গেল। যাইবার সময় কিশোরকে নিজের ঠিকানা দিয়া বলিয়া গেল, মাঝে মাঝে চিঠিপত্র দিও। বিদায় দিবার সময় কিশোরের মনটা একটু খারাপ হইল বটে কিন্তু তাহা নিতান্তই। স্বাভাবিক। যাহার সহিত তিন বৎসর একই ঘরে কাটাইয়া দিয়াছে, তাহার বিদায়ের সময় মনটা যদি একটু বিষণ্ণও না হয়, তবে তাহাকে ঘোর পাষণ্ড বলিতে হইবে।

মাস ছয়েক পরে গোলাপী খামে একখানা চিঠি আসিল-তীর্থনাথের বিবাহ। ছাপাননা। নিমন্ত্রণপত্রের উল্টা পিঠে তীর্থনাথ নিজের হাতে লিখিয়া দিয়াছে, নিশ্চয় আসিতে হইবে, না। আসিলে চলিবে না। চিঠিখানা একটা বইয়ের মধ্যে রাখিয়া কিশোর ভাবিল, এই তো কাছেই যশোর, তীর্থদা যখন এত করিয়া লিখিয়াছে, তখন একদিনের জন্য যাইতে হইবে। কিন্তু বিবাহের দিনটা তাহার তন্দ্রাভিভূত স্মরণশক্তির উপর দিয়া এমনই লঘু পদে চলিয়া গেল যে, সপ্তাহকাল অতীত হইবার পূর্বে সে কথা আর মনে পড়িল না। যখন পড়িল, তখন সে অনুতপ্তভাবে মার্জনা চাহিয়া একখানা চিঠি লিখিয়া দিল।

ইহার পর আরও বছর তিনেক গত হইয়াছে। কিশোর সম্মানের সহিত এম. এসি পাস করিবার পর আমহার্স্ট স্ট্রীটে একখানা ছোট বাসা ভাড়া লইয়া বেকারভাবে বসিয়া ছিল। পয়সা রোজগারের কোন তাড়া ছিল না, অথচ কিছু না করিয়া বসিয়া থাকিতেও তাহার মন উঠিতেছিল না। অনেক দিন বাড়ি যাওয়া হয় নাই, সেখানেও একবার যাওয়া দরকার, কিন্তু ভিতর হইতে সেদিক পানে কোন তাগিদ ছিল না। একটা কিছু করিতে হইবে, এমনই মনোভাব লইয়া সে গড়িমসি করিতেছিল, এমন সময় হঠাৎ তীর্থনাথের নিকট হইতে তার আসিল—শীঘ্র এসো, আমি মুমূর্য। কিশোর বিলম্ব করিল না, সেই দিন একটা ব্যাগে গোটাকয়েক জামা কাপড় পুরিয়া লইয়া যশোর যাত্রা করিল।

যশোর পৌঁছিয়া হাই স্কুলের মাস্টার তীর্থনাথের বাড়ি খুঁজিয়া লইতে বিলম্ব হইল না। ভাড়াটে বাড়ি, অতিশয় জীর্ণ, উপরে খোলার ছাদ, কিশোর কড়া নাড়িতেই একটি কুড়ি-একুশ বছর বয়সের মেয়ে আসিয়া দ্বার খুলিয়া দিল। কিশোর তাহাকে দেখিয়া বুঝিল, তীর্থনাথের স্ত্রী। কিন্তু কী অপরূপ রূপসী এই রমণী! রুক্ষ চুল, ময়লা কাপড়, গহনা না থাকারই মধ্যে, রাত জাগিয়া চোখের কোণে কালি পড়িয়াছে, কিন্তু তাহার মধ্য দিয়াও রূপের জ্যোতি যেন বিচ্ছুরিত হইতেছে। কিশোর একবার চোখ তুলিয়াই সসম্রমে মাথা নীচু করিয়া ফেলিল।

তীর্থনাথের তখন যক্ষ্মার শেষ অবস্থা, কিশোরকে দেখিয়া তাহার অত্যন্ত নিষ্প্রভ চক্ষু দুটা যেন একটু সজীব হইল। তাহার হাতখানা নিজের কঙ্কালসার অঙ্গুলির মধ্যে টানিয়া লইয়া ক্ষীণস্বরে বলিল, এসেছ?

তীর্থনাথের অবস্থা দেখিয়া কিশোরের চোখে জল আসিয়া পড়িয়াছিল, সে তাহার মুখের উপর ঝুঁকিয়া পড়িয়া রুদ্ধস্বরে বলিল, শুধু পড়ে পড়ে আর সিগারেট খেয়ে জীবনটা নষ্ট করে ফেললে, তীর্থদা? ঘরের মেঝেয় তখনও এককোণে স্তুপে ভূপে বই ও সিগারেটের টিন পড়িয়া ছিল।

তীর্থনাথের চর্মসার মুখে যেন একটু ব্যথার ভাব প্রকাশ পাইল; সে বলিল, বড় ভুল করেছি, ভাই। আগে বুঝতে পারিনি, কিন্তু এখন আর ফেরবার পথ নেই। হঠাৎ একদিন মুখ দিয়ে রক্ত উঠল-সাবধান হবার সময় তো দিলে না। কষ্ট আর কিছু নয়— চক্ষু দুটা মাথার শিয়রের দিকে তুলিয়া বলিল, ওর জন্যেই একটু ভাবনা হত। কিন্তু তুমি যখন এই শেষ সময় এসে পড়েছ, তখন আর ভাবনা নেই।

কিশোর বলিল, আর দুদিন আগে আমায় খবর দিলে না কেন, তীর্থদা?

তীর্থনাথ বলিল, তোমার পড়াশুনার সময়, পরীক্ষা সামনে, তাই আর কিছু জানাইনি। আর, জানালেও তো বাঁচাতে পারতে না, ভাই! বরং এই ভাল হল, যাবার সময় তোমায় দেখতে পেলুম।

 কিশোরের মনের মধ্যে একটা অব্যক্ত যন্ত্রণা হইতে লাগিল, সে চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। তীর্থনাথ বোধ করি তাহার মনের অবস্থা বুঝিয়া বলিল, ট্রেনে এসেছিস, মুখ হাত-পা ধুয়ে একটু কিছু মুখে দে, কিশোর। তারপর আমার কাছে এসে বসিস, দু-একটা কথা বলব। ওঠ, আর দেরি করিস নে।

দ্বিরুক্তি না করিয়া কিশোর তীর্থনাথের স্ত্রীর পশ্চাতে ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল।  

আসন করিয়া জলখাবারের থালা কিশোরের সম্মুখে ধরিয়া দিয়া তীর্থনাথের স্ত্রী বিমলা অদূরে মেরে উপর বসিলে কিশোর জিজ্ঞাসা করিল, বাড়িতে আর কি কেউ নেই, বৌদি? আপনি একলাই—

সে মাথা নাড়িয়া বলিল, আত্মীয়-স্বজন তো কেউ নেই, তবে পাড়ার ছেলেরা বড় ভাল, সব সময়ে দেখাশুনা করে। আর, শহরের ডাক্তারবাবুরাও যথেষ্ট করেছেন, তাঁদের ঋণ শোধ দেবার নয়। কিন্তু হাজার হলেও তাঁরা সবাই পর তো, তাঁদের কাছে আর কত প্রত্যাশা করা যায়? ইনিও গছেন প্রায় পাঁচ মাস। তাই এখন বেশীর ভাগ আমাকে একলাই চালাতে হয়।

কিশোর নতমুখে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করিল, ডাক্তাররা কী বলেন?

বিমলা সহজভাবে বলিল, ডাক্তাররা জবাব দিয়ে গেছেন। আজকালের মধ্যেই বোধ হয় সব শেষ হয়ে যাবে।

কিশোর অবাক হইয়া এই অসম্ভব সংযমশালিনী নারীর মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। এ কি সত্যই সংযম, না শুধু ঔদাস্য?

কিশোরের মনের ভাব বুঝিয়া বিমলা নীরবে একটু হাসিল; কিন্তু তাহার সংশয় দূর করিবার কোন চেষ্টা করিল না।

কিশোর আসিয়া আবার তীর্থনাথের শয্যার পাশে বসিল। সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইয়া গিয়াছিল, বিমলা ঘরে আলো জ্বালিয়া দিল।

তীর্থনাথ আস্তে আস্তে জিজ্ঞাসা করিল, পাস করলি, এবার কী করবি, ঠিক করেছিস? কিশোর চুপ করিয়া রহিল দেখিয়া তীর্থনাথ একটু হাসিবার চেষ্টা করিয়া বলিল, গেজেট থেকে যতটুকু পাওয়া যায়, ততটুকু খবর তোর বরাবরই নিয়েছি, কিশোর। আমি বলি, তুই প্রফেসারি কর; বাবার পয়সা আছে বলে চুপ করে বসে থাকিস নে। আমার বিশ্বাস, ও পথে তুই উন্নতি করতে পারবি।

কিশোর চুপ করিয়াই রহিল; নিজের প্রসঙ্গ লইয়া এ সময়ে আলোচনা করিতে তাহার ভাল লাগিতেছিল না। কিন্তু অন্য কী প্রসঙ্গ তুলিয়া সে কথা পাল্টাইবে, তাহাও ভাবিয়া পাইল না। অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুকে এত কাছে এমন করিয়া সে আর কখনও দেখে নাই।

তীর্থনাথ বলিল, আচ্ছা থাক, তোর কথা আর বলব না, এবার আমার কথা বলি। কথা বেশী নয়, কিশোর, একটুখানি, কিন্তু তার পেছনে ভার প্রকাণ্ড। তোর কাঁধ যে কতখানি শক্ত, তা ভাল। করে জানি বলেই আজ তোর ওপর হঠাৎ এতবড় বোঝা চাপিয়ে দিতে পারছি। জানি, মাঝে মাঝে ভারী মনে হলেও এ বোঝা তুই ইচ্ছে করে কোন দিন ফেলতে পারবি না।

অজ্ঞাত আশঙ্কায় কিশোরের প্রাণ ভরিয়া উঠিল। কিসের ভার, কোন্ বোঝার কথা তীর্থদা বলিতেছে?

একটু থামিয়া তীর্থনাথ বলিতে লাগিল, ওকে সব কথা বলেছি, ও সব জানে। হস্টেলে থাকতে অত ছেলের মধ্যে তোকেই কেবল মনে মনে স্নেহ করতুম, কিশোর। তুই জানতিস না, একটা বইয়ের পোকা যে মানুষকে ভালবাসতে পারে, এ বোধ হয় তুই কল্পনাও করতে পারিসনি। তারপর আমি যখন চলে এলুম, তখন দুদিনেই তুই আমায় ভুলে গেলি, এমন কি আমার বিয়ের সময় পর্যন্ত এলি না। আমি কিন্তু তোকে চিনতুম, চিনতুম বলেই কোন দিন একটা গ্লানির ছায়া পর্যন্ত আমার মনে পড়েনি। আর আজ শেষ সময়, নির্ভর করতে পারব বলে কেবল তোকেই ডেকেছি।

একবার দম লইয়া তীর্থনাথ আবার আরম্ভ করিল, পৃথিবীতে আর একটি লোককে এমনই ভালবেসেছিলুম, সে ঐ মাথার শিয়রে দাঁড়িয়ে আছে। আমারই মত অভাগা ও, তিন কুলে আপনার বলতে কেউ নেই। আমরা দুজনে পরস্পরকে পেয়ে কী পরম আশ্রয়ই না পেয়েছিলুম। দারিদ্র্য হয়তো ছিল, কিন্তু অভাব ছিল না। কিন্তু আমি নির্বোধ, নিজের পায়ে কুড়ল মারলুম, ওরও সর্বনাশ করলুম।—সে যাক, ও ভেবে আর এখন কোন লাভ নেই। শরীরের যত্ন তো কোন দিনই করতে। শিখিনি, চিরদিন তাকে অবহেলার বস্তুই মনে করে এসেছি। কিন্তু আজ ওকে ছেড়ে যেতে যে কী কষ্ট হচ্ছে তা তোকে বোঝাতে পারব না, ভাই। শুধু এইটুকু সান্ত্বনা যে, ওকে তোর হাতে দিয়ে যাচ্ছি।

কিশোরের বাঙ্‌নিষ্পত্তি হইল না। সে একবার চোখ তুলিয়া দেখিল, তীর্থনাথের স্ত্রী খাটের বাজু ধরিয়া পাথরের প্রতিমার মত দাঁড়াইয়া আছে; মুখে ক্রন্দনের চিহ্নমাত্র নাই, চক্ষু দুটি স্থির, ওষ্ঠাধর এমন দৃঢ়ভাবে সম্বদ্ধ, যেন আর কিছুতেই খুলিবে না।

তীর্থনাথ পুনশ্চ বলিল, আমার কথা বুঝতে পেরেছিস, কিশোর? ওর ভার সম্পূর্ণভাবে তোর উপর দিয়ে গেলুম। তুই দেখিস-শুনিস, নিজের কাছে রাখিস। টাকা আমি কিছু রেখে যাব, যাতে একলা বিধবার কষ্টে-সৃষ্টে চলে যায়। কিন্তু টাকাই তো বড় জিনিস নয়, ভাই; ও এখনও ছেলেমানুষ, একজন পুরুষ অভিভাবক চাই, তা নইলে সংসার চারিদিকে রাক্ষসের মত হাঁ করে আছে যে।

তীর্থনাথ চুপ করিল। স্তব্ধ হইয়া কিশোর ভাবিতে লাগিল, এতখানি বিশ্বাস তাহাকে তীর্থদা করিতে পারিল কি করিয়া? মাত্র তিন বৎসর তাহারা একসঙ্গে কাটাইয়াছে, কিন্তু এই তিন বৎসরের মধ্যে এক দিনের জন্যও সে জানিতে পারে নাই যে, তীর্থনাথ তাহাকে এতখানি শ্রদ্ধা-বিশ্বাস করে। কেমন করিয়াই জানিবে? তীর্থনাথ থাকিত বই লইয়া, আর সে থাকিত জীবনের সমস্ত উত্তেজনা-উদ্দীপনার মাঝখানে। ইহার মধ্যে কখন আপনার কোণে থাকিয়া তীর্থনাথ তাহাকে নিজের বুকের অন্তরতম স্থানে টানিয়া লইয়াছিল, তাহা সে অনুভবেও জানিতে পারে নাই।

কিশোরের নিশ্চল মূর্তির দিকে চাহিয়া তীর্থনাথের মুখে উদ্বেগের ছায়া পড়িল, কি রে, পারবি না মনে হচ্ছে? বড্ড ভারী লাগছে?

ব্যাকুল হইয়া কিশোর বলিল, না দাদা, ভারী লাগছে না। কিন্তু ও-সব কথা এখন থাক, তুমি সেরে ওঠো।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া তীর্থনাথ বলিল, অঃ, বড় আরাম দিলি, কিশোর। তোর সম্বন্ধে ভয় আমার কোন কালেই ছিল না। কিন্তু তবু কত দিন দেখাশুনা নেই—অবস্থার ফেরে মানুষের মনও তো বদলে যায়। তুই কিন্তু ঠিক তাই-ই আছিস কিশোর, তেমনি সোজা আর মজবুত। তোকে দেখলে তৃপ্তি হয়। বলিয়া সস্নেহে কিশোরের গায়ে কম্পিত শীর্ণ হাতখানা বুলাইয়া দিল।

অনেকক্ষণ নীরব থাকিয়া তীর্থনাথ আবার বলিল, আমাকে মিছে আশ্বাস দেবার চেষ্টা করিস নে, কিশোর। আমি জানি, আমার হয়ে এসেছে, আজকালের মধ্যেই যাব। একটা উইল করে রেখেছি, আরও যা-কিছু কাগজপত্র—ওর কাছেই পাবি। আমার যা-কিছু সব ওর কাছে। ভাল কথা, বিয়ে করেছিস?

কিশোর ঘাড় নাড়িয়া জানাইল, না, করে নাই।

কিছুকাল শুন্যের দিকে তাকাইয়া থাকিয়া তীর্থনাথ বলিল, করিস। এমন নিশ্চিত শান্তি আর কিছুতে নেই! নির্ভর করবার, ভালবাসবার, সান্ত্বনা দেবার একটি লোক সর্বদা কাছে থাকা যে কত সুখ, তা তোকে কি করে বোঝাব? গায়ে কখনও একটা আঁচ লাগতে দেয় না রে, সব তারা নিজেরা গা পেতে নেয়। আর শাসনের ঘটা যদি দেখিস, যেন আমরা পুরুষমানুষগুলো সবতেই অক্ষম—কিছুই করতে পারি না—ওরাই যেন আমাদের সারথি বলিয়া খুব আহ্লাদে হাসিবার চেষ্টা করিতেই প্রবল কাশির ধাক্কায় তাহার সব আহ্লাদ লুপ্ত হইয়া গেল।

কাশি থামিলে তীর্থনাথ আর কথা কহিতে পারিল না। তাহার অব্যক্ত যন্ত্রণার দৃশ্য সহ্য করিতে পারিয়া কিশোর সেখান হইতে উঠিয়া গেল।

রাত্রিকালে পাশের ঘরে শুইবার ব্যবস্থা করিয়া দিয়া এবং দরকার হইলেই ডাকিবে বলিয়া বিমলা স্বামীর কাছে গিয়া বসিল। শুইবার আগে কিশোর দেখিয়া গেল, তীর্থনাথের আচ্ছন্ন অবস্থা, কখন জ্ঞান আছে, কখন নাই, কিশোর পূর্বে কখন যক্ষ্মারোগী দেখে নাই-মৃত্যু যে একেবারে আসন্ন, তাহা সে বুঝিতে পারিল না।

রাত্রিতে একবার উঠিয়া আসিয়া কিশোর রোগীর ঘরের দরজার নিকট হইতে মৃদুস্বরে জিজ্ঞাসা করিল, কেমন আছেন এখন?

ভিতর হইতে উত্তর আসিল—ভাল আছেন।

কিশোর আশ্বস্ত হইয়া শুইতে গেল। স্থির করিল, শেষ রাত্রিতে গিয়া ক্লান্ত শুশ্ৰষাকারিণীকে বিশ্রাম করিবার অবকাশ দিবে।

ভোর হইতে না হইতে কিশোর তাড়াতাড়ি উঠিয়া আসিয়া দেখিল, মেঝের উপর স্বামীর দেহ কোলে লইয়া তীর্থনাথের স্ত্রী স্থির হইয়া বসিয়া আছে। কিশোরের মাথার ভিতর একটা প্রবল হাতুড়ির আঘাতের সঙ্গে সঙ্গে যেন চারিদিক অন্ধকার হইয়া গেল। তারপর দৃষ্টি পরিষ্কার হইলে টলিতে টলিতে মৃতের পাশে গিয়া দাঁড়াইল। মৃতের মুখে সংশয় বা ক্লেশের চিহ্নমাত্র নাই, আছে। কেবল অপরিসীম যন্ত্রণার অবসানে নিশ্চিন্ত বিশ্রাম।

আমায় একবার ডাকলে না, বৌদি! কখন শেষ হল? স্থির, দৃঢ় কণ্ঠে তীর্থনাথের বিধবা উত্তর করিল, রাত্রি তিনটের সময়। তোমাকে জাগিয়ে তো কোন লাভ হত না, ঠাকুরপো। শেষ সময়টা আমি একলাই তাঁর কাছে থাকতে চেয়েছিলাম। আর কেন, এবার লোকজন ডাকো; মৃতদেহ বেশীক্ষণ ফেলে রাখা তো ঠিক নয়।

তাহার অটল ধৈর্য দেখিয়া কিশোর ক্ষিপ্তের মত বাহির হইয়া গেল। কেবল তাহার মাথার মধ্যে। ঘূর্ণি হাওয়ার মত ঘুরিতে লাগিল, এমন হইল কেন? তীর্থদা অমন স্ত্রী ফেলিয়া যাইতে পারিল কিরূপে?

পাড়ার লোক আসিয়া যখন তীর্থনাথের কঙ্কালখানা তাহার স্ত্রীর হাত ছাড়াইয়া বাঁধিয়া-ছাঁদিয়া হরিধ্বনি করিয়া লইয়া চলিয়া গেল, তখন একবার মা গো বলিয়া সদ্যোবিধবা মাটিতে মূৰ্ছিত হইয়া পড়িল। সমস্ত দিন আর তাহার সংজ্ঞা হইল না।

দশদিন পরে তীর্থনাথের প্রেতকৃত্য সমাধা করিয়া এগারো দিনের দিন বিধবা তাহার স্বামীর খানকয়েক পুঁথিপত্র ও একটা টিনের ট্রাঙ্ক লইয়া কিশোরের সহিত কলিকাতায় চলিয়া আসিল। ব্যাঙ্কে তীর্থনাথের হাজার তিনেক টাকা ছিল। তাহা সে মৃত্যুর পূর্বে কিশোরের নামে নিঃশর্তে উইল করিয়া গিয়াছিল।

<

Sharadindu Bandyopadhyay ।। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়