সোমনাথের পড়ার ঘরে ফরাস-ঢাকা তক্তপোশের মাঝখানে বসে সে খাতার ওপর ঝুঁকে হাতের লেখা মক্স করছে। তক্তপোশের এক কোণে ললিতা বসে পুতুল খেলছে, কিন্তু পুতুলের চেয়ে সোমনাথের দিকেই তার মন পড়ে আছে বেশী। সে মাঝে মাঝে সোমনাথের পানে ঘাড় উঁচু করে চাইছে। একসময় সে বলল–কি লিখছ?

সোমনাথ মুখ না তুলে বলল-হাতের লেখা রপ্ত করছি।

ও। —নিজের নাম লিখতে পার?

সোমনাথ এবার মুখ তুলল—এত বোকার মত কথা বলতে পারে এই মেয়েটা ললিতা

তাড়াতাড়ি বলল— আচ্ছা, আচ্ছা, লিখতে পার! কিন্তু আমার নাম লিখতে পার কি?

খানিকক্ষণ চোখ পাকিয়ে থেকে সোমনাথ বলল—এদিকে আয়, দেখিয়ে দিচ্ছি লিখতে পারি কি না।

ললিতা এসে হুমড়ি খেয়ে বসল, সোমনাথ খাতায় লিখতে লিখতে বলল—ল-লি-তা। কেমন, লিখতে পারি?

ললিতা সন্দিগ্ধভাবে বলল—ঠিক লিখেছ তো?

ঠিক লিখেছি মানে? সোমনাথ হঠাৎ চোখ বড় করে বলল–অ্যাাঁ, তুই কি পড়তে জানিস না?

ললিতা বলল—না। কেউ তো আমায় শেখায়নি।

তাই নাকি! আচ্ছা ঠিক আছে, আমিই শেখাব। আজ আমি তোর গুরু। বুঝলি? সোমনাথ ললিতার মাথায় হাল্কা একটা চাঁটি মারল।

এই সময় পাণ্ডে এলেন, সোমনাথকে প্রশ্ন করলেন—কী, কেমন আছ?

সোমনাথ বলল আজ্ঞে ভাল আছি। কিন্তু এই মেয়েটাকে কেউ লেখাপড়া শেখায় না কেন?

পাণ্ডে একটু অপ্রস্তুত হয়ে বললেন–কি জানো, তোমার দাদু মেয়েদের লেখাপড়া শেখা পছন্দ করেন না—

কিন্তু বোম্বাইয়ের সব মেয়েই তো স্কুলে যায়, লেখাপড়া করে। আমি দাদুকে বলব।

না, তার দরকার নেই। তুমি যদি ললিতাকে লেখাপড়া শেখাতে চাও শেখাতে পার।

ডাক্তার চলে গেলেন।

সোমনাথ তখন ললিতার দিকে ফিরে গম্ভীর গলায় বলল— মন দিয়ে শোন্। আগে তোকে বর্ণপরিচয় শেখাব। এদিকে আয়।

ললিতা অনুগত ছাত্রীর মত তার সামনে এসে বসল— বলুন গুরুজি। সোমনাথ খাতায় বড় বড় অ লিখল, আঙুল দেখিয়ে বলল—এই হল—অ।

সামনে ঝুঁকে ললিতা অ দেখল, তারপর মুখ তুলে বলল— অ। —একে অ বলে কেন?

সোমনাথ বলল—কেন বলে সে খবরে তোমার দরকার নেই। বল— অ।

আচ্ছা-অ। এবারে চল ঘোড়া ঘোড়া খেলি।

সোমনাথ ধমক দিয়ে বলল—তোর মাথায় কি খেলা ছাড়া কিছুই ঢোকে না? চুপ করে বোস। বল—আ।

বড় করে আ লিখে আঙুল দিয়ে দেখাল। ললিতা বলল— আ। তুমি লাট্টু ঘোরাবে না?

গর্জন করে সোমনাথ বলল না। বল—আ।

নির্লিপ্তভাবে ললিতা বলল— আ। একে আ বলে কেন?

গুরুজির পক্ষে আর ধৈর্যরক্ষা করা সম্ভব হল না, তিনি ছাত্রীর গালে একটি চড় মারলেন। ছাত্রী ভ্যাঁ করে কেঁদে উঠল।

.

অন্তঃপুরের একটি ঘরে কুসুম মেঝেয় বসে প্লেটে খাবার সাজাচ্ছে। তার সামনে অনেকগুলি রুপোর রেকাবি ও খাবারের ঝুড়ি। গোবর্ধন গেলাসে জল ভরছে। সে এখন বেশ আনন্দে আছে।

কাজের সঙ্গে সঙ্গে গোবর্ধন কথা বলে চলেছে-বৌদিদি, কর্তাবাবুর এত অল্প রাগ অনেকদিন দেখিনি। সকাল থেকে আজ এখনো আমাকে একটি বার গালাগাল দেননি। গড়গড়ার নল বন্ধ হয়ে গিয়েছিল তা শুধু বললেন, নল বদলে দে। অবাক কাণ্ড।

মুখে একটু হাসি নিয়ে কুসুম গোবর্ধনের গল্প শুনছিল, এখন একটি রেকাবি তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল— এই নাও বাবার জলখাবার। সময়ের দিকে নজর রেখো। ঠিক সময়ে ঘরে নিয়ে যেও, এক মিনিট আগে নয় পরেও নয়। তুমি বরং খাবার নিয়ে দোরের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবে, যেই ঘড়িতে নটা বাজবে, অমনি ঘরে ঢুকবে। তাহলে তিনি রাগ করবেন না।

গোবর্ধন বলল— যা বলেছ বৌদিদি। তুমি যদি গোড়া থেকে এসে আমাকে সব কাজ শিখিয়ে দিতে, তাহলে কর্তাবাবু কোনদিনই আমার ওপর রাগ করতেন না।

এক হাতে জলখাবারের রেকাবি অন্য হাতে জলের গেলাস নিয়ে গোবর্ধন চলে গেল। কুসুম সেই দিকে চেয়ে থেকে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল।

ওদিকে একনাথ নিজের বিছানায় অর্ধশয়ান হয়ে খবরের কাগজ পড়ছেন। বাতের ব্যথায় হাঁটু ফুলেছে, হাঁটুতে ফ্ল্যানেলের পটি জড়ানো, হাঁটুর নীচে তাকিয়া।

কাগজ ফেলে দিয়ে তিনি ডাকলেন—গোবর্ধন! গলার স্বর তেমন রুক্ষ নয়।

কিন্তু গোবর্ধনের সাড়া নেই। ভুরু কুঁচকে তিনি ঘড়ির দিকে তাকালেন। মেজাজ চড়তে শুরু করল। গাড়োলটা গেল কোথায়। তিনি আবার কড়া সুরে ডাকলেন—গোবর্ধন!

এবারও গোবর্ধনের দেখা নেই। রাগে ফুলতে ফুলতে তিনি বিছানা ছেড়ে উঠলেন, খোঁড়াতে খোঁড়াতে কোনরকমে গিয়ে আরামকেদারায় বসে পড়লেন—হতভাগা গাড়োলটাকে আজ দূর করে দেব।

এই সময় ঠং ঠং করে নটা বাজল। গোবর্ধন রেকাবি ও গেলাস হাতে প্রবেশ করল।

একনাথ বাঘের মত চোখ পাকিয়ে চাইলেন, তারপর গোবর্ধনের হাত থেকে গেলাস আর রেকাবি ছিনিয়ে নিয়ে মেঝেয় আছাড় মারলেন—এতক্ষণ কোথায় আড্ডা দিচ্ছিল রে হারামজাদা উল্লুক?

গোবর্ধন বলল–আজ্ঞে আমি তো দোরের ঠিক বাইরে দাঁড়িয়েছিলাম।

একনাথ এবার অবাক হলেন, তারপর খিচিয়ে উঠলেন— দাঁড়িয়ে ছিলি তো সাড়া দিচ্ছিলি না কেন?

গোবর্ধন বলল—আজ্ঞে বৌদিদি বললেন যে ঠিক নটা বাজলে জলখাবার নিয়ে ঘরে ঢুকতে।

রাগে দিশাহারা হয়ে একনাথ গর্জন ছাড়লেন-বেরিয়ে যা— দূর হয়ে যা আমার সামনে থেকে, বেকুব কোথাকার! যাচ্ছিস?

গোবর্ধন আর দাঁড়াল না, একদৌড়ে কুসুমের কাছে উপস্থিত হল। কুসুমের খাবার সাজানো তখনো শেষ হয়নি, সে মুখ তুলল। গোবর্ধন হাঁপাতে হাঁপাতে বলল— সর্বনাশ হয়েছে বৌদিদি, কর্তাবাবু খাবার ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আমাকে যা নয়-তাই বলে তাড়িয়ে দিয়েছেন।

খাবার ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছেন?

সব ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছেন। আমি খাবার নিয়ে দোরের বাইরে দাঁড়িয়েছিলাম, যেই ঠং ঠং করে নটা বাজল অমনি ঘরে ঢুকলাম। কিন্তু কর্তা তখন চটে লাল

কুসুম বলল— বুঝেছি। তোমাকে আর কিছু করতে হবে না। তুমি বরং সোমনাথ আর ললিতাকে ডেকে আন। বাবার খাবার নিয়ে আমি যাচ্ছি।

গেলাস ও প্লেট তুলে নিয়ে কুসুম দৃঢ়পদে শ্বশুরের ঘরের দিকে চলল। গোবর্ধন শঙ্কিত মুখে চোখ গোল করে চেয়ে রইল। একনাথ কুসুমকে তাঁর সামনে যেতে বারণ করে দিয়েছেন, তবু সে যাচ্ছে। এইবার বুঝি একটা কুরুক্ষেত্র কাণ্ড বাধল।

চেয়ারে বসে একনাথ আপন মনে তর্জন-গর্জন করছিলেন, কুসুম পাশের দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকল। সেই দিকে তাকিয়ে একনাথের বাচনিক বাহ্বাস্ফোট বন্ধ হয়ে গেল, তিনি স্তম্ভিত বিস্ময়ে চেয়ে থেকে দেয়ালের দিকে চোখ ফিরিয়ে প্যাঁচার মত বসে রইলেন।

কুসুম তাঁর বাঁ-পাশে এসে চুপ করে দাঁড়াল। একনাথ প্রথমে তার দিকে তাকালেন না। তারপর আড়চোখে একবার খাবারের দিকে তাকালেন। কুসুম নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল।

হঠাৎ একনাথ তিরিক্ষ সুরে বললেন—কি চাও?

কুসুম মৃদুকণ্ঠে বলল–খাবার এনেছি।

দরকার নেই।

কুসুম চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। একনাথ কিছুক্ষণ পরে আড়চোখে দেখলেন কুসুম যায়নি, বললেন—কথা কানে যায়নি, কাঠের পুতুলের মত দাঁড়িয়ে আছ কেন?

কুসুম নির্বিকার দাঁড়িয়ে রইল। একনাথের মুখে আষাঢ়ে মেঘের অন্ধকার, চোয়াল বজ্রের মত কঠিন; এ অবস্থায় তিনি কি করবেন ভেবে পাচ্ছেন না। হঠাৎ হাত বাড়িয়ে তিনি কুসুমের হাত থেকে প্লেট কেড়ে নিয়ে খেতে আরম্ভ করলেন। মুখ কিন্তু বজ্রগম্ভীর হয়ে রইল।

খাওয়া শেষ হলে কুসুম প্লেট নিয়ে গেলাস এগিয়ে ধরল। একনাথ গেলাসে চুমুক দিয়েছেন এমন সময় ডাক্তার পাণ্ডে দোরের সামনে এসে দাঁড়ালেন।

দৃশ্যটি দেখে ডাক্তারের মুখ ক্ষণেকের জন্যে উদ্ভাসিত হয়েই আবার শান্ত নির্লিপ্ত ভাব ধারণ করল। তিনি এগিয়ে এলেন। একনাথ জলের গেলাস কুসুমকে ফেরত দিয়ে ডাক্তারের প্রতি ভীষণ ভ্রূকুটি করে বললেন-তোমার আবার কি দরকার?

কুসুম গেলাস ও রেকাবি নিয়ে চলে গেল, দোরের কাছ থেকে একবার ফিরে তাকাল। ডাক্তার হাসিমুখে এগিয়ে এসে বললেন–কিছু না বাবুসাহেব, রোজের হাজিরা দিতে এসেছি। পায়ের ব্যথাটা কেমন?

একনাথ বললেন–সেকথা বলে লাভ কি? রোগই যখন সারাতে পার না তখন রোজ এসে জেরা করার কি দরকার?

ডাক্তার প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়ে বললেন–চেয়ারে বসলে দেখছি আপনার যন্ত্রণাটা কম থাকে। ওষুধ ঠিকমত খাচ্ছেন তো?

একনাথ বললেন–তোমার ওষুধ খেলে ছাই হয়। ও ওষুধ আমি গোবর্ধনকে খাওয়াচ্ছি, ওর বুদ্ধিশুদ্ধি যদি একটু খোলে।

পাণ্ডে সজোরে হেসে উঠলেন। একনাথের ভ্রূকুটি আবার গভীর হল— এতে হাসির কী আছে? তোমার ওই রদ্দি ওষুধ আমার দরকার নেই, তোমার রোজ রোজ এসে খোঁজ-খবর নেবারও দেরকার নেই। তোমার ডাক্তারি বাদ দিয়েও আমি ভাল থাকতে পারি।

সে তো খুবই ভাল কথা, আমিও তাই চাই। এখানে আসতে না হলে অন্য রোগীগুলোর দিকে নজর দিতে পারি। প্রকৃতিই সবচেয়ে বড় ডাক্তার, বাবুসাহেব। আচ্ছা চলি। ডাক্তার পিছু ফিরলেন।

একনাথের গলা থেকে শব্দ বার হল–হুম।

.

বাগানে ফোয়ারা থেকে জল উঠছে, পনেরো বছর পরে ফোয়ারা থেকে আবার জল উৎসারিত হচ্ছে। সকালবেলা বাগানের এক পাশে ঘাসের ওপর পা ছড়িয়ে বসে ললিতা কোঁচড়ে একরাশ ফুল নিয়ে মালা গাঁথছে। ফুচ-সুতোর সাহায্যে মালাটি প্রায় দুই হাত লম্বা হয়েছে।

পিছন দিক থেকে সোমনাথ হামাগুড়ি দিয়ে তার দিকে আসছে। ললিতার পাশে এসে সে ঘোড়ার মত চিহি চিহি শব্দ করে বলল-ঘোড়া হাজির।

ললিতা আহ্লাদে তড়াক করে লাফিয়ে উঠল, কোঁচড়ের ফুলগুলি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল। ললিতা সোমনাথের পিঠে চড়ে বসল, ফুলের মালা লাগামের মত তার মুখে পরিয়ে দিয়ে মুখে টক টক শব্দ করে বলল–আগে বঢ়ো—আগে বঢ়ো

হামা দিতে দিতে সোমনাথ বলল—সওয়ারী যাবে কোন দিকে?

ললিতা বলল—সওয়ারী যাবে ফোয়ারার দিকে। তার তেষ্টা পেয়েছে, জল খাবে। টক টক।

ঘোড়ার মত অঙ্গভঙ্গি করে চিহি চিহি শব্দ করতে করতে সোমনাথ ফোয়ারার দিকে চলল।

ফোয়ারার চারিদিকে গোল করে সিমেন্ট বাঁধান, চৌবাচ্চায় লাল মাছ ঘুরে বেড়াচ্ছে।

ঘোড়া ও আরোহিণী পাশাপাশি হাঁটু মুড়ে বসে আঁজলাভরে জল তুলে মুখে দিল, তারপর সিমেন্টের ওপর বসে গল্প করল। সোমনাথ বলল–আমার পকেটে একটা জিনিস আছে।

ললিতা সাগ্রহে প্রশ্ন করল— কি জিনিস ভাই?

সোমনাথ ধমক দিয়ে বলল–আবার! গুরুজি বলতে পার না।

ললিতা শুধরে নিয়ে বলল— কি জিনিস গুরুজি?

ভারিক্তি চালে সোমনাথ পকেট থেকে একটি দেশলাইয়ের বাক্স বার করল এতে কী আছে জান?

কি আছে, দেশলাইয়ের কাঠি?

না— আরশোলা।

ললিতা অমনি কুঁকড়ে গেল। সোমনাথ বলল—এটাকে পুষব ভাবছি।

ললিতা বলল–আরশোলা কেউ পোষে নাকি?

পুষলেই হল। লোকে কুকুর পোষে, পাখি পোযে, আরশোলা পুষলে দোষ কি?

আরশোলা ঘেউ ঘেউ করে ডাকবে? বুলবুলের মত গান গাইবে?

বলতে পারি না, হয়তো শেখালে শিখবে। বাক্সটি সন্তর্পণে একটু খুলে সোমনাথ ভেতরে উঁকি মারল—দ্যাখো কেমন গোঁফ নাড়ছে।

দুজনে মাথা ঠেকাঠেকি করে দেখতে লাগল। ললিতা বলল— মনে হচ্ছে ওর তেষ্টা পেয়েছে। একটু জল দিলে হয়।

সোমনাথ বলল–দূর বোকা! আরশোলা কি জল খায়! ওরা তেল খায়।

দূর থেকে গোবর্ধনের গলা শোনা গেল—এখানে তোমাদের কী হচ্ছে?

সে কাছে এসে দাঁড়াতেই সোমনাথ বলল-গোবর-দা, কী সুন্দর একটা আরশোলা?

গোবর্ধন অমনি পশ্চাৎপদ হল— অ্যাঁ— আরশোলা! ফেলে দাও—ফেলে দাও। আরশোলা ভারি পাজি জন্তু-ওটাকে জলে ফেলে দাও

সোমনাথ হাসতে হাসতে উঠে দাঁড়িয়ে বলল— তুমি বুঝি আরশোলাকে ভয় কর?

গোবর্ধন আর একটু পিছিয়ে গিয়ে বলল–ভয় আমি কাউকে করি না কিন্তু দেশলাইয়ের বাক্স হাতে সোমনাথ এগিয়ে আসছে দেখে সে আবার পিছু হটতে লাগল—এ আবার কি…এরকম ঠাট্টা আমার ভাল লাগে না…আরশোলা দুচক্ষে দেখতে পারি না দেখলেই গা সিরসির করে—ছোটবাবু, ভাল হবে না বলছি। চকিতে পিছন ফিরে গোবর্ধন দৌড় মারল। সোমনাথ ও ললিতা হাসতে হাসতে তার পিছনে ছুটল।

.

অন্তঃপুরের একটি ঘরে মেঝের ওপর একটি আসনে বসে ডাক্তার পাণ্ডে আহার করছেন, হাত-পাখা নিয়ে তাঁর সামনে বসে কুসুম খাওয়া তদারক করছে।

খেতে খেতে পাণ্ডে কথা বলছেন—এই দুমাসেই বাবুসাহেব অনেক বদলে গেছেন।

কুসুম চোখ নীচু করে বলল-সে আপনি ভাল বলতে পারেন।

পাণ্ডে বললেন— হাঁ মা, বোঝা যায়। এখন ওঁকে দেখে বেশ প্রফুল্ল মনে হয়, শরীর অনেক ভাল হয়েছে। মা, ওষুধপত্র কিছু নয়; আসল হল মন, মন-মেজাজ ভাল থাকলে সব ভাল থাকে। গত পনেরো বছর বাবুসাহেবের মুখে হাসি দেখিনি; আশা হচ্ছে শিগগিরই ওঁর হাসিমুখ দেখতে পাব।

অশ্রুরুদ্ধ স্বরে কুসুম বলল— মা চণ্ডী তাই করুন।

.

একনাথ নিজের ঘরে মোটা লাঠিতে ভর দিয়ে এদিক-ওদিক ঘুরছেন, ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ডাকলেন—গোবর্ধন।

গোবর্ধনের দেখা নেই। একনাথ কিছুক্ষণ দোরের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন, তারপর মেঝেয় লাঠি ঠুকতে ঠুকতে কতকটা আত্মগতভাবেই বললেন—কোথাও আড্ডায় বসেছে হতভাগা! নাঃ, ওকে দিয়ে আর চলবে না।

তাঁর আফিমের সময় হয়েছে। তিনি নিজেই গিয়ে দেরাজ খুলে আফিমের কৌটোটি তুলে নিলেন। দেরাজে আরো অনেক টুকিটাকি জিনিস রয়েছে, অনেকদিন তিনি নিজের হাতে দেরাজ খোলেননি, আজ ওইগুলির ওপর তাঁর দৃষ্টি পড়ল। সবই ধুলোয় ঢাকা পুরানো জিনিস, তার মধ্যে দাঁবার ছক ও ঘুঁটির বাক্স রয়েছে। একটু দ্বিধা করে তিনি সে দুটি বার করলেন, ফুঁ দিয়ে ধুলো উড়িয়ে স্নেহের ভঙ্গিতে তাদের গায়ে হাত বুলোত লাগলেন। অজ্ঞাতসারে একটা চাপা নিশ্বাস পড়ল।

হঠাৎ বন্ধ জানলার খড়খড়ি দিয়ে নীচে থেকে একটা হল্লার আওয়াজ এল। একনাথ ভ্রূকুটি করলেন, দাবার ছক ও ঘুঁটি নামিয়ে রেখে জানলার কাছে গেলেন, জানলার পাল্লা খুলে নীচের দিকে তাকালেন।

জানলার ঠিক নীচে বাগানের এক কোণে সোমনাথ ও ললিতা গোবর্ধনের সঙ্গে কানামাছি খেলছে। বাড়ির অন্য ঝি-চাকর—তাদের মধ্যে তারা-ঝিও আছে—পাশে দাঁড়িয়ে মজা দেখছে। গোবর্ধনের চোখে ঝাড়ন বাঁধা, সে হাতড়ে বেড়াচ্ছে, আর ললিতা ও সোমনাথ তার মাথায় চাঁটি মেরে পালিয়ে যাচ্ছে। গোবর্ধন তাদের ধরতে পারছে না। খেলা বেশ জমে উঠেছে। ঝি-চাকরেরা খেলা দেখতে দেখতে উচু গলায় হেসে উঠছে।

জানলা থেকে অলক্ষিতে একনাথ এই দৃশ্য দেখছেন। তাঁর মুখ গম্ভীর।

এই সময় সোমনাথ পকেট থেকে দেশলাইয়ের বাক্সটি নিয়ে পা টিপে টিপে গোবর্ধনের পিছন দিকে গেল, আরশোলা বার করে তার ফতুয়ার মধ্যে ছেড়ে দিয়ে পালিয়ে এল। গোবর্ধন চিড়িক মেরে উঠল—ওরে বাবা, এটা কি রে! পিঠের ওপর সড় সড় করছে

সোমনাথ খিলখিল করে হেসে বলল-গোবর-দা, চিনতে পারলে না? আর-শো-লা।

নিমেষে চোখের বাঁধন খুলে ফেলে গোবর্ধন লাফালাফি আর চিৎকার করতে লাগল— ওরে বাবা রে, গেছি রে— এই যে কাঁধের ওপর—আরে, পেট খামচাচ্ছে—

জানলায় দাঁড়িয়ে একনাথ মৃদু মৃদু হাসছেন। পনেরো বছর পরে প্রথম তাঁর মুখে হাসি দেখা দিয়েছে।

নীচে থেকেও যৌথ হাসির কলধ্বনি আসছে। হঠাৎ গম্ভীর হয়ে একনাথ হাঁক দিলেন গোবর্ধন।

সকলের চোখ একসঙ্গে জানলার পানে উঠল। তারপর চক্ষের পলকে দাস-দাসীরা অন্তর্হিত হল। ললিতা ও সোমনাথ জানলার দিকে চেয়ে হাততালি দিয়ে হাসতে লাগল। গোবর্ধন ভব্যিযুক্ত হয়ে বলল আজ্ঞে যাই বাবু।

জানলা থেকে সরে এসে একনাথ বিছানায় বসে আফিমের গুলি পাকাতে লাগলেন, তাঁর মুখে হাসি হাসি ভাব লেগে রইল।

গোবর্ধন এসে মনিবের সামনে দাঁড়াল। তার গা-ভরা অস্বস্তি, মাঝে মাঝে গা ঝাড়া দিচ্ছে। আরশোলাটা বোধহয় এখনো তার জামার মধ্যে আছে।

একনাথ কড়া চোখে তার পানে তাকিয়ে বললেন–কি হয়েছে? অমন চিড়িক মারছিস কেন?

গোবর্ধন বলল— আজ্ঞে না, ও কিছু নয়।

কিছু নয় তো চুপ করে দাঁড়া।

হঠাৎ গোবর্ধন পেটের জামা মুঠোতে চেপে ধরে চেঁচিয়ে উঠল—ধরেছি ব্যাটাকে ধরেছি। বলেই কর্তার দিকে চেয়ে থেমে গেল।

কর্তা বললেন—কী ধরেছিস? তোর পেটে কী হয়েছে? পেট কামড়াচ্ছে?

গোবর্ধন তখন কাতর স্বরে বলল–আজ্ঞে না বাবু, পেট কামড়াচ্ছে না। একটা আরশোলা–ছোটবাবু জামার মধ্যে আরশোলা ছেড়ে দিয়েছেন।

হাসি চাপার চেষ্টায় একনাথের মুখ ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল। তিনি বললেন—তুই নিজে একটা আরশোলা। জল দে, আফিম খাব।

গোবর্ধন সোরাই থেকে জল ঢেলে আনল, একনাথ আফিমের গুলি মুখে দিয়ে জল খেলেন। গোবর্ধন সোরাইয়ের মুখে গেলাস চাপা দিয়েছে এমন সময় আবার আরশোলা তার বগলে সড় সড় করে উঠল; সে বগল চেপে ধরে একটা অর্ধোচ্চারিত চিকুর ছেড়ে লাফাতে লাফাতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। এবার একনাথের গলার মধ্যে হাসির মত একটা চাপা আওয়াজ শোনা গেল।

সোমনাথ ঘরে ঢুকল; একনাথ অমনি গম্ভীর হলেন। সোমনাথ বলল— দাদু, গোবর-দার নাচ দেখলেন?

একনাথ গম্ভীর মুখে বললেন— ওর পেছনে লেগেছ কেন? আরশোলা নিয়ে এ কি খেলা! কোথায় পেলে আরশোলা?

সোমনাথ উৎসাহ ভরে বলল— নীচে ভাঁড়ার ঘরে কাঠের সিন্দুকটার মধ্যে অনেক আরশোলা আছে দাদু। দেরাজের দিকে যেতে যেতে—এটা অনেক পুরানো দেরাজ, এর মধ্যেও আরশোলা আছে।

দেরাজের ওপর দাদার ছক ও ঘুঁটি দেখে সে অবাক দৃষ্টিতে একনাথের পানে চাইল, ঘুঁটির কৌটো হাতে নিয়ে বলল—দাদু, আপনি দাবা খেলতে জানেন?

হাস্যকর প্রশ্ন। একনাথ বললেন— ফাজিল ছেলে! তুমি জান?

সোমনাথ বলল–জানি। বাবা শিখিয়েছিলেন।

একনাথের চোখের ওপর বাষ্পচ্ছায়া পড়ল, তিনি নিশ্বাস চেপে বললেন—তোমার বাবাকে আমি শিখিয়েছিলাম।

সোমনাথ ছক আর ঘুঁটির কৌটো নিয়ে একনাথের পাশে এসে দাঁড়াল—আমার সঙ্গে এক দান খেলবেন দাদু?

আয়ত চোখে চেয়ে থেকে একনাথ বললেন–তুমি খেলবে আমার সঙ্গে! তোমার সাহস তো কম নয়। আমি চোখ বুজে খেললেও তুমি হেরে যাবে।

সোমনাথ উত্তেজিত হয়ে বলল— কখখনো না, আপনি আমাকে হারাতে পারবেন না। বাজি রাখুন, আমি যদি আপনাকে হারিয়ে দিই কী দেবেন বলুন?

একনাথ ক্ষণেকের জন্যে চোখ বুজলেন, লোকনাথের সঙ্গে শেষ দাবা খেলার কথা মনে পড়ে গেল। তিনি চোখ খুলে বললেন— কী নেবে তুমি?

একটা টাট্টুঘোড়া।

বেশ, তাই হবে। আর তুমি যদি হেরে যাও আমাকে কী দেবে?

সোমনাথ ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ ভাবল, তারপর পকেট থেকে লাট্টু বের করে বলল–এই লাট্টু আপনাকে দেব।

সোমনাথের সীরিয়াস মুখের দিকে চেয়ে একনাথের ঠোঁটের কোণ নড়ে উঠল, তিনি বললেন— টাট্টুর বদলে লাট্টু! বেশ, বাজি রইল। —বোর্ড লাগাও।

সোমনাথ মহানন্দে টেবিলের ওপর ছক পেতে ঘুঁটি সাজাতে লাগল। প্রশ্ন করল— কোন ঘুঁটি আপনি নেবেন? সাদা না কালো?

বিছানা থেকে নামতে নামতে একনাথ বললেন–কালো—আমি চিরদিন কালো ঘুটি নিয়ে খেলি।

তিনি একটু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এসে টেবিলের সামনে বসলেন; ছকের ওপর ঘুঁটির অবস্থান পরিদর্শন করে বললেন–ঠিক আছে। তুমি আরম্ভ কর।

সোমনাথ মন্ত্রীর ঘরের বোড়ে চারের ঘরে এগিয়ে দিয়ে একনাথের মুখের পানে চাইল। একনাথ রাজার ঘরের বোড়ে চারের ঘরে এগিয়ে দিলেন। সাদা কালো দুই বোড়ে মুখোমুখি বসল। খেলার লড়াই শুরু হয়ে গেল।

.

অন্তঃপুরের উঠোনে কুসুম পায়রাদের গম খাওয়াচ্ছে। কোঁচড় থেকে গম নিয়ে উঠোনে ছড়িয়ে দিচ্ছে, একঝাঁক পায়রা গুঁতোগুতি করে তাই খাচ্ছে।

পুরোহিতমশাই পুজোর ঘরে স্তব পাঠ করছেন। গোবর্ধনের সংহত গলা শোনা গেল-বৌদিদি–

কুসুম ফিরে চাইল। গোবর্ধন চোখ বড় বড় করে কাছে এসে দাঁড়াল। তার মুখ দেখে মনে হয় ভীষণ একটা কিছু ঘটেছে। কুসুম শঙ্কিত হয়ে বলল—কী হয়েছে গোবর্ধন?

মাথা নেড়ে গোবর্ধন বলল— তুমি বিশ্বাসই করতে পারবে না বৌদিদি, আমি নিজের চোখে দেখেছি তা আমারই বিশ্বাস হচ্ছে না

কুসুমের আতঙ্ক বাড়ছে-সোমনাথ কোথায়?

আহা, সেই কথাই তো বলছি বৌদিদি

ব্যাকুল স্বরে কুসুম বলল–শিগগির বল–সোমনাথ কোথায়?

কর্তাবাবুর সঙ্গে দাবা খেলছে। ভগবানের কী লীলা! স্বপ্নেও ভাবা যায় না। ঘরে উঁকি দিয়ে দেখি দাদা আর নাতি মুখোমুখি বসে দাবা খেলছেন। এ বাড়িতে আগে যেমন হত ঠিক তেমনি। পুরানো আমলে কি আবার ফিরে এল বৌদিদি?

কুসুমের চোখে জল এসে পড়ল, সে আঁচল দিয়ে মুখ মুছল।

.

ওদিকে দাদা-নাতি দাবা খেলায় মগ্ন। সোমনাথ ছকের ওপর ঝুঁকে আছে, চোখে একাগ্র তন্ময়তা। একনাথ মাঝে মাঝে চোখ তুলে দেখছেন; তাঁর মনে বিভ্রম জাগছে–এ কি সোমনাথ, লোকনাথ?

লোকনাথই চাল দিচ্ছে, তারপর সোমনাথের গলার আওয়াজ আসছে—দাদু, এবার আপনার চাল।

আচ্ছন্নের মত একনাথ চাল দিচ্ছেন। মাথার মধ্যে ঘুরছে লোকনাথ–সোমনাথ—আমার ছেলে–আমার নাতি লোকনাথ যেন ছেলেকে আমার কাছে প্রতিনিধি পাঠিয়েছে; নিজে এল না, বড় অভিমানী ছিল

জলখাবারের দুটি রেকাবি হাতে নিয়ে কুসুম ঘরে ঢুকল। পিছনে গোবর্ধন। সে কুসুমের দিকে চোখ বেঁকিয়ে চাইল; যেন বলল—দেখলে? কী বলেছিলাম!

কুসুম ইশারা করল, গোবর্ধন একটি ছোট টিপাই এনে খেলার টেবিলের পাশে রাখল। কুসুম রেকাবি দুটি টিপাইয়ের ওপর রেখে খেলোয়াড়দের দিকে চাইল, কিন্তু খেলোয়াড়দের কোন দিকেই লক্ষ্য নেই। কুসুমের মুখ শান্ত, সে অনুচ্চ স্বরে বলল-বাবা, আপনার জলখাবার।

একনাথ মুখ না তুলেই বললেন—বাইরে অপেক্ষা করতে বল, এখন আমি ব্যস্ত আছি।

কুসুম ও গোবর্ধন মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল, তারপর কুসুম একটু গলা চড়িয়ে বলল–আপনার খাবার এনেছি বাবা।

একনাথ বিরক্ত স্বরে বললেন–তাকে কাল আসতে বল, আজ আমার সময় নেই। এক ঘর গজ এগিয়ে দিয়ে বিজয়দীপ্ত কণ্ঠে বললেন-কিস্তি।

সোমনাথ একটু বিপদে পড়েছে; চারিদিকে শত্রু। কিন্তু পরিত্রাণের রাস্তা এখনো খোলা আছে। সে গজের মুখ থেকে রাজাকে সরিয়ে নিয়ে একনাথের পানে চেয়ে মিটিমিটি হাসল— অর্থাৎ কী এমন কিস্তি দিয়েছ।

এই সময় ডাক্তার পাণ্ডে বাইরের দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকলেন, ঢুকেই থমকে দাঁড়ালেন। দাদা ও নাতি দাবা খেলায় মগ্ন, বাহ্যজ্ঞানশুন্য। কুসুমের পানে চেয়ে তাঁর মুখ হাসিতে ভরে উঠল, তিনি ভ্রূ তুলে নীরব প্রশ্ন করলেন— কাণ্ডটা কী?

কুসুম মৃদু হেসে খেলোয়াড়দের পানে চেয়ে রইল। ডাক্তার এসে একনাথের পিছনে দাঁড়িয়ে খেলা দেখতে লাগলেন।

হঠাৎ খেলার মোড় ঘুরে গেল। সোমনাথ নিজের মন্ত্রীকে কোণাকুণি দুঘর এগিয়ে দিয়ে বলল–কিস্তি।

একনাথ চমকিত হয়ে নিজের রাজা নিয়ে পালাবার চেষ্টা করলেন, কিন্তু কোন ফল হল না; আরো দু চাল পরে সোমনাথের মন্ত্রী একনাথের রাজার সামনে চেপে বসল, সোমনাথ বলল–কিস্তি মাৎ।

অত্যন্ত বিপন্নভাবে একনাথ ছকের ওপর ঝুঁকে পড়ে দেখলেন সত্যিই তিনি মাৎ হয়ে গেছেন, আর রাজা নিয়ে পালাবার রাস্তা নেই। ওদিকে সোমনাথ নাচতে শুরু করেছে, নাচছে আর বলছে দাদুকে হারিয়ে দিয়েছি, দাদু মাং হয়ে গেছেন—

একনাথের মুখে কথা নেই, তিনি হতবুদ্ধি হয়ে ছকের দিকে তাকিয়ে আছেন। কুসুম ঠোঁটের ওপর আঁচল চাপা দিয়েছে, গোবর্ধন দন্ত-বিকশিত করে মাথা চুলকোচ্ছে। ডাক্তার হঠাৎ সজোরে হেসে উঠলেন।

সোমনাথ তখনো নাচছে দাদুকে হারিয়ে দিয়েছি মা তুমি সাক্ষী, ডাক্তারবাবু সাক্ষী–দাদু, আমাকে ঘোড়া দিন। সে একনাথের সামনে হাত পাতল।

একনাথ মুখ তুলে বোকার মত বললেন-ঘোড়া!

হ্যাঁ। বাজি রেখেছিলেন হেরে গেলে টাট্টুঘোড়া দেবেন। সে টপ করে খাবারের প্লেট তুলে নিয়ে খেতে আরম্ভ করল।

একনাথ লজ্জিতভাবে ছক থেকে সোমনাথের পানে চাইলেন। বিড় বিড় করে বললেন— অনেকদিন খেলিনি…দুধের ছেলের কাছে হেরে গেলাম

সোমনাথ খেতে খেতে বলল-দাদু, আমার ঘোড়া?

দেব রে বাপু, দেব। কিন্তু কাল আবার খেলা বসবে, তোকে গজচক্র অশ্বচক্র করে ছেড়ে দেব

তিনি খাবারের প্লেট তুলে নিলেন। তাঁর মুখে একটু হাসির ঝিলিক খেলতে লাগল, মৃদু হাসি ক্রমে বাড়তে লাগল, শেষে একেবারে হো হো করে অট্টহাসি হাসতে লাগলেন। যেন বহুকালের রুদ্ধ উৎসমুখ হঠাৎ খুলে গিয়ে জলের উচ্ছাস চারিদিকে উৎসারিত হল।

বাষ্পচ্ছন্ন চোখে কুসুম তাঁর পানে চেয়ে রইল। ডাক্তারের চোখও আর্দ্র হল, তিনি জানলার সামনে গিয়ে দাড়ালেন।

<

Sharadindu Bandyopadhyay ।। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়