অবন্তীর বিশাল রাজমন্ত্ৰভবনের মধ্যে একটি কক্ষে পঞ্চাশজন মসীজীবী অনুলেখক সারি দিয়া ভূমির উপর বসিয়াছে। প্রত্যেকের সম্মুখে একটি করিয়া অনুচ্চ কাষ্ঠপীঠিকা, তদুপরি মসীপাত্র ভূর্জপত্রের কুণ্ডলী প্রভৃতি ন্যস্ত। স্বয়ং জ্যেষ্ঠ-কায়স্থ একটি লিখিত পত্র হস্তে লইয়া অনুলেখকদের সম্মুখে পদচারণ করিতেছেন এবং পত্রটি উচ্চকণ্ঠে থামিয়া থামিয়া পাঠ করিতেছেন; অনুলেখকগণ শুনিয়া শুনিয়া লিখিতেছেন।

জ্যেষ্ঠ-কায়স্থ স্থূলকায় মধ্যবয়স্ক ব্যক্তি, অপিচ রসিক। তিনি পড়িতেছেন—আগামী শারদ পূর্ণিমা তিথিতে কোজাগর মহোৎসব দিবসে—হুম হুসভাকবি শ্রীকালিদাস বিরচিত কুমারসম্ভবম্ নামক মহাকাব্য অবন্তীর রাজসভায় পঠিত হইবে…অথ শ্রীমানের, বিকল্পে শ্ৰীমতীর—অহহহচরণরেণুকণাস্পর্শে অবন্তীর রাজসভা পবিত্র হৌক—হুম্—

 

মন্ত্রগৃহে স্বয়ং বিক্রমাদিত্য উপবিষ্ট। তাঁহার একপাশে তূপীকৃত নিমন্ত্রণ-লিপির কুণ্ডলী, মহামন্ত্রী একটি করিয়া লিপি রাজার সম্মুখে ধরিতেছেন, দ্বিতীয় এক কর্মিক ক্ষুদ্র দবীতে দ্রবীভূত জতু লইয়া পত্রের উপর ঢালিয়া দিতেছে, মহারাজ তাহার উপর মুদ্রাঙ্গুরীয়ের ছাপ দিতে দিতে বলিতেছেন—উত্তরাপথে দক্ষিণাপথে যেখানে যত জ্ঞানী গুণী রসজ্ঞ আছেন—পুরুষ নারী–কেউ যেন বাদ না যায়—

 

উজ্জয়িনী নগরীর পূর্ব তোরণ। তোরণ হইতে তিনটি পথ বাহির হইয়াছে; দুইটি পথ প্রাকারের ধার ঘেঁষিয়া উত্তরে ও দক্ষিণে গিয়াছে, তৃতীয়টি তীরের মত সিধা পূর্বমুখে গিয়াছে।

পঞ্চাশজন অশ্বারোহী রাজদূত তোরণ হইতে বাহিরে আসিয়া সারি দিয়া দাঁড়াইল। পৃষ্ঠে আমন্ত্রণ-লিপির বস্ত্ৰপেটিকা ঝুলিতেছে, অস্ত্রশস্ত্রের বাহুল্য নাই।

গোপুর শীর্ষ হইতে দুন্দুভি ও বিষাণ বাজিয়া উঠিল। অমনি অশ্বারোহী দল তিন ভাগে বিভক্ত হইয়া গেল; দুই দল উত্তরে ও দক্ষিণে চলিল, মাঝের দল ময়ূরসঞ্চারী গতিতে সম্মুখ দিকে অগ্রসর হইল।

কুন্তল রাজ্যের রাজভবন ভূমি। পূবোল্লিখিত সরোবরের মর্মর সোপানের উপর কুন্তল রাজকুমারী একাকিনী বসিয়া আছেন। মুখে চোখে হতাশা ও নৈরাশ্য পদাঙ্ক মুদ্রিত করিয়া দিয়াছে, কেশ বেশ অযত্নবিন্যস্ত; বাঁচিয়া থাকার প্রয়োজন যেন তাঁহার শেষ হইয়া গিয়াছে।

সরোবরের জল বায়ুস্পর্শে কুঞ্চিত হইয়া উঠিতেছে; রাজকুমারী লীলাকমলের পাপড়ি ছিড়িয়া। জলে ফেলিতেছেন; কোনোটি নৌকার মত ভাসিয়া যাইতেছে, কোনোটি ড়ুবিতেছে।

অদূরে একটি তরুশাখায় হেলান দিয়া বিদ্যুল্লতা গান গাহিতেছে, তাহার গানের গুঞ্জরন কতক রাজকুমারীর কানে যাইতেছে, কতক যাইতেছে না—

ভাসলো আমার ভেলা–
সাগর জলে নাগরদোলা ওঠা-নামার খেলা
সেথা ভাসলো আমার ভেলা।…

গান শেষ হইয়া গেল; রাজকুমারী তাঁহার ভাসমান পদ্মপলাশগুলির পানে চাহিয়া ভাবিতেছেন—দিনের পর দিন…আজকের দিন শেষ হল, আবার কাল আছে.তারপর আবার কাল…কালের কি অবধি নেই?

রাজকুমারীর পিছনে চতুরিকা আসিয়া দাঁড়াইল, তাহার হাতে কুণ্ডলিতে নিমন্ত্রণ-লিপি। সে বিষণ্ণমুখে ইতস্তত করিয়া রাজকুমারীর পাশে আসিল, সোপানের পৈঠার উপর পা মুড়িয়া বসিতে বসিতে বলিল—পিয়সহি, অবন্তীর রাজসভা থেকে আমন্ত্রণ এসেছে, তোমার জন্যে স্বতন্ত্র লিপি–

নিরুৎসুকভাবে লিপি লইয়া রাজকুমারী জতুমুদ্রা খুলিয়া দেখিলেন, চতুরিকা বলিয়া চলিল—মহারাজ সভা থেকে পাঠিয়ে দিলেন। তাঁরও আলাদা নিমন্ত্রণ-লিপি এসেছে কিন্তু তিনি যেতে পারবেন না। বলে পাঠালেন, তুমি যদি যেতে চাও তিনি সুখী হবেন।

লিপি পাঠ শেষ করিয়া রাজকুমারী আবার তাহা কুণ্ডলাকারে জড়াইতে লাগিলেন, যেন চতুরিকার কথা শুনিতে পান নাই এমনিভাবে জলের পানে চাহিয়া রহিলেন। ঈষৎ তিক্ত হাসি তাঁহার মুখে ফুটিয়া উঠিল, তিনি লিপি জলে ফেলিয়া দিবার উপক্রম করিলেন কিন্তু ফেলিলেন। চতুরিকার দিকে না ফিরিয়াই অবসন্ন কণ্ঠে বলিলেন—পিতা সুখী হবেন? বেশ—যাব।

 

উজ্জয়িনীর পূর্ব-তোরণ পুষ্পপল্লব ও মাল্যে শোভা পাইতেছে। তিনটি পথ দিয়া পিপীলিকাশ্রেণীর ন্যায় মানুষ আসিয়া তোরণের রন্ধ্রমুখে অদৃশ্য হইয়া যাইতেছে। রাজন্যবর্গ হস্তীর গলঘণ্টা বাজাইয়া মন্দমন্থর গতিতে আসিতেছেন; যোদ্ধৃবেশধারী পদাতি অশ্ব, এমন কি উষ্ট্রও আছে। মাঝে মাঝে দুএকটি চতুর্দোলা আসিতেছে; সূক্ষ্ম আবরণের ভিতর লঘু মেঘাবৃত শরৎচন্দ্রের ন্যায় সম্ভ্রান্ত আর্য মহিলা।

একটি দোলা তোরণমধ্যে প্রবেশ করিল; সঙ্গে মাত্র দুই চারিজন পদাতি পরিচর। দোলায় ক্ষীণাবরণের মধ্যে এক সুন্দরী বিমনাভাবে করতলে কপোল রাখিয়া বসিয়া আছেন। দর্শকদের মধ্যে যাহারা দোলার উপর দৃষ্টি রাখিয়াছিল তাহারা অনুমান করিল, ইনি কুন্তল রাজদুহিতা হৈমশ্রী।

 

সভাগৃহের প্রবেশদ্বারে মহামন্ত্রী প্রভৃতি কয়েকজন উচ্চ কর্মচারী দাঁড়াইয়া আছেন। অতিথিগণ একে একে দুয়ে দুয়ে আসিতেছেন, মহামন্ত্রী তাঁহাদের পদোচিত অভ্যর্থনাপূর্বক তিলক-চন্দন ও গন্ধমাল্যে ভূষিত করিয়া অভ্যন্তরে প্রেরণ করিতেছেন। নেপথ্যে মধুর স্বননে বাঁশি বাজিতেছে।

সভার অভ্যন্তরে বক্তার বেদী ব্যতীত অন্য আসনগুলি ক্রমশ ভরিয়া উঠিতেছে। সন্নিধাতা কিঙ্করগণ সকলকে নির্দিষ্ট আসনে লইয়া গিয়া বসাইতেছে। উধ্বে মহিলাদের মঞ্চেও অল্প শ্রোত্রীসমাগম হইতে আরম্ভ করিয়াছে। মহাদেবী ভানুমতীর আসন এখনো শূন্য আছে।

 

কালিদাসের কুটির প্রাঙ্গণে কবি সভায় যাইবার জন্য প্রস্তুত হইতেছেন, মালিনী তাঁহার ললাটে চন্দন পরাইতে দিতেছে। মালিনীর চোখ দুটি অরুণাভ, যেন লুকাইয়া কাঁদিয়াছে। সে থাকিয়া থাকিয়া দন্ত দিয়া অধর চাপিয়া ধরিতেছে।

কুমারসম্ভবের পুঁথি বেদীর উপর রাখা ছিল, তাহা কবির হাতে তুলিয়া দিতে দিতে মালিনী একটু হাসিবার চেষ্টা করিয়া বলিল—এতদিন তুমি আমার কবি ছিলে, আজ সারা পৃথিবীর কবি হলে। কত লোক তোমার গান শুনবে, ধন্যি ধন্যি করবে–

কালিদাস সলজ্জ হাসিলেন—কি যে বলো। আমার কাব্য লেখার চেষ্টা বামন হয়ে চাঁদে হাত বাড়ানো। হয়তো সবাই হাসবে।

মালিনী তাঁহার বিনয় বচনে কান না দিয়া বলিল—আজ পৃথিবীর যত জ্ঞানী গুণী সবাই তোমার গান শুনবে, কেবল আমিই শুনতে পাব না—

কালিদাস সবিস্ময়ে চক্ষু তুলিলেন—তুমি শুনতে পাবে না কেন?

মালিনী দীনকণ্ঠে বলিল—সভায় কত রাজা রানী, কত বড় বড় লোক এসেছেন, সেখানে আমাকে কে জায়গা দেবে কবি!

কালিদাসের মুখের ভাব দৃঢ় হইল, তিনি মালিনীর একটি হাত নিজের হাতে তুলিয়া লইয়া বলিলেন—রাজসভায় যদি তোমার জায়গা না হয় তাহলে আমারও জায়গা হবে না। এস।

মালিনীর চক্ষু দুটি সহসা-উৰ্গত অশ্রুজলে উজ্জ্বল হইয়া উঠিল, অধর কাঁপিয়া উঠিল।

রাজসভা অগুরুগন্ধে আমোদিত। অতিথিগণ স্ব স্ব আসনে বসিয়াছেন, সভায় তিল ফেলিবার স্থান নাই। রাজ-বৈতালিক প্রধান বেদীর উপর যুক্তকরে দাঁড়াইয়া মহামান্য অতিথিগণের সাদর সম্ভাষণ গান করিতেছেন। কিন্তু সেজন্য সভার জল্পনা গুঞ্জন শান্ত হয় নাই। সকলেই প্রতিবেশীর সঙ্গে বাক্যালাপ করিতেছেন, চারিদিকে ঘাড় ফিরাইয়া সভার শিল্পশোভা দেখিতেছেন, মন্তব্য প্রকাশ করিতেছেন।

উপরে মহিলামঞ্চও কলভাষিণী মহিলাপুঞ্জে ভরিয়া উঠিয়াছে। কেন্দ্রস্থলে মহাদেবীর স্বতন্ত্র আসন কিন্তু এখনো শূন্য।

বৈতালিক স্তবগান গাহিয়া চলিয়াছেন।

মহিলামঞ্চের দ্বারের কাছে দেবী ভানুমতীকে আসিতে দেখা গেল। তিনি কুন্তলকুমারী হৈমশ্রীর হাত ধরিয়া হাস্যালাপ করিতে করিতে আসিতেছেন। হৈমশ্রীও সময়োচিত প্রফুল্লতার সহিত কথা কহিতেছেন। মনে হয় উৎসবের বাতাবরণে আসিয়া তাঁহার অবসাদ কিয়ৎ পরিমাণে দূর হইয়াছে।

তাঁহারা স্বীয় আসনে গিয়া পাশাপাশি বসিলেন। রাজবংশজাতা অন্য কোনো মহিলা বোধ হয় আসেন নাই, কেবল কুন্তলকুমারীই আসিয়াছেন। সেকালে মহিলা মহলে বিদ্যাচর্চার সমধিক অসদ্ভাব ছিল বলিয়া মনে হয়; তাই যে দুই চারিটি বিদুষী নারী দেখা দিতেন, তাঁহারা অতিমাত্রায় সম্মান ও শ্রদ্ধার পাত্রী হইয়া উঠিতেন।

বৈতালিকের স্তুতিগান শেষ হইয়া আসিতেছে।

মালিনী ভীরু সঙ্কুচিত পদে মহিলামঞ্চের দ্বারের কাছে আসিয়া ভিতরে উকি মারিল। ভিতরে

আসিয়া অন্যান্য মহিলাদের সঙ্গে একাসনে বসিবার সাহস নাই, সে দ্বারের কাছেই ইতস্তত করিতে লাগিল। তাহার হাতে একটি ফুলের মালা ছিল, মাধবী ও বান্ধুলি পুষ্প দিয়া গঠিত। মালাগাছি লইয়াও বিপদ; পাছে কেহ দেখিয়া হাসে। মালিনী অবশেষে মালাটি কোঁচড়ের মধ্যে রাখিয়া দ্বারের পাশেই মেঝের উপর বসিয়া পড়িল। এখান হইতে গলা বাড়াইলে নিম্নে বক্তার বেদী সহজেই দেখা যায়।

বৈতালিকের গান শেষ হইল। সঙ্গে সঙ্গে ঘোর রবে দুন্দুভি বাজিয়া উঠিয়া সভাগৃহ-মধ্যে তুমুল ধ্বনি-তরঙ্গের সৃষ্টি করিল।

তারপর—

সভা একেবারে শান্ত হইয়া গিয়াছে, পাতা নড়িলে শব্দ শোনা যায়।

কালিদাস বেদীর উপর বসিয়াছেন, সম্মুখে উন্মুক্ত পুঁথি। তিনি একবার প্রশান্ত চক্ষে সভার চারিদিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিলেন, তারপর মন্দ্রকণ্ঠে পাঠ আরম্ভ করিলেন—

অস্ত্যত্তরস্যাং দিশি দেবতাত্মা
হিমালয়ো নাম নগাধিরাজঃ।

মহিলামঞ্চের মধ্যস্থলে কুন্তলকুমারী নির্নির্মষ নেত্রে নিম্নে কালিদাসের পানে চাহিয়া আছেন। এ কে? সেই মূর্তি—সেই কণ্ঠস্বর! তবে কি—তবে কি–?

কালিদাস পাঠ করিয়া চলিয়াছেন। শ্রোতাদের মনশ্চক্ষে ধীরে ধীরে একটি দৃশ্য ফুটিয়া উঠিতেছে-তুষারমৌলি হিমালয়। দূরে একটি অধিত্যকা, তথায় একটি ক্ষুদ্র কুটির ও লতাবিতান। পতিনিন্দা শুনিয়া দক্ষদুহিতা সতী প্রাণবিসর্জন দিবার পর মহেশ্বর এই নির্জন স্থানে উগ্র তপস্যায় রত আছেন।

কালিদাস শ্লোকের পর শ্লোক পড়িয়া চলিয়াছেন। বিশাল সভা চিত্রার্পিতবৎ বসিয়া আছে; কালিদাসের কণ্ঠস্বর এই নিঃশব্দ একাগ্রতার মধ্যে মৃদঙ্গের ন্যায় মন্দ্রিত হইতেছে।

মহিলামঞ্চে কুন্তলকুমারী তন্দ্রাহতার ন্যায় বসিয়া শুনিতেছেন। বাহ্যজ্ঞান নাই, চক্ষু নিষ্পলক; কখন বক্ষ ভেদ করিয়া নিশ্বাস বাহির হইতেছে, কখন গণ্ড বহিয়া অশ্রুর ধারা নামিতেছে তাহা জানিতেও পারিতেছেন না।

মহাকাব্যের ছন্দে ছন্দে চিত্র রচিত হইতেছে। হিমালয়ের অধিত্যকায় মহেশ্বরের লতাগৃহ। দ্বারে নন্দী প্রকোষ্ঠে হেমবেত্র লইয়া দণ্ডায়মান। বেদীর উপর যোগাসনে বসিয়া মহেশ্বর ধ্যানমগ্ন।

বনপথ দিয়া গিরিকন্যা উমা কুটিরের পানে আসিতেছেন। হস্তে ফুল জল সমিধপূর্ণ পাত্র।

বেদীপ্রান্তে পৌঁছিয়া উমা নতজানু হইয়া মহেশ্বরকে প্রণাম করিলেন। শঙ্কর ধ্যানমগ্ন।

প্রথম সর্গ সমাপ্ত হইলে কালিদাস ক্ষণেক ব্রিাম দিয়া দ্বিতীয় সর্গ পড়িতে আরম্ভ করিলেন।

মেঘলোকে ইন্দ্রসভা। ইন্দ্র ও দেবগণ মুহ্যমানভাবে বসিয়া আছেন; মদন ও বসন্ত প্রবেশ করিল। মদনের কণ্ঠে পুষ্পধনু, বসন্তের হস্তে চূত-মঞ্জরী। ইন্দ্র সাদরে মদনের হাত ধরিয়া বলিলেন—এস বন্ধু, আমাদের দারুণ বিপদে তুমিই একমাত্র সহায়।

কৈতববাদে স্ফীত হইয়া মদন সদর্পে বলিল—আদেশ করুন দেবরাজ। আপনার প্রসাদে আমি কেবলমাত্র বসন্তকে সঙ্গে নিয়ে সাক্ষাৎ পিণাকপাণির ধ্যানভঙ্গ করতে পারি।

দেবগণ সমস্বরে জয়ধ্বনি করিয়া উঠিলেন। মদন ঈষৎ ত্রস্ত ও চকিত হইয়া সকলের মুখের পানে চাহিল। সত্যই মহাদেবের ধ্যানভঙ্গ করিতে হইবে নাকি?–

কালিদাস কাব্যপাঠ করিয়া চলিয়াছেন। সকলে রুদ্ধশ্বাসে শুনিতেছে। মহিলামঞ্চে হৈমশ্রীর অবস্থা পূর্ববৎ বাহ্যজ্ঞানশূন্য। ভানুমতী তাহা লক্ষ্য করিলেন, কিন্তু কিছু না বলিয়া কাব্যশ্রবণে মন দিলেন।

হিমালয়। সমস্ত প্রকৃতি শীতজর্জর, তুষার কঠিন। বৃক্ষ নিষ্পত্র, প্রাণীদের প্রাণচঞ্চলতা নাই। তপোবনের সন্নিকটে একটি শাখাসর্বস্ব বৃক্ষ দাঁড়াইয়া আছে। মদন ও বসন্তের সূক্ষ্ম দেহ এই বৃক্ষের উপর দিয়া ভাসিয়া গেল, সঙ্গে সঙ্গে বৃক্ষটি পুষ্প পল্লবে ভরিয়া উঠিল। দূরে সহসা কোকিলকাকলি শুনা গেল। হিমালয়ে অকাল বসন্তের আবির্ভাব হইয়াছে।

সহসা হরিতায়িত বনভূমির উপর কিন্নর মিথুন নৃত্যগীত আরম্ভ করিল, পশুপক্ষী ব্যাকুল বিস্ময়ে ছুটাছুটি ও কলকূজন করিয়া বেড়াইতে লাগিল। প্রমথগণ প্রমত্ত উদ্দাম হইয়া উঠিল।

নন্দী প্রকৃতির এই আকস্মিক রূপান্তরে বিব্রত হইয়া চারিদিকে কঠোর দৃষ্টিপাত করিতে লাগিল, তারপর ওষ্ঠে অঙ্গুলি রাখিয়া প্রমথদের নীরবে শাসন করিল—চপলতা করিও না, মহেশ্বর ধ্যানমগ্ন।

বেদীর উপর মহেশ্বর যোগাসনে উপবিষ্ট। চক্ষু ভূমধ্যে স্থির, শ্বাস নাসাভ্যন্তরচারী, নিবাত নিষ্কম্প দীপশিখার ন্যায় দেহ নিশ্চল।

রুমঝুম মঞ্জীরের শব্দ কাছে আসিতেছে; উমা যথানিয়ত পূজার উপকরণ লইয়া আসিতেছেন। নন্দী সসম্রমে পথ ছাড়িয়া দিল।

মহেশ্বরের ধ্যানসমাধি ক্রমে তরল হইয়া আসিতেছে; তাঁহার নয়নপল্লব ঈষৎ ফুরিত হইল। লতাবিতানের এক কোণে দাঁড়াইয়া মদন ধনুর্বাণ হস্তে অপেক্ষা করিতেছে। পার্বতী আসিতেছেন, এই উপর্যুক্ত সময়।

পার্বতী আসিয়া বেদীমূলে প্রণাম করিলেন, তারপর নতজানু অবস্থায় স্মিতসলজ্জ চক্ষু দুটি মহেশ্বরের মুখের পানে তুলিলেন। মদনের অলক্ষিত উপস্থিতি উভয়ের মনেই চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করিয়াছিল; মহাদেবের অরুণায়ত নেত্র পার্বতীর মুখের উপর পড়িল।

মদন এই অবসরের প্রতীক্ষ্ণ করিতেছিল, সাবধানে লক্ষ্য স্থির করিয়া সম্মোহন বাণ নিক্ষেপ করিল।

মহেশ্বরের তৃতীয় নয়ন খুলিয়া গিয়া ধৰ্ধক্ করিয়া ললাট বহ্নি নির্গত হইল—কে রে তপোবিঘ্নকারী! তিনি মদনের দিকে দৃষ্টি ফিরাইলেন। হরনেত্ৰজন্মা বহ্নিতে মদন ভস্মীভূত হইল।

ভয়ব্যাকুলা উমা বেদীমূলে নতজানু হইয়া আছেন। মহেশ্বর বেদীর উপর উঠিয়া দাঁড়াইয়া চতুর্দিকে একবার রুদ্র দৃষ্টি নিক্ষেপ করিলেন। তারপর তাঁহার প্রলয়ঙ্কর মূর্তি সহসা শূন্যে অদৃশ্য হইয়া গেল।

কালিদাস মদনভস্ম নামক সর্গ শেষ করিয়া ক্ষণেকের জন্য নীরব হইলেন, সভাও নিস্তব্ধ হইয়া রহিল। এতগুলি মানুষ যে সভাগৃহে বসিয়া আছে, শব্দ শুনিয়া তাহা বুঝিবার উপায় নাই।

কালিদাস পুঁথির পাতা উল্টাইলেন, তারপর আবার নূতন সর্গ পড়িতে আরম্ভ করিলেন।

রতিবিলাপ শুনিয়া কুন্তলকুমারীর নয়নে অশ্রুধারা বহিল। ভানুমতীও আবার নূতন করিয়া কাঁদিলেন। দ্বার পার্শ্বে বসিয়া মালিনী কাঁদিল। প্রিয়-বিয়োগ ব্যথা কাহাকে বলে এতদিনে মালিনী বুঝিতে শিখিয়াছে।

কবি ক্রমে উমার তপস্যা অধ্যায়ে পৌঁছিলেন।

 

হিমালয়ের গহন গিরিসঙ্কটের মধ্যে কুটির রচনা করিয়া গিরিরাজসুতা উমা কঠোর তপস্যা আরম্ভ করিয়াছেন। পতি লাভার্থ তপস্যা। স্বয়ং বিশীর্ণ দ্রুমপর্ণ, অর্থাৎ আপনা হইতে খসিয়া পড়া গাছের পাতা—তাহাও পার্বতী আর আহার করেন না। তাই তাঁহার নাম হইয়াছে—অপর্ণা।

কৃচ্ছ্রসাধন বহু প্রকার। গ্রীষ্মের দ্বিপ্রহরে তপঃকৃশা পার্বতী চারি কোণে অগ্নি জ্বালিয়া মধ্যস্থ আসনে বসিয়া প্রচণ্ড সূর্যের পানে নিষ্পলক চাহিয়া থাকেন। ইহা পঞ্চাগ্নি তপস্যা। আবার শীতের হিমকঠিন রাত্রে যখন জলের উপর তুষারের আস্তরণ পড়ে তখন সেই আস্তরণ ছিন্ন করিয়া উমা জলমধ্যে প্রবেশ করেন; আকণ্ঠ জলে ড়ুবিয়া শীতের রাত্রি অতিবাহিত হয়। সারা রাত্রি চন্দ্রের পানে চাহিয়া উমা চন্দ্রশেখরের মুখচ্ছবি ধ্যান করেন।

এইভাবে কল্প কাটিয়া যায়। তারপর—

একদিন উমার কুটির দ্বারে এক তরুণ সন্ন্যাসী দেখা দিলেন। ডাক দিলেন—অয়মহং ভোঃ!

উমা কুটিরে ছিলেন, তাড়াতাড়ি বাহিরে আসিয়া সন্ন্যাসীকে পাদ্যঅর্ঘ্য দিলেন। সন্ন্যাসীর চোখের দৃষ্টি ভাল নয়; লোলুপনেত্রে পার্বতীকে নিরীক্ষণ করিয়া তিনি বলিলেন—সুন্দরি, তুমি কী জন্য তপস্যা করছ?

পার্বতী অনুচ্চ কণ্ঠে বলিলেন—পতিলাভের জন্য।

সন্ন্যাসী বিস্ময় প্রকাশ করিয়া বলিলেন—কি আশ্চর্য! তোমার মত ভুবনৈকা সুন্দরীকেও পতিলাভের জন্য তপস্যা করতে হয়! কে সেই মূঢ় যে নিজে এসে তোমার পায়ে লুটিয়ে পড়ে না! তার নাম কি?

পার্বতী সন্ন্যাসীর চটুলতায় বিরক্ত হইলেন, গম্ভীরমুখে বলিলেন—তাঁর নাম শঙ্কর মহেশ্বর শিব চন্দ্রশেখর–

সন্ন্যাসী বিপুল বিস্ময়ের অভিনয় করিয়া শেষে উচ্চ ব্যঙ্গ-হাস্য করিয়া উঠিলেন—কি বললে—শিব মহেশ্বর! সেই দিগম্বর উন্মাদটা—যে একপাল প্রেত-প্রমথ নিয়ে শ্মশানে মশানে নেচে বেড়ায়! তাকে তুমি পতিরূপে কামনা কর! হাঃ হাঃ হাঃ!

সন্ন্যাসীর ব্যঙ্গ-বিস্ফুরিত অট্টহাস্য আবার ফাটিয়া পড়িল। পার্বতীর মুখ ক্রোধে রক্তিম হইয়া উঠিল, তিনি সন্ন্যাসীর প্রতি একটি জ্বলন্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া কহিলেন—কপট সন্ন্যাসী, তোমার এত স্পর্ধা তুমি শিবনিন্দা কর! আর আমি এখানে থাকব না।

পার্বতী কুটিরের পানে পা বাড়াইলেন। পিছন হইতে শান্ত কোমল স্বর আসিল—উমা, ফিরে চাও—দেখ আমি কে?

উমা ফিরিয়া চাহিলেন। যাহা দেখিলেন তাহাতে তাঁহার রোমাঞ্চিত তনু থরথর কাঁপিতে লাগিল। শিলারুদ্ধগতি তটিনীর ন্যায় তিনি চলিয়া যাইতেও পারিলেন না, স্থির হইয়া দাঁড়াইয়া থাকিতেও পারিলেন না।

সন্ন্যাসীর স্থানে স্বয়ং মহেশ্বর। তিনি মৃদু মৃদু হাস্য করিতেছেন। পার্বতীর কণ্ঠ হইতে ক্ষীণ বাষ্পরুদ্ধ স্বর বাহির হইল—মহেশ্বর।

গিরিরাজ গৃহে হর-পার্বতীর বিবাহ।

মহা আড়ম্বর; হুলস্থূল ব্যাপার। পুরীগণ হুলুধ্বনি করিতেছেন, দেবগণ অন্তরীক্ষে স্তুতিগান করিতেছেন, ভূতগণ কলকোলাহল করিয়া নাচিতেছে।

বিবাহ মণ্ডপে বর-বধূ পাশাপাশি বসিয়াছেন। রতি আসিয়া মহেশ্বরের পদতলে পড়িল। গৌরী একবার মহেশ্বরের পানে অনুনয়-ভরা দৃষ্টি নিক্ষেপ করিলেন।

আশুতোষ প্রীত হইয়া রতির মস্তকে হস্ত রাখিলেন; অমনি মদন পুনরুজ্জীবিত হইয়া যুক্তকরে দেব-দম্পতির সম্মুখে উপস্থিত হইল।

অবন্তীর রাজসভায় কালিদাস কুমারসম্ভব পর্ব শেষ করিয়াছেন। জয়ধ্বনিতে সভা পূর্ণ।

কবির মস্তকে মালা বর্ষিত হইতেছে; ক্রমে তাঁহার কণ্ঠে মালার তূপ জমিয়া উঠিল। তিনি যুক্তকরে নতনেত্রে দাঁড়াইয়া এই সংবর্ধনা গ্রহণ করিলেন।

উপরে মহিলামঞ্চেও চাঞ্চল্যের অন্ত নাই। কুঙ্কুম লাজাঞ্জলি পুস্পাঞ্জলি কবির মস্তক লক্ষ্য করিয়া নিক্ষিপ্ত হইতেছে। মহিলাদের রসনাও নীরব নাই, সকলে একসঙ্গে কথা কহিতেছেন। সভা ভঙ্গ হইয়াছে, তাই মহিলারাও নিজ নিজ আসন ছাড়িয়া উঠিয়াছেন, কিন্তু আশু সভা ছাড়িবার কোনো লক্ষণই দেখা যাইতেছে না। ভানুমতী মাতিয়া উঠিয়াছেন, পরম উৎসাহভরে সকলের সঙ্গে আলাপ করিতেছেন।

এই প্রমত্ত আনন্দ-অধীর সমষ্টির এক প্রান্তে কুন্তলকুমারী হৈমশ্রী মুছাহতার ন্যায় বসিয়া আছেন। তাঁহার বিস্ফারিত চক্ষে দৃষ্টি নাই, কেবল অধরোষ্ঠ যেন কোন্ অনুচ্চারিত কথায় থাকিয়া থাকিয়া নড়িয়া উঠিতেছে—আমার স্বামী আমার স্বামী–

মালিনীর অবস্থাও বিচিত্র। সে একসঙ্গে হাসিতেছে, কাঁদিতেছে, একবার ছুটিয়া মঞ্চের প্রান্ত পর্যন্ত যাইতেছে, আবার দ্বারের কাছে ফিরিয়া আসিতেছে। তাহার দিকে কাহারো দৃষ্টি নাই। মালিনী একবার চারিদিকে চাহিয়া দেখিল, তারপর সাবধানে কোঁচড় হইতে মালাটি বাহির করিয়া কালিদাসের শির লক্ষ্য করিয়া ছুঁড়িয়া দিল। মালাটি চক্রাকারে ঘুরিতে ঘুরিতে কালিদাসের মাথা গলিয়া পড়িল। কবি স্মিত চক্ষু তুলিয়া চাহিলেন।

 

রাজসভা শূন্য হইয়া গিয়াছে। নীচে একটিও লোক নাই, উপরে একাকিনী কুন্তলকুমারী বসিয়া আছেন, আর মালিনী দ্বারে ঠেস দিয়া দাঁড়াইয়া ঊর্ধ্বমুখে কোন্ দুর্গম চিন্তায় মগ্ন হইয়া গিয়াছে।

সহসা চমক ভাঙ্গিয়া কুন্তলকুমারী দেখিলেন তিনি একা, সকলে চলিয়া গিয়াছে। তিনি উঠিয়া দ্বারের দিকে চলিলেন। সকলে হয়তো তাঁহার ভাব-বিহ্বলতা লক্ষ্য করিয়াছে। কে কি ভাবিয়াছে কে জানে।

হৈমশ্রী দ্বারের কাছে পৌঁছিলে মালিনী চট্‌কা ভাঙ্গিয়া সোজা হইয়া দাঁড়াইল, সসম্রমে বলিল—দেবি, আমার ওপর মহাদেবী ভানুমতীর আজ্ঞা আছে, আপনি যেখানে যেতে চাইবেন নিয়ে যাব।

হৈমশ্রী নিঃশব্দে মাথা নাড়িয়া বাহির হইয়া গেলেন। কিছুদূর গিয়া তাঁহার গতি হ্রাস হইল, ইতস্তত করিয়া তিনি দাঁড়াইলেন, তারপর মালিনীর দিকে ফিরিয়া আসিলেন। বলিলেন—তুমি কি মহাদেবী ভানুমতীর কিঙ্করী?

মালিনী বলিল–হ্যাঁ দেবি, আমি তাঁর মালিনী।

কুন্তলকুমারী আসল প্রশ্নটি সহজভাবে জিজ্ঞাসা করিবার চেষ্টা করিলেন কিন্তু গলা বুজিয়া গেল। অতি কষ্টে উচ্চারণ করিলেন—তুমি—তুমি–কবি শ্রীকালিদাস কোথায় থাকেন তুমি জানো?

মালিনী চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া চাহিল; সহজ সম্রমের সুরেই বলিল—হাঁ দেবি, জানি।

আগ্রহের কাছে সংকোচ পরাভূত হইল, কুন্তলকুমারী আর এক-পা কাছে আসিলেন—কোথায় থাকেন তিনি?

মালিনীর মুখে একটু হাসি খেলিয়া গেল—শিপ্রা নদীর ধারে নিজের হাতে কুঁড়ে ঘর তৈরি করেছেন, সেইখানেই থাকেন। তাঁর খবর নিয়ে আপনার কী লাভ দেবি? কবি বড় গরিব, দীনদরিদ্র; কিন্তু তিনি বড়লোকের অনুগ্রহ নেন না।

হৈমশ্রী আর একটু কাছে আসিলেন—তবে কি—তুমি কি তাঁর সঙ্গে কি তোমার পরিচয় আছে?

তিক্ত হাসিতে মালিনীর অধরপ্রান্ত নত হইয়া পড়িল—আছে দেবি, সামান্যই। তিনি মহাকবি, আমি মালিনী। তাঁর সঙ্গে আমার কতটুকু পরিচয় থাকতে পারে?

কুন্তলকুমারী কিছু শুনিলেন না, প্রবল আবেগে মালিনীর হাত চাপিয়া বলিলেন—তুমি আমাকে তাঁর কাছে নিয়ে যেতে পারবে?

মালিনীর চোখ হইতে যেন ঠুলি খসিয়া পড়িল। এতক্ষণ সে ভাবিয়াছিল রাজকুমারীর জিজ্ঞাসা বড় মানুষের ক্ষণিক কৌতূহল মাত্র; এখন সে সন্দেহ-প্রখর চক্ষে তাঁহার পানে চাহিয়া রহিল, তারপর সহসা প্রশ্ন করিল—তুমি কে? কবি তোমার কে?

ওষ্ঠাধর চাপিয়া কুন্তলকুমারী দুরন্ত বাষ্পেষ্মস দমন করিলেন—তিনি আমার স্বামী।

অতর্কিতে মস্তকে প্রবল আঘাত পাইলে মানুষ যেমন ক্ষণেকের জন্য বুদ্ধিভ্রষ্ট হইয়া যায়, মালিনীরও তদ্রুপ হইল। সে বিহ্বলভাবে চাহিয়া বলিল—স্বামী–স্বামী?

তারপর ধীরে ধীরে তাহার উপলব্ধি ফিরিয়া আসিল, সে ঊর্ধ্বমুখে চক্ষু মুদিত করিয়া অস্ফুট স্বরে বলিল—ও স্বামী! তাই! বুঝতে পেরেছি, দেবি, এবার সব বুঝতে পেরেছি। তা আপনি তাঁর কাছে যেতে চান?

হৈমশ্রী মিনতি করিয়া বলিলেন—হাঁ। তুমি আমাকে তাঁর কাছে নিয়ে চল।

মালিনীর বুকের ভিতরটা শূলবিদ্ধ সর্পের মত মুচড়াইয়া উঠিতেছিল, সে একটু বক্রোক্তি না করিয়া থাকিতে পারিল না—দেবি, আপনি রাজার মেয়ে, সেখানে যাওয়া কি আপনার শোভা পাবে? সে একটা খড়ের কুঁড়ে ঘর, সেখানে কবি নিজের হাতে বেঁধে খান। এই দারিদ্র্য কি আপনি সহ্য করতে পারবেন রাজকুমারী?

হৈমশ্রীর ভয় হইল মালিনী বুঝি তাঁহাকে লইয়া যাইবে না। তিনি হাতের কঙ্কণ খুলিতে খুলিতে ব্যগ্রভাবে বলিলেন-তুমি বুঝতে পারছ না—আমি যে তাঁর স্ত্রী–সহধর্মিণী। এই নাও পুরস্কার। দয়া করে আমাকে তাঁর কুটিরে নিয়ে চল।

হৈমশ্রী কঙ্কণটি মালিনীর হাতে গুঁজিয়া দিতে গেলেন, কিন্তু মালিনী লইল না, বিতৃষ্ণার সহিত হাত সরাইয়া লইল। তিক্ত হাসিয়া বলিল—থাক, দরকার নেই, এইটুকু কাজের জন্যে আবার পুরস্কার কিসের! আসুন আমার সঙ্গে।

রাজকুমারীর জন্য অপেক্ষা না করিয়াই মালিনী চলিতে আরম্ভ করিল।

<

Sharadindu Bandyopadhyay ।। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়