রাজপুরীর প্রথম ভবনে মহামন্ত্রী যুক্তকরে কালিদাসকে সংবর্ধনা করিলেন। শীর্ণকায় তীক্ষ্ণচক্ষু বৃদ্ধ মহা আড়ম্বরে সম্ভাষণ আরম্ভ করিলেন—স্বাগত—শুভাগতম্। অষ্টোত্তর শ্রীযুক্ত পরমভট্টারক পরমভাগবত সৌরাষ্ট্রকুমারের জয় হৌক। আসুন মহাভাগ—আপনার পদদ্বন্দ্ব স্পর্শে—

কালিদাস সম্মোহিতভাবে শুনিতে শুনিতে এতক্ষণে কেবল পদ শব্দটি বুঝিতে পারিলেন। কিন্তু পদদ্বন্দ্ব কী বস্তু? তিনি ত্রস্তভাবে নিজের পায়ের দিকে চক্ষু নামাইলেন—পদদ্বন্দ্ব!

মহামন্ত্রী স্মিতমুখে বলিলেন—পদযুগল।

কালিদাস তথাপি বিভ্রান্ত। বলিলেন—পদযুগল!

মহামন্ত্রী সপ্রশংস মুখে একটু হাস্য করিলেন—কুমার দেখছি পরিহাস-প্রিয়। পদদ্বন্দ্ব অর্থাৎ পদযুগল—অর্থাৎ দুটি পা–।

কালিদাসের মুখের মেঘ কাটিয়া গেল—ওঃ! দ্বন্দ্ব মানে দুটি! তাই পদদ্বন্দ্ব বললেন!

মহামন্ত্রী আসিয়া কালিদাসের বাহু ধরিলেন। রসিক ও কৌতুকী রাজপুত্র এ জগতে বড়ই বিরল। বৃদ্ধ স্মিতহাস্যে বলিলেন—বৃদ্ধের সঙ্গে পরিহাস করবেন না কুমার, রসালাপের যোগ্যতর স্থান কাছেই আছে। আসুন, আপনাকে রাজকন্যার কাছে নিয়ে যাই

স্বয়ংবর সভায় বহুক্ষণ কোনো পাণিপ্রার্থীর শুভাগমন হয় নাই; এই অবকাশে সখীদের মধ্যে রঙ্গরস জমিয়া উঠিয়াছিল। রাজকুমারী একটি সখীর পৃষ্ঠে পৃষ্ঠভার অর্পণ করিয়া অলস ভঙ্গিতে বসিয়া ছিলেন; বিদ্যুল্লতা দুইটি ময়ূরপুচ্ছ হাতে লইয়া রাজকুমারীকে ঘিরিয়া ঘিরিয়া নৃত্য করিতেছে এবং অনুচ্চ জনান্তিক স্বরে গান গাহিতেছে। তাহার গানের কথাগুলিতে যে মৃদু রতিরস আছে হৈমশ্রী তাহা উপভোগ করিতেছেন। সখীরা কেহ মুখ টিপিয়া হাসিতেছে, কেহ বা ব্যক্তভাবেই কুন্দদন্ত বিকশিত করিয়া আছে। একটি সখীর অঙ্গুলির মৃদু আঘাতে ভূমিশয়ান বীণার তন্ত্রী হইতে মুগ্ধ মূৰ্ছনা গুঞ্জিত হইয়া উঠিতেছে।

সহসা বাধা পড়িল। কয়েকটি সখী দূরে মহামন্ত্রীকে আসিতে দেখিয়া বিদ্যুল্লতার দিকে উৎকণ্ঠ হইয়া সমস্বরে শীৎকার করিয়া উঠিল— —!

বিদ্যুল্লতা ঘাড় ফিরাইয়া একবার দ্বারের দিকে এস্ত দৃষ্টিপাত করিয়াই থপ করিয়া বসিয়া পড়িল। হৈমশ্রী ঈষৎ চকিতভাবে দ্বারের পানে আয়ত চক্ষু ফিরাইলেন।

প্রধান দ্বারপথে মহামন্ত্রী কালিদাসকে সঙ্গে লইয়া অগ্রসর হইয়া আসিতেছেন। কালিদাসের চোখেমুখে অকুণ্ঠ বিস্ময়; মাঝে মাঝে কোনো একটি সুন্দর কারুকার্য দেখিয়া তাঁহার মন্থর গতি রুদ্ধ হইয়া যাইতেছে; মহামন্ত্রী তাঁহার বাহু স্পর্শ করিয়া আবার তাঁহাকে সম্মুখে পরিচালিত করিতেছেন।

উভয়ে দ্বিতীয় বেদীর উপর আসিয়া দাঁড়াইলেন। কালিদাস সম্মুখস্থ যুবতি্যুথের প্রতি সুস্মিত বিস্ময়ে চাহিয়া রহিলেন।

সখীরাও ইতিমধ্যে উঠিয়া দাঁড়াইয়াছিল এবং সহস্রচক্ষু লইয়া এই মুকুটধারী পরম সুন্দর যুবাপুরুষকে নিরীক্ষণ করিতেছিল। রাজকুমারী একবার চক্ষু তুলিয়া আবার চক্ষু নত করিয়াছিলেন; তাঁহার মুখের নিরুৎসুক ঔদাসীন্য অনেকটা কাটিয়া গিয়াছিল। বলা বাহুল্য, এমন কান্তিমান পাণিপ্রার্থী ইতিপূর্বে স্বয়ংবর সভায় পদার্পণ করেন নাই।

মহামন্ত্রী মহাশয় একবার গলা ঝাড়া দিয়া দক্ষিণ হস্তখানি অভয়মুদ্রার ভঙ্গিতে তুলিলেন—স্বস্তি। পরমভট্টারক শ্রীমান সৌরাষ্ট্রকুমার রাজকুমারীর প্রশ্নের উত্তর দিতে এসেছেন। শুভমস্তু।

রাজকুমারী দুই করতল যুক্ত করিয়া বুক পর্যন্ত তুলিলেন; চোখ দুটি ঈষৎ উঠিয়া আবার নত হইল। বাহিরে কিছু প্রকাশ না পাইলেও তিনি যেন অন্তরে অন্তরে বিচলিত হইয়া উঠিয়াছেন, জোয়ারের জলস্পর্শে ঘাটে বাঁধা তরণীর মত।

এদিকে মহামন্ত্রী কালিদাসকে চক্ষু দ্বারা ইশারা করিতেছেন মাথা হইতে শিরস্ত্রাণটি খুলিয়া ফেলিতে; কিন্তু কালিদাস ইঙ্গিতটা ঠিক ধরিতে পারিতেছেন না। মহামন্ত্রী তখন তাঁহার কানের কাছে মুখ লইয়া গিয়া মৃদুস্বরে কথা বলিলেন; কালিদাস তাড়াতাড়ি শিরস্ত্রাণ খুলিয়া ফেলিলেন। কিন্তু ওটা রাখিবেন কোথায়? এদিক ওদিক স্থান না পাইয়া শেষে মহামন্ত্রীর হাতে ওটা ধরাইয়া দিয়া সহাস্য মুখে রাজকুমারীর দিকে ফিরিলেন।

কালিদাসের শিরস্ত্রাণ-মুক্ত মুখমণ্ডল দেখিয়া যুবতীদের মুণ্ড ঘুরিয়া গেল। তাহারা নিশ্বাস সংবরণ করিয়া দেখিতে লাগিল; এক ঝাঁক খঞ্জন যেন কোন্ মায়াবীর মন্ত্ৰকুহকে স্থির চলৎশক্তিহীন হইয়া গিয়াছে। শেষে মৃগশিরা আর থাকিতে না পারিয়া পাশের সখীর কানে কানে বলিল—কী চমৎকার চেহারা ভাই, যেন সাক্ষাৎ কন্দর্প। এমন আর কখনো দেখেছিস!

আশেপাশের দুই তিনজন চাপা গলায় বলিয়া উঠিল—সস্‌স্‌–!

চতুরিকা রাজকুমারীর মনের ভাব বুঝিয়াছিল, সে তাঁহার কানের কাছে মুখ লইয়া গিয়া হ্রস্বকণ্ঠে বলিল—মহেশ্বরের কাছে মানত করো এবার যেন না ফস্কায়।

রাজকুমারী মুখ টিপিয়া হাসিলেন, আঙুল দিয়া ঠেলিয়া চতুরিকাকে পাশে সরাইয়া দিলেন। চতুরিকা বড় প্রগন্ডা।

প্রশ্ন করিতে বিলম্ব হইতেছে। সৌরাষ্ট্রকুমারকে কতক্ষণ দাঁড় করাইয়া রাখা যায়! মহামন্ত্রী আর একবার গলা ঝাড়া দিয়া বলিলেন—কুমারি, কুমার-ভট্টারক নিজের ভাগ্য পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হয়েছেন, এবার আপনার প্রশ্ন করুন।

রাজকুমারী মুখ তুলিলেন। কালিদাসের সঙ্গে তিনি ঠিক মুখোমুখিভাবে দাঁড়াইয়া ছিলেন না। একটু পাশ ফিরিয়া ছিলেন। এখন মনোরম গ্রীবাভঙ্গি সহকারে তিনি একবার কালিদাসের দিকে মুখ ফিরাইলেন, তারপর আবার সম্মুখ দিকে চাহিয়া অনুচ্চ স্পষ্ট স্বরে বলিলেন—প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে—জগতে সবচেয়ে শক্তিমান কী?

সখীরা এতক্ষণ একদৃষ্টে রাজকুমারীর পানে চাহিয়া ছিল, এখন যন্ত্র-নিয়ন্ত্রিতবৎ একসঙ্গে কালিদাসের পানে মুও ফিরাইল।

কালিদাস কিন্তু ইত্যবসরে অন্যমনস্ক হইয়া পড়িয়াছেন; চারিদিকে এত মহার্ঘ বৈচিত্র্য ছড়ানো রহিয়াছে যে চক্ষু বিভ্রান্ত হইলে দোষ দেওয়া যায় না। তিনি রাজকুমারীর প্রশ্ন করার ব্যাপারটা ভালরূপ অনুধাবন করিয়াছিলেন কিনা তাহাতেও সন্দেহ আছে। মহামন্ত্রী তাঁহার ভাব দেখিয়া মনে করিলেন ইহা সৌরাষ্ট্রদেশীয় রসিকতার একটা অঙ্গ। তিনি সসম্রমে প্রশ্নের পুনরুক্তি করিয়া কালিদাসের মনোযোগ আকর্ষণ করিলেন—কুমারী প্রশ্ন করেছেন, জগতে সবচেয়ে শক্তিমান কী?

কালিদাসের চক্ষুযুগল এই সময় বিস্ময়-বিমুগ্ধভাবে ঊর্ধ্বে উঠিতেছিল, হঠাৎ তাঁহার মুখে ভয়ের ছায়া পড়িল। ত্রাস-বিস্ফারিত নেত্র ঊর্ধ্বে রাখিয়া তিনি একটি বাহু পাশের দিকে বাড়াইয়া বৃদ্ধ মন্ত্রীর কণ্ঠ জড়াইয়া ধরিলেন। তারপর বিনা বাক্যব্যয়ে তাঁহাকে দুই হস্তে জাপ্টাইয়া ধরিয়া আলিসার পানে তাকাইতে লাগিলেন।

উর্ধ্বে আলিসার উপর যে হাব্‌শী রক্ষীযুগলের ভয়ঙ্কর যুদ্ধাভিনয় আরম্ভ হইয়াছিল এবং তাহা দেখিয়াই যে কালিদাসের ঈদৃশ অবস্থান্তর ঘটিয়াছে তাহা কেহ বুঝিতে পারিল না। বৃদ্ধ মহামন্ত্রী উত্ত্যক্ত হইয়া ভাবিলেন, সৌরাষ্ট্র দেশের রাজকীয় রসিকতা ক্রমশ চরমে উঠিতেছে। গলা ছাড়াইবার চেষ্টা করিতে করিতে তিনি বলিলেন—প্রশ্নের উত্তর দিন কুমার।

ব্যাপার বেশিদূর গড়াইতে পারিল না; হাবশী যুগল ইত্যবসরে দ্বন্দ্বাভিনয় শেষ করিয়া আবার শান্তভাবে বিপরীত মুখে চলিতে আরম্ভ করিয়াছিল। কালিদাস কতকটা আশ্বস্ত হইয়া মন্ত্রীকে ছাড়িয়া দিলেন। ক্ষুব্ধ মন্ত্রী কণ্ঠের ঘাম মুছিতে মুছিতে পুনশ্চ বলিলেন—এইবার প্রশ্নের উত্তর!

কিন্তু কালিদাস বাঙনিষ্পত্তি করিবার পূর্বেই রাজকুমারী কথা কহিলেন, বীণার ঝঙ্কারের ন্যায় ঈষৎ কম্পিত কণ্ঠে বলিলেন—প্রথম প্রশ্নের যথার্থ উত্তর পেয়েছি।

সকলে অবাক। উত্তেজিত সখীর দল রাজকুমারীকে ভাল করিয়া ঘিরিয়া ধরিল। চতুরিকা বলিয়া উঠিল—আঁ—কী উত্তর পেলে!

কুমারীর গণ্ডদুটি ঈষৎ অরুণাভ হইল। তিনি ঈষৎ গ্রীবা বাঁকাইয়া স্পষ্ট অথচ সংবৃতকণ্ঠে বলিলেন—প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে—ভয়! কুমার অভিনয়ের দ্বারা যথার্থ উত্তর দিয়েছেন।

সখীর দল সশব্দে নিশ্বাস ছাড়িয়া কালিদাসের দিকে ফিরিল।

কালিদাস মন্ত্রীর পানে চাহিয়া একটু বিহ্বলভাবে হাসিতেছেন, কোন্ দিক দিয়া কী হইয়া গেল ধারণা করিতে পারিতেছেন না। মন্ত্রীও কতকটা বোকা বনিয়া গিয়া ঘাড় চুলকাইতে লাগিলেন।

রাজকুমারী কথা কহিলেন। তাঁহার মুখচ্ছবিতে একটু উদ্বেগ দেখা দিয়াছে; কি জানি কুমার দ্বিতীয় প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পারিবেন কিনা। কিন্তু তাঁহার কণ্ঠস্বর তেমনি সংযত এবং

আবেশহীন হইয়া রহিল। তিনি বলিলেন—এবার দ্বিতীয় প্রশ্ন—দ্বন্দ্ব হয় কাদের মধ্যে?

প্রশ্ন করিয়াই রাজকুমারী কালিদাসের পানে একটি উৎকণ্ঠা-মিশ্র দৃষ্টি প্রেরণ করিলেন।

কালিদাস এবার প্রস্তুত ছিলেন; প্রশ্ন শুনিয়া তাঁহার মুখ হর্ষোৎফুল্ল হইয়া উঠিল। তিনি মন্ত্রীর পানে কৌতুক কটাক্ষপাত করিয়া তর্জনী তুলিলেন, যেন ইঙ্গিতে বলিতে চাহিলেন যে এ প্রশ্নের সমাধান তো পূর্বেই হইয়া গিয়াছে। তারপর বিজয়দীপ্ত চক্ষে রাজকুমারীর দিকে চাহিয়া দুইটি অঙ্গুলি ঊর্ধ্বে তুলিয়া বলিলেন—দ্বন্দ্ব—দুই।

রাজকুমারীর চক্ষে চকিত আনন্দ খেলিয়া গেল, তিনি রুদ্ধ নিশ্বাস মোচন করিলেন। চতুরিকা উত্তেজনা-বিকৃত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিল—কি হল—ঠিক হয়েছে?

রাজকুমারী ক্ষণেক নীরব থাকিয়া বোধ করি নিজের উদ্গত হৃদয়বৃত্তি সংবরণ করিয়া লইলেন, তারপর ধীর স্বরে কহিলেন—কুমার দ্বিতীয় প্রশ্নের যথার্থ উত্তর দিয়েছেন—দ্বন্দ্ব হয় দুই-এর মধ্যে।

সভাকক্ষের ভিতর দিয়া উত্তেজনার একটা ঝড় বহিয়া গেল। সখীরা প্রায় সকলেই একসঙ্গে কলকূজন করিয়া উঠিয়া তৎক্ষণাৎ স্ শব্দের শাসনে নীরব হইল। উত্তেজনায় মৃগশিরা ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলিতে লাগিল; বনজ্যোৎস্না ভূলুণ্ঠিত বীণাটার উপর পা চাপাইয়া দিয়া তাহার মর্মন্তু হইতে যন্ত্রণার কাকুতি বাহির করিল; বিদ্যুল্লতার নীবিবন্ধ খুলিয়া খসিয়া পড়িবার উপক্রম করিতেছিল, হঠাৎ সেইদিকে মনোযোগ আকৃষ্ট হওয়ায় সে ব্যাকুলভাবে বস্ত্র সংবরণ করিয়া সকলের পিছনে লুকাইল। রাজকুমারী সকলের মধ্যে দাঁড়াইয়া নীহারশুভ্র উত্তরীয়টি ভাল করিয়া অঙ্গে জড়াইয়া লইলেন।

বুড়া মন্ত্রীর গায়েও বোধহয় উত্তেজনার ছোঁয়াচ লাগিয়াছিল, তিনি দুই হস্ত সহর্ষে ঘর্ষণ করিতে করিতে বলিলেন—ধন্য কুমার! ধন্য কুমার। আপনি দুটি প্রশ্নের নির্ভুল উত্তর দিয়েছেন। এবার শেষ প্রশ্ন। মাত্র একটি প্রশ্ন বাকি।

এই সব উত্তেজনা উদ্দীপনার মধ্যে কালিদাস কিন্তু অত্যন্ত নির্লিপ্তভাবে একদিকে তাকাইয়া দেখিতেছিলেন; স্বর্ণদণ্ডের উপর পাখি দুটি তাঁহার সকৌতুক মনোযোগ আকৰ্ষণ করিয়া লইয়াছিল। তাই রাজকুমারী যখন তৃতীয় প্রশ্ন উচ্চারণ করিলেন তাহা কালিদাসের কানে গেল কিনা সন্দেহ।

যিনি প্রশ্নের উত্তর দিবেন তাঁহার কোনো উৎকণ্ঠা নাই, কিন্তু রাজকুমারীর গলা শুকাইয়া গিয়াছিল, বুকের ভিতর হৃত্যন্ত্রের ক্রিয়া ঠিক স্বাভাবিকভাবে চলিতেছিল না। কিন্তু বাহিরে কিছু প্রকাশ করা চলিবে না। কুমার যদি শেষ প্রশ্নের উত্তর না দিতে পারেন অথচ কুমারীর মনের পক্ষপাত প্রকাশ হইয়া পড়ে, তবে সে বড় লজ্জার কথা হইবে। তিনি যথাসম্ভব স্থির স্বরে কথা বলিলেন, তবু গলা একটু কাঁপিয়া গেল—শেষ প্রশ্ন—পৃথিবীতে সবচেয়ে মিষ্ট কি?

যুবতিবৃন্দ যুগপৎ কালিদাসের পানে চক্ষু ফিরাইল।

কালিদাস ফিক্‌ করিয়া হাসিলেন। কিন্তু তাঁহার মুখে কথা নাই, চক্ষু শুক-মিথুনের উপর নিবদ্ধ। রাজকুমারী ঈষৎ বিস্ময়ে চক্ষু ফিরাইয়া দেখিলেন কালিদাস অন্য দিকে তাকাইয়া আছেন; তাঁহার মুখে ক্ষণিক ক্ষোভের ছায়া পড়িল। পরক্ষণেই কালিদাস সম্মুখে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া বলিয়া উঠিলেন—ঐ দ্যাখো—ঐ দ্যাখো–।

সকলে একসঙ্গে তাঁহার অঙ্গুলিসঙ্কেত অনুসরণ করিয়া তাকাইলেন। ব্যাপার এমন কিছু গুরুতর নয়, দণ্ডের উপর বসিয়া শুক-দম্পতি অমুদিতনেত্রে পরস্পর চঞ্চুচুম্বন করিতেছে; তাহাদের কণ্ঠ হইতে গদগদ কূজন নির্গত হইতেছে। যিনি ভবিষ্যকালে লিখিবেন—মধু দ্বিরেফঃ কুসুমৈকপাত্রে পপৌ প্রিয়াং স্বামনুবর্তমানঃ–তিনি এই দেখিয়াই বিহ্বল আত্মবিস্মৃত।

রাজকুমারীর চক্ষে কিন্তু আনন্দের বিজলী খেলিয়া গেল; তিনি কালিদাসের পানে সভঙ্গ একটি কটাক্ষ নিক্ষেপ করিয়া সলজ্জ রক্তিম মুখখানি নত করিয়া ফেলিলেন।

কালিদাস হাসিতে হাসিতে রাজকুমারীর দিকে ফিরিলেন, চমকিত হইয়া দেখিলেন তিনি ধীরে ধীরে নতজানু হইতেছেন। যুক্তকরে শির অবনমিত করিয়া কুমারী অধস্ফুট স্বরে বলিলেন—আর্যপুত্র শেষ প্রশ্নের যথার্থ উত্তর দিয়েছেন। পৃথিবীতে সবচেয়ে মিষ্ট—প্রণয়।

ক্ষণকালের বিস্ময় বিমূঢ়তা কাটিয়া যেন শত ছিন্ন হইয়া গেল। সখীরা আর সম্ভ্রম শালীনতার শাসন মানিল না। চিৎকার হুড়াহুড়ি অঞ্চল-উত্তরীয়ের উৎক্ষেপে তাহাদের প্রমত্ত উল্লাস একেবারে বাহ্যজ্ঞান শূন্য হইয়া পড়িল। রাজকুমারী উঠিয়া দাঁড়াইতে চার পাঁচজন ছুটিয়া গিয়া তাঁহাকে একসঙ্গে জড়াইয়া ধরিল। কয়েক জন মুঠি মুঠি লাজ লইয়া সকলের মাথার উপর বৃষ্টি করিতে লাগিল। একজন ঘন ঘন শঙ্খ বাজাইয়া তুমুল শব্দ-তরঙ্গের সৃষ্টি করিল। যাহারা অবশিষ্ট রহিল, তাহাদের মধ্যে কেহ কেহ পরস্পর হাত ধরিয়া ঘুরিয়া ঘুরিয়া নাচিতে লাগিল; অন্য কয়জন পরস্পর আঁচল টানিয়া, কবরী খুলিয়া দিয়া কপট কলহে হৃদয়াবেগ লাঘব করিতে প্রবৃত্ত হইল।

মহামন্ত্রী কালিদাসের দুই হাত চাপিয়া ধরিয়া গদগদ কণ্ঠে বলিলেন—ধন্য কুমার! ধন্য আপনার কূটবুদ্ধি! আমি মহারাজকে সুসংবাদ দিতে চললাম। বলিয়া তিনি দ্রুতপদে সভা হইতে নিষ্ক্রান্ত হইয়া গেলেন।

বিশ্বস্তকুন্তলা চতুরিকা বেদীর কিনারায় ঊর্ধ্বমুখী হইয়া দাঁড়াইয়া দুই হাত নাড়িয়া উপরিস্থিত হাব্‌শী রক্ষীকে ইশারা করিতেছিল, মুখের কাছে সম্পুটিত করপল্লব যুক্ত করিয়া জানাইতেছিল— শিঙা বাজাও, বিষাণ বাজাও, নগরীতে সংবাদ দাও রাজকন্যা পতিবরণ করিয়াছেন।

দেখিতে দেখিতে নগরময় রাষ্ট্র হইয়া গেল, রাজকন্যা পতিবরণ করিয়াছেন। নগরোদ্যানে আনন্দ-বিহ্বল নাগরিকেরা ছুটিয়া আসিয়া সমবেত হইল; নৃত্যগীত আরম্ভ হইয়া গেল, যেন সকলের গৃহেই আজ পরমোৎসব।

নগরোদ্যান বেষ্টনকারী পথের উপর দিয়া এক সুসজ্জিত হস্তী চলিয়াছে; চারিদিকে বিপুল জনতা। হস্তীপৃষ্ঠে আসীন ঘোষক চিৎকার করিয়া দুই বাহু আস্ফালন করিয়া বোধ করি রাজকুমারীর স্বয়ংবর সংক্রান্ত কোনো রাজকীয় বার্তা ঘোষণা করিতেছে, কিন্তু জনতার কলকোলাহলে কিছুই শোনা যাইতেছে না। ঘোষকের পশ্চাতে বসিয়া দ্বিতীয় এক পুরুষ মুঠি মুঠি স্বর্ণমুদ্রা চারিদিকে ছড়াইতেছে। নিম্নে সোনা কুড়াইবার হুড়াহুড়ি মারামারি।

ক্রমে রাত্রি হইল। রাজপুরীর পূজামন্দিরে অগ্নি সাক্ষী করিয়া কুমারী হৈমশ্রীর সহিত কালিদাসের বিবাহ হইল।

রাত্রি গভীর হইতেছে। আকাশে পূর্ণচন্দ্র, দীপান্বিতা নগরী। সৌধে সৌধে আলোকমালা; গীতবাদ্যে, সুগন্ধি অগুরু-ধূমে বাতাস আমোদিত। সর্বাঙ্গে দীপালঙ্কার পরিয়া রাজপুরী সখিপরিবৃতা প্রধান নায়িকার ন্যায় শোভা পাইতেছে। রাত্রি যত বাড়িতেছে উৎসাহ উত্তেজনা ততই মন্থর রসঘন হইয়া আসিতেছে, নায়ক নায়িকার নিভৃত মিলনের আর বিলম্ব নাই।

 

নগরীর এক মদিরাগৃহের সম্মুখে একদল মশালহস্ত উৎসবকারী সৌরাষ্ট্রের প্রকৃত যুবরাজকে ঘিরিয়া ধরিয়াছিল এবং প্রমত্ত রঙ্গ-কৌতুকের অঙ্কুশে বিঁধিয়া তাঁহাকে প্রায় পাগল করিয়া তুলিয়াছিল। মকরবর্মা দীর্ঘ বনপথ পদব্রজে অতিক্রম করিয়া সবেমাত্র নগরে আসিয়া পৌঁছিয়াছেন; অঙ্গের বসন ছিন্ন কর্দমাক্ত, জঠরে জ্বলন্ত ক্ষুধা—তাঁহার মানসিক অবস্থা সহজেই অনুমেয়। সর্বাপেক্ষা পরিতাপের বিষয় এই যে কেহই তাঁহাকে সৌরাষ্ট্রের যুবরাজ মকরবর্মা বলিয়া বিশ্বাস করিতেছে না।

মকরবর্মা উত্তপ্ত কণ্ঠে বলিলেন—আমি বলছি আমিই সৌরাষ্ট্রের যুবরাজ।

এক ব্যক্তি মুখে চার শব্দ করিয়া বলিল—তা তো অনেকক্ষণ থেকেই বলছ, আমরাও শুনে আসছি। কিন্তু তার প্রমাণ কই বাছাধন।

মকরবর্মা অধিকতর ক্রুদ্ধ হইয়া উঠিতে লাগিলেন, উদ্ধত স্বরে কহিলেন—প্রমাণ! প্রমাণ আবার কি? দেখতে পাচ্ছ না আমি যুবরাজ? বলিয়া তিনি বুক ফুলাইয়া গর্বিত ভঙ্গিতে দাঁড়াইলেন। সকলে হাসিয়া উঠিল। হাসি থামিলে একজন সান্ত্বনার স্বরে বলিল—আচ্ছা আচ্ছা, তুমিই সৌরাষ্ট্রের যুবরাজ।—কিন্তু যার সঙ্গে রাজকুমারীর বিয়ে হল, সে তবে কে?

যুবরাজ মকরবর্মা এবার একেবারে ক্ষেপিয়া গেলেন, ফেনায়িত মুখে চিৎকার করিলেন—সে—সে একটা কাঠুরে। চোর—প্রবঞ্চক বাটপাড়! আমার কাপড় জামা জুতো ঘোড়া সব চুরি করে নিয়ে পালিয়েছে।

আবার উচ্চহাস্যে তাঁহার কথা চাপা পড়িয়া গেল; রাজকুমার নিষ্ফল ক্রোধে দন্ত কিড়িমিড়ি করিতে লাগিলেন। হাসি মন্দীভূত হইলে প্রথম ব্যক্তি মিটিমিটি চাহিয়া বলিল—সত্যি কথা বলতে কি চাঁদবদন, তোমাদের মধ্যে কাঠুরে যদি কেউ থাকে সে তিনি নয়—তুমি। বলি, ক ঘড়া তালের রস চড়িয়েছ?

সকলে হাসিল। মকরবর্মা দেখিলেন এখানে কিছু হইবে না; তিনি রূঢ় হস্তে ভিড় সরাইয়া বাহির হইবার চেষ্টা করিলেন—ছেড়ে দাওসরে যাও। আমি দেখে নেব সেই চোর কাঠুরেটাকে—শূলে দেব। যাবে কোথায় সে! একবার তাকে দেখতে চাই।

তাঁহার কণ্ঠস্বর জনতার বাহিরে মিলাইয়া গেল। প্রথম ব্যক্তি নীরস কণ্ঠে মন্তব্য করিল—কী আর দেখবে যাদু। তিনি এতক্ষণে রাজকন্যেকে নিয়ে বাসর-শয্যায় শয়ন করেছেন।

আবার হাসির লহর ছুটিল।

 

রাজভবনের উদ্যান-মধ্যে একটি সরোবর। সরোবরের স্থির দর্পণে চাঁদের প্রতিবিম্ব পড়িয়াছে।

বাঁধানো ঘাটের পাশে মর্মরবেদী; তাহার উপর কালিদাস ও হৈমশ্রী পাশাপাশি বসিয়া আছেন। নব পরিণয়ের পীতসূত্র তাঁহাদের মণিবন্ধে জড়ানো রহিয়াছে। হৈমশ্রীর হাতে একটি ক্ষুদ্র রৌপ্যনির্মিত তীর—যাহা পরবর্তী কালে কাজললতায় রূপান্তরিত হইয়াছে।

রাজকুমারী নতমুখে তীরটি লইয়া নাড়াচাড়া করিতেছেন; কালিদাস মুগ্ধ উন্মনাভাবে চাঁদের পানে চাহিয়া আছেন। কিছুক্ষণ কথাবার্তা নাই। তারপর কালিদাস একটি নিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন—কী সুন্দর চাঁদ! ঠিক যেন ঠিক যেন যে উপমাটি খুঁজিতেছিলেন তাহা পাইলেন না। হৈমশ্রী মুখখানি একটু তুলিয়া স্মিত সলজ্জ কণ্ঠে বলিলেন—ঠিক যেন–?

কালিদাস ক্ষুব্ধভাবে মাথা নাড়িলেন—জানি না। মনে আসছে মুখে আসছে না—

রাজকুমারী একটু নিরাশ হইলেন; নব অনুরাগের আকাঙ্খায় যে সুমিষ্ট উপমাটি প্রত্যাশা করিয়াছিলেন কালিদাসের কণ্ঠে তাহা আসিল না।

এই সময় সহসা বিকট শব্দ শুনিয়া হৈমশ্রী চমকিয়া উঠিলেন।

শব্দটি আসিল প্রাসাদ বেষ্টনকারী প্রাচীরের পরপার হইতে। প্রাচীরের বাহিরে রাজপথ গিয়াছে, সেই পথ দিয়া এক শ্রেণী ভারবাহী উষ্ট্র চলিয়াছিল। একটি উষ্ট্র বোধ করি প্রাচীরের উপর হইতে গলা বাড়াইয়া অদূরে নবদম্পতিকে দেখিয়া হর্ষধ্বনি করিয়া উঠিয়াছিল।

ভয় পাইয়া হৈমশ্রী কালিদাসের হাত চাপিয়া ধরিয়াছিলেন। কালিদাস কৌতুক অনুভব করিয়া উচ্চ হাসিয়া উঠিলেন। রাজকুমারীর শিরীষ কোমল হস্তে একটু সস্নেহ চাপ দিয়া বলিলেন—ভয় নেই রাজকুমারি, ও একটা উট—যাকে সাধুভাষায় বলে—উট্র।

সাধুভাষা বলিয়া কালিদাস উৎফুল্ল হইয়া উঠিয়াছিলেন। কিন্তু হৈমশ্রীর মুখে সংশয়ের ছায়া পড়িল; তিনি বিস্ফারিত নেত্রে কালিদাসের পানে চাহিয়া ক্ষীণস্বরে কহিলেন—কি—কি বললেন আর্যপুত্র!

কালিদাস দেখিলেন ভুল হইয়াছে। তিনি তাড়াতাড়ি ভুল সংশোধন করিলেন—না না—উট্র নয় উট্র নয়—উষ্ট।

হৈমশ্রীর মুখ শুকাইয়া গেল; শঙ্কিত সন্দেহে কালিদাসের পানে চাহিয়া থাকিয়া তিনি আপনার অবশে ধীরে ধীরে উঠিয়া দাঁড়াইলেন, অস্ফুট স্বরে বলিলেন—উট্র—উষ্ট—

তারপর চকিতে তাঁহার মুখের মেঘ কাটিয়া গেল; কালিদাস আজ প্রথম হইতে যে আচরণ করিয়াছেন তাহা মনে পড়িয়া গেল। তিনি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন—ও—আর্যপুত্র পরিহাস করছেন! কী পরিহাস-প্রিয় আপনি!

কালিদাসও উঠিয়া দাঁড়াইয়াছিলেন। তিনি উত্তর দিলেন না, কেবল মৃদু মৃদু হাসিতে লাগিলেন।

এই সময়ে তোরণের ঘটিকাগৃহে মধ্যরাত্রির প্রহর বাজিল। ক্ষণস্থায়ী রাগিণীর আলাপ বন্ধ হইলে কালিদাস সবিস্ময়ে প্রশ্ন করিলেন—ও কি?

হৈমশ্রীর চোখে আবার বিস্ময়মিশ্র সন্দেহ দেখা দিল। রাজপুরীতে প্রহর বাজে সৌরাষ্ট্রের যুবরাজ তাহাও জানেন না। না, ইহাও পরিহাস!

তিনি বলিলেন—মধ্যরাতের প্রহর বাজল।

কালিদাস বলিলেন—ওহো বুঝেছি, রাত দুপুর হয়েছে। এবার চল, ভেতরে যাই।

তিনি অকুণ্ঠ সহজতায় হৈমশ্রীর দিকে হস্ত প্রসারিত করিয়া দিলেন। হৈমশ্রীর সংশয় আবার দূর হইল। এমন স্বচ্ছন্দ আভিজাত্য, এমন অনিন্দ্যকান্তি, রাজপুত্র নহিলে কি সম্ভব?

দুইজনে হাত-ধরাধরি করিয়া শয়নমন্দিরের দিকে চলিলেন।

 

ঠিক এই সময় প্রাসাদের এক বহিঃকক্ষে সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকারের অভিনয় চলিতেছিল। বক্ৰী পাপগ্রহের ন্যায় সৌরাষ্ট্রের মকরবর্মা তির্যক গতিতে কুন্তলরাজের সম্মুখীন হইয়াছিলেন।

দীপোৎসব তখনো শেষ হয় নাই; সেই দীপাবলীর আলোকে কক্ষের মধ্যস্থলে চারিটি ব্যক্তি দাঁড়াইয়াছিলেন—সৌরাষ্ট্রের মকরবর্মা, কুন্তলের বৃদ্ধ মহামন্ত্রী, পুস্তপাল মহাশয় এবং স্বয়ং কুন্তলরাজ। সৌরাষ্ট্র কুমারের বেশবাস পূর্ববৎ, তিনি সংহত ক্রোধে ঘন ঘন নিশ্বাস ত্যাগ করিতেছেন; মহামন্ত্রীর মনের ভাব বুঝিবার উপায় নাই, পুস্তপাল মহাশয় যে ত্রস্ত ও বিপন্ন হইয়া পড়িয়াছেন তাহা বুঝিতে কাহারও বেগ পাইতে হয় না। স্বয়ং কুন্তলরাজও বিলক্ষণ বিচলিত হইয়াছেন; তিনি গম্ভীর প্রকৃতির স্বল্পভাষী দৃঢ়শরীর পুরুষ, বয়স অনুমান পঞ্চাশ, মাথার চুল ও গুম্ফ পাকিতে আরম্ভ করিয়াছে। তাঁহার চোখের স্বাভাবিক শান্ত দৃষ্টি আকস্মিক বিপৎপাতে উদ্বিগ্ন হইয়া উঠিয়াছে।

পুস্তপালের প্রাণে ভয় ঢুকিয়াছে এই অনর্থের জন্য তাহাকেই দায়ী করা হইবে। তিনি করুণ স্বরে আপত্তি করিতেছেন—কিন্তু মহারাজ, এ যে—এ যে একেবারেই অসম্ভব! এই লোকটা—মানে ইনি—এও কি সম্ভব?

প্রতিবাদে মকরবর্মা একটি অন্তগূঢ় গর্জন ছাড়িলেন। ক্রমাগত চিৎকার করিয়া তাঁহার গলা ভাঙ্গিয়া গিয়াছিল, শরীরও অবসন্ন হইয়া পড়িয়াছিল, তবু দক্ষিণহস্তের মুষ্টি পুস্তপালের নাসিকার অনতিদূরে স্থাপন করিয়া তিনি দন্ত খিচাইয়া বলিলেন—সম্ভব! এই দ্যাখো সৌরাষ্ট্রের মুদ্রাঙ্কিত অঙ্গুরীয়। সম্ভব!

পুস্তপাল মহাশয় মুষ্টির সান্নিধ্য হইতে নাসিকা দ্রুত অপসারিত করিয়া দেখিলেন তর্জনীতে সত্যই একটি মুদ্রাঙ্কিত অঙ্গুরী রহিয়াছে। তিনি বার কয়েক চক্ষু মিটিমিটি করিয়া বলিলেন—কিন্তু কিন্তু আপনি যদি সত্যিই আপনার সহচর ভৃত্য পরিজন কোথায়?

মকরবর্মা বলিলেন—বলছি না পরিজনদের পিছনে ফেলে আমি এগিয়ে আসছিলাম, তোমাদের জঙ্গলে একটা বাটপাড়—

কুন্তলরাজ বাধা দিয়া বলিলেন—দেখি অঙ্গুরীয়। সৌরাষ্ট্রের মুদ্রা আমি চিনতে পারব।

মকরবর্মা অঙ্গুরীয় খুলিয়া রাজার হাতে দিলেন। রাজা লক্ষ্য করিলেন, তর্জনীর মূলে অঙ্গুরীয় পরিধানের চক্রচিহ্ন রহিয়াছে। এ ব্যক্তি যে অঙ্গুরীয় কুড়াইয়া পাইয়া বা চুরি করিয়া সদ্য অঙ্গুরীয় পরিধান করিয়াছে তাহা নয়। রাজা তখন মুদ্রাঙ্কিত অঙ্গুরীয় উত্তমরূপে পরীক্ষা করিয়া শেষে উহা প্রত্যর্পণ করিলেন, অত্যন্ত উদ্বিগ্নভাবে গুল্ফের প্রান্ত টানিতে টানিতে অস্ফুট কণ্ঠে বলিলেন—মুদ্রা সৌরাষ্ট্রেরই বটে।

মকরবর্মা অঙ্গুরীয় পুনশ্চ পরিধান করিতে করিতে চারিদিকে বিজয়দীপ্ত চক্ষু ঘুরাইতে লাগিলেন। পুস্তপাল মহাশয়ের মুখ কাঁদো কাঁদো হইয়া উঠিল। মহামন্ত্রী মৃদু গলা ঝাড়া দিলেন—ইনি যদি সৌরাষ্ট্রের যুবরাজই হন, তাহলেও এখন তো আর

কুন্তলরাজ বলিলেন-কোনো উপায় নেই। সে-ব্যক্তি যেই হোক, অগ্নি সাক্ষী করে আমার কন্যাকে বিবাহ করেছে—

মহামন্ত্রী জুড়িয়া দিলেন—তাছাড়া রাজকুমারীর প্রতিজ্ঞা ছিল, চণ্ডাল হোক, পামর হোক, যে-কেউ তাঁর প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে—

সৌরাষ্ট্রকুমার বিস্ফোরকের ন্যায় ফাটিয়া পড়িলেন—ভস্ম হোক প্রশ্ন আর তার উত্তর! কুন্তলরাজ, আমি আপনার কন্যাকে বিবাহ করিতে চাই না। আমি চাই—বিচার। যে চোর আমার অশ্ব আর বস্ত্রাদি চুরি করেছে সে আপনার জামাতাই হোক, আর–

মহামন্ত্রী মোলায়েম সুরে অনুরোধ করিলেন—ধীরে কুমার, সংযম হারাবেন না।

মকরবর্মা আরও চড়া সুরে বলিলেন—আমি বিচার চাই। কুন্তলরাজ্যের সীমানার মধ্যে এই চুরি হয়েছে; তস্করকে শূলে দেওয়া হোক। আর, তা যদি না হয়, সৌরাষ্ট্র দেশ নির্বীর্য নয় এ কথা স্মরণ রাখবেন।

কুন্তলরাজ এই স্পর্ধিত উক্তি গলাধঃকরণ করিলেন; ক্রোধে তাঁহার মুখ রক্তবর্ণ হইলেও এই ব্যক্তি যে সত্যই রাজপুত্র সে প্রত্যয়ও দৃঢ় হইল। তিনি কণ্ঠ সংযত করিয়া বলিলেন—এ বিষয়ে পরিপূর্ণ অনুসন্ধান না করে কিছুই হতে পারে না। আপনার অভিযোগ যদি সত্য হয়— রাজা মহামন্ত্রীর পানে ফিরিলেন।

চতুর মহামন্ত্রী রাজার প্রতি একটি গোপন কটাক্ষপাত করিয়া পরম আপ্যায়নের ভঙ্গিতে মকরবর্মার দিকে ফিরিলেন—নিশ্চয় নিশ্চয়, সে কথা বলাই বাহুল্য। কিন্তু শ্ৰীমন, আপনি আজ রাত্রিটা রাজপ্রাসাদে বিশ্রাম করুন রাত্রির মধ্যযাম অতীত হয়েছে—

মহামন্ত্রী পুস্তপালের পেটে গোপনে কনুইয়ের এক গুঁতা মারিলেন। পুস্তপাল অমনি বলিয়া উঠিলেন–হাঁ হাঁ, কুমার-ভট্টারক, আর কালক্ষয় করবেন নাসারাদিন অভুক্ত আছেন—পরিশ্রমও কম হয়নি—আসুন, কুমার, এই দিকে—এই যে বিশ্রান্তিগৃহ

ক্লান্ত ক্ষুৎপিপাসাতুর যুবরাজের পক্ষে প্রলোভন প্রবল হইলেও তিনি সহজে নরম হইবার পাত্র নয়। তিনি বলিলেন—আমি বিচার চাই, ন্যায়দণ্ড চাই—নইলে—

মহামন্ত্রী তাড়াতাড়ি বলিলেন—অবশ্য—অবশ্য। সে তো আছেই। উপস্থিত আপনার বস্ত্রাদি ত্যাগ করা প্রয়োজন

পুস্তপাল সাগ্রহে বলিলেন—ওদিকে ময়ূর মাংস পিণ্ডীর মাহিষ-দধি, মাধ্বী দ্রাক্ষাসবসমস্তই প্রস্তুত রয়েছে। আসুন, আর বিলম্ব করবেন না—

মহামন্ত্রী বলিলেন—চলুন চলুন—অশুভস্য কালহরণ—

সৌরাষ্ট্রকুমার তথাপি বলিলেন—কিন্তু যদি প্রতিবিধান না পাই—

তিনি আর লোভ প্রতিরোধ করিতে পারিলেন না, মহামন্ত্রী ও পুস্তপালের সাদর আহ্বানের অনুবর্তী হইয়া বিশ্রান্তিগৃহের অভিমুখে চলিলেন। কুন্তলরাজ একাকী দাঁড়াইয়া উদ্বিগ্ন মুখে গুফের প্রান্ত টানিতে লাগিলেন।

 

ইত্যবসরে কালিদাস ও হৈমশ্রী শয়নকক্ষে উপনীত হইয়াছেন। সখী কিঙ্করীরাও বিদায় লইয়াছে। আড়ি পাতিয়া বরবধূকে বিরক্ত করিবার বিধি যদিচ সেকালেও ছিল, কিন্তু আজিকার দিনব্যাপী মাতামাতির পর সকলেই ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছিল। তাছাড়া আজ বসন্তোৎসবের রাত্রে নিজস্ব মিলনোৎকণ্ঠাও কম ছিল না।

নির্জন সুবৃহৎ শয়নকক্ষটি ফুলে ফুলে আচ্ছন্ন; যূথী ও মল্লী মিলিয়া পালঙ্কের শুভ্র আস্তরণ রচনা করিয়াছে। পালঙ্কের চারিকোণে দীপদণ্ডের মাথায় সুরভি বর্তিকা জ্বলিতেছে।

প্রাচীরগাত্রে হরপার্বতী রামজানকী প্রভৃতি আদর্শ দম্পতির মিথুন চিত্র। প্রাচীরের একটি অংশ বস্ত্র দ্বারা আবৃত, বস্ত্রের উপর রাজহংসের চিত্র অঙ্কিত রহিয়াছে; হংসের চঞ্চুতে সনাল পদ্মকোরক।

রাজকুমারী কালিদাসকে লইয়া যবনিকার সম্মুখে দাঁড়াইলেন, কালিদাসের দিকে মৃদু হাসিয়া যবনিকা সরাইয়া দিলেন। দেখা গেল, প্রাচীরগাত্রে একটি কুলঙ্গি রহিয়াছে; কুলঙ্গির থাকে থাকে অগণিত পুঁথি থরে থরে সাজানো।

কালিদাসের চক্ষু মুগ্ধ আনন্দে ভরিয়া উঠিল। পুঁথির প্রতি এই গ্রামীণ যুবকের অহেতুক আকর্ষণ ছিল; তিনি একবার রাজকুমারীর দিকে, একবার পুঁথিগুলির দিকে হর্ষোৎফুল্ল দৃষ্টিপাত করিতে লাগিলেন। তারপর সন্তর্পণে একখানি পুঁথি হস্তে তুলিয়া পরম স্নেহ ও শ্রদ্ধাভরে নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন।

পুঁথির মলপট্টের লিখন কালিদাস পড়িতে পারিলেন কিনা তিনিই জানেন; মলপট্টের উপর বিশদ অক্ষরে লেখা ছিল—

মৃচ্ছকটিকম্

কালিদাস গদ্‌গদ্‌ কণ্ঠে বলিলেন—কত পুঁথি! তুমি সব পড়েছ?

হৈমশ্রী গ্রীবা ঈষৎ হেলাইয়া সায় দিলেন। কালিদাসের মুখ একটু ম্লান হইল। তিনি হাতের পুঁথিটির প্রতি বিষণ্ণভাবে চাহিয়া সেটি আবার যথাস্থানে রাখিয়া দিলেন, নিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন—আমি একটিও পড়িনি। যদি পড়তে পারতাম, আজকের চাঁদ কিসের মত সুন্দর নিশ্চয় বলতে পারতাম।

আবার কুমারী হৈমশ্রীর মুখ শুকাইল। তিনি স্খলিতস্বরে বলিলেন—কিন্তু—না না, পরিহাস করবেন না আর্যপুত্র! আপনি সৌরাষ্ট্রের যুবরাজ—!

কালিদাসের মুখে কৌতুকের হাসি ফুটিল—কিন্তু আমি তো রাজপুত্তুর নই!

হৈমশ্রীর মাথায় আকাশ ভাঙ্গিয়া পড়িল—রাজপুত্র নয়! তবে-কে আপনি?

কালিদাস বলিলেন—আমি কালিদাস। বনের মধ্যে কাঠ কাটছিলাম, এমন সময়—

হৈমশ্ৰী বুদ্ধিভ্রষ্টের মত বলিলেন—কাঠ কাটছিলেন! কাঠুরে! তুমি তবে সত্যিই বর্ণপরিচয়হীন মূর্খ?

সরলভাবে কালিদাস ঘাড় নাড়িলেন—হ্যাঁ, আমি লেখাপড়া জানি না।—যখনই কোনো সুন্দর জিনিস দেখি, ইচ্ছে করে তার বাখান করি। কিন্তু পারি না।

রাজকন্যা আর শুনিলেন না; উর্ধ্বে মুখ তুলিয়া দুই চক্ষু সজোরে মুদিত করিয়া যেন একটা ভয়াবহ দুঃস্বপ্নকে মনশ্চক্ষুর সম্মুখ হইতে দূর করিবার চেষ্টা করিলেন। তারপর টলিতে টলিতে পালঙ্কের পাশে গিয়া নতজানু হইয়া শয্যার পুষ্পস্তরণের মধ্যে মুখ গুঁজিলেন। প্রবল হৃদয়োচ্ছ্বাসে তাঁহার দেহের ঊর্ধ্বাঙ্গ মথিত হইয়া উঠিল।

কালিদাস কিছুক্ষণ অবাক হইয়া চাহিয়া রহিলেন, তারপর সসংকোচ পদক্ষেপে রাজকন্যার পাশে গিয়া দাঁড়াইলেন।

রাজকন্যা জানিতে পারিলেন কালিদাস পাশে আসিয়া দাঁড়াইয়াছেন, তিনি মুখ তুলিয়া তীব্রস্বরে প্রশ্ন করিলেন—রাজপুত্র সেজে তুমি এখানে কি করে এলে?

হৈমশ্রীর স্ফুরিতাধর মুখ দেখিয়া কালিদাস শঙ্কা ভুলিয়া গেলেন। ক্রোধেও মুখখানি কী সুন্দর—ঠিক যেন—ঠিক যেন। তিনি ক্রোধ দেখিতে পাইলেন না, সৌন্দর্যই দেখিলেন। উপরন্তু ভারি মজার কাহিনীটা রাজকুমারীকে শুনাইতে হইবে। কালিদাসের মুখে হাসি ফুটিল, তিনি শয্যাপাশে বসিয়া সহাস্যে বলিলেন—সে ভারি মজার কথা। শুনবে? তবে বলি শোন–

তিনি বলিতে আরম্ভ করিলেন। আখ্যানবস্তু আমাদের প্রত্যক্ষদৃষ্ট, সুতরাং শুনিবার প্রয়োজন নাই।

<

Sharadindu Bandyopadhyay ।। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়