তৃতীয় পরিচ্ছেদ – চাতক ঠাকুরের দূরদর্শিতা

বেতসকুঞ্জে দণ্ডার্ধকাল বসিয়া থাকিয়া রঙ্গনা উঠিল। আবার কলসী কাঁখে নদীর পানে চলিল।

হেমন্তের মৌরী নদী নিজের খাতে ফিরিয়া আসিয়াছে। বেশি চওড়া নয়, কিন্তু স্রোতের টান আছে; অদূর পর্বতগুহা হইতে যে দুরন্ত চঞ্চলতা লইয়া বাহির হইয়াছিল তাহা এখনও শান্ত হয় নাই। স্ফটিকের ন্যায় স্বচ্ছ জল, তল পর্যন্ত সূর্যকিরণ প্রবেশ করিয়াছে; তলদেশে শুভ্র নুড়িগুলি ঝিমি করিতেছে। দুই দিকের উপলবিকীর্ণ তীরভূমি সমতল নয়; কোথাও প্রক্ষিপ্ত শিলাখণ্ড মাথা তুলিয়া আছে, কোথাও প্রবণ বেলাভূমি ক্রমাবনত হইয়া নদীতে মিশিয়াছে।

এইরূপ একটি বেলাভূমিতে বেতসগ্রামের স্নান-ঘাট। বাঁধানো ঘাট নয়, নুড়ি বিছানো স্বাভাবিক ঘাট। কিন্তু আজ ঘাটে কেহ নাই; এ সময় যাহারা ঘাটে আসিত তাহারা নৃত্যগীতে মত্ত।

রঙ্গনা আসিয়া কলস পূর্ণ করিয়া ঘাটে রাখিল, তারপর স্নান করিতে জলে নামিল। এক হাঁটু জলে দাঁড়াইয়া সে অন্যমনস্কভাবে চুলের বিননি খুলিতে আরম্ভ করিয়াছে এমন সময় পিছন হইতে আহ্বান আসিল— রাঙা মেয়ে! রাঙা মেয়ে!

চকিতে ঘাড় ফিরাইয়া রঙ্গনা দেখিল— দক্ষিণ দিক হইতে নদীর তীর ধরিয়া চাতক ঠাকুর আসিতেছেন। তাঁহার এক হাতে কয়েকটি সনাল পদ্ম, অন্য হাতে পদ্মপাতার একটি ঠোঙা।

চাতক ঠাকুরের বয়সের যদিও কেহ হিসাব রাখে না তথাপি তাঁহার দেহষ্টি এখনও অটুট ও কর্মক্ষম আছে। বেণুবংশের ন্যায় শীর্ণ দীর্ঘ আকৃতি, গাত্রবর্ণ শুষ্ক তালপত্রের ন্যায়। সুদূর অতীতে মাথায় ও মুখে হয়তো চুল ছিল, এখন একটিও নাই। তুণ্ড সম্পূর্ণ দন্তহীন। তবু কুঞ্চিত রেখাঙ্কিত মুখে একটি অনির্বচনীয় প্রশান্ত শ্ৰী আছে। অঙ্গে বস্ত্রাদির বাহুল্য নাই, কটিতটে কেবল একটি কষায়বর্ণ বস্ত্র জড়ানো; তাহাও হাঁটু পর্যন্ত। সেকালে স্ত্রীপুরুষ কাহারও কটিবাস হাঁটুর বেশি নীচে নামিত না; তবে মেয়েরা বসনাঞ্চল দিয়া ঊর্ধ্বাঙ্গ আবৃত করিত। আগুলফলম্বিত শাটী পরিধানের রীতি ছিল না।

রঙ্গনা চুলগুলি হাত-ফের দিয়া জড়াইতে জড়াইতে তীরের দিকে ফিরিল— ঠাকুর! কোথায় গিয়েছিলেন?

চাতক ঠাকুর রঙ্গনার সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইলেন, প্রসন্ন হাসিয়া বলিলেন— তোর জন্য কি এনেছি দ্যাখ। মৌরলা মাছ! বলিয়া পদ্মপাতার ঠোঙা খুলিয়া দেখাইলেন।

রঙ্গনার মুখেও হাসি ফুটিল। মৌরী নদীতে মাছ আছে; কিন্তু যে ধরে সেই খায়, বিতরণ করে না। রঙ্গনার ভাগ্যে মৌরলা মাছ বড় একটা জুটিয়া ওঠে না। অথচ তখনকার দিনে মোরল মচ্ছ সহযোগে ওগগরা ভত্তা অতি উপাদেয় ভোজন বিলাস বলিয়া পরিগণিত হইত। বহু শতাব্দী পরেও রসনা-রসিক কবিরা কদলী-পত্রে তপ্ত ভাত, গব্য ঘৃত, মৌরলা মাছ ও নালিতা শাকের গুণ বর্ণনায় পঞ্চমুখ হইতেন।

চাতক ঠাকুরের হাত হইতে ঠোঙা লইয়া রঙ্গনা কলসীর পাশে রাখিল, হাসিমুখে বলিল— মাছ আনতে গিয়েছিলেন?

চাতক ঠাকুর বলিলেন— মাছ আনতে যাই নি। ভোরবেলা উঠে ভাবলাম, আজ পর্বদিন, ঠাকুরদের পায়ে পদ্মফুল দেব, যাই দক্ষিণের বিল থেকে পদ্মফুল তুলে আনি। তিন কোশ বৈ তো নয়। গিয়ে দেখি জলগাঁয়ের জেলেরা মাছ ধরছে। তারাই পদ্মফুল তুলে দিলে, আর চারটি মৌরলা মাছও দিলে। তা ভাবলাম, নিয়ে যাই, রাঙা মেয়ে খাবে।

অদ্ভুত মানুষ এই দেবস্থানের পূজারী; ছয় ক্রোশ পথ হাঁটিয়া এক হাতে দেবতার ফুল অন্য হাতে মৌরলা মাছ লইয়া ফিরিয়াছেন।

চাতক ঠাকুর যে সহজ সাধারণ মানুষ নয়, সত্যই একজন অদ্ভুত মানুষ, তাহা শুধু বেতসগ্রামের লোক নয়— দক্ষিণের আরও পাঁচখানা গ্রামের লোক জানিত। উপরন্তু মাঝে মাঝে তাঁহার উপর দেবতার ভর হইত; তখন তিনি দেবাবিষ্ট হইয়া অতি আশ্চর্য বস্তু প্রত্যক্ষ করিতেন। এই প্রত্যক্ষ দর্শনের কাহিনী শুনিয়া গ্রামবাসীরা অবাক হইয়া যাইত। প্রবীণ ব্যক্তিরা বলিত, ঠাকুরের বায়ু-রোগ আছে, থাকিয়া থাকিয়া বায়ু কুপিত হয়।

ঠাকুরের বায়ু কুপিত হওয়ার কথা রঙ্গনা মায়ের মুখে শুনিয়াছিল কিন্তু কখনও চোখে দেখে নাই। আজ আকস্মিকভাবে তাহা প্রত্যক্ষ করিবার সুযোগ পাইয়া গেল।

চাতক ঠাকুর প্রস্থানোদ্যত হইয়া বলিলেন, যাই, দেবস্থানে ফুল চড়াই গিয়ে। –মৌরলা মাছের কী রাঁধবি?

রঙ্গনা জানিত মাছের প্রতি ঠাকুরের লোভ নাই, তিনি নিরামিষাশী। সে সলজ্জ কণ্ঠে বলিল— মা যা বলবে তাই রাঁধব।

টক্‌ রাঁধিস্। বলিয়া রঙ্গনার প্রতি সস্নেহে স্মিতদৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া তিনি পা বাড়াইয়াছেন এমন সময় একটি ব্যাপার ঘটিল। একটা সোনাপোকা কোথা হইতে উড়িয়া আসিয়া রঙ্গনার সীমন্তের উপর বসিল; কালো চুলের মাঝখানে সোনাপোকাটা জ্বলজ্বল করিয়া উঠিল। রঙ্গনা জানিতে পারিল না, কিন্তু চাতক ঠাকুর স্থিরদৃষ্টিতে সেইদিকে চাহিয়া রহিলেন। তাঁহার মুখের হাসি ধীরে ধীরে মিলাইয়া গেল, তিনি স্বপ্নবিষ্ট কণ্ঠে কহিলেন— তোর সিঁথেয় সিঁদুর কেন রে, রাঙা মেয়ে?

সিঁদুর! রঙ্গনা চমকিয়া চুলের উপর হাত রাখিতে গেল, অমনি সোনাপোকা ভোঁ করিয়া উড়িয়া গেল। রঙ্গনা উড্ডীয়মান পতঙ্গটাকে উজ্জ্বল চক্ষে লক্ষ্য করিয়া হসিয়া উঠিল— সোনাপোকা!

চাতক ঠাকুর কথা না বলিয়া চাহিয়া রহিলেন, তারপর ধীরে ধীরে একটি প্রস্তরপট্টের উপর বসিয়া পড়িলেন, তাঁহার হস্তপদের স্নায়ুপেশী ক্রমশ কঠিন হইয়া উঠিতে লাগিল। কাচের ন্যায় নিষ্পলক চক্ষু যেন কোন্ সুদূর মরীচিকার দৃশ্য দেখিতেছে এমনিভাবে শূন্যে বিস্ফারিত হইয়া রহিল।

রঙ্গনা চাতক ঠাকুরের এই দেবাবেশ দেখিয়া প্রথমে ভয় পাইল; তারপর সতর্কভাবে তাঁহার দিকে চাহিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। সে জানিত এ সময়ে কথা কহিতে নাই, ঠাকুরকে জাগাইবার চেষ্টা করাও বিপজ্জনক।

চাতক ঠাকুর যতক্ষণ অদৃশ্য লোকের স্বপ্ন দেখিতেছেন এই অবকাশে আমরা তাঁহার অতীত সম্বন্ধে দু একটা কথা বলিয়া লই।

অনুমান ষাট বছর আগে, গ্রামের বর্তমান বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা যখন বালক বালিকা ছিল, তখন একদিন চাতক ঠাকুর কোথা হইতে বেতসগ্রামে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছিলেন। তাঁহার দুই বগলে দুইটি প্রস্তরমূর্তি। ঠাকুরের চেহারা একটু ক্ষেপাটে গোছের, কিন্তু সাত্ত্বিক প্রকৃতি বলিয়া মনে হয়।

বেতসগ্রাম চিরদিন অতিথি বৎসল; গ্রামের তাকালিক প্রবীণ ব্যক্তিরা চাতক ঠাকুরকে সাদরে গ্রহণ করিয়াছিলেন। তিনি তৎকালে নিজের কি পরিচয় দিয়াছিলেন, কোথা হইতে আসিতেছেন, কোন বর্ণ, কী গোত্র— এ সকল কথা এখন আর কাহারও স্মরণ নাই। তাঁহার বয়সের কথা কেহ জিজ্ঞাসা করে নাই; চেহারা দেখিয়া মনে হইয়াছিল মধ্যবয়স্ক।

যা হোক, চাতক ঠাকুর গ্রামে রহিয়া গেলেন। দেবস্থানের অশ্বত্থ বৃক্ষতলে তখন কেবল একটি ধ্বজা প্রোথিত থাকিত, ওই ধ্বজার মূলেই গ্রামের ভক্তিশ্রদ্ধা নিবেদিত হইত। চাতক ঠাকুর তাঁহার আনীত মূর্তি দুটি ধ্বজার দুই পাশে বসাইয়া পূজা আরম্ভ করিয়া দিলেন। মূর্তি দুটির একটি বুদ্ধমূর্তি এবং অন্যটি বিষ্ণু বিগ্রহ—সেজন্য কাহারও আপত্তি হইল না। বরং একসঙ্গে এক জোড়া দেবতা পাইয়া গ্রামবাসীরা উৎফুল্ল হইল। সে সময় উপাস্য দেবতা লইয়া বেশি বাছ-বিচার ছিল না; পূজার পাত্র যা-হোক একটা থাকিলেই হইল। অধিকন্তু ন দোষায়। যাহার যেটা ইচ্ছা পূজা করিবে।

তারপর বছরের পর বছর কাটিয়া গিয়াছে; চাতক ঠাকুরের আগমন কালে যাহারা বয়স্ক ছিল তাহারা মরিয়া গিয়াছে; আরও দুই পুরুষ কাটিয়াছে। চাতক ঠাকুরের কিন্তু ক্ষয়ব্যয় নাই, তিনি তাঁহার শিলা-বিগ্রহের মতই অবিনশ্বররূপে বিরাজ করিতেছেন। গ্রামবাসীরা মাঝে মাঝে তাঁহার বয়স সম্বন্ধে জল্পনা করে। কেহ বলে তাঁহার বয়স আশী; কেহ বলে শটকে পুরিয়া গিয়াছে। ঠাকুরকে জিজ্ঞাসা করিলে তিনি হাসেন, উত্তর দেন না; নিজের বয়স কত তাহা তিনি নিজেই জানেন কিনা সন্দেহ। বস্তুত নিজের সম্বন্ধে তাঁহার মন সম্পূর্ণ উদাসীন। তিনি তিন পুরুষ ধরিয়া গ্রামের প্রত্যেকটি মানুষের সুখ-দুঃখের সহিত ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত; রোগে এমন সেবা করিতে আর দ্বিতীয় নাই। দুই চারিটি শিকড়-বাকড় মুষ্টিযোগও জানেন এবং প্রয়োজন হইলে প্রয়োগ করেন। কিন্তু নিজের সম্বন্ধে কোনও ভাবনা-চিন্তা নাই। দেবস্থানের পূজা, দিনান্তে দুটি তণ্ডুল এবং হাসিমুখে নির্লিপ্তচিত্তে গ্রামবাসীদের সকল কাজে সাহচর্য—ইহাই তাঁহার জীবন।

গ্রামবাসীরা সস্নেহে বলে—আমাদের পাগলা ঠাকুর। মাঝে মাঝে বায়ু কুপিত হয় বটে কিন্তু এমন আপনভোলা মানুষ হয় না।

বায়ু-রোগই হোক আর দেবাবেশই হোক, মৌরীর ঘাটে প্রায় একদণ্ড কাল হচেতন অবস্থায় বসিয়া থাকিবার পর চাতক ঠাকুরের সংজ্ঞা ফিরিয়া আসিল; তাঁহার চোখের দৃষ্টি আবার সহজ হইল। রঙ্গনা এতক্ষণ দুই চক্ষে উৎকণ্ঠা ভরিয়া দাঁড়াইয়া ছিল, তিনি তাহার দিকে হাত বাড়াইয়া ক্ষীণ হাসিলেন। রঙ্গনা তাড়াতাড়ি আসিয়া তাঁহাকে ধরিয়া তুলিল। চাতক ঠাকুর স্খলিতপদে গিয়া নদীর জলে মুখ প্রক্ষালন করিলেন, মাথায় জল দিলেন। তারপর আবার শিলাপট্টে আসিয়া বসিলেন। এই একদণ্ড সময়ের মধ্যে তাঁহার শারীরিক শক্তি যেন সমস্ত নিঃশেষ হইয়া গিয়াছিল।

রঙ্গনা তাঁহার পাশে বসিয়া সংহত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিল— ঠাকুর! কী হয়েছিল?

চাতক ঠাকুর ক্ষণেক চুপ করিয়া রহিলেন, তারপর আস্তে আস্তে বলিলেন— তোর চুলে সোনাপোকা বসেছিল; আমার মনে হল সিঁদুর ডগড়গ করছে। সেইদিকে চেয়ে রইলাম। তারপর দেখতে দেখতে সব হাওয়ায় মিলিয়ে গেল, নদী ঘাট কিছু রইল না। তার বদলে দেখলাম—দেখলাম—

কী দেখলেন? দেখলাম যুদ্ধ হচ্ছে হাজার হাজার লোক অস্ত্র নিয়ে মারামারি কাটাকাটি করছে। আহত মানুষের কাতরানি, হাতি-ঘোড়ার ছুটোছুটি—আকাশে ঝাঁকে ঝাঁকে তীর উড়ছে, গঙ্গম্ শব্দে রণভেরী বাজছে—ভয়ঙ্কর যুদ্ধ

রঙ্গনা চাতক ঠাকুরের মুখে রামায়ণ মহাভারতের কাহিনী শুনিয়াছে, যুদ্ধ তাহার অপরিচিত নয়। সে বলিল—কোথায় যুদ্ধ হচ্ছে?

চাতক ঠাকুর বলিলেন,—তা জানি না। ঐ দিকে উত্তর দিকে। দুই পাশে পাহাড়, একদিকে প্রকাণ্ড নদী, আর একদিকে জঙ্গল; তার মাঝখানে যুদ্ধ হচ্ছে।

তারপর?

অনেকক্ষণ যুদ্ধ চলল। দক্ষিণ দিকের দল হটে যেতে লাগল। দেখলাম, একজন অশ্বারোহী উল্কার বেগে বেরিয়ে এল— ঘোড়া ছুটিয়ে এই দিকে পালিয়ে আসতে লাগল। সাদা ঘোড়ার পিঠে প্রকাণ্ড-শরীর আরোহী, তার কপালে তলোয়ারের কাটা দাগ, রক্ত ঝরছে। সাদা ঘোড়া

আর আরোহী জঙ্গলের মধ্যে মিলিয়ে গেল।

আর কি দেখলেন?

ক্রমে যুদ্ধ ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। দক্ষিণের দল পালাতে লাগল, বিজয়ী দল তাদের তাড়া করল। দেখতে দেখতে রণস্থল শূন্য হয়ে গেল, কেবল মরা মানুষ হাতি ঘোড়া পড়ে রইল।

আর কিছু দেখলেন না?

চাতক ঠাকুর চকিত হইয়া একবার আকাশের উত্তর-পশ্চিম কোণে দৃষ্টিপাত করিলেন, তারপর উদ্বিগ্ন স্বরে বলিলেন— আর একটা অদ্ভুত জিনিস দেখলাম। শূন্য যুদ্ধক্ষেত্র থেকে আকাশের পানে চোখ তুলে দেখি, উত্তর-পশ্চিম কোণ থেকে প্রকাণ্ড একটা মেঘ ছুটে আসছে, কালবোশেখীর কালো মেঘ। মেঘ যখন আরও কাছে এল তখন দেখলাম, মেঘ নয়—ধুলোর ঝড়। যেন ঐদিকের কোনও মরুভূমিতে ঝড় উঠেছে, তাই ধুলোবালি উড়ে আসছে। চক্ষের নিমেষে আকাশ বাতাস ছেয়ে গেল, সূর্যের আলো নিভে গেল। আর কিছু দেখতে পেলাম না; অন্ধকারে অন্ধের মত বসে রইলাম। তারপর আস্তে আস্তে চোখের সহজ দৃষ্টি ফিরে এল।

শুনিতে শুনিতে রঙ্গনার চক্ষু-তারকা বিস্ফারিত হইয়াছিল, সে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করিল—এর মানে কি ঠাকুর?

চাতক ঠাকুর বলিলেন— তা জানি না, রাঙা মেয়ে। কিন্তু মনে হয় বড় দুর্দিন আসছে। ঐ যে মরুভূমিতে ঝড় উঠেছে, এ ঝড়ের ঝাপটা আমাদের গায়েও লাগবে, আমাদের ঘরের মক্কাও উড়ে যাবে। কিছুক্ষণ নতমুখে নীরব থাকিয়া তিনি উদ্বিগ্ন চক্ষু তুলিয়া রঙ্গনার পানে চাহিলেন— কিন্তু তোর সিঁথেয় সিঁদুর দেখলাম কেন রে রাঙা মেয়ে? তোর কি তবে বিয়ের ফুল ফুটেছে! কোথা থেকে বর আসবে? কোন তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে রাজপুত্তুর আসবে? বলিয়া তিনি স্নেহকম্পিত করাঙ্গুলি দিয়া রঙ্গনার চিবুক তুলিয়া ধরিলেন।

সলজ্জে ঘাড় ফিরাইয়া রঙ্গনা দেখিল, তাহার মা কখন অলক্ষিতে কাছে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে। সে লজ্জায় আরও রক্তবর্ণ হইয়া উঠিয়া দাঁড়াইল।

গোপা বলিল— তোর দেরি হচ্ছে দেখে এলাম। তুই এখন ঘরে যা। আমি ঠাকুরের সঙ্গে দুটো কথা বলব।

রঙ্গনা কলসী আর মৌরলা মাছের ঠোঙা লইয়া চলিয়া গেল। গোপা তখন প্রস্তরপট্টের উপর বসিয়া বলিল— ঠাকুর, কি কথা বলছিলেন রাঙাকে, আমায় বলুন। ওর কি বিয়ের ফুল ফুটেছে? কবে কোথায় কার সঙ্গে বিয়ে হবে, কিছুই ভেবে পাচ্ছি না। আপনি কী জানতে পেরেছেন বলুন।

চাতক ঠাকুর তখন দিব্য চক্ষে যাহা দেখিয়াছিলেন তাহার আদ্যোপান্ত বিবরণ গোপাকে শুনাইলেন। শেষে বলিলেন–রাঙা মেয়ের চুলে সোনাপোকা বসেছিল, ঠিক সিঁদুরের মত। দেখাচ্ছিল; তাই ভাবছি ওর বুঝি সিঁদুর পরবার সময় হয়েছে— দেবতারা তাই ইশারায় জানিয়ে দিলেন।

গোপা ব্যাকুল হইয়া বলিল— কিন্তু কি করে হবে ঠাকুর? গ্রামের কোনও ছেলে কি? কিন্তু তাই বা কি করে হবে? মোড়লদের ভয়ে গাঁয়ের ছেলেরা যে ওর পানে চোখ তুলে তাকায় না। নইলে আমার রাঙার মত মেয়ে—

চাতক ঠাকুর ভাবিতে ভাবিতে বলিলেন— গাঁয়ের কেউ নয়। এ যে সোনাপোকা, গোপা-বৌ। সারা গায়ে সোনা জড়ানো। কোথা থেকে রাজপুত্তুর আসছে কে জানে? মহাভারতের গল্প শুনেছ তো! শকুন্তলা বনের মধ্যে মুনির আশ্রমে থাকত; কোথা থেকে হঠাৎ এলেন রাজা দুষ্মন্ত মৃগয়া করতে। রাঙা মেয়েরও তেমনি দুষ্মন্ত আসবে। তুমি ভেবো না।

গোপা চাতক ঠাকুরের পায়ের উপর নত হইয়া ঝরঝর করিয়া কাঁদিয়া ফেলিল— ঠাকুর, আপনার মুখে ফুলচন্দন পড়ক।

<

Sharadindu Bandyopadhyay ।। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়